Monday, 14 July 2014

একটু খোলা হাওয়ার জন্যে

মীজান রহমান
                                
 সোফার একপাশে আমি। আরেকপাশে আমর আব্দাল্লা। সামনে কিচেন থেকে চেয়ার টেনে এনে বসা তার স্ত্রী, রিপি। ওরা ওয়াশিংটন থেকে অটোয়াতে এসেছে আমার সঙ্গে দুটো দিন কাটাবে বলে। আমর গল্প করছিল। দেশবিদেশের গল্প, তার নিত্য ভ্রাম্যমান জীবনের নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প। তার মাঝে দুটি গল্প আমার মনে গেঁথে আছে। একটি রোয়াণ্ডার, আরেকটি আমাদের পোড়াদেশ বাংলাদেশের। প্রথমে রোয়াণ্ডার ঘটনাটি বলা যাক।
 রোয়াণ্ডার গল্প অবশ্য সবারই জানা। পৃথিবীশুদ্ধ লোক সেটা গড়গড় করে বলে দিতে পারবেকিন্তু সে গল্পটা ছিল মৃত্যু আর হত্যার গল্প, মানুষের পশু হয়ে যাওয়ার বীভৎস গল্প। তাদের আরেকটা গল্প আছে, বেঁচে থাকার গল্প, বেঁচে থাকার যে একটা দুর্বহ সংগ্রাম আছে তার গল্প। দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখের গল্প। আমরের কাছ থেকে আমরা তারই একটা খণ্ডচিত্র পেলাম সেদিন।
 রোয়াণ্ডার সমাজ প্রধানত দুভাগে বিভক্ত। হুটু ও টুটসি। না, এরা দুটি আলাদা গোত্র নয়, আলাদা শ্রেনীমাত্র। অনেকটা হিন্দু ভারতের মত। হুটুরা মূলত কৃষক শ্রেনীর মানুষ, আর টুটসিরা ঐতিহাসিকভাবে জমিদার শ্রেণী। এক শ্রেণী জমির মালিক, আরেক শ্রেণী জমির শ্রমিক। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তির আগমন সেই শ্রেণীবিভাগের সুঠাম সমীকরণটিকে আগাগোড়া ওলটপালট করে দেয়। স্থানীয় জমিদাররা আর জমির মালিক থাকে না তখন, তারা হয়ে যায় গৃহপালিত পশুর পালক ও ব্যবসায়ী। আর হুটুরা যে তিমিরে ছিল আগে সেই তিমিরেই থেকে যায়। কিন্তু রোয়াণ্ডাতে আরো একটা শ্রেণী ছিল যাদের কথা বাইরের পৃথিবীতে প্রায় কারুরই জানা নয়।তারা এখনো আছে, এবং ঠিক সেই অবস্থাতেইতাদের নাম বাটোয়া। সমাজের সবচেয়ে নিচুস্তরে তাদের অবস্থান---এতই নিচু যে তাদের কোনও শ্রেণীভুক্ত বলেই গণ্য করা হয়না। ঠিক ভারতের দালিত জাতির মত, যারা আর্যনির্মিত ব্রাহ্মন-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্র চারশ্রেণীর কোনটাতেই পড়ে না। তারা সত্যিকার অর্থেই অচ্ছুত, আনটাচেবুল। রোয়াণ্ডার বাটোয়াদের জমিজমা করারও অধিকার নেই। তারা রোয়াণ্ডার অস্পৃশ্য জাতি।
 এই হতভাগা বাটোয়াদেরই একটা গল্প বলছিল আমর। সেখানে অক্সফামের একটা কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প ছিল, যার মাধ্যমে কৃষকদের ফসল উৎপাদনের একটা বড় সহায়তার কাজ চলছিল। সমস্যা ছিল যে এতে করে বাটোয়াদের কোনও উপকারই হচ্ছিল না। যার জমি নেই তার জমিতে ফসল হোক বা হোক তাতে কার কি। অক্সফামের কর্মকর্তাদের সেটা জানা ছিল। এবং তাঁরা পথ খুঁজছিলেন কিভাবে এর একটা সমাধান বের করা যায়। সেই পথ খুঁজতে গিয়েই আমরকে পাওয়া। ও মূলত শিক্ষক। মিশরে তার জন্মবৃদ্ধি, লেখাপড়া সব। প্রথমে সমাজবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, তারপর আইন পাশ করে কায়রোর ফৌজদারি আদালতে ওকালতির কাজে নিযুক্ত হওয়া। ওর কাছে যা শুনলামঃ তার ওকালতি জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হল আনোয়ার সাদেকের হত্যাকারিদের বিচারের সময় সরকারি পক্ষের কৌঁশুলী হিসেবে কাজ করা। কিন্তু সে ওকালতিতে সারাজীবন কাটাবে এরকম কোনও উচ্চাকাংখা ছিল না। উচ্চাকাংখা ছিল আমেরিকায় যাবে, উচ্চশিক্ষা নেবে, তারপর জীবন