Tuesday 24 April 2012

Sukher Kotha Bolo Na Aar - Dwijendra Geeti - Anup Jalota

Sukher Kotha Bolo Na Aar - Dwijendra Geeti - Anup Jalot


দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, Dwijendralal Ray, Songs, দ্বিজেন্দ্রগীতি, Video,

Published on Apr 24, 2012 by
Sukher Kotha Bolo Na Aar - Dwijendra Geeti - Anup Jalota
অনুপ জালোটা 

Category:

License:

Standard YouTube License

না ভোলার কাব্য ♥♪♥

নূরুন্ নাহার

(মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার রোকনুজ্জামান রবার্ট স্মরণে)

তোমার ওপারে যাওয়ার টিকিট-
বুকিং দেওয়া হয়েছিল শুনেছিলাম।
কখন যেন চলে যাও-
ভয়ে-ভয়ে তাই দিন গুনছিলাম।
ভবিষ্যত ভাবুকের মত ভাবছিলাম-
তুমি হয়তো চলে যাবে, বসন্তে অথবা বৈশাখে।
টিকিটের সিরিয়াল কবে পাবে-
দিন-ক্ষণ কিছুই জানা ছিলনা;
তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শেষ দেখা হলোনা!
তুমি যেদিন চলে গেলে-
সেদিন মাঝ রাতেই কোকিল ডেকেছিল;
ভার কণ্ঠে তোমার ওপারে যাওয়ার কথা গোপনে বলেছিলো।
সবাই আজ তোমার কথা-
জনে-জনে কানে-কানে বলছে,
তোমার আত্মার চার পাশ ঘিরে-
ময়ূরেরা পেখম মেলে নাচছে
প্রজাপতিরা পরীর মত পাখা দুলিয়ে হাসছে।
তোমাকে নিয়ে আমাদের কত কথার মিটিং চলে
থানা রোডে পাবলিক লাইব্রেরির বিশ্বস্ত টেবিলে।
তোমার কবিতার কথা-
স্বপ্নের সিথানকাব্য যেন সংস্কৃতির উঠোনে অমূল্য রতন।
আমরা তোমাকে একবারও ভুলিনি।
তোমাকে ভোলেনি গাছের পাতারা, গ্রীস্মের সিঁদুর রাঙা কৃষ্ণচূড়ারা
ঘাস ভেজা শিশিরেরা-
পাঁচ গাঁয়ের এঁকে বেঁকে যাওয়া মেঠো পথেরা।
সাঁঝ রাতে জ্বলে ওঠা বাঁশ বনে জোনাকিরা আলোরা
রংধনুর সাত রংআ আভারা-
তোমাকে ভোলেনি-
রক্তে ধোয়া এই বাংলার নাগরিকেরা।
তুমিতো এই মানচিত্রের বরেণ্য সংস্কৃতিবান মানবিক মুক্তিযোদ্ধা।
তোমাকেতো ভোলা যায়না-
হয়তোবা ভোলা যাবেনা কোনদিন,
তাইতো তোমার কাছে আমাদের
একগুচ্ছ শাপলার হাসির মত
হৃদয় জোড়া নাগরিক ঋণ।

প্রকাশ সূত্র : খোন্দকার রোকনুজ্জামান রবার্ট
স্মরণ
শৈলকুপা নাগরিক কমিটি। শৈলকুপা, ঝিনাইদহ।
১০ই জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯, ২৪ মে ২০১২



