মীজান রহমান
সেদিন অঙ্কের শিক্ষক ক্লাসে ঢুকে অঙ্ক
দিয়ে শুরু করেননি। করেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ দিয়ে। আধুনিক সভ্যতার গতিপথ।
অঙ্কের মাস্টারের জন্যে একটু অপরিচিত এলাকা বই কি।
পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে
ছাত্রছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা সুরে বললেনঃ এই যে দেখছ যন্ত্রখানা আমার
হাতে, তোমাদের মত আমারও নেশা ধরে গেছে এর সঙ্গে। ক্লাসে ঢুকতে বা ক্লাস থেকে
বেরুতে আমি পকেট থেকে এটি চেক করি প্রথমে, তারপর অন্য কাজ। দিনে কম করে গোটা পঁচিশেক
টেক্সট মেসেজ পাঠাই। ঠিক তোমরা যেমন কর। এই যন্ত্রের এমনই অদ্ভুত ক্ষমতা যে
ছাত্র-শিক্ষকের যে ব্যবধানটা ছিল আগে তা পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। সেটা তেমন খারাপ
কিছু নয়, খারাপ হল নেশাটি। ছোট্ট এই যন্ত্রটি কেমন করে আমাদের সবাইকে নাকে দড়ি
দিয়ে ঘোরাচ্ছে দেখতে পাচ্ছ তো? বর্তমান সভ্যতার সবচেয়ে বড় সঙ্কট হল ক্ষুদ্র
যন্ত্রের হাতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়ন্ত্রন পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া। সুতরাং,
বিশ্বপৃষ্ঠের সবচেয়ে ধীশক্তিসম্পন্ন জাতি হিসেবে আমাদের একটা কিছু করা উচিত, তাই
না?
আজকে আমি পণ করেছি নিজের সঙ্গেঃ আজকের
দিনটা আমি এর ব্যবহার থেকে বিরত থাকব। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আমি তোমাদেরও
আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আমার সঙ্গে যোগ দিতেঃ পুরো দিনটা না হলেও স্কুল ছুটির আগ
পর্যন্ত। পারবে? পারবে তোমরা সেলফোনটা আমার কাছে জমা দিয়ে সারাদিন ফোন ছাড়া থাকতে?
ছেলেমেয়েরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি
করে। এগারো-বারো বছর বয়স তাদের। সবকিছুতেই তারা কৌতুক খোঁজে। অনর্থক মুখ টিপে
হাসবে, এই তাদের স্বভাব। এবারও তাই। এ কি অদ্ভুত প্রস্তাব স্যারের। সেলফোন ছাড়া
মানুষ বাঁচে কিভাবে? প্রথম দুচারমিনিট কেউ কোনও সাড়া দেয় না। তারপর সামনের বেঞ্চ
থেকে একটি ভিয়েতনামিজ মেয়ে সাহস করে দাঁড়ায়। সাথে সাথে একটি ভারতীয় ছেলেও। তারা
কারো দিকে না তাকিয়ে শিক্ষকের টেবিলে তাদের সেলফোন জমা দিয়ে নিজ নিজ সীটে ফিরে
যায়। ওদের দেখাদেখি ক’টি শ্বেতাংগ ছেলেমেয়েও দাঁড়িয়ে যায়। তারপর আরও। আরো। এভাবে
সমস্ত ক্লাসটাই তাদের সেলফোন জমা দিয়ে যার যার সীটে বসে পড়ে। শিক্ষক তুষ্টির হাসি
হাসেন। এরকমটিই তিনি আশা করেছিলেন। এর পর তাঁর অঙ্কের ক্লাস শুরু হয় যথারীতি।
কথাটা বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়ে
স্কুলব্যাপী। প্রিন্সিপ্যাল ভাবেনঃ তাইতো। এতো দারুণ একটা আইডিয়া। সমস্ত
স্কুলব্যাপী শুরু করলে কেমন হয়? কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। প্রিন্সিপ্যাল স্বয়ং যা
চাইছেন তাকে কার্যকরা করা থামায় কে? সকালবেলা মাইকের ঘোষণাতে জানিয়ে দিলেন সবাইকে
যে সপ্তাহের একটা দিন, বুধবার, এখন থেকে ‘ফোন হলিডে’। কেউ তার
সেলফোন-আইফোন-স্মার্টফোন এসব ব্যবহার করবে না। না, বাধ্যবাধকতামূলক নয়, তবে আমরা
শিক্ষকরা সবাই করব, এবং আমাদের একান্ত আশা যে ছাত্রছাত্রীরাও সবাই তাতে সাড়া দেবে।
বলা বাহুল্য যে বাধ্যবাধক না হবার কারণে প্রথম দুচারদিন অনেকেই যোগ দেয়নি তাঁর
ডাকে। তবে, সম্ভবত বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণেই, সপ্তাহ দুয়ের মাঝে দেখা গেল কোন
ছাত্রই স্কুলে থাকাকালে সেলফোন ব্যবহার করছে না, সপ্তাহের সেই একটি দিন। এবং, বহুদিন পর, ছেলেমেয়েরা
স্কুলের হলঘরে মেঝের ওপর আরাম করে বসে, গালগল্প করছে পরস্পরের সঙ্গে, যা তাদের
বাবামায়েরা করতেন একসময়। একসঙ্গে বসে আড্ডা মারা, হাসিফূর্তিতে মজে থাকা, যা এই
বয়সের ধর্ম, তা যেন ফিরে আসে প্রতি বুধবার। তারপর এমন অবস্থা দাঁড়াল একসময় যে
‘ফোন-হলিডে’র আইডিয়াটি গ্রীষ্মের ছুটির পর চালু রাখা উচিত কি উচিত নয় সেসম্বন্ধে
ছাত্রছাত্রীদের মতামত জানতে চাইলে ওরা একবাক্যে ‘উচিত’ বলে উত্তর দেয়।
প্রস্তাব যেমন অদ্ভুত, ফলাফল যেন তার
চেয়েও অদ্ভুত। টেলিভিশনের পর্দায় স্কুলের প্রশস্ত হলের মেঝেতে বসা ছেলেমেয়েগুলোর
সোরগোল আর হাসিঠাট্টার দৃশ্য দেখে আমার মন ভরে গেল। মানবজাতির অন্তরীণ প্রাণশক্তির
ওপর আমার সেই পুরনো আস্থা, যা একটু একটু করে হারাতে শুরু করেছিলাম, তা যেন নতুন
করে ফিরে পেলাম। ভবিষ্যৎ এখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার নয়। এখনো আশা আছে। মানুষ চাইলে সবই
