Friday, 9 January 2015

অধ্যাপক মীজান রহমান: এক নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ

অভিজিৎ রায়


আমি ডাকতাম মীজান ভাই বলে। অধ্যাপক মীজান রহমান। এই বরেণ্য মানুষটির মূল পরিচয় ছিল গণিতবিদ হিসেবে। শুধু গণিতবিদ বললে ভুল হবে, বাংলাদেশের যে কয়জন একাডেমিয়ার সাথে যুক্ত শিক্ষাবিদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন, বাংলাদেশকে পরিচিত করতে পেরেছেন দর্পভরে বিশ্বের অঙ্গনে, তার মধ্যে মীজান রহমান ছিলেন অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন তিনি, এরপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এম.এ) এবং কানাডার ব্রান্সউইকে (পিএইচডি)। তারপর  সেই ১৯৬৫ সালে কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে একটানা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গণিতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষকের সম্মান সহ বহু সম্মানেই তিনি ভূষিত হয়েছেন। শুধু শিক্ষক হিসেবে তিনি খ্যাতিমান তা নন, শিক্ষায়তনে সাফল্য পেতে হলে যা যা দরকার, সবই তাঁর ঝুলিতে ছিল। গণিতের বিখ্যাত জার্নালগুলোতে খুঁজলেই যে কেউ পাবেন তাঁর অসংখ্য গবেষণাপত্রের হদিস, পাশাপাশি কিছুদিন আগে গণিত শাস্ত্রের পণ্ডিত জর্জ গ্যাসপারের সাথে লিখেছেন মহামূল্যবান একটি পাঠ্যপুস্তক বেসিক হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজ  (১৯৯০) শিরোনামে, যেটা প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই গণিতের ছাত্রদের জন্য অবশ্য-পঠিত পুস্তক হিসেবে বিবেচিত। তিনি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক প্রফেসর আলবার্তো গ্রুনবাম এবং নেদারল্যাণ্ডের গণিতবিদ এরিখ কোয়েলিংক প্রমুখের সাথেও গণিত বিষয়ক বহু গবেষণা করেছেন। গণিতে তার অবদান এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ১৯৯৮ সালে কানাডার ওই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তাঁকে এমিরিটাস অধ্যাপক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যারা এমিরিটাস শব্দার্থটির সাথে পরিচিত নন, তাদের জানাই এমিরিটাস অধ্যাপক হবার ব্যাপারটি খুব বিরল সম্মানের, যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই। এঁরা অবসর নেবার পরেও যে কোন জায়গায় নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত করতে পারেন, আজীবন ধরেই। পরে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘Distinguished Research Professor’-এর খেতাবও পেয়েছিলেন। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড এশকি নাকি তাঁকে সিম্বলিক ক্যালকুলেশনের ক্ষেত্রে মাস্টার হিসেবে ডাকতেন। গণিত বিষয়ে বাংলাদেশের কিংবদন্তির তালিকা কেউ কোনদিন বানাতে বসলে  মীজান রহমানকে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু গণিতের কাঠখোট্টা জগতের বাইরেও তার আরেকটা পরিচিতি ছিল। তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক। তার প্রথমদিককার উপন্যাস লাল নদী (২০০১) পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, আলোড়িত হয়েছিলাম, সহসা আবিষ্কার করেছিলাম এক সমাজ সচেতন প্রগতিশীল সুলেখকের প্রতিচ্ছবিকে। পরে জেনেছি এই নিভৃতচারী লেখকের এই একটি নয়, একগাদা ভাল ভাল বই আছে। তার মধ্যে রয়েছে তীর্থ আমার গ্রাম, প্রসঙ্গ নারীঅ্যালবাম, অনন্যা আমার দেশ, আনন্দ নিকেতন, দুর্যোগের পূর্বাভাষ, ভাবনার আত্মকথন, শুধু মাটি নয় প্রভৃতি। সে সময় লজ্জিতই হয়েছিলাম তার বইয়ের সাথে আগে পরিচিত না হওয়ায়। এর পরে যখনই সুযোগ পেয়েছি মীজান রহমানকে পড়বার চেষ্টা করেছি, নিজ উদ্যোগেই। এক ধরণের দায়িত্ববোধ থেকেই। বলা বাহুল্য, তাঁর লেখা পড়ে কখনোই হতাশ হইনি, বরং আলোকিত হয়েছি নানাভাবে। ভাল লাগা আরো বেড়েছে পরবর্তীতে যখন জানলাম তিনি একজন ধর্মমোহমুক্ত সত্যিকার মুক্তমনা মানুষ, একজন মানবতাবাদী। শুধু তাই নয়, দর্শনের জগতে আমরা যাদের স্কেপ্টিক বলি, মীজান রহমান সেই গোত্রভুক্ত ছিলেন। সে অনুভূতি আমার আরো দৃঢ় হয়েছে পরবর্তীতে তার মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত লেখাগুলো পড়ে। তিনি ধর্মগ্রন্থের বানীগুলোকে কেবল নিনির্মেষ স্তব করতেন না, বরং সময় সময় প্রকৃত অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীদের মতো ক্রিটিকালি দেখতে চাইতেন। তাই অন্য অনেকের মত কোরানের আয়াতে বিগ ব্যাং খুঁজে পাননি, বরং ঈশ্বর নির্দেশিত ধর্মগ্রন্থগুলোতে বহু সময়েই আবিষ্কার করেছেন অপবিজ্ঞান, কুসংস্কার, অসাম্য আর নিপীড়নের দীর্ঘদেহী করাল ছায়া।  মুক্তমনা সাইটে রাখা তাঁর ব্লগের  ইনশাল্লাহকোথায় স্বাধীনতা, হতবুদ্ধি, হতবাক কিংবা আউট অব্ কন্টেক্সট শিরোনামের প্রবন্ধগুলো পড়লেই মীজান রহমানের প্রগতিশীল দার্শনিক অভিজ্ঞার সন্ধান পাবেন পাঠকেরা। তিনি কোন ধরণের অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতেন না। ধর্মগ্রন্থের তথাকথিত ১৯-এর মিরাকল সহ নিউমেরিক্যাল মিরাকল নিয়েও তার সংশয়বাদী লেখা আছে অস্ত্র যেখানে যুক্তির বিকল্প শিরোনামে।  অদৃশ্য স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। তিনি পার্থিব জগতের কথা তুলে ধরে প্রায়ই বলতেন, আমার স্বর্গ এখানেই। এই শিরোনামে তাঁর একটি প্রবন্ধও আছে মুক্তমনায়।  স্বর্গের অনাবশ্যক এবং অলীক হুরপরী নিয়ে কখনো চিন্তা ছিলো না বলে  তিনি আগে থেকেই মরণোত্তর দেহ দান করে যাবার কথা বলে গেছেন।