কাটাবে শিক্ষকতায়। এভাবেই আমর প্রথমে ঘর বাঁধে ওয়াশিংটিনে, ইউনিভার্সিটি অফ পীসের অধ্যাপক হিসেবে। “শান্তির বিশ্ববিদ্যালয়”----নামটি আমারও খুব পরিচিত নয়, সারাজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও। এটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জাতিপুঞ্জের’ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যদিও আর্থিক সহায়তাতারা পায় প্রধানত বেসরকারি অনুদানের মারফতে। তাদের শুধু গতানুগতিক পাঠক্রম আছে তাই নয়, প্রায়সই তাদের অভিজ্ঞ অধ্যাপকদের পাঠানো হয় দেশবিদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শ বা সরাসরি সহায়তা দিয়ে কাজটা যথাসম্ভব এগিয়ে দিতে। সেভাবেই আমর আব্দাল্লার আবির্ভাব রোয়াণ্ডার হতভাগ্য বাটোয়াদ্রর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার দায়িত্ব নিয়ে
 বাটোয়াপাড়াতে গিয়ে আমরের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটি ছিলঃ বিস্ময়। আতঙ্ক। মানুষ এভাবে বেঁচে থাকতে পারে? এরা কি রক্তমাংসের মানুষ, না, কেবল কতগুলো হাড় আর দোলানো-মোচড়ানো চামড়ার সমষ্টি? এরা, ছোটবেলার খেলার বয়স থেকে বড় হয়ে ওঠা, তারপর সংসারধর্ম পালন শেষ হয়ে গেলে আস্তে আস্তে বার্ধক্যে পৌঁছানোর যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাতে মোটেও অভ্যস্ত নয়। এদের জীবন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ অবহেলা আর অনাদরের জীবন। এদের সঙ্গে আমাদের উপমহাদেশের অন্য কোন জাতির তুলনা করব বুঝতে পারছিনা। আমরের বর্ণনা শুনে বিহারের সরকারি পায়খানার মেথরদের ওপর একটা ছবি দেখেছিলাম অনেক আগে, তার কথা মনে পড়ল। ঢাকার মেথরপট্টিতেও এমন চলমান কঙ্কাল দেখেছি আমি। পৃথিবীর সব ‘উন্নয়নশীল’ দেশেই বোধ হয় এমন দৃশ্য দেখা যাবে নগরে বন্দরে।
 বাটোয়াদের কাছে আন্তর্জাতিক সাহায্য পৌঁছানোর একটা বিকল্প পন্থা বের করে নেন অক্সফামের কর্মকর্তারা। তারা চাষাবাদ করে জীবিকা অর্জনের অধিকার পাবে না, ঠিক আছে, তাহলে যাদের আছে, অর্থাৎ হুটুরা, তাদের কাছ থেকে উৎপন্ন ফসল কিনে বটোয়াদের হাতে তুলে দেওয়া যায়, যা তারা হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করে কিছু নগদ পয়সা রোজগার করতে পারবে। তারপর সে বাজার থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরতে পারবে। আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ালো অন্যখনে। ফসলগুলো তাদের হাতে পৌঁছালো ঠিকই, কিন্তু বাজারে যেতে পারল না। তার আগেই সব উধাও। মানে একেবারে গায়েব। আরে, এত এত গমভূট্টা, বাজরা সবজি, এগুলো গেল কোথায়? আমর গেল তদন্ত করতে। ভাই তোমাদের এত ফলফসল দেওয়া হল বিক্রি করে নগদ টাকা বানানোর জন্যে, সেগুলো তোমরা কি করলে? জানতে চাইল আমর। তখন এক বৃদ্ধ, শীতল শুকনো চোখদুটো তার প্রাচীন গুহার গাঢ় অন্ধকার থেকে বের হয়ে এসে বললঃ আমরা খেয়ে ফেলেছি সব। সেকি? কেন? আমর জিজ্ঞেস করে। তখন বুড়ো একটু হাসবার চেষ্টা করে বললঃ সাহেব। এর নাম ক্ষুধা। ক্ষুধা যে বড় কামড়ায়।
 “ক্ষুধা কামড়ায়”----দুটি শব্দ যেন মহাকালের কৃষ্ণবিবর থেকে নির্গত হয়ে আমরের চেতনাকে আড়ষ্ট করে ফেলল। সে নির্জীব হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। এক্ষুধা তো সময়ের ক্ষুধা নয়, সকালবেলার ক্ষুধা সন্ধ্যাবেলা চুকানোর ক্ষুধা নয়। এক্ষুধা হাজার বছরের বিরামহীন ক্ষুধা। এ ক্ষুধার কথা আমরের বোঝার কথা নয়, আমার আর রিপির বোঝার কথা নয়, এ-ক্ষুধা কেবল ক্ষুধার্তেরই বোঝার বস্তু। এ-ক্ষুধার অধিকার কেবল চিরলাঞ্ছিত আর চিরবঞ্চিতদের।