পারে-----সপ্তাহে একদিন সেলফোন ছাড়া বেঁচে থাকতেও।
আসলে আমি নিজে সেলফোনের ব্যবহার
পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছি। কেবল সেলফোনই নয়, কোনরকম সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিও আমার
বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। ফেসবুক আর টুইটারের প্রতি আগ্রহ আমার গোড়া থেকেই ছিল না। ফেসবুকের
মাধ্যমে দুনিয়াশুদ্ধ বন্ধু খুঁজে বেড়ানোর প্রয়োজন আমি একেবারেই বোধ করিনা। এমনিতেই
আমার যথেষ্ঠ বন্ধু, ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে, আমার আর না হলেও চলবে। আমার
ল্যাণ্ডফোনে কলার আইডি নেই, কলার-ওয়েটিং নেই, এসবের কোনটাই আমার ‘প্রয়োজন’ তালিকার
অন্তর্গত নয়। কলার-আইডি, আমার মতে, মানুষকে লোকবাছাই করে ফোন ধরা-না-ধরার সুযোগ
দেয়। অজান্তে মানুষকে ছাঁটাই করতে প্রবৃত্ত করে----একপ্রকার বিভেদনীতি উস্কে দেয়
তার ভেতর। অর্থাৎ অজ্ঞাতসারে মানুষ একজন সেগ্রেগেশনিস্ট হয়ে পড়ে। এরকম সেগ্রেগশনের
ভুক্তভোগী আমি নিজেই হয়েছি বহুবার। অনেকসময় দেখা যায়, আমি যখন ফোন করি তখন কেউ ধরে
না। হয়ত খাচ্ছে, নয় টিভি দেখছে সোফায় বসে, খেলা দেখছে, ভিডিও গেম খেলছে, টেক্সট
মেসেজ পাঠাচ্ছে কাউকে, অতএব তাদের সময় নেই, অতএব তাদের যখন সময় হবে তখন ডাকবে, নয়ত
আদৌ ডাকবে না। তাদের যুক্তি, দরকার হলে কলার মেসেজ রেখে দেবে, আমার যখন সুযোগ হবে
তখন ডাকব, নয়ত আদৌ ডাকব না। এটা ফ্রি কান্ট্রি, তাই না? হ্যাঁ, অবশ্যই ফ্রি।
জানি কি বলবেনঃ আপনি হলেন মান্ধাতার
আমলের মানুষ। যন্ত্রকে আপনি ভয় পান, তাই এ থেকে দূরে থাকাটাই আপনার জন্যে নিরাপদ।
একেবারে অযৌক্তিক কথা নয়, যন্ত্রকে আমি একটু দূরত্বে রাখারই পক্ষপাতী। এই ধরুণ
জিপিএস নামক একটি আশ্চর্য বস্তু। আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন কোনও অচেনা জায়গায়, আর
যন্ত্রটি তার মিষ্টি, সেক্সি গলায়, আপনাকে বলে দিচ্ছে কেমন করে যেতে হবে আপনার
উদ্দিষ্ট বিন্দুতে, কোথায় মোড় নিতে হবে কত মিনিট পর এবং কত মিটার চালাবার পর। এর
চেয়ে তাজ্জব জিনিস আর কি হতে পারে? আজকাল যার জিপিএস নেই গাড়িতে সে হয় কঞ্জুস, নয়ত
সদ্য গ্রাম থেকে আগত। আমি অবসরপ্রাপ্ত, সীমিত উপার্জনের মানুষ হতে পারি, কিন্তু
কঞ্জুস বলে মনে করি না নিজেকে। তবে সদ্য গ্রাম থেকে আসা, সেটা বলতে পারেন, যদিও
পঞ্চাশ বছর পর সেটাও হয়ত ঠিক ‘সদ্য’ থাকে না। আমার আসল কারণটা কিন্তু
ভিন্ন----নিজেরই সজ্ঞান সিদ্ধান্ত যে জিপিএস ছাড়াই আমার গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব
হবে, যেরকম হয়েছে জিপিএস নামক যন্ত্রটি বাজারে নামার পূর্ববর্তী যুগে। সেসময় যে
উপকরণগুলো ব্যবহার করে আমি ভ্রমণক্রিয়াটি অতি সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করেছি, সেই
উপকরণগুলি এখনো পুরোপুরি ক্ষয় হয়ে যায়নি। এই উপকরণসমূহের প্রধান হল আমার জন্মগত ‘জিপিএস’টি-----অর্থাৎ
আমার মস্তিষ্ক। মানছি, নিজের মাথা থেকে কখনো মিষ্টি গলার আওয়াজ শোনা যাবে না, সেক্সি
তো একেবারেই নয়, তবে আমার বয়সে এসবের খুব একটা প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। অন্তত
গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে নয়। সে যাই হোক ভাই, জিপিএস ছাড়াই আমি দিব্যি
হিল্লিদিল্লি করে বেড়াতে পারছি। দোয়া করুণ বাকি কটা দিন যেন সেভাবেই কাটাতে পারি।
আমার মূল প্রসঙ্গটা কিন্তু যন্ত্রের
সাথে আমার বা আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, প্রসঙ্গ হল প্রযুক্তি আর মানুষের মাঝে
একটা জীবন্ত প্রতিপক্ষতা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তার শেষ কোথায়। আধুনিক সভ্যতার একটা
বৈশিষ্ট্যই হল প্রশ্ন তোলা। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে একটু সামনে-পেছনে তাকানো।
জিজ্ঞেস করা নিজেদের আমরা ব্যালেন্স রক্ষা করে চলতে পারছি কিনা, আমাদের চলার পথের
দিকনির্দেশটি কোনও অদৃশ্য জিপিএস-এর ওপর ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঁজে ছুটছি কিনা, ভাবতে চাওয়া। মোট কথা কার হাতে নিয়ন্ত্রণের
কাঠিখানা। ‘নিয়ন্ত্রণ’, নিয়ন্ত্রণ----এই হল গোড়ার কথা। বলবেন সে আবার কেমনতরো
প্রশ্ন। যন্ত্রকে তো আমরাই আবিষ্কার করেছি, চালাচ্ছিও আমরাই। সুতরাং যন্ত্রের হাতে
নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া বলতে কি বোঝায়?