চিত্র: মীজান রহমানের সাথে আমি আমাদের শূন্য থেকে মহাবিশ্ব বইটির পাণ্ডুলিপি নিয়ে আলোচনা।

তিনি আমার পরিচালিত মুক্তমনা ব্লগে নিয়মিত লিখতেন। বাংলাতেই বেশি, তবে ইংরেজিতেও লিখেছেন। একটা সময় এর পরিচালনার সাথেও যুক্ত হয়েছিলেন আমার অনুরোধে। এই অনুরোধের উত্তরে ইমেইলে বলেছিলেন, সাধারণত আমি কোন সংগঠনের সাথে জড়িত হই না, কিন্তু তোমার অনুরোধটা ব্যতিক্রম। তোমাদের মতো মুক্তচিন্তার মানুষদের নিয়ে আমার অনেক আশা। পরিবর্তন যদি হয় তবে তোমাদের মধ্য থেকেই আসবে।  কোন এক বিচিত্র কারণে তিনি আমার লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। ব্লগে আমার অনেক লেখাতেই তার মন্তব্য আছে, আছে অফুরন্ত প্রংশসাবাক্য যা এখন আমাকে লজ্জিতই করে দেয়। বিডিনিউজে আমি ঠিক এর আগে যে লেখাটি লিখেছিলেম সবই ব্যাদে আছে শিরোনামে আজ গিয়ে দেখলাম সেখানেও তিনি ছোট একটি মন্তব্য করেছেন তিনি। প্রশংসা করেছেন লেখাটির, একমত পোষণ করেছেন লেখাটির অভিমতের সাথে। ইমেইল করেও মাঝে সাঝে এই কাজ করতেন তিনি। শুধু তাই নয়। আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী নামে একটা বই লিখেছিলাম আমি ২০০৫ সালের দিকে। কি কুক্ষণে সেটা মীজান রহমানের চোখেও পড়ে গিয়েছিল। এর পর থেকেই তিনি আমার এ বইটি সবাইকে পড়তে বলতেন। তিনি বলতেন এই বইটা পড়লে আর মীজান রহমানের লেখা বই পড়ার দরকার হবে না (পাঠকেরা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এই কথাটি তিনি  এমনকি  তার প্রকাশিত গ্রন্থ শূন্য-এর ভূমিকায় লিখে দিয়েছেন!) মাঝে সাঝেই আমি দূর দূরান্ত থেকে ফোন কল পেতাম মীজান ভাইয়ের উপদেশে নাকি তারা বইটি পড়েছেন, এবং আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। তাঁদের মধ্যে সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরাও ছিলেন। অজানা অচেনা মানুষের কাছ থেকে এই ধরণের ফোনকল পেয়ে লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে যেত।  তার মত একজন কৃতবিদ্য মানুষ আমার লেখার এভাবে প্রশংসা করছেন, মানুষকে বলে বেড়াচ্ছেন এটা আমি মানতে পারতাম না কিছুতেই।  মাঝে মধ্যে ফোন করে মৃদু বকুনিও দিতাম এসব ঢং করার জন্য। তিনি স্মিত হাসতেন। বড্ড প্রশ্রয়ের সে হাসি। পরের দিকে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। জানতাম মীজান রহমান এমনই। আজ তিনি মারা যাবার পর এখান ওখান থেকে জানলাম এ কাজটা শুধু তিনি আমার সাথেই করেননি  আরো অনেক লেখকের সাথেই করেছেন। ডেইলি স্টারের কলামিস্ট মাহফুজুর রহমান মুক্তমনার ইংরেজি ব্লগে একটি লেখা দিয়েছেন A tribute to Dr. Mizan Rahman শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেছেন, ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়ে অন্য কারো থেকে ফোন নম্বর যোগাড় করে মাহফুজ সাহেবের বাসায় ফোন করেছিলেন মীজান রহমান সুদূর অটোয়া থেকে। এর  আগে এমনকি চিনতেনও না তাঁকে।  কেবল লেখাটি ভাল লেগেছিল বলেই নম্বর যোগাড় করে ফোন করেছিলেন।  কত নিরহংকারী একজন মানুষ হলে এটা করা সম্ভব!  শিক্ষা, সংস্কৃতি, মনন এবং চিন্তায় তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই হিমালয়তুঙ্গস্পর্শী একজন মানুষ। অথচ কারো চিন্তার সাথে ঐক্য হলে, কারো লেখা ভাল লাগলে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে আপন করে নিতে কুণ্ঠিত হতেন না কখনোই।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি কেবল প্রশংসাই করে গেছেন। যেখানে দরকার সমালোচনাও করেছেন বিস্তর। কিন্তু তার শেখানোর পদ্ধতিটাও ছিল তাঁর মননের মতোই মার্জিত, আলোকিত। যেমন মনে পড়ছে, গত বছরের জানুয়ারিতে দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিরক্ত হয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম, সুধাংশু তুই পালা শিরোনামে।  শামসুর রহমানের একটা বিখ্যাত কবিতা আছে সুধাংশু যাবে নানামে। কবিতাটা এরকমের -
লুণ্ঠিত মন্দির, আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে
একটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো
আখেরে কি তুমি চলে যাবে? বেলা শেষে
সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে
বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা,
স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।

স্বর বলে, লুটেরা তোমাকে জব্দ করে
ফেলে আশে পাশে
তোমার জীবনে নিত্যদিন লেপ্টে থাকে
পশুর চেহারা সহ ঘাতকের ছায়া,
আতঙ্কের বাদুড় পাখার নিচে কাটাচ্ছ প্রহর,
তবু তুমি যেও না সুধাংশু।

আকাশের নীলিমা  এখনো
হয়নি ফেরারি, শুদ্ধাচারী গাছপালা
আজও সবুজের
পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী
কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না

আমি আমার লেখায় হতাশা আর বিরক্তি প্রকাশ করে লিখেছিলাম, দেশের যা অবস্থা - এখন আমি রোমান্টিক কবির মতো  এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও, পরাজিত সৈনিকের মতো সুধাংশু যাবে না বলে অহংকার করি না, বরং প্র্যাক্টিকাল হয়েই ভাবি আমার কাতর মিনতি বন্ধু সুধাংশু, এখনই তুই পালা

