Sunday, 28 July 2013

অজজননীর লজ্জাবরণ?

মীজান রহমান

অনেকদিন পর বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিতে একটু হালকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। প্রথমত হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমেদ শফি দেশব্যাপী হাসির হুল্লোড় সৃষ্টি করেন নারীজাতিকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে। তাঁর নিজের মুখনিঃসৃত, অননুকরণীয় ভাষাতেঃ “...তেঁতুল গাছের নিচে দিয়া হাঁইটা যান তাইলেও আপনার লালা ঝরবে।...ঠিক তেমনি মহিলাদের দেখলে দিলের মাঝে লালা ঝরে।...যতই বুজুর্গ হন আপনার মনের মাঝে কু খেয়াল আইসা যাবে”। হেফাজতের বুজুর্গ হজরত শফি তাই বাংলাদেশের মহিলাসম্প্রদায়কে লক্ষ করে বয়ান দিচ্ছেনঃ “এই মহিলারা, ঘরের চার দিউয়ারির মধ্যে তোমরা থাকো...হুজুরের আগের জমানায় মহিলারা বেপর্দায় চলাফেরা করতো।...উলংগ অবস্থায় ঘুরাফেরা করিও না রাস্তাঘাটে, হাটে-মাঠে”। আল্লামার মহান বাণী প্রচার হবার পর বাংলাদেশের যাবতীয় তেঁতুল ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই খুশিতে বাগবাগ। তেঁতুলের  মত একটি নিরীহ ফলের কদর কতখানি উপরে উঠে গেল বুঝতে পারছেন তো? তাঁর পরামর্শমত মহিলাগণ যদি সত্যি সত্যি ‘চার দিউয়ারির’ ভেতর আবদ্ধ থাকার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে আমাদের হতভাগ্য পুরুষজাতির তো লালা নির্গমনের জন্য একমাত্র তেঁতুলদেরই শরণাপন্ন হতে হবে। অবশ্য রমনী গৃহবাসিনী হলেই যে পুরুষের রমনস্পৃহা নিবৃত্ত থাকতে হবে তার তো কোনও অর্থ নেই----বিকল্প ব্যবস্থা আল্লাপাকই কবুল করে দেবেন। সেপ্রসঙ্গে যাচ্ছি একটু পর।
দ্বিতীয় রসের ভাণ্ডারটি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন দেশের এক অতিশয় মেধাবি আর্মি জেনারেল (অঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ঢাকার ‘নয়াদিগন্ত’ পত্রিকার ১৬ই জুলাই সংখ্যার উপসম্পাদকীয়তে প্রকাশিত ‘সামনে বদরের যুদ্ধ’ শীর্ষক নিবন্ধে তাঁর বক্তব্যগুলো বিশেষ প্রনিধানযোগ্য। লেখাটি পড়ার পর আমার মত সাধারণ পাঠকের মনে ধারণা জন্মায় যে দ্বিনদুনিয়ার মালিক, বিশ্বজগতের মহান সৃষ্টিকর্তা, পাকপরেন্দকার আল্লাতা’লা, স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করেছিলেন, (প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষে, ফেরেস্তাবাহিনীর মারফত), একদলের পক্ষ নিয়ে আরেক দলের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তব্যটি অবিশ্বাস্যরকম হাস্যকর হলেও আল্লামা শফির মত হাস্যরস উৎপাদক নয়, ভীতিসঞ্চারক। যখন ভাবি যে কোরাণের একজায়গায় আল্লাতা’লা বলছেন যে সংসারে কোনকিছুই ঘটে না তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, আবার অন্যত্র বলছেন, কাফেরদের কল্লা কেটে ফেল (এই কাফেররা তো তাঁর ইচ্ছাতেই যুদ্ধ করছিল, তাই না?), তখন আমার বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে। কথাগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় আপনার কাছে? রাস্তার সাধারণ মুটেমজুরের মুখ থেকে বেরুলে মানা যেত---বুঝতাম যে এগুলো পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু একজন গণ্যমান্য সেনাপতি? তা’ও শোনা যায় দারুণ মাথাওয়ালা লোক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তএঁরা দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, জাতির আশাভরসা। এঁরাই যদি এসব আজগুবি কথা বলতে শুরু করেন জাতির উদ্দেশে তাহলে দেশের কি হবে? একদিকে আল্লামা শফির মত মূর্খ লোক তাঁর মূর্খতর চেলাদের চিরমূর্খ বানিয়ে রাখাতে বদ্ধপরিকর, আরেকদিকে আর্মি জেনারেল ইবরাহিমের মত তুখোড় মেধাবী মানুষ দেশের অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত সম্প্রদায়টিকে অজ্ঞতার অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন----উভয়দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে জাতির ভবিষ্যতের ওপর।
এবার চলুন হেফাজতে ইসলামের আল্লামা শফির ‘চার দিউয়ারির ভেতর’ প্রসঙ্গটা সেরে ফেলি।
আমার কি মনে হয় জানেন? শুধু ‘মহিলাগণ’ই নন, চার থেকে চোদ্দ বছরের ছেলেদেরও ‘চার দিউয়ারির ভেতর’ বাস করা দরকার----তাদেরই নিরাপত্তার জন্যে। আল্লামা সাহেবের সমগোত্রীয় ‘বুজুর্গ’গণের বিষয় আমি যতদূর জানি, মহিলারা ‘উলংগ’ অবস্থায় রাস্তায় বাহির হোক বা না হোক, ছোট ছোট ছেলেরা, বিশেষ করে নাদুশ নুদুশ প্রকৃতির প্রিয়দর্শন বালকেরা, উলংগ কেন, হাফপ্যান্ট পরিহিত অবস্থাতে ঘরের বাইরে গেলেই কারো না কারো ‘দিলের লালা’ নির্গত হতে শুরু করে। আমার ছোটবেলার দুচারটে অভিজ্ঞতা আছে যার ভিত্তিতেই আমি বলছি এসব কথা। একবার সদরঘাট থেকে গয়না নৌকায় কোনও এক গ্রামে যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যায় যাত্রা করে মাঝরাতে গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা। বয়স তখন বারো কি তেরো। নদীর বাতাসে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছিল----কখন গভীর ঘুমে টলে পড়লাম মনে ছিল না। ঘুম ভাঙ্গলো পেছনে শক্ত কিছুর গুঁতো খেয়ে। এক অতিশয় কুৎসিৎ, দুর্গন্ধময়, তাগড়া চেহারার লোক আমার পেছনে শোয়া।
আমাদের গ্রামে একটা আবাসিক মাদ্রাসা ছিল----মৌলবিসাহেবরা সেখানে কোরাণহাদিস পাঠ করতেন, আবার পানাহার বসবাস সবই করতেন। আমি শহর থেকে প্রায়ই গ্রামে যেতাম বেড়াতে। গ্রামের বন্ধুরা তখন আমাকে সাবধান করে দিত কক্ষনো যেন একলা ঐ মাদ্রাসার রাস্তায় না যাই। কি হবে গেলে? আমি হয়ত বোকার মত জিজ্ঞেস করতাম। ওরা মুখ টিপে হাসত শুধু। তাতেই বোঝা যেত ব্যাপারটা কি। সুতরাং আল্লামা শফির মত এই অধমও দেশের যাবতীয় প্রিয়দর্শন বালকদের উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করছিঃ তোমরা যেন ‘চার দিউয়ারির বাইরে’ না যাও অভিভাবকের সংগ ব্যতীততাহলে বিপদ হতে পারে। একলা যদি বেরুতে হয় একান্ত তাহলে রমনীদের মত অংগপ্রত্যংগ অতিশয় যত্নসহকারে আবৃত রাখার চেষ্টা করো----বদ ছেলেদের মত ‘উলংগ’ অবস্থায় বেরিও না।
