মীজান রহমান
সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি আমার নতুন ঠিকানা। কবে উঠছি, তা’ও। কিভাবে যেতে হবে
সেখানে জানতে চেয়েছে কেউ কেউ। সোজা। হাইওয়ে থেকে মেইটল্যণ্ডের এক্সিট নাও। তারপর
দুমিনিট পর পশ্চিম দিকে মোড় নাও বেজলাইনে। সাবধানে টার্ণ নেবে কিন্তু। জায়গাটা বড় খারাপ---অসম্ভব
ট্র্যাফিক, ঘন ঘন আক্সিডেন্ট হয়। প্রথম যে দালানটা দেখবে ডানদিকে সেখানে ঢুকে আমার
বাজার টেপো। না, বাজার নাম্বার এখনো পাইনি। পেলে জানিয়ে দেব।
মুভাররা আসবে শিগগিরই। মুভের জন্যে নয়, প্যাকিঙ্গের জন্যে। একদফা প্যাকিং আগেই
হয়ে গেছে। অনেক জিনিস ফে্লে দেয়া হয়েছে। অনেকটাই হালকা এখন বাড়িটা। ভারি
জিনিসগুলোর বেশির ভাগই চ্যারিটিতে চলে গেছে। অভাবী পরিবারের তো অভাব নেই
এশহরে----ওদের কাজে লাগবে। একসময় যেগুলো না হলে ভদ্রভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব ছিল
না বলে ভাবা হত, সেগুলো অনাবশ্যক বাহুল্য বলে মনে হয় এখন। অটোয়াতে যখন প্রথম আসি
আমরা, জীবনের সেই প্রথম প্রভাতে, যখন যৌবন ছিল, যখন গোটা পৃথিবীটাই মনে হত আমাদের
হাতের মুঠোতে, দুর্দম দুর্বার, আমরা দুজন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একবার করে ধর্ণা
দিতাম ফার্নিচারের দোকানে, কার্পেট আর হোম ডেকোরেটিঙ্গের দোকানগুলোতে। কিনি বা না
কিনি ঘুরে ঘুরে দেখতেও আনন্দ----আমার না হলেও ওর তো অবশ্যই। মেয়েটার অদ্ভুত স্বভাব
ছিল----নিজের পোশাক আশাকের ব্যাপারে যেমন ভয়ঙ্করভাবে উদাসীন, ঘরবাড়ি সাজানোর
ব্যাপারে ঠিক ততটাই তৎপর---একটু উনিশ বিশ হবার উপায় ছিল না। জিনিসগুলো সব ফার্স্ট
ক্লাস হওয়া চাই। যেমন তেমন কার্পেট হলে চলবে না, প্লাস হতে হবে, মোটা পশমের সুতো
দিয়ে বোনা। যাতে কার্পেটের ওপর হাঁটতে লোকের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়----বলবেঃ
ভাবী, এ-কার্পেট আপনারা কোত্থেকে কিনেছেন? রীতিমত রাজবাড়ির মখমল মনে হয়। অটোয়ার
আপস্কেল দোকানগুলোতে একসময় আমার স্ত্রীর মুখটি সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। ওকে দেখলেই
ওদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। হবে না কেন? ওকে দেখতে পাওয়া মানেই তো মোটা অঙ্কের চেক
একটা।
এভাবে যে কত হাজার জিনিস জমা হয়েছিল আমাদের বাড়িতে। আজ তার কিছুই নাই বলতে
গেলে। অনেকদিন সেগুলো ধরে রেখেছিলাম। ও চলে যাবার পর মনে হত ওই জিনিসগুলির ভেতরই
ওকে রেখে দেব, ও থাকবে সেগুলোতে, আমাকে মনে করিয়ে দেবে ঘন ঘন ভ্যাকুয়াম করতে
কার্পেটগুলো, ধুলোমোছা করতে দেরাজগুলো, বাথরুমগুলো যেন ছোটলোকের বাথরুমে পরিণত না
হয় কোনদিন। বছরদুয়েক আগে তো ওসব নিয়ে লম্বা একটা লেখাও লিখে ফেললাম। কি যেন নাম
দিয়েছিলাম ওটার? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে----যাদুঘর। স্মৃতির যাদুঘর। আমার ব্যক্তিগত
হেরিটেজ। কিন্তু কোথায়? সেই ‘যাদুঘর’ও তো আজকে মুভাররা মাথায় করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে
কোথায় কে জানে---কি’ই বা আসে যায় তাতে। জানিনা কেমন করে মন সহসা অবশ হয়ে গেল। না,
অবশ নয়, পাথর। হ্যাঁ পাথর। ক্যানাডার ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পার্মাফ্রস্টের মত। এই
পাষাণ মানুষটিকে আমি চিনি না। সে নতুন এসেছে এখানে----আমার সবকিছু ঘাড়ে করে তুলে
নিয়ে গেছে।
মুভাররা আসবে বলে শোবার ঘরের বুরোদুটো খুলে দেখছিলাম কি আছে সেগুলোতে। একটার
খবর তো আগেই জানা ছিল-----কয়েক হাজার ফটো। সেই কবেকার ছবি সেগুলো। পৃথিবীর যত
আপনজনেরা, যত ভালোলাগা মানুষেরা, দামি দামি জাপানি ক্যামেরাতে ছবি তুলে সুন্দর
প্রিন্ট করা খামে করে পাঠিয়ে দিত আমাদের, আর আমি অতি অযত্নে সেগুলো গুঁজে রাখতাম
ড্রয়ারের নিরাপদ অন্ধকারেতে। তখনো ডিজিটালের যুগ শুরু হয়নি----কোডাকলারের প্রিন্ট
আমাদের সবারই দারুণ পছন্দের জিনিস। সেই অযত্নে লালিত ছবিগুলোর এবার একটা সুরাহা
করা দরকার, ভাবলাম মনে মনে। ওয়ালমার্ট থেকে একটা সস্তা অ্যালবাম কিনে এনে একদিন
বসে গেলাম সেগুলো একটি একটি করে ঢোকাব বলে। চারশ’ ছবির অ্যালবাম----একটুতেই ভরে
গেল। ছবি তখনো কয়েক হাজার বাকি। নাহ, আর ধৈর্য নেই। কি হবে এত ছবি দিয়ে। ছেলেরা তো
এখন সব কম্পিউটারে দেখে তাদের ডিজিটাল ক্যামেরাতে তোলা রঙ্গচঙ্গে ছবি। নাতি নাতনির
তো কথাই নেই---তারা থোরাই কেয়ার করবে আমার এই ঘুনে ধরা শেওলাপড়া ছবির অ্যালবাম। অতএব,
কি এক দুর্দৈব ঝোঁকের মাথায় বাকি ছবিগুলোকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ফেলে
দিলাম গার্বেজে। একটিবার সেগুলো উলটে-পালটে দেখবারও স্পৃহা জাগল না মনের
ভেতর----একটু কৌতূহল। ক্ষীণ একটা বোধ সৃষ্টি হল মনে----আমি নেই। মৃত। সমাহিত।
কষ্ট হচ্ছিল যখন তারা ওর ব্যক্তিগত জিনিসগুলো তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। এবং আমি মুখ
ফুটে তাদের বাধা দেব সে কল্পনাটাও তখন মাথায় আসেনি। নিঃশব্দে ওরা সেগুলো ট্রাকে
করে নিয়ে গেল। বারোটা বছর আমি সেগুলো যক্ষের ধনের মত আগলে রেখেছিলাম। আর সব যায়
যাক, ওর দৈনন্দিনের জিনিসগুলো আমি কিছুতেই চোখের আড়াল হতে দেব না। ওগুলোতে যেন
বাইরের কারো হাত না পড়ে----তাহলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। না, ওগুলো আমার, একান্তই আমার,
জোরগলায় বলতাম আমি। ওর দাঁতের মাজন, কমাতে যাওয়ার আগে বাবু ওই মাজন দিয়েই মায়ের
দাঁত পরিষ্কার করে দিয়েছিল----ওই মাজন পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। হাতের লোশন (তার
সবচেয়ে পছন্দের লোশন ছিল কেরি লোশন, কেরি সাহেবের যে কি ভাগ্য), চুলের কাঁটা (ঠিক
আছে, শেষের দিকে আঁচরাবার মত চুল ওর একেবারেই ছিল না, কিন্তু ছিল না বলেই তো
ওগুলোর দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে, অচল মুদ্রাদের মত), চশমা, একফালি নকল দাঁত। ওর
পুরনো, রঙ ছুটে যাওয়া, নেকড়া-মত দেখতে ব্লাউজগুলো, পেটিকোটগুলো, (শেষের দিকে তো
সেগুলো সে একেবারেই পরত না, কোনরকমে একটা সস্তা গাউন জড়িয়ে রাখত গায়ে)। সেই গাউনটা