এর কিছুদিন পরেই মীজান রহমান আমার লেখাটির প্রত্যুত্তরে মুক্তমনায় লিখলেন, না, তারা যাবে না কোথাও। স্পষ্ট করেই বললেন মহামূল্যবান কিছু কথা,যা আমি  নতমস্তকে  শিরোধার্য করে আছি আজও :
আমরা মুসলমান জাতি নই, আমরা হিন্দু জাতি নই, বৌদ্ধ বা খৃস্টান জাতি নই, চাকমা বা সাঁওতাল জাতিও নই, আমরা মানবজাতি। আমরা একটি বাঙালি জাতি। আমাদের জাতিসত্তা এক, আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এক, আমাদের বর্ণগোত্র সব এক। এমনকি আমাদের ধর্মও একসেই ধর্মের নাম মানবধর্ম। এই মানবধর্ম শব্দটি যাদের অভিধানের অন্তর্গত নয়, এই শব্দটি যারা উচ্চারণ করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়নি বা উচ্চারণ করতে অনিচ্ছুক, তারা আমাদের দেশে অবাঞ্ছিত, অনাদৃত। দেশ যদি কাউকে ছেড়ে যেতেই হয় তাহলে সংখ্যালঘুরা ছাড়বে না-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-চাকমা-সাঁওতালরা ছাড়বে না। ছাড়বে যাদের উপস্থিতি আমাদের পথের চলাকে বারবার, বার বার, প্রতিহত করেছে, আমাদের জাতীয় সম্মানকে খর্ব করে দিয়েছে, আমাদের জাতীয় পতাকাকে, জাতীয় সঙ্গীতকে, জাতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অপমান করেছে, তারা

আদ্যোপান্ত মানবতাবাদী ঋজু বাঙালি -এই হচ্ছেন মীজান ভাই।  বয়সে আমার বাবার থেকেও বড়। কিন্তু আমাদের কাছে উনি সব সময়েই ছিলেন মীজান ভাই হিসেবে। আমার স্ত্রী বন্যা অবশ্য আরো অনেক আগে থেকেই তাঁকে চিনতেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি।  তিনি ছিলেন কানাডার সকল মুক্তমনা এবং প্রগতিশীল তরুণ-তরুণীদের কাছে একেবারে ছায়ার মতোন।  অটোয়ার অনেকেই মীজান ভাইকে চিনতেন। মণিকা রশীদ, লুৎফুন্নাহার লতা, ভজন সরকার, সদেরা সুজন, ফেরদৌস নাহার, শফিউল ইসলাম সহ অনেক তরুণ তরুণীর একেবারে কাছের মানুষ ছিলেন মীজান ভাই। ছিলেন বাঙালিদের আড্ডার মধ্যমণি। মীজান ভাইয়ের প্রয়াণের খবরটা শুনেই মণিকাকে ফোন করেছিলাম। ততক্ষণে মণিকার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন মীজান ভাই, এত ঝড় ঝাপটার জীবনে আমার একমাত্র আশ্রয়টুকু নিয়ে চলে যেতে পারলেন! এই অসহ্য রোদের মধ্যে আমি এখন কার ছায়ার নিচে গিয়ে দাঁড়াবো! । আমি যখন ফোন করলাম, তখনো তিনি কাঁদছেন। অনেককেই এভাবে কাঁদিয়ে গেলেন মীজান ভাই। মাথার উপর থেকে হঠাৎ ছাদ সরে গেলে কার না কান্না হয়।  মীজান রহমানকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে আমারও কি  গলাটা আটকে আসেনি? কান্না আমিও থামাতে পেরেছি কই?

মীজান ভাই মারা গেছেন এ মাসের ৫ তারিখ। আজ আট তারিখে আমি যখন এ লেখা লিখতে বসেছি প্রাথমিক শোক আর কান্না কাটিয়ে; ধাতস্থ হতে পেরেছি একটু হলেও। তাই ঠিক করেছি তার সম্বন্ধে কিছু প্রয়োজনীয়  কথা লিখব। মীজান রহমানের কিছু দিক ছিল যা হয়তো এমনকি তার কাছের মানুষেরাও অবহিত নন।  তিনি সম্ভবত ছিলেন কানাডার প্রথম বাংলাদেশি অধ্যাপক। তিনি শুধু গণিতবিদই ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের সময়টিতে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠিত করেছিলেন, তাদের দিয়ে তহবিল গঠন করে কোলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনারের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। এই অর্থসাহায্য থেকেই  মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র এবং খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রবাসে জনমত গঠন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী গণহত্যার সঠিক চিত্র তুলে ধরে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারকে চিঠি পাঠানো সহ  স্বাধীনতা যুদ্ধে পরোক্ষভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন তিনি।  তার লেখালিখিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল স্পষ্ট। এমনকি মুক্তমনায় যে লেখাগুলো পোস্ট করতেন, সেগুলো তিনি শেষ করতেন মুক্তিসন উল্লেখ করে।