মহিলারা ‘উলংগ’ অবস্থায় ঘরের বাহির না হলেও পুরুষদের বালকপ্রীতি খুব একটা নিবৃত্ত থাকবে কিনা সন্দেহ। আমার এ উক্তিটাতে আশা করি আমার পাঠকদের কোমল অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে না। বিষয়টি আমার কল্পনাপ্রসূত নয়, এমনকি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিপ্রক্ষিতেই নয় কেবল। এর পেছনে ইতিহাসের সাক্ষ্য আছে, আছে শাস্ত্রীয় কেচ্ছাকাহিনীও। এটা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয় যে পুরুষের ‘lewd’ আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ঐশিবাণী উচ্চারিত হয়েছে তিনটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থেই----ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট, ও কোরাণ। কেন? সোজা হিসাব। কারণ সেযুগে এগুলো বেশ ব্যাপকভাবেই ছিল তাদের সমাজে। আপনি যদি রোমানদের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেন একটু তাহলেই দেখতে পাবেন সমকাম (Sodomy)  বিষয়টিকে একসময় কত সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাপার বলে গণ্য করতেন ওঁরা। তাদের সেনাসামন্তেরা, ভদ্রজনেরা, স্ত্রীসংগ ছাড়াও, ক্রীতদাসপুত্রদের সঙ্গে যৌনসুখ উপভোগ করতে পছন্দ করতেন----অনেকটা বৈচিত্রের খাতিরেই হয়ত কিংবা ক্রীড়াচ্ছলে। এমনই প্রচলিত ছিল ব্যাপারটি যে ক্রীতদাসদের বাচ্চা ছেলেগুলোকে বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হত কিভাবে তাদের মুনিবদের রতিকর্মে পূর্ণমাত্রায় সুখপ্রদান করা যায়। ক্রীতদাসপুত্রদের চেহারানমুনা তেমন আকর্ষণীয় ছিল না বলে অনেকসময় ভদ্রজনেরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন তাদের সমপর্যায়ের পরিবারদের ছোট ছোট ছেলেদের প্রতি----যা তাদের অভিভাবকরা খুব সুনজরে দেখতেন না, স্বভাবতই। যাই হোক, ওল্ড টেস্টামেন্টে এই ‘লুড’ ব্যবহারের প্রতি চরম ঘৃণার ভাব প্রকাশ করার পেছনে সম্ভবত এই ইতিহাসটিই কাজ করেছিল বেশি। আমার বিশ্বাস পরবর্তী গ্রন্থসমূহেরও অনুরূপ কাহিনী।
যৌনতা একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি মানবজাতির-----তার জৈব জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর উৎস প্রকৃতি নিজেই, যার গোড়াতে রয়েছে জীবজগতের প্রজনন প্রক্রিয়া। এর কারণেই নারী পুরুষ দুপক্ষেরই কমবেশি সমান আকর্ষণ যৌনমিলনের প্রতি। (দিলের লালা শুধু পুরুষের নয়, নারীরও আসতে পারে, যা সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন তাসলিমা নাসরিন তাঁর এক সাম্প্রতিক লেখাতে) তফাৎ এটুকুই যে সামাজিক ও পরিবেশিক কারণে নারী যতটা সংবরণ করতে সক্ষম সেই যৌনস্পৃহ, পুরুষ তা পারে নাএকে জোর করে, আল্লামা শফি বা অন্যান্য সব মোল্লা-মওলানাদের ফতোয়া দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলে (যেমন ‘মহিলদের দিউয়ারির ভেতর’ আটকে রাখা) ফল হয় বিপরীত। তার যৌনাকাঙ্খাটি বিকৃত আকারে প্রকাশ পায় মাঝে মাঝে। বালকদের প্রতি দৃষ্টিপাত করার কথা একটু আগেই উল্লেখ করা হল, সেটা ‘মহিলাদের দিউয়ারির ভেতর’ আবদ্ধ থাকা সত্বেও ঘটতে পারে----সমকাম প্রবৃত্তি তো প্রকৃতিরই এক রহস্যময় বৈচিত্র্য। তাদের শরীরে এই প্রবৃত্তি প্রাকৃতিকভাবেই উপস্থিততখন যদি মহিলাগণ ‘উলংগ অবস্থাতেও রাস্তায়’ বের হন সমকামী পুরুষদের কোনও আগ্রহ থাকবে না তাদের প্রতি----তাদের আগ্রহ সেই বালকদেরই প্রতি। কিন্তু যখন স্পৃহানিবৃত্তির কোন পন্থাই খুঁজে পায়না পুরুষ তখনই সে খোঁজে ভিন্ন পথ----পুরোপুরি বিবমিষা সৃষ্টিকর পথ। যেমন চতুষ্পদী জন্তু বা অন্য কোনও মাধ্যম। হ্যাঁ, চারপেয়ে প্রাণীদের কথাই বলছি আমি। আঁতকে উঠবেন না। একটি ঘটনা তো আমার নিজের চোখেই দেখা।
আমার ছোটবেলায় কলতাবাজারের কুট্টিপাড়ার একটা অভিজ্ঞতা এখনো মনে আছে। ওপাড়ার ছেলেগুলি খুব ভদ্র, সংযত চরিত্রের ছেলে ছিল বলা চলে না। এক গরমের দিন রাস্তায় বেশ ভিড়----চোদ্দ পনেরো বছরের কতগুলো রুক্ষ চেহারার ছেলের সমাবেশ একজায়গায়। তারা হাসাহাসি করছে কি নিয়ে। দুটো কুকুর একে অন্যের প্রেমবন্ধনে অবিচ্ছেদ্যভাবে আবদ্ধ। সেই দৃশ্য দেখে এলাহি নামক একটি ছেলের  গায়ে জোশ এসে গেল। যেহেতু ওপাড়ার মেয়েরা বেশির ভাগ সময় ‘চার দিউয়ারির ভেতর’ আবদ্ধ থাকে, এবং উপযোগী নাদুশ নুদুশ বাচ্চা ছেলেও দেখা যাচ্ছিল না অকুস্থলে, সেহেতু তার দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয়ে গেল অদূরে আপনমনে ঘাস চিবোতে থাকা একটি অজসন্তানেরর প্রতি। এলাহি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে আপাতত এতেই কাজ চলবে। যেমন নিয়ত তেমন কাজ। পাশের দুই বন্ধুর সাহায্যে কর্মটি অল্পক্ষণের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গেল, ছাগশিশুর কোনরকম সহযোগিতা ছাড়াই। জানি, পাঠকের গা ঘিন ঘিন করছে। করবেই। আমার তো গা ঘিনঘিন করছে গত সত্তর বছর ধরে----সেকারণেই তো এখনো ভুলতে পারিনি।
কিন্তু কেন? মানুষ এরকম ঘৃণ্য কাজ করে কিভাবে, কেন? করে কারণ প্রকৃতিকে কৃত্রিমভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলে মানুষের মন নানারকম বিকৃত পন্থা বের করার চেষ্টা করবেই তার প্রাকৃতিক প্রবৃত্তিগুলো নিবৃত্ত করবার জন্য। আমার মনে আছে, আজার নাফিসি নামক এক বিখ্যাত ইরানী লেখিকার বই পড়েছিলাম যার নাম ছিলঃ Reading Lolita in Tehran. বইটার এক জায়গায় ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়েতুল্লা খোমাইনির ছাত্রবয়সের লেখা একটি উদ্ধৃতি তিনি তুলে দিয়েছিলেনঃ “ আপনার গৃহপালিত মুরগির সঙ্গে যৌনসুখ উপভোগ করাতে কোনও দোষ নেই, তবে সেমুরগির মাংস খাওয়া হারাম”। বিশ্বাস হয় আপনার? আমার হয়নি।