যন্ত্রের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া
বলতে কি বোঝায় তার আভাস তো দেওয়াই হল প্রথম পংক্তিতে। পুরো একটা দিন সেলফোন আর
টেক্সটিং না করে বেঁচে থাকা যে কি শক্ত বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্যে সেটা
ওদের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আমার পনেরো বছর বয়স্ক নাতনির সঙ্গে যখন কথা বলি
তখন সে হয়ত তাকায় আমার দিকে, মেকি একটা হাসিও হয়ত দেবে ক্ষণে ক্ষণে, কিন্তু বুঝতে
পারি যে তার মন এবং কান দুটিই পড়ে আছে সুরেলা যন্ত্রখানির প্রতিঃ আইফোন। আজকাল
কোনও টিনেজ ছেলে বা মেয়েকে পাশে বসিয়ে ধীরেসুস্থে একটা কথা বলার চেষ্টা করা অনর্থক,
তাদের মন অন্যত্র। শুধু টিনেজদেরই বা দোষ দিই কেন, আমাদের বড়রাও আজকাল খুব পিছিয়ে
নেই। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল লক্ষ করেছেন? তারা হাঁটছে সামনের দিকে কিন্তু তাদের
চোখটা নিচের দিকে, আইফোনে কি নতুন মেসেজ এল সেদিকে। ওরা যদি আপনার গায়ে ধাক্কা
লাগিয়ে চলতি গাড়ির সামনে উপুড় করে ফেলে দেয় তাহলে ওদের দোষ দেবেন না----বেচারিরা
টেক্সটিং করছিল। রাস্তা পারাপার হবার সময় ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে যানবাহনের
খেয়াল রাখা সোজা নয়। হঠাৎ করে যদি গাড়ি এসে চাকার নিচে ফেলে দেয় তাহলে দোষটা হবে
কার? যে চাপা পড়ে গেল তার? না, আপনার অনুমান ভুল----দোষটা সবসময়ই গাড়ির চালকের।
লোকটার বুঝা উচিত ছিল যে বেচারি ফোন নিয়ে ব্যস্ত, গাড়ির দিকে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব
হয়নি তার পক্ষে। ওদিকে গাড়িওয়ালা নিজেও যে ফোনের ব্যবহার করছেন না তা’ই বা বলবে
কে। ওই যে বললামঃ ফ্রি কান্ট্রি। যা ইচ্ছা তা’ই করতে পারেন। আইন অমান্য করেও ছাড়
পাবেন যদিনা সাক্ষাৎ আইনের চোখের সামনে পড়ে যান। ওরকম বেকুব হলে তো আপনাকে ভুগতে
হবেই। আজকাল অনেক ড্রাইভারই গাড়ি চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলেন, টেক্সটিং করেন,
রূপসী মেয়েরা ঠোঁটে লিপস্টিক মাখেন, কফিতে চুমুক দেন, কোন কোন ব্যস্তবাগীশ পুরুষ
শুনেছি ঝট করে সকালের শেভটাও সেরে নেন। এর নাম স্বাধীনতা----অবাধ স্বাধীনতা।
সুতরাং ‘নিয়ন্ত্রণ’টা কার
কাছে----প্রযুক্তিজাত পণ্য, না, তার ব্যবহারকারি মানুষ, এপ্রশ্নটি হয়ত আজকের দিনে
একান্ত অবান্তর নয়। সংসারে বোধ হয় এমন কোনও মানুষ নেই যে তার নিজের জীবনের
নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায়। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা এই যে আসলে আমাদের প্রায় কারুরই কোনও
নিয়ন্ত্রণ নেই আমাদের জীবনের ওপর। অজান্তে আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণটি বাইরের
কোন-না-কোন শক্তির ওপর ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুত একটা নিরাপত্তার ভাব অনুভব করি। শেকলটি
পরানো হয় শৈশবেই----মাতৃভাষা শেখার আগে যখন মানুষকে ধর্মের বুলি শিখতে হয়। একটা
বিদেশী ভাষাও। মানে তার বর্ণবোধ কেবল, অর্থবোধ নয়। ধর্মকর্মের ব্যাপারে অর্থ যত কম
বোঝা হয় ততই ভাল। তাহলে অনুধাবনের চেয়ে পালনের অভ্যাসটা সহজেই গড়ে উঠতে পারে। তার
একটা ‘পরিচয়’ তৈরি হয়, যদিও সে-পরিচয়ের সঙ্গে তার নিজের কর্ম বা ইচ্ছার কোনও
সংশ্রব নেই। অতএব আমাদের নিয়ন্ত্রণটি গোড়াতেই অন্যের হাতে চলে গেল, কথাটা বলে কি
খুব অন্যায় করে ফেললাম?