Nurun Nahar, নূরুন নাহার

Thursday 19 April 2012

'নিঃসঙ্গতাই আমার এক ধরনের সঙ্গী'-ড. মীজান রহমান

 নিঃসঙ্গতাই আমার এক ধরনের সঙ্গী'-ড. মীজান রহমান


 
ড. মীজান রহমান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান গণিতবিদ। গণিতশাস্ত্রে তার ব্যুৎপত্তি, সাহিত্যে আকুতি। দেশ ছেড়েছেন প্রায় পাঁচ দশক আগে। কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের ডিসটিংগুইশ প্রফেসর এমিরেটস ড. মীজান রহমানের পেশাগত জীবনের শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও পদার্থবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৫৪ সালে ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার পর উচ্চশিক্ষার্থে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন। সেখানে গণিতশাস্ত্রে বিএ, এমএ ডিগ্রি। ১৯৬৫ সালে কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ব্রানসউইক (Brunswick) থেকে পিএইচডি। কানাডার অটোয়া শহরের কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগেই কেটেছে তার বর্ণাঢ্য গণিতজ্ঞ জীবন। ‘হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজ’ নিয়ে তার লেখা (সহলেখক) বই, গণিতশাস্ত্রে খুবই উচ্চতম কাজ বলে স্বীকৃত।
পশ্চিমা একাডেমিক জগতে গণিতশাস্ত্রের অত্যন্ত গুণী এই অধ্যাপকের হৃদয়ে সাহিত্যের অনুরণন তাকে বাংলাভাষার কাছেই এনেছে শেষাবধি। ১৯৯০ সাল থেকে আমেরিকা, কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রপত্রিকা, ব্লগ, ইন্টারনেটে ড. মীজানের লেখনি খুবই পরিচিত। ইতোমধ্যে দশটির বেশি বই বেরিয়েছে তার। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস সর্বত্রই তার অপার আনন্দ। সুখ-দুঃখের এক ব্যতিক্রমী জীবন তার। নিঃসঙ্গতা আর সঙ্গসুখের দু’জীবন উদযাপন করেন দার্শনিক আনন্দময়তায় নৈর্বক্তিক নিরাসক্তির মিশেলে। ঢাকায় এসেছিলেন সম্প্রতি। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২, ঢাকার গুলশানে তার সঙ্গে কথা হয় জীবন ও ভাবনা নিয়ে। বিস্তর এ কথোপকথনকে তিনি আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার বলতে রাজি না হলেও তার জীবনের লড়াই-সংগ্রাম-উত্থান-পতন-সুখ-আনন্দের এক বড় ছবি আছে এখানে। সাপ্তাহিক-এর পক্ষ থেকে কথা বলেছেন শুভ কিবরিয়া
সাপ্তাহিক : আপনি জন্মেছেন কত সালে, কোথায়?
ড. মীজান রহমান : ১৯৩২ সালে। ঢাকা শহরে। আমার বাবার জন্ম হাসনাবাদ নামে একটি গ্রামে। রায়পুরা থানার অন্তর্গত নরসিংদী জেলায়। এখন শুনেছি এটা কেরানীগঞ্জ উপজেলাধীন, ঢাকা জেলার অন্তর্গত। সেকালে নরসিংদী শহর ছিল না। ছিল সাপ্তাহিক একটা বাজার। নরসিংদী, মাধবদী, মনিপুর, আটিয়াবাদের একটা অংশ ছিল সাপ্তাহিক হাট। যদিও আমার জন্ম, লেখাপড়া ঢাকা শহরে।
সাপ্তাহিক : ঢাকার কোথায় থাকতেন?
ড. মীজান রহমান : আমার জন্ম রোকনপুর বলে একটা ছোট পাড়ায়। সেটা এখনকার পুরনো ঢাকায় কলতাবাজার পাড়ার সংলগ্ন রোকনপুর। আমার বাবা চাকরি করতেন ফৌজদারি কোর্টে। উনি ছিলেন সাধারণ বেতনভোগী পেশকার।
বাবার নাম ছিল  মোহাম্মদ আলী। যেহেতু উনি ঢাকার ফৌজদারি কোর্টে চাকরি করতেন সেহেতু কাছাকাছি বাসা রাখাই ছিল সুবিধা। আমার বাবা ও মা দুজনের জন্মই গ্রামে। তারা বড় হয়েছেন গ্রামে এবং আমার জন্মকালে বাবা ও মার, বিশেষ করে বাবার ভীষণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল গ্রামের সঙ্গে। একেবারে নাড়ির সম্পর্ক। আমার ছোট দুই চাচা ছিলেন, ফুফু ছিলেন চারজন। তারা সবাই গ্রামে থাকতেন। সে সময় গ্রামভিত্তিক সমাজ ছিল। আমি এখনও গর্বের সঙ্গে বলি আমার গায়ে গোবরের গন্ধ আছে। এটা এই ভাবনায় বলি সে কালের মাটির যে স্বাদ, সেই স্বাদ প্রধানত আসত গোবর থেকে। সুতরাং ঐ যে গোবরের সঙ্গে আমাদের নাড়ির একটা যোগসূত্র সেটা যে মানুষ ভুলে যায়, সে মানুষ নিজের মূলটাকেই ভুলে যায়।
সাপ্তাহিক : আপনার ছোটবেলার জীবন?
ড. মীজান রহমান : কলতাবাজারে। সেখানে বড় বড় দেয়াল ছিল। সূর্য উঠত কি উঠত না বোঝাই যেত না। দেয়ালগুলো শেওলায় ঢাকা থাকত। দেয়াল ফুঁড়ে বটের চারা গজাত। সেখানে ছিল বিরাট ছাদ। রাস্তায় বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেতাম খোলা পায়খানা থেকে গামলা ভেঙে মল বেরিয়ে আসছে। সেই দুর্গন্ধ ঢাকতে নাকেমুখে কাপড় গুঁজে দৌড় দিতাম সেখান থেকে। আমার বোনেরা যে কিভাবে এই পরিবেশে স্কুলে যেত, কিভাবে মানুষ হয়েছে তা এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা!
সাপ্তাহিক : আপনারা কয় ভাইবোন ছিলেন?
ড. মীজান রহমান : আমরা নয় ভাইবোন। পাঁচ ভাই, চার বোন। আমি ছিলাম ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আমরা সবাই জীবিত, একজন ছাড়া। আমার যে ইমিডিয়েট ছোট বোন ছিল, জোবেদা। আমার বোন, আমার খেলার সাথী, সেই সব থেকে আগেই বিদায় নিয়েছে। বাকিরা বেঁচে আছে। যদিও সবাই বার্ধক্যের পথে।
সাপ্তাহিক : সবাই কি ঢাকাতেই থাকেন?
ড. মীজান রহমান : না, না। দুই ভাই দেশের বাইরে। একজন অস্ট্রেলিয়াতে, একজন ওয়াশিংটনে। এক বোন থাকে লণ্ডনে। বাকিরা সবাই বাংলাদেশে। যে বোনটি মারা গেল, সে বোনটি ১৯৬৩-৬৪ সালে চাকরির কারণে পাকিস্তানে চলে যায়। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করে তারপর সোশ্যাল স্টাডিজে ঢুকে। সে ছিল উন্নয়নকর্মী। সেখান থেকে চলে যায় করাচিতে। করাচি থেকেই সে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষা দেয়। মেয়েদের মধ্যে সে দ্বিতীয় পজিশন পায়। ফলে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়। মিনিস্ট্রি অব ইকোনমিক্সে তার চাকরি হয়। সেখানেই কাশ্মীরে এক ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং বিয়ে হয়। সেখানেই সে স্থায়ী আবাস গড়ে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বোনটি পাকিস্তানে।
এটা খুব কষ্টের কাহিনী। সে মারা গেল ১৯৮৬ সালে।
সাপ্তাহিক : এর মধ্যে সে আর বাংলাদেশে আসেনি?
ড. মীজান রহমান : এসেছে। দেশ স্বাধীন হবার পর একবার না দুবার এসেছে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল একবার লন্ডনে। আমি কোনো একটা কনফারেন্সে কানাডা থেকে লন্ডনে যাচ্ছিলাম। পথে সামান্য সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল।
আমার জীবনে এটা একটা কষ্টের স্মৃতি। তাকে নিয়ে ‘আবার দেখা হবে’ শিরোনামে একটা লেখা লিখেছি। আমার এক বইয়ে লেখাটি আছে।
সাপ্তাহিক : আপনার স্কুল-কলেজে লেখাপড়া কোথায়?
ড. মীজান রহমান : প্রথমে মায়ের কাছে। মার নাম ছিল আছিয়া খাতুন। মার সম্পর্কে ‘মা’ বলে একটি লেখা আছে আমার। She was like a shadow, lived like a shadow, died like a shadow. তিনি ছিলেন ছায়ার মতো। বেঁচেছেন ছায়ার মতো, মরেছেন ছায়ার মতোই। ‘মা’ এমন একটা সম্পর্ক, যতদিন ‘মা’ জীবিত থাকে ততদিন তাকে আমরা লক্ষ্যই করি না। তাকে বুঝতে চাই না। তার ভেতরে যে কষ্ট আছে তা ভাবি না। যখন নিজেদের কষ্ট মোচন করার কথা ভাবি, তখনই মায়ের কাছে যাই। মা আমাদের কষ্টের ওপর মলম মেখে দেয় তার কথা দিয়ে, স্নেহ দিয়ে। কখনই আমরা ভাবি না তিনি শুধু মা’ই নন, তিনি একজন নারী। আমাদের সবচাইতে বড় দুর্বলতা বা ফাঁক হলো এখানেই। আমরা মায়ের বাইরেরটাই দেখি, কিন্তু তার ভেতরের খবর একেবারেই রাখি না। আমার ‘মা’ হচ্ছেন তেমনই একজন মানুষ। সেই মায়ের কাছেই আমার লেখাপড়ার শুরু।
আমরা ভাইবোনরা কোনোদিন কোনো পাঠশালায় যাইনি।
সাপ্তাহিক : বাবার কথা?
ড. মীজান রহমান : বাবা ছিলেন স্বল্প বেতনের চাকুরে। কেরানি। বাবার একটা ত্রুটি ছিল। উনি ছিলেন একজন সৎ কেরানি। সৎ কেরানি হলে তার পরিবারের যে কি দুর্গতি হয় সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ঐ যে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া, জীবন দেখাÑ আমি সেটাকেই বলি ‘অভাবের সিন্ধুক’। সেই অভাব থেকেই আমাদের স্বপ্নের জন্ম। আমাদের জীবনে যতকিছু প্রেরণা, তাড়না, বাসনা, আকাক্সক্ষার যে প্রচণ্ড স্ফূর্তি সবকিছুর মূলেই হলো সেই ‘অভাব’। সেই অভাবের মধ্যে আমরা নয় ভাইবোন একসঙ্গে থেকে নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করে, শেয়ার করে বড় হয়েছি। একই বিছানায় হয়ত চারজন করে থাকতাম, একটা টেবিলে প্রায় পাঁচজন একত্রে বসে একটা হারিকেনের আলোতে পড়তাম। এভাবে কষ্ট করে করে আমরা মানুষ হয়েছি।
সাপ্তাহিক : আপনার স্কুলের কথা!
ড. মীজান রহমান : কলতাবাজারের মুসলিম হাইস্কুলে পড়েছি। আমরা সব ভাই ঐ একই স্কুলে পড়েছি। মুসলিম হাইস্কুলে যাবার দুটি কারণ ছিল। প্রথমত এটা বাসার একেবারে কাছাকাছি। হেঁটে যাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত এটা ছিল মুসলিম হাইস্কুল। বাবা, সনাতন সেই কালের মানুষ। সেই কালে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে একটা সামাজিক টেনশন ছিল। সুতরাং সে সময় মুসলমানরা মুসলমানদের জায়গায়, হিন্দুরা হিন্দুদের জায়গায় যেত। এটিই ছিল আমাদের রেওয়াজ। Two nations, two solitudes.
সাপ্তাহিক : মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করলেন কত সালে?
ড. মীজান রহমান : ১৯৪৮ সালে। আমি বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান পাইনি। কেননা পরীক্ষার সময় আমার বাবা অসুস্থ ছিলেন।
সাপ্তাহিক : ১৯৪৮ সাল, দেশভাগের পরপর একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল।
ড. মীজান রহমান : খুবই টেনশন ছিল। তখনই আমার বাবার হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হব তখনই বাবার এই সমস্যা দেখা দেয়। ঢাকার সে সময়ের বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. মন্মথ নন্দী ছিলেন গরিবের একমাত্র সহায়। উনার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তখন কঠিন দারিদ্র্য ছিল। তবুও সেকালে গরিবের বন্ধু ছিল। একালে নাই। সেটাই হলো স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা।
সাপ্তাহিক : তারপরে বাবার অসুখের কি হলো?
ড. মীজান রহমান : বাবা আস্তে আস্তে সেরে উঠলেন। But not before I had lost a lot of time. হয়ত এটা আমার ভাগ্যই। আজ মনে হয়, এটা হয়ত একটা অজুহাত ছিল আমার ভালো রেজাল্ট না হবার। সে সময় অন্য কারণে হয়ত আমার মানসিক শৃঙ্খলার অভাব ছিল।
সাপ্তাহিক : কলেজে পড়তে কোথায় গেলেন?
ড. মীজান রহমান : জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলাম। আবার দারিদ্র্যের কথায় আসি। আর্থিক সম্পন্নতা থাকলে আমি হয়ত ঢাকা কলেজেই ভর্তি হতাম। ঢাকা কলেজ অনেকটা দূরে। কিন্তু ঢাকা কলেজে যেতে হলে বাস অথবা রিকশায় যেতে হতো। অথবা সাইকেলে। এর কোনোটারই সামর্থ্য আমাদের ছিল না। মুসলিম হাই স্কুলে যখন পড়তাম, তখন দুটো বৃত্তি পেতাম। একটা হলো স্কলারশিপ আরেকটা হলো পুওর ফান্ডের বৃত্তি।
এভাবেই লেখাপড়া করেছি। সৌভাগ্যবশত আমরা অসাধারণ সব শিক্ষক পেয়েছি মুসলিম হাইস্কুলে। ইব্রাহিম খলিল ছিলেন আমাদের বাংলার টিচার। ইংরেজি পড়াতেন হেডমাস্টার আব্দুর রহমান। এঁদের কাছে শিখেছি অত্যন্ত স্ট্রং ইংলিশ। যদিও ভিক্টোরিয়ান টাইমের ইংলিশ, অত্যন্ত স্ট্রং প্রপার ইংলিশ। বাংলা টিচার ইব্রাহিম খলিল আমাকে বলতেন, দেখ মীজান, যদি তুমি ভালো বাংলা শিখতে চাও তবে ইংরেজিটা ভালো করে শেখ। ভালো ইংরেজি শিখতে চাইলে বাংলা ভালো করে শেখ। স্কুলে শিক্ষকরা অবশ্য ভাবতেন, আমি অসম্ভব মেধাবী কিছু করে ফেলব। যদিও আদতেই তার কিছুই হয়নি।
এই যে দুই ভাষার প্রতি গুরুত্ব। একটা মাতৃভাষা, আরেকটা ইউরোপিয়ান ভাষা। অনেকে ভুল করে যে, ইংরেজি একটা সাম্রাজ্যবাদী ভাষা। এটা ঠিক না। ঊহমষরংয রং ধ মধঃবধিু ঃড় ঃযব ড়িৎষফ.  সেটা তখন হিন্দুরা বুঝেছিল কিন্তু মুসলমানরা বোঝে নাই। অবশ্য দুঃখের বিষয় আমরা এখনও ভালো করে সেটা বুঝি না।