তিনি ভাল রান্না করতেন। তবে সেটা যতটা না শখে তার চেয়েও বেশি বোধ করি জীবনের প্রয়োজনে।  অনেকেই হয়তো জানেন না, মীজান রহমানের স্ত্রী মারা যাবার আগে দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। বহু বছর।  মীজান রহমান তখন একা হাতে সংসার সামলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করিয়েছেন, বাসায় ফিরে এসে রান্না বান্না করেছেন, স্ত্রীকে খাইয়েছেন, তার যাবতীয় পরিচর্যা করেছেন। শুধু তাই নয়, তার ছোট দুই ছেলেকে একা হাতে মানুষ করেছেন। তার দু ছেলে বাবু এবং রাজা বলা যায় মীজান রহমানের হাতেই মানুষ হয়ে বাড়ির গণ্ডি ছেড়েছেন।  এই ধরণের অনুপম দৃষ্টান্ত বাঙালি সমাজে খুব বেশি দেখা যায় না।

মীজান রহমান ছিলেন মনে-প্রাণে আমূল নারীবাদী। প্রথাগত জেন্ডার-রোলে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। রান্না বান্না করা, বাচ্চা মানুষ করা  যারা মেয়েদের কাজ মনে করতেন, মীজান রহমান কেবল তত্ত্বে নয়, ব্যবহারিক প্রয়োগেও এই সমস্ত আপ্তবাক্যকে ভুল প্রমাণ করে গেছেন। তার সামনে নারীদের অপমান সূচক কোন কথা বলা যেত না, তা যতই হাস্যরসে বলা হোক না কেন। কতবার আমার স্ত্রী বন্যাকে খোঁচাতে গিয়ে মীজান ভাইয়ের  চোখ রাঙানি খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।


২০১২ সালে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত মীজান রহমানের বই 'শূন্য'

আন্তঃ ধর্ম বিয়ের খুব বড় সমর্থক ছিলেন মীজান ভাই। এ নিয়ে কোন আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা না হলেও তার বায়াস টের পেতাম। আমাকে এবং আমার স্ত্রী বন্যাকে তাঁর ভাল লাগার একটা বড় কারণ আমি বুঝি, তাঁর দৃষ্টিতে আমরা ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে জীবন সাজাতে পেরেছি। আমাদের কাছে এটা তেমন কোন বড় ব্যাপার না হলেও পরে  অবাক হয়ে জেনেছি এ  ধরণের অন্য সকল দম্পতীরাও কীভাবে মীজান রহমানের খুব প্রিয়। ধর্মীয় বৈরিতা এবং প্রাচীরের কারণে দুটি পুরুষ এবং নারী একসাথে থাকতে পারছে না জানলে তার কষ্ট হত। তার পালিতা কন্যা উর্বী এবং জীবনকে শেষ বয়সে এসে এতোটা আপন করে নিয়েছিলেন হয়তো এসমস্ত কারণেই। তাঁর মধ্যে কোন সংকীর্ণতা ছিল না। আসলে চিন্তায় মননে তিনি এতোটাই অগ্রগামী ছিলেন যে, অনেক প্রগতিশীল তরুণদেরও লজ্জায় ফেলে দিতে পারতেন।