পরে সে চুপ করে বসে থাকত ফ্যামিলি রুমের সোফাতে, ভাবলেশহীন, অনির্দিষ্ট দৃষ্টি, অপেক্ষায়,
অপেক্ষায়। কিসের অপেক্ষায় তা আমরা দুজনই জানতাম। কোনদিন উচ্চারণ করেনি, আমিও না।
ভীষণ সাহসী মেয়ে ছিল সে। মৃত্যু তো আসবেই, তা নিয়ে ভাববার কি আছে? ভেবে ভেবে যদি
মৃত্যুকে রোধ করা যেত তাহলে নাহয় খুব করে ভাবা যেত, দরকার হলে একটু কাঁদাও,
দোয়াদরুদ তো সবাই পরে, তাতে কি কাজ হয়েছে কখনো? এই ছিল মেয়েটার অদ্ভুত চিন্তাধারা।
ওর আশেপাশে সবাই কেঁদে কেঁদে সারা, বড় ছেলে যার চোখে পানি দেখা মানে পশ্চিম দিকে
সূর্য ওঠা, সে’ও বারবার টিসু ব্যবহার করছিল। কিন্তু যার কারণে এত সোরগোল এত
আহাজারি চতুর্দিকে, সে’ই নির্বিকার। যেন বেড়াতে যাচ্ছে কোথাও।
সেই জিনিসগুলো ছিল আমার যাদুঘরের প্রদর্শনী---অতি যত্নসহকারে কাচের ঘেরাও করা
প্রকোষ্ঠে সুরক্ষিত। তারপর হঠাৎ করে কি হল, নিজেকে বিশ্বাস করিনি যখন বললামঃ হ্যাঁ
ওগুলো নিয়ে যান আপনারা। নতুন জায়গাতে আমি কোথায় রাখব ওগুলো। সেখানে কি এতগুলো
দেরাজ থাকবে? এতগুলো তাক, কাবার্ড, ওয়ার্ডরোব? ব্যাপ্তি আর স্থানের বিলাসিতা
ফুরিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। এদেশে এগুলোকে বলা হয় ডাউনসাইজিং। ছাঁটাই, ছাঁটাই আর
ছাঁটাই। সংকুচিত হতে হতে শূন্যতে পৌঁছানো। এক বস্ত্রে বের হয়ে যাও অবশেষে। যেখানে
যাচ্ছি সেখানে সেগুলোর প্রয়োজন হবে না। সেখানে কোনও দ্বিমুখি রাস্তা নেই।
ছেলেরা মোটেও চায়নি আমি বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাই। বড় ছেলে বলেছিলঃ
বাড়ি থাক, আপনি চলে আসুন আমার এখানে। আলাদা ঘর আছে, আলাদা বাথরুম আছে, এখানে বরফ
নেই, ফ্রিজিং রেইন নেই, গাড়ি চালাবারও প্রয়োজন হবে না---আমরাই নিয়ে যাব যেখানে
যেখানে যেতে চাবেন। কোনও অসুবিধা হবে না আপনার। ছোট ছেলেরও প্রায় একই কথা। আমি
হাসি। এই কাজটি আমি সারাজীবন এড়িয়ে চলেছি, ছেলেদের ওপর ভরসা করা, ওদের খেয়ালখুশির
ওপর জীবনকে সঁপে দেওয়া। কোনদিন যেন তা না করতে হয় আমাকে---তার আগেই যেন আমি ওপারে
চলে যাই। প্রার্থনা যদি আমার থাকে কিছু এই একটাই।
বুঝি ওরা কেন বলে এমন করে। এই বাড়িতে আমাদের প্রায় ত্রিশ বছর কেটে গেল। অনেক
স্মৃতি এখানে-----আমার চেয়ে ছেলেদের অনেক বেশি। ওদের জীবনের বেশির ভাগই কেটেছে এই
বাড়িতে, আর আমার ছোট একটা অংশ মাত্র। এখানে ওরা জন্মায়নি বটে, কিন্তু প্রথম জীবনের
উদ্দাম সময়গুলো তো সব এখানেই কেটেছে। এই বাড়ি থেকেই আমার বড় ছেলে ইউনিভার্সিটিতে
যেতে শুরু করে। মেয়েবন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে আসার সাহস পায়, যা ওর মা একেবারেই পছন্দ
করত না। ছোট ছেলেরও মাথা গরম হতে শুরু করেছিল----মায়ের সঙ্গে রাগ করে তো একদিন বাড়ি
থেকে পালিয়েই গিয়েছিল। ওর ভাই আর আমি দুজনে মিলে সারা শহর খুঁজে শেষ পর্যন্ত পেলাম
রিডো আর অটোয়া নদী যেখনে মেশে একজায়গায়, সেখানে। ওদের মাকে যেমন একদিকে অন্ধভাবে