মানুষের এই অনুবর্তনপ্রবণতাটি তার
মৌলিক প্রকৃতিরই অন্তর্গত কিনা জানিনা (সেটা নৃবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের এলাকা),
তবে এর পূর্ণ ব্যবহারটি যে করে নিচ্ছেন আধুনিক হাইটেক প্রযক্তির চতুর বণিকগণ সেটা
আমরা দেখেও দেখছি না, বুঝেও না বুঝার ভাণ করে আছি। কিন্তু এর শেষ কোথায়। কোথায় এই
অন্ধ কাফেলার সমাপ্তি? প্রযুক্তির রথে করে এই যে শূন্যভ্রমণে বের হওয়া, আমরা
যাচ্ছি কোথায়?
এই ‘ভবিষ্যৎ’টিকে, এই গন্তব্যটিকে
একেকজন জ্ঞানীগুণি ব্যক্তি একেকভাবে দেখছেন। কেউ দেখছেন মানবজাতির ক্রমিক
অবান্তরায়ন এবং অন্তিম অপনয়ন, কেউ দেখছেন অন্তহীন সম্ভাবনারূপে। হতাশা ও অবলুপ্তির প্রধান
প্রবক্তা হলেন রেমণ্ড কার্যওয়েল (১৯৪৮-) নামক এক বিখ্যাত ব্যক্তি। ক্যালিফোর্নিয়ার
গুগল কোম্পানির প্রকৌশলবিভাগের মহাপরিচালক। অসংখ্য পদকপদবিপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী,
প্রকৌশলী, চিন্তাবিদ, লেখক, বক্তা। স্কুলবয়স থেকেই তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এসেছেন----অবিশ্বাস্যরকম
মেধাবী পুরুষ একজন। তিনি এমন এক ভবিষ্যদবাণী করেছেন যা মানবকূলের জন্য মোটেও
আশাব্যঞ্জক নয়। তাঁর মতে ২,০৪৫ সালের মাঝে মানবেতিহাসের একটি চরম ক্রান্তিকাল চলে
আসবে, যার নামকরণ করা হয়েছেঃ ‘সিঙ্গুলারিটি’।
আধুনিক কম্পিউটার যুগের সূচনাকাল ধরা হয় আজ থেকে
দেড়শ’ বছর আগেকার সময়কে। এর আদি জনক বলে গণ্য করা হয় চার্লস ব্যাবেজ (১৭৯১-১৮৭১)
নামক এক ‘সর্বজ্ঞ’ (Polymath)
ব্যক্তিকে। তাঁর জন্ম ব্রিটেনে-----একাধারে গাণিতিক, দার্শনিক, মেকানিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ার, ও আবিষ্কারক। দ্রুত গণনকর্মের জন্যে তিনি একটি যুগান্তকারি যন্ত্র
আবিষ্কার করেন যার নামকরণ করা হয়েছে ‘ব্যাবেজ ইঞ্জিন’। সেই মেশিন তিনি নিজে
পূর্ণভাবে নির্মাণ করে যেতে পারেননি, কিন্তু তাঁর আইডিয়াগুলো অনুসরণ করে ২০০২ সালে
সেই ‘মেশিন’টি শেষ পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে লণ্ডনে। তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক
অগ্রসর ছিলেন। বর্তমান যুগের কম্পিউটারে চার্লস ব্যাবেজের অনেক
আইডিয়ারই প্রভাব আছে।
অত্যাধুনিক ‘তথ্যযুগ’এর সূচনা কিসেতে বা কখন?
সঠিক দিনতারিখ চিহ্নিত করে হয়ত কিছু বলা সম্ভব নয়, সঙ্গতও নয়, তবে বোধ হয় খুব
অন্যায় হবে না যদি কেউ দাবি করেন যে ১৯৯০ সালের একটি যুগান্তকারি ঘটনা থেকেই শুরু
হয় সমস্ত পরিক্রমাটি-----দুজন তরুণ গবেষক দ্বারা ‘বিশ্বজাল’ (World Wide Web সংক্ষেপে WWW) নামক এক
অভূতপূর্ব জিনিসের সূচনা। এই আবিষ্কারকদ্বয় হলেন ব্রিটেনের টিম বার্নার্স-লি ও
বেলজিয়ামের রবার্ট কেলাউ। তাঁরা নিশ্চয়ই জানতেন তাঁদের কাজ কিভাবে সমস্ত পৃথিবীতে
বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে দেবে। তা সত্বেও তাঁরা এর ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা
প্রতিষ্ঠা করার কোনও প্রয়াস নেননি। ইচ্ছে করেই নেননি। নিলে তাঁরা দুজনই হয়ত আজকে কয়েক
শত বিলিয়ন ডলারের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু পয়সা বানানোর দিকে ওঁদের ঝোঁক ছিল না
মোটেও। তাঁরা বরং চাইছিলেন যাতে এই ‘জাল’টি পৃথিবীর ছোটবড়, গরিবধনী সকলের কাছেই সহজলভ্য
হয়, স্বল্পব্যায় বা বিনাব্যয়তেই সেটা ব্যবহার করতে পারে সবাই। সত্যিকার নমস্য ব্যক্তি
এঁদেরই বলে।
‘বিশ্বজাল’ আর ইন্টারনেটের পরই স্থান
দিতে হয় মোবিল বা সেলফোনকে। এর আবিষ্কারক কে? এই প্রশ্নটি আমি অনেককেই জিজ্ঞেস
করেছিলাম, মুহূর্তে মুহূর্তে এটি ব্যবহার করতে না পারলে যাদের নাভিশ্বাস হবার
উপক্রম হয়। একজনও বলতে পারেনি। আগেকার সেই কৌতূহলটাই যেন মরে গেছে। ‘তথ্য’ যখন
