মীজান রহমান
সকলেই মূলত তৈলপুষ্ট) ফর্বস
পত্রিকায় নিয়মিতই ব্রুনাইর সুলতানের উল্লেখ থাকে বড় বড় অক্ষরে। তাঁর বিলাসবহুল
জীবনের একটা আভাস দেওয়া যাক। তাঁর রাজপ্রাসাদে মোট ১,৭৮৮ টি কক্ষ। মাস্টার
বেডরুমের আয়তন ৪,০০০ বর্গফুট। প্রাসাদের বাথরুম সংখ্যা ২৫৭। ৫ খানা সুইমিং
পুল। তাঁর গাড়ির সংখ্যা আনুমানিক ৭,০০০। একটা হেয়ারকাটের
জন্যে তিনি খরচ করেন ২১,০০০ ডলার! তাঁর ছোটভাই প্রিন্স জেফ্রির গাড়ির সংখ্যা ২,৩০০
এর কিঞ্চিৎ বেশি বলেই অনুমান করা হয়। তিনি নিজে বিলেত আমেরিকাতে ফুর্তির জীবন যাপন
করে কম করে ১৫ বিলিয়ন ডলার উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ক’বছর আগে তাঁকে নিয়ে বেশ
হই চই হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। বেসামাল জীবন, উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহার, লাগামবিহীন
যৌনবিলাস, ইত্যাদি। তাঁর বাড়াবাড়ি তাঁর বড় ভাইকেও বিব্রত করে ফেলেছিল। সেই ‘বড়ভাই’
নিজে তুলসিধোয়া ফেরেশতা, তা নয়। তাঁর প্রাসাদেও নিয়মিত সেক্স-পার্টি হওয়ার খবর
আসে। তাঁর হারেমে রূপসী নারী আর কিশোরী মিলে ঠিক কজন মজুত আছেন তা অনুমান করা শক্ত
নয়। বিদেশ থেকে বিশেষ অর্ডার দিয়ে আমদানিকৃত সুরার লহরি তাঁর প্রাসাদজীবনের অতি
আবশ্যিক অঙ্গবিশেষ।
পত্রিকায় দুটি খবর পড়ে বেশ মজাই পেলাম। একটি অটোয়াতে।
আরেকটি পাকিস্তানের লাহোরে। অটোয়াতে একটি টিনেজ মেয়ের ছবি বড় করে ছাপা কাগজে।
সুশ্রী চেহারা, কান্তিময়, স্নিগ্ধ। বেশ ভদ্রঘরেরই মনে হল। স্থানীয় জুনিয়ার হাইতে
পড়ে মেয়েটি। খবরের বিষয়বস্তু হলঃ তার স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নালিশ----ছাত্রীদের
প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। ছাত্রদের জন্যে কোনও ড্রেসকোড নেই, আছে কেবল মেয়েদের
জন্যই----এ কেমনতরো বিচার। মেয়েদের ভদ্রভাবে, শালীনতার সঙ্গে পোশাক পরতে হবে,
ছেলেরা পরতে পারে যা-ইচ্ছে তাই। মেয়েরা ব্রা পরতে পারবে, কিন্তু কেউ যেন ব্রা’র
ফিতে দেখতে না পারে। মেয়ের বক্তব্যঃ ফিতাই যদি আড়াল করতে হয় তাহলে ব্রা পরারই বা
দরকার কি। বাচ্চা মেয়ে, তেরো-চোদ্দ বছরের বেশি হবে না, কিন্তু যুক্তি বেশ পাকা
বলেই তো মনে হল আমার কাছে। এখানে মহারানী ভিক্টোরিয়ার কড়া চোখের মৃদু আভাস দেখা
যাচ্ছে বটে। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এমন কোনও বেয়াদবি হয়ত নয়।
এর পাশে যে খবরটা না পড়ে পারা গেল না
সেটা একটি হতভাগ্য পাকিস্তানী মেয়ের কাহিনী। মস্তবড় অপরাধ করে ফেলেছিল
সে----প্রেমে পড়ে গিয়েছিল! শুধু তাই নয়, বিয়েও করে ফেলেছিল ছেলেকে বাবামার অমতে,
তদুপরি সে তিনমাসের গর্ভবতী। এতগুলো অপরাধ পরিবার ক্ষমা করে কিভাবে। সমাজই বা
বরদাস্ত করবে কেন। অতএব তার প্রাপ্য সর্বোচ্চ শাস্তি। সর্বোচ্চ এবং প্রকাশ্য। এবং
শাস্ত্রসম্মত। আমৃত্যু প্রস্তরনিক্ষেপ, নতুবা একশ’টি বেত্রাঘাত। মেয়ের বাবা, নিজে,
এবং তার বড়ভাই, মেয়েকে পাকড়াও করে নিয়ে যান লাহোরের অন্যতম জনবহুল
স্থানে---হাইকোর্ট চত্বরের সামনে। যেখানে রাষ্ট্রের মহাবিচারপতিগণ নিত্য পদচারণা করেন,
