Wednesday 30 July 2014

স্বপ্ন দোলা

নাজমীন চৌধুরী
আমি গাইব, আকাশ ও বাতাসের কোলে -
পাখীও ধরিবে তাল তাহা' স্বরে।
-   তুমি?
আমি? বাঁধিবো চুল।
আলতা মাখা পায়ে দেব পারী, সুদূরে -
দুলিবো ঘর বাঁধা স্রোতে।
চুড়ির নিক্কন, রান্না ও বাড়ন্ত শিশু,
ছলা-কলা হীন পূজ-অর্চনা
অনেক ভালো বেসে।
ফুটিবে পাতা ও ফুল।
নাচিবে শালিক সেথা' দীঘির দু’পারে।
র’বে বন্ধুরা যে যার মত
প্রশান্ত পথে –
জ্যোৎস্না মাখা রাতে, বৃষ্টি ভেজা মাঠে।
কুড়া'বো কত জ্ঞ্যানী শিশু পথে।
দেবো না কাঁদিতে সে’জনা ও তাহারে।
যখন সে আর সাধিবে না তত্ত্ব,
মাঙ্গিবেনা ক্ষমা মলিন শিখা তরে।  
ঠিক তখনই-
মোর ফেরা হবে তব দোরে।

২০১৪ জুলাই ৩০
ক্যানাডা



Lilac Leaves ♥♪♥ Geranium :: Composition: SNC
Photo Credit: SAI, VCV

Sunday 27 July 2014

বকুল ফুল

নাজমীন চৌধুরী

হাসছিস কেন?
দুঃখে!
বালাই-ষাট! কিসের দুঃখ?
সাত পাঁচ মিলে অনেক দুঃখ!
পাগল একটা। কষ্ট কষ্ট খেলা!
বল আমাকে - 
শুনবে?
রুপমা নোতুন তিনটি পোশাক নিয়ে বিভ্রান্ত।
তোর কি তাতে?
আছে। আছে বই কি!
পছন্দের চতুর্থ পোশাকটায় তাকে বেশী ভালো দেখাতো যে -
হতভাগা। বন্ধ হোয়ে গেছে দোকান–পাট।
খুশীতে হাসছিস! দুঃখে নয়।
আমি হাসি বা কাঁদি, তোমার কি?
না কিছু নেই, এমনিতেই –
শোনো তাহলে, বলিঃ
শুধু ছোট ভাই দুটো নতুন জামা পেয়েছে,
মায়ার আপত্তি নেই তাতে; সেমাই ফিরনী খাবে।
সেই কিশোরটির কথা আছে মনে? বকুল ফুল কিনেছি যার কাছে? ওর মাও ভালো ভালো রান্না করছে আজ। আলীশন ঘরে।
ওকে উৎসবে নিয়ে যাবে কে, বাবা? উঁহু। সে এক গোপন কথা!
হুম, অনর্থক ভাবনায় তোর মাথাটাই গেল গোল্লায়।
যার যার তার তার। জীবন এগুচছে।
চেয়ে দেখ, ভাল আছে সব্বাই।
প্রতিবেশী রুপমা, মায়া ও ফুল-কিশরকে শুভেচ্ছা!
চল, আমরাও ভাগাভাগী করি আনন্দ ভালোবাসা -
হেসে কেঁদে।

সবাইকে ঈদ মুবারক 

(ছবি সংগ্রহঃ ইনটারনেট)

Photo: হাসছিস কেন?       
দুঃখে! 
বালাই-ষাট! কিসের দুঃখ? 
সাত পাঁচ মিলে অনেক দুঃখ! 
পাগল একটা। কষ্ট কষ্ট খেলা!
বল আমাকে -  
শুনবে? 
রুপমা নোতুন তিনটি পোশাক নিয়ে বিভ্রান্ত। 
তোর কি তাতে? 
আছে। আছে বই কি! 
পছন্দের চতুর্থ পোশাকটায় তাকে বেশী ভালো দেখাতো যে - 
হতভাগা। বন্ধ হোয়ে গেছে দোকান–পাট।
খুশীতে হাসছিস! দুঃখে নয়। 
আমি হাসি বা কাঁদি, তোমার কি?
না কিছু নেই, এমনিতেই – 
শোনো  তাহলে, বলিঃ 
শুধু ছোট ভাই দুটো নতুন জামা পেয়েছে, 
মায়ার আপত্তি নেই তাতে; সেমাই ফিরনী খাবে। 
সেই কিশোরটির কথা আছে মনে? বকুল ফুল কিনেছি যার কাছে?                                         ওর মাও ভালো ভালো রান্না করছে আজ। আলীশন ঘরে। 
ওকে উৎসবে নিয়ে যাবে কে, বাবা? উঁহু। সে এক গোপন কথা! 
হুম, অনর্থক ভাবনায় তোর মাথাটাই গেল গোল্লায়। 
যার যার তার তার। জীবন এগুচছে। 
চেয়ে দেখ, ভাল আছে সব্বাই। 
প্রতিবেশী রুপমা, মায়া ও ফুল-কিশরকে শুভেচ্ছা! 
চল, আমরাও ভাগাভাগী করি আনন্দ ভালোবাসা - 
হেসে কেঁদে।

সবাইকে ঈদ মুবারক :)

(ছবি সংগ্রহঃ ইনটারনেট)

২০১৪ জুলাই ২৭
ক্যানাডা

'হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল' ♥♪♥

[উত্সর্গ: প্রীতিলতা]

আমার অনুজ, বাহার, এর কাছ থেকে অনেক মজার মজার গল্প শুনেছি। শুনবেন, একটা মজার গল্প? সম্প্রতি এক জাপানী কর্মকর্তা বেশ কিছুদিন বাংলাদেশে কাজ করেছেন। একটু একটু করে বাংলা শিখে ফেলেছেন। আজ উনার বিদায়-সম্বর্ধনা। এই সভায় ওই জাপানী'র বেশ কয়েকজন সহযোগী কর্মকর্তা বক্তৃতা দিলেন - ক্যামন কেটেছে কর্মময় দিনগুলো একসাথে। নোতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে জাপানীদের আগ্রহ অপরিসীম। একটা পকেট নোটবুক ও কলম এদের নিত্য সঙ্গী। যাতে সহজেই ঝট করে টুকে নেয়া যায়। একারণেই বোধ হয় জাপানী-জাতি সৃজনশীলতায় শ্রেষ্ঠ।

এবার জাপানী কর্মকর্তার বক্তৃতার পালা। "আমি মুগ্ধ হয়েছি আপনাদের ভালবাসায়। আপনাদের মনোরম আতিথেয়তা ও আপ্যায়নে আমি রীতিমত অভিভূত। আপনাদের একটা জিনিস আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনারা একে অপরকে 'দা বা 'দি বলে সম্বোধন করে থাকেন। কিন্তু আমাকে কেউ 'দা বলে ডাকেননি কেন বুঝতে পারিনি। আমাকে আপনারা আপনাদের মত আপন করে ডাকেননি। আমার খুব ভাল লাগতো যদি আপনারা আমাকে আপনাদের মত করে ডাকতেন।"

এবার সভাপতির বক্তৃতায় সুবোধ'দা বললেন, "আপনার নাম এমনই, যার সঙ্গে 'দা যোগ করলে আপনি ও  আপনার আসে-পাশের সবাই বিব্রত বোধ করবেন।" তাই আমরা সবাই কাউকে বিব্রত করতে চাইনি।"

এই দেখুন, আপনাদেরকেতো বলাই হয়নি আমাদের ওই জাপানী অতিথির নাম। ওই জাপানী কর্মকর্তার নাম ছিল 'বোকাচো'! শুভ-বিদায় মি. বোকাচো। আবার দেখা হবে মি. বোকাচো নিকোচু।

♥♪♥
শফিউল ইসলাম
কেমব্রিজ, ওন্টারিও, ক্যানাডা
রচনাকাল: ২০১৪ জুলাই ২৫
প্রকাশকাল: ২০১৪ জুলাই ২৬
শেষ সম্পাদনা: ২০১৪ জুলাই ২৮


ফটো: অন্তর্জাল
http://www.hairstyles123.com/hairstyles/japanese-hairstyles/page/2/
২০১৪ জুলাই ২৫


Hiroshima Bomb Dome, Japan, c1996 August (♥♪♥)


Hiroshima Peace Park, Japan, c1996 August (♥♪♥)


Huist Ten Bosch, LED Art Garden, Nagasaki, Japan ♥♪♥ 20111227-29

সৌজন্যে:
Life2Love
ShafSymphony
Vision Creates Value

Saturday 26 July 2014

বেদী ও বাদ্য

নাজমীন চৌধুরী
বিদেশ বিভূঁই এ এসে প্রথম প্রথম চোখ কান খুব খাড়া রাখতাম; বিশেষ করে বাঙ্গালী পরিবেশে। কেমন যেন নিজের মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভের অনুভূতি জেগে উঠত। যাকে সুক্ষ ভাবে বলে ভালো লাগা । বাংলাভাষা ও দেশের মানুষ গুলো কতো আপন!

কালের স্রোতে খাপ খাইয়ে নেয়া প্রতিষ্ঠিত অভিবাসীদের কাছে একে একে কতকিছু জেনেছি। অসাধারন মনবল তাঁদের! প্রতিটি মুখই অনেক অনেক পাতায় লেখা এক একটা ইতিহাসের বই। একান্ত নিজের।

তখনও কম্পিউটার ততোটা প্রসার ও প্রচার পায় নি। দেশ থেকে আসা শিক্ষানবিশ পরিচিতগন ও স্থানীয় অভিবাসীদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ হতো ফোনে আর আমন্ত্রণ/নিমন্ত্রন পর্বে। সে কত কথা, কত দিন এবং কত স্মৃতি । ভাল-মন্দ হিসেব করতে হলে বলব, ভালর পাল্লাটাই ছিল বেশী ভারী।

ওরকম একদিন। আতিথ্যকর্তার বাড়িতে আমদের ভীড়। প্রায় তিরিশটি পরিবারের সমাবেশ। দু’একজন বাদে সবাই নির্ধারিত সময়ে এসেছেন। অভিবাদন বিনিময় শেষে নিজেদের মত আয়েশ করে বসা। তারপর বিভিন্ন বিষয়ে কথা বার্তার শুরু। এমন সময় অল্প বয়সী ক’জন ছেলে মেয়ে এসে ফলের রস নিয়ে চলে গেল উপরের ঘরে। একজন মা তার ছেলেকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন, “খাবার খাবে না। জুস পেলে আর কথা নাই”।

আমিও অতিথিদের সাথে বসে তাদের গল্প শুনি। বাবামায়েরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের কথা নিয়েই ব্যস্তঃ স্কুলে খুব ভাল করছে, ক’জন পিয়ানো তে অনেকটা এগিয়েছে, অনেকেই কুরআন পাঠ শিখছে এরকম বিভিধ কথার বিন্যাস। সবার ভাষ্যেই এক ধরনের সুখের ছোঁয়া, চোখে উজ্জ্বল তৃপ্তি!

