লুত্ফুন নাহার লতা
নিউ ইয়র্ক :: ২০১৩ জুলাই ২১
চোখের পলকে এক বছর হয়ে
গেল! আকাশের অনন্ত নক্ষত্রবীথি থেকে ঝরে গেলেন বড় প্রিয় মানুষটি! আমার প্রথম সিরিজ
নাটকের জনপ্রিয় নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদ! অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসে! কোন কথাটি বলি আর কোন কথাটি
বলি না, আর কোন কথাটি মনে করে
যে মন বিষন্ন হয়ে যায়! কত যে কথা! নরওয়ে থেকে রওনা হলাম লন্ডনের পথে বন্ধু সালাম
ভাই ভাবীর বাসা থেকে বেরুবো এমন সময় টিভি তে শোনা গেল হুমায়ুন আহমেদের অবস্থা খুব
খারাপ, মাজহার মিডিয়াকে
জানাচ্ছে পরিস্থিতি ভালর দিকে!
ঘন্টা দুই তিনেকের
মধ্যে লন্ডনে পৌছে খবর পেলাম চলে গেছেন! জুলাইয়ের ১১ তারিখে আমি নিউইয়র্ক থেকে
আসার কয়েকদিন আগে গেলাম বেলভিউ হসপিটালে তাঁকে দেখতে, কিন্তু তিনি যেখানে আছেন সেখানে
সবাইকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না! সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে, বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁচের ভেতর থেকে
তাকে এক নজর দেখার জোর চেষ্টা শেষে একা একা ঘরে ফিরছি, হঠাত মনে হল কেউ আমাকে ডাকছে 'মিস মিলি!' আমার চোখ বাঁধা মানলো না! অনেকটা
পথ বাস ট্রেন করে আমি ঘরে ফিরে এলাম!
শেষ দেখা হয়েছিল
জামাইকায় তার বাসায়! সেদিন ছিল বাসন্তি পূজো! বাসন্তি রঙের শাড়ী আর হলুদ গাঁদা ফুল
পরেছিলাম পূজোর অনুষ্ঠানে মঞ্চের উপরে আমার একক পরিবেশনা ছিল বলে! রাত তখন বেশ
হয়েছে! কেমন উদাস হাওয়া বইছে! আর আমার মন উথাল পাথাল! কেবল মনে হচ্ছে কেমন দেখব
হুমায়ুন ভাইকে! বন্ধু মুনিয়া মাহমুদ আর নুরুদ্দিন ভাইয়ের সাথে গেছি হুমায়ুন ভাইকে দেখব বলে। বাসায় গিয়ে যখন
দাড়ালাম বসার ঘরে নিষাদ কেঁদে চলেছে কারন ছোট ভাই নিনিত তাকে ধাক্কা মেরেছে! আর
নিনিত দূরে দাঁড়িয়ে অভিনয় করে দেখাচ্ছে সে কেমন করে ভাইকে মেরেছে! লজ্জা পেয়ে
নিষাদ মার কোল থেকে নেমে দৌড়ে গেল বাবার কাছে! ক্লান্ত শাওন, কত কত রাত সে ভালো করে ঘুমায় নি!
দিনের পরে দিন ওই মেয়েটির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে অকালবৈশাখী!
হুমায়ুন ভাই শোবার ঘরে, দেশে কারো সাথে কথা বলছেন! আমি
এসেছি সে খবর পেয়েছেন কিনা বোঝা গেল না! কিছুক্ষন পরে এক হাতে নিষাদকে পেটের উপর
বেঁধে নিয়ে অন্যহাতে লুঙ্গির গিট ধরে, খালিগায়ে, খালিপায়ে এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে! কিন্তু তার দিকে
তাকিয়ে আমরা সবাই এক রকম জোরেই হেসে উঠলাম! সারা মাথা, মুখ, বুক, পেট বেয়ে নামছে দুধের ধারা! সব
সাদা! বাবার সাথে বনিবনা না হওয়ায় নিনিত দুধের বোতল ছুড়ে মেরেছে আর তা খুলে গিয়ে
বাবার মাথায় পড়ে এই অবস্থা!