অন্যায় আর অবিচার মোচনই যাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই পবিত্র মণ্ডপে, মেয়েকে দাঁড়
করিয়ে, তিনি এবং তাঁর অনুগত সঙ্গীসাথিরা, মুহুর্মুহু পাথর ছুড়ে ওর সারা শরীর
ছিন্নভিন্ন করে ফেলেন, রক্তের স্রোত বন্যাধারার মত প্রবাহিত হতে থাকে রাস্তায়। চারদিকে লোকজন নিঃশব্দে
দাঁড়িয়ে সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য উপভোগ করে যান----একটিবার কেউ তাদের বাধা দেবার
প্রয়াস পেয়েছিলেন কিনা তার কোনও প্রমাণ নেই। (জনতার তো চিরাচরিত কাজই তাই---তামাশা
দেখা দূর থেকে)। শরিয়ার বিধান, পরিবারের সম্মান, তাতে তারা বাধা দেবে কেন। মেয়েটার
অসার দেহ পড়ে থাকল পথের ওপর। পথের বিবর্ণ ধুলোই হয়ে থাকল তার একমাত্র বিশ্বস্ত
সাক্ষী।
একটা কুটিল ভাবনা তখন আমার মনের ভেতর
খেলা করতে লাগল। এ-দুটি মেয়ে যদি স্থান পরিবর্তন করে একে অন্যের জন্মভূমিতে পৌঁছে
যেতে পারত তাহলে কেমন হত। অটোয়ার মেয়েটির কি দশা হত সেটা তো সহজেই অনুমান করা যায়।
প্রথমে দশটা জোয়ান মিলে তাকে চামড়াশুদ্ধ কামড়ে ছিড়ে খেয়ে ফেলত। তারপর যথাযথ
শরিয়ামাফিক তার ‘সুযোগ্য’ শাস্তির ব্যবস্থা করা হত-----ইরাণে যা হয় নিত্যনিয়মিত,
সৌদি আরবে হয়, সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়াতে যা হয়েছে। শোনেননি বুঝি? তাহলে শুনুন। পঁচিশ
বছরের এক বিধবা মেয়ে। ভরা যৌবন সারা শরীরে, অতএব পরম লোভনীয় পাড়ার ছেলেবুড়ো
সকলেরই। সহজপ্রাপ্য বলেও ধারণা অনেকের। একদিন পরিবারের লোকেরা তার ঘরে এক
শ্রীমানের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। আর যায় কোথায়। সেখানে শরিয়ার শাসন, অতএব ক্ষমার
ফাঁক নেই। শাস্তি না দেওয়াটাই মহাপাপ। কিন্তু এমন একটি রসালো দ্রব্য, তার অপচয় করা
কি ঠিক হবে? না তাতে পুরুষজাতির ইজ্জত থাকে। সুতরাং ঠিক ওই ঘরেতেই আটন’জন তাগড়া
জোয়ান ছেলে উপর্যুপরি মেয়েটাকে ধর্ষণ করে, তারপর তাকে ছেড়া নেকড়ার মত অসার অবস্থায়
ফেলে চলে যায়। বাকি কাজটুকু সমাজপতিদের----বিচার আচার করে যা শাস্তি দেবার দেওয়া। অটোয়ার
মেয়েটির ব্যাপারে ভাবলামঃ পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করে ওরকম ধৃষ্টতা দেখাবার সাহস পেলে
সম্ভবত তারও একই অবস্থা দাঁড়াত। ওদিকে পকিস্তানের ওই হতভাগা মেয়েটি এদেশের মুক্ত
পরিবেশে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তার নিজের জীবন নিয়ে মগ্ন থাকতে পারত----কেউ তাকে
ঢিল মেরে জখম করার কথা কল্পনাতেও স্থান দিত না। এদেশের শাস্ত্রে বা আইনে, এমনকি
সামাজিক আচরণেও, সেরকম বিধান নেই।
পাকিস্তানের আরো একটি খবর ভীষণ বিচলতি
করেছিল আমাকে। এক পাকিস্তানী ডাক্তার, খুবই বিবেকবান, একনিষ্ঠ, সেবাগতপ্রাণ,
বিলেত-আমেরিকার ভাল ভাল কলেজ থেকে উঁচু ডিগ্রি-করা তরুণ চিকিৎসক, দেশে গেছেন
কিছুদিন দেশের গরিবদুখিদের সঙ্গে সময় কাটাবেন, অসহায় রোগিদের চিকিৎসা করবেন বিনা
পয়সায়। খানিকটা পুরনো দিনের সেই ‘দেশের ঋণ পরিশোধ করে দায়মুক্ত’ হওয়ার তাগিদেই
হয়ত। কিন্তু তাঁকে সেসুযোগ দেওয়া হয়নি। বিমানবন্দরেই তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