আমরা স্কুল থেকে ব্যালেন্স শিক্ষা পেয়েছি। বাংলা ও ইংরেজি দুটোই আমরা ভালোভাবে শিখেছি।
সাপ্তাহিক : আপনার সমসাময়িক কারা ছিলেন?
ড. মীজান রহমান : বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন। মুসলিম হাইস্কুলে আমার একবছর সিনিয়র ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ এক সময় মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন।
সাপ্তাহিক : তারপর জগন্নাথ কলেজে পড়তে গেলেন?
ড. মীজান রহমান : জগন্নাথ কলেজে যেয়ে আমি আরেকটু  পথভ্রষ্ট হয়ে গেলাম। আমি ঢুকলাম সায়েন্সে। কিন্তু আমার ভেতরে পোকাটা ছিল সাহিত্যের। বরাবরই তাই ছিল। আমি যদি বিদেশে জন্মগ্রহণ করতাম সম্ভবত আমি ম্যাথমেটিশিয়ান হতাম না। I am a very poor mathematician. I think I could be better writer.
আমি যদি গোড়া থেকেই সাহিত্য নিয়ে থাকতাম, আমি হয়ত বড় লেখক হতে পারতাম। জগন্নাথ কলেজে যেয়ে, আমার তখন ১৬/১৭ বছর বয়স। টিনএজার। কলেজে যেয়ে আড্ডা মারতে, সিগারেট খেতে শুরু করি। সাহিত্য করতে শুরু করি। নারীদের প্রতি আকর্ষণ শুরু হয়ে যায়। ফলে, পড়াশোনা গেল রসাতলে। বাবার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
সাপ্তাহিক : বাবা কি টের পেলেন যে, আপনি পড়াশোনা ছেড়ে অন্য কিছুতে মনোযোগী হয়ে উঠেছেন?
 ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই অবশ্যই।
সবাই ধারণা করত অসম্ভব ভালো কিছু করব আমি। But I was nobody. তারপর জগন্নাথ কলেজে যেয়ে রাজনীতিতে ঢুকলাম। একদল বলল তোমাকে সাহিত্য সম্পাদক বানাব। বিরাট ব্যাপার। সাহিত্য সম্পাদক হয়ে গেলাম।
সাপ্তাহিক : কোনো রাজনৈতিক দল থেকে?
ড. মীজান রহমান : তখন কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। ছাত্রদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হতে হতো।
সাপ্তাহিক : কলেজে শিক্ষকদের কথা কি মনে পড়ে?
ড. মীজান রহমান : আমি কলেজে ঢুকলাম ১৯৪৮ সালে। তখনও অনেক হিন্দু শিক্ষক ছিলেন। তারা অসম্ভব ভালো শিক্ষক ছিলেন। যেমন হরিপ্রসন্ন ঘোষ, উনি ছিলেন কেমিস্ট্রির (রসায়ন) শিক্ষক। বাংলার অজিত কুমার গুহ, পদার্থ বিদ্যার অখিল দত্ত, ইংরেজির শশাংক বাবু, জীববিজ্ঞানের নীরেন্দ্র গুহ- এরা অসম্ভব ভালো শিক্ষক ছিলেন। আমাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ছিলেন। এসব স্টার শিক্ষকরা তখন আমাদের পড়াতেন।
তারপর এলো ১৯৫০। তখনই অশনির ধ্বনি বেজে উঠল। বাজল শিঙ্গা। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হলো। দাঙ্গাটি হয়নি, দাঙ্গা বাধানো হয়েছিল। তখনকার ঢাকায় রহমতুল্লাহ বলে এক বিহারি ভদ্রলোক ছিলেন, তারই ইংগিতে এই দাঙ্গার ঘটনা ঘটল।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পাকিস্তান হওয়া সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গে যেসব হিন্দুরা ছিল (জন্মসূত্রে যারা এখানকার বাসিন্দা) তারা ১৯৫০-এর দাঙ্গার পরই পূর্ববাংলা ছাড়ল। দাঙ্গাটা বাধানো হয়েছিল এ কারণেই যে হিন্দুদের সরিয়ে বিহারিদের একটা জায়গা দিতে হবে। বাড়িগুলো বিনাপয়সায় দখল করতে হবে। এটাই ছিল তাদের মতলব।
সাপ্তাহিক : আপনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করলেন? রেজাল্ট?
ড. মীজান রহমান : ১৯৫০ সালে। সাধারণ প্রথম বিভাগে। আহামরি কিছু না। তবে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে সে সময় একটা পত্রিকা বের করলাম। সেখানে আমার সমসাময়িক, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল মোস্তফা কামাল, শিল্পী আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ছেলে। পরে যিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। সমসাময়িক ছিলেন ড. মঞ্জুর-ই খুদা (ড. কুদরত-ই খুদার ছেলে)।
সাপ্তাহিক : সে সময় আপনি তো সাহিত্য নিয়ে মাতোয়ারা মানুষ। সাহিত্যজগতের কারও সঙ্গে উঠাবসা সম্পর্ক।
ড. মীজান রহমান : ঐ সময় বেশ বিশিষ্ট লোকজনের সঙ্গে আমার ওঠানামা ছিল। তখনও বিউটি বোর্ডিং শুরু হয়নি। বিউটি বোর্ডিংয়ের যাত্রা শুরু হলো আরও পরে।
সাপ্তাহিক : ১৯৫০ সালে আইএসসি পাস করলেন। এরপর কি পড়বেন, কোথায় পড়বেন এটা কিভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন?
ড. মীজান রহমান : আমি বরাবরই ভালো ছাত্র ছিলাম। আইএসসিতে আহামরি রেজাল্ট ভালো না হলেও স্কলারশিপ পেলাম।  ম্যাট্রিকে ঢাকা বোর্ডে আমি মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করি।
আইএসসিতে প্রাণিবিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যালে আমাকে শূন্য মার্কস দেয়া হয়। কেননা আমি প্রাকটিক্যাল ক্লাসই করিনি। সেজন্য ফলাফল খারাপ হয়।
তবে, অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষকরা আমার ওপর খুব প্রত্যাশা করেছিলেন যে, এই ছেলে সাংঘাতিক ভালো কোনো রেজাল্ট করবে। তারা যখন জানল, প্রাণিবিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যালে শূন্য নম্বর দেয়া হচ্ছে, তখন তারা দেখল সর্বনাশ! যার ওপর আমাদের এত আশা সে যদি শূন্য পায় তো ফেল করে যাবে। তাদের হস্তক্ষেপে প্র্যাকটিক্যালে আমাকে কোনো রকমে পাস নম্বর দেয়া হয়। এই যে আমি প্রাণিবিজ্ঞানে এত কম নাম্বার পেলাম, ফলে মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া হলো না। অন্য বিষয়ে যথেষ্ট ভালো নাম্বারই পেয়েছিলাম। পড়াশুনা না করা সত্ত্বেও রেজাল্ট খারাপ হয়নি।
এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন থেকে আমি বদলে যাব। I want to challenge myself. তখন আমি ফিজিক্সে অনার্স নিলাম।
সাপ্তাহিক : ফিজিক্স কেন?
ড. মীজানা রহমান : তখন ফিজিক্স ছিল ভালো ছাত্রদের কাক্সিক্ষত বিষয়। ইংরেজিতে বলে ‘নিশ’। পদার্থবিজ্ঞানই হলো মেধাবী ছাত্রদের পীঠস্থান। যদিও আমি মেধাহীন মানুষ তবুও মেধাবীদের সংস্পর্শে নিজেকে উন্নত করার আশাতেই ফিজিক্স বিষয়ে পড়তে যাওয়া। ১৯৫০-এর শেষেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স বিভাগে ভর্তি হলাম।
সেখানে আমার সহপাঠী ছিল অধ্যাপক ড. হারুনর রশীদ, অধ্যাপক আবদুল লতিফ, সে সময় আইএসসিতে প্রথম হয়েছিল সালাহ্উদ্দীন (পরবর্তীতে সিএসপি অফিসার হয়)। ফিজিক্সে যারা পড়ত তখন তারা সবাই খুব বিখ্যাত, মেধাবী ছাত্র। সেখানে গিয়ে আমি হাজির। যা হোক, I was not too bad.
ফিজিক্সে অনার্স, সাবসিডিয়ারিতে নিলাম ম্যাথমেটিক্স আর কেমিস্ট্রি (অঙ্ক ও রসায়ন)।
অঙ্কে ভালোই করতাম। কেমিস্ট্রি আমার ভালো লাগত না। বিশেষত ল্যাব। ওটা অসহ্য ছিল। কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরির যন্ত্রণাতেই ভাবলাম, কেমিস্ট্রি ছাড়তে হবে। কিভাবে ছাড়া যায়? তখন খোঁজ নিয়ে দেখলাম, একটা উপায় আছে।
অনার্স নেয়া, ডাবল অনার্স। ম্যাথমেটিক্স ও ফিজিক্সে এক সঙ্গে ডাবল অনার্স নেয়া যায়। সে সময় এই সুযোগ ছিল।
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সুবর্ণ যুগ ছিল। অসম্ভব ভালো তীক্ষèধী ছাত্ররা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত। ওদের চ্যালেঞ্জের জন্য ডাবল অনার্স চালু করা হয়েছিল। ম্যাথমেটিক্স ও ফিজিক্সে ডাবল অনার্স। যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এটা চালু ছিল। আমি একমাত্র ছাত্র যে ফিজিক্স ও ম্যাথমেটিক্সে ডবল অনার্স-এ প্রথম শ্রেণী পাই।
সাপ্তাহিক : এই যে ম্যাথমেটিক্স নিলেন, সেটা কি ফিজিক্স অনার্স শেষ করার পর?
ড. মীজান রহমান : না, না, না। যখন আমি ফিজিক্স অনার্স পড়ছি, আর সাবসিডিয়ারিতে কেমিস্ট্রি ছেড়ে দিলাম, তখন আমি নিলাম ডাবল অনার্স। খুব কঠিন ছিল এটা। আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম।
সাপ্তাহিক : তাহলে তো বলা যায়, ম্যাথমেটিক্স আপনার আনন্দেরই বিষয় ছিল?
ড. মীজান রহমান : ফিজিক্সিটা ছিল সে যুগে ফ্যাশনেবল সাবজেক্ট। বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশে, বিশেষ করে আণবিক বিজ্ঞান, তার বিকাশের ইতিহাস শুরু হয়েছে ১৯২৪-২৫ সাল থেকে। তারপর থেকে তার যে দ্রুত ধাবমান বিকাশের ধারা শুরু হয় সেটা হয়েছিল আণবিক বোমা আবিষ্কার হওয়ায়। এবং যেটা ব্যবহারও করা হয়। তারপর থেকেই পারমাণবিক গবেষণাটা দেশে দেশেই প্রচণ্ড রকম বেগবান হয়েছে। ভালো ছাত্র পেলে সবাই ফিজিক্স নিতে চেয়েছে। তখন ওখানেই ক্যারিয়ার, ওখানেই গ্লামার সবকিছু। দেশে দেশে তখন ইনস্টিটিউট অব অ্যাটমিক রিসার্চ তৈরি হতে শুরু  করে। আমাদের পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন। ভালো ছাত্র হলে, সেখানে চাকরি একেবারে অবধারিত। এ কারণেই ভালো ছাত্ররা ফিজিক্স পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
সাপ্তাহিক : সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক কারা ছিলেন?
ড. মীজান রহমান : প্রথম দিকে বেশ ক’জন হিন্দু শিক্ষক ছিলেন। যতীন্দ্রনাথ দত্ত, ... নামগুলো ঠিক এ মুহূর্তে মনে নেই।
সাপ্তাহিক : আপনি ১৯৫৩ সালে অনার্স পাস করলেন?
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ, ফিজিক্স অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্সে অনার্স পাস করলাম। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলাম।
সাপ্তাহিক : তারপর মাস্টার্স?
ড. মীজান রহমান : মাস্টার্স করলাম অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্সে।
সাপ্তাহিক : অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্সে কেন?
ড. মীজান রহমান : সে সময় সেটা আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল। সেখানে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলাম। তখন থেকেই শুরু হলো আমার সত্যিকারের নিজেতে ফেরা।
অনার্স থেকেই আমি অন্য সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করলাম।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকব ঢুকব করছি, তখনকার কলতাবাজার থেকে একটু সামনে আমার বাবা ছোট একটা বাসা বানালেন, একরামপুর বলে একটা জায়গায়। লক্ষ্মীবাজারের মোড়ে ‘মতিভাই’ বলে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল, কায়েদে আজম কলেজে’র (এখন কবি নজরুল কলেজ) কাছে। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের আগেই একটা গলি ছিল, তার পরেই ছিল ‘মতিভাই রেস্টুরেন্ট’। সেটা ছিল একটা ল্যান্ডমার্ক। ওখানে দেখতাম, আমার মতো অনেক ছাত্র বসে চা-সিঙ্গাড়া খাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন ছিল সৈয়দ শামসুল হক। সৈয়দ শামসুল হকের বাসা ছিল কায়েদে আযম কলেজের কাছে। তাদের সূত্র ধরেই আমার পরিচয় ঘটে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে। ওরা যখন শুনল আমি র্ফিজিক্স ও ম্যাথমেটিক্সে ডাবল অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি, ওরা আমার ব্যাপারে একটু উৎসাহী হয়ে ওঠে। কেননা ফিজিক্স ও ম্যাথমেটিক্সে ডাবল অনার্সে আমার আগে ও পরে আর কেউই প্রথম শ্রেণী পায়নি। এভাবে তারা আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়। শামসুর রাহমান ও আমি ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হই। তারপরে পরিচয় হয় শহীদ কাদরীর সঙ্গে। তখন সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান, আমিÑ এই চারজন মিলে একটা ভালো সার্কেল গড়ে উঠল।
আমার ওপর শহীদ কাদরী একটা লেখা লিখেছিল। ইত্তেফাকে বেরিয়েছিল। আমি যতœ করে রেখে দিয়েছি। কানাডা থেকে আমি একবার দেশে যাবার পর শহীদ কাদরীর সঙ্গে দেখা হলে সে লেখাটা লেখে। ও তখন ইত্তেফাকে কাজ করত। আমাকে নিয়ে লম্বা এই উপ-সম্পাদকীয়তে বিস্তারিত লেখা ছিল আমাদের পরিচয় পর্ব নিয়ে।