সহজলভ্য হয়ে যায়, কষ্ট করে দূর দূর লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্য ধরে
বিশ্বকোষ ঘাঁটতে হয়না, তখনই বোধ হয় মানুষের সেই জ্ঞানস্পৃহাটি একটু দুর্বল হতে
শুরু করে। কেবল তাই নয়। তখন ‘তথ্য’ আর ‘জ্ঞান’এর মাঝে যে বিরাট ফারাক আছে একটা সে
বোধটুকুও বোধ হয় একটু ভোঁতা হয়ে যায়।
সেলফোনের আবিষ্কারক হিসেবে যে নামটির
উল্লেখ করা আন্তর্জাল মাধ্যমে তিনি হলেন আমেরিকান প্রকৌশলী মার্টিন কুপার (১৯২৮-)।
মূল আইডিয়াটি হয়ত তাঁরই, যদিও তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে আরেকটি নাম খুব লক্ষণীয়ভাবে
উঠে আসে----জন ফ্রান্সিস মিচেল (১৯২৮-২০০৯)। তাঁরা দুজনই কাজ করতেন মটরোলা
কোম্পানিতে। মটরোলার বেতার যোগাযোগ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা দুজনই। কুপার
সাহেব তাঁর যন্ত্রটির প্রথম সংস্করণ জনসমক্ষে নিয়ে আসেন ১৯৭৩ সালে। জিনিসটা তখন
ব্যবহারযোগ্য অবস্থাতে ছিল তা বলা যায় না-----একেতো বেশ ভারি, তদুপরি দশ মিনিট
ব্যবহার করার পর ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যেত, নতুন করে তাকে চার্জ করে নিতে হত কয়েক
ঘন্টাব্যাপী। সুতরাং বাজারে ছাড়ার যোগ্য নয় তখনো। সৌভাগ্যবশত মটরোলা কোম্পানির
পূর্ণ আস্থা ছিল তাঁর এই অভিনব উদ্ভাবনের ওপর। পুরো বিশটা বছর তারা তাঁকে এবং তাঁর
সহকর্মীদের সমর্থন ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে যায়। শেষে, মোট ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করার
পর, তাঁদের সেই বিশ্বাস ফলপ্রসূ হয়। ১৯৯৩ সালে সেটা বাজারে ছাড়ার সাথে সাথে তুমুল
সাড়া পড়ে যায় চতুর্দিকে। নতুন দিনের সূর্য উদয় হয় বিশ্বব্যাপী। স্বাগতম সেলফোন।
আজকে পৃথিবীর প্রায় এক পঞ্চমাংশ মানুষই দুরারোগ্যভাবে আসক্ত এতে। বদ্ধ নেশাখোর জুয়ারির
চাইতে কম নেশাকর নয় এই নেশা। এই অবস্থাটি হয়ত কল্পনাও করতে পারেননি মার্টি কুপার
বা তাঁর সঙ্গীসাথীরা, ১৯৭৩ সালে। তবে ব্রিটেনের ব্যাবেজ সাহেবে বা দুই ‘বিশ্বজাল’
আবিষ্কারকের মত “বোকা” তিনি বা তাঁর সহকর্মীরা ছিলেন না। বাজারে ছাড়ার আগেই তাঁরা
ওটাকে পেটেন্ট করে নিয়েছিলেন যাতে তাঁদের স্বত্বটা পাকাপোক্ত হয়ে থাকে। ফলত তাঁরা
সকলেই এখন অঢেল ধনসম্পদের অধিকারী।
এবার আমার মূল প্রশ্নে ফিরে যাবঃ
মানবজাতির ভবিষ্যৎ। রেমণ্ড কার্যওয়েলের অবান্তরায়ন বাণীই কি সত্য প্রমাণিত হবে,
না, ইতোমধ্যে এমন কিছু ঘটবে যাতে করে মানুষ নতুন করে ফিরে পাবে তার জীবনকে।
এ-প্রশ্নের মোকাবিলা করার আগে দেখা যাক কি বিশ্বাস বা অনুকল্পের ভিত্তিতে তিনি সেই
সর্বনাশা সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন। ভিত্তিটা ছিল মূলত মানুষ আর তার প্রতিপক্ষ, কম্পিউটার,
দুয়ের বুদ্ধিশক্তির ক্রম প্রবৃদ্ধির তুলনামূলক হার। এটা ঠিক যে মানুষের
বুদ্ধিশক্তি বৃদ্ধি পায় সরলরেখাতে, আর, অন্তত এযাবত, কম্পিউটারের “বুদ্ধিশক্তি”
বৃদ্ধি পেয়েছে এক অবিশ্বাস্য ‘এক্সপোনেনশিয়েল’ গতিতে। তার কিছু কিছু লক্ষণ তো
আমাদের মত সাধারণ মানুষেরই দৃষ্টিসীমার মধ্যে পৌঁছে গেছে। কার্যওয়েল সাহেবের
অন্ধকা্রাচ্ছন্ন ভবিষ্যদবাণীর সবটুকু যে নেহাৎ কোনও পাগলা ফকিরের আবোল তাবোল
বকাবাজি নয় তার ‘প্রমাণ’ পেতে বড় বড় পণ্ডিতদের সাহায্য নেবার প্রয়োজন নেই, আমরা
নিজেরাই টের পাচ্ছি। উন্নত বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই আজকে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর এত
দুর্বল অবস্থা, তার অনেক কারণের মাঝে একটি বড় কারণ হলঃ প্রতিযোগিতা। তবে একে
অন্যের সাথে নয়, সবাই মিলে একটা অমানব দৈত্যরে
সঙ্গেঃ যন্ত্র! স্বয়ংচালিত যন্ত্র। আজকাল কোন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা সরকারি