কে বা কারা করেছে সেকাজ সেটা পরিষ্কার জানা যায়নি, তবে অনুমান করা হয় যে তাঁর বড়
অপরাধ ছিল একটি আহমেদিয়া, বা কাদিয়ানি, পরিবারে জন্মগ্রহণ করা। কাদিয়ানিরা মুসলমান
সেটা স্বীকার করা বা দাবি করাটাও সেদেশে বড় পাপ। তারাই নয় কেবল, শিয়ারা,
ইসমাইলিরা----এরা সবাই অমুসলমান। এবং অমুসলমান হওয়ার মত অভিশাপ আর নেই পাকিস্তানে।
আপনি অমানুষ হতে পারেন, রক্তচোষা পিশাচ হতে পারেন, সিরিয়েল রেপিস্ট বা সিরিয়েল
কিলারও হতে পারেন, সমাজে তার মার্জনা আছে, মার্জনা নেই কেবল সুন্নি মুসলমান না
হওয়ার।
এসব কাহিনী শোনার পর আমি মনে মনে হাজারবার
কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের জাতীয় নেতাদের, বিশেষ করে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। তাঁদের
আত্মত্যাগের কারণেই তো আজকে আমরা পাকিস্তানের এসব কুকীর্তি থেকে নিজেদের আলাদা
ভাবতে পারছি। ভাগ্যিস, দেশটাকে তাঁরা স্বাধীন করতে পেরেছিলেন। নইলে আমি কেমন করে
লুকোতে পারতাম নিজেকে পাকিস্তানী বলে স্বীকার করার লজ্জা। কোন্ অধিকারে আমি দাবি
করতাম যে, না, আমি সেরকম মুসলমান নই। আসলে আমি প্রথমত মুসলমসানই হতে চাই না, হতে
চাই একজন হৃদয়বান মানুষ, একজন সৎ, সত্যনিষ্ঠ ও ইহজাগতিক মানুষ, যার বিচারে ধর্মের
চাইতে কর্মের মূল্য অনেক বেশি, ইমানের চেয়ে মনুষ্যত্বের, যার প্রাণের বড় ধ্বনিটা
কোনও খড়গহস্ত ‘সুন্নি’র নয়, বড় ধ্বনি বৃহত্তর মানবতাবোধের।
সম্প্রতি আরো দুটি ঘটনার খবর পৌঁছালো
আমার কাছে। একটি স্থানীয় পত্রিকায়, আরেকটি ইউটিউবে। পত্রিকায় দুজন ‘বিবাহিত’ সমকামী
পুরুষ। পশ্চিম বিশ্বে ‘সমকামী’র সাথে ‘বিবাহিত’ শব্দটির সংযোগ এক অভিনব ঘটনা। দশ
বছর আগে কেউ একে কল্পনাতে ঠাঁই দিতেও সাহস পেত না হয়ত। পঞ্চাশ বছর আগে
জীববিজ্ঞানীরা, যারা তার বহু আগে থেকেই টের পেয়েছিলেন যে সমকাম কোনও চারিত্রিক
বিকৃতি নয়, প্রকৃতিরই এক অদ্ভুত মেজাজি রূপ মাত্র। জীবজগতে তা আছে, আদিকাল থেকেই
ছিল, মনুষ্যকুলেও ছিল, বরাবরই ছিল, সেটা মেনে নেবার মত বুকের পাটাই ছিলনা কেবল।
মেনে নেয়া দূরে থাক, সমাজের কোথাও সমকামের সামান্য গন্ধ পাওয়ামাত্র পাগলা কুকুরের
মত লাঠিসোটা নিয়ে সবাই ছুটত বেচারার পেছনে তার গা থেকে সমকামের ‘ভূত’ ছাড়াবার
জন্যে। ধর্মান্ধ দেশগুলোতে তো বটেই, এমনকি উন্নত বিশ্বেও। পৃথিবীর সর্বোন্নত দেশ
বলে নিজেকে দাবি করতে সর্বদা ভালবাসে, সেই মহান আমেরিকাতেও, মাত্র ১৬ বছর আগে,
১৯৯৮ সালের ৬ই অক্টোবর, ওয়াইয়োমিং অঙ্গরাজ্যের লারামি শহরের শহরতলিতে ম্যাথিও
সেপার্ড নামক এক ২১ বছর বয়স্ক নিরীহ যুবক, ইউনিভার্সিটির ছাত্র, তাকে নির্মমভাবে
পিটিয়ে মৃতাবস্থায় ফেলে রাখা হয় একটা পোড়োজমির বেড়ার ওপর। তার অপরাধঃ সমকামী
(অন্তত সেভাবেই খবরটা প্রচার হয়েছিল সেসময়)। সেই বর্বর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, ঘরে
ঘরে সেই লোমহর্ষক বেতারে টিভিতে প্রচার হবার পর, হঠাৎ করেই যেন আমেরিকার বিবেক
নাড়া দিয়ে ওঠে। ঠিক সেসময়ই প্রসিডেন্ট ক্লিন্টনের সেই বিখ্যাত বাণী শোনা যায় সংবাদ
মাধ্যমেঃ “ডোন্ট আস্ক, ডোন্ট টেল”। (জানতে চেও না, জানতে দিও না)। আজকে সেই একই