আমাদের সামনে হাতের
কাছে টিস্যু বক্স থাকায় আমি, মুনিয়া, শাওন সবাই মিলে তাকে মুছানোর
চেস্টা করলাম! উনি এক মুখ হাসি ছড়িয়ে আমার দিকে সরাসরি চেয়ে বললেন 'মিস মিলি আপনার কি কোনোদিন বয়স
বাড়বে না!' সমস্ত আকাশ উঠলো হেসে! পুরো
পরিবেশ গেলো বদলে! কোথায় ভেবেছিলাম হুমায়ুন ভাইকে দেখে কেমন করে কান্না লুকিয়ে
হেসে হেসে কথা বলব, মনে মনে তার একটা
রিহার্সালমত ভেবে রেখেছিলাম ভেবেছিলাম হুমায়ুন ভাই কে বলব 'এইসব দিনরাত্রি'র বাবলু'র কথা! তার সেই বিখ্যাত ডায়লগ 'হৈয়ার বাড়ি গেছিলাম দুধ ভাত দিছিল
দুধভাত খাইছিলাম!' সেই কথা! বাবলু এই শহরেই থাকে, অনেক বড় হয়ে গেছে --- এইসব, নাহ সে কথা বলার আর অবকাশ রইল না!
আমিও হেসে বললাম 'হ্যা হুমায়ুন ভাই সেই
যে আপনি আমাকে মিস মিলি বানিয়েছিলেন বয়স ওখানেই আটকে আছে!' রাত বেড়েছে আরো! ঘরে ফেরার পালা!
বের হয়ে আসার আগে দরজা পর্যন্ত এসে দাড়ালেন আমাদের পিছু পিছু----
ফিরে আসতে আসতে আবার
সেই ডাক শুনতে পেলাম! 'মিস মিলি!' কেমন যেনো নিশিতে পাওয়া মানুষের
মত আমি আমার চারিদিকে তাকালাম! আমার মনে পড়ল ১৯৮৮ তে আমরা যখন বহুব্রীহি নাটকের
কাজ করছি তখন টেলিভিশনে রাজাকার শব্দটি বলা যেত না! কিন্তু কি অসম দৃড়তায় বাংলাদেশ
টেলিভিশনের কালাকানুন ভেঙ্গে পাখীকে চরিত্র বানিয়ে সেই পাখীর মুখ দিয়ে সারা জীবনের
ঘৃনা ও ধিক্কার জানিয়ে দিলেন! বাংলার মানুষ আবার দীর্ঘকাল পরে জ্বলে উঠল ঘৃনায়!
ফিরে যেতে যেতে চোখ বয়ে আমার জলের ধারা নামল! বিপন্ন বাসনা তবু তাঁর মঙ্গল কামনায় নতজানু হল! আমি যেনো সারা আকাশ জুড়ে থৈ থৈ
পূর্ণিমার ধু ধু জোতস্নায় হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টিয়ার মুখে সমস্বরে সেই ধিক্কারের
স্লোগান শুনতে পেলাম! তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার!!!
::
লন্ডনে মহা সমারোহে
চলছে অলিম্পিকের আয়োজন! সারা পৃথিবী থেকে ক্রীড়ামোদীরা এসে ভরে গেছে এই শহর। তিল ধারনের ঠাই
নেই এমন অবস্থা! ২০ সে জুলাই সারাদিন কেটে গেল বাকিংহাম প্যালেসের সামনে, লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ার, লন্ডন টাওয়ার আর লন্ডন ব্রীজের
আশেপাশে ঘুরে। এবারের ইউরোপ যাত্রায় আমার ছেলে সিদ্ধার্থ আমার সঙ্গী! তার লিস্ট
অনুসারে অনেক কিছু দেখার ইচ্ছে থাকলেও এবার তা দেখা হল না বলে সে খুব মন খারাপ করলো!
কথা ছিল ফ্রাংকফুর্ট, বার্লিন হয়ে লন্ডনে এসে কয়েকটি
দিন থাকব আর সে সব ঘুরে ঘুরে দেখবে! কিন্তু এর মধ্যে থেকে তিন, চার দিনের জন্যে আবার নরওয়ে তে যাবার প্লান করায় সেটা আর হল
না। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল পিকাডিলি সার্কাসে একটি সন্ধ্যা কাটানোর! লন্ডনে এলে সব
সময় আমার প্রিয় হ্যারডস থেকে এক চক্কর না ঘুরে আসলে আমার মনেই হয় না, লন্ডনে এলাম! মনের অতৃপ্তি মনে
রেখে আর আমার দিকে কপাল কুচকে চোখ সরু করে তাকিয়ে পরদিন হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে সে ফিরে গেল নিউইয়র্ক আর আমি
চললাম দেশে!