সাপ্তাহিক : অনার্স করার পর আপনি অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্সে মাস্টার্স করলেন?
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ, অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্সে আরও ভালো করলাম। এই অর্থে যে আমি ওখানে অবিশ্বাস্যরকম উচ্চ নাম্বার পেলাম। গোল্ড মেডেল পেলাম। সে সময় আমরা ৯ জনের মতো প্রথম শ্রেণী পাই। আমাদের ব্যাচে ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী ছিল।
সাপ্তাহিক : মাস্টার্সে কারা পড়াতেন, সে সময়ের শিক্ষক?
ড. মীজান রহমান : ড. আজিজুল হক ছিলেন। আবুল কাশেম ছিলেন যিনি ছিলেন অরিজিনালি বিহারের অধিবাসী। প্রফেসর তিল্লু ছিলেন জার্মান। উনি দুটো বিষয় পড়াতেন। আবদুল হাকিম, সামসুল হক ছিলেন আমাদের শিক্ষক। এদের কথাই মনে করতে পারছি।
সাপ্তাহিক : এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে কি যুক্ত থাকলেন? নাকি শুধু লেখাপড়া নিয়ে মগ্ন?
ড. মীজান রহমান : একেবারে লেখাপড়া। জীবনের আর সবকিছু বাদ। তখন শুধুই লেখাপড়া। একনিবিষ্টতা না থাকলে কিছু হয় না। একসঙ্গে সবকিছু করার মতো মেধা আমার ছিল না, হয়ত এখনও নাই। তাই শুধুই লেখাপড়া নিয়েই থেকেছি।
সাপ্তাহিক : মাস্টার্স পাস করলেন কবে?
ড. মীজান রহমান : পাস করলাম ১৯৫৪তে। যদিও আমাদের রেজাল্ট বেরুল ১৯৫৫ সালে। কেননা এর মধ্যে ১৯৫২তে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। ফলে এক বছর পিছিয়ে গেছি আমরা।
সাপ্তাহিক : কর্মজীবন শুরু করলেন কবে?
ড. মীজান রহমান : অনার্স, মাস্টার্স মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের রেজাল্ট নিয়ে গড় করার পর দেখা গেল আমি হলাম সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। আর প্রথম হলো মঞ্জুর-ই খুদা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মঞ্জুর-ই খুদা ইংল্যান্ডে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেছে। তার অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমিই হলাম প্রথম। আমি সেটা জানি না। বাসায় বসে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন ভাবছি।
একদিন আমার বাসায় গিয়ে হাজির হলেন আমার বন্ধু ও সহপাঠী ড. হারুন অর রশীদ। তার বাবা ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে সে আমার বাসায় গিয়ে খবর দিল, ‘এই মিঞা, তুমি জান না তুমি যে বিলেত যাচ্ছ।’ চিন্তা করে দেখুন সেকালে মানুষের মনের কতখানি উদারতা। সে কিন্তু আমার চেয়ে ভালো ছাত্র। সে সুযোগ পায়নি। আমি পেয়েছি। তাতে তার কোনো হিংসা নেই, ঈর্ষা নেই। সে আমাকে খবর দিতে গেছে।
সেকালে নিয়ম ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যার সর্বোচ্চ নাম্বার থাকে সে মেরিট স্কলারশিপে পড়তে যায় বিদেশে। এটা তখনকার পাকিস্তান সরকারের নিয়ম ছিল। প্রতি বছর প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন এই বৃত্তি পেত মেধার ভিত্তিতে। সে সুবাধে আমি চলে গেলাম ক্যামব্রিজে।
সাপ্তাহিক : তখন কি আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছেন?
ড. মীজান রহমান : না, না, না।
সাপ্তাহিক : তারপর, আপনার কর্মজীবন?
ড. মীজান রহমান : এভাবেই আমি ক্যামব্রিজ থেকে পাস করে দেশে ফিরলাম ১৯৫৮ সালে। এ বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করলাম।
সাপ্তাহিক : অনার্স ও মাস্টার্স পাস করার পর বিদেশে গেলেন পড়তে। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে আপনার পরিবারকে এ সময় কি আর্থিক সহায়তা করতে পেরেছেন?
ড. মীজান রহমান : না, একদম পারিনি। এ সময় বাবারও খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল। এত ভাইবোনদের লেখা পড়ার খরচ যোগানো! কি যে এক কঠিন সংগ্রাম গেছে, সেটা অবর্ণনীয়। আমি জানি না পরিবারের সদস্যরা সে সময়টা কিভাবে পার করেছে। তবে এটুকু বুঝি সে সময়ে পরিবারের সবাই নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুক্তভোগী হয়েছে। বিশেষ করে আমার ছোট ভাই। সে আমার চেয়েও বেশি মেধাবী ছিল। তাকে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠাই। আমার ধারণা ছিল তাতে তার পেশাজীবন ভালো হবে। কিন্তু ওটা ছিল একটা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে যে ধরনের সামগ্রীর দরকার হয়, সেসব কেনার আর্থিক সঙ্গতি তখন তার ছিল না। সে সময় তাকে আর্থিক সাহায্য করার কেউ ছিল না। সে কলতাবাজার বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যেত আবার হেঁটে বাসায় ফিরত। এ রকম কষ্ট করে আমাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়েছে।
সাপ্তাহিক : আর আপনি গেলেন ক্যামব্রিজে পড়তে?
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ, আমি তখন ক্যামব্রিজে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে গিয়েছি। আমি ক্যামব্রিজ থেকে পাস করে তখন অনায়াসে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারতাম। কারণ আমি যে কলেজে পড়ি, সেখান থেকেই পাস করেছিলেন হার্ভাড সাহেব। তখন নিয়মই ছিল, ক্যামব্রিজ থেকে যে কেউ ভালোভাবে পাস করবে, স্বাভাবিক নিয়মেই হার্ভাডে তাকে অ্যাডমিশন দেয়া হবে।
সাপ্তাহিক : ক্যামব্রিজে আপনার রেজাল্ট নিশ্চয়ই ভালো ছিল?
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ। ভালো ছিল। কিন্তু ক্যামব্রিজ থেকে হার্ভাডে না যেয়ে আমাকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হলো পরিবারের কথা ভেবে। তারা আমার ওপর তখন আর্থিকভাবে নির্ভরশীল। আমি এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিলাম।
সাপ্তাহিক : সে সময় শিক্ষকদের বেতন কেমন ছিল?
ড. মীজান রহমান : মাসে বেতন পেতাম ৪৫০ টাকা। সে সময়ের জন্য অনেক টাকা। সাধারণ স্কেল ২৫০ টাকা থেকে শুরু হতো বোধহয়। যেহেতু বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছি সেহেতু উচ্চতর বেতনে আমি জয়েন করি।
সাপ্তাহিক : আপনি কি তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকেন?
ড. মীজান রহমান : না, আমি নিজেদের বাসায় থাকি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার সামর্থ্য তখন ছিল না। পরিবারকে সাহায্য করতে হতো।
সাপ্তাহিক : এরপর আপনার বিয়েশাদী?
ড. মীজান রহমান : সেটা পরে। প্রথমে এক বোনের বিয়ে দিলাম। আরেক বোনের জন্য ছেলে খোঁজাখুঁজি করে শেষে সেটা হলো না। সেই বোনটিই চলে গেল করাচিতে।
সাপ্তাহিক : আপনারা ভাইবোনেরা তো মেধাবী ছিলেন, লেখাপড়ায়?
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ, মোটামুটি। সব ভাইবোন না। অধিকাংশ। আমি মোটামুটি চলনসই। আমার ছোট ভাইটি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ল। তারপর তার এক বিড়ম্বনাময় জীবন শুরু হলো। সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে খুব একটা ভালো রেজাল্ট করতে পারল না। এটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার। তারপর চাকরি শুরু করল। পরে ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে সরে গিয়ে ব্যাংকে ঢুকল। পরে প্রশাসনিক লাইনে চলে গেল। তারপর কিভাবে যেন স্পেশাল সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) পরীক্ষা দিল। সেখানে সে ফার্স্ট হলো। প্রশাসনে যোগ দিল। পরে পূর্ণ সচিব হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। তার নাম হাবিবুর রহমান। ১৯৯৫ সালের দিকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে চাকরিজীবন শেষ করে।
সাপ্তাহিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার শিক্ষকতা জীবনে সহকর্মী, শিক্ষার্থী কারা ছিল?
ড. মীজান রহমান : আমার সহকর্মী এবং সমসাময়িক ছিলেন, আবদুর রহমান যিনি মাসখানেক আগে মারা গেছেন। ড. মুশফির রহমান, ড আজিজুল হক, আজিজুর রহমান খলিফা (উনি আমার শিক্ষক ও সহকর্মী), রমজান আলী সরদার, শামসুল হক, সাদেক খান .... এসব নামই মনে পড়েছে। এরা আমার সহকর্মী ছিলেন।
সাপ্তাহিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি থাকলেন?
ড. মীজান রহমান : ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। ১৯৬১ সালে আমি বিয়ে করি।
সাপ্তাহিক : বিয়ে হলো কিভাবে?
ড. মীজান রহমান : বিয়ে তো সবাই করে। আমিও করলাম। যদিও গরিব ঘরের বড় ছেলের বোধহয় বিয়ে না করাটাই ভালো। তবুও আমি করলাম। অনেকটা সে কারণেই আমি দেশের বাইরে চলে গেলাম।
সাপ্তাহিক : কোথায় বিয়ে করলেন?
ড. মীজান রহমান : আমার স্ত্রী শামসুন্নাহার। ডাক নাম পারুল। ওঁর বাবা-মা জীবিত ছিলেন তখন, কিন্তু একেবারেই অক্ষম। বাবা-মা দুজনই তখন খুবই বৃদ্ধ। আমার স্ত্রী ছিলেন তাদের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। ও থাকতেন তার ভাইয়ের বাসায়। তার ভাই হলেন ড. এ করিম। যিনি মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। উনি মারা গেছেন। আমার স্ত্রীর আরেক বড় ভাইয়ের নাম অলি আহাদ। ভাষা সৈনিক ও রাজনীতিবিদ। তিনি এখনও জীবিত আছেন।
সাপ্তাহিক : আপনার স্ত্রীর লেখাপড়া।
ড. মীজান রহমান : আমার স্ত্রী বাংলায় পড়তেন। ফাইনাল পরীক্ষার সময় তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে হওয়ার পর আর পরীক্ষা দিতে পারেননি। সুতরাং বলা যেতে পারে তিনি বিএ পর্যন্ত পড়েছেন। বিএ পাস করার পরিবর্তে তার বিয়েই হয়ে গেল। বিয়ের পর আমি থাকলাম ঢাকা হলের হাউজ টিউটর হিসেবে। ১৯৬২ সালে আমি চলে গেলাম কানাডায়।
সাপ্তাহিক : পরবর্তী লেখাপড়া সব কানাডাতেই?
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ। আমার একটা ইন্টারেস্টিং পজিশন ছিল। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ব্রানসউইক (Brunswick) সেখানে আমাদের যে হেড অব ডিপার্টমেন্ট ছিলেন উনি ছিলেন সাউথ আফ্রিকান। উনি ইমপেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি করা মানুষ। উনি যে সাবজেক্টে বিশারদ ছিলেন, সেই বিষয়ে আমারও আগ্রহ ছিল। উনার অধীনে আমি পিএইচডির ছাত্র হয়ে গেলাম। একাধারে আমি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেও শুরু করলাম।
সাপ্তাহিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন কানাডা গেলেন তখন কি শিক্ষক হিসেবে না পিএইচডির ছাত্র হিসেবে গেলেন?
ড. মীজান রহমান : দুটোই। ফলে আমি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলাম। আমাদের একটা বেতন ছিল। আমাকে লেকচারার হিসেবে নেয়া হয়েছিল। আবার পিএইচডির ছাত্র হলাম। এটার একটা সুবিধা ছিল। খুব একটা unusual পজিশন। আগে এরকম পজিশনে আর কেউ থাকেনি। তার কারণ ছিল, আমি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর ওরা আমার সম্পর্কে খুবই ভালো সুপারিশ করেছিল। যে কারণে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। সরাসরি অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার দিয়েছিল।
সাপ্তাহিক : ক্যামব্রিজ থেকে কানাডা গেলেন। সে সময় ম্যাথমেটিক্সের কোন ব্রাঞ্চে আপনার অধিকতর আগ্রহ জন্মেছে?
ড. মীজান রহমান : আমি তো অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্সের (ফলিত গণিত) ছাত্র। কিন্তু আসলে ম্যাথমেটিক্সকে এভাবে ভাগ করাটা ঠিক না। Mathematics is Mathematics. আমাদের এখানে  এই যে Applied Mathematics এবং Pure Mathematics- এই বিভাজনের ধারণা এসেছে ইংল্যান্ড থেকে। ইউরোপ কিংবা আমেরিকাতে এ ধারণা ছিল না। কিন্তু এই বিভাজনের মানেটা এখনও ব্রিটেনে যেরকম অন্য দেশে সে রকম নয়।
