Sunday, 28 July 2013

অজজননীর লজ্জাবরণ?

মীজান রহমান

অনেকদিন পর বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিতে একটু হালকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। প্রথমত হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমেদ শফি দেশব্যাপী হাসির হুল্লোড় সৃষ্টি করেন নারীজাতিকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে। তাঁর নিজের মুখনিঃসৃত, অননুকরণীয় ভাষাতেঃ “...তেঁতুল গাছের নিচে দিয়া হাঁইটা যান তাইলেও আপনার লালা ঝরবে।...ঠিক তেমনি মহিলাদের দেখলে দিলের মাঝে লালা ঝরে।...যতই বুজুর্গ হন আপনার মনের মাঝে কু খেয়াল আইসা যাবে”। হেফাজতের বুজুর্গ হজরত শফি তাই বাংলাদেশের মহিলাসম্প্রদায়কে লক্ষ করে বয়ান দিচ্ছেনঃ “এই মহিলারা, ঘরের চার দিউয়ারির মধ্যে তোমরা থাকো...হুজুরের আগের জমানায় মহিলারা বেপর্দায় চলাফেরা করতো।...উলংগ অবস্থায় ঘুরাফেরা করিও না রাস্তাঘাটে, হাটে-মাঠে”। আল্লামার মহান বাণী প্রচার হবার পর বাংলাদেশের যাবতীয় তেঁতুল ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই খুশিতে বাগবাগ। তেঁতুলের  মত একটি নিরীহ ফলের কদর কতখানি উপরে উঠে গেল বুঝতে পারছেন তো? তাঁর পরামর্শমত মহিলাগণ যদি সত্যি সত্যি ‘চার দিউয়ারির’ ভেতর আবদ্ধ থাকার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে আমাদের হতভাগ্য পুরুষজাতির তো লালা নির্গমনের জন্য একমাত্র তেঁতুলদেরই শরণাপন্ন হতে হবে। অবশ্য রমনী গৃহবাসিনী হলেই যে পুরুষের রমনস্পৃহা নিবৃত্ত থাকতে হবে তার তো কোনও অর্থ নেই----বিকল্প ব্যবস্থা আল্লাপাকই কবুল করে দেবেন। সেপ্রসঙ্গে যাচ্ছি একটু পর।
দ্বিতীয় রসের ভাণ্ডারটি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন দেশের এক অতিশয় মেধাবি আর্মি জেনারেল (অঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ঢাকার ‘নয়াদিগন্ত’ পত্রিকার ১৬ই জুলাই সংখ্যার উপসম্পাদকীয়তে প্রকাশিত ‘সামনে বদরের যুদ্ধ’ শীর্ষক নিবন্ধে তাঁর বক্তব্যগুলো বিশেষ প্রনিধানযোগ্য। লেখাটি পড়ার পর আমার মত সাধারণ পাঠকের মনে ধারণা জন্মায় যে দ্বিনদুনিয়ার মালিক, বিশ্বজগতের মহান সৃষ্টিকর্তা, পাকপরেন্দকার আল্লাতা’লা, স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করেছিলেন, (প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষে, ফেরেস্তাবাহিনীর মারফত), একদলের পক্ষ নিয়ে আরেক দলের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তব্যটি অবিশ্বাস্যরকম হাস্যকর হলেও আল্লামা শফির মত হাস্যরস উৎপাদক নয়, ভীতিসঞ্চারক। যখন ভাবি যে কোরাণের একজায়গায় আল্লাতা’লা বলছেন যে সংসারে কোনকিছুই ঘটে না তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, আবার অন্যত্র বলছেন, কাফেরদের কল্লা কেটে ফেল (এই কাফেররা তো তাঁর ইচ্ছাতেই যুদ্ধ করছিল, তাই না?), তখন আমার বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে। কথাগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় আপনার কাছে? রাস্তার সাধারণ মুটেমজুরের মুখ থেকে বেরুলে মানা যেত---বুঝতাম যে এগুলো পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু একজন গণ্যমান্য সেনাপতি? তা’ও শোনা যায় দারুণ মাথাওয়ালা লোক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তএঁরা দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, জাতির আশাভরসা। এঁরাই যদি এসব আজগুবি কথা বলতে শুরু করেন জাতির উদ্দেশে তাহলে দেশের কি হবে? একদিকে আল্লামা শফির মত মূর্খ লোক তাঁর মূর্খতর চেলাদের চিরমূর্খ বানিয়ে রাখাতে বদ্ধপরিকর, আরেকদিকে আর্মি জেনারেল ইবরাহিমের মত তুখোড় মেধাবী মানুষ দেশের অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত সম্প্রদায়টিকে অজ্ঞতার অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন----উভয়দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে জাতির ভবিষ্যতের ওপর।
এবার চলুন হেফাজতে ইসলামের আল্লামা শফির ‘চার দিউয়ারির ভেতর’ প্রসঙ্গটা সেরে ফেলি।
আমার কি মনে হয় জানেন? শুধু ‘মহিলাগণ’ই নন, চার থেকে চোদ্দ বছরের ছেলেদেরও ‘চার দিউয়ারির ভেতর’ বাস করা দরকার----তাদেরই নিরাপত্তার জন্যে। আল্লামা সাহেবের সমগোত্রীয় ‘বুজুর্গ’গণের বিষয় আমি যতদূর জানি, মহিলারা ‘উলংগ’ অবস্থায় রাস্তায় বাহির হোক বা না হোক, ছোট ছোট ছেলেরা, বিশেষ করে নাদুশ নুদুশ প্রকৃতির প্রিয়দর্শন বালকেরা, উলংগ কেন, হাফপ্যান্ট পরিহিত অবস্থাতে ঘরের বাইরে গেলেই কারো না কারো ‘দিলের লালা’ নির্গত হতে শুরু করে। আমার ছোটবেলার দুচারটে অভিজ্ঞতা আছে যার ভিত্তিতেই আমি বলছি এসব কথা। একবার সদরঘাট থেকে গয়না নৌকায় কোনও এক গ্রামে যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যায় যাত্রা করে মাঝরাতে গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা। বয়স তখন বারো কি তেরো। নদীর বাতাসে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছিল----কখন গভীর ঘুমে টলে পড়লাম মনে ছিল না। ঘুম ভাঙ্গলো পেছনে শক্ত কিছুর গুঁতো খেয়ে। এক অতিশয় কুৎসিৎ, দুর্গন্ধময়, তাগড়া চেহারার লোক আমার পেছনে শোয়া।
আমাদের গ্রামে একটা আবাসিক মাদ্রাসা ছিল----মৌলবিসাহেবরা সেখানে কোরাণহাদিস পাঠ করতেন, আবার পানাহার বসবাস সবই করতেন। আমি শহর থেকে প্রায়ই গ্রামে যেতাম বেড়াতে। গ্রামের বন্ধুরা তখন আমাকে সাবধান করে দিত কক্ষনো যেন একলা ঐ মাদ্রাসার রাস্তায় না যাই। কি হবে গেলে? আমি হয়ত বোকার মত জিজ্ঞেস করতাম। ওরা মুখ টিপে হাসত শুধু। তাতেই বোঝা যেত ব্যাপারটা কি। সুতরাং আল্লামা শফির মত এই অধমও দেশের যাবতীয় প্রিয়দর্শন বালকদের উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করছিঃ তোমরা যেন ‘চার দিউয়ারির বাইরে’ না যাও অভিভাবকের সংগ ব্যতীততাহলে বিপদ হতে পারে। একলা যদি বেরুতে হয় একান্ত তাহলে রমনীদের মত অংগপ্রত্যংগ অতিশয় যত্নসহকারে আবৃত রাখার চেষ্টা করো----বদ ছেলেদের মত ‘উলংগ’ অবস্থায় বেরিও না।
মহিলারা ‘উলংগ’ অবস্থায় ঘরের বাহির না হলেও পুরুষদের বালকপ্রীতি খুব একটা নিবৃত্ত থাকবে কিনা সন্দেহ। আমার এ উক্তিটাতে আশা করি আমার পাঠকদের কোমল অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে না। বিষয়টি আমার কল্পনাপ্রসূত নয়, এমনকি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিপ্রক্ষিতেই নয় কেবল। এর পেছনে ইতিহাসের সাক্ষ্য আছে, আছে শাস্ত্রীয় কেচ্ছাকাহিনীও। এটা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয় যে পুরুষের ‘lewd’ আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ঐশিবাণী উচ্চারিত হয়েছে তিনটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থেই----ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট, ও কোরাণ। কেন? সোজা হিসাব। কারণ সেযুগে এগুলো বেশ ব্যাপকভাবেই ছিল তাদের সমাজে। আপনি যদি রোমানদের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেন একটু তাহলেই দেখতে পাবেন সমকাম (Sodomy)  বিষয়টিকে একসময় কত সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাপার বলে গণ্য করতেন ওঁরা। তাদের সেনাসামন্তেরা, ভদ্রজনেরা, স্ত্রীসংগ ছাড়াও, ক্রীতদাসপুত্রদের সঙ্গে যৌনসুখ উপভোগ করতে পছন্দ করতেন----অনেকটা বৈচিত্রের খাতিরেই হয়ত কিংবা ক্রীড়াচ্ছলে। এমনই প্রচলিত ছিল ব্যাপারটি যে ক্রীতদাসদের বাচ্চা ছেলেগুলোকে বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হত কিভাবে তাদের মুনিবদের রতিকর্মে পূর্ণমাত্রায় সুখপ্রদান করা যায়। ক্রীতদাসপুত্রদের চেহারানমুনা তেমন আকর্ষণীয় ছিল না বলে অনেকসময় ভদ্রজনেরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন তাদের সমপর্যায়ের পরিবারদের ছোট ছোট ছেলেদের প্রতি----যা তাদের অভিভাবকরা খুব সুনজরে দেখতেন না, স্বভাবতই। যাই হোক, ওল্ড টেস্টামেন্টে এই ‘লুড’ ব্যবহারের প্রতি চরম ঘৃণার ভাব প্রকাশ করার পেছনে সম্ভবত এই ইতিহাসটিই কাজ করেছিল বেশি। আমার বিশ্বাস পরবর্তী গ্রন্থসমূহেরও অনুরূপ কাহিনী।