২০১২ সালের একুশে বই মেলা মীজান রহমান, বিজ্ঞান লেখক ফারসীম এবং আমি

আর তাঁর লেখালিখি নিয়ে নতুন করে আর কি বলব? তাঁর গদ্যরীতির দারুণ ভক্ত ছিলাম আমি। তাঁর ভাষা ছিল খুব আধুনিক, ঝরঝরে। গ্রামের পাশ দিয়ে কুল কুল রবে বহমান নদীর মতো যেন।  অনলাইনে তার ব্লগগুলো তো বটেই তার বইগুলো পড়লেও তাঁর ভাষার প্রাঞ্জলতা উপলব্ধি করবেন পাঠকেরা। তিনি শূন্য নামে একটি বই লিখেছিলেন ২০১২ সালে।  শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত এ বইটির কথা আগেও বলেছি। গণিতের বিষয়াদি নিয়ে বই। কাজেই অনেক কাটখোট্টা বই হবার কথা। কিন্তু মীজান রহমানের লেখনীর গুণে হয়ে উঠলো ঠিক বিপরীত। এ বইটির রিভিউ করেছিলাম একসময়। রিভিউটি মুক্তমনায় প্রকাশিত হয়েছিল, প্রকাশিত হয়েছিল আহমাদ মাযহার সম্পাদিত বইয়ের জগৎ পত্রিকাতেও।  মীজান রহমানের ভাষার প্রাঞ্জলতায় মুগ্ধ-পাঠক বনে গিয়ে লিখেছিলাম
এ ধরণের বইয়ের পূর্বশর্ত হল ভাষার প্রাঞ্জলতা। মীজান রহমানের বই পড়ে আমার মনে হয়েছে তার ভাষা তার চিন্তার মতোই যেন সাবলীল। তিনি ভাষার অনাবশ্যক বাগাড়ম্বর এড়িয়ে চলেন। অধ্যাপকীয় কায়দায় ভাবগম্ভীর এবং নিরর্থক শব্দরাজির কথামালা সাজিয়ে জ্ঞান জাহির করতে থাকেন না, বরং থাকেন যতদূর সম্ভব সাধারণ পাঠকের চিন্তার কাছাকাছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানীরা যখন পাঠকদের জন্য সাধারণ একটা বিজ্ঞানের লেখা লিখতে গিয়ে অহেতুক অবিমৃশ্যকারী কিংবা কুজ্ঝটিকার মতো জাড্য বল, জাড্য কাঠামো, বিচ্ছুরণ-প্রস্থচ্ছেদ, পর্যায়ী বস্তুনিচয়  জাতীয় শব্দরাজির ব্যাপক সমাহার ঘটান, গঠন করেন প্লাংকের কোয়ান্টাম তত্ত্বে বলা হয় যে, মানুষের পক্ষে কোনো বিকিরণ কম্পকের শক্তির পরিমাণ সীমিত নির্ভুলতা ছাড়া চিহ্নিত করা যায় না টাইপের  বিরক্তিকর ধরণের একঘেয়ে জটিল বাক্যরাজির, সেখানে মীজান রহমান কোয়ান্টাম জগতের নিয়ম কানুন ব্যাখ্যা করেন অনুপম ছন্দে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এক দুঃসাহসী চিন্তা নিয়ে খেলা করতে লাগলেন মনে মনে ছোট কণারা বড়দের মত একটানা রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে চলে না, তারা চলে অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে, অনেকটা ব্যাঙ যেমন করে চলে (শূন্য, পৃষ্ঠা ৮৩)

২০১২ সালে বই মেলায় প্রকাশিত বিজ্ঞান এবং গণিতের বইগুলোর মধ্যে শূন্য বইটিকে অন্যতম  গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে আমি বিবেচনায় রেখেছিলাম। শুধু তাই নয়, বইটি সেটি পড়তে গিয়ে এবং রিভিউ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম যুগপৎ বিজ্ঞান এবং বাংলা সাহিত্যে এমন বই  দুর্লভ।  আর পাশাপাশি তিনি বোধ করি ছিলেন বাংলা ব্লগ-জগতের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগার। চিরতরুণ মীজান ভাই ছাড়া ৮২ বছর বয়সে আর কেউ কি এভাবে বাংলায় ব্লগ করে গেছেন

আমার সাথে একটা বই লেখার কথা ছিল তাঁর। তার মত সফল একাডেমিয়ান এবং সুসাহিত্যিকের আমার মতো ছাপোষা কারো সাথে কিছু লেখার কথা নয়। কিন্তু লিখলেন। বিপুল উৎসাহে প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার একটা বই লিখে শেষ করে ফেললেন। পাণ্ডুলিপি শেষ করে আমরা দুজন মিলে বইটার শিরোনাম দিলাম -   শূন্য থেকে মহাবিশ্ব।  প্রচ্ছদও হয়ে গেল। বইটা নিয়ে দারুণ উচ্চাশা ছিল তাঁর।  বইটি নিয়ে কথা হইলেই  শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন তিনি। পাণ্ডুলিপি গত বছরই জমা দেয়া হয়েছিল।  কিন্তু  বইটি দেখে যেতে পারলেন না। শুদ্ধস্বরের প্রকাশক টুটুলকে প্রায়ই ইমেইল করতেন বইটার ব্যাপারে। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সময় ফুঁরিয়ে আসছে দ্রুত।  বইটি শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারলেন না।  শূন্য থেকে মহাবিশ্বর পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে শূন্যেই হারিয়ে গেলেন প্রিয় মীজান ভাই।