দেশ, আমেরিকাও নেহাৎ কম নয় ধর্মীয় গোঁড়ামির দিক থেকে, তা সত্ত্বেও, স্রেফ
মানবাধিকারের খাতিরে সেই চিরনিষিদ্ধ বিষয়টিকে (যা তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বারবার
ঘিনঘিন করা হয়েছে, পইপই করে বলা হয়েছে যে সমকাম মহাপাপ) বৃহত্তর সামাজিক বিধানের
অন্তর্গত বলে গ্রহণ করে নিয়েছে। ম্যাথিও সেপার্ডের অমানুষিক হত্যার সূত্র ধরে, আজ
মাত্র তেরো কি চোদ্দ বছরের মাঝে, এই একই দেশের নানা অঙ্গরাজ্যে, ‘সমকাম’ শুধু নয়,
‘সমকামী বিবাহ’ পর্যন্ত তারা সহ্য করে নিয়েছে। আগেকার কিছু রক্ষণশীল রাজ্যেও এ
বিবাহ এখন আইনত স্বীকৃত। এর নাম প্রগতি। না, আমি একে কেবল প্রগতিই বলব না, বলব
দ্রুত অগ্রগতি। অগ্রগতির এই ত্বরিত বেগ, পশ্চিম বিশ্বের প্রধান চালিকাশক্তি। তার
ধনদৌলত নয়, শানসওকত নয়, বিশাল বিশাল দালানকোঠা আর আকাশচুম্বী ইমারত নয়, তার আসল
সম্পদ হল এই অগ্রগতি, এক মুহূর্ত কোথাও থেমে না থাকার অন্ধ নেশা, সম্মুখ, সম্মুখ
আর সম্মুখ ছাড়া অন্য কোনও দিক তাদের গণনায় নেই----এখানেই পশ্চিম সবার আগে এগিয়ে
গেছে। আমরা, আমাদের দেশ, তা এখনো পারিনি বলে আমরা সেই মধ্যযুগের পঙ্কতে পা আটকে পড়ে
আছি।
একই সাথে ইউটিউবে যে ভিডিওটা দেখলাম তার
চেহারা একেবারে ভিন্ন। মানে বিপরীত। দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার অবস্থা
দাঁড়ায়----এতটাই বীভৎস। একটি লেখাপড়া জানা মেয়েকে টেনে হেঁচড়ে সদর রাস্তায় নিয়ে
এসেছে পুলিশ। দুজন ইয়া জোয়ান কশাই চেহারার দৈত্যাকার পুরুষ। তাদের হাতে লম্বা,
চামড়ার চাবুক। তাকে ১০০ বার চাবুক মারা হবে, প্রকাশ্যে। লোকজন জমা হয়েছে
চারপাশে----খোলা জায়গাতে বিনা পয়সায় তামাশা দেখবার সুযোগ তো বেশি হয়না ওদের। দেশটা
তো ইউরোপ-আমেরিকা নয়, খোদ আফ্রিকা। এবং সুদান, যেখানে শরিয়ার শাসন। শরিয়ার শাসন
যেখানে সেখানেই তো জনসাধারণের ভাগ্যে ঘটে প্রকাশ্য বেত্রাঘাতের দৃশ্য দেখতে পাওয়া মাঝে
মাঝে। ওসব দেশে তো এমনিতেই বিনোদন বড় বিরল।
শুরু হল চাবুকের বাড়ি। ইউটিউবে
পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল সেই ঘায়ের শব্দ----যেন সুদানের তপ্ত বায়ুর গা চিরচির করে
কেটে সোজা মেয়েটির শরীরে গিয়ে লাগছে। একেকটি ঘা বিকট এক চিৎকার তুলে নিয়ে আসে
মেয়েটির আত্মা ভেদ করে। সে যে কি অসহ্য ব্যথা হতে পারে কল্পনা করতেই আমার মাথা
ঝিমঝিম করতে থাকল। এবং বেচারি যতই বলে, না না আর নয়, আর পারছি না নিতে, ততই যেন
জোয়ানদুটির জোশ বেড়ে যায়----শরিয়ার শানিত রক্তচক্ষু ততই হিংস্র হয়ে ওঠে। না, আমি শেষ পর্যন্ত দেখতে
পারিনি----অতটুকু বর্বরতা অন্তত ক্যানাডায় বসে দেখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। পঞ্চাশ
বছর আমি একটা সভ্য দেশে বাস করেছি। ধর্মের নামে এতখানি পাশবিকতা কেমন করে সহ্য করব
আমি।
ও হ্যাঁ, ভাল কথা, মেয়েটার কি অপরাধ
ছিল সেটাই তো বলা হয়নি। পশ্চিমা মেয়েদের মত সে প্যান্ট পরে রাস্রায় বেরিয়েছিল!
মানে একটা তুচ্ছ, পাশ্চাত্য পোশাকের জন্যে ১০০ টি দোররা? তা’ও সদর রাস্তায়? এই
শরিয়াকে ক্যানাডা-আমেরিকায় আমদানি করার জন্যে আমাদের মিয়াভাইরা উঠেপড়ে লেগেছেন?