যৌনতা একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি মানবজাতির-----তার জৈব জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর উৎস প্রকৃতি নিজেই, যার গোড়াতে রয়েছে জীবজগতের প্রজনন প্রক্রিয়া। এর কারণেই নারী পুরুষ দুপক্ষেরই কমবেশি সমান আকর্ষণ যৌনমিলনের প্রতি। (দিলের লালা শুধু পুরুষের নয়, নারীরও আসতে পারে, যা সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন তাসলিমা নাসরিন তাঁর এক সাম্প্রতিক লেখাতে) তফাৎ এটুকুই যে সামাজিক ও পরিবেশিক কারণে নারী যতটা সংবরণ করতে সক্ষম সেই যৌনস্পৃহ, পুরুষ তা পারে নাএকে জোর করে, আল্লামা শফি বা অন্যান্য সব মোল্লা-মওলানাদের ফতোয়া দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলে (যেমন ‘মহিলদের দিউয়ারির ভেতর’ আটকে রাখা) ফল হয় বিপরীত। তার যৌনাকাঙ্খাটি বিকৃত আকারে প্রকাশ পায় মাঝে মাঝে। বালকদের প্রতি দৃষ্টিপাত করার কথা একটু আগেই উল্লেখ করা হল, সেটা ‘মহিলাদের দিউয়ারির ভেতর’ আবদ্ধ থাকা সত্বেও ঘটতে পারে----সমকাম প্রবৃত্তি তো প্রকৃতিরই এক রহস্যময় বৈচিত্র্য। তাদের শরীরে এই প্রবৃত্তি প্রাকৃতিকভাবেই উপস্থিততখন যদি মহিলাগণ ‘উলংগ অবস্থাতেও রাস্তায়’ বের হন সমকামী পুরুষদের কোনও আগ্রহ থাকবে না তাদের প্রতি----তাদের আগ্রহ সেই বালকদেরই প্রতি। কিন্তু যখন স্পৃহানিবৃত্তির কোন পন্থাই খুঁজে পায়না পুরুষ তখনই সে খোঁজে ভিন্ন পথ----পুরোপুরি বিবমিষা সৃষ্টিকর পথ। যেমন চতুষ্পদী জন্তু বা অন্য কোনও মাধ্যম। হ্যাঁ, চারপেয়ে প্রাণীদের কথাই বলছি আমি। আঁতকে উঠবেন না। একটি ঘটনা তো আমার নিজের চোখেই দেখা।
আমার ছোটবেলায় কলতাবাজারের কুট্টিপাড়ার একটা অভিজ্ঞতা এখনো মনে আছে। ওপাড়ার ছেলেগুলি খুব ভদ্র, সংযত চরিত্রের ছেলে ছিল বলা চলে না। এক গরমের দিন রাস্তায় বেশ ভিড়----চোদ্দ পনেরো বছরের কতগুলো রুক্ষ চেহারার ছেলের সমাবেশ একজায়গায়। তারা হাসাহাসি করছে কি নিয়ে। দুটো কুকুর একে অন্যের প্রেমবন্ধনে অবিচ্ছেদ্যভাবে আবদ্ধ। সেই দৃশ্য দেখে এলাহি নামক একটি ছেলের  গায়ে জোশ এসে গেল। যেহেতু ওপাড়ার মেয়েরা বেশির ভাগ সময় ‘চার দিউয়ারির ভেতর’ আবদ্ধ থাকে, এবং উপযোগী নাদুশ নুদুশ বাচ্চা ছেলেও দেখা যাচ্ছিল না অকুস্থলে, সেহেতু তার দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয়ে গেল অদূরে আপনমনে ঘাস চিবোতে থাকা একটি অজসন্তানেরর প্রতি। এলাহি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে আপাতত এতেই কাজ চলবে। যেমন নিয়ত তেমন কাজ। পাশের দুই বন্ধুর সাহায্যে কর্মটি অল্পক্ষণের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গেল, ছাগশিশুর কোনরকম সহযোগিতা ছাড়াই। জানি, পাঠকের গা ঘিন ঘিন করছে। করবেই। আমার তো গা ঘিনঘিন করছে গত সত্তর বছর ধরে----সেকারণেই তো এখনো ভুলতে পারিনি।
কিন্তু কেন? মানুষ এরকম ঘৃণ্য কাজ করে কিভাবে, কেন? করে কারণ প্রকৃতিকে কৃত্রিমভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলে মানুষের মন নানারকম বিকৃত পন্থা বের করার চেষ্টা করবেই তার প্রাকৃতিক প্রবৃত্তিগুলো নিবৃত্ত করবার জন্য। আমার মনে আছে, আজার নাফিসি নামক এক বিখ্যাত ইরানী লেখিকার বই পড়েছিলাম যার নাম ছিলঃ Reading Lolita in Tehran. বইটার এক জায়গায় ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়েতুল্লা খোমাইনির ছাত্রবয়সের লেখা একটি উদ্ধৃতি তিনি তুলে দিয়েছিলেনঃ “ আপনার গৃহপালিত মুরগির সঙ্গে যৌনসুখ উপভোগ করাতে কোনও দোষ নেই, তবে সেমুরগির মাংস খাওয়া হারাম”। বিশ্বাস হয় আপনার? আমার হয়নি।
অতএব মহিলাগণকে ‘চার দেউইয়ারির ভেতর’ আবদ্ধ রাখলেই পুরুষজাতির জান্তব স্বভাবটিকে দমন করে রাখা যাবে না। ফলটা হবে এই যে তখন আপনার পাড়ার ছোট ছোট ছেলেগুলোকে সামাল দিয়ে রাখতে হবে। এমনকি আপনার ঘরের ছাগলগুলিকেও লজ্জাবরণ পরিয়ে রাখার দরকার হতে পারে।
মূল কথাটা কিন্তু ‘চার দিউয়ারি’ নয়, শব্দটা হল সংযম। এটি মানুষ কিছুটা শেখে তার পারিবারিক এবং সামাজিক সংস্কার থেকে, যেকারণে আল্লামা শফির মত আলেমউলেমাগণও তাঁদের খালাফুফু-বোনেদের প্রতি কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করার কথা কল্পনাও করেন না। অনুরূপভাবে বাইরের ‘উলংগ’ মহিলাদের প্রতিও কুদৃষ্টি যাতে নিক্ষেপ না করা হয় তার জন্যেও একরকমের মানসিকতা তৈরি করতে হয় অবলম্বন করতে হয় নারীকে কিভাবে সম্মানের চোখে দেখতে হয় তার একটা সুস্থ মানসিকতা। মোদ্দা কথা, সভ্যতা। শ্লীলতা। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখবার ক্ষমতা, সংযম,  যা শিখতে হয় স্কুলকলেজে গিয়ে, শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে ওঠাবসা করে। না, মাদ্রাসার শিক্ষায় চলবে না----সেখানে শুধু  ‘চার দিউয়ারির ভেতর’ মহিলাদের আবদ্ধ রাখার কথাই শিখবে, আর কিছু শিখবে না। তার বাইরের জিনিসগুলো শেখার জন্যে দেশবিদেশের বইপুস্তক পড়তে হবে, জানতে হবে বিজ্ঞানজগতের কোথায় কি হচ্ছে, বড় বড় চিন্তাবিদরাই বা কি বলেছেন ও বলছেন।
হেফাজতে ইসলামের প্রসংগ ঢের হয়েছে। এবার আমার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসা যাক। বদরের যুদ্ধ। যার ওপর ‘নয়াদিগন্তের’ উপসম্পাদকীয়তে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছেন ইবরাহিম সাহেব ‘সামনে বদরের যুদ্ধ’ শিরোনামাতে। আমার জানামতে বদরের যুদ্ধ ঘটেছিল ৬২৪ খৃষ্টাব্দে----আজ থেকে প্রায় ১,৪০০ বছর আগে। সেটাকে ‘সামনে বদরের যুদ্ধ’ অভিহিত করে লেখক কি বুঝাতে চাচ্ছেন জানিনা, সম্ভবত তিনি বলতে চাইছেন যে মুসলিম উম্মার জন্য এ-যুদ্ধ প্রতি বছরই একবার করে ঘটে, রমজানের পবিত্র মাসে। আসলে আপনি যদি কোরাণের ৮ নং সুরার শিরোনামা লক্ষ করেন তাহলে দেখবেন, মওলানা দাউদের তরজমাতে কেবল বলা আছেঃ ‘Spoils’ (যার আভিধানিক অর্থ Booty বা ‘লুটের মাল’)পাঠক যেন আমাকে ভুল না বোঝে--- বদরের যুদ্ধের সঙ্গে লুটের মালের কোন সম্পর্ক আছে সেরকম কোন ইঙ্গিত করার চেষ্টা আমি ভুলক্রমেও করছি না। আমি কেবল শব্দটার আক্ষরিক অর্থ যা ডিকশনারিতে আছে তা’ই উল্লেখ করলাম। মওলানা ইউসুফ আলী আর মওলানা পিকথলের তরজমাগুলোতেও হুবহু এক শিরোনামঃ ‘Spoils of War’ তাতে এমন একটা ধারণায় পৌঁছানো হয়ত কবিরা গুণাহ বলে গণ্য হবে না যে সমস্ত সুরাটি আসলে লুটের মালের ভাগবাটোয়ারা বিষয় নিয়েই। যদিও সুরার ভেতরে প্রবেশ করার পর আমরা টের পাই যে এখানে লুটটাই বড় নয়, বড় হল ঈমানদারদের জীবনমরণ যুদ্ধ মক্কার কাফেরদের সঙ্গে।