 আমরের দ্বিতীয় গল্পটিও বলতে গেলে ক্ষুধারই গল্প। তবে পেটের ক্ষুধা নয়, ভিন্নরকমের ক্ষুধা। এ-ক্ষুধা কামড় দেয় না পেটের তন্ত্রীতে, তবে ইতিহাসের কন্দর থেকে পুঞ্জীভূত বেদনার দীর্ঘশ্বাস তুলে নিয়ে আসে। এ-ক্ষুধার জ্বালা ক্ষুধিতদেরও বোধগম্য নয় অনেক সময়। এ-গল্পটি বাংলাদেশ থেকে কুড়িয়ে আনা। বিশ্বশান্তির কাজ নিয়ে আমরকে বেশ কবারই যেতে হয়েছিল সেখানে। একবার তার সুযোগ হয় চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত এলাকার একটি মাদ্রাসাতে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার। সমস্যা ছিল এই যে মাদ্রাসাটি ছিল মেয়েদের। প্রধান শিক্ষক থেকে ছাত্রীদের সকলেই আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা----শুধু ছোট একটি জালের মত, জেলখানার খুনি আসামীর কয়েদখানার খুপরির মত, চোখের ওপর একটুখানি ফাঁক। যা দিয়ে তারা পৃথিবীর খণ্ডিত অংশের একটা ধারণা পেতে পারে বটে, কিন্তু তাদের মুখাবয়বের রহস্য বাইরের জগতে কারুরই জানার সাধ্য থাকে না। এই অবরোধবাসী কিছু নারীর সাথেই কিছুটা সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয় আন্তর্জাতিক শান্তির বার্তাবাহী মিশরীয় পুরুষ আমর আব্দাল্লার। আমরের লক্ষ্য ছিল ওদের সঙ্গে যথাসম্ভব খোলাখুলি আলাপ আলোচনা করে তাঁদের সুখদুঃখের কথা শোনা তাঁদেরই মুখে। শেষে ওর শান্তিকর্মীরা তাঁদের জন্যে কি করতে পারে, কি করলে তাঁদের উপকার হয়, তাঁদের মাদ্রাসা জীবনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আসে, জানার জন্যে। বেশি নয়, মুষ্টিমেয় কজন শিক্ষক তার সামনে, প্রধান শিক্ষকসহ। ওর প্রশ্নের উত্তরে ওঁরা কি বলেছেন অনুমান করতে পারেন? আমর আমার দিকে তাকায়ঃ আমার কি ধারণা জানার জন্যে। ঠিক এমনি করে নাকি সে তার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের দিকেও তাকায়ঃ ওরা কি বলে, কার কি অনুমান। এখানেই আমরের বৈশিষ্ট্য, শিক্ষক হিসেবে। শ্রোতাদের সাথে করে সে একটা রহস্যময় জায়গাতে নিয়ে যেতে পারে, কৌতূহলটাকে একটা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারে। আমি ওর প্রশ্ন শুনে কিঞ্চিৎ থতমত খেয়ে ইষৎ অনিশ্চিতভাবে জবাব দিইঃ ভালো একটা লাইব্রেরি? বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা? মেয়েদের যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা? তাইতো, আর কি হতে পারে? মনে মনে ভাবি আমি, আস্ত মূর্খেরা যেমন করে ভাবে। আমার জবাব পেয়ে আমর নিশ্চয়ই মিটিমিটি হাসছিল নিজের মনে, নেহাৎ মুরুব্বীর প্রতি সম্মানবশতঃ সামনাসামনি তা প্রকাশ করেনি। বুঝতে পারছিলাম যে আমরের প্রশ্নের উত্তরে মেয়েগুলো এমন তালিকা দিয়েছিলেন যা সে কল্পনাও করতে পারেনি। সেই কল্পনা-করতে-না-পারা দুনিয়াছাড়া প্রশ্ন গ্রাম্য মহিলা মাদ্রাসার হতদরিদ্র একদল নারীর কাছ থেকে আসবে সেটা একেবারেই অকল্পনীয়। দুটি আরজ তাঁদেরঃ এক, মাদ্রাসার ভেতরেই যদি মেয়েদের জন্যে একটা বাস্কেটবল খেলার কোর্ট তৈরি করে দিতেন কেউ তাহলে বড় উপকার হত! দুই, কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারলে মেয়েরা কোরাণ-হাদিসের ফাঁকে একটু বাদ্যবাজনা করেও মন ভরাতে পারত!