ওসব আলচনার এক বিষয়ীর নাম সুপ্ত। সুপ্তর জন্ম ও বেড়ে উঠা দুটোই ব্রিটিশ রাজ্যে। আমরা সেদিন ওদের ঘরেই আমন্ত্রিত। শাহী খাবার, সবাই খুব মজা করে খাচ্ছি। আমদের আসরে সুপ্তের পদার্পণ একটু দেরীতেই বইকি। হঠাৎ এক জনইকার ইশারা আ্মাদের দৃষ্টি কাড়ে। সরল সোজা অন্য বেচারী সেই ইঙ্গিত না বুঝে বলেই বসলো, “কি হইছে?”

তৎক্ষণাৎ অতি চতুরীর হস্তক্ষেপ, “ধীরে ধীরে খাও, বাবা; গলায় বাঁধবে”।
ব্যস, যেন সবার বোঝা সারা। কি জানি কী বুঝলাম! তা থাকগে। সম্পর্কে এক আনটি প্রশ্ন করল, “সুপ্ত, তুমি রোজা রাখছ?”

না, সংক্ষিপ্ত জবাব তার।
খাবার শেষ করে ও চলে গেল। সবার চোখে চোখ রেখে মিষ্টি হেসে বিদায় নিল নিজের ঘরে। ওর সাথে আমরাও কুশল বিনিময় করি। আদবকায়দা ও চেতনাবোধের উপস্থিতিটা অনুভব করি প্রাণ দিয়ে। তুষ্ট হয়েছি খাবার খেয়েও। সে আর ভাষায় বলা!

বেশিরভাগ নিমন্ত্রিতরাই একমত, খাওয়া বেশী হয়ে গেছে। খানিক্টা সময় প্রয়োজন। ফলে, প্রধান খাবার ও মিষ্টান্নের মাঝে বিরতি। আর বিরতিতে নানান কথার মেলাঃ দেশী-বিদেশী রাজনীতি, রাজনীতিবিধদের নিকুচি করণ, সেরা ধর্মের গুনাগুন, অমার্জনীয় আচার/আচরন ও আরও কত কিছু! রাজনীতি বিষয়ে আমি একবাক্যে বোধির, এ প্রসঙ্গে কথা শুনতে ভাল লাগে না বলে শুনি না। এই ভাষাটাকে খুব কঠিন লাগে জন্য বলাও শিখি নি। তো পাশের ঘরের লোকজন কি করছে জানতে উঠে পরি। সেখানেও আলাপ-চারিতা; এক চমকেই মুখরোচক মনে হোল। কোন শাড়ীর দাম কতো, কে কে দেশে যাচ্ছে ঈদ করতে, কার যেন চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে, হবু বউ ইউরোপের ... ।
“ছেলের ত বিয়ের বয়স হোল, মেয়ে-টেয়ে খুঁজছেন কি”? মাথায় গোলাপি ওড়নার মধ্য বয়সীনি জিজ্ঞেস করেন সুপ্তর মাকে । অংশ নেবার জন্যই বুঝি উনি কিছুক্ষন থেকেই নেড়েচেড়ে উঠছিলেন।

“না আমরা কিছু ভাবি নি তবে ওর একটি মেয়েকে পছন্দ”।

- বাঙালি না কি সাদা? সাথে কৌতুহুল মাখা দৃষ্টি তার।

“বাঙ্গালী না রে ভাই, সে কপাল নিয়ে জন্মাই নি!” তাঁর দীর্ঘশ্বাস ঘড়ের বাতাসটাকে কুয়াশায় ভরে দিল যেন। “এদেশে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কি যে অশান্তি!”
ক’জন সুপ্তর মাকে সায় দিলেন হ্যা সুচক মাথা নেড়ে।

সবুজ শাড়ীতে পরিপাটি মহিলা আশ্বাস দিলেন, “ বাঙালী হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। মুসলমান ঘরের কত মেয়ে আছে!”

সুপ্তর মা কি ভাবলেন জানি না। উনি নির্দ্বিধায় বলে গেলেন, “না না মেয়েটির জাতকুল তেমন জানিনা। শুধু জানি যে ও সুপ্তের সাথে একই স্কুলে পড়ত। সেখান থকেই জানা শোনা, উঠা বশা, প্রেম ও বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ। মেয়েটিকে ভালই মনে হয়। সামনের জুলাই তে ওদের বিয়ে।“

- মেয়ে মোসলমান হচ্ছে তার আগে নিশ্চয়?

“সুপ্ত এ ব্যপারে ত কিছু বলে নি,” মায়ের উত্তর।
“ওমা সে কি কথা!” বলে নিমন্ত্রিতা জিভে কামড় দিলেন। এ কোণ অনাসৃষ্টির কথা, ভাবখানা অনেকটা সেরকমই।
প্রসংগ যখন তুঙ্গে আরোহণ করছে, ঠিক তক্ষুনি আসর ভাঙ্গল একজন চাদর চাইতে এসে। তাঁর ব্যাখ্যা, লোকজন বেশী, শুধু জায়নামাজে যায়গা হবে না।
সুপ্তর মা চাদরের ব্যবস্থা করে দিয়ে ফিরে এলেন আমাদের মাঝে। মুখের হাসিটা তখনও ধরে রেখেছেন।
“যুগ বদলে গেছে ভাবী,”
এবার ওনার বলার পালা – “দাদী/নানীদের কালে ছিল বাল্যবিবাহ প্রথা। মা খালাদের বিয়ে হতো, আর আমাদের সময় বর পছন্দ না হলে বাবা মা কে তা জানিয়ে দেবার সুযোগ হয়েছিল। অনেকেই ভালবাসার জ্বালেও আটকা পরেছি আমাদের প্রজন্মে। জাহোক, অত কথায় আর যাই না। আমাদের ছেলে-মেয়েরা বিয়ে করবে সঙ্গীকে জেনেশুনে, এটাই ত চলছে এখন এবং তাই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি! ওদেরটা ওদের ‘পরেই থাক না। যথাসাধ্য ভাল মন্দ জানিয়েছি, লেখা পড়া শিখেছে, বয়স হয়েছে, বাকিটা তাদের নিজেদের”।

“ঠিক বলেছেন,” মুখ খুললেন এক সমজদার।
“দেশেও ত তাই চলছে!” গল্পে গল্পে বললেন ওনার চব্বিশ বছর বয়সী মেয়েটির বিয়ের প্রতি খুব অনীহা। আয়নির জন্ম দেশে তবে ওর বেড়ে ওঠা এখানে। গ্রীষ্মের ছুটিতে দুই/তিন বছর পর পর দেশে বেড়াতে গেলেও সে শুধু ওখানকার বাংলা ভাষা ও আত্মীয়-আদর টাকেই বেছে নেয়। ওনার হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলার ঢংটা বেশ সাবলীল মনে হোল। উনি বলেই চললেনঃ
জানেন, ওর এক বান্ধবীকে তার বাবা মা দেশে নিয়ে গিয়ে মামাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়াছিল। আয়নির এই ধরনের বিয়েতে তীব্র ঘৃণা। শুধু তাই নয়, তার বান্ধবী ভয়ে প্রতিবাদ করে নি বলেও সে ক্ষিপ্ত। আয়নির নিজের চোখে দেখা অনেকেরি বিয়ের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে! ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কতোটা দায়ী সেটা আঁচ করা কঠিন, তবে দুজন মানুষ সম্পর্ক থেকে বিচ্ছেদ নেয় নিশ্চয়ই কোন গভীর কারনে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আয়নির মা প্রকাশ করেন তার বিহ্বলতার কথাও। কোনটা ভাল কোনটা খারাপ, তা বলা বেশ কঠিন বলে জানান তিনি। তাঁকে ভাগ্যবিশ্বাসেও সংবেদনশীল মনে হয়েছে বইকি! সব বাবা মাই চায় তাদের ছেলে-মেয়ে সুস্থ থাক, সুখে থাক। তিনিও তাদের সাথে একমত বলে ঘোষণা দেন।
“এযুগে কাউকে জোর করে ত আর বিয়ে দেয়া যায় না; আর ভিন ধর্মী কাউকে বিয়ে করলেই বা ঠেকাবেন কি করে?” তাঁর নিগুঢ় প্রস্নে উদ্বেগের মাত্রাটাই গেল বেড়ে।

বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম, মনে পড়ে। কিসের মধ্যে কি! এত মজার মজার খাবার খেয়ে চিত্ত হবে উতফুল্ল, তা না! ছেলে-মেয়ে নিয়ে একঘেয়েমিপনা।

রাতের গভীরে ঘরে ফিরে আমরা দুজন এসব ছোটোখাটো গল্পমালা ভাগাভাগি করিঃ
কয়েকটা পরিবার একসাথে কিছুক্ষন মাত্র। কেউ বা অন্যের চলাচল ও আনুসাংগিকতা নিয়ে অখুশী। আবার কেউ বা একে অন্যের ভুলত্রুটি শুধরে দিতে অবলীলায় একটুখানি হাঙ্গামাও বাঁধাল। এঁরা জন্মভূমি ছেড়ে এসেছে বিভিন্ন প্রয়োজনে। অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা মিটেছে; সেকারনেই পাশ্চাত্তের সুযোগ সুবিধার গুন বিশ্লেষণেও তাঁরা আন্তরিক। পরবর্তী প্রজন্মকে বড় এবং শিক্ষিত করে তোলার পথ আকাশের মত উঁচু ও উন্মুক্ত তাঁদের। তবে জীবন-মরণের সীমান্তে চূড়ান্ত সুখের চাবিটা হাত করতেই বংশধরদের পাশ্চাত্য কায়দায় জীবন যাপনের ধারাপাত নিয়ে, টানা হেচরার চেষ্টাও অটুট রেখেছেন তাঁরা।