কার্যালয়ে টেলিফোন করে কোনও তথ্য জানতে চাইলে কোন মানুষের কন্ঠ শুনতে পাবেন? না,
পাবেন না। মানুষের জায়গাতে এখন যন্ত্র বসেছে। সেই যন্ত্রকন্ঠই নানারকম প্রশ্নোত্তর
দ্বারা আপনার সমস্যা চুকে দেবার চেষ্টা করবে। আজকাল রক্তমাংসের শ্রমিক ঠিক কোথায়
কোথায় ব্যবহার করা হয় বলুন তো। হাতে গুণে শেষ করা যাবে, এতই অল্প। পোস্টাপিসে
চিঠিপত্র সাজানো, ডাকের বাক্স গুছানো, যা আগে করা হত গায়ের শ্রম দ্বারা, এখন তা
করা হয় যন্ত্রের সাহায্যে। ইন্টারনেট আর অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে আজকাল
ডাকে চিঠিপত্র পাওয়াদাওয়ার যুগ তো প্রায় উঠেই গেছে। যৎসামান্য যাকিছু অবশিষ্ট
রয়েছে তা’ও হয়ত অচিরেই রবোট মাধ্যমে বিলি করার উদ্যোগ শুরু হয়ে যাবে। তার অর্থ পুরনোদিনের
‘ডাকপিয়ন’ শব্দটিই কালে কালে অভিধান থেকে উধাও হয়ে যাবে (তখনকার ছেলেমেয়েরা
রবিঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’ বা ‘পোস্টাপিস’ পড়ে ঠিক একই রকম রস পাবে কিনা সন্দেহ)।
আজকাল ক’জন লোকের ঘরে আপনি কাগজে-ছাপা সংবাদপত্র দেখতে পাবেন? একমাত্র আমার মত
বৃদ্ধজন ছাড়া প্রায় কাউকেই পাবেন না। ইন্টারনেটেই যদি সব খবর পাওয়া যায় তাহলে
মানুষ পয়সা দিয়ে কাগজ কিনবে কেন? বইয়ের দোকানগুলো সব উঠে যাচ্ছে একে
একে----প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বিমানকর্তাদের বড়
খরচগুলোর একটা হলঃ চালক-সহচালক আর ফ্লাইট পরিচারকদের বেতন। সেটা হয়ত তাঁরা অনায়াসে
বাঁচাতে পারবেন জ্যান্ত পাইলটের পরিবর্তে যান্ত্রিক পাইলট ব্যবহার করার সযোগ পেলে।
অনতিকাল পর হয়ত তা’ও মানুষের সাধ্যসীমার ভেতরে চলে আসবে। তখন আপনি পাইলটবিহীন
বিমানে করেই হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াতে পারবেন, এবং সম্ভবত বিপুলভাবে হ্রাসকৃত মূল্যে।
তারপর ধরুণ, তেলের খনি, স্বর্ণরৌপ্যের খনি, কয়লার খনি, সমুদ্রগর্ভে তৈলসম্পদ আছে
কি নাই তার সুগভীর তল্লাশ, এ সবই অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল চাকরি, অতএব শ্রমিকদের
উপার্জনও বেশি। ভবিষ্যতে হয়ত তাদের এই ‘উচ্চ’ উপার্জনের পন্থাটিও বন্ধ হয়ে যাবে।
তখন কোথাও কোন বড় দুর্ঘটনা হলেও মানুষজন কারো কোন ক্ষয়ক্ষতি হবে না, কারণ
‘কর্মিরা’ কেউ মানুষ থাকবে না, থাকবে সব ভয়ালু চেহারার রবোট। রবোটপ্রযুক্তির
মানবকল্যানমূলক প্রয়োগগুলোর মাঝে অন্যতম হল চিকিৎসাবিজ্ঞানে। বিশেষ করে সার্যিকেল
ক্ষেত্রে। দুর্ঘটনা বা অন্য কোনও কারণে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন হয়ে যাওয়া রুগীদের
জন্যে রবোট হয়েছে পরম বন্ধু। যাদের কোনদিনই হাঁটাচলা করার কথা ছিল না তারা রীতিমত
দৌড় প্রতিযোগিতায় যেতে পাচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে দুরূহ হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট
সার্যারিতেও রবোট ব্যবহার করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পার্কিংসন, গুরুতর
পক্ষাঘাতপ্রাপ্ত রুগীর চলচ্ছক্তিহারানো অবস্থা, শিরদাঁড়ার অন্তিম দুর্বলাবস্থা, এ
সবকিছুর ভেতরেই রবোট প্রক্রিয়া মানুষকে তার জীবনের আংশিক আনন্দ ফিরিয়ে দিতে পারছে।
অসুস্থ মানুষের সহায় যদি হতে পারে যন্ত্র তাহলে সুস্থ মানুষেরই বা হবে না কেন?
কঠিন প্রশ্ন মনে হলেও আসলে কিন্তু খুব কঠীন নয় তার উত্তর। যন্ত্রকে ‘সুস্থ মানুষের
সহায়’ হতে দেওয়াতে ক্ষতি নেই, ক্ষতি কেবল মানুষকে সরিয়ে তাকে অভুক্ত রেখে শেষে
অসুস্থ করে ফেলার প্রয়াসের মধ্যে। শুনেছি জাপানে আজকাল রবোটেরই রাজত্ব----দৈনন্দিন
জীবনের সর্বত্রই রবোটের ছড়াছড়ি। সেই রাজত্ব অচিরেই উত্তর আমেরিকাতে ছড়াবে না তার
কোন নিশ্চয়তা আছে কি?