শূন্য থেকে মহাবিশ্ব মীজান রহমানের সর্বশেষ বই, কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারলেন কই?

আজ হোক, কাল হোক বইটি হয়তো বেরুবে, কিন্তু আমি আমার যদ্যপি আমার গুরু মীজান ভাইকে কোথায় খুঁজে পাব? কোন্‌ ঠিকানায় পাঠাবো আমি বইয়ের প্রকাশিত কপিগুলো?
----

অভিজিৎ রায়: ব্লগার এবং বিজ্ঞান লেখক।
২০১৫ জানুয়ারী ০৯

Appendix A: Technical Communications via Email and Facebook

ই-যোগাযোগ ২০১৫ জানুয়ারী ০৮-০৯

It looks like BDNews did not publish the article with all the pictures.

Here is my complete article in Doc format

Avijit


From: "shafiul_i@yahoo.com" <shafiul_i@yahoo.com>
To: charbak_bd@yahoo.com 
Sent: Friday, January 9, 2015 8:43 AM
Subject: Re: Remembering Mizan Bhai

Avijit 'Da,

Doc files pl with your name, city, date and publication ref if applicable....

Shafiul

Mizan Bhai (Dr. Mizan Rahman) was a brilliant mathematician, freethinker, rationalist and a prolific writer; he was very dear to me.  He was a regular contributor to our Mukto-Mona blog. He and I had been even planning to write a new book, ‘Shunno theke mohabisshyo’, but he is no more to see it :(


He will be a great inspiration to us all.

Regards
Avijit

২০১৫ জানুয়ারী ০৮

Greetings Friends,

Thank you for your email.

We have been compiling Dr Mizan Rahman's memoirs, interviews and articles on Facebook 'আকাশভরা, সূর্য-তারা ....' Album (this discussion thread) and Vision Creates Value Blog. May we seek our continual support to enrich his archive? Please feel free to submit/advise any resources that you wish to see in the archive. Links to Dr Mizan Rahman's Interviews, Memoirs and Articles: Vision Creates Value: Mizan Rahman
Moments with Dr Mizan Rahman (*-*) :: Interview and Links to his Selected Articles: Vision Creates Value: Amazing Visionary Journey of Dr Mizan Rahman

Link to Dr Mizan's Memoirs on FB Album  'আকাশভরা, সূর্য-তারা ....' : https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10152657329914503&set=a.10152002909239503.1073741873.771659502&type=3&theater

You will find Dr Mizan's 74 posts on Vision Creates Value Blog plus selected comprehensive links  to his published interviews and articles. Stay tuned.... More to come....

We appreciate your continual support....

Best wishes to your endeavors.

Shubharthee,
Shafiul
Vision Creates Value Team
Shafiul Islam, PhD, CText FTI | 1-519-267-5585 | Skype: shafiul2010 | www.linkedin.com/in/shafiul2009
This communication is confidential and may contain privileged information protected by privacy and intellectual property legislation. Unauthorized use is strictly prohibited. If you are not the intended recipient or have received this communication in error, please notify the sender immediately. Thank you.

On Thursday, January 8, 2015 12:35 AM, Babu S. Rahman <cdnhoser@msn.com> wrote:

 
I regret to inform you that my dear father passed on 1/5/15 at 7:28PM. The janazah and burial were held today. Our deepest thanks for all the support and love from family, friends and fans.
 
There will be a memorial for Abu.
 
Function details:
 
Light snacks will be served.
 
Friday Jan 9, 2015
6 – 8 PM
 
Location:
Overbrook Community Centre
33 Quill Street
Ottawa, ON, K1K 4E7
613-742-5147;  613 742-5150   
 
The format is intended to be very free-flowing, with essentially an open microphone.
 
Our contact number: 613-224-9146
 

Regards
Babu

No comments:

Post a Comment