ঠিক তাই! দুই যুগ বড় বেশী সময় নয়।বাবা-মা যেমনটি বলতেন। মধ্যারণের ছায়ায় আজ আড়চোখে দেখি - আমিই সুপ্ত ও আয়নির মা, অভিবাসী ও বিতর্কিত! ঘোর কেটে বেদীতে বসে বাজাই বাদ্য।

২০১৪ জুলাই ২৬
ক্যানাডা


Lilac Leaves ♥♪♥ Geranium :: Composition: SNC
Photo Credit: SAI, VCV

রুপালীর সোনালী স্বপ্ন ♥♪♥

[উত্সর্গ: দূরদর্শী চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতান ও মোস্তফা আজিজ-কে]

রুপালী বেশ সুন্দরী ও শিল্পমনা। অপূর্ব গানের গলা! নব্বই দশকে ডাক্তারী পাশ করে চাকরি শুরু করেছে ঢাকার একটা ক্লিনিকে। সেখানেই অল্প-স্বল্প পরিচয় সৈকতের সাথে। সৈকত, একজন প্রকৌশলী, এই ক্লিনিকের প্রশাসক। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে বিদেশ যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সময় এক বন্ধু রুপালীর বিয়ের প্রস্তাব আনলো সৈকতের সাথে।

সময় সীমিত। সবকিছু দ্রুত-গতিতে হতে হবে। রুপালীর আশীর্বাদের জন্য আংটি কেনা হয়েছে। এক সন্ধ্যায়  সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার কথা। রুপালীর মা, একজন লাইব্রেরিয়ান, ফোন করেছেন ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা-পরিচালককে। রুপালীর পরিবারের অন্য বিয়েগুলোতে দেল-মোহর ঠিক হয়েছে তিন লাখ টাকা। এটা রুপালীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

উনি জানতে চাইলেন, আপনি কি বলতে চাইছেন, "আমরা যদি আপনার প্রস্তাবে রাজি না থাকি তাহলে আজ সন্ধ্যায় আমাদের আসার দরকার নেই? আমরা আপনার এই প্রস্তাবে রাজী হলে আপনাকে জানাবো।"  সৈকত ও সৈকতের বন্ধুরা ওই প্রস্তাব ও প্রস্তাব প্রদানের কৌশল ও ধরণে বেশ বিব্রত। রুপালী-সৈকতের সোনালী-স্বপ্নের শেষ এখানেই!

কিছু মানুষের 'প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস' এর জন্য রুপালীদের সোনালী স্বপ্ন '...এমনই এসে ভেসে যায় ...।' সৈকত সুদূর থেকে যায়। 'কোন সুদূর, সেই স্বপ্নপুর ...?'


ফটো: 'দ্য স্টর্ম' পেইন্টিং ১৮৮০

♥♪♥
শফিউল ইসলাম
কেমব্রিজ, ওন্টারিও, ক্যানাডা
রচনাকাল: ২০১৪ জুলাই ১৯
প্রকাশকাল: ২০১৪ জুলাই ২৬

সৌজন্যে:
Life2Love
ShafSymphony
Vision Creates Value

Thursday 24 July 2014

ভাবনার অবসরে

নাজমীন চৌধুরী

ঠিক আছে, আজ তোর ছুটি। তো কি কারনে ছুটি নিলি, কোন বিশেষ কারণ? “না, দিদিভাই তেমন কিছু না, এই ” গাড়ী-চালকের মুখের কথা কেড়ে নিল বাগানের মালি, “আমার কথাও ভাবেন একটু, আমিও ছুটি চাই”। যা যা, তুইও যা; তবে কাল ওদের দিকে খেয়াল রাখিস, কদিন ধরে একদম বৃষ্টি নাই কি না। 
দক্ষিনের বারান্দা থেকে বিদায় নিল অনীমা। একটু শান্তি করে বসার উপায়ও নেই। এদিকে তুর্য সূর্য আর ওদিকে আবদারের চাহিদা! ঘরে ঢুকতেই রাধুনির কপট আচরণ, “শুনলাম, ওগোরে না চাইতেই ছুটি মঞ্জুর করছেন। আমরা কি দোষ কইরেছি?” দোষ কেউ করে নি, তুইও না। কালকে ফিরিস কিন্তু! 
একচিলতে বাগানে বসে ভাবছিল ও। একা। এমন যদি হত! আমারও ছুটি। 
যাহ্‌, এসব কি ভাবছি? পাশের বাড়ীর কুকুরের উচ্চস্বরে চমকে উঠে অনিমা। বেলা হল যে!

২০১৪ জুলাই ২৪
ক্যানাডা

Lilac Leaves ♥♪♥ Geranium :: Composition: SNC
Photo Credit: SAI, VCV

Sunday 20 July 2014

কি করে খাবিনি ♥♪♥

[উত্সর্গ: প্রীতিলতা]

অনিমেষ বিয়ে করেছে। তার বাড়িতে নোতুন বউ। এই নোতুন বউ দেখার জন্য অনেক পড়শীর ভীড় আজ এই বাড়িতে। একই সঙ্গে চলছে নানা-রকমের রান্নার আয়োজন। বাড়ির উঠানে চলছে নানা-রকমের প্রস্তুতি। এককোনে অনিমেষ সহ কয়েকজন নারিকেল ছুলছে। নোতুন বউও চেষ্টা করে দেখতে চায় - সেও নারিকেল ছুলতে পারে কিনা। সেই প্রচেষ্টা পর্যবেক্ষণ করে অতি কৌতুহলী এক প্রতিবেশী প্রচন্ড হতাশ ও ভীষণ চিন্তিত! সে সহজ-সরলভাবে বলেই ফেললো, "একটা নারিকেল ছুলতি পারে না, ও কি করে খাবিনি; ও কি করে সংসার চালাবিনি!"

পড়শীরা জানে না অনিমেষ পরিবার অচিরেই পাড়ি জমাবে দূর-পরবাসে। যেখানে নারিকেল ছুলে খেতে হয় না। সেখানে ছোলা/কোরা নারিকেল কিনতে পাওয়া যায়। আমরা সবাই আমাদের অঙ্গনে ভাবতে ভালবাসি। নোতুন বউ-এর যে দক্ষতার দরকার নেই তা নিয়ে আজ এবাড়িতে একটুখানি বাহারি বিড়ম্বনা নিয়ে বিহব্বল পারদর্শী পড়শীরা।

♥♪♥
শফিউল ইসলাম
কেমব্রিজ, ওন্টারিও, ক্যানাডা
রচনাকাল: ২০১৪ জুলাই ১৯
প্রকাশকাল: ২০১৪ জুলাই ২০


ফটো: সুচিত্রা সেন 
অন্তর্জাল 
২০১৪ জুলাই ১৯

সৌজন্যে:
Life2Love
ShafSymphony
Vision Creates Value 

Saturday 19 July 2014

আগুন ♥♪♥

[উত্সর্গ: দূরদর্শী চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতান ও মোস্তফা আজিজ-কে]

সত্তর-আশির দশকের কথা। তখন গ্রামে-গঞ্জে রেডিও-শোনার বেশ প্রচলন ছিল। বাংলাদেশ বেতার থেকে 'বশীর সাহেবের সংসার' শিরোনামে একটা ধারাবাহিক অনুষ্ঠান প্রচার হতো। এই অনুষ্ঠানে মূলত: পরিবার-পরিকল্পনা, জন্ম-নিয়ন্ত্রণ, কুসংস্কার, বহু-বিবাহ ও বাল্য-বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে আলোকিত আলোচনা ও শিক্ষামূলক স্বল্প-দৈর্ঘ্যের নাটিকা প্রচার করা হতো। সমস্যা-সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে একটু একটু করে অনুষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। এই জনপ্রিয়তার আরো একটা বিশেষ কারণ - অনুষ্ঠানগুলো প্রচার হতো গ্রামের সহজ-সরল ভাষায়।

বেশ স্বচ্ছল ও বিত্তশালী বশীর সাহেব আবারও তাঁর পুত্রের  বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেছেন। কিন্তু এবারও বহু-বিবাহিত বশীর সাহেব পাত্রীকে তাঁর নিজের জন্যই বেশী পছন্দ করেছেন। প্রতিবার উনি পুত্রের জন্য পাত্রী খুঁজতে গিয়ে নিজেই পাত্র সেজে বিয়ে করে বসেন। এ ব্যাপারে বহুরুপী বশীর সাহেবের পড়শীদের কৌতুহলের সীমা নেই। শুনুন তাহলে, আমার স্মৃতির পাতা থেকে একদিনের এক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের অংশ-বিশেষ। এক কৌতুহলী পড়শী ও বশীর সাহেবের এক চিলতে সংলাপ:

পড়শী: --- 'বশীর সাব, শুনলাম মিয়া দেখতি গিছলেন;  তা মিয়া দেখতি ক্যামন?'
বশীর সাহেব: --- 'মিয়া আমার খুব পছন্দ হয়ছে। বেশ সাজে-গুজে, লাল-টুক-টুকে একখান শাড়ী পরে আইছিলো; মনে হচ্ছিলো যেন কয়লার পাঁজায় আগুন নাগেছে।'

শুনলেন তো,  বশীর সাহেবের মুখে মেয়ের রূপের বর্ণনা! এবারও পুত্রধনের কপালে পাত্রী হলো না। এভাবেই বহু-বিবাহিত বশীর সাহেবের সংসার বড় হতে থাকে। সমাজ-সংসারের পরিধির রং বদলাতে থাকে।  সবুজ-স্বপ্ন ঝরে পড়তে থাকে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রতিরোধে প্রত্যয়, প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার প্রয়োজন। সেসুত্রে সে সময় 'বশীর সাহেবের সংসার' অনুষ্ঠানটি বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে - যার প্রতিফলন আমরা ইদানিং দেখতে পাই।


ফটো: Girl with Sugarcane, S.Ilayraja (India), Facebook, 2014 July 17 

♥♪♥
শফিউল ইসলাম
কেমব্রিজ, ওন্টারিও, ক্যানাডা
রচনাকাল: ২০১৪ জুলাই ১৮
প্রকাশকাল: ২০১৪ জুলাই ১৯