 দুটির কোনটিই যে পাঠকের অনুমানের সাথে মেলেনি সেটা প্রায় হলপ করেই বলে দেয়া যায়। বোরখাপরা মাদ্রাসার মেয়েদের কাছ থেকে এরকম অদ্ভুত আবদার কারুরই কল্পনায় আসার কথা নয়। আমর নিজেও হতবম্ভ----একেবারেই আশা করেনি এটা।
 গল্পটা অসম্ভব ভালো লাগল আমার। তার নাটকীয় সমাপ্তিটুকুর জন্যে হয়ত কিছুটা, কিন্তু পুরোটা নয়। আসল কারণটি হল এই আপাতসরল কাহিনীটির ভেতর যে কত যুগযুগান্তের অসমাপ্ত কাহিনী লুকিয়ে আছে, কত যে গভীর আর্তনাদ, তারই খানিকটা আভাস পেলাম এতে। এটি একাধারে নিরেট, কঠিন বাস্তব গল্প জীবনের, অন্যদিকে পৃথিবীর সকল অবগুন্ঠিত নারীর সম্মিলিত মুক্তির কামনা। এগল্পের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়ানো একটি নগ্ন বাস্তবতা, এবং একটি প্রায়-দুর্বোধ্য প্রতীক।
 আমরের মাদ্রাসার গল্প শোনার পর মনে পড়ল অনেকদিন আগেকার দেখা অনুরূপ কিছু দৃশ্যের কথা। তারেক মাসুদের অসাধারণ সৃষ্টিঃ “মাটির ময়না” ছবিটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমারঘটনা সব মনে নেই ভালো, কিন্তু দুটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ দৃশ্য আমার স্পষ্ট মনে আছে। একেবারে আঁট করে গাঁথা মনের ভেতর----কখনোই ভুলবার নয়। পাঠক যারা দেখেছেন ছবিটা নিশ্চয়ই মনে রাখবেন যে ওটাও ছিল মাদ্রাসার গল্প----ছেলেদের মাদ্রাসা। ছেলেদের মাদ্রাসার ভেতরের খবরাদি তারেক মাসুদের খুব ভালো করেই জানবার কথা, কারণ তিনি নিজেই ছিলেন ছোটবেলা থেকে কৈশোরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাদ্রাসার ছাত্র। পুরো আট বছর। মূল গল্পটি গ্রামবাংলার একটি অতি-রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের চারজন সদস্য, তাদের মাদ্রাসায়-পড়া ছেলে অনু, তার বড় বোন, মা ও বাবা কাজী সাহেব, তাঁদের টানাপোড়েনের জীবন, এবং সেই জীবনের ওপর গভীর ছায়া ফেলে-রাখা পার্শ্ববর্তী মাদ্রাসার নানা বিচিত্র দৃশ্যমালাকে কেন্দ্র করে। কাজীসাহেব মসজিদের ইমামতি করে যেদুটি পয়সা উপার্জন করেন তাতেই কোনমতে সংসার চালাতে হয় তাঁর গৃহবন্দী স্ত্রীকে। এই ‘গৃহবন্দী’কে ঘিরে একটা দৃশ্য তৈরি করেন তারেক মাসুদ যা অনবদ্য মনে হয় আমার কাছে। বাড়িতে একটিমাত্র ঘর, যাতে গোঁজাগুঁজি করে সবাইকে ঘুমুতে হয়। এবং তাতে একটিমাত্র জানালা। এই জানালাটিকে তারেক মাসুদ ব্যবহার করেন একটি অসাধারণ প্রতীক হিসেবে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরুবার সময় স্বামী কাজী শক্ত করে বন্ধ করে যান জানালাটিকে। উনি চলে যাওয়ার পর এদিক-ও্দিক তাকিয়ে স্ত্রী সেটিকে পুরোপুরি খুলে দেন। একই দৃশ্যের অবতারণা হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এমন হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী প্রতীকি দৃশ্য খুব কম ছবিতেই দেখা যায়। মানুষের রুদ্ধ প্রাণ, তৃষার্ত প্রাণ যে কি অবর্ণনীয় ক্রন্দন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে কত বিচিত্র উপায়ে এই একটি দৃশ্যতে চলচ্চিত্রকার তারেক তা আশ্চর্য নৈপুণ্যের সাথে অতি অল্প কথাতে বুঝিয়ে দিলেন। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম শিল্পকলার সেই মহোৎকর্ষের দিকে।
 ছবিটার দ্বিতীয় দৃশ্যটি ছিল মাদ্রাসার ভেতরকার ঘটনা। হয়ত প্রথমটির চেয়েও মর্মভেদী। আরো তীক্ষ্ণ, ধারালো, দর্শককে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার অবস্থাতে পৌঁছে দেয়। দুটি বালক, টুপি কোর্তাপরিহিত ক্ষুদে মৌলবিসাহেব, মাদ্রাসার মাঠে বল খেলছিল। এবয়সের অন্যান্য ছেলেরা যেমন চাঁদা তুলে বল কেনার পর তাতে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে পাড়ার মাঠে নিয়ে যায় খেলার জন্যে ঠিক ওরকম। খুব ছোটাছুটি করছিল দুবন্ধুতে। সে কি হাসি তাদের, কি উচ্ছল উদ্দাম প্রাবন্ততা। ওরাই কেবল, আর কেউ যোগ দেয়নি তাদের সঙ্গে কি কারণে কে বলবে। একজন বল ছুঁড়ে মারে দূর থেকে, আরেকজন দৌড়ে গিয়ে সেটা ধরার চেষ্টা করে। খেলতে খেলতে দুজনই হাঁপাতে শুরু করেছিল। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতে গিয়ে আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ছেলেদুটো বল খেলছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা রাবারের বল নয়, চামড়ার তো একেবারেই নয়, এমনকি পাকা জাম্বুরা দিয়ে তৈরি বলও নয়। আসলে তাদের হাতে কোনও বলই ছিল না। ছিল কেবল একটা কাল্পনিক বল, যার অস্তিত্ব নেই, যা পৃথিবীর কোনও নিপুন কারিগরের হাতের স্পর্শ পায়নি, যা পদার্থ নয়, বস্তু নয়, যা বাজারে নগদ পয়সা দিয়ে কেনার প্রয়োজন হয়না। এ বল শুধু দুটি বুভুক্ষু বালকের কল্পনার রঙ দিয়ে গড়া মূর্তি, একটি বিমূর্ত পুত্তলিকা।
 ছবিটা কবে দেখেছিলাম? মনে নেই ভাই। তারিখ মনে রাখার প্রয়োজনই বা কি।দৃশ্যটা এখনো জ্বলজ্বল করে মনে। মহৎ ছবি একেই বলে। কি কপাল আমাদের। এমন একজন বড়মাপের শিল্পীকে এত অল্প বয়সে হারালাম আমরা, তা’ও এক তুচ্ছ অর্বাচীন সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। ভদ্রলোকের বয়স ছিল মাত্র ৫৬। আরো কত কি বড় বড় কাজ রেখে যেতে পারতেন তিনি, কত অমূল্য উপচার তিনি তুলে দিতে পারতেন জাতির পাত্রে। ডালা ভরে সাজাতে পারতেন কত বিচিত্র চলচ্চিত্র।
 কিন্তু তা হল না। হতে পারল না। সব ভেস্তে গেল। যেমন করে ভেস্তে গেল স্বাধীনতার সব স্বপ্ন, সব প্রতিশ্রুতি।

অটোয়া, ১৪ই জুলাই, ‘১৪

মুক্তিসন ৪৩


মীজান রহমান

No comments:

Post a Comment