সারাটি পথ মনে পড়লো কত
কথা! কত বছর নাটক করিনি! অথচ চোখ বন্ধ করলেই আমার চোখের সামনে আজো তিনটি ক্যামেরার
লালবাতি জ্বলে ওঠে! ১৯৯৭ সালে বুক ভরা অভিমান নিয়ে স্বদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম!
১৯৯৬ তে নিজের জীবন বাজী রেখে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষার জন্য প্রতিবাদের
দূর্গ গড়ে তুলেছিলাম! আমার অহংকার আমি নেমেছিলাম রাজপথে! আমার গৌরব আমি প্রতিবাদ
করেছিলাম! আমার প্রাপ্তি, সেই ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা
আজো এই দেশের মাটিতে নিশ্বাস ফেলতে পারছেন! ওরা বেঁচে আছেন! কিন্তু আমি দেশের কাছে, সরকারের কাছে রইলাম মুল্যায়নহীন, বহুদূরের একজন অচেনা মানুষ! যে
দেশ ও তার মানুষের জন্য আমার কতনা হাহাকার! সেই প্রিয় স্বদেশের সীমানা ছেড়ে, দেশান্তরী হয়েছিলাম আমার পাঁচ
বছরের একমাত্র সন্তান সিদ্ধার্থকে নিয়ে! পেছনে ফেলে গেলাম আমার জননী, জন্মভূমি। আমার রেডিও, আমার টেলিভিশন, আমার মঞ্চ, আর আমার স্বত্বার শেকড়, আমার নাটক!!!
২২ জুলাই রোববার সকালে
প্লেনের জানালা দিয়ে লাল রঙের মাটি দেখা গেলে আমার আত্মা বরাবরের মত হু হু করে
কেঁদে উঠল! ঐ তো! ঐ তো আমার মাটি! আমার দেশের মাটি! প্লেন রানওয়ে স্পর্শ করল, আমি লন্ডন থেকে ঢাকায় পৌছুলাম!
এয়ারপোর্টের ঝামেলা শেষ করে বের হবার সময় একজন অফিসারের কাছে জানতে চাইলাম 'আজ তো নিউইয়র্ক থেকে লেখক হুমায়ুন
আহমেদের আসার কথা তাই না! উনি কি পৌছে গেছেন? জবাবে উনি যা বললেন তাহল কিছু
একটা সমস্যার জন্য আজ এসে পৌছুবেন না, তবে কাল সকালে উনি আসবেন!’
দেশে যখনি যাই
প্রতিবারের মত এবারেও এয়ারপোর্টে বিশেষ সম্মান, বিশেষ যত্নের এতোটুকু ব্যত্যয় হল
না! আমাকে বসিয়ে আমার নাটকের কথা বলতে কেউ ভুললেন না! এবারে তার সাথে যুক্ত হল
আমার অধিকাংশ নাটকের প্রিয় নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদের নাম! কেমন করে তারা অধীর
অপেক্ষায় বসে থাকতেন আমাদের নাটকের জন্য! হুমায়ুন আহমেদের প্রথম টেলিভিশন সিরিজ
নাটক 'এইসব দিনরাত্রি' প্রচারিত হত মঙ্গলবারে।
সেদিন সন্ধ্যার পরেই ঢাকা শহর সুন সান হয়ে যেতো সবাই নাটক দেখবে বলে! এমন অনেক
কথার ফাঁকে ফাঁকে সবাই ছল ছল চোখে হুমায়ুন আহমেদের আত্মার শান্তি কামনা করলেন!
একটি ছোট্ট জীবনে এতো মানুষ তাঁকে কী করে এতো ভালোবাসল! এটা অসম্ভব ভালোলাগা এক
বিস্ময় আমার মনে! দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে এক আকাশ শূন্যতাকে বুকে চেপে এয়ারপোর্ট থেকে
বেরিয়ে এলাম!
পরদিন সকালে ঘুম থেকে
উঠে সাদা শাড়ী পরে রেডি
হলাম শহীদ মিনারে যাবার জন্য! প্রতি বছর এই সময়টাতে আমি দেশে আসি! আর সৌভাগ্য কি
দুর্ভাগ্য জানিনা শহীদ মিনারে ছুটে যেতে হয় কারো না কারো জন্যে বিদায়ের এই
মহাসমারোহে! গত বছর এখানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম অনন্যসাধারন দুই সংস্কৃতি-কর্মী, ফিল্ম-মেকার তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনিরের
অকাল প্রয়ান! এবার হুমায়ুন আহমেদের জন্যে!