গোড়াতে যে লুটটাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য তার প্রমাণ মেলে অন্তত দুজায়গায়। প্রথমত কোরাণের উপরোক্ত সুরাটির প্রথম আয়েতেই। দাউদের তরজমায় মূল সুরার নিচে একটি টিকাতে তিনি লেখেনঃ “Muhammad’s plan was to attack an unarmed caravan belonging to the Qurayesh of Mecca on its way from Syria to that city…..” ( মুহাম্মদ (দঃ) এর মূল পরিকল্পনা ছিল সিরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে মক্কার দিকে আসতে থাকা কোরেশদের একটি নিরস্ত্র কাফেলার ওপর হামলা করে তাদের সমস্ত মালপত্র লুন্ঠন করা। পাশ্চাত্য ইতিহাসজ্ঞ লেভারিং লুইস (১)  ও ম্যাক্সিম রডিনসন (২) এই তথ্যটি আরো সবিস্তারে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে ওই কাফেলাটি ছিল বিশেষভাবে লোভনীয়----আনুমানিক ৫০,০০০ দিনারের মালামাল ছিল তাদের কাছে। মোহাম্মদ(দঃ) ও তাঁর ৩১৯ সদস্যবিশিষ্ট ভক্ত মুসলিম বাহিনী ভেবেছিলেন যে কাফেলাটি বরাবরের মত বদর মামক জায়গাটির ভেতর দিয়ে পার হবে, কারণ সেখানেই ছিল একটি শীতল পানির কূপ----মরুভূমির ওপর দিয়ে এতটা পথ অতিক্রম করার পর নিশ্চয়ই তাদের খুব পিপাসা পাবে। সমস্যা হল যে কোরেশদের দলপতি ছিলেন আবু সুফিয়ান ইবনে হার্ব নামক অতিশয় বুদ্ধিমান ও চতুর লোক (পরবর্তীতে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত উম্মায়াদ বংশ)। তিনি দূর থেকে জায়গাটির থমথমে ভাব দেখে পছন্দ করলেন না। ওই জায়গাতে আগেও অনেক লুট তরাজ হয়েছে। আবু সুফিয়ান তখন কাফেলাটিকে সরাসরি বদরের কূপের পাশ দিয়ে না নিয়ে ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে মক্কা থেকে ১২০০ সশস্ত্র সৈন্য বিশিষ্ট একটা দল এগিয়ে আসে সেই কাফেলাকে জনবলের ভরসা দিতেদুদলের মধ্যে যুদ্ধ তখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানরা দেখলেন যে তাদের চেয়ে চারগুণ সংখ্যার শত্রুবাহিনীর মোকাবেলা করতে হলে একমাত্র উপায় কোনও বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা। তাঁরা অদূরের একটি পাহাড়ের উল্টোধারে গিয়ে, কোরেশদের চোখের আড়ালে, ঘাপটি মেরে বসে থাকলেন, আর মনে মনে কামনা করলেন আল্লার সাহায্য। তারপর সুযোগ বুঝে তাঁরা ওদের ওপর তুমুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যখন তারা মোটেও প্রস্তুত ছিল না ওই আকস্মিক আক্রমনের জন্য। এই আকস্মিকতাটিই ছিল মুসলমানদের মোক্ষম অস্ত্র। তার ওপর নবীজির নিপুন পরিচালনা ও উদ্দীপনাতে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সুশৃংখল ও ঐক্যবদ্ধ একটি দল, যার বিপরীতে কোরেশদের শৃংখলা বলতে কিছুই ছিল না। ফলে তারা সংখ্যায় চারগুণ ভারি হয়েও মনোবলে ছিল একবারেই দুর্বল-----মুসলমানদের হিংস্র আক্রমনের মুখে তারা দিশাহারা হয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই যে যার জান বাঁচানোর জন্যে এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করেবেশ কিছু কোরেশ নেতা ও গোটা পঞ্চাশেক সৈন্য প্রাণ হারায় সেখানে। তাতেও তারা ছাড়া পায়নি। মুসলমান পক্ষের মেয়েরাও কম দুর্ধর্ষ ছিলেন না। পশ্চাদপদ শত্রুকে তুমুল বিক্রমে ধাওয়া করেছিলেন তাঁরা ( তার সঙ্গে বর্তমান যুগের মুসলিম নারীদের তুলনা করুণ, বিশেষ করে ‘চার দিউয়ারির ভেতর মহিলাদের বন্দিত্ব’কামী আল্লামা-আমীরদের)। বলা বাহুল্য যে বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা কেবল বিজয়ী হয়েছিলেন তা’ই নয়, আশাতীত লাভজনক অভিযানও ছিল সেটা----১৫০ টি উট, ১০টা ঘোড়াসহ বহু অস্ত্রশস্ত্র ও মুক্তিপণ আদায়যোগ্য যুদ্ধবন্দী পাকড়াও করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আসলে বদরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মক্কার কোরেশদের মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙ্গে যায়----তাদের এতদিনের ব্যবসাবাণিজ্য, সিরিয়ার সঙ্গে, আশেপাশের অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে, সব দুর্বল হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে বদরের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মুসলমানদের বুকে দুর্দান্ত সাহস ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। ওই সময়ই তারা সর্বপ্রথম ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে বদরের মাঠ কাঁপিয়ে তোলেন।
জনাব ইবরাহিমের লেখাতে বারবার যে জিনিসটা উঠে এসেছে সেটা হল মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে আল্লাতা’লার নিজেরই হাজারখানেক ফেরেস্তা পাঠিয়ে যুদ্ধ করানো। যেমন মুসলমান সাক্ষীদের বয়ান অনুযায়ী লম্বা লম্বা গায়েবী তলোয়ার দিয়ে শত্রু নিধন করতে দেখা----অর্থাৎ তলোয়ার আছে কিন্তু তলোয়ারধারী নেই। তারপর আছে মোহম্মদের (দঃ) হাতের মুঠোতে পথের ধূলো, এবং সেধূলো ছুড়ে বহুদূরবর্তী শত্রুর চোখ প্রায় অন্ধ করে দেওয়া, সূর্যের আলো মুসলমানরা দেখতে পাচ্ছেন পরিষ্কার, কিন্তু কোরেশরা দেখতে পাচ্ছে অন্ধকার, ইত্যাদি। এগুলো যে আধুনিক যুগের লেখাপড়াজানা, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কারো পক্ষেই সম্ভব নয় বিশ্বাস করা সেটা অনুমান করেই হয়ত মওলানা ইউসুফ আলী তাঁর অনুবাদের পাদটিকাতে মন্তব্য করেছেন যে ফেরেস্তা প্রেরণের ব্যাপারটি খুব সম্ভব আক্ষরিক অর্থে নেওয়া ঠিক হবে না----এগুলোর একটা রূপক ব্যাখ্যা থাকাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার যে বদরের যুদ্ধের ঠিক পরের বছরই কোরেশরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র আর দলবল নিয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করতে আসে, এবং সেযুদ্ধে মুসলিম পক্ষ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন, যদিও আগের বারের মত এই ওহুদেরর যুদ্ধতেও আল্লাতা’লা তিন থেকে পাঁচ হাজার ফেরেস্তা পাঠিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। বদরের চেয়ে তিনচারগুণ বেশি ফেরেস্তা যেখানে মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে সে পক্ষ নিদারুণভাবে হেরে যায় কিভাবে সেটাও আমার মাথায় ঢোকে না। অতএব রূপক জাতীয় ব্যাখ্যা অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের অতি উচ্চশিক্ষিত, পরম ধার্মিক, ঈমানদার, জনাব ইবরাহিম সেগুলোকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করে তাঁর পাঠকদেরও আহ্বান জানিয়েছেন ঠিক একইভাবে বদরের যুদ্ধের অলৌকিক ঘটসমূহকে স্মরণ করতে। তিনি আরো বললেন যে কোরেশদের ওপর আল্লাতা’লার নির্দেশে কোত্থেকে তীর বল্লম এসে ‘কাফেরদের’ নাস্তানাবুদ করতে থাকে। এ এক জলজ্যান্ত উদাহরণ ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থাকলে কিভাবে সমাজের একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। এবং তার ফলে তাঁর মত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দ্বারা কিভাবে গোটা সমাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়আল্লামা শফির মত অর্ধশিক্ষিত লোকেরা যতনা ক্ষতি করেন আমাদের অভাগা জাতিটার তার শতগুণ বেশি ক্ষতি করেন জেনারেল ইবরাহিমের মত আপাতশিক্ষিত ব্যক্তিরা।
৮ নং সুরার কতগুলো জায়গা আমাকে ভীষণভাবে বিচলিত করে। যেমন (৮ঃ১২) আয়েতের বক্তব্যটিঃ “I will instill terror into the hearts of the Unbelievers: smite ye above their necks, and smite all their finger-tips off them” (ইউসুফ আলী) (“আমি অবিশ্বাসীদের মনে ভীতি সঞ্চার করবতাদের মস্তক ছিন্ন করে দেব, কেটে টুকরো করে দেব তাদের প্রতিটি আঙ্গুলের ডগা”। ) আল্লাতা’লা স্বয়ং একথা বলছেন? তাঁর নিজের সৃষ্ট মানবদের নিয়ে? বিশেষ করে যখন এই কোরাণ থেকেই আমরা শিখেছি যে ভূপৃষ্ঠের একটা গাছের পাতাও নড়ে না তাঁর ইচ্ছা ছাড়া? আরো একটি জায়গা আছে যেখানে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ, আয়েতটা পড়ার পর(ঃ১৭)ঃ “It was not ye who slew them; it was God”. ( তোমরা যখন শত্রু নিধন করলে সেটা তোমরা করনি, করেছিলেন আল্লা”) এটা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় আপনার কাছে? আল্লা স্বহস্তে তাঁর সৃষ্ট মানবসন্তানকে হত্যা করবেন? হয়ত আমারই বুঝার ভুল----আল্লাই আমার মনে তালা লাগিয়ে রেখেছেন। আপনি যদি এর তাৎপর্য বুঝে থাকেন দয়া করে আমাকে বলে দেবেন। আমার মত গুণাগার মানুষ, ভাই, কোরাণের এই সুরাগুলো পড়ে দারুণ ঘুরপাক খাচ্ছি, সাথে সাথে ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। আল্লা আবার হত্যা করেন কিভাবে?
 সূত্রঃ,
 (১) God’s Crucible: Islam and the Making of Europe 70-1215,  by David  Levering Lewis, W.W. Norton and Co. Inc., New York, 2008
  (২) The Battle of Badr, by Maxime Rodinson, New Press, New York, 1968, Eng.Ed. in 1971 , see p.165-170.