ভালবাসত, ওদিকে ভয়ে কথা বলতে সাহস পেত না। একসময় ছেলেরা চলে যায় আমেরিকায়----বড়
ছেলে বার্কলিতে, আর ছোটটি নিউ ইয়র্কের জুলিয়ার্ডে। সে এক উত্তাল অধ্যায় আমাদের জীবনের। বড় স্বপ্ন, বড়
আশা। ছেলেরা বিখ্যাত হবে, বিশ্বজোড়া তাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে---কত না অলীক কল্পনা ভর
করেছিল মনে। এখন হাসি পায় ভাবলে। বাবামায়েরা কত না অসম্ভব চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়
মনে, তারপর বাস্তব এসে একদিন সেগুলো গুঁড়ো করে দেয়। ওদের মা তো সেরকম একটা আজগুবি
স্বপ্ন নিয়েই মরে গেল। আর আমি এখনও বেঁচে আছি রূঢ় বাস্তবকে নিয়ে। ওরা কেউ
‘বিখ্যাত’ হয়নি, হবেও না। এখন স্বপ্নটাও মরে গেছে। ওরা বেঁচে থাকুক, সুখ বলে যদি
কিছু থাকে সংসারে তাই যেন হয় তাদের উত্তরাধিকার।
এই বাড়িতে তাদের অনেক, অনেক স্মৃতি। বিশেষ করে তাদের মায়ের। শেষের কটা বছর তো
ভীষণ কষ্ট করে গেছে মেয়েটা। বাথরুমে যাবার শক্তিটুকু ছিল না একসময়। বড় ছেলে ওকে কোলে
করে তুলে নিয়ে গেছে। সারাজীবন এত লজ্জা মেয়েটার, শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানের কাছেও
সেই লজ্জা লুকিয়ে রাখতে হল। ছোট ছেলেও একবার ওকে তুলে নিয়েছিল পা-ফসকে-মেঝেতে-পড়ে-যাওয়া
অবস্থা থেকে। সেগুলো তারা ভুলবে কেমন করে। এই বাড়ির লিভিং রুমে শুয়ে-থাকা অবস্থাতে
সে আমাদের সবাইকে একসাথে জড় করে, পরিষ্কার নিরাবেগ কন্ঠে, কতনা হিতকথা শুনিয়ে
গিয়েছিল, কতনা স্বচ্ছ সুন্দর, নির্মল ভালবাসা। আমরা সবাই কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালাম,
কেবল ওই মানুষটিই একেবারে নির্বিকার----লেশমাত্র আবেগ ছিল না ওর চোখেমুখে। হ্যাঁ,
এই বাড়িরই দেয়ালকে, বাতাসকে, প্রতিটি অণুপরমাণুকে, সাক্ষী রেখে। এই বাড়ির সাক্ষ্য
তো এখনো লেগে আছে। সেকথা ওরা ভোলে কেমন করে। তারপর হাসপাতাল থেকে ওকে ওরা নিয়ে যায়
মর্গে----যেখানে মরা মানুষদের ভিড়। পরের দিন কফিনের বাক্সতে করে এবাড়ির সেই একই
লিভিং রুমের মেঝেতে নিয়ে আসা হয় ছেলের পিয়ানো শুনতে চেয়েছিল বলে। কি অসম্ভব করুণ
সুরই না ছিল সেটা----ব্রামসের ইন্টারমেজো। কান্না এনে দেয়। ওর খুব পছন্দ ছিল,
আমারও। এই সুরটা বাজিয়ে সে সারা পৃথিবীশুদ্ধ লোককে কাঁদিয়ে তুলত। বাজানো শেষ হলে
ওরা কফিনটা তুলে নিয়ে যায় কবরস্থানে, শহর থেকে ২৫ মাইল দূরে। এবাড়ির খেলা বলতে
গেলে তখনই সাঙ্গ হয়ে যায়। খেলার ঘর থেকে কবরের স্তব্ধতা। কিন্তু স্মৃতিটা যাবে
কোথায়। ও চলে যাবার পর যেন ছেলেরা আরো শক্ত করে বেঁধে রাখল বাড়িটাকে। যেন এর মধ্যে
তাদের অস্তিত্বেরই কোনও গূঢ় সূত্র আত্মগোপন করে আছে। এবাড়ি তাদের মনের ঠিকানা। এখানে
তাদের স্থায়িত্বের আশ্বাস। এ তাদের ‘হোম’। একমাত্র হোম বলে যাকে জানে তারা।
কিন্তু সেখানে আমার স্থান কোথায়। আমিও তো ‘হোম’ খুঁজেছি সারা জীবন। কোথায় সে
হোম? সে তো প্ল্যাটোর আদর্শ জগতের মতই এক আদর্শ নিলয় ছাড়া কিছু নয়। একটা মায়াবি