ব্রিটেনে এটা হয়েছে প্রধানত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের কারণে। ব্রিটেন সেসময় যে মডেল অনুসরণ করত, তার উপনিবেশ হিসেবে আমরাও তার অনুকরণ করেছি। সে কারণে আমাদের উপমহাদেশে, সর্বত্রই Applied Mathematics পাওয়া যাবে।
সাপ্তাহিক : আপনি পিএইচডি করলেন কি বিষয়ে?
ড. মীজান রহমান : আমি পিএইচডি করলাম ম্যাথমেটিক্সে। যদিও আমার বিষয় ছিল অ্যাপ্লাইড ওরিয়েনটেড।
সাপ্তাহিক : পিএইচডি করলেন কত সালে? তারপর?
ড. মীজান রহমান : ১৯৬৫ সালে। পিএইচডি করার সঙ্গে সঙ্গে নানা চাকরির অফার পেলাম। আমরা যে সময় লেখাপড়া শেষ করেছি তখন পৃথিবীর চাকরির বাজার এত প্রতিযোগিতামুখর ছিল না। We did not have to look for a job, Jobs to look for us. আমরা চাকরি খুঁজতাম না। চাকরিই আমাদের খুঁজে বের করত।
সুতরাং আমার সামনে অনেক চাকরির অফার এল। ততক্ষণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমি দেশে ফিরে যেতে পারব না।
সাপ্তাহিক : কেন?
ড. মীজান রহমান : একমাত্র কারণ ছিল, আমার স্ত্রীর অসুস্থতা। আমার বিয়ের অল্পকাল পরেই বোঝা গেল তার কিডনিতে একটা সমস্যা আছে। আমি যখন কানাডাতে গেলাম তার এক বছরের মধ্যেই বোঝা গেল তার কিডনিতে বেশ গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেটা ভবিষ্যতে কেবলই অবনতির দিকে যাবে। এবং তাই হলো। চিকিৎসকরা বললেন, ভবিষ্যতে কিডনি ফেইলিউর হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। শুধু তাই নয়, চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলেন, যদি সন্তান নিতে চাও, আর দেরি করো না। তখনই আমরা সন্তান নেবার সিদ্ধান্ত নেই। প্রথম তিন বছরে আমাদের দুই পুত্র সন্তান জন্ম নেয়।
আমি বুঝলাম এ অবস্থায় দেশে ফিরে গেলে স্ত্রীর সুচিকিৎসা সম্ভব হবে না। হলেও এত ব্যয়সাধ্য হবে যা আমার পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না। ফলে তখন আমি কানাডাতে স্থায়ীভাবে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
সাপ্তাহিক : কানাডায় যাবার ফলে বাংলাদেশে আপনার পরিবারকে (বাবা-মা-ভাইবোন) কি কিছুটা আর্থিক সহায়তা করতে পারছিলেন? নাকি নিজের স্ত্রী সন্তানদের নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন?
ড. মীজান রহমান : এ বিষয়ে আমার ভেতরে যে অন্যায়, বিবেকের যে দংশন, সেটা নিয়েই আমাকে মরতে হবে। সেই দায়িত্বটুকু আমি নিচ্ছি। স্ত্রীর অসুস্থতা ছাড়াও আরও অনেক পারিবারিক কারণে আমার মনে হলো দূরত্বটা প্রয়োজন। আমি জানি, বাংলাদেশে আমার পরিবারের সে সময় দারুণ অর্থকষ্টে দিন কেটেছে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার যথাসাধ্য চেষ্টা আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট হয় নাই।
সাপ্তাহিক : আপনি কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়েই জয়েন করলেন?
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ। ১৯৬৫ সালে কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করলাম। ১৯৬৮-এ অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, তারপরে ১৯৭৮-এ ফুল প্রফেসর হলাম।
সাপ্তাহিক : এই পুরো কর্মজীবন আপনি কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়েই থেকে গেলেন। অন্য কোথাও গেলেন না। এর কারণ কি?
ড. মীজান রহমান : একটা জায়গাতে থাকার বিবিধ কারণ থাকে। প্রথমত, পেশাগত কারণ। পেশাগত তৃপ্তি যদি কোথাও হয় তাহলে প্রচণ্ড রকম যুক্তি ছাড়া অন্য কোথাও যাবার যৌক্তিক কারণ নেই।
অটোয়া শহরটা একটা আদর্শ শহর। পরিবার নিয়ে বসবাসের জন্য। ছোট শহর, বড় নয়। সেখানে সবকিছু আছে। রাজধানী শহর, দূতাবাসসহ বিভিন্ন অফিসের সদর দপ্তর আছে। খোলামেলা জায়গা আছে। আলোবাতাস আছে।  হ্রদ আছে, পাখি আছে, নদী আছে, বিশাল আকাশ আছে, গাছ আছে।
সাপ্তাহিক : তাহলে বলতে পারি, ড. মীজান রহমান সেখানে জীবনের আনন্দের প্রায় সব উপকরণ খুঁজে পেলেন?
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ। পেলাম। ১৯৬৫ থেকে ২০১২- প্রায় ৪৭ বছর কাটিয়ে দিলাম এই শহরে। এই দীর্ঘসময়ে এখনো পর্যন্ত আমার একবারও মনে হয়নি কেন এখানে থাকলাম। বরং আমার মনে হয়েছে, ভাগ্যিস আমি অন্য কোথাও যাইনি।
সাপ্তাহিক : আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন?
ড. মীজান রহমান : দুই ছেলে। কোনো মেয়ে নেই। সেই কারণেই পৃথিবীর সর্বত্র আমার মেয়েরা।
সাপ্তাহিক : ছেলেরা কি করেন?
ড. মীজান রহমান : বড় ছেলের গতানুগতিক জীবন। সে কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করেছে। পরে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এমএসসি ও পিএইচডি করেছে। সেখানেই চাকরি করছে আইবিএম কোম্পানিতে। ওখানেই থাকে। আমেরিকাই তার নিবাস, চাকরিস্থল। বিয়েও করে ফেলল ওখানে জন্মপ্রাপ্ত ও বৃত্তিপ্রাপ্ত গুজরাটি এক মুসলমান মেয়েকে। সোফিয়া তার নাম।
ছোট ছেলের জীবন খুবই অগতানুগতিক। তার জীবন হলো সঙ্গীতনির্ভর। সে পিয়ানিস্ট। সে অন্য কিছুই করেনি। তাকে আমরা পাঠিয়েছিলাম কনজারভেটরি অব মিউজিক, সেন্ট লুইস-এ। সেখান থেকে পাস করে সে চান্স পেল নিউইয়র্কের জুলিয়ান স্কুলে। জুলিয়ান স্কুলকে ধরা হয় হার্ভাড অব মিউজিক। সেখানে সে বিএ, এম. পাস করে। তারপরে ফ্রিল্যান্স কাজ করে। থাকে লাসভেগাসে। প্রোগ্রাম করে বেড়ায় নানা জায়গাতে।
সাপ্তাহিক : আপনার স্ত্রী?
ড. মীজান রহমান : আমার স্ত্রী মারা গেছেন ১০ বছর হলো।
সাপ্তাহিক : ছেলেদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি পশ্চিমের বাবা-সন্তানের মতন? নাকি প্রাচ্য দেশীয়...
ড. মীজান রহমান : আমার সঙ্গে ওদের সম্পর্ক ভিন্নরকম। আমি খুবই আনকনভেনশনাল ধরনের মানুষ। ক’জন বাবাকে আপনি জানেন যে তার ছেলেকে মিউজিক স্কুলে পাঠাবে? বিশেষ করে ক্লাসিক্যাল মিউজিক পড়তে। যেখানে আমি জানি যে, জীবিকার খুব নিশ্চয়তা নাই সেখানে। কিন্তু আমার ছেলেদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সম্পূর্ণ আলাদারকম। আমি আমার সন্তানদের বলেছি, কোনো রকম আর্থিক উত্তরাধিকার আমি তাদের জন্য রেখে যাব না। আমি মনে করি, যদি সন্তানদের ধ্বংস করতে চান, তবে তাদের জন্য সম্পত্তি রেখে যান। আমি তাদের জন্য আমার কিছু কাজ রেখে যাচ্ছি। আমি লেখাপড়া করি। এ থেকে যদি সন্তানরা কিছু উত্তরাধিকার পায় সেটাই যথেষ্ট।
সাপ্তাহিক : এই যে আপনি বাংলাদেশের জলকাদায় বেড়ে উঠলেন, এখানকার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করলেন। এরপর প্রায় সারাজীবন ব্যয় করলেন প্রবাসে। আপনার তাহলে দেশের প্রতি অবদান কি? কি ফেরত দিলেন দেশকে? নাকি নিজেকে এখন একজন বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
ড. মীজান রহমান : হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দেশের প্রতি কনট্রিবিউশন? দেশের প্রতি কনট্রিবিউশন মানেটা কি? আমি যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাই, লোকে আমাকে সম্মাননা দেয়, আমি যখন গর্বের সঙ্গে বলি আমি বাংলাদেশের মানুষ, তখন কি বাংলাদেশের সুনাম হয় না। It's not a contribution?
কি ধরনের কনট্রিবিউশন আপনারা চান? আমি তো বিশাল মাপের কোনো মানুষ নই।
সাপ্তাহিক : কিন্তু গণিত জগতে তো আপনি একজন উল্লেখযোগ্য মানুষ। শিক্ষকতা বা একাডেমিক জগতে তো আপনার বড় অবদান আছে।
ড. মীজান রহমান : আমি নিজেকে যেভাবে describe করি, সেটা হলো আমার অত্যন্ত সীমিত মেধা দিয়ে যতটুকু সাফল্য অর্জন করা সম্ভব ছিল আমার পক্ষে, আমি মনে করি সেটা হয়ে গেছে। সুতরাং আমার কোনো regret নাই।
সাপ্তাহিক : সেটা তো একান্তই আপনার ব্যক্তিগত বিষয়।
ড. মীজান রহমান : হ্যাঁ, সেটা ব্যক্তিগত। আবার মনে রাখতে হবে আমি এমন কোনো বিশাল ব্যক্তিত্ব নই, যেখানে সাফল্যের পাওনা আমি নিজের সঙ্গে সঙ্গে দেশকেও দিতে পারব। আমরা যেন ভুলে না যাই, আমার জীবনের ৩০টা বছর কেটেছে মূলত আমার স্ত্রী রোগশয্যাতে। মানুষ এটা ভুলে যায়। এটা যে কি জিনিস ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ তা অনুধাবন করতে পারবে না।
ভাবতে পারেন, আমার স্ত্রী হাসপাতালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব। ছেলেদের স্কুলে নিয়ে যেতে হবে, আনতে হবে। তাদের জন্য রান্না করতে হবে। আমার নিজের খাবার রান্না করতে হবে। Am I a superman to do all this things? But I have to do it for 30 years! (আমি কি এসব কাজ করার জন্য একজন সুপারম্যান? এক হাতে সব করতে পারব? অথচ ৩০ বছর ধরে আমাকে এসব কাজ করতে হয়েছে।)
সুতরাং সুপারম্যান হলে আমি দেশ, পরিবার সবাইকে হয়ত আরও কিছু দিতে পারতাম। আমি গান্ধী, নেহেরুর মতো মানুষ হলে হয়ত পারতাম। কিন্তু আমি তা নই।
সাপ্তাহিক : এই যে গত ৫০ বছর ধরে আপনি কানাডাতে আছেন। এর মধ্যে পৃথিবীজুড়ে তো নানা পরিবর্তন হলো। দেশ-বিদেশ, পূর্ব-পশ্চিম পৃথিবীজুড়ে নানারকম পরিবর্তন হলো। আপনি এগুলো কিভাবে দেখেন?
ড. মীজান রহমান : অনেক ছায়া একে অন্যকে মাড়িয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী কোথায় ছিল, কোথায় এসেছে! আমি যে তার দর্শক হতে পেরেছি, সেটা ভেবে বিস্মিত হই। আমার মনে হয় আমি এক ভিনগ্রহের মানুষ এখানে এসে আমি এতগুলো পরিবর্তন এই গ্রহের ভেতর দেখেছি।
সাপ্তাহিক : মূল্যবোধ, রাজনীতি, সমাজের এই এত পরিবর্তন আপনার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি? আপনি তো পুরনো মূল্যবোধ, জীবনদর্শন নিয়েই আছেন বলে মনে হচ্ছে।
ড. মীজান রহমান : আমার যে সীমাবদ্ধতা তার মধ্যেই তো আমার বৃদ্ধি। আমি শিখেছি প্রধানত মনের দরজা যদি খোলা রাখা হয় তাহলে অনেক কিছুকে ধারণ করে রাখা যায়। অনেক কিছু দেখা যায়, বোঝা যায়। তার সঙ্গে শামিল হওয়া যায়। তাকে অবলোকন করলে, অবচেতনে মনের ভেতর গ্রহণ করলেই প্রত্যেক ধারার সঙ্গে আমি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকছি।
আমি পৃথিবীর নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই চলেছি। অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলাম। কানাডাতে আজকাল যারা নতুন যায়, তাদের আমি বলি, দেখ, ভুলে যেও না, একবার যখন তুমি নিজের দেশ ছেড়ে কানাডাতে এসেছে তখন তো তুমি শুধু কানাডাতেই আসছ না তুমি বিশ্বময় যাত্রা শুরু করেছ। You do not come to Canada you come to the world. কেননা, এটা সারা বিশ্বের মিলনকেন্দ্র। এখানে তুমি এক দেশের মানুষ নও। সারা পৃথিবীর নানা দেশের, নানা জাতির, নানা সংস্কৃতির মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে। আলাদা আলাদা ভাষা, চেহারা, চর্চা নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ এখানে এসেছে।
কাজেই দ্রুতই যে তুমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে যে, এই দেশের লোক খারাপ, এই দেশের লোক ভালোÑ তাদের সঙ্গে না মেশার আগেই ভেবে নেবে, এই দেশের লোক কাফের, ওরা মোনাফেক, ওরা স্বধর্মী, ওরা বিধর্মী, তাহলে তোমরা কিছুই শিখবে না।
সে জন্যই বলি, মনের দরজা বন্ধ রেখে যদি কেউ বিদেশে যায় তাহলে সে কিছুই শিখবে না।
মানুষের জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হলো, মনের দরজা খোলা রাখা (Keep the mind open)। যে জিনিসটার চর্চা আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হয় না।
সাপ্তাহিক : সাহিত্য ছিল আপনার জীবনের প্রথম প্রেম। কলেজ জীবনের পরে ক্যারিয়ারে মনোযোগী হয়ে পড়ায় সাহিত্যপ্রেম চাপা পড়ে গিয়েছিল। অনেক পরে আবার লেখালেখি শুরু করলেন। এখন অবিরাম লিখছেন। সাহিত্যপ্রেমের নতুন জাগরণ কখন, কিভাবে হলো?