অটোয়া, ২৮শে জুলাই, ‘১৩

মুক্তিসন ৪২

মীজান রহমান

Sunday, 21 July 2013

আমি, আমি, এবং আমি

মীজান রহমান

শিরোনামটি আমার নিজের কল্পনাপ্রসূত নয়----অন্য জায়গা থেকে মেরে-দেওয়া। মে মাসের ২০ তারিখে সাপ্তাহিক ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের শীর্ষ নিবন্ধের নাম ছিলঃ “The Me, Me, Me Generation”. লিখেছেন জোয়েল স্টাইন, ‘টাইম’ এর অন্যতম নিয়মিত কলামিস্ট। তাঁর দীর্ঘ লেখাটির সারমর্মটুকু প্রচ্ছদপৃষ্ঠাতেই বড় বড় করে ছাপাঃ “Millennials are lazy, entitled narcissists who still live their parents.” মিলেনিয়েল বলতে লেখক বোঝাচ্ছেন যাদের জন্ম ১৯৮০ থেকে ২,০০০ সাল পর্যন্ত এবং প্রধানত আমেরিকান প্রজন্মের কথাই বলছেন তিনি এদের সম্বন্ধে ভদ্রলোকের ধারণা যে খুব উঁচু নয় সেটা তো শিরোনাম পড়েই টের পাওয়া যায় অথচ ঠিক পরের লাইনটিতেই তিনি প্রায় একইরকম জোর দিয়ে বলছেনঃ “ Why they will save us all.” অর্থাৎ এদের মত স্বার্থপর, উচ্ছন্নে-যাওয়া প্রজন্ম যেমন আর হয়না, আবার এরাই আমাদের ভবিষ্যতের একমাত্র আশা-----মানবজাতির ত্রাণকর্তা যদি হতে হয় কাউকে এরাই হবে। গত ৩রা জুলাইর সংখ্যাতে টরন্টোর সাপ্তাহিক অনলাইন পত্রিকা ‘নতুনদেশ’ এর সম্পাদক সেরীন ফেরদৌস জোয়েল স্টাইনের এই লেখাটির অবলম্বনে একটি নাতিদীর্ঘ রচনা দাঁড় করিয়ে ফেললেন তাদের বাংলাভাষাভাষী পাঠকদের অবগতির জন্যে----কারণ তাঁর মতে, এবং আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত এতে, যে সমস্যাটি কেবল আমেরিকার তরুণদের বেলাতেই নয় গোটা বিশ্বের (বাংলাদেশ সমেত) নতুন প্রজন্মের বেলাতেও প্রযোজ্য। তবে সেরীন ফেরেদৌসের লেখাতে স্টাইন সাহেবের বক্তব্যের প্রথম দিকটা যেমন স্পষ্ট করে ফুটে উঠেছে তেমন তাঁর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি উঠেছে বলে মনে হয়নি, সম্ভবত পত্রিকার স্থান সঙ্কুলানের কারণেই। আমার এই লেখাটিতে প্রধানত এই দ্বিতীয় বক্তব্যটির ওপরই আলোকপাত করার চেষ্টা করব
একশ বছর আগে পৃথিবীর যে চেহারা ছিল তার সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের বলতে গেলে কোন মিলই নেই। একশ বছর আগে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ছিল দেড়শ কোটির একটু বেশি, আর এখন হল ৭০০ কোটির ওপর। সমস্যাও অন্তত সাতগুণ বেশি। কিন্তু একটা জিনিস বদলায়নি তেমন----মানুষের মৌলিক চিন্তাধারা। ১,৯০০ সালের প্রজন্ম যেরকম মতামত পোষণ করতেন তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সম্বন্ধে, ২,০১৩ সালের প্রবীন প্রজন্মও প্রায় একই মতামত পোষণ করেন তাদের তরুণ তরুণীদের নিয়ে। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এই লেখাটির মাঝখানে নিটোল একটা তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন লেখক, যাতে ১,৮৬০ থেকে শুরু করে একেকটা যুগের মনমানসিকতার ছবি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন ১,৮৬০-১,৮৮২ এর যুগটা, যখন আমেরিকার গৃহযুদ্ধ সমাপ্তপ্রায়, এবং তরুণ তরুণীদের চিন্তাচেতনাতে কেবল বৃহত্তর সমাজকল্যানেরই কল্পনা---কিভাবে আপামর জনসাধারণের জীবনে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্ন ফিরিয়ে আনা যায়----আপাতদৃষ্টিতে একটি মহৎ, নিঃস্বার্থ উদ্দেশ্য প্রনোদিত একটি প্রজন্ম। অথচ এই উন্নত চেতনাসমৃদ্ধ প্রজন্মকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ১,৯১১ সালের এক বিশিষ্ট প্রতিবেদক বলেছিলেনঃ “Veteran teachers are saying that never in their experience were young people so thirstily avid of pleasure as now----so selfish...”. (“ গুরুজনরা বলছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাতে মানুষ কখনোই এমন উগ্রভাবে লালায়িত হয়নি ভোগসম্ভোগের প্রতি, যতটা হয়েছে আজকের তরুণ প্রজন্ম। বা এত নগ্নভাবে স্বার্থপর----”।) তার অর্থ যুগ বদলেছে, মানুষ বদলেছে, বদলায়নি কেবল মানুষের মৌলিক চরিত্র----পুরনোরা সবসময় নতুনদের দোষ খুঁজবে, আর নতুনরা চলবে তাদের নিজেদের খেয়ালখুশি মত। আমার বাবা বলতেন কলিযুগ এসে গেছে, আমার বাবার বাবাও ঠিক একই কথা বলতেন, এবং আমি নিজেও প্রায় একই সুরে কথা বলতে শুরু করেছি।
তবুও পার্থক্য একটা আছে---বড় পার্থক্য, যেটা স্টাইন আর সেরীন উভয়ের লেখাতেই ফুটে উঠেছেবর্তমান যুগ প্রযুক্তি-চালিত---যার অর্থ এই যে এযুগে কোনকিছুই লুকানোর উপায় নেই। রাস্তায় কেউ কারুর পকেটমারার চেষ্টা করলে, সে যতই আড়াল করার চেষ্টা করুক, পথচারীদের কারো-না-কারো ডিজিটাল ক্যামেরাতে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবে। ষাটসত্তুর বছর আগে, অর্থাৎ আমার শৈশব আর প্রথম যৌবনে নিজের হাতে ক্যামেরা থাকা দূরে থাক, স্বচক্ষে ক্যামেরা দেখতে পাওয়াটাও ছিল পরম ভাগ্যের বিষয়। ফলে আমার বা আমার প্রজন্মের আর সব মানুষের জীবন ছোটবেলায় কেমন ছিল তার কোনও প্রামানিক দলিল নেই, লিখিত বা ক্যামেরাবন্দী, কোনটাই না। আমাদের অতীতের খবর কারুরই জানার উপায় নেই---আমাদের অতীত হাজার কুৎসিৎ হলেও ক্ষতি নেই, কেউ জানবে না, নিজেরা ছাড়াআজকের প্রজন্মের বেলায় হয়েছে ঠিক তার বিপরীত---লুকোতে চাইলেও এখন কিছুই লুকোনো যাবে না। অজ্ঞাত অতীত বলে কিছু থাকবার জো নেই--- সবই কোন-না-কোন মাধ্যমে দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে, সেটা ইন্টারনেটেই হোক আর ব্যক্তিগত টুইটার আর ফেসবুকের মাধ্যমেই হোক। আজকের প্রজন্ম ডিজিটালের প্লাবনে ভেসে-যাওয়া কাষ্ঠখণ্ডের মত---ক্রমাগত ভেসেই চলেছে ভেসেই চলেছে। তাদের প্রতিদিনকার কর্মই নয় কেবল, তাদের ইচ্ছাগুলোও যেন ডিজিটাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা আধুনিক যুগের---পরিপূর্ণভাবে মুক্ত এরা প্রাচীন রীতিনীতির নাগপাশ থেকে, অথচ কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেদের সেই স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছায় সঁপে দিয়েছে যন্ত্রের কাছে। আগে যারা ছিল অভিভাবকার্পিত নিগড়বন্ধনে, এখন তারা জড়িয়ে পড়েছে ডিজিটাল যন্ত্রের অলক্ষ্য বন্ধনে। তাই ভাবি, বন্ধনই কি মানবচরিত্রের মৌলিক প্রকৃতি? অথচ মজার ব্যাপার, এযুগের যে-কোনও ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞেস করুনঃ বলত ‘ডিজিটাল’ বলতে কি বোঝায়? সামান্য একটু চিন্তাভাবনা যারা করে, অর্থাৎ যারা একটু কৌতূহল নিয়ে জানতে চেষ্টা করে বিজ্ঞাপনের বাইরে আরো কিছু আছে কিনা, তারা হয়ত ইনমিন করে আওড়াবেঃ ও হ্যাঁ শুনেছি ডিজিটাল এসেছে ডিজিট থেকে। মানে অঙ্কের ডিজিট---বিশেষ করে ০ আর ১ এর মালা গেঁথে যা তৈরি করা হয়। ব্যস, ঐ পর্যন্তই তাদের জ্ঞানের দৌড়অনেক আগে, যখন আধুনিক প্রযুক্তি প্রসূতিঘর থেকে নির্গতই হয়নি, তখনই আলবার্ট আইনস্টাইন একটা কথা বলেছিলেনঃ “I fear the day that technology will surpass the human interaction. The world will have a generation of idiots”. (“আমার