সৌজন্যে:
Life2Love
ShafSymphony
Vision Creates Value

Monday 14 July 2014

একটু খোলা হাওয়ার জন্যে

মীজান রহমান
                                
 সোফার একপাশে আমি। আরেকপাশে আমর আব্দাল্লা। সামনে কিচেন থেকে চেয়ার টেনে এনে বসা তার স্ত্রী, রিপি। ওরা ওয়াশিংটন থেকে অটোয়াতে এসেছে আমার সঙ্গে দুটো দিন কাটাবে বলে। আমর গল্প করছিল। দেশবিদেশের গল্প, তার নিত্য ভ্রাম্যমান জীবনের নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প। তার মাঝে দুটি গল্প আমার মনে গেঁথে আছে। একটি রোয়াণ্ডার, আরেকটি আমাদের পোড়াদেশ বাংলাদেশের। প্রথমে রোয়াণ্ডার ঘটনাটি বলা যাক।
 রোয়াণ্ডার গল্প অবশ্য সবারই জানা। পৃথিবীশুদ্ধ লোক সেটা গড়গড় করে বলে দিতে পারবেকিন্তু সে গল্পটা ছিল মৃত্যু আর হত্যার গল্প, মানুষের পশু হয়ে যাওয়ার বীভৎস গল্প। তাদের আরেকটা গল্প আছে, বেঁচে থাকার গল্প, বেঁচে থাকার যে একটা দুর্বহ সংগ্রাম আছে তার গল্প। দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখের গল্প। আমরের কাছ থেকে আমরা তারই একটা খণ্ডচিত্র পেলাম সেদিন।
 রোয়াণ্ডার সমাজ প্রধানত দুভাগে বিভক্ত। হুটু ও টুটসি। না, এরা দুটি আলাদা গোত্র নয়, আলাদা শ্রেনীমাত্র। অনেকটা হিন্দু ভারতের মত। হুটুরা মূলত কৃষক শ্রেনীর মানুষ, আর টুটসিরা ঐতিহাসিকভাবে জমিদার শ্রেণী। এক শ্রেণী জমির মালিক, আরেক শ্রেণী জমির শ্রমিক। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তির আগমন সেই শ্রেণীবিভাগের সুঠাম সমীকরণটিকে আগাগোড়া ওলটপালট করে দেয়। স্থানীয় জমিদাররা আর জমির মালিক থাকে না তখন, তারা হয়ে যায় গৃহপালিত পশুর পালক ও ব্যবসায়ী। আর হুটুরা যে তিমিরে ছিল আগে সেই তিমিরেই থেকে যায়। কিন্তু রোয়াণ্ডাতে আরো একটা শ্রেণী ছিল যাদের কথা বাইরের পৃথিবীতে প্রায় কারুরই জানা নয়।তারা এখনো আছে, এবং ঠিক সেই অবস্থাতেইতাদের নাম বাটোয়া। সমাজের সবচেয়ে নিচুস্তরে তাদের অবস্থান---এতই নিচু যে তাদের কোনও শ্রেণীভুক্ত বলেই গণ্য করা হয়না। ঠিক ভারতের দালিত জাতির মত, যারা আর্যনির্মিত ব্রাহ্মন-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্র চারশ্রেণীর কোনটাতেই পড়ে না। তারা সত্যিকার অর্থেই অচ্ছুত, আনটাচেবুল। রোয়াণ্ডার বাটোয়াদের জমিজমা করারও অধিকার নেই। তারা রোয়াণ্ডার অস্পৃশ্য জাতি।
 এই হতভাগা বাটোয়াদেরই একটা গল্প বলছিল আমর। সেখানে অক্সফামের একটা কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প ছিল, যার মাধ্যমে কৃষকদের ফসল উৎপাদনের একটা বড় সহায়তার কাজ চলছিল। সমস্যা ছিল যে এতে করে বাটোয়াদের কোনও উপকারই হচ্ছিল না। যার জমি নেই তার জমিতে ফসল হোক বা হোক তাতে কার কি। অক্সফামের কর্মকর্তাদের সেটা জানা ছিল। এবং তাঁরা পথ খুঁজছিলেন কিভাবে এর একটা সমাধান বের করা যায়। সেই পথ খুঁজতে গিয়েই আমরকে পাওয়া। ও মূলত শিক্ষক। মিশরে তার জন্মবৃদ্ধি, লেখাপড়া সব। প্রথমে সমাজবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, তারপর আইন পাশ করে কায়রোর ফৌজদারি আদালতে ওকালতির কাজে নিযুক্ত হওয়া। ওর কাছে যা শুনলামঃ তার ওকালতি জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হল আনোয়ার সাদেকের হত্যাকারিদের বিচারের সময় সরকারি পক্ষের কৌঁশুলী হিসেবে কাজ করা। কিন্তু সে ওকালতিতে সারাজীবন কাটাবে এরকম কোনও উচ্চাকাংখা ছিল না। উচ্চাকাংখা ছিল আমেরিকায় যাবে, উচ্চশিক্ষা নেবে, তারপর জীবন কাটাবে শিক্ষকতায়। এভাবেই আমর প্রথমে ঘর বাঁধে ওয়াশিংটিনে, ইউনিভার্সিটি অফ পীসের অধ্যাপক হিসেবে। “শান্তির বিশ্ববিদ্যালয়”----নামটি আমারও খুব পরিচিত নয়, সারাজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও। এটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জাতিপুঞ্জের’ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যদিও আর্থিক সহায়তাতারা পায় প্রধানত বেসরকারি অনুদানের মারফতে। তাদের শুধু গতানুগতিক পাঠক্রম আছে তাই নয়, প্রায়সই তাদের অভিজ্ঞ অধ্যাপকদের পাঠানো হয় দেশবিদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শ বা সরাসরি সহায়তা দিয়ে কাজটা যথাসম্ভব এগিয়ে দিতে। সেভাবেই আমর আব্দাল্লার আবির্ভাব রোয়াণ্ডার হতভাগ্য বাটোয়াদ্রর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার দায়িত্ব নিয়ে
 বাটোয়াপাড়াতে গিয়ে আমরের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটি ছিলঃ বিস্ময়। আতঙ্ক। মানুষ এভাবে বেঁচে থাকতে পারে? এরা কি রক্তমাংসের মানুষ, না, কেবল কতগুলো হাড় আর দোলানো-মোচড়ানো চামড়ার সমষ্টি? এরা, ছোটবেলার খেলার বয়স থেকে বড় হয়ে ওঠা, তারপর সংসারধর্ম পালন শেষ হয়ে গেলে আস্তে আস্তে বার্ধক্যে পৌঁছানোর যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাতে মোটেও অভ্যস্ত নয়। এদের জীবন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ অবহেলা আর অনাদরের জীবন। এদের সঙ্গে আমাদের উপমহাদেশের অন্য কোন জাতির তুলনা করব বুঝতে পারছিনা। আমরের বর্ণনা শুনে বিহারের সরকারি পায়খানার মেথরদের ওপর একটা ছবি দেখেছিলাম অনেক আগে, তার কথা মনে পড়ল। ঢাকার মেথরপট্টিতেও এমন চলমান কঙ্কাল দেখেছি আমি। পৃথিবীর সব ‘উন্নয়নশীল’ দেশেই বোধ হয় এমন দৃশ্য দেখা যাবে নগরে বন্দরে।
 বাটোয়াদের কাছে আন্তর্জাতিক সাহায্য পৌঁছানোর একটা বিকল্প পন্থা বের করে নেন অক্সফামের কর্মকর্তারা। তারা চাষাবাদ করে জীবিকা অর্জনের অধিকার পাবে না, ঠিক আছে, তাহলে যাদের আছে, অর্থাৎ হুটুরা, তাদের কাছ থেকে উৎপন্ন ফসল কিনে বটোয়াদের হাতে তুলে দেওয়া যায়, যা তারা হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করে কিছু নগদ পয়সা রোজগার করতে পারবে। তারপর সে বাজার থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরতে পারবে। আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ালো অন্যখনে। ফসলগুলো তাদের হাতে পৌঁছালো ঠিকই, কিন্তু বাজারে যেতে পারল না। তার আগেই সব উধাও। মানে একেবারে গায়েব। আরে, এত এত গমভূট্টা, বাজরা সবজি, এগুলো গেল কোথায়? আমর গেল তদন্ত করতে। ভাই তোমাদের এত ফলফসল দেওয়া হল বিক্রি করে নগদ টাকা বানানোর জন্যে, সেগুলো তোমরা কি করলে? জানতে চাইল আমর। তখন এক বৃদ্ধ, শীতল শুকনো চোখদুটো তার প্রাচীন গুহার গাঢ় অন্ধকার থেকে বের হয়ে এসে বললঃ আমরা খেয়ে ফেলেছি সব। সেকি? কেন? আমর জিজ্ঞেস করে। তখন বুড়ো একটু হাসবার চেষ্টা করে বললঃ সাহেব। এর নাম ক্ষুধা। ক্ষুধা যে বড় কামড়ায়।
 “ক্ষুধা কামড়ায়”----দুটি শব্দ যেন মহাকালের কৃষ্ণবিবর থেকে নির্গত হয়ে আমরের চেতনাকে আড়ষ্ট করে ফেলল। সে নির্জীব হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। এক্ষুধা তো সময়ের ক্ষুধা নয়, সকালবেলার ক্ষুধা সন্ধ্যাবেলা চুকানোর ক্ষুধা নয়। এক্ষুধা হাজার বছরের বিরামহীন ক্ষুধা। এ ক্ষুধার কথা আমরের বোঝার কথা নয়, আমার আর রিপির বোঝার কথা নয়, এ-ক্ষুধা কেবল ক্ষুধার্তেরই বোঝার বস্তু। এ-ক্ষুধার অধিকার কেবল চিরলাঞ্ছিত আর চিরবঞ্চিতদের।