ড. মীজান রহমান : আমি তো ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ থেকে চলে গেলাম। তখন থেকেই আমার ‘অঙ্কের জীবন’ বা ‘ম্যাথমেটিক্স লাইফ’ শুরু হলো। সাহিত্য থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এমনকি আমি বাংলা পত্রিকা পড়তাম না (পাওয়া যেত না বলে)। এমনকি আমি যখন কানাডায় কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম যাই সেখানে কোনো বাঙালির সঙ্গে দেখাও হয়নি। ফলে অনবরত ইংরেজি বলতে হতো। এ দিকে আমার স্ত্রীর এমন একটি স্বভাব ছিল যে সে ইংরেজি শিখবে। কেননা সে তো ছিল বাংলার ছাত্রী। ইংরেজি একদম বলতে পারত না। বিদেশে গিয়ে প্রয়োজনের কারণেই তাকে ইংরেজি শিখতে হয়েছে। তবে তার মধ্যে শেখার তীব্র চেষ্টা ছিল। সে কারণে সে খুব ভালো ইংরেজি শেখে। পরে সে আর বাংলা বলতই না। বলতে পারতই না। ফলে আমার আর বাংলা বলার লোকই ছিল না।
১৯৬২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত, I was absolutely divorced from my Bengaliness. একেবারেই বাঙালিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। যদিও মজার ব্যাপার হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রবাসে আমি খুবই গভীরভাবে যুক্ত ছিলাম।
১৯৯০তে অটোয়াতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ঠিক করল ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে তারা একটা স্মরণিকা বের করবে। লেখা দরকার। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের একজন জানত যে, আমি এককালে লিখতাম। সে বলল, মীজান ভাই স্মরণিকায় আপনাকে লেখা দিতে হবে। আমি বললাম, অসম্ভব। এখন তো বাংলা শব্দই আসবে না আমার মাথায়। তবুও সে নাছোড়বান্দা। কেননা তারাও বাংলায় লেখার লোক খুব একটা পাচ্ছে না। যা হোক, ওদের চাপাচাপিতে বহু কষ্টে একটা লেখা লিখে ফেললাম বাংলায়। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সংগ্রামটা আমি বুঝি আর কি!
কোনোভাবে একটা লেখা বেরুল। আমার অবস্থা তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। কপাল কাকে বলে! স্মরণিকাটি বেরুলে লোকে বলল আমার লেখাটিই নাকি সবার ভালো লেগেছে। ঝড়ে বক পড়ে...। ঝড়ে বক পড়ে গেল। তখন আরেকটা মাসিক পত্রিকা বেরুত অটোয়া থেকে। ‘মাসিক বাংলাদেশ’। চালাত মাহামুদুল হাসান। পরে সে ‘পড়শী’ নামে একটা পত্রিকাও বের করে। মাহামুদুল হাসান একজন কোয়ালিটি সম্পন্ন মানুষ। সে যেখানেই যেত, সেখান থেকে কোয়ালিটি সম্পন্ন ভালো পত্রিকা বের করত। সে আমাকে চিনতও না। ২১শে ফেব্রুয়ারি স্মরণিকায় আমার লেখা পড়ে একটা অনুষ্ঠানে আমাকে অনুরোধ করল মীজান ভাই আমার পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে হবে। এই যে পড়ে গেলাম ফাঁদে... চলল লেখালেখি। ওখানে আমার প্রথম লেখাটাই ছিল, ‘আমরা কানাডিয়ান না বাংলাদেশি’ শিরোনামে। সেই আত্মজিজ্ঞাসা শুরু হয়ে গেল। তারপরে একে একে লেখা বেরুতে লাগল। ঝরনার মুখ খুলে দিলে যে রকম হয় আর কি! আমার ভেতরে কিছু আবেগ ছিল, জমাট আবেগ, সেগুলো বেরুতে লাগল, প্রবল ধারায়।
তারপরে ‘তীর্থ আমার গ্রাম’ লিখলাম। দেখলাম মানুষ আমার লেখা গ্রহণ করছে। আমার মনে আছে, সেই একই লেখা আমি পাঠাতাম নিউ ইয়র্কে ‘প্রবাসী’ পত্রিকাতে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তখন মাহমুদ উল্লাহ সাহেব। উনি ছিলেন বেশ পড়াশোনা জানা বিজ্ঞ মানুষ। সেই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ আরও অনেক গুণী মানুষ ছিলেন।
এভাবেই কানাডা, আমেরিকাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আমার একটা পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হলো।
সাপ্তাহিক : এর মধ্যে তো অনলাইনেও অনেক বাংলা ম্যাগাজিন এসে গেল?
ড. মীজান রহমান : সেটা আরও পরে। ভুলে যাবেন না ইন্টারনেট খুব সাম্প্রতিক বিষয়। ইন্টারনেট তো বাজারে এলো ১৯৯০ এর দিকে। ১৯৯৪তে আমার প্রথম বই বেরুল, ‘তীর্থ আমার গ্রাম’। এটা বেশ জনপ্রিয়তা পেল।
সাপ্তাহিক : এটা বের হলো কোথা থেকে?
ড. মীজান রহমান : ঢাকা থেকে। আবদুল করিম বলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন, উনি নিয়মিত প্রকাশক ছিলেন না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। আমার ভগ্নিপতি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসে কাজ করতেন। তার মাধ্যমেই যোগাযোগ।
এরপর আলম খোরশেদ, উনি ছিলেন কানাডার মন্ট্রিয়েলে। তার একটা প্রতিষ্ঠান ছিল, নাম ‘সুলতানার স্বপ্ন’। সে আমার লেখা খুব পছন্দ করত। সে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে আমার সংকলনের প্রকাশনার ভার নেয়। ‘লাল নদী’। শুধু তাই নয়, প্রকাশনা উৎসব করে। সে খুব কর্মী মানুষ। প্রচারণা ও মার্কেটিং ভালো জানে। এরপরে আরও বই বের হয়।
সাপ্তাহিক : তারপর তো আপনি পুরোদস্তুর লেখক বনে গেলেন। লেখকজীবন তৈরি হলো।
ড. মীজান রহমান : লেখকজীবন তৈরি হয়ে গেল। যদিও আমি যে লেখক, এটা এখনও নিজে বোধ করি না। নিজের মধ্যে সেই বোধটা আসেনি। কারণ, আমি তো কবিতা লিখি না, উপন্যাস লিখি না, গল্প মাঝেমধ্যে লিখি, যদিও আমি গল্পকার নই। অর্থাৎ আমি ঠিক প্রচলিত লেখক বলতে যা বোঝায় তা নই। ওদিকে আমি আবার প্রচলিত কলামিস্ট বলতে যা বুঝায় তাও নই। কলামিস্ট হলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে লিখতে হয়। আমি তা করি না। আমি তা হলে কি নিয়ে লিখি?
মোটা দাগে বলা যায়, আমি জীবন নিয়ে লিখি। জীবনের প্রতিফলন নিয়ে লিখি। আমার জীবন আমার ওপর যে পদচিহ্ন রেখে যাচ্ছে সেই চিহ্নগুলোকে আমি সম্প্রসারণ করি। সে হিসেবে আমি ঠিক প্রথামাফিক লেখক নই।
সাপ্তাহিক : আমরা একটু প্রসঙ্গ পাল্টাই। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে তখন কানাডায় প্রবাস জীবনে এই সংগ্রামের সঙ্গে আপনার কি কোনো সম্পৃক্ততা ছিল?
ড. মীজান রহমান : ১৯৭১ সালে, আমাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল। প্রতিটি বাংলাদেশি (দু’একজন পাকিস্তানপন্থি বাদে), আমরা সবাই ঐ একই লক্ষ্যে একই তালে খুঁজেছি, লড়েছি, হেসেছি, কেঁদেছি। যেহেতু আমার ভেতরে দেশচেতনা কোনো সময়ই কমে নাই। আমি দেশে ফিরিনি ব্যক্তিগত কারণে, তা না হলে আমি দেশ ছেড়ে বাইরে যাবার মানুষ নই। কোনোদিনই সে রকম মানুষ ছিলাম না। সুতরাং দেশের কান্নাতে অন্যদের মতো আমিও আকুল হয়েছিলাম। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তা করেছি, আমার স্ত্রী করেছেÑ আমরা সবাই করেছি।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে যখন গণহত্যা শুরু হলো, তখন অটোয়ায় বসবাসরত বাঙালিরা আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের কিছু করতে হবে। তৎক্ষণাৎ কোনো এসোসিয়েশন না করে আমরা একটা এডহক কমিটি তৈরি করলাম। আমরা নাম দিলাম ‘অ্যাকশন কমিটি’। সেখানে শুধু বাংলাদেশে জন্ম নেয়া মানুষই ছিল তা নয়, আমাদের অ্যাসোসিয়েট সদস্যরা ছিল ভারতীয়। আমাদের কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। অর্থসংগ্রহের দুটো ধারা ছিলÑ একটা হলো অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সহায়তা, আরেকটা ছিল শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা করা। একটা আমরা নিজেরাই করতাম। মাসিক বেতনের পাঁচ শতাংশ আমরা দান করতাম। এটা দিয়েই তহবিল তৈরি হতো।
সাপ্তাহিক :  এটা কি অটোয়াভিত্তিক না কানাডা ভিত্তিক?
ড. মীজান রহমান : অটোয়া ভিত্তিক। তখন অটোয়ায় গোটা পঞ্চাশেক বাঙালি ছিল। কানাডা জুড়েই এ রকম নানা সংগঠন গড়ে ওঠে। প্রচুর খাটনি ছিল আমাদের। শুধু টাকা সংগ্রহ নয়, প্রচারের কাজও চালিয়েছি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করা, পাকিস্তানপন্থিদের মোকাবিলা করা- সেটাও আমাদের দেখতে হতো। মোটকথা আমরা সবাই জড়িত ছিলাম।
সাপ্তাহিক : এরপর দেশ স্বাধীন হলো। আপনার দেশে আসা যাওয়া তখন কেমন ছিল?
ড. মীজান রহমান : খুব কম। আমি দেশ ছাড়লাম ১৯৬২ সালে। তারপর দেশে ফিরলাম সপরিবারে ১৯৬৬ সালে। তারপর ১৯৬৮-এর শেষে এক মাসের ছুটি কাটাতে। তারপর আমি একাই এলাম ১৯৭৭ সালে। আমার দুই ছেলেসহ পুরো পরিবার বাংলাদেশে এলাম ১৯৮০ তে। সেবারই ছিল আমার স্ত্রীর শেষবারের মতো বাংলাদেশে আসা। আমার স্ত্রী মারা যান ২০০২ সালে।
সাপ্তাহিক : আপনার স্ত্রীকে সমাহিত করেছেন কোথায়?
ড. মীজান রহমান : কানাডার অটোয়াতে।
সাপ্তাহিক : এখন তো আপনি একাই থাকেন? নিঃসঙ্গতা আপনাকে কষ্ট দেয় না?
ড. মীজান রহমান : একাই থাকি। নিঃসঙ্গতা! নাহ্। এটা খানিকটা কাব্যিক মনে হতে পারে। কিন্তু আমি প্রায় আক্ষরিক অর্থে মিন (Mean) করি, এই যে একাকিত্ব, এই একাকিত্বই আমার এক ধরনের সার্বক্ষণিক নীরব সঙ্গী হয়ে থাকে। অনেকটা আবহ সঙ্গীতের মতো আমাকে ঘিরে থাকে। আমার স্মৃতি আমাকে সঙ্গ  দেয়। আমি যখন লেখালেখি করি সেটা আমাকে সঙ্গ দেয়। ভাবনার জগতে আমি ভীষণ মুক্ত। সেই মুক্তি আমাকে সঙ্গ দেয়।
আমার ব্যক্তিগত চরিত্র একটু ভিন্নরকম। আমি অনেক সময় খুব ভালোভাবে নিঃসঙ্গ হই যখন অনেক লোকজন থাকে আমার চারপাশে। রাস্তায় যখন চলি, যখন সবাই নিজের নিজের পথে চলছে, তখন নিঃসঙ্গতা আমাকে দারুণ আনন্দ দেয়। মনে হয়, এই যে এত লোক রাস্তায় হাঁটছি, চলছি, কেউ জানছে না আমার মনের ভেতর কি ভাবছি আমি।
যদিও আমি মোটামুটি মুখরই থাকি। কথাবার্তা প্রচুর বলি। কিন্তু নিঃসঙ্গতাই আমার এক ধরনের সঙ্গী। নিঃসঙ্গতা আমাকে যন্ত্রণা দেয় না, সঙ্গ দেয়।
সাপ্তাহিক : তাহলে কি বলব, জীবনের জটিলতা, জীবনের নখর আক্রমণের থাবা থেকে আপনি একজন পলায়নপর মানুষ?
ড. মীজান রহমান : না, একদমই নয়। তবে আমি আবার যোদ্ধা মানুষও নই। আমি বিবাগীও না আবার সংসারিও না। এর মাঝখানে একটা জায়গাতে থাকি।
সাপ্তাহিক : ধর্ম বিশ্বাসে আপনার অবস্থান কি?
ড. মীজান রহমান : আমি জীবনে এক সময় ছিলাম পূর্ণ আস্তিক। যখন আমার বিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করার বুদ্ধিগত বৈদগ্ধময় চিন্তার যোগ্যতা ছিল না। তারপর যখন আস্তে আস্তে যুক্তি দিয়ে সব কিছুকে ভাববার, প্রশ্ন করার আস্থা তৈরি হলো, তখন আমিও বিবর্তিত হলাম। এখন আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, বিশ্বাসের সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বাসটা ব্যক্তিগত। সত্যটা অত্যন্ত অব্যক্তিগত এবং নৈর্ব্যক্তিক।
সাপ্তাহিক : কিন্তু আমাদের চারপাশে তো ঠিক এর উল্টো ঘটে। মানুষের বয়স যত বাড়ে মানুষ ততই নাস্তিক থেকে আস্তিক হয়। আপনি...
ড. মীজান রহমান : সেটা হয় মৃত্যুর ভয়ে। আসলে ধর্মের সৃষ্টিটাই হলো মৃত্যুর ধারণার মধ্য দিয়ে। মৃত্যু যদি না থাকত, তাহলে ধর্মের সৃষ্টি হতো না। মৃত্যু না থাকলে ঈশ্বর থাকত না। সবকিছুর মূলেই হচ্ছে মৃত্যু। এখন মৃত্যুকে যদি আমি জীবনের অংশ  বলে মেনে নেই, ভাবতে পারি, তখন আর সেই ভয়টা থাকে না।
সাপ্তাহিক : তাহলে মৃত্যু নিয়ে আপনার ভীতি নেই? আপনার মৃত্যু ভাবনাটা কেমন?
ড. মীজান রহমান : মৃত্যু ভয়ে ভুগি না। মৃত্যুকে আমি বরণও করি না, আবার বিচরণও করি না। একে আমি জীবনের অখণ্ড অংশ বলেই ভাবি। আমি মনে করি মৃত্যু যদি না থাকে তাহলে সতর্কতাও থাকবে না। মৃত্যুর প্রয়োজনেই আমরা জীবনে সতর্ক হই, সাবধান হই!
সাপ্তাহিক : আপনার এই জীবন ভাবনার পেছনে কি ম্যাথমেটিক্সের কোনো ভূমিকা আছে?
ড. মীজান রহমান : ম্যাথমেটিক্স কতটা ভূমিকা রেখেছে জানি না। তবে সামান্য পড়াশোনা থেকে বুঝেছি যে, The place of man is very insignificant, in the earth.
পৃথিবীতে ব্যক্তি মানুষের যে বিরাট মূল্য আছে, এটা একেবারেই সত্য নয়। তবে হ্যাঁ, তার কাজ থাকে। ব্যক্তি মানুষ নশ্বর কিন্তু তার সৃষ্টি অবিনশ্বর।