ভয় সেই দিনটিকে যেদিন প্রযুক্তি মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে অতিক্রম করে চলে যাবেগোটা পৃথিবীটাই তখন ভরাট হয়ে যাবে একপাল গর্ধভ দ্বারা”।) প্রায় অনুরূপ সুরে গত শতাব্দীর আরেক মহাসুরী, বার্ট্রাণ্ড রাসেল বলেছিলেন একজায়গায়ঃ “Machines are worshipped because they are beautiful, and valued because they confer power; they are hated because are hideous, and loathed because they impose slavery”. (“যন্ত্রকে মানুষ পূজা করে তার রূপশোভার কারণেযন্ত্র মানুষকে ক্ষমতার স্বাদ দেয় বলে তাকে মূল্যবান বলে গণ্য করা হয়। অথচ তার প্রতি একরকম বিদ্বেষ ভাবাপন্নতাও পোষণ করে মানুষ তার কুটিলতার জন্যে--- যন্ত্র মানুষকে নতুন প্রকারের দাসত্বশৃংখলে আবদ্ধ করে ফেলে”।) আসলেই হয়ত তাই---প্রযুক্তি যেন নতুন যুগের সোনার শেকল। প্রচণ্ড একটা শক্তির স্বাদ নিশ্চয়ই ধারন করে এই অত্যাশ্চর্য বস্তুটি যার প্রভাবে ছেলেমেয়েরা টেক্সটিঙ্গের যাদুকরি ছলনাতে দিকবিদিক ভুলে গিয়ে রাস্তা পারাপার হয় যানবাহনের কথা না ভেবেই, বা কাপড়জামা পরা অবস্থাতেই পুকুরের জলে পড়ে যায় সামনে পেছনে তাকাতে না পারার ফলে। আইন্সটাইনের মত কড়া কথা বলার সাহস আমার নেই, এমনকি ‘ইডিয়ট’ শব্দটা আদৌ প্রযোজ্য কিনা সেবিষয়েও আমার সন্দেহ আছে। তবে বার্ট্রাণ্ড রাসেলের সঙ্গে সুর মেলানো যেতে পারে অনায়াসেই---মানুষ যেমন করে অভ্যাসের দাসত্ব গ্রহণ করে স্বেচ্ছায় এবং প্রায়শঃই সানন্দে, অনুরূপভাবে প্রযুক্তির বশ্যতাও আমরা অকাতরে গ্রহণ করে নিয়েছি। এযুগের নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তির কাছে নতজানু হবার আগে আরো কতগুলো বিষয়ের প্রতি নতি স্বীকার করে নিয়েছে---ম্যারিওয়ানা, কোকেন, ফ্রি সেক্স, পপ মিউজিক, আরো কত কি।
জোয়েল স্টাইনের লেখাতে এসবের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত। সাথে সাথে অনেক বিজ্ঞানসম্মত জরিপের  ফলাফলও---ভদ্রলোক কাঁচা কাজ করেননি। আমাদের যুগে, সেই মান্ধাতার যুগে, আমরা স্বপ্ন দেখতাম, একদিন হয়ত মানুষ টেলিফোনের মাধ্যমে দূরের মানুষের সঙ্গে শুধু কথাই বলতে পারবে না, পরস্পরের চেহারাও দেখতে পারবে। সেটা ছিল সেযুগের কল্পনা, ইচ্ছার ফানুশ, বিজ্ঞানের রূপকথা। আমার জীবনকালে সেটা বাস্তবে পরিণত হবে সেটা ভাবতেও সাহস পেতাম না। অথচ ঠিক তা’ই হয়ে গেছে। আজকে ছেলেমেয়েরা যখন তখন যেখানে সেখানে কারণে অকারণে তাদের আইফোন আর স্মার্টফোন ব্যবহার করে যাকে খুশি তাকে ডাকছে, পৃথিবীর  এক কোনা থেকে আরেক কোনায়---পরস্পরের মুখ দেখছে, কথা বলছে, হাসছে, গাইছে, প্রেম নিবেদনও করছে বা। এ এক আশ্চর্য খেলা---এদের জীবন এক অবারিত প্রেমকুঞ্জন, আদি অন্তহীন এক লীলাক্ষেত্র।
পুরনো প্রজন্মের দৃষ্টিতে এরা এক হতচ্ছাড়া নষ্ট প্রজাতি। অলস, অকর্মণ্য, অপদার্থ, আত্মকেন্দ্রিক, নিজেদের তাৎক্ষণিক সুখটুকু ছাড়া সংসারে আর কোনকিছুর প্রতিই তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তারা পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত বাপের হোটেলে খায়, থাকে, ঘুমায়, অথচ দিনরাত চব্বিশ ঘন্টায় একবারও বাবামায়ের মুখদর্শন করে কিনা সন্দেহ। তাদের জগতে একমাত্র একটি মানুষই মূল্যবান---সে নিজে---আর কারো অস্তিত্ব আছে কি নেই তাতে তার কিছু আসে যায় না। এরা শিশুকাল থেকেই শুনে আসছে  যে তারা অন্য কারো সন্তানের মত নয়, তারা স্পেশাল, অন্তহীন সম্ভাবনা নিয়ে জন্মেছে তারা, মেধায় বুদ্ধিতে তাদের জুড়ি নেই কোথাও।
অতি অল্প বয়স থেকে তারা স্কুলে যেতে শুরু করে ঠিকই, কিন্তু শেখে কতখানি সেটাই প্রশ্ন। তার চেয়ে শতগুণে বেশি শোনে প্রশংসা, শোনে হাততালিঃ সাবাশ সাবাশ, বেশ করেছ বেশ করেছ। মনস্তত্ববিজ্ঞানের বড় বড় পণ্ডিতরা বলে দিয়েছেন, বাচ্চাদের যেন কস্মিনকালেও সমালোচনা না করা হয়, সবসময় প্রশংসা করে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। পণ্ডিতরা অবশ্য বলে দেননি, সম্ভবত তাঁরা নিজেরাই স্পষ্ট জানেন না বলে, যে এই ‘আত্মবিশ্বাস’টি বৃদ্ধি পেতে পেতে একসনয় আত্মশ্লাঘাতেও পরিণত হতে পারে, যা কারো জন্যই হিতকর নয়, বিশেষ করে তার নিজের জন্য। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা ঠিক সে অবস্থাটাই দাঁড়িয়েছে বর্তমান যুগে।
আগেকার দিনে, অর্থাৎ আমার বাল্যকালের সেই প্রায়-প্রাগৈতিহাসিক যুগে, ‘গ্র্যাজুয়েশন’ কাকে বলে তার কোনও ধারণাই ছিল না আমার ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার আগ পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ডিগ্রি অর্জন করেও কোন গ্র্যাজুয়েশন দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার দেশের রাজনৈতিক গণ্ডগোলের জন্যে। আজকে আমার নাতিদের গ্র্যাজুয়েশন শুরু হয়েছে কিণ্ডারগার্টেন থেকে। না, ওদের কিণ্ডারগার্টেন আর পাঠশালার গ্র্যাজুয়েশনে হাজিরা দেবার ডাক পড়েনি আমার, কিন্তু জুনিয়ার হাই আর হাই স্কুলের গ্র্যাজুয়েশন কিছুতেই এড়ানো গেল না। পিতামহ হিসেবে ওদের এই বিপুল শুভক্ষণটিতে আমাকে যেতেই হল। প্রথমে নাতনির জুনিয়ার থেকে হাইতে ওঠার অনুষ্ঠান, পরে নাতির হাই স্কুল পাস করে ইউনিভার্সিটিতে যাবার ছাড়পত্র উৎসব। না গিয়ে উপায় ছিল না। পারিবারিক সম্মানের ব্যাপার। জুন-জুলাইতে আমি প্রায় কখনোই ক্যালিফোর্নিয়াতে যাই না, কড়া সূর্য সারাক্ষণ মাথার ওপর। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন হল জুনের তৃতীয় সপ্তাহে---আমার জন্যে তো তারা উৎসব স্থগিত রাখতে পারে নাসুতরাং পৌত্রপৌত্রীর গ্র্যাজুয়েশন উপলক্ষে এবার ক্যালিফোর্নিয়ার প্রবল প্রখর রৌদ্রের তাপে আমার কেশমুক্ত করোটিখানিকে প্রায় তেলেভাজা মত করে ফিরে এলাম অটোয়াতে। বাচ্চাদের গ্র্যাজুয়েশন মানে  বড়দের সানবার্ণমানে উত্তর আমেরিকায়।
নাতির গ্র্যাজুয়েশনে একটা মজার জিনিস দেখলাম। মাঝারি আকারের একটা স্কুল ওদের। সেখান থেকে পাস করেছে প্রায় পাঁচশ ছাত্রছাত্রী। মনে মনে তুলনা করলাম আমার সময়টির সঙ্গে---যখন আমাদের গরিব স্কুল থেকে মোট ২৫ জন ছাত্র ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ঢুকেছিল। এমনকি আমার বড় ছেলে বাবু, স্কুল পাস করেছিল ১,৯৮৩ সালে, তখন তার সতীর্থদের সংখ্যা ছিল, যতদূর মনে পড়ে, ৭৫ কি ৮৫। এবং সেসময় সমস্ত স্কুল থেকে একটিমাত্র ছাত্র বা ছাত্রী নির্বাচিত হত ‘ভ্যালেডিক্টরিয়ান’ হিসেবে, গোটা স্কুলজীবনে অসামান্য কৃতিত্ব আর নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেবার জন্যে--- মাত্র একজন, ছাত্রসংখ্যা যতই হোক। আজ তার নিজের ছেলের গ্র্যাজুয়েশনে দেখা গেল, একজন নয়, দুজন নয়, মোট ২৫ জন ভ্যালেডিক্টরিয়ান! একেই কি বলে ‘একজনের মন রক্ষা করতে গিয়ে আর দশজনের মন খারাপ করা যাবে না’ জাতীয় মনস্তাত্বিক নীতি? নাকি স্রেফ ইনফ্লেশন, আমেরিকার শেয়ার মার্কেটেরই মত? জানিনা। আসলে বর্তমান যুগের কি’ই বা জানি আমি?