 আমরের দ্বিতীয় গল্পটিও বলতে গেলে ক্ষুধারই গল্প। তবে পেটের ক্ষুধা নয়, ভিন্নরকমের ক্ষুধা। এ-ক্ষুধা কামড় দেয় না পেটের তন্ত্রীতে, তবে ইতিহাসের কন্দর থেকে পুঞ্জীভূত বেদনার দীর্ঘশ্বাস তুলে নিয়ে আসে। এ-ক্ষুধার জ্বালা ক্ষুধিতদেরও বোধগম্য নয় অনেক সময়। এ-গল্পটি বাংলাদেশ থেকে কুড়িয়ে আনা। বিশ্বশান্তির কাজ নিয়ে আমরকে বেশ কবারই যেতে হয়েছিল সেখানে। একবার তার সুযোগ হয় চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত এলাকার একটি মাদ্রাসাতে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার। সমস্যা ছিল এই যে মাদ্রাসাটি ছিল মেয়েদের। প্রধান শিক্ষক থেকে ছাত্রীদের সকলেই আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা----শুধু ছোট একটি জালের মত, জেলখানার খুনি আসামীর কয়েদখানার খুপরির মত, চোখের ওপর একটুখানি ফাঁক। যা দিয়ে তারা পৃথিবীর খণ্ডিত অংশের একটা ধারণা পেতে পারে বটে, কিন্তু তাদের মুখাবয়বের রহস্য বাইরের জগতে কারুরই জানার সাধ্য থাকে না। এই অবরোধবাসী কিছু নারীর সাথেই কিছুটা সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয় আন্তর্জাতিক শান্তির বার্তাবাহী মিশরীয় পুরুষ আমর আব্দাল্লার। আমরের লক্ষ্য ছিল ওদের সঙ্গে যথাসম্ভব খোলাখুলি আলাপ আলোচনা করে তাঁদের সুখদুঃখের কথা শোনা তাঁদেরই মুখে। শেষে ওর শান্তিকর্মীরা তাঁদের জন্যে কি করতে পারে, কি করলে তাঁদের উপকার হয়, তাঁদের মাদ্রাসা জীবনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আসে, জানার জন্যে। বেশি নয়, মুষ্টিমেয় কজন শিক্ষক তার সামনে, প্রধান শিক্ষকসহ। ওর প্রশ্নের উত্তরে ওঁরা কি বলেছেন অনুমান করতে পারেন? আমর আমার দিকে তাকায়ঃ আমার কি ধারণা জানার জন্যে। ঠিক এমনি করে নাকি সে তার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের দিকেও তাকায়ঃ ওরা কি বলে, কার কি অনুমান। এখানেই আমরের বৈশিষ্ট্য, শিক্ষক হিসেবে। শ্রোতাদের সাথে করে সে একটা রহস্যময় জায়গাতে নিয়ে যেতে পারে, কৌতূহলটাকে একটা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারে। আমি ওর প্রশ্ন শুনে কিঞ্চিৎ থতমত খেয়ে ইষৎ অনিশ্চিতভাবে জবাব দিইঃ ভালো একটা লাইব্রেরি? বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা? মেয়েদের যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা? তাইতো, আর কি হতে পারে? মনে মনে ভাবি আমি, আস্ত মূর্খেরা যেমন করে ভাবে। আমার জবাব পেয়ে আমর নিশ্চয়ই মিটিমিটি হাসছিল নিজের মনে, নেহাৎ মুরুব্বীর প্রতি সম্মানবশতঃ সামনাসামনি তা প্রকাশ করেনি। বুঝতে পারছিলাম যে আমরের প্রশ্নের উত্তরে মেয়েগুলো এমন তালিকা দিয়েছিলেন যা সে কল্পনাও করতে পারেনি। সেই কল্পনা-করতে-না-পারা দুনিয়াছাড়া প্রশ্ন গ্রাম্য মহিলা মাদ্রাসার হতদরিদ্র একদল নারীর কাছ থেকে আসবে সেটা একেবারেই অকল্পনীয়। দুটি আরজ তাঁদেরঃ এক, মাদ্রাসার ভেতরেই যদি মেয়েদের জন্যে একটা বাস্কেটবল খেলার কোর্ট তৈরি করে দিতেন কেউ তাহলে বড় উপকার হত! দুই, কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারলে মেয়েরা কোরাণ-হাদিসের ফাঁকে একটু বাদ্যবাজনা করেও মন ভরাতে পারত!
 দুটির কোনটিই যে পাঠকের অনুমানের সাথে মেলেনি সেটা প্রায় হলপ করেই বলে দেয়া যায়। বোরখাপরা মাদ্রাসার মেয়েদের কাছ থেকে এরকম অদ্ভুত আবদার কারুরই কল্পনায় আসার কথা নয়। আমর নিজেও হতবম্ভ----একেবারেই আশা করেনি এটা।
 গল্পটা অসম্ভব ভালো লাগল আমার। তার নাটকীয় সমাপ্তিটুকুর জন্যে হয়ত কিছুটা, কিন্তু পুরোটা নয়। আসল কারণটি হল এই আপাতসরল কাহিনীটির ভেতর যে কত যুগযুগান্তের অসমাপ্ত কাহিনী লুকিয়ে আছে, কত যে গভীর আর্তনাদ, তারই খানিকটা আভাস পেলাম এতে। এটি একাধারে নিরেট, কঠিন বাস্তব গল্প জীবনের, অন্যদিকে পৃথিবীর সকল অবগুন্ঠিত নারীর সম্মিলিত মুক্তির কামনা। এগল্পের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়ানো একটি নগ্ন বাস্তবতা, এবং একটি প্রায়-দুর্বোধ্য প্রতীক।
 আমরের মাদ্রাসার গল্প শোনার পর মনে পড়ল অনেকদিন আগেকার দেখা অনুরূপ কিছু দৃশ্যের কথা। তারেক মাসুদের অসাধারণ সৃষ্টিঃ “মাটির ময়না” ছবিটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমারঘটনা সব মনে নেই ভালো, কিন্তু দুটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ দৃশ্য আমার স্পষ্ট মনে আছে। একেবারে আঁট করে গাঁথা মনের ভেতর----কখনোই ভুলবার নয়। পাঠক যারা দেখেছেন ছবিটা নিশ্চয়ই মনে রাখবেন যে ওটাও ছিল মাদ্রাসার গল্প----ছেলেদের মাদ্রাসা। ছেলেদের মাদ্রাসার ভেতরের খবরাদি তারেক মাসুদের খুব ভালো করেই জানবার কথা, কারণ তিনি নিজেই ছিলেন ছোটবেলা থেকে কৈশোরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাদ্রাসার ছাত্র। পুরো আট বছর। মূল গল্পটি গ্রামবাংলার একটি অতি-রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের চারজন সদস্য, তাদের মাদ্রাসায়-পড়া ছেলে অনু, তার বড় বোন, মা ও বাবা কাজী সাহেব, তাঁদের টানাপোড়েনের জীবন, এবং সেই জীবনের ওপর গভীর ছায়া ফেলে-রাখা পার্শ্ববর্তী মাদ্রাসার নানা বিচিত্র দৃশ্যমালাকে কেন্দ্র করে। কাজীসাহেব মসজিদের ইমামতি করে যেদুটি পয়সা উপার্জন করেন তাতেই কোনমতে সংসার চালাতে হয় তাঁর গৃহবন্দী স্ত্রীকে। এই ‘গৃহবন্দী’কে ঘিরে একটা দৃশ্য তৈরি করেন তারেক মাসুদ যা অনবদ্য মনে হয় আমার কাছে। বাড়িতে একটিমাত্র ঘর, যাতে গোঁজাগুঁজি করে সবাইকে ঘুমুতে হয়। এবং তাতে একটিমাত্র জানালা। এই জানালাটিকে তারেক মাসুদ ব্যবহার করেন একটি অসাধারণ প্রতীক হিসেবে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরুবার সময় স্বামী কাজী শক্ত করে বন্ধ করে যান জানালাটিকে। উনি চলে যাওয়ার পর এদিক-ও্দিক তাকিয়ে স্ত্রী সেটিকে পুরোপুরি খুলে দেন। একই দৃশ্যের অবতারণা হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এমন হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী প্রতীকি দৃশ্য খুব কম ছবিতেই দেখা যায়। মানুষের রুদ্ধ প্রাণ, তৃষার্ত প্রাণ যে কি অবর্ণনীয় ক্রন্দন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে কত বিচিত্র উপায়ে এই একটি দৃশ্যতে চলচ্চিত্রকার তারেক তা আশ্চর্য নৈপুণ্যের সাথে অতি অল্প কথাতে বুঝিয়ে দিলেন। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম শিল্পকলার সেই মহোৎকর্ষের দিকে।
 ছবিটার দ্বিতীয় দৃশ্যটি ছিল মাদ্রাসার ভেতরকার ঘটনা। হয়ত প্রথমটির চেয়েও মর্মভেদী। আরো তীক্ষ্ণ, ধারালো, দর্শককে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার অবস্থাতে পৌঁছে দেয়। দুটি বালক, টুপি কোর্তাপরিহিত ক্ষুদে মৌলবিসাহেব, মাদ্রাসার মাঠে বল খেলছিল। এবয়সের অন্যান্য ছেলেরা যেমন চাঁদা তুলে বল কেনার পর তাতে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে পাড়ার মাঠে নিয়ে যায় খেলার জন্যে ঠিক ওরকম। খুব ছোটাছুটি করছিল দুবন্ধুতে। সে কি হাসি তাদের, কি উচ্ছল উদ্দাম প্রাবন্ততা। ওরাই কেবল, আর কেউ যোগ দেয়নি তাদের সঙ্গে কি কারণে কে বলবে। একজন বল ছুঁড়ে মারে দূর থেকে, আরেকজন দৌড়ে গিয়ে সেটা ধরার চেষ্টা করে। খেলতে খেলতে দুজনই হাঁপাতে শুরু করেছিল। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতে গিয়ে আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ছেলেদুটো বল খেলছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা রাবারের বল নয়, চামড়ার তো একেবারেই নয়, এমনকি পাকা জাম্বুরা দিয়ে তৈরি বলও নয়। আসলে তাদের হাতে কোনও বলই ছিল না। ছিল কেবল একটা কাল্পনিক বল, যার অস্তিত্ব নেই, যা পৃথিবীর কোনও নিপুন কারিগরের হাতের স্পর্শ পায়নি, যা পদার্থ নয়, বস্তু নয়, যা বাজারে নগদ পয়সা দিয়ে কেনার প্রয়োজন হয়না। এ বল শুধু দুটি বুভুক্ষু বালকের কল্পনার রঙ দিয়ে গড়া মূর্তি, একটি বিমূর্ত পুত্তলিকা।
 ছবিটা কবে দেখেছিলাম? মনে নেই ভাই। তারিখ মনে রাখার প্রয়োজনই বা কি।দৃশ্যটা এখনো জ্বলজ্বল করে মনে। মহৎ ছবি একেই বলে। কি কপাল আমাদের। এমন একজন বড়মাপের শিল্পীকে এত অল্প বয়সে হারালাম আমরা, তা’ও এক তুচ্ছ অর্বাচীন সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। ভদ্রলোকের বয়স ছিল মাত্র ৫৬। আরো কত কি বড় বড় কাজ রেখে যেতে পারতেন তিনি, কত অমূল্য উপচার তিনি তুলে দিতে পারতেন জাতির পাত্রে। ডালা ভরে সাজাতে পারতেন কত বিচিত্র চলচ্চিত্র।
 কিন্তু তা হল না। হতে পারল না। সব ভেস্তে গেল। যেমন করে ভেস্তে গেল স্বাধীনতার সব স্বপ্ন, সব প্রতিশ্রুতি।