এই যে পরকালের ধারণা। মানুষের এটা একটা পরিব্যাপ্ত ধারণা। মৃত্যুর পরেও সে বাঁচতে চাইছে। অমর হতে চাইছে বলেই মানুষ পরকালের একটা মডেল তৈরি করেছে।
সাপ্তাহিক : আপনি শারীরিকভাবে এখনও সুস্থ। বার্ধক্য আপনাকে পীড়িত করে নাই। এখনও সচল আপনি। কিন্তু বার্ধক্য যদি আপনাকে আক্রমণ করে, আপনি যদি শয্যাগত হয়ে পড়েন, তখন কি আপনার এই চিন্তা বদলে যাবে?
ড. মীজান রহমান : আমি জানি না তখন কি হবে। তবে, আমি চাই তার আগেই যেন আমার মৃত্যুটা ঘটে। আমাকে যদি কেউ বলে, তুমি কি অবিশ্বাসী? আমি বলব, আমি বিশ্বাসী। তবে যুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে। Belief (ভরসা) আর Faith (প্রশ্নাতীত বিশ্বাস) এর মধ্যে পার্থক্য আছে। Faith is without any logic. Belief is with logic. I have acquired a set of belief, that is my acquisition not imposition.
আমার বিশ্বাস অর্জিত, আরোপিত নয়। আমি যুক্তিনির্ভর মানুষ।
সাপ্তাহিক : আচ্ছা আপনি তো গ্লোবাল সিটিজেন (বৈশ্বিক নাগরিক)। পৃথিবীর বহু দেশ, বহু মানুষ, বহু ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার চোখে বাঙালির শক্তি ও দুর্বলতাকে কিভাবে দেখেন? বিশেষত বাঙালির সাংগঠনিক শক্তি সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি কি?
ড. মীজান রহমান : একজন বাঙালি, beautiful, দুইজন বাঙালি টলারেবল (tolerable), তিনজন বাঙালি হলেই দল বা বিভক্তি ঘটবে। বাঙালির সাংগঠনিক শক্তি নাই, সেটাই বড় দুর্বলতা।
সাপ্তাহিক : বাঙালির শক্তির জায়গা কোথায়?
ড. মীজান রহমান : তার তীক্ষè বুদ্ধি। তীক্ষè বুদ্ধি কিভাবে হয়? ইতিহাস দ্বারা হয়। বিবর্তনের মাধ্যমে হয়। বাঙালিকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে তার জীবিকার জন্য। জীবন রক্ষার জন্য। ইতিহাসজুড়ে তার প্রভুরা তাকে শাসন করেছে। সে কখনোই নিজের প্রভু হয়নি। ১৯৭১ সালের পর সে প্রথম নিজেই নিজের প্রভু হয়েছে।
সাপ্তাহিক : পশ্চিমা জগতে তো আপনার বাস।  এদের সম্পর্কে আপনি জ্ঞাত। পশ্চিমা দেশগুলো ইরাক, আফগানিস্তানসহ নানা দেশে আগ্রাসন চালাচ্ছে। আপনি এই শিক্ষিত সভ্য পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকাণ্ডকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ড. মীজান রহমান : কোনো দেশে কোনো আগ্রাসনই সমর্থন যোগ্য নয়। নৈতিকভাবে এমনকি রাজনৈতিকভাবে আগ্রাসনকে সমর্থন করা যায় না। তবে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। প্রতিটি জাতিরই একটা না একটা সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস ছিল। বর্তমানে চলছে ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের যুগ। অতীতে ব্রিটিশ, স্পেনীয়দের সাম্রাজ্যবাদ ছিল নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের চেহারাটা কিছুটা সূক্ষ্ম। ভেতরে ভেতরে বাণিজ্যিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে অবনত করা। কিন্তু আদিযুগে আরও বর্বর রকমের সাম্রাজ্যবাদ ছিল।
ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের যুগ ছিল বলতে গেলে প্রায় সাত’শ বছর। ৭৩২ সালে প্রথমে তারা স্পেনের ভেতর ঢুকে, সে সময় থেকে শুরু করে ১৪০০-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্যবাদ ছিল। যদিও তাদের প্রতাপ ও প্রভাবটি আস্তে আস্তে নিভতে শুরু করে। দ্বাদশ শতক থেকে শুরু হয়ে এই সাম্রাজ্যবাদ ধীরে ধীরে পতনের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু এই সাম্রাজ্যবাদ যেখানে গেছে সেখানেই একই রকমভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। তখনকার সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি ছিল এক রকম, এখনকার সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি হচ্ছে ভিন্নরকম। কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্যটা একই। মূল লক্ষ্যটা কি? অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করা।
প্রতিটি পরাশক্তিরই উদ্দেশ্য ছোট শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। কেউ নিয়ন্ত্রণ করে দৈহিকভাবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনই একটা অবস্থা সৃষ্টি করে দেবে, তার কাছে নমঃ নমঃ করে বেঁচে থাকা ছাড়া উপায় নেই। আরেকটা উপায় হলো দেহকে তো নিয়ন্ত্রণ করবেই উপরন্তু মনকেও নিয়ন্ত্রণ করবে। তার চেয়েও মারাত্মক জিনিস হলো, যেটাকে আমি বলি তৃতীয়মাত্রার নিয়ন্ত্রণ (Controll of the third degree) এবং সর্বনিকৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ- সেটা হলো চিন্তাজগতের ওপর নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ এমন একটা অবস্থা এই সাম্রাজ্যবাদ তৈরি করে দেবে যখন স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেও ভয় পাবে। সেটা করে ধর্ম। ধর্ম এই তৃতীয়মাত্রার নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে। হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, ইসলাম, বৌদ্ধ সব ধর্মই চিন্তাজগতে এই প্রভাব বিস্তার করে।
এই যে নিয়ন্ত্রণের পিপাসাটা এটা almost organic. যখনই যেখানে ক্ষমতার উপস্থিতি থাকবে, সেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে। আজকে আমেরিকার হাতে এত শক্তি আছে বলেই তারা এটা যত্রতত্র প্রয়োগ করছে। এটা এক সময় দুর্বল হবে। দুর্বল হতে বাধ্য। সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন এই নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে আরেকজনের হাতে।
সাপ্তাহিক : কিন্তু এই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে যে নতুন উপাদান ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এর উত্থান হচ্ছে। এটা কি পৃথিবীকে নতুন কোনো সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেবে?
ড. মীজান রহমান : আমার মনে হয় না, এটা পৃথিবীকে কোনো নতুন সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেবে। I don't think so, যেমন ইরানে আদৌ কি তারা সত্যি সত্যি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে চায়? একমাত্র হিরোশিমা ছাড়া কোথাও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হয়নি। যতই হম্বিতম্বি চলুক না কেন। ওই যে লাল বাটনে আংগুল দেয়া, তার আগেই তার আংগুলকে পুড়িয়ে ফেলবে সে। কেননা এতবড় দায়িত্ব নেয়ার মানুষ পৃথিবীতে হয়নি।
সুতরাং আমার ধারণা পৃথিবীতে কোনো বড় সংঘাত হবে না। কেননা সাধারণ মানুষ এটা চায় না।
ইরানে ১৯৯৯ এ যখন খোমেনী এলেন তখন যে ইউফোরিয়া (সুখোন্মদনা) ছিল, কেন ছিল? তার আগে ইরানে শাহ্র যে স্বৈরাচারী শাসন ছিল তা থেকে রক্ষা পাবার জন্য। ইরানে এটা কোনো বিপ্লব ছিল না। এটা ছিল শাহের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া। Revolutions are not created by crowds, revolutions are created lay ideas. জনতার অংশগ্রহণ দিয়ে বিপ্লব হয় না। বিপ্লব তৈরি হয় আইডিয়া থেকে। যেখানে কোনো নতুন রফবধ থাকে না, সেখানে কোনো রেভ্যুলেশন তৈরি হয় না। আজকে মধ্যপ্রাচ্যে যে আরব বসন্ত হচ্ছে, সেখানে কোনো নতুন idea  নেই। এটা হচ্ছে এজিটেশন, জনপ্রতিবাদ।
সাপ্তাহিক : তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের এই জাগরণকে আপনি রেভ্যুলেশন বা বিপ্লব বলতে রাজি নন?
ড. মীজান রহমান :  মোটেই না। একদম না। এটা কোনো বিপ্লব নয়। এটা জনগণের এক ধরনের ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া। এটা কোনো কাজ দেবে না। আবার ইসলামী রক্ষণশীলদের উত্থান ঘটবে। মিশরে ইতোমধ্যে ইসলামী ব্রাদারহুড নির্বাচনে জিতেছে। এই ইসলামী ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাসানুল বান্না যিনি ছিলেন পশ্চিমবিদ্বেষী জাতীয়তাবাদী।
আমি জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করি না। জাতীয়তাবাদীরা পৃথিবীর কোথাও কোনো উপকার করতে পারেনি। হিটলার মুসোলিনির দিকে তাকিয়ে দেখুন! এসব জাতীয়তাবাদীদের কর্মকাণ্ড দেখুন!! এরা সব সময় তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল। সুতরাং আরব জাগরণ কোনো বড় প্রভাব ফেলবে না যেহেতু এর মধ্যে কোনো নতুন আইডিয়া নেই।
রাশিয়ান বিপ্লব। সেখানে বড় আইডিয়া ছিল। যেটাকে নষ্ট করেছে স্ট্যালিন। তা না হলে এই ‘সমাজতন্ত্র’ তো বিনস্ট হতো না। মাওসেতুং- বড় আইডিয়া এনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার উত্তরসূরিরা তা নষ্ট করেছে।
সাপ্তাহিক : তাহলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যে মুক্তিসংগ্রাম তা কি কোন বড় আইডিয়া থেকে এসেছে?
ড. মীজান রহমান : It was a reactionary idea. বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হলো, যে কারণে বাংলাদেশ তৈরি হলো, ওই কারণটাকেই আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের উত্থান পর্ব। যেইমাত্র আমরা  সিংহাসনে গেলাম সেইমাত্র আমাদের ভোগের পর্ব শুরু হলো।
সাপ্তাহিক : ইতিহাস চেতনা, যুক্তিপ্রবণতা দিয়ে ৪০ বছর বয়সী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে কিভাবে দেখেন?
ড. মীজান রহমান :  দুঃখের বিষয় আমি ভোগের এই ধারা থেকে কোনো পরিত্রাণ দেখছি না। এ জন্য দেখছি না, যে কোনো মেকানিজম তো তৈরি হয়নি। এমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না যেখানে পরিত্রাণের উপায়গুলো শেষপর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। এই শক্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা দেখছি না। এখানে সবাই উন্নয়নের কথা বলতে যেয়ে জিডিপি গ্রোথ দেখায়, পরিসংখ্যানগত অগ্রগতি দেখায়। পরিসংখ্যান তো কতগুলো সংখ্যা। এই সংখ্যাতাত্ত্বিক উন্নয়ন দিয়ে তো মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন বোঝায় না।
আমি আসলে বলতে চাচ্ছি ‘আত্মশক্তির’ কথা। ভেতরের যে শক্তি দরকার তার কথা। ১৯৭১-এ  যে স্পিরিট ছিল, এখন সেটা দেখছি না।
সাপ্তাহিক : আবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনি কি হতাশ হন কখনো? হতাশা কি গ্রাস করে?
ড. মীজান রহমান : না আমাকে হতাশা গ্রাস করে না। কেননা ইতিহাসবোধ যার কিছুটা আছে, তারা নিজস্ব কিছু যুক্তি তৈরি করে নেয়। খুব বড় পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, একটা জাতিকে কতগুলো পর্যায় অতিক্রম করতেই হবে। কোথায় একটা জাতি যাবে সেটা ইতিহাসই নির্ণয় করে দেবে। সেখানে হতাশার হা দিয়ে নিরাশার কি আছে?
হতাশ মানুষ কখন হয়? যখন সে কোনো কিছু নিয়ে ভাবে, আশা করে, ফল পায় না- তখন সে হতাশ হয়। যদি আমাদের নীহার রঞ্জন রায়, ভবেশ মজুমদার, গোলাম মুরশিদের বই পড়া থাকে- তাহলে আমরা দেখব এখন যা হচ্ছে তা আমাদের চরিত্রেরই ফল। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। মানুষ যে বলে, ‘বাঙালির হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস’, গৌরবটা কোথায় ছিল দেখান তো? এই যে শঠতা, এটাই হলো আমাদের সমস্যা।
সাপ্তাহিক : একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। তাজউদ্দীন আহমদ নিয়ে আমাদের এখানে খুব একটা আলোচনা হয় না। উনার সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
ড. মীজান রহমান : উনি ছিলেন বাঙালির মধ্যে সত্যিকারের অবাঙালি চরিত্রের মানুষ। বাঙালির স্বাভাবিক স্বভাব উনার ছিল না। দুর্লভ ব্যক্তিত্ব ছিল উনার। প্রচণ্ড মেধাবী মানুষ ছিলেন। He was the man of প্রিমিয়ার লীগ। গান্ধী, নেহেরু, মার্শাল টিটো এই ধারার মানুষের কাতারের মানুষ।