অতএব মহিলাগণকে ‘চার দেউইয়ারির ভেতর’ আবদ্ধ রাখলেই পুরুষজাতির জান্তব স্বভাবটিকে দমন করে রাখা যাবে না। ফলটা হবে এই যে তখন আপনার পাড়ার ছোট ছোট ছেলেগুলোকে সামাল দিয়ে রাখতে হবে। এমনকি আপনার ঘরের ছাগলগুলিকেও লজ্জাবরণ পরিয়ে রাখার দরকার হতে পারে।
মূল কথাটা কিন্তু ‘চার দিউয়ারি’ নয়, শব্দটা হল সংযম। এটি মানুষ কিছুটা শেখে তার পারিবারিক এবং সামাজিক সংস্কার থেকে, যেকারণে আল্লামা শফির মত আলেমউলেমাগণও তাঁদের খালাফুফু-বোনেদের প্রতি কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করার কথা কল্পনাও করেন না। অনুরূপভাবে বাইরের ‘উলংগ’ মহিলাদের প্রতিও কুদৃষ্টি যাতে নিক্ষেপ না করা হয় তার জন্যেও একরকমের মানসিকতা তৈরি করতে হয় অবলম্বন করতে হয় নারীকে কিভাবে সম্মানের চোখে দেখতে হয় তার একটা সুস্থ মানসিকতা। মোদ্দা কথা, সভ্যতা। শ্লীলতা। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখবার ক্ষমতা, সংযম,  যা শিখতে হয় স্কুলকলেজে গিয়ে, শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে ওঠাবসা করে। না, মাদ্রাসার শিক্ষায় চলবে না----সেখানে শুধু  ‘চার দিউয়ারির ভেতর’ মহিলাদের আবদ্ধ রাখার কথাই শিখবে, আর কিছু শিখবে না। তার বাইরের জিনিসগুলো শেখার জন্যে দেশবিদেশের বইপুস্তক পড়তে হবে, জানতে হবে বিজ্ঞানজগতের কোথায় কি হচ্ছে, বড় বড় চিন্তাবিদরাই বা কি বলেছেন ও বলছেন।
হেফাজতে ইসলামের প্রসংগ ঢের হয়েছে। এবার আমার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসা যাক। বদরের যুদ্ধ। যার ওপর ‘নয়াদিগন্তের’ উপসম্পাদকীয়তে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছেন ইবরাহিম সাহেব ‘সামনে বদরের যুদ্ধ’ শিরোনামাতে। আমার জানামতে বদরের যুদ্ধ ঘটেছিল ৬২৪ খৃষ্টাব্দে----আজ থেকে প্রায় ১,৪০০ বছর আগে। সেটাকে ‘সামনে বদরের যুদ্ধ’ অভিহিত করে লেখক কি বুঝাতে চাচ্ছেন জানিনা, সম্ভবত তিনি বলতে চাইছেন যে মুসলিম উম্মার জন্য এ-যুদ্ধ প্রতি বছরই একবার করে ঘটে, রমজানের পবিত্র মাসে। আসলে আপনি যদি কোরাণের ৮ নং সুরার শিরোনামা লক্ষ করেন তাহলে দেখবেন, মওলানা দাউদের তরজমাতে কেবল বলা আছেঃ ‘Spoils’ (যার আভিধানিক অর্থ Booty বা ‘লুটের মাল’)পাঠক যেন আমাকে ভুল না বোঝে--- বদরের যুদ্ধের সঙ্গে লুটের মালের কোন সম্পর্ক আছে সেরকম কোন ইঙ্গিত করার চেষ্টা আমি ভুলক্রমেও করছি না। আমি কেবল শব্দটার আক্ষরিক অর্থ যা ডিকশনারিতে আছে তা’ই উল্লেখ করলাম। মওলানা ইউসুফ আলী আর মওলানা পিকথলের তরজমাগুলোতেও হুবহু এক শিরোনামঃ ‘Spoils of War’ তাতে এমন একটা ধারণায় পৌঁছানো হয়ত কবিরা গুণাহ বলে গণ্য হবে না যে সমস্ত সুরাটি আসলে লুটের মালের ভাগবাটোয়ারা বিষয় নিয়েই। যদিও সুরার ভেতরে প্রবেশ করার পর আমরা টের পাই যে এখানে লুটটাই বড় নয়, বড় হল ঈমানদারদের জীবনমরণ যুদ্ধ মক্কার কাফেরদের সঙ্গে।