বহুদূর থেকে হুমায়ুন
ভাই এসেছেন। সারা বাংলাদেশ ভেঙ্গে পড়েছে শহীদ মিনারে। লেখক, কবি, শিল্পি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, নাট্য-ব্যক্তিত্ব, ছাত্র, শিক্ষক, সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন, সকল মিডিয়া আর হাজার হাজার মানুষ
এসেছে স্রোতের মত সারা বাংলাদেশ থেকে! লোকে লোকারন্য। সকল টিভি চ্যানেলগুলো এসে তাদের অবস্থান নিয়েছে
অনেক আগেই। ক্রেনের মত লম্বা স্কাই স্ক্র্যাপারের সাহায্যে ক্যামেরাম্যান উপর থেকে
ক্যামেরা প্যান করে স্ক্রল আপ বা স্ক্রল ডাউন করে ছবি নিচ্ছেন! বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংস্কৃতিককর্মী কেউ
কেউ ধারাবর্ণনা দিচ্ছেন!
সবকটি টিভি চ্যানেল
সরাসরি সমপ্রচার করছে এই বিদায় উৎসব! হ্যা উৎসব ই তো! মানুষের স্রোত চলেছে সারি
দিয়ে, প্রিয় লেখক, প্রিয় নাট্যকার, প্রিয় পরিচালক, প্রিয় মানুষ হুমায়ুন আহমেদকে শেষ
বারের মত দেখতে। তাদের হৃদয় নিংড়ান শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে! হুমায়ুন আহমেদের প্রিয়
ফুল কদম! যত দূর চোখ যায় সবার হাতে কদম! সেই সাথে বকুল, জুঁই, বেলী, দোলনচাঁপা সহ নানা রকম সাদা ফুলে ওদের
দুহাত ভরা! জীবনে তিনি যেমন উজাড় করে দিয়ে গেছেন তার পাঠকদেরকে, তেমনি আজ ওরাও প্রান উজাড় করে
এনেছে ওদের পরম ভালোবাসা একজন হিমু'র জন্যে!
ওনাকে রাখা হয়েছে একটি
অস্থায়ী মঞ্চের মত বানিয়ে তাতে দুগ্ধ ধবল শামিয়ানা দিয়ে ঘেরা! তার পেছনে আর একটি
শামিয়ানার তলায় হাজারো ভীড়ের মধ্যে আত্মীয় পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে পাথরের মত বসে
আছেন ওনার মা। মুখোমুখি শাওন ।শাওন কে ধরে দাঁড়িয়ে আছে অভিনেত্রী তানিয়া, মায়ের পাশে দাঁড়ানো ডঃ জাফর ইকবাল!
এছাড়াও কত যে মানুষ! সে দৃশ্য যে না দেখেছে তাকে তা বলে বোঝান যাবে না।
আমি গিয়ে দাঁড়ালাম
হুমায়ুন আহমেদের মায়ের পাশে! ওনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, 'খালাম্মা আপনি তো কোন সাধারন মা
নন আপনি '৭১-এ দেশের জন্য স্বামীকে হারিয়েছেন! আজ জননন্দিত সন্তান হারিয়েছেন! আপনি
হুমায়ুন ভাইয়ের মা! আপনাকে তো ভেঙ্গে পড়লে চলবে না!' শাওনের দিকে তাকানো যায় না এই চার
পাঁচ দিনে সে যেনো ঝরে পড়া একটি শুকনো পাতার মত ফ্যাকাশে! সে থেকে থেকে কেঁদে উঠছে, অনর্গল কথা বলছে! আমাকে দেখে আবার সে গুঙিয়ে উঠলো! হাত দুখানি ধরে কেবল
বললাম 'শাওন, শান্ত হও! শান্ত হও!'
হুমায়ুন আহমেদের
মৃত্যুর আগে ওনার শেষ ইচ্ছা কি ছিল বা কোথায় উনি সমাহিত হতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে
পারিবারিক সিদ্ধান্ত হয়নি তখনো ! সেই বিতর্কে, সারা পরিবার, সারা দেশের মানুষ, সারা পৃথিবীতে ছড়িতে থাকা অগনিত
হুমায়ুন ভক্ত দ্বিখন্ডিত! জাফর ভাইয়ের সাথে কথা বলে বুঝলাম পারিবারিক সম্মানের কথা
ভেবে ওনারা বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে চান!