ছবি : কাজী তাইফুরসংগৃহীত





সৌজন্যে: www.saptahik.com
  নিঃসঙ্গতাই আমার এক ধরনের সঙ্গী'-ড. মীজান রহমান

Tuesday 17 April 2012

Shimul Mustapha - Amar Kurey Ghore (Humayun Azad)

Shimul Mustapha - Amar Kurey Ghore (Humayun Azad)


Shimul Mustapha - Amar Kurey Ghore (Humayun Azad)
Rakhal ChheleRakhal Chhele·286 videos
55
108 views
Like 0     Dislike 0
Published on Apr 17, 2012
আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ'মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প'ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ'রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আর দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক।

আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমি
সবুজ পাতা নেই সোনালি লতা নেই শিশির কণা নেই
ঘাসের শিখা নেই জলের রেখা নেই
আমার মরুভূর গোপন কোনো কোণে একটু নীল হয়ে
বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটি শীষ আজ উঠুক।

আমার গাছে গাছে আজ একটি কুঁড়ি নেই
একটি পাতা নেই শুকনো ডালে ডালে বায়ুর ঘষা লেগে
আগুন জ্ব'লে ওঠে তীব্র লেলিহান
বাকল ছিঁড়েফেড়ে দুপুর ভেঙেচুরে আকাশ লাল ক'রে
আমার গাছে আজ একটা ছোট ফুল ফুটুক।

আমার এ-আকাশ ছড়িয়ে আছে ওই
পাতটিনের মতো ধাতুর চোখ জ্বলে প্রখর জ্বালাময়
সে-তাপে গ'লে পড়ে আমার দশদিক
জল ও বায়ুহীন আমার আকাশের অদেখা দূর কোণে
বৃষ্টিসকাতর একটু মেঘ আজ জমুক।

আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ'মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প'ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ'রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক।

আমার কুঁড়েঘরে
কবি: হুমায়ুন আজাদ
আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা

Shimul Mustapha - Amader Maa (Humayun Azad)

Shimul Mustapha - Amader Maa (Humayun Azad)


Shimul Mustapha - Amader Maa (Humayun Azad)
Rakhal ChheleRakhal Chhele·286 videos
55
421 views
Like 1     Dislike 0
Published on Apr 17, 2012
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক'রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেণীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা .... মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা .... দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচণ্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানক্ষেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানক্ষেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।

কবিতা: আমাদের মা
কবি: হুমায়ুন আজাদ
আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা
এলবাম: জননী যন্ত্রণা

Sunday 15 April 2012

ডাক দিয়ে যাই

[ উৎসর্গ প্রীতিলতা ]

ডাক দিয়ে যাই
প্রেমের সৈকতে
প্রকৃতির মতো
শর্তহীন শর্তে।

সহানুভূতির
বাঁধন ছাড়িয়ে
সমানুভূতির
সীমানা পেরিয়ে

প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতিতে
শান্তিপূর্ণ সহবাসে
জীবনের জয়গানে
প্রেমের সেতুবন্ধনে
 
অন্ধ বিশ্বাসের বৃত্ত ভেঙ্গে
'সৃস্টি-সুখের উল্লাসে'
দূরদর্শীতার সীমানায়   
প্রগতি ও প্রযুক্তির মোহনায় 

'বন্ধনহীন, মুক্ত স্বাধীন' 
সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়
প্রকৃতির মতো তোমাকে চাই
আর তাই ডাক দিয়ে যাই !

'তোমাদের নেই কোনো ভয়
আমরা করবো জয়'।

♫ ♪ '__̴ı̴̴̡̡̡ ̡͌l̡̡̡ ̡͌l̡*̡̡ ̴̡ı̴̴̡ ̡̡͡|̲̲̲͡͡͡ ̲▫̲͡ ̲̲̲͡͡π̲̲͡͡ ̲̲͡▫̲̲͡͡ ̲|̡̡̡ ̡ ̴̡ı̴̡̡ ̡͌l̡̡̡̡._' ♫ ♪
 
শফিউল ইসলাম 

২ বৈশাখ ১৪১৯
১৫ এপ্রিল ২০১২
কেমব্রিজ, অন্টারিও, কানাডা  
  

হিমালয়ের কাছে তরুলতার চাওয়া! ♥♪♥

নূরুন্ নাহার



(ডাঃ কামাল উদ্দীন আহম্মেদকে-
যে ছিলে আমাদের অনেক কাছের!
অথচ এখন অনেক দূরের!)

তুমি হিমালয়-
আমি তুচ্ছ তরুলতা!
কখন যেন টুক্রো ট্ক্ুেরা করে ছিড়ে ফেলো,
তোমার জন্য আমার অনুভবের বাগানে সাজানো
কচি কচি পাতা!

হিমালয়ের সাথে কী
তরুলতার তাল মেলে ?
কখন যেন ছিট্কে পড়ি,
তোমার উচ্চতর অবহেলার শেলে!

হিমালয় সত্যি কী-
তরুলতার দীর্ঘশ্বাস বোঝে ?
তরুলতা তো-
আজীবন আতঙ্কে বিশ্বাসের ছোঁয়া খোঁজে !!!

২ বৈশাখ ১৪১৯
১৫ এপ্রিল ১৯১২

Nurun Nahar, Poem, নূরুন্ নাহার