সুতরাং বন্ধুগণ, আমাদের কার্যওয়েল
সাহেব বদ্ধ পাগল নন। তাঁর ‘সিঙ্গুলারিটি’ শব্দটির তাৎপর্য হল সেই ভয়াবহ মুহূর্তটি
যখন মানুষের জৈবিক বুদ্ধিশক্তির ঠিক সমান্তরাল পর্যায়ে পৌঁছে যাবে যান্ত্রিক বুদ্ধিশক্তি।
তাঁর এই গা শীতল-করা ভবিষ্যদবাণীকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবেন না।
তবে।
সৌভাগ্যবশত তাঁর কথা যে শেষ কথা না’ও হতে পারে
সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত বিজ্ঞজনেরও অভাব নেই বর্তমান যুগে। কোন কোন
প্রফেসার তো রীতিমত গালাগাল করেছেন রেমণ্ড কার্যওয়েলকে। বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ
ছাড়াই একটা উড়োকথা ছেড়ে দিয়েছে লোকটা। আস্ত পাগল। আত্মগরিমাতে অন্ধ একজন মানুষ,
ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার তাঁকে (ধর্মীয়) ভণ্ড পয়গম্বর বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
কি যুক্তিতে? লোকটা ‘অবান্তরকরণ’এর মধ্য দিয়ে ধর্মবাণীর প্রতিধ্বনি নিয়ে আসছেনঃ
কেয়ামত। ‘সিঙ্গুলারিটি’ মানে শেষ বিচারের দিন, তাই না?
এধরণের নানা তর্কবতর্কের মাঝ দিয়ে
আরেকটি ছোট আলোকরশ্নি কিন্তু বের হয়ে আসে। সেই আলোকরশ্নিটির নামঃ আশা। হয়ত
কার্যওয়েল যা বলেছেন তার একাংশ সত্য হলেও পুরোটা নয়। তিনি একটা দিক দেখেছেন, সবটা
দিক দেখেননি। মানুষ নামক চির বিস্ময়কর জীবটিকেই হয়ত তিনি পাশ কাটিয়ে গেছেন।
কার্যওয়েলের ভবিষ্যদবাণী আমাকে সেই
আগেকার ম্যালথুসিয়ান ফর্মুলার কথা মনে করিয়ে দেয়----তিনিও মনে করতেন মানুষের
সংখ্যা বাড়ে একইরকম এক্সপোনেনশিয়েল রেটে। সেটা সত্য ছিল অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যখন
মানুষের সংখ্যা মাত্রাছাড়ানো অঙ্কতে পৌঁছে যায়নি। তারপর যখন সেই “মাত্রা”টি
অতিক্রান্ত হতে শুরু করে তখন মানুষের মধ্যে আরম্ভ হয়ে যায় প্রতিযোগিতা,
সার্ভাইভেলের সংগ্রাম। তখন সেই ‘এক্সপোনিনেনশিয়েল’ নিয়মটি আর কাজ করে না----তার
বদলে আসে আরেক নিয়ম যার সারকথা হলঃ বৃদ্ধি হলেও সংযত, অনেক সংযত, সঙ্গত হারে, যাতে
করে মানবজাতি তার নিজের সংখ্যার ভারে কাত না হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে এযুগের অনেক
প্রযুক্তিবিদ ও চিন্তানায়কও বিশ্বাস করেন যে প্রযুক্তিশক্তির হারও মনুষ্যজাতির
প্রাণশক্তির সাথে প্রবল প্রতিযোগিতায় নেমে একটু একটু করে শিথিল হতে শুরু করবে। প্রযুক্তিকে
যখন মানুষের জীবিকা ও জীবনের ওপর অহিতকর প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যাবে তখন মানুষ
নিজেই রাশ টেনে ধরার চেষ্টা চালাবে। ঠিক যেমনটি হয়েছে সাম্প্রতিক অটোয়া স্কুলের
ক্লাসরুমে----প্রথমে শিক্ষক, পরে ছাত্রছাত্রী সবাই স্বেচ্ছায় বর্জন করতে পেরেছে
তাদের ‘প্রাণপ্রিয়’ যন্ত্রখানির ব্যবহার।
আধুনিক মানুষ, উন্নত বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ, কোনও বহিঃশক্তির
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ‘নিয়ন্ত্রণ’ কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারবে না। এবং কার্যওয়েল
সাহেব যেভাবে যান্ত্রিক শক্তির চরিত্রটিকে দাঁড় করতে চাচ্ছেন তাতে তো মনে হবারই
কথা যে এটি এক অশুভ ‘বহিঃশক্তি’ বই কিছু নয়----যেন এমন এক ভীমকায় দৈত্য যে আমাদের
গ্রাস করাতেই উদ্যত। কিন্তু আমার মনে হয়না তাঁর এই হতাশার ছবিটা শেষ পর্যন্ত টিকতে
পারবে।
ঠমাস ম্যালথুস (১৭৬৬-১৮৫৪) নিজে খুব
ডাকসাঁইটে বিজ্ঞানী বা সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন বিলেতে তা নয়। কিন্তু ছোটকাল থেকেই তাঁর
একটা বাতিক ছিল----নানান দেশের জনসংখ্যার হিসেব রাখা, এবং সেগুলো নানান যুগের সাথে
মিলিয়ে একটা ধারাবাহিকতা তৈরি করা। তাঁর অভিজ্ঞতাতে যে চিত্রটি পরিষ্কার দেখা
যাচ্ছিল তাতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হার সেসময়কারই লোকসংখ্যার সমানুপাতিক----অর্থাৎ যত
মানুষ থাকবে ততই বাড়বে মানুষ। এটাই হল ‘এক্সপনেনশিয়েল’ আইনের সারমর্ম। কিন্তু সেই
‘মানুষ বাড়া’র সাথে যে প্রজননক্ষম মানুষের সংখ্যা ছাড়া আরো কিছু উপাদানের প্রয়োজন