অটোয়া, ১৪ই জুলাই, ‘১৪

মুক্তিসন ৪৩


মীজান রহমান

Sunday 13 July 2014

মনীষা

নাজমীন চৌধুরী

ওকে আমরা অনেকেই গ্রহণও করি নি, ত্যাগও করি নি। মনীষা কে সব সময়ই দেখেছি পেছনের সারিতে বসতে। শান্ত, সৌম্য ও মার্জিত। ওর গলার আওয়াজ টা আজ মনে পড়ছে না। সে অনেক আগের কথা, বছর তিরিশ হবে। 

সেবারের গ্রীস্মের ছুটির মাত্র কদিন বাকি।ওদিন ইংরেজি শেখানোর শিক্ষিকা ক্লাস এ এলেন। তাঁর মুখটা ভয়াবহ বিষন্ন। আপা আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা মনীষার কথা শুনেছো?”
আমাদের বাক রুদ্ধ হোলেও উসখুসের আওয়াজটা পোঁছে গেল তুঙ্গে। বয়সন্ধিতে বুঝি তাই হয়। ওকে আমরা চিনতাম মাত্র; বন্ধুত্ব হয়ে উঠেনি।

আমাদের গোটাকতকের আসন ছিলো বেঞ্চের প্রথম সারিতে; অনেকটা রাজত্বের মতো! শুধু আসন কেন, সবার উপরে একটা পদ করে নেবার অনুশীলনটাও ছিল তীব্র। জানামতে মনীষা কখনো প্রতিযোগিতার স্রোতে গা করেনি। সাধারণ লক্ষের সাথে আমাদের অমিলই ছিল বেশি। ও তার স্বল্প পরিধীতেই বেশ ছিল।

“তোমরা যা খুশী করো, আমার কিছুই ভাল লাগছে না।” বললেন তিনি।
আপার প্রখর ব্যথিত চিত্তের স্পর্শে সবাই আবার একটু নেড়েচেড়ে উঠি। কিছুক্ষনের ভারী হাওয়ায় নিশ্চল সহপাঠী আমরা। কেউ প্রথম সারিতে, কেউ শেষে আর বাকিরা মাঝে বসে। এরপর নিচু গলায় গুঞ্জনেরও সমাবেশ। মনীষার কথা কতটা ছিল তাতে? মনে পড়ে না।

( স্বর্গীয়া কল্যাণী'কে ...)

২০১৪ জুলাই ১৩
ক্যানাডা

Lilac Leaves ♥♪♥ Geranium :: Composition: SNC
Photo Credit: SAI, VCV

Friday 11 July 2014

ফুটবল ভালবাসা

নাজমীন চৌধুরী

চুলার ধোঁয়া সরানো পাখাটাকে (আমি এটাকে ডাকি মাথা খারাপ করা যন্ত্র বলে) থামিয়ে ছেলের উদ্দ্যশ্যে দৌড়ালাম। বিমথিত বিলাপের শব্দ আসছে সেদিক থেকে। তার কাছাকাছি পৌঁছে দেখি সোফাতে উত্তাল বেগে থাপ্পড়ের দামামা। “ওকি পাগল হোয়ে গেল নাকি?” বিষয়টা নিরধারনের পূর্বেই চটাপট টেলিভিশন বন্ধ। ও ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাল করেছ, ওটা বন্ধই থাক”। বিশ-তিরিশ সেকেন্ডের দীর্ঘ অপেক্ষা। ততক্ষনে আমার রক্তের সমুদ্র তার সাধারণ তাপমাত্রা পেরিয়ে গেছে। উচ্চস্বরে বলতে চাইলাম, “তোর সমস্যাটা কিসে?” তবে সেটা ব্যক্ত করার সাহস না পেয়ে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বল্লাম, “তোমার সময় মতো আমাকে কষ্টের কথাটা বলতে পার; যদি ইচ্ছে হয়”।

“দুঃখিত, খুব অনুভূতি প্রবন হয়ে উঠেছিলাম। ডাচ রা হেরে গেল”।

আঃ! কী বাঁচাটাই না বাঁচলাম! ছেলে আমার পাগল হ্য় নি এখনও, ফুটবল খেলা দেখছিল।

শীর্ষ দল দুটোর চূড়ান্ত পর্বের খেলার অপেক্ষা হাতে গনা কয়েক দিনের মাত্র। জানামতে বেসিরভাগ খেলা প্রেমিক বন্ধুবর্গ যখন আর্জেন্টিনা বলতে বিহব্বল, সে তখন জার্মানীকে সমর্থন করছে মনে-প্রানে ও আপণ ধর্মে।

২০১৪ জুলাই ১১
ক্যানাডা


Lilac Leaves ♥♪♥ Geranium :: Composition: SNC
Photo Credit: SAI, VCV

Tuesday 8 July 2014

ঋতুপর্ণ ঘোষ ♥♪♥ Rituparno Ghosh

Explore and enjoy the amazing visionary journey of talented Rituparno Ghosh ....

Kolkata remembers filmmaker Rituparno Ghosh

অভিমানিনী হে (A Tribute to Rituparno Ghosh)

AKAPATEY RITUPARNO GHOSH

Rituparno ghosh's documentary made by varun rajput and ankita bhattacharjee( Ndtv Indiacan, Kolkata)


Arekti Premer Golpo .Just Another Love Story "ENGLISH SUBTITLES" J

Dahan by Rituparno Ghosh full movie


ঋতুপর্ণ ঘোষ 
১৯৬৩ আগস্ট ৩১ - ২০১৩ মে ৩০


অপর্ণা সেন স্মরণ করলেন দূরদর্শী ঋতুপর্ণ ঘোষ-কে 


ঐশ্বরিয়া রায় ♥♪♥ ঋতুপর্ণ ঘোষ 

Selected Featured Insights:

Rituparno Ghosh
Rituparno.jpg
Rituparno Ghosh at MAMI festival
Born31 August 1963
KolkataWest BengalIndia
Died30 May 2013 (aged 49)
KolkataWest BengalIndia
Other namesRitu
OccupationFilm director
Years active1992-2013
Notable work(s)Unishe April 1994
Dahan 1997
Raincoat 2004
The Last Lear 2007
Chokeher Bali 2003
Chitrangada 2012
Satyanweshi 2013