দেশবিদেশের খবরাখবর যারা রাখেন একাধটু
তারা হয়ত একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছেন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর যোগাযোগ
মাধ্যমের কল্যানে মানুষে-মানুষে যে ব্যবধানটি ছিল একসময়, যে ফারাক ছিল এক জাতির
সঙ্গে আরেক জাতির, তা অনেকাংশেই হ্রাস পাবার কথা। সে কারণেই তো ‘গ্লোবাল ভিলেজ’
নামক একটা জনপ্রিয় বুলি চালু হয়েছে, তাই না? সব ভেদাভেদ দূর হয়ে যাবে, ভেঙ্গে যাবে
সব বাধার দেয়াল। কিন্তু বাস্তবে কি ঠিক তার বিপরীতটাই দেখা যাচ্ছে না? পশ্চিম যত
দ্রুতবেগে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে, আলোকায়নের দিকে, প্রাচ্যের কতগুলো জাতি প্রায়
একই গতিতে ধেয়ে চলেছে পেছনের দিকে। পশ্চিমে আজকে ‘মানবাধিকার’এর জয়জয়াকার, প্রকৃত
ক্ষেত্রে না হলেও কাগজেকলমে, আর প্রাচ্যের দেশগুলোতে ‘মানবাধিকার’ লঙ্ঘন আর বর্জনই
যেন হয়ে উঠছে দৈনন্দিন জীবনের নিয়ম। এবং এই প্রক্রিয়াতে দুটি জিনিস বিপুল সহায়তা
দিয়েছে। এক, তেল। মানে খনিজ তেল, জ্বালানি তেল। দুই, ধর্ম। ধর্ম না হলেও ধর্মীয়
গোঁড়ামি তো বটেই, যদিও গোঁড়া বিশ্বাস ছাড়া ধর্মপালন হয় কেমন করে তা’ই আমার মাথায়
ঢোকে না। এরা একে অন্যের অবিছেদ্য দোসর। আগে যেমন ছিল ধর্ম আর রাজ্য----যেখানে
ধর্ম সেখানে রাজ্য, আবার রাজ্য এগুতে থাকলে ধর্মও ছুটবে পেছন পেছন। আজকে
রাজ্যবিস্তার হচ্ছে না তেমন, অন্তত ভৌগোলিকভাবে নয়, কিন্তু তেল দিয়ে রাজ্যের
মানুষগুলিকে কিনে ফেলার প্রক্রিয়াটি মোটামুটি ভালই চলছে বলে মনে হয়। তার প্রকৃষ্ট
উদাহরণ তো আমাদের নিজেদের দেশটিই। ১৯৭২ সালে কিরকম একটি দেশ হবার কথা ছিল, আর এখন
কি হয়েছে তা একটু ভেবে দেখলে সহজেই বোঝা যাবে যে এর পেছনে কারিগরি কাজখানি হল সৌদি
তেলের টাকার। সেই জোরেই তো ‘৭২এর ঘৃণ্য মোল্লারা আজকে দেশের সর্বেসর্বা হয়ে
দাঁড়িয়েছেন, মুখ দিয়ে যা বেরুচ্ছে তা’ই বলে যাচ্ছেন অবলীলাক্রমে। আজকে তারা আমাদের
বলে দিচ্ছেন কারা দেশে থাকার যোগ্য, কারা যোগ্য নয়। আজকে তারাই বলে দিচ্ছেন কে
মুসলমান, কে নয়, কে নাসারা, কে মোনাফেক কে ইমানদার। এ সবই তেলের বরাতে হয়েছে।
কিন্ত সেসব তো সবারই জানাকথা।
এবার একটু অন্যদিকে চোখ ফেরানো যাক।
ধরুণ, ব্রুনাই নামক প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী ক্ষুদ্র দেশটির কথা। বোর্নিও
দ্বীপের অন্তর্গত একরত্তি একটা দেশ----মোট এলাকা ৭৪৩,৩৩০ বর্গ কিলোমিটার (২৬৭,৫৯৯
বর্গ মাইল), যার অধিকাংশই গভীর জঙ্গলাকীর্ণ। লোকসংখ্যা সর্বকুল্যে ৪০৮,৭৮৬ (২০১২ সালের শুমার
অনুযায়ী), অর্থাৎ আমাদের অটোয়া শহরের প্রায় অর্ধেক। সেখানে কেমন করে যেন একটা
রাজতন্ত্র দানা বেঁধে ওঠে সেই মধ্যযুগ থেকেই। প্রবল প্রতাপাদিত্য সুলতান বোল্কিয়া
ব্রুনাই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে, এবং রাজত্ব করেন ১৪৮৫ থেকে
১৫২৫ পর্যন্ত। সেই যে কায়েম হয়ে বসে গেল বোল্কিয়া বংশ, সেই বংশধারা এখনো বলবৎ,
যদিও পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিক যুগে তাঁদের ভাগ্যাকাশে বেশ কিছু উত্থান পতন ঘটেছে।
অবশেষে তাঁরা ব্রিটেনের রক্ষিতা রাষ্ট্র (protectorate) হিসেবে নাম-কা-ওয়াস্তে সুলতানত্ব বজায় রাখতে
পেরেছিলেন অনেকদিন। তারপর ১৯৮৪ সালে ব্রিটেন শেষবারের মত ব্রুনাইর পাট চুকিয়ে