হতে পারে সেদিকটা তিনি গোণাতে ধরেননি। ধরার প্রয়োজন হয়নি তাঁর সময় যখন সংসারে
কোথাও খাদ্যবস্তুর অভাব নামক কোন অবস্থার অস্তিত্ব ছিল না, যখন দুর্ভিক্ষ ছিল না,
মহামারিতে দেশ-কি-দেশ কাবাড় হয়ে যেত না। সুতরাং সন্তান উৎপাদনে বাধা কোথায়। কিন্তু
মানুষের সংখ্যা যখন ম্যালথুসিয়ান বেগে বাড়তে বাড়তে একটা চরম সীমায় পৌঁছে যায় যখন
বাচ্চা উৎপাদনের চাইতে বাচ্চাপালনের সমস্যাটাই বড় হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে, তখন তাঁর
প্রবর্তিত সহজ ফর্মুলাটি তার প্রযোজ্যতা হারিয়ে ফেলে। তার জায়গাতে আসন করে নেয়
আরেকটি আইন যাকে বলা হয় ‘লজিস্টিক ফরমুলা’---এর প্রবক্তা ছিলেন বেলজিয়ামের এক
গাণিতিক-সমাজবিজ্ঞানী, পিয়ের ভারহুর্স্ট (১৮০৪-১৮৪৯)। তাঁর ফর্মুলাতে জনসংখ্যা
প্রথমদিকে ধাই ধাই করে ওঠার পর বাস্তবতার সম্মুখিন হয়ে ক্রমে ঝিমিয়ে পড়তে থাকে।
পরবর্তীকালে তাঁর ফর্মুলাও একটু মার্জিত হয় অন্যান্য গবেষকের হাতে, কিন্তু তাঁর
মুল সুরটি, সংযত বৃদ্ধি, সেটা বজায় থাকে।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, প্রযুক্তির
ক্ষেত্রেও অনেকটা তা’ই হবে। ‘কৃত্রিম’ বা ‘যান্ত্রিক বুদ্ধি’ (আর্টিফিশিয়েল
ইনটেলিজেন্সে) আপাতত এক্সপোনেনশিয়েল হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলেও অচিরেই তার
অন্তর্শক্তি নিঃশেষিত হতে শুরু করবে। মানুষ নিজেই সতর্ক হয়ে উঠবে। কে জানে,
মানুষের মত ক্ষুদ্র জীবও হয়ত তখন যন্ত্রের মত দৈত্যের পায়ে বেড়ি পরাতে সক্ষম হবে।
অটোয়ার স্কুলের কচিকাচারা যদি পারে তাদের সেলফোনগুলোকে গুদামে জমা দিয়ে হলের খোলা
মেঝেতে আসন গেড়ে বসে তাদের বাবামায়েদের মত হাসিঠাট্টা আর হৈ হুল্লোড়ে মজে থাকতে,
আমার মত বৃদ্ধ যদি জি পি এস ছাড়াই পরম আত্মবিশ্বাস নিয়ে দীর্ঘ শকট সফরে বের হতে
পা্রে, তাহলে তরুণ প্রজন্মের যারা আমার চাইতে শতগুণে বেশি সজাগ ও সচেতন তারা পারবে
না কেন? অবশ্যই পারবে। মানুষ পারবে না এমন কোনও কথাই দয়া করে কেউ যেন না বলে
আমাকে। এদেশের সেই পুরনো বুলিঃ “We shall
overcome”---এতে আমার গভীর আস্থা।
প্রযুক্তি আর জনসংখ্যাই নয় কেবল,
মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমি এই আত্মিক আশাবাদটি বুকের মাঝে পোষণ করি
সর্বদা। এই ধরুণ আমাদের প্রিয় দেশটির বর্তমান চালচিত্র। একদিকে যেমন আলোয় আলোয় ঝলমল
করছে চারদিক (অর্থনৈতিকভাবে তো তাই মনে হচ্ছে, যদিও তার বেশির ভাগই অন্যের কাঁধে
ভর করে অর্জিত), আরেকদিকে তেমনি তিমিরে তিমিরে আকন্ঠ নিমজ্জিত। দুর্নীতি বেসামাল।
জনসংখ্যা বেসামাল। ধর্মীয় গোঁড়ামি বেসামাল। আইনশৃংখলার অভাব, বেসামাল। রাজনৈতিক
দলগুলোর আদর্শ বলে কিছু নেই, তার বদলে আছে তাদের নিজ নিজ দলীয় আদর্শ। তাদের সেই
দলীয় আদর্শ গড়ে উঠেছে কোনও জাতীয় লক্ষকে কেন্দ্র করে নয়। সেগুলো একটি ব্যক্তিকে
কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘কাল্ট’ মাত্র, ধর্মীয় কাল্টের চাইতে যার প্রকৃতি তেমন ভিন্ন
নয়, যা সেই পুরনোদিনের পীরভক্তিকেও হার মানায়। এবং এই অধঃপতনের গতিটাও অনেকটা সেই
ম্যালথুসিয়ান গতির মতই এক্সপোনেনশিয়েল মনে হয় মাঝে মাঝে। প্রশ্ন হলঃ এই গতি কি অব্যাহত থাকবে
নিরবধি?
না, থাকবে না। সেখানেও বাধা সৃষ্টি হতে
বাধ্য। কিন্তু সেবাধা আমার বা আমার অব্যবহিত দুতিন প্রজন্মের লোকেদের কাছ থেকে
আসবে না। আমরা সবাই, এক হিসেবে, কলুষিত। নিজ নিজ স্বার্থ খুঁজে বেড়াচ্ছি সবসময়। না
ভাই, ওই বাধার দেয়াল দাঁড় করাতে পারবে একমাত্র নতুন যুগের নতুন প্রজন্ম। ঠিক
যেমনটি হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য দেয়াল ভাঙ্গাগড়ার বেলাতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস
বাংলাদেশের তরুণরাই সজোরে পুনরুদ্ধার করে নেবে তাদের সময়কে, তাদের জীবনকে, তাদের
ভবিষ্যৎকে। এ-পৃথিবী তাদের অধিকার, এ-পৃথিবীর আলোবাতাস তাদের দখলে এবং তাদেরই কেবল।
অটোয়া, ৭ই জুন, ‘১৪
মুক্তিসন ৪৩
মীজান রহমান :: Mizan Rahman
No comments:
Post a Comment