Monday 7 July 2014

আমাদের মেয়েরা ও আমরা

মীজান রহমান

 আমি কি হিংসা করি কাউকে?
না, এখন করিনা, আগে করতাম। হিংসা করতাম যারা আমার চেয়ে বেশি মেধাবি, বেশি সফল, তাদের। আরো হিংসা করতাম যাদের সৌভাগ্য হয়েছে কন্যাসন্তানের পিতা হবার। অনেকদিন আগের কথা সেগুলো। সেসব দিন পার হয়ে গেছে বহু আগে। এখন সংসারে কারো প্রতি হিংসা বা ঈর্ষার ভাব পোষণ করিনা আমি বিশেষ করে কন্যার বাবাদের। বরং ভাবি, ভাগ্যিস আমাদের মেয়ে হয়নি।
 ভাগ্যবান ভাবার কারণ, আমাকে মেয়ে বিয়ে দিতে হয়নি। প্রবাসে মেয়ে বিয়ে দেওয়া যে কতবড় সমস্যা সেটা আমার সমসাময়িকদের মধ্যে দেখেছি, আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট তাদেরও হিমশিম খেতে দেখছি আজকাল। বড় সমস্যা মেয়েরাই। বিশেষ করে যাদের জন্ম এখানে। পশ্চিমের কালচারে আজকাল মেয়েদের কেউ ‘বিয়ে দেয় না’, তারা ইচ্ছে হলে বিয়ে করে নিজেদের পছন্দমত ছেলেকে, ইচ্ছে না হলে আদৌ করেনা। ঐ ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’টুকু দেখে দেখেই তারা বড় হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাবামায়েরা ‘মেয়েদের ইচ্ছাকে’ তেমন গুরুত্ব দিয়ে অভ্যস্ত নন----এটা আমাদের ‘কালচার’এই নেই। পরিবার ভালো, ছেলে ভালো, চাকরি ভালো---আর কি চাই? মেয়ের আপত্তি থাকার তো কোনও কারণই নেই। সমস্যাটা সেখানেই। আমরা, পাক-ভারত-বাংলার বাবামায়েরা সেদিকটা দেখিনা ভালো। বুঝিনা কেন ওদের এদেশে জন্মানো আর বড় হওয়ার সাথে ‘বাবামায়ের পচ্ছন্দকরা’ পাত্রের কি সম্পর্ক থাকতে পারে। আমরা বুঝিনা যে জীবনসঙ্গি হিসেবে ছেলেদের যা চাহিদা মেয়েদের চাহিদা ঠিক তা নয়। বুঝিনা এজন্যে যে আমাদের কালচারে ‘ইচ্ছার স্বাধীনতা’, ‘ছেলেমেয়ের চাওয়াপাওয়ার পার্থক্য’----এসব সূক্ষ্ম ‘পশ্চিমা’ ব্যাপার স্যাপার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আমরা বুঝি যে ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে’। এবং সংসার সুখের হতে হলে রমনীকে সুস্থ সবল সন্তান উৎপাদন করতে হবে, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-শুশ্রূষা ও দেখভাল করতে হবে, গৃহস্থালীর সুষ্ঠু পরিচর্যা করে শ্বশুরালয়ের ছোটবড় সবাইকে খুশি রাখতে হবে। বিদেশে-জন্মানো ছেলেরা সেটা যত সহজে মেনে নিতে পারে মেয়েরা তত পারেনাখটমটিটা শুরু হয় সেখানেই। এবং এই ‘খটমটি’র সূত্রপাতটি ঘটে প্রধানত যখন দুপক্ষেরই শ্বশুর-শাশুড়ি একই শহরে বসবাস করেন (একই পরিবারের অন্তর্গত হলে তো কথাই নেই। একেবারে সোনায় সোহাগা)।
 আরো একটা বড় সমস্যা----মেয়েদের কেরিয়ার। দেশে ‘মেয়েদের কেরিয়ার’ হল স্বামীর ঘরে, এদেশেও একসময় তাই ছিল। কিন্তু নতুন যুগের আলোতে সব পালটে গেছে। এখন ছেলেদের কেরিয়ার আর মেয়েদের কেরিয়ার বলে আলাদা কিছু নেই----সবারই সমান অধিকার। উইমেন্স রাইটস, হিউমান রাইটস, চার্টার অফ রাইটস-----হাজার রকম ‘রাইটসের’ প্রভাবে পশ্চিমের সমাজ একেবারে কানায় কানায় ভরামুস্কিলটা এখানেই---আমরা পূর্বাঞ্চলের বাবামায়েরা মনের দিক থেকে চিরপ্রাচ্য, অন্তত মেয়েদের ব্যাপারে, ওদিকে মেয়েরা শতভাগ প্রতিচ্য। ‘প্রাচ্য-প্রতিচ্য দোঁহে নাহি মেলে’---কথাটি দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ অভিবাসী পরিবারেই প্রযোজ্য।
 আমার কথাবার্তায় পাঠক যেন ভেবে না বসেন যে আমাদের দেশের বাবামায়েরা তাদের মেয়েদের সুখশান্তির ব্যাপারে একটু উদাসীন। মোটেও তা নয়। বরং উলটো। পৃথিবীর সব সমাজেই, ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে, আমি যতদূর জানি, মেয়েরা প্রায় সবসময়ই বাবাদের চোখের মনি, আদরের ধন, তাদের ‘রাজকন্যা’। প্রাচ্য ও প্রতিচ্য, উভয় গোলার্ধেই বাবারা, মায়েরা তো অবশ্যই, কামনা করেন তাদের সেই পরম আদরের কন্যাগুলি যেন চিরসুখি হয়, দীর্ঘজীবী হয়, রত্নগর্ভা হয়মুস্কিল এই যে তাঁদের চিন্তাধারার সাথে আধুনিক যান্ত্রিক যুগের ছেলেমেয়েদের চিন্তাধারা একেবারেই খাপ খায় না। ‘চিরসুখি’ বলতে বাবামায়েরা যা ভাবেন ছেলেমেয়েরা তা ভাবে না। মেয়েরা তো রীতিমত কয়েদখানা মনে করে তাঁদের সেই ‘চিরসুখ’এর জীবনকে। ছেলেরা তবু আপোস করতে প্রস্তুত অনেক ক্ষেত্রে, কিন্তু মেয়েরা সহজে বশ মানতে রাজি নয়। ওরা নিজেদের জীবন বলতে আলাদা একটা পরিচয় তৈরি করে নিতে চায়----ওটা তাদের জন্মগত অধিকার।
 শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবামায়েরা অনেক সময় মেয়েদের মনের কথা ভেবেই যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে রাজি হয়ে যান। ঠিক আছে মা, তুমি পড়াশুনা শেষ করে বিয়ের কথা ভাবতে চাও, তা’ই হোক। কিন্তু মনে রেখো, মেয়েদের বিয়ের বয়স কিন্তু চট করে পার হয়ে যায়। তখন কিন্তু তোমার জীবনের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে ষোল আনা। এবং সত্যি সত্যি তাই হয়। দেশে যেমন হয় বিদেশে আরো বেশি। দেশে তো তবু টাকা দিয়ে ছেলে কেনা যায়, কিন্তু বিদেশে তা সম্ভব নয়, অন্তত শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে সেরকমটি আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখিনি। অতএব শেষ পর্যন্ত যা দেখা যায় তা প্রায় কারুরই পরম কাম্য নয়----মেয়ে চিরকুমারী থেকে যায় সারাজীবন, নতুবা ভিনজাতীয় ভিনধর্মীয় ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নেয়। আজকাল ক্যানাডা আমেরিকার অভিবাসী সমাজের ঘরে ঘরেই দেখা যাচ্ছে হয় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর বয়স্ক অবিবাহিত মেয়ে, নয়ত ভিনদেশী জামাই। ভিনদেশী ছেলেমেয়ের বিয়েতে অন্তত আমার অমত নেই, কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। প্রথমত দুটি ভিন্ন ভিন্ন মানুষ একত্রে আমৃত্যু একসঙ্গে বসবাস একটি অপ্রাকৃতিক ঘটনা, কারণ দুটি মানুষ পরস্পরের সঙ্গে নিখুঁতভাবে খাপ খেয়ে যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক। ইংরেজিতে আমি একে বলি ‘ন্যাচুরেল ইনকম্পাটিবিলিটি’। তবু ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে, সমাজের কে কি বলবে সেদিকটা লক্ষ্য করে, পারিবারিক শান্তির খাতিরে, এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক কারণে অনেক বিয়েই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। কিন্তু বর্তমান যুগের নানাবিধ ‘অধিকার’ বোধের কারণে আগেকার সেই বন্ধনগুলো ঠিক একই রকম শক্ত গেঁটোতে আবদ্ধ নয়। অর্থনৈতিক কারণটিও আগের চেয়ে অনেকটাই শিথিল আজকে----এযুগের বৌমাদেরও কাজে যেতে হয়। প্রধানত একজনের উপার্জনে সংসার চালানো শক্ত, দ্বিতীয়ত লেখাপড়া-জানা বৌ ঘরে বসে থেকে কি কেবল শ্বশুর-শাশুড়ির পা টেপাটেপি আর অজুর পানি গরম করেই জীবন কাটাবে? বিদেশে তো আরো সঙ্গিন অবস্থা। চাকরির বাজারে নিদারুণ সংকট আজকাল। পাস-করা ডাক্তারকে অনেকসময় ট্যাক্সি চালাতে হয়, বিএ-এমএ ডিগ্রিধারী স্ত্রীকে টিম হর্টন বা ওয়ালমার্টের কাউন্টারে কেশিয়ারের কাজ করতে হয়----নতুবা তাদের মর্টগেজ দেওয়া সম্ভব হবে না, ছেলেমেয়েদের জামাকাপড় কিনে দেওয়া সম্ভব হবে না, তিনচার বছর পর পর দেশে বেড়াতে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব, ঢাকা শহরে পাঁচ কাঠা জমি কেনার স্বপ্ন সফল হবে না জীবনেও। অতএব এরা দুজনই অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল পরস্পরের ওপর----আগেকার মত স্বামীর ওপর স্ত্রী, তা নয়। এ এক ভিন্নধরণের বন্ধন----দুজনই উপার্জনক্ষম, সুতরাং একাধারে মুক্ত অথচ মুক্ত নয়এসব পরিবারে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয় ছেলেমেয়েরা-----ছুটির দিন ছাড়া সচরাচর বাবামায়ের মুখ দেখারই সুযোগ হয়না তাদেরছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত তাদের মূলত আপনা-আপনিই বেড়ে উঠতে হয়। তারপর একসময় বাবামায়ের চোখে পড়েঃ তাইতো, আমাদের মেয়ের যে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। শুরু হয়ে যায় পাত্র খোঁজার হিড়িক। দেশের মুরুব্বিদের কাছে, বিলেত আমেরিকার আত্মীয়স্বজনদের কাছে। তাদের ধারণা নেই যে ইতোমধ্যে, তাদের চোখের আড়ালে, তাদের কর্মজীবনের ২৪/৭ এর আড়ালে, তাদের আদরের ছোট খুকিটির একটা নিজস্ব মন গড়ে উঠেছে, নিজস্ব পরিচয়ের পরিধি গড়ে উঠেছে, বিদেশী সমাজের ধ্যানধারণার সঙ্গে গড়ে উঠেছে একপ্রকারের একাত্মতা।
পাত্রের খোঁজে সারা দুনিয়ার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত চষে বেড়ানোর পর বাবামা মেয়ের সামনে হাজির করলেন একজন অতি সুযোগ্য পাত্র----মেয়ে তার দিকে না তাকিয়েই বলে দিলঃ উঁহু, তা হবে না। আমি এখন বিয়েই করব না। আমার কম্পিউটার সায়েন্স পাস করতে হবে, তারপর চাকরি বাকরি পেলে দেখা যাবে বিয়ে করব কি করব না। বাপমা মাথায় হাত দিয়ে বলেনঃ সব্বনাশ, একি বলে মেয়ে? একারণেই কি আমরা দুজন দিনরাত গাধার মত খাটনি খেটে যাচ্ছি? একারণেই কি দেশের আপনজন সবাইকে ছেড়েছুড়ে দিয়ে বিদেশবিভুঁইতে এসে চাকরবাকরের মত জীবনযাপন করা?