নিজের দেশে ফিরে যায়, সুলতান বোক্লিয়ার ওপর রাষ্ট্র পরিচালনার ভার চাপিয়ে।
ইতোমধ্যে, ১৯২৯ সালে তেল আবিষ্কার হয় ব্রুনাইতে, বিপুল সেই সম্পদ। সেই সম্পদের
যতটুকু অংশ শুষে নেওয়া সম্ভব ব্রিটেন তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করার পর বাকিটুকু
উদারচিত্তে দান করে দেন মহামান্য সুলতানের পরিবারকে। আজকে শুধু তেল নয়, ন্যাচুরেল
গ্যাসের জন্যেও ব্রুনাইর উৎপাদন ক্ষমতা বড় বড় অনেক দেশের সঙ্গেই তুলনীয়। তেল আর
গ্যাসের কল্যানে ব্রুনাইর মত ক্ষুদ্র একটি দেশ এখন অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ বলে
গণ্য করা হয় না, পশ্চিম বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে এমন যোগ্যতাসম্পন্ন
সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র। সেদেশে গরিব বলে কেউ নেই, কোন পরিবারে অভাব অনটন নামক কোন
অবস্থার সঙ্গে পরিচয় নেই। সেখানে শিক্ষা অবৈতনিক, স্বাস্থ্যরক্ষা ও পরিচর্যাজনিত
যাবতীয় ব্যয় সব সরকারের দায়িত্ব। পৃথিবীর ১৮২ টি দেশের মাঝে অর্থসম্পদের দিক থেকে
ব্রুনাইর অবস্থান ৫ নম্বর। এদেশের মানুষ যদি ‘চিরসুখি’ না হয় তাহলে কারা হবে বলুন
তো। আসলেও তাই----‘সুখ’ জিনিসটাকে যদি দাড়িপাল্লায় ওজন করা যেত তাহলে ব্রুনাইর
অর্ধলক্ষ মানুষ হয়ত দুনিয়ার সবাইকে হার মানিয়ে দিত।
কিন্তু।
কিন্তু, হ্যাঁ, একটা কিন্তু আছে বটে।
ব্রুনাইর সুলতান মে মাসের ১ তারিখে নতুন আইন প্রবর্তন করেছেন। ঠিক নতুন নয়, বরং খুবই
পুরনো। এতই পুরনো যে ওই আইন ব্রুনাইর মত একটি দারিদ্র্যমুক্ত রাষ্ট্রে প্রয়োগ
করবার কি প্রয়োজন ছিল সেটাই কোনও সুস্থমস্তিষ্ক লোকের মাথায় ঢোকে না। সেটা হল
শরিয়া। শরিয়ার আইন বলতে কি বোঝায়? তাহলে মুখোশটা নাহয় পুরোপুরিই তুলে ধরা যাকঃ
নিম্নলিখিত ‘অপরাধগুলোর’ যে কোন একটাতে দোষী সাব্যস্ত হলে গুরুতর শাস্তি পেতে
হবেঃ বেত্রাঘাত, অঙ্গবিচ্ছেদ (হাত বা পা বা উভয়ই), কারাবাস, প্রস্তরনিক্ষেপ দ্বারা
মৃত্যুদণ্ড, মুণ্ডচ্ছেদ, ইত্যাদি।
(১) শুক্রবার জুম্মার নামাজে শরিক না হওয়া;
(২) অবিবাহিত নারীর গর্ভধারণ;
(৩) অশালীন পোশাক পরিধান;
(৪) হিজাব পরাতে আপত্তি করা; (মেয়েদের জন্যে অবশ্যি)
(৫) অমুসলমান বেবিসিটার নিয়োগ;
(৬) খৃস্টানদের “আল্লা” শব্দটির ব্যবহার, এবং অমুসলমানদের ধর্মীয় আলোচনা;
(৭) রোজার দিনে প্রকাশ্যে খাবার বা পানীয় মুখে দেওয়া;
(৮) চৌর্যবৃত্তি;
(৯) সমকামিতা;
(১০) বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার।
পশ্চিমের নারীবাদী গোষ্ঠী আর মানবাধিকারবাদীরা স্বভাবতই খুব খুশি নন সুলতানের
শরিয়াতন্ত্রের ওপর। তাদের আপত্তির জবাবে সুলতান বলেছেনঃ আমার কি করার আছে। এতো
আল্লার কথা, আমার নয়। (প্রশ্ন করতে হয়, এটা যে আল্লার বিধান সেটা তিনি কেমন করে
জানলেন? আল্লার নিজের মুখ থেকে শোনা? তা যদি না হয় তাহলে কোন-না-কোন মানুষ বলেছে।
অর্থাৎ বিশ্বাসটি আল্লাকে নয়, সেই মানুষটিকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পৃথিবীর কোন
ধর্মই স্বয়ং ‘আল্লার’ কাছ থেকে আসেনি, একজন বা একাধিক ‘মানুষ’ বলেছেন যে সেটা
আল্লার কাছ থেকে এসেছে, এবং মানুষ তা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে নিয়েছে।)