গোড়াতে যে লুটটাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য তার প্রমাণ মেলে অন্তত দুজায়গায়। প্রথমত কোরাণের উপরোক্ত সুরাটির প্রথম আয়েতেই। দাউদের তরজমায় মূল সুরার নিচে একটি টিকাতে তিনি লেখেনঃ “Muhammad’s plan was to attack an unarmed caravan belonging to the Qurayesh of Mecca on its way from Syria to that city…..” ( মুহাম্মদ (দঃ) এর মূল পরিকল্পনা ছিল সিরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে মক্কার দিকে আসতে থাকা কোরেশদের একটি নিরস্ত্র কাফেলার ওপর হামলা করে তাদের সমস্ত মালপত্র লুন্ঠন করা। পাশ্চাত্য ইতিহাসজ্ঞ লেভারিং লুইস (১)  ও ম্যাক্সিম রডিনসন (২) এই তথ্যটি আরো সবিস্তারে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে ওই কাফেলাটি ছিল বিশেষভাবে লোভনীয়----আনুমানিক ৫০,০০০ দিনারের মালামাল ছিল তাদের কাছে। মোহাম্মদ(দঃ) ও তাঁর ৩১৯ সদস্যবিশিষ্ট ভক্ত মুসলিম বাহিনী ভেবেছিলেন যে কাফেলাটি বরাবরের মত বদর মামক জায়গাটির ভেতর দিয়ে পার হবে, কারণ সেখানেই ছিল একটি শীতল পানির কূপ----মরুভূমির ওপর দিয়ে এতটা পথ অতিক্রম করার পর নিশ্চয়ই তাদের খুব পিপাসা পাবে। সমস্যা হল যে কোরেশদের দলপতি ছিলেন আবু সুফিয়ান ইবনে হার্ব নামক অতিশয় বুদ্ধিমান ও চতুর লোক (পরবর্তীতে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত উম্মায়াদ বংশ)। তিনি দূর থেকে জায়গাটির থমথমে ভাব দেখে পছন্দ করলেন না। ওই জায়গাতে আগেও অনেক লুট তরাজ হয়েছে। আবু সুফিয়ান তখন কাফেলাটিকে সরাসরি বদরের কূপের পাশ দিয়ে না নিয়ে ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে মক্কা থেকে ১২০০ সশস্ত্র সৈন্য বিশিষ্ট একটা দল এগিয়ে আসে সেই কাফেলাকে জনবলের ভরসা দিতেদুদলের মধ্যে যুদ্ধ তখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানরা দেখলেন যে তাদের চেয়ে চারগুণ সংখ্যার শত্রুবাহিনীর মোকাবেলা করতে হলে একমাত্র উপায় কোনও বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা। তাঁরা অদূরের একটি পাহাড়ের উল্টোধারে গিয়ে, কোরেশদের চোখের আড়ালে, ঘাপটি মেরে বসে থাকলেন, আর মনে মনে কামনা করলেন আল্লার সাহায্য। তারপর সুযোগ বুঝে তাঁরা ওদের ওপর তুমুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যখন তারা মোটেও প্রস্তুত ছিল না ওই আকস্মিক আক্রমনের জন্য। এই আকস্মিকতাটিই ছিল মুসলমানদের মোক্ষম অস্ত্র। তার ওপর নবীজির নিপুন পরিচালনা ও উদ্দীপনাতে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সুশৃংখল ও ঐক্যবদ্ধ একটি দল, যার বিপরীতে কোরেশদের শৃংখলা বলতে কিছুই ছিল না। ফলে তারা সংখ্যায় চারগুণ ভারি হয়েও মনোবলে ছিল একবারেই দুর্বল-----মুসলমানদের হিংস্র আক্রমনের মুখে তারা দিশাহারা হয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই যে যার জান বাঁচানোর জন্যে এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করেবেশ কিছু কোরেশ নেতা ও গোটা পঞ্চাশেক সৈন্য প্রাণ হারায় সেখানে। তাতেও