ওদিকে ছেলের মুখেও সেই একই কথা। আমি এখন বিয়ে করবনা। কেরিয়ার আগে, তারপর বিয়ে। তাছাড়া বিয়ের দরকারই বা কি। তাইতো। বিয়ের দরকারই বা কি। এমন দুনিয়াছাড়া কথা দেশ-থেকে-আসা পুরনোদিনের বাবামায়েরা বুঝবেন কেমন করে? তাদের ধারণাই নেই যে বিবাহ নামক যে পুরাকালীন প্রতিষ্ঠানটি মানুষ গড়ে তুলেছিল নেহাৎ সামাজিক শৃঙ্খলার খাতি্রে, যার অন্য কোনও গূঢ় নৈতিক বা নৃতাত্বিক তাৎপর্য নেই, থাকার কোনও যৌক্তিক কারণও নেই, সেই পরম ‘পবিত্র’ প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি এখন নড়বড়ে হয়ে উঠেছে আধুনিক যুগের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্ত পরিবেশের প্রভাবে। আমরা, পুরনো দিনের সেকেলে মনোভাবের মানুষ, এটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। সেটা যেমন স্বাভাবিক, নতুন দিনের নতুন প্রজন্ম যে তাকে গ্রহণ করে নিতে পারছে, তা’ও সমান স্বাভাবিক। সমস্যা হল ওরা আমাদেরই সন্তান----একই পরিবারে দুটি ভিন্ন শিবির তৈরি হয়ে যাওয়া কারো পক্ষেই কল্যানকর নয়।
আমাদের প্রবীনদের একটা কথা বুঝতে হবেঃ যুগ আমাদের মনের দিকে চেয়ে তার ধারা পরিবর্তন করবে না। বিদেশে তো নয়ই, দেশেও না। পরিবর্তনটা হতে হবে আমাদের নিজেদের ভেতরই। পোশাকে-আশাকে সাজসজ্জায় আর বাহ্যিক আচার আচরণে তো হয়েই যাচ্ছি, কিন্তু বড় পরিবর্তনটা আসতে হবে মনমানসিকতায়। পূব থেকে পশ্চিমে এসেছি আমরা উন্নত জীবনযাপনের আশাতে। পশ্চিমের অগ্রমুখি সমাজের সুযোগসুবিধাগুলো সব উপভোগ করে যাব অবলীলাক্রমে, অথচ পূর্বদেশের পশ্চাতমুখি ধ্যানধারণাগুলি প্রাণপন আঁকড়ে বসে থাকব তা তো হতে পারেনা। কিন্তু তা হয়, অধিকাংশ পরিবারেই হয়। এবং সেকারণে নতুন প্রজন্মের সাথে ঠোকাঠুকিটাও হয় অবধারিতভাবে। এর একটা বিহিত না করতে পারলে একদিকে যেমন স্থানীয় সমাজ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব আমরা, বহুলপ্রচারিত বহুজাতীয়তা সত্বেও, অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন হব আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও। এই ‘বিহিতের’ প্রচেষ্ঠাতে ব্যক্তি আর পরিবারকে কেবল নয়, পুরো সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। সমষ্টির যুগ্ম প্রয়াস ছাড়া একক চেষ্টাতে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান প্রায় অসম্ভব বলেই আমি মনে করি।
প্রশ্ন হলঃ এই সমষ্টিগত প্রয়াসটির চেহারা কিরকম হওয়া উচিত। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে আমরা কজন মিলে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম অটোয়াতে একটি বাঙালি সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। অনেকটা কমিউনিটি সেন্টারের মত। প্রাথমিকভাবে আমাদের প্রস্তাবটি ছিল, ঠিক কমিউনিটি সেন্টার না হলেও, একটি বৃদ্ধাশ্রম। আমাদের অভিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন এমন একটা বয়সে এসে পৌঁচেছেন যে তাদের পক্ষে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকা হয়ত সম্ভব নয়, সম্ভব হলেও অত্যন্ত দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে বার্ধক্যজনিত বিবিধ সমস্যার কারণে। তাদের সাহায্য দরকার। প্রশ্ন হল এই সাহায্যটি আসবে কোথা থেকে। পরিবার, না, সমাজ (মানে বৃদ্ধাশ্রম)? এদেশের বুড়োরা সাধারণত সিনিয়ার হোমে চলে যান নির্দ্বিধায়। আমরা তা পারিনা সহজে। কালচারের বৈষম্য বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেখানে। দিনরাত ইংরেজিতে কথা বলা আর ‘বিদেশি’ খাবার খাওয়া দুবেলা, ‘বিদেশি’ আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করা, সেই প্রবীণ বয়সে সেটা কারুরই কাম্য নয়। আমাদের আশা ছিল বৃদ্ধাশ্রমটি তৈরি হয়ে গেলে তাকে কেন্দ্র করে আস্তে আস্তে একটা কমিউনিটি সেন্টারও নির্মাণ করে ফেলা খুব কঠিন হবে না। কমিউনিটি সেন্টারের ওপর এত জোর দিচ্ছি কেন আমি? জোর দিচ্ছি এজন্যে যে তাহলে সেখানেই একটা সংস্থান হতে পারত আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের। তারা সেখানে গিয়ে পরস্পরের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করতে পারত, খেলাধূলা করতে পারত নিজেদের পরিচিত পরিবেশে, কথাবার্তা বলতে পারত নিজেদের ভাষায়। এভাবেই পরিচয় হতে হতে একসময় ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়ে যেতে পারত, এমনকি মনের আদানপ্রদানও। এতে করে হয়ত বিজাতীয় সম্পর্কের সম্ভাবনাটি অনেকটাই কমিয়ে দেয়া যেত। তারা নিজেরাই বাছাই করে নিতে পারত তাদের ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গিদের। এখন তাদের সে-সুযোগটা নেই। হাই স্কুলে যাবার পরই ছেলেমেয়েরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে শুরু করে। তারপর এমন হয় যে বছরের পর বছর কেটে যায় তাদের কোনও যোগাযোগ থাকে না, চিঠিপত্র দূরে থাক, ইমেইলেও নয়। ছোটবেলার পরিচিত মুখগুলি কালে কালে আগন্তুকের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির পেছনে এ’ও একটা ইন্ধন যোগায় বলে আমি মনে করি।
কেউ কেউ এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন যে ছেলেরা, এমনকি মেয়েরাও, অনায়াসে মসজিদে গিয়ে সেই অভাবটি ঘুচিয়ে নিতে পারে। মসজিদ তো একরকমের ‘কমিউনিটি সেন্টার’ও বটে! দুঃখিত, আমি একমত পোষণ করতে পারছিনা। মসজিদ একটি উপাসনাগৃহ----কেবল মুসলমান ধর্মাবলম্বী ছেলেদের জন্যে। মেয়েরা সেখানে যেতে পারে বটে, কিন্তু ভদ্র শরিয়ামাফিক মার্জিত পোশাক পরিধান করে (যার মানে হিজাব বা নিকাব বা ঐজাতীয় কিছু একটা পোশাক), এবং ছেলেদের থেকে আলাদা পরিবেশে, ইত্যাদি। এমন একটি শ্বাসরোধকর পরিবেশে কোনও সুস্থমস্তিষ্ক স্বাভাবিক টিনেজার যেতে চাইবে বলে মনে হয় আপনার? না ভাই, মসজিদ শুধু নামাজেরই জন্যে, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার জন্যে নয়। ‘অবাধ’ শব্দটাই মসজিদ বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে খাপ খায় না। সেখানে বাধাই নিয়ম। ওদিকে টিনেজদের স্বভাবই হল সবরকম বাধা অমান্য করা। ওই অমান্যতার প্রবৃত্তিকে মুক্তির স্বাদ দেবার সুযোগ করে দিতে হবে আমাদের। কিন্তু আমরা তা করছিনা, করার প্রয়োজনটাও বোধ করছিনা।
ত্রিশ বছর আগে বড় একটা সুযোগ ছিল বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার----ক্যানাডিয়ান সরকার থেকে একটা মোটা অঙ্কের অনুদান পাওয়া যেত তখন। কিন্তু আমাদের কমিউনিটির রথী-মহারথীরা খুব একটা গা করেননি তখন। হয়ত তাঁরা ভাবতেন যে বুড়ো হতে অনেক দেরি তখন, এত তাড়া কিসের। কেউ কেউ হয়ত এমনও ভাবতেন যে তাঁরা কোনদিন বুড়ো হবেন না, বা হলেও ছেলেমেয়েরা থাকতে চিন্তা কিসের। বাপদাদা চোদ্দ পুরুষের কেউ কখনো আশ্রমে থাকেনি, আমরা থাকব কেন? দুঃখের বিষয় যে বাস্তব জীবন এসে কড়া নাড়ছে আমাদের সবারই দরজায়। আমরা বুড়ো হচ্ছি, এবং আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আমরা চাচ্ছি না ছেলেমেয়েদের ওপর নির্ভর করতে----এতে করে আমরা যেমন ওদের পথের কঁটা হয়ে পড়ি তেমনি ওরাও পদে পদে আমাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধবয়সে আমাদের সবচেয়ে কাম্য বস্তু হলঃ স্বাধীনতা, আত্মসম্মান, মাথা উঁচু রেখে চোখ বুঁজতে পারা। সেটি কোনও সন্তানের গলগ্রহ অবস্থায় সম্ভব নয়। সেকারণে আজকাল দেশেও শুনেছি মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবামায়েরা আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন, অথবা সরাসরি কোনও পছন্দসই আশ্রমে উঠে যাচ্ছেন। এটাই নতুন যুগের নতুন সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার ধারা----এতে ভালমন্দ সত্যযুগ-কলিযুগের ব্যাপার নেই। সহজ সরল বাস্তবতা। এর সাথে মানিয়ে চলা ছাড়া উপায় নেই আমাদের।
কিন্তু আমরা সেই বাস্তবতাটি অনিবার্য জেনেও কেবল পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ ফাণ্ডের জন্যে টাকা তুলে যাচ্ছি। এবং দুঃখের বিষয় যে ‘মসজিদ’ শব্দটা শোনামাত্র আমাদের পকেটের বোতাম আপনা থেকেই খুলে যায়। আদত কথাটা কিন্তু নামাজ নয়, কমিউনিটি নয়, সোয়াব। আমাদের প্রধান চিন্তা হল পরকাল। বেহেশত। হাশরের ময়দান। বেহেশতে যেতে হলে যথেষ্ঠ ‘ব্রাউনি পয়েন্ট’ জমাতে হবে, যার আরেক নাম ‘সোয়াব’। সোয়াবের গন্ধ পেলেই আমরা চোখ বুঁজে ছুটি। তখন আমাদের সন্তানেরা কি গোল্লায় গেল না জাহান্নামে গেল সেসব তুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করিনা। আর বুড়োরা? তাদের আবার সমস্যা কিসের? বয়স হয়েছে, সারাদিন আল্লার কালাম নিয়ে থাকবেন, নামাজরোজা করবেন, বারকয়েক মক্কাশরিফে যাবেন, কোরাণ তেলোয়াত করবেন চব্বিশ ঘন্টা----তারপর সময় হলে তৌবা পড়ে ইন্তেকাল করবেন। এর চেয়ে শান্তির জীবন আর কি আছে। তাদের আশ্রমের প্রয়োজন হবে কেন?
তাইতো। মসজিদ থাকতে আশ্রম আর কমিউনিটি সেন্টার কেন?

অটোয়া, ৭ই জুলাই, ‘১৪

মুক্তিসন ৪৩
মীজান রহমান