তবে কি জানেন, মহান সৃষ্টিকর্তার আরেক
নাম পরম করুণাময়, তা একেবারে অকারণে নয়। তাঁর আইনকানুন একটু কড়া হতে পারে, তাই বলে
তাঁর প্রাণে দয়ামায়া নাই সেটা কিন্তু ঠিক নয়। কড়া আইনের মাঝেও তিনি ফাঁকফোকড় রাখেন
প্রয়োজনবিশেষে----‘ব্যতিক্রম’ বিষয়টি তাঁর রাজত্বেও প্রযোজ্য। ব্রুনাইর বেলাতেও তা
সত্য। শরিয়া আইন জারি করতে গিয়ে সুলতান বোল্কিয়া একটি ব্যতিক্রম রেখেছেন----তিনি নিজে
এবং তাঁর পরিবারের সদস্যসমূহ। এঁদের বেলাতে একই আইন খাটবে না। কেন খাটবে না তার
কোনও পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই, এবং সেটা আল্লার দরবার থেকেই এসেছে কিনা তা’ও তিনি
খোলশা করে জানিয়ে দেননি কাউকে। তবে ধর্মগ্রন্থগুলো একটু ঘাঁটাঘাটি করলেই দেখা যাবে
যে এধরণের ‘ব্যতিক্রম’ আল্লাতা’লা আরো বহুবার কবুল করেছেন। কেন করেছেন সে রহস্য এক
আল্লামাবুদ ছাড়া কে জানবে? তাঁর মনের খবর জানবার সাধ্য দুনিয়াতে কার।
যাই হোক, ব্রুনাইর বেলাতে এই
‘ব্যতিক্রম’এর ফলাফলটি বিশেষভাবে লক্ষনীয়। আজকে সুলতান বোক্লিয়ার ব্যক্তিগত
ধনদৌলতের মূল্য ধরা হয়েছে ২০ বিলিয়ন, সৌদির রাজাবাহাদুরের চাইতে মাত্র ১ বিলিয়ন
নিচে। পৃথিবীর ১৫ টি রাজশাসিত রাষ্ট্রের মাঝে তাঁর স্থান ৪ নম্বর। (উল্লেখ্য যে ১৫
টি অর্বুদপতি রাজার মধ্যে ৯ জনই মুসলমান এবং
ব্রুনাইর সুলতানের
স্বর্ণশকট
|
এত যে মাত্রাছাড়ানো বিলাসিতার জীবন
রাজপরিবারের, সাথে সাথে জনগণের জন্যে কড়া শরিয়ার শাসন, এতে কি জনগণের খুব মন
খারাপ? মোটেও না। তারা নাকি সুলতান বোক্লিয়াকে প্রচণ্ডরকম ভালবাসে। সিঙ্গাপুর
ম্যানেজমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপিকা, ব্রিজেট ওয়েলশ
তাঁর নাম, লিখেছেন এক জায়গায়ঃ “ সুলতান আক্ষরিকভাবেই দেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার
জ্যান্ত প্রতীক, রাষ্ট্রপরিচালনাতে তাঁর দক্ষ হাতের ছাপ সর্বত্র----তিনি নির্ভীক ও
সদয়চিত্ত। প্রজারা তাঁকে অন্ধের মত ভালবাসে”। অতএব, এদেশে কোনদিন
রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠবে না সেটা ধরেই নেওয়া যায়। কেবল তাঁর প্রজারাই
নয়, দেশবিদেশের বড় বড় নেতারাও যেন সুলতান বোক্লিয়ার মোহপাশে আবদ্ধ। ব্রিটেনের রানী
তাঁর সাক্ষাৎ পেলে যেন ধন্য হয়ে যান। সেদেশে তিনি ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত। আমেরিকার
প্রেসিডেন্টরা নিয়মিত তাঁকে সালাম ঠুকেন। অবশ্য এটাও ঠিক যে তাঁরা হয়ত সুলতানকে
ততটা গা করেন না, যতটা করেন তাঁর তৈলসম্পদকে। তৈলবুভুখ পশ্চিমের তো ধারাটাই এই।
যেখানে তেলের গন্ধ সেখানেই তেল ঢালে তারা। ব্রুনাইর মত ক্ষুদ্র দেশ পশ্চিমের পরম বন্ধু তার কারণ
হয়ত সুলতান বোক্লিয়ার চারিত্রিক মাধুর্য খুব নয় যতটা তাঁর তেলের ঝিলিক।
দুঃখের বিষয় যে সব দেশের বেলাতে তেল
সমান আশীর্বাদ রূপে কাজ করে না। বরং ঠিক উল্টোটাই হয় অনেক ক্ষেত্রে---আশীর্বাদ না
হয়ে হয় অভিশাপ। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আফ্রিকার গুটিকয় তেলপূর্ণ দেশ। নাইজেরিয়া
আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল দেশ----দিনপ্রতি তাদের উৎপাদন ২.২ মিলিয়ন ব্যারেল।
ব্রুনাইর মত অবস্থা হলে তারা পৃথিবীর সমৃদ্ধতম দেশগুলোর অন্যতম হতে পারত। পারত