কফিনের পাশে সাদা
কাগজের মত দাঁড়িয়ে আছে নোভা, শিলা আর কালো ফ্রেমের
চশমা পরা নুহাশ! নুহাশ
কিছুক্ষণ
পর পর বাবার কফিনের উপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে! আমি শিলাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলে
শীলা তার ভার ছেড়ে দিয়ে কেঁদে উঠলো ! নোভাকে খুঁজছিলাম নোভার কাছেই! মাথায় ওড়না বেঁধে
রাখায় আমি ওকে চিনতেই পারিনি! বিপাশা আমেরিকা থেকে এখনো এসে পৌছায় নি। ওরা তিন বোন
আমাদের কত প্রিয় ছিল! ওরা 'এইসব দিনরাত্রি'র সেটে এসে বসে বসে খেলা করত!
আমরা ওদের সবাইকে ডাকতাম টুকটুকি বলে! আমাদের ঐ নাটকে ছোট্ট একটি মেয়ে ছিল যার নাম টুকটুকি! 'বহুব্রীহি' নাটকের সেটে ওরা এলে আনন্দ বয়ে
যেতো! এই নাটকের মা (আলেয়া ফেরদৌসি) আমাদের জন্য খাবার বানিয়ে আনতেন! হুমায়ুন
ভাইয়ের তিন মেয়ে, পরিচালক নওয়াজিশ আলী
খানের ছেলে তোরসা আর ছোট্ট মেয়ে রেহনুমা কে সাথে নিয়ে আমরা সেই মজার নুডল খেতাম!
হুমায়ুন ভাইও বাদ পড়তেন না! আর নুহাশ! সে তো সেদিন হল! ও আমার ছেলে সিদ্ধার্থের বয়সি!
সময় শেষ হয়ে এসেছে
প্রায়, ঈদ গা মাঠে নামাজে
জানাজা হবে সেখানে যেতে হবে, কেউ এসে জানান দিলে
সবাই গিয়ে ঘন হয়ে দাঁড়ালাম তার কফিনের পাশে, ফুলে ফুলে পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে
উঠেছে পুরো এলাকা জুড়ে! এই সব মূহুর্তে মন কেমন এক অপার্থিব আলোকে ভেসে বেড়ায়, কফিনের উপর থেকে একটি তাজা বকুলের
মালা তুলে নিলাম হাতে! দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে
ফিসফিসিয়ে বললাম 'হুমায়ুন ভাই আপনার কি
মনে হচ্ছে আপনার প্রিয় বই তারাশংকরের 'কবি' থেকে সেই উদ্ধৃতি! "জীবন এতো ছোট কেনে!"
হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে
এগিয়ে গেল তাঁর শেষযাত্রা! পিছনে অগনিত মানুষের মিছিল! ক্রন্দন! হাহাকার! ফুল!
পায়ের কাছে পড়ে থাকা বর্ষার প্রথম কদম! কিছুক্ষণের মধ্যে আস্তে আস্তে শুন্য হয়ে এলো
শহীদ মিনার। আজ দাফন হবে না। আজ
রাতে তিনি
থাকবেন বারডেমের হিম ঘরে! কাল পারিবারিক সিদ্ধান্ত হলে তারপর শেষ হবে এই পার্থিব
আয়োজন!
অপার্থিব এক যাত্রায়
তিনি একাকী চলেছেন সেই আনন্দধামে! আমার হাতের ভেতর তাঁর শেষ চিহ্ন বকুল মালা! ছোট
নয় তাঁর বিশাল জীবনের সুষমায় ভরা এই ফুল! আমার মনের শূন্যপ্রান্তরে আমি যেনো শুনতে
পাচ্ছি সেই অনন্তধামের পানে ছুটে চলা এক স্বর্গ-সংগীত গীত হতে! তা যেন
সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিব্যাপ্ত হয়ে কী এক অজানা ইন্দ্রজাল বিছিয়ে দিয়ে গেলো
আমার উপলব্ধির উপকূলে। আমি শহীদ মিনার থেকে পা বাড়ালেম এই জেনে,..."তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ...."
নিউ ইয়র্ক :: ২০১৩ জুলাই ২১
লুত্ফুন নাহার লতা
লুত্ফুন নাহার লতা: লেখক, শিক্ষক, আবৃত্তিকার, ও নাট্য-শিল্পী।
No comments:
Post a Comment