এবার ছেলের বাড়িতে মাত্র দু’সপ্তাহ ছিলাম। ওদের আদরযত্নের অভাব ছিল না, কেবল আমারই মন টিকছিল না। ওই সময়টুকুই মনে হচ্ছিল যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। একেতো তাতানো রোদ, তার ওপর যাদের জন্য যাওয়া তাদেরই দেখা নেই। গ্র্যাজুয়েশন উপলক্ষে নাতির যে কতগুলো পার্টি হয়ে গেল তার হিসেব রাখার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলাম। লাভ নেই। একরাত পার্টি করার পর ভাবলাম পরের রাতটা নিশ্চয়ই বাসায় থাকবে। না, কোথায়, টিনেজদের কি ওসব মেনে চলার বালাই আছে। গ্র্যাজুয়েশন মানে একরকম রাজ্য জয় করে ফেলা---হোক না সেটা স্কুল থেকে কলেজে ওঠার রাজ্যদুই সপ্তাহের ভেতর নাতির মুখদর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল সর্বকূল্যে তিন কি চারবার। নাতনি অবশ্য সেবয়সে পৌঁছায়নি এখনো---আরো বছর তিনেক অপেক্ষা করতে হবে। মেয়েটা আগে আমার সঙ্গে খুব গল্প করতে চাইত---দেশবিদেশের গল্প, প্রাচীন সভ্যতার গল্প। অনেক প্রশ্ন করত, এমনকি তার নিজের মতামত প্রকাশ করতেও দ্বিধা করত না। দারুণ আনন্দ পেতামতারপর সে এগারো পার হয়ে উঠে গেল বারোতে। কৈশোরের প্রথম কুড়িগুলো ক্রমশ ফুটতে শুরু করেছে। বড়কথা, হাতের কাছে এসে গেছে ফেসবুক, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন। এখন আর দাদুর কাছ থেকে দেশবিদেশের গল্প শোনার প্রয়োজন নেই তার---যা শোনার ইন্টারনেট থেকেই শুনতে পারে। যা শেখার সব ফেসবুকের নতুন-পাওয়া বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শিখতে পারে। ভদ্রতা করে সে এখনো মাঝে মাঝে আমাকে সংগ দেয়, কিন্তু আমি বুঝতে পারি যে তার মন পড়ে আছে ইন্টারনেটে, কান পড়ে আছে ফোনের ভাইব্রেশনের প্রতি---হয়ত কোনও ‘জরুরি’ টেক্সট মেসেজ, যা তৎক্ষণাৎ জবাবের দাবি রাখে, বৃদ্ধ দাদুর সঙ্গে ইনিয়ে মিনিয়ে কথা বলার চেয়ে হাজার গুণ জরুরি। ও হয়ত গড়ে ৮৮ টি টেক্সট মেসেজ পাঠায় না এখনো (স্টাইনের জরিপ অনুযায়ী), তবে ষোল-সতেরোতে পৌঁছুলে, কে জানে, হয়ত প্রয়োজন দাঁড়িয়েও যেতে পারে। ওদের জীবন বড়ই ব্যস্ত জীবন---দিনরাত তারা সাইবার স্পেসের মহাশূন্যতার তরঙ্গায়িত পরিমণ্ডলে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। আজকাল তারা গাড়ি চালাত চালাতে টেক্সটিং করে, পাশে-বসে-থাকা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার চেয়ে বরং টেক্সটিঙ্গে যোগাযোগ করতে ভালবাসে, বাবামায়ের সঙ্গে না হলেও ভাইবোনদের সঙ্গে তো অবশ্যই। এবং সেই টেক্সটের ভাষা কেবল তারা ছাড়া আর কারুর বোঝার সাধ্য নেই---অন্তত আমার যে নেই সেটা জানি। এদের ইংরেজি বানান দেখলে কাঁদব না হাসব ভাবতে হয়। আগেকার দিনে টেলিগ্রাফ যন্ত্রের একটা সাংকেতিক ভাষা ছিল---যাকে বলে মর্স কোড, পুরোপুরি গণিতের ফর্মুলা অনুযায়ী। কিন্তু ওদের ভাষা সাংকেতিক নয়, সংক্ষেপকৃত। আমাদের যুগে,(এমনকি বর্তমান যুগের স্কুলকলেজেও) ইংরেজির “আমি”কে লেখা হত বড় অক্ষরের “আই” দিয়ে। সেটাকে তারা i তে পরিণত করেছে। ইংরেজির “wait” হয়ে গেছে 8, “you” হয়েছে u. মজার ব্যাপার হল শুধু টিনেজরা নয়, বেশ কিছু পরিণতবয়স্ক বাঙ্গালিকেও ঠিক একইরকম বানান করতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ বৃক্ষের ব্যাধিটি আগা থেকে শুরু করে এখন গোড়ার দিকে ধাবমান। কেবল টেক্সটিঙ্গে নয়, সাধারণ চিঠিপত্র বা ইমেইলেও ঠিক তা’ই চালু হয়ে যাচ্ছে। ভাষার কৌলিন্যের ওপর তাদের কতখানি শ্রদ্ধাবোধ সেটা ভাববার বিষয়।
স্মার্টফোন আর আইফোনের সাথে পরম উৎসাহে যোগ দিয়েছে আধুনিক গণমাধ্যমের আরো কতগুলো অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার---যথা ফেসবুক, টুইটার, আইপ্যাড, ইত্যাদি। এগুলোর মধ্য দিয়ে তারা অনাস্বাদিত ‘সেলেব্রিটি’র স্বাদ পাচ্ছে। পৃথিবীর যাবতীয় ফেসবুকবন্ধুর কাছে প্রতিটি যুবক-যুবতী, পরিণত-অপরিণত সর্বপ্রকার মানবসন্তান, রাতারাতি ইংরেজি ভাষার খোদ সেক্সপিয়ারে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। কয়েকছত্র পদ্য রচনা করে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়ামাত্র স্তাবকদের চোখে তিনি হয়ে যান ভবিষ্যতের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কেউ কেউ শুনেছি প্রেমিকার সাথে রতিসুখ উপভোগ করার দৃশ্য ডিজিটালের পর্দায় অমর করে রাখার চেষ্টা করেন---সেটা ব্যবহার করে দুচারজনকে সফলভাবে ব্ল্যাকমেল করার কথাও শোনা যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি আসলেই এক অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার---যার বদৌলতে আধুনিক যুগের কোনকিছুই, শয়নকক্ষও যার ব্যতিক্রম নয়, গোপন থাকতে পারছে না।
টাইম পত্রিকার জোয়েল স্টাইন বলছেনঃ এই মিলেনিয়েল প্রজন্মটির ধারণা পৃথিবীর এমন কোনও ভোগ্যবস্তু নেই যা তাদের প্রাপ্য নয়। একটা সর্বজনীন অধিকারবোধ জন্ম নিয়েছে তাদের মনে। ‘সবই আমার, এবং একমাত্র আমারই’---এমন একটা অসুস্থ মানসিকতার শিকার তারা। তারা হল এযুগের উৎকট ‘নার্সিসাস’ রোগী। নিজেকে নিয়ে তারা এতই মশগুল যে পৃথিবীতে অন্যকিছুর অস্তিত্বই যেন একটা মহা রহস্য তাদের কাছে।
প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, এই যে অদ্ভুত একটা মানসিকতা সৃষ্টি হয়ে গেল পুরো একটা প্রজন্মের ভেতর এর পেছনে সমাজবিজ্ঞানের কোন্‌ উপাদানগুলো কাজ করেছে। কোত্থেকে উৎপ্তত্তি হল এরা? সহজ উত্তর হল, এবং আমার মতে সঠিক উত্তর, এদের আগের প্রজন্মটি। এবং এই আগের প্রজন্মটির আচার-আচরণের উৎস তারও আগের প্রজন্ম। আমরা যেন ভুলে না যাই যে আজকের নতুন প্রজন্মটি আমাদেরই ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি। তারা আমেদেরই স্বপ্নের ফসল। তাদের জীবনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব তো আমাদের ওপরই ছিল। আমেরিকার মিলেনিয়ামদের বাবামায়েরা---১৯৬১-১৯৮০ সময়টিতে যাদের জন্ম, তারাও কি কম আত্মাভিমানে ভুগতেন? মোটেও না। তারা হয়ত ‘আমি, আমি, আমি’ জেনারেশন ছিলেন না, কিন্তু ‘আমি’ নামক বিশেষ বিশেষণটি তো তাদের কারণেই উদ্ভাবন করা হয়েছিল। তারা ছিলেন ‘আমি প্রথম’, ‘ময়লা ফেলতে হয় যেখানে ইচ্ছে সেখানে ফেলো, আমার ব্যাকইয়ার্ডে নয়’, মনোধারাতে আক্রান্ত প্রজন্ম। তারাই বোধ হয় আমেরিকার প্রথম প্রজন্ম যারা ভুলতে শুরু করলেন যে অনেকগুলো ‘আমি’তে মিলে বড় একটা ‘আমরা’ গড়ে ওঠে, এবং অনেকগুলো ‘আমরা’ একটা নির্দিষ্ট পথে চলতে শুরু করার পরই তৈরি হয় একটা জাতি---একটা সভ্যতা। তাদের সেসব ভাবার দরকার ছিল না, কারণ তারা জীবনে কখনোই দেখবার সুযোগ পাননি অভাব কাকে বলে, অনাহার অর্ধাহার কাকে বলে, চিকিৎসার অভাবে অকালমৃত্যু কাকে বলে। তারা কখনো বড় যুদ্ধ দেখেনি, বড় মণ্বন্তর দেখেনি, বড় মহামারি দেখেনি, এমনকি বড়রকমের অর্থনৈতিক ধ্বসও দেখেনি। তাদের আগের প্রজন্মটি, অর্থাৎ ১৯৪৩-১৯৬০ এর ভেতর যাদের জন্ম তাদের বলা হয় ‘বেবি বুমার্স’ (বাড়ন্তশিশু প্রজন্ম)---দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধক্লান্ত জোয়ানরা বাড়ি এসে সন্তান উৎপাদনের কাজে মগ্ন হয়ে যান, সেই মহাযজ্ঞেরই অনিবার্য ফসল তারা। তারা ওই অভাবঅনটন-দুঃখদুর্দশা-যুদ্ধবিগ্রহ সবই দেখেছিলেন, তাই তারা পণ করেছিলেন তাদের সন্তানদের যেন কিছুতেই সেসব কষ্ট সহ্য করতে না হয়। তারাই তাদের স্বপ্ন দিয়ে, মনোবল দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে, স্থাপন করেন আজকের অতিপরিচিত  জনকল্যান প্রতিষ্ঠানগুলো---সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা, অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও মানসম্মান বজায় রেখে জীবনযাপনের স্বাধীনতা, সমাজে যারা অক্ষম পঙ্গু অসহায় তাদের জন্য বিশেষ ত্রাণব্যবস্থাসহ তাদের পুনর্বাসনের বিবিধ সামাজিক পরিকল্পনা, এ সবই তারা রেখে যান তাদের পরবর্তী প্রজন্মটির জন্যে। আমাদের আজকের এই যে পরম সুখস্বাছন্দ্য আর নিরাপত্তার আবহাওয়া পশ্চিম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশজুড়ে, তার মূলে তো ওই প্রজন্মটিরই একটা সুস্থ সুন্দর, অগ্রমুখি সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন আর সাধনা  দিয়ে তৈরি। তারা নিজেরা খুব বিত্তবান হয়ত ছিলেন না, কিন্তু তাদের চিত্তশক্তি ছিল দুর্জয়। সমস্যা এই যে, এক প্রজন্ম তাদের ত্যাগ আর চিত্তশক্তি