তারা বিশ্বব্যাপী একটি নেতৃত্বের অবস্থানে সমাসীন থাকতে। কিন্তু তার পরিবর্তে তারা
আটকে রয়েছে একটি চিরসমস্যাসংকুল আফ্রিকান রাষ্ট্রসমূহের তালিকাতে। একটা-না-একটা বড়
ঝামেলা সেখানে লেগেই রয়েছে। যার মূল কারন কি তা হয়ত একেকজনের চোখ একেকরকম। তবে
মুসলিম-খৃস্টানের চিরকালীন সংঘাত, প্রাচীন গৌত্রিক কালচার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক
বৈষম্য, এগুলোর একটা নেতিবাচক প্রভাব যে থাকবেই তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
ইদানিং ‘বোকো হারাম’ নামক যে এক মুসলিম সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে,
যাদের ঘোষিত মন্ত্র মনে হচ্ছে পাশ্চাত্য শিক্ষার পূর্ণ বয়কট, বিশেষ করে মেয়েদের
বেলায়, কারণ পশ্চিম সবকিছুই নাপাক অতএব ‘হারাম’, এবং সেই ছুতোতে ২৭৯ টি ছাত্রীকে
ছিনতাই করে নিয়ে গেছে কোথায় কোন জঙ্গলে কে জানে, (এবং তাদের বাজারদরে বিক্রি করে
দেবে বলে হুমকি দিয়েছে), তারাও সম্ভবত সেই আর্থ-সামাজিক বিভেদেরই অনাকাঙ্খিত
ফলাফল। তেল সেদেশের আর্থিক স্বাচ্ছল্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করেছে নিঃসন্দেহে, সাথে সাথে
তার সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যাগুলোকে করেছে উগ্রতর। আফ্রিকার অন্যান্য তেল-সমৃদ্ধ
দেশের দৃশ্য খুব পৃথক নয়। লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, গ্যাবন, আলজিরিয়া, রিপাব্লিক অফ
কঙ্গো, এরা সবাই তেল এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ, কিন্তু আধুনিক
সভ্যতার মাপকাঠিতে তারা এখনো নিদারুণভাবে পশ্চাদপদ। তেল তাদের সহায় হয়নি, বরং
অন্তরায় হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে।
আমাদের নিজেদের দেশে তৈলসম্পদ হয়ত
নেই, অন্তত এখন পর্যন্ত তার সুস্পষ্ট কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গ্যাস ছিল, এখনো
আছে কিছু, কিন্তু তার সদব্যবহার হয়েছে কতখনি তা বিচার্য। তবে তেল না থাকলেও যে
তেলের তাপে গা পুড়ানো সম্ভব তার সামান্য আভাস তো একটু আগেই দিলাম আমি। শুধু আমরা
কেন, সমগ্র পৃথিবীতেই আজকে একরকম ত্রাসের আবহাওয়া বিরাজমান, তার পেছনে
মধ্যপ্রাচ্যীয় তেলের ছিটেফোঁটা প্রভাব যে একেবারে নেই তা’ই বা হলপ করে বলবে কে।
সবশেষে একটা ছোট্ট টিকাটিপ্পনি রেখে
যাবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আপাতদৃষ্টিতে ব্রুনাইকে মনে হয় অন্যান্য দেশের
চাইতে একটু আলাদা। খোলা চোখে তো মনেই হবে না সেখানে কোনও সমস্যার গন্ধ থাকতে পারে।
এর চেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ আর কোথায় পাবেন আপনি? প্রশ্ন হলঃ তাই যদি হয় তাহলে শরিয়ার
মত একটি মানবতাবিরোধী সমাজব্যবস্থা সূচনা করতে হয় কেন? সেখানে শতকরা দশজন নাগরিক
খৃস্টান। তাদের নাগরিক অধিকার এমন নগ্নভাবে খর্ব করার
প্রয়োজনটাই বা ছিল কোথায়। মাত্র ৪ লক্ষ মানুষের মধ্যে এতখানি ভেদাভেদ সৃষ্টি করে
রাখার উদ্দেশ্যটা কি? তাছাড়া ব্রুনাইতে ‘জরুরী অবস্থা’ চালু করা আছে দীর্ঘকাল
ব্যাপী। আসমানে যদি একফালি মেঘ না থাকে
তাহলে ‘জরুরী’র প্রয়োজনটি কোথায়।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট
অটোয়া, ৩১শে মে, ২,০১৪
মুক্তিসন ৪৩
মীজান রহমান :: Mizan Rahman
No comments:
Post a Comment