ঠিকানা যা কেবল কল্পনাতেই বাস করে, যাকে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার ছোটবেলার নির্মল
নিষ্পাপ সময়টুকুরই মত। কে যেন বলেছিলেন একটা কথাঃ হোম হল এমনি এক জায়গা যেখান থেকে
বেরুবার জন্যে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি প্রথম যৌবনে, তারপর সেই একই জায়গাতে ফিরে যাবার
জন্যে আকুল হয়ে উঠি শেষবেলাকার শংখধ্বনি যখন বেজে উঠতে শুরু করে জীবনে। কিন্তু তখন
আর সময় নেই। সময়ের টানে ভেসে গেছে সব।
কিছুদিন আগেও কিন্তু আমার মনে সেই মায়াবি গৃহের কুহকিনী ডাক জেগে রয়েছে।
স্বপ্ন ছিল একদিন ফিরে যাব। সেখানে। ওই নীরব নিঃস্পন্দ বটের ছায়াতলে গিয়ে বসব
একটিবার। যাব সেই নদীর ঘাটে, গলাডুবু জলেতে নেমে কোশে করে শীতল পানি খাব, পাড়ার
কিশোরী মেয়েগুলোকে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে যাব। যাব আমাদের গ্রামের সেই আমবাগানের
বুনো ঘ্রাণের কাছে, বর্ষার দিনে গায়ের কাপড় মাথায় তুলে পাড়ি দেব কোমরছোঁয়া পানির
সাগর। বাড়ির উঠোনে খালিগায়ে দাঁড়িয়ে খুব করে ভিজব প্রথম বৈশাখের প্রবল
ঝড়েতে----আহা যদি একটিবার, আর একটিবার প্রভু, যদি পারতাম সমাজ সংসার সব ঝেড়ে ফেলে
দিয়ে যদি একটিবার যেতে পারতাম সেই প্রাণমন্দিরে। কিন্ত কই, তা হবার উপায় কোথায়।
খুব শখ করে গিয়েছিলাম আমার গ্রামের বাড়িতে, যেখানে আমার বাবার জন্ম, যেখানে আমার
পিতামহ আর প্রপিতামহ সবারই জন্ম, যেখানে আমাদের দক্ষিণ ঘরের জানালা দিয়ে আমি
বৈশাখি ঝড়ের তাণ্ডব দেখতাম, ভয়ে বুক কাঁপত, ভয় হত আনন্দ আর উত্তেজনায়, প্রলয়ের
বজ্রধ্বনি কল্পনা করে শিহরিত হয়ে উঠত মনপ্রাণ। কিন্তু কোথায় সে গ্রাম, কোথায় সে
উঠান আর বর্ষার জলেতে উজাড় হয়ে যাওয়া বনপ্রান্তর। লোকে লোকারণ্য। চারদিকে কেবলই
কোলাহল। সবাই ছুটছে, দিকবিদিকে কেবল ছুটছে, একদণ্ড দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকাবারও সময়
নেই কারো। আমার সেই স্বর্গ এখন একমুঠো ধুলোর স্মৃতিচিহ্ন বই কিছু নয়। ওরা সব বদল
গেছে, তার চেয়ে বেশি বদলেছি আমি নিজে। কে যেন বলেছিল একটা কথাঃ আমরা যদি ফিরে যেতে
পারিও কোনদিন তবুও, এবং জায়াগাটি যদি অবিকল আগেরই মত থেকে যায়, তথাপি আমাদের মনে
হবে সব বদলে গেছে। না, আমরা আমাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাই না, যাই আমদের হারানো শৈশব
আর বাল্যের কাছে। সেটা আমি জেনেও মানতে চাইনি-----সময়কে স্থির জায়গাতে ধরে রাখতে
চেয়েছিলাম, যা কখনোই হয় না। এতকাল পরে কেন জানিনা, সহসাই মন তা মেনে নিয়েছে। একবছর
আগে যা অকল্পনীয় ছিল আজ ঠিক তা’ই অনায়াসে পেরে উঠছি আমি। আজকে আমার সময় হয়েছে
ঠিকানা বদল করার। না, একে আর হোম বলব না আমি, কেবলই একটা বিকল্প বাসগৃহ। শেষ বদলের
আগেকার শেষ ঐচ্ছিক বদল। এখানে আমার বার্ধক্য বারবার পথের
বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। অতএব তোমরা আমাকে যেতে দাও এবার।
অটোয়া, ২৩শে মে, ২০১৪
মুক্তিসন ৪৩
মীজান রহমান :: Mizan Rahman
No comments:
Post a Comment