দ্বারা অর্জিত দ্রব্যের যাকিছু রেখে যায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, ভোক্তা প্রজন্মটি সেই উত্তরাধিকার দ্বারা বিত্তবান হয়ে ওঠার ফলেই হয়ত হারিয়ে ফেলে ওই ত্যাগের চেতনাটিবেবি বুমার্স’দের বেলাতে হয়ত তার সবটা না হলেও কিছুটা ঘটেছিলএকেই বোধ হয় বলা হয়ঃ ভালো করতে গিয়ে মন্দ ফল পাওয়ামানবচরিত্রের এ দিকটা নিয়ে আমার নিজের একটা ছোট মন্তব্য আছেঃ কৈশোর আর প্রথম যৌবনে একটু অভাব অনটনের অভিজ্ঞতা থাকা ভালো---এতে কারো কোনও স্থায়ী ক্ষতি হয় না স্থায়ী ক্ষতি প্রায় অবধারিতভাবেই ঘটে অঢেল প্রাচুর্যের পরিবেশেপ্রাচুর্য প্রায় কখনোই চরিত্রগঠনের জন্য বড়রকমের সহায়তা দান করে বলে আমার আমার মনে হয় না। ছোটবেলায় একাধটু কষ্টের অভিজ্ঞতা থাকলে স্বপ্ন আর উচ্চাকাংখাগুলো সহজেই বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। পক্ষান্তরে যাদের কোন অভাবই নেই তাদের আবার স্বপ্ন দেখার কি আছে? আমরা যেন  ভুলে না যাই যে পশ্চিম বিশ্বের এই যে ব্যাপক ড্রাগ সমস্যা, মাদকসমস্যা, যদৃচ্ছ যৌনাচার,  এগুলোর সূচনা কিন্তু আজকের নয়, সেই ‘বেবি বুমার্স’রাই এগুলোর জনক। মজার ব্যাপার যে আমাদের তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি আর বিশ্বায়নের ফলপ্রসূতে উৎপন্ন উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজটিতেও এখন এই ‘পাশ্চাত্য’ ড্রাগাসক্তি, মাদকদ্রব্য আর অবাধ যৌনতার ব্যাধিটি বেশ জোরেসোরেই ছড়িয়ে পড়েছে বলে শুনতে পাচ্ছি। এটাই স্বাভাবিক---চিরকাল তাই হয়েছে, ভবিষ্যতেও ঠিক তাই হবে তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। দুঃখের বিষয় হলঃ পশ্চিমে এগুলো পুরো সমাজটাকে রুগ্ন করে তুলতে পারেনি (করলে এরা অনেক আগেই ক্ষয় হয়ে যেত, এবং আমরা নিজের দেশ ছেড়ে এখানে এসে বাসা বাঁধার কথা কল্পনা করতাম কিনা সন্দেহ), কিন্তু আমরা ঠিক একই দাবি করতে পারব বলে আমার মনে হয়না। আমরা ক্ষয় হচ্ছি, প্রতিদিনই আমাদের জাতীয় জীবনে রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নের দেশ বানাবো বলে শুরু করেছিলাম সেটা হয়ে গেল তাসের ঘর যা একটু বাতাস বইলেই ধসে পড়ার উপক্রম হয়।
নতুন প্রজন্মের অতিরিক্ত প্রযুক্তিপ্রীতির ওপর দোষ চাপানোর আগে আরো একটা জিনিস আমাদের ভাবা দরকারঃ এর জন্য মূল দায়ী কারা? ওরা তো কাউকে বলেনি ঘন ঘন নতুন যন্ত্র নিয়ে আসার জন্য বাজারে। ওরা তো আপেলের স্টিভ সাহেবের হাতেপায়ে ধরে মিনতি করেনি প্রতি বছর তাদের হাতে একটা নতুন আইফোন তুলে দিতে---তিনি এবং তাঁর মত পৃথিবীর আরো সহস্র ধনকুবেররা নিজেদের স্বার্থে বা তাদের তথাকথিত ‘ইনিভেস্টার’দের স্বার্থেই নতুন জিনিস নিয়ে এসেছিলেন তাদের মুনাফার পাহাড়গুলোকে আরো উর্ধমুখি করার তাগিদেবাজারে নতুন খেলনা এলে যেমন ছেলেমেয়েরা সেগুলো কেনার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে, ঠিক একইভাবে আজকের তরুণরাও প্রযুক্তির খেলনাগুলো বাজারে আসামাত্র হাতে পাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠছে। আমি বলতে চাচ্ছি যে আজকের প্রজন্মের এই যে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তার গোড়ার কারণ ওরা নয়, ওদের হাতে খেলনা তুলে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহনকারী প্রাপ্তবয়স্ক লোভী প্রজন্মটি---অর্থাৎ আমরা এবং আমাদের পরবর্তী এই ‘বেবি বুমার্স’ প্রজন্মটি।
এতক্ষণ ধরে একপেশে কথা বলার পর, এবার আমার আসল কথাতে আসি। নতুন প্রজন্মের যত খুঁতই থাক, যত আপাতনষ্ট জীবনই যাপন করুক তারা, আমার মতে, গত পঞ্চাশ বছরের মাঝে আমার নিজের চোখে দেখা সব প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম তারাইঅবাক হচ্ছেন বুঝি? হোন, আপনার অবাক হওয়াতে আমি কিন্তু মোটেও অবাক হচ্ছি না।
আমার যুক্তিগুলো বলি এবার।
বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা আগের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ---পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে কোনদিন কোন মুহূর্তে তার খবর তারা যতটা জানে তার একাংশও আমাদের প্রজন্মের জানা ছিল না। আমাদের হয়ত কৌতূহল ছিল কিছুটা বেশি, জানার আগ্রহও অধিকতর, কিন্তু সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। আজকে তাদের সুযোগের অপেক্ষা করতে হয়না, সুযোগ প্রতিমুহূর্তেই দর্শন দেয় তাদের কাছে নানাপ্রকারের যান্ত্রিক উপকরণের মাধ্যমে। তারা হয়ত আমাদের মত বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে না (সময় কোথায় ওদের!), প্রধানত বইপত্রের অভাবটুকু তাদের যান্ত্রিক বন্ধুরাই বহুলাংশে পূরণ করে দেয় বলে। মোট কথাঃ এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সাধারণ জ্ঞান আমাদের যুগের ছেলেমেয়েদের চাইতে শতগুণে বেশি
বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তিজাত ব্যাপক যোগাযোগ ব্যবস্থা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দিয়েছে নতুন প্রজন্মের ভেতরঃ তারা আমাদের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সংস্কারমুক্ত। আগেকার দিনের সব আজেবাজে ভূতপ্রেতের গল্প শুনিয়ে ওদের ভয় দেখানো যাবে না। আজগুবি ঘটনা, অলৌকিকতা, কুমারির পেটে সন্তান, সাত আসমানের ওপরে সশরীরে গমন ও প্রত্যাবর্তন, পাহাড়ের গায়ে স্বয়ং প্রভুর সাক্ষাৎ, এসব বানোয়াট গল্পও ওরা শুনতে রাজি নয় আমরা যেমন মোল্লা-পাদ্রীদের মুখে শুনে এসেছি দুধের দাঁত পড়ার বয়স থেকেপ্রকৃতির বিবিধ ঘটনাসমূহের কার্যকারণ সম্পর্ক বিষয়ে এযুগের ছেলেমেয়েরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন---সংসারের সব ঘটনার পেছনেই একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, এটা ওদের কাছে যত পরিষ্কার আমাদের প্রজন্মের অনেক প্রাপ্তবয়স্কের কাছেও তত পরিষ্কার নয়। এর প্রধান কারণ, আমার মনে হয়, ওই বিশ্বায়িত তথ্যসরবরাহ---অহরহই তো সংবাদ আদানপ্রদান হচ্ছে বিশ্বের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত। আগে যেমন আমরা দুয়ে দুয়ে মেলাতে পারতাম না, এযুগের ছেলেমেয়েরা সেটা চোখের পলকে মেলাতে পারছে। এরা অনেক, অনেক মুক্ত মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন ভাইসপ্রেসিডেন্ট, এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, আল গোর, ভীষণ পরিবেশ-সচেতন মানুষ। তিনি একটা প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেছিলেনঃ “Inconvenient Truth” (অসুবিধাজনক সত্য), যাতে বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ কি অবিশ্বাস্য গতিতে এগুচ্ছে তার একটা ভয়াবহ দৃশ্য তুলে ধরেছিলেন। টেলিভিশনের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক প্রোগ্রামে অহরহই দেখা যাচ্ছে তুন্দ্রা অঞ্চলের প্রকাণ্ড সব বরফের পাহাড় কিভাবে গলে গলে সমুদ্রের দিকে ছুটে চলেছে। প্রতি সপ্তাহে টেলিভিশনের আরো অনেক প্রোগ্রামে বায়ুদূষণের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি আমরা। পরিবেশবিজ্ঞানীরা তো বহুকাল আগে থেকেই সাবধানবাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতে কি কারো টনক নড়ছে? কর্ণপাত করছে কেউ? দায়সারাভাবে করছেন কেউ কেউ, কিন্তু কোনও অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করছেন সবাই। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নির্বাচিত সদস্য তো মানতেই রাজি নন যে ‘ উষ্ণায়ন’, ‘বায়ুদূষণ’ এগুলো আসলেই কোন বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত সত্য।  তাদের ধারণা এগুলোর কোনও ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রমাণ নেই---উদ্দেশ্যপ্রনোদিত পরিবেশবাদীদের মিথ্যা প্রচারণা মাত্র। সাধারণ মানুষদের মনোভাব অনেকটা ‘হ্যাঁ হলে হতেও পারে, কিন্তু তাতে আমার কি করার আছে’-জাতীয় দায়িত্ব-এড়ানো ভঙ্গি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, উচ্চমানের বাড়িগাড়িতে যারা মোটামুটি অভ্যস্ত তারা যেন আরো উদাসীন এব্যাপারে। তাদের বাড়িতে হয়ত চব্বিশঘন্টা টেলিভিশন চলছে---সব খবরাখবরই পাচ্ছেন তারা। কিন্তু তারা কি আগের চেয়ে কম জ্বালানিশক্তি ব্যবহার করছেন? কম শীতাতপনিয়ন্ত্রন যন্ত্রাদি? কম গাড়ি চালাচ্ছেন? কম বৈদ্যুতিক শক্তি? অন্তত আমি করছিনা জানি। আপনি?