তারা ছাড়া পায়নি। মুসলমান পক্ষের মেয়েরাও কম দুর্ধর্ষ ছিলেন না। পশ্চাদপদ শত্রুকে তুমুল বিক্রমে ধাওয়া করেছিলেন তাঁরা ( তার সঙ্গে বর্তমান যুগের মুসলিম নারীদের তুলনা করুণ, বিশেষ করে ‘চার দিউয়ারির ভেতর মহিলাদের বন্দিত্ব’কামী আল্লামা-আমীরদের)। বলা বাহুল্য যে বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা কেবল বিজয়ী হয়েছিলেন তা’ই নয়, আশাতীত লাভজনক অভিযানও ছিল সেটা----১৫০ টি উট, ১০টা ঘোড়াসহ বহু অস্ত্রশস্ত্র ও মুক্তিপণ আদায়যোগ্য যুদ্ধবন্দী পাকড়াও করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আসলে বদরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মক্কার কোরেশদের মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙ্গে যায়----তাদের এতদিনের ব্যবসাবাণিজ্য, সিরিয়ার সঙ্গে, আশেপাশের অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে, সব দুর্বল হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে বদরের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মুসলমানদের বুকে দুর্দান্ত সাহস ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। ওই সময়ই তারা সর্বপ্রথম ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে বদরের মাঠ কাঁপিয়ে তোলেন।
জনাব ইবরাহিমের লেখাতে বারবার যে জিনিসটা উঠে এসেছে সেটা হল মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে আল্লাতা’লার নিজেরই হাজারখানেক ফেরেস্তা পাঠিয়ে যুদ্ধ করানো। যেমন মুসলমান সাক্ষীদের বয়ান অনুযায়ী লম্বা লম্বা গায়েবী তলোয়ার দিয়ে শত্রু নিধন করতে দেখা----অর্থাৎ তলোয়ার আছে কিন্তু তলোয়ারধারী নেই। তারপর আছে মোহম্মদের (দঃ) হাতের মুঠোতে পথের ধূলো, এবং সেধূলো ছুড়ে বহুদূরবর্তী শত্রুর চোখ প্রায় অন্ধ করে দেওয়া, সূর্যের আলো মুসলমানরা দেখতে পাচ্ছেন পরিষ্কার, কিন্তু কোরেশরা দেখতে পাচ্ছে অন্ধকার, ইত্যাদি। এগুলো যে আধুনিক যুগের লেখাপড়াজানা, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কারো পক্ষেই সম্ভব নয় বিশ্বাস করা সেটা অনুমান করেই হয়ত মওলানা ইউসুফ আলী তাঁর অনুবাদের পাদটিকাতে মন্তব্য করেছেন যে ফেরেস্তা প্রেরণের ব্যাপারটি খুব সম্ভব আক্ষরিক অর্থে নেওয়া ঠিক হবে না----এগুলোর একটা রূপক ব্যাখ্যা থাকাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার যে বদরের যুদ্ধের ঠিক পরের বছরই কোরেশরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র আর দলবল নিয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করতে আসে, এবং সেযুদ্ধে মুসলিম পক্ষ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন, যদিও আগের বারের মত এই ওহুদেরর যুদ্ধতেও আল্লাতা’লা তিন থেকে পাঁচ হাজার ফেরেস্তা পাঠিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। বদরের চেয়ে তিনচারগুণ বেশি ফেরেস্তা যেখানে মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে সে পক্ষ নিদারুণভাবে হেরে যায় কিভাবে সেটাও আমার মাথায় ঢোকে না। অতএব রূপক জাতীয় ব্যাখ্যা অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের অতি উচ্চশিক্ষিত, পরম ধার্মিক, ঈমানদার, জনাব ইবরাহিম সেগুলোকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করে তাঁর পাঠকদেরও আহ্বান জানিয়েছেন ঠিক একইভাবে বদরের যুদ্ধের অলৌকিক ঘটসমূহকে স্মরণ করতে। তিনি আরো বললেন যে কোরেশদের ওপর আল্লাতা’লার নির্দেশে কোত্থেকে তীর বল্লম এসে ‘কাফেরদের’ নাস্তানাবুদ করতে থাকে। এ এক জলজ্যান্ত উদাহরণ ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থাকলে কিভাবে সমাজের একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। এবং তার ফলে তাঁর মত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দ্বারা কিভাবে গোটা সমাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়আল্লামা শফির মত অর্ধশিক্ষিত লোকেরা যতনা ক্ষতি করেন আমাদের অভাগা জাতিটার তার শতগুণ বেশি ক্ষতি করেন জেনারেল ইবরাহিমের মত আপাতশিক্ষিত ব্যক্তিরা।
৮ নং সুরার কতগুলো জায়গা আমাকে ভীষণভাবে বিচলিত করে। যেমন (৮ঃ১২) আয়েতের বক্তব্যটিঃ “I will instill terror into the hearts of the Unbelievers: smite ye above their necks, and smite all their finger-tips off them” (ইউসুফ আলী) (“আমি অবিশ্বাসীদের মনে ভীতি সঞ্চার করবতাদের মস্তক ছিন্ন করে দেব, কেটে টুকরো করে দেব তাদের প্রতিটি আঙ্গুলের ডগা”। ) আল্লাতা’লা স্বয়ং একথা বলছেন? তাঁর নিজের সৃষ্ট মানবদের নিয়ে? বিশেষ করে যখন এই কোরাণ থেকেই আমরা শিখেছি যে ভূপৃষ্ঠের একটা গাছের পাতাও নড়ে না তাঁর ইচ্ছা ছাড়া? আরো একটি জায়গা আছে যেখানে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ, আয়েতটা পড়ার পর(ঃ১৭)ঃ “It was not ye who slew them; it was God”. ( তোমরা যখন শত্রু নিধন করলে সেটা তোমরা করনি, করেছিলেন আল্লা”) এটা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় আপনার কাছে? আল্লা স্বহস্তে তাঁর সৃষ্ট মানবসন্তানকে হত্যা করবেন? হয়ত আমারই বুঝার ভুল----আল্লাই আমার মনে তালা লাগিয়ে রেখেছেন। আপনি যদি এর তাৎপর্য বুঝে থাকেন দয়া করে আমাকে বলে দেবেন। আমার মত গুণাগার মানুষ, ভাই, কোরাণের এই সুরাগুলো পড়ে দারুণ ঘুরপাক খাচ্ছি, সাথে সাথে ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। আল্লা আবার হত্যা করেন কিভাবে?
 সূত্রঃ,
 (১) God’s Crucible: Islam and the Making of Europe 70-1215,  by David  Levering Lewis, W.W. Norton and Co. Inc., New York, 2008
  (২) The Battle of Badr, by Maxime Rodinson, New Press, New York, 1968, Eng.Ed. in 1971 , see p.165-170.

অটোয়া, ২৮শে জুলাই, ‘১৩

মুক্তিসন ৪২

মীজান রহমান

No comments:

Post a Comment