কেবল বর্তমান প্রজন্মটিই এগুলো কেবল মুখে মুখে উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনেও প্রতিফলিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এযুগের ছেলেমেয়েদের অনেকেই পারতপক্ষে গাড়ি করে বাইরে যায় না, সাইকেলে করে যায়, বা পায়ে হেঁটে। তারা বাড়িতে অনর্থক বাতি জ্বালিয়ে রাখে না, জ্বাললেও কম পাওয়ারের বাল্ব ব্যবহার করে। এরা সত্যিকার অর্থেই ‘গ্রীন’ তত্বে বিশ্বাসী। কিছুদিন আগে টেলিভিশনে দেখছিলাম, গুটিকয় টিনেজ মেয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে একসাথে ভ্রমণে বেরুবার। কোথায় যাচ্ছে? মেক্সিকো? (যেখানে সবাই যায়?) জামাইকা? কস্টা রিকা? না, এগুলোর কোনটাই নয়। এরা যাচ্ছে তুন্দ্রায়। স্বচক্ষে দেখতে চায় তুন্দ্রার বিশাল বরফের পাহাড়গুলোর তরল হয়ে যাবার অভসাবনীয় দৃশ্য। দেখতে চায় দ্রুত উষ্ণায়ন দ্বারা কি অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছি আমরা বিশ্বপরিবেশের। যার অস্তিত্ব আমাদের বিজ্ঞ নেতারা আরামকেদারায় বসে ঘাড় নেড়ে অস্বীকার করে যাচ্ছেন সাময়িক রাজনৈতিক ফায়দার জন্য, তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ তারা তুলে নিয়ে আসতে চায় তাদের ডিজিটাল ক্যামেরাতে। একেই আমি বলি কমিটমেন্ট। শপথ---বিবেকের কাছে, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, দৃঢ়মনস্ক শপথ। এ বয়সের মেয়েরা ২৫/৩০ বছর আগে ডিস্কোতে গিয়ে হয়ত সারারাত কোমর দুলিয়ে নাচত। এযুগেও যে নাচেনা তা নয়, কিন্তু কেউ কেউ আবার ডিস্কোর পরিবর্তে তুন্দ্রাতে যাবে বরফগলার দৃশ্য দেখতে, বা নিরক্ষীয় অঞ্চলের অবিশ্বাস্যরকম দ্রুত নির্বৃক্ষায়নের দৃশ্য দেখতে
এ-প্রজন্মের যে জিনিসটা সবচেয়ে আনন্দ দেয় আমাকে তা হল ওরা মানুষকে কিভাবে দেখে। আমরা, পুরনোরা, মানুষকে ঠিক মানুষ হিসেবে দেখি না, দেখি কে হিন্দু কে মুসলমান, কে খৃস্টান কে বৌদ্ধ, কে শ্বেতকায় কে কৃষ্ণকায়, এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তারতম্যকেও আমরা বিরাট করে দেখতে অভ্যস্ত। এবং এই ভেদাভেদের সংস্কৃতিকেই আমরা বলি বংশমর্যাদা, মানসম্মান---কালচার। আজকের প্রযুক্তি প্রজন্ম ওসবের ধার ধারে না সচরাচর। ওরা নিজেদের আইফোন, টুইটার আর টেক্সটিং নিয়েই ব্যস্ত। বৈষম্যের কালচারে তারা অনাগ্রহী। লোকটা ইন্টারেস্টিং হলেই হল, তার গায়ের রং, বা কোন পরিবারে তার জন্ম, কি তার ধর্ম, কি তার জ্ঞাতিগোত্র তাতে কি আসে যায়।
আসলেও, তাতে কি আসে যায়।
এদের এই আলোকিত, আধুনিক, ও প্রগতিশীল মনোভাব আমাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করে, আশান্বিত করে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। মানবজাতির ক্রমোন্নয়নের স্বপ্নকে আর সুদূরপরাহত বলে মনে হয়না। এদের কল্যানে আজকে মানুষ নামক প্রাণীটির অস্তিত্ব খুব বিপন্ন দেখায় না।
পৃথিবীজোড়া একটা আধুনিক শব্দ অহরহ উচ্চারিত হচ্ছে---মানবাধিকার। না, শব্দটি নতুন নয়, নতুন তার ভেতরের বাণীটুকু। সব মানুষেরই একটা নিজস্ব অধিকার আছে! রাজসিংহাসনে বসা রাজাধিরাজ থেকে শুরু করে রাস্তার ঝাড়ুদার, মুদিওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, মেথর কুলি, সবারই সমান অধিকার---আধুনিক যুগের এটিই বোধ হয় সবচেয়ে যুগান্তকারি আইডিয়া। অবশ্য ‘গণতন্ত্র’ শব্দটাতে যে এই সার্বিক অধিকারের বিষয়টি এঁটে নেই তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ দেশে ‘গণতন্ত্র’ বলতে বোঝায় ভোটাধিকার। এটা নিশ্চয়ই কাউকে বুঝিয়ে দিতে হবে না যে ‘ভোটাধিকার’ আর ‘মানবাধিকার’, দুটি এক জিনিস নয়। বিরাট ফারাক তাদের। মধ্যপ্রাচ্যের গুটিকয় দেশ বাদে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন ‘ভোটাধিকার’ ভিত্তিক গণতন্ত্র মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে---এটা যে একপ্রকার অগ্রগতি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিকার মানবাধিকার যদ্দিন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না ততদিন সত্যিকার অর্থে আমরা আধুনিক হওয়া দূরে থাক, সভ্যতার মাপকাঠিতেও পশ্চিম বিশ্বের অনেক জাতি থেকেই পিছিয়ে থাকছি। পশ্চিমে যে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা নয়, কিন্তু একটা সচেতন প্রচেষ্টা সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরেই বিদ্যমান সেটা যেন কেউ অস্বীকার না করেন। আমার বক্তব্য অবশ্য সেটা নয়, বক্তব্য আমাদের নতুন প্রজন্ম। আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যানেই হোক আর তাদের নিজেদের অন্তর্দৃষ্টির কারণেই হোক, আজকের ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই ছোটবড় সকল মানুষকেই সমান সম্মান দিতে সক্ষম---তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রম কেন হবে সেটা তাদের কাছে বোধগম্য নয়।
এযুগের ছেলেমেয়েরা আমাদের চাইতে অনেক বেশি বিজ্ঞানমনস্ক। তারা প্রকৃতির বিভিন্ন রূপকে প্রাকৃতিক বৈচিত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মেনে নিতে প্রস্তুত। তাই বর্তমান যুগের কতগুলো বিষয়, যা আমাদের পুরনো প্রজন্মের কাছে দারুণ অস্বস্তিকর, যেমন সমকামিতা, বহুকামিতা, বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ, গর্ভপাত---এগুলো ওদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অতি সহজেই তারা এগুলো মেনে নিতে পারে, যা আমরা পারি না। কিম্বা বিয়ে ছাড়াই একসঙ্গে বসবাস করা, ভিন্ন ধর্ম বা ভিন্ন বর্ণের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক, এগুলোও তাদের কাছে একরকম ডালভাতই বলা যায়। মোট কথা, আমাদের জগতটি যেমন কাটাতারের বেড়া দিয়ে আবদ্ধ ছিল চারিদিক, এদের জগতে বলতে গেলে কোনও বেড়াই নাই।
কেবল মানবাধিকারই নয়, জীবজগতের তথাকথিত ‘অবলা’ প্রাণীদেরও যে একটা অধিকার থাকা প্রয়োজন সেটা আমরা হয়ত মুখে বলেই শেষ, কিন্তু ওদের কাছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যেত, বাড়িতে মেহমান এলে কেমন সোরগুল পড়ে যেত সারাবাড়ি।  কিভাবে তাদের আদর-আপ্যায়ন করা যায়। এই রে,একটা খাশি জবাই কর, গোটাদুই মুরগি জবাই কর, বা বাজার থেকে সেরপাঁচেক বাছুর গরুর মাংস নিয়ে আয়---সারাবাড়ি গরম। এযুগের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে সেধরণের মাংসাশী রব উঠবে কিনা সন্দেহ। তারা বিনা কারণে, বাড়িতে অতিথি এসেছে বলে, অনর্থক কতগুলো অসহায় প্রাণীকে হত্যা করে ভোজোৎসব করতে মোটেও আগ্রহী হবে না। প্রাণীদেরও মৃত্যুকষ্ট আছে সেটা হয়ত আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কিন্তু ওরা জীবজগতের অনেক তথ্যই জানে, যা আমরা জানিনা, বা জানলেও গ্রাহ্য করিনা। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মেই তাত্বিকভাবে একটা সুন্দর কথা লেখা আছে শাস্ত্রেঃ ‘জীবে দয়া’। তাত্বিকই শুধু, বাস্তবে তার বিপরীত। প্রতিদিন কত লক্ষ জীব হত্যা করা হয় সে হিসাব কেউ রাখার প্রয়োজন মনে করে না, কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেকেই রাখে সে খবর হয়ত তারা শাস্ত্রের ধার ধারে না তেমন, কিন্তু ‘জীবে দয়া’ বিষয়টি ওদের শাস্ত্রে না থাকলেও অন্তরে আছে।
এরকমই একটা আদর্শ পৃথিবীর ছবি কল্পনায় রচনা করেছিলেন আগেকার কোন কোন মহৎপ্রাণ ব্যক্তিতাদের নানা সৃষ্টিধর্মী কাজে, লেখায়, গানে, কবিতায় সেই সুর প্রকাশ পেয়েছিল বারবার, যদিও তাঁদের মাঝেও অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনেই সেটা পালন করতে সক্ষম হননি সামাজিক বাধানিষেধের কারণে (ওই কাটাতারের বেড়াগুলো অতিক্রম করা মহৎ ব্যক্তিদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি সবসময়)। আধুনিক যুগের নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তির হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্বেও, হাজারো আত্মকেন্দ্রিকতা, হাজার ‘আমি’ত্ব সত্বেও, সেই বাধানিষেধের দেয়াল অনায়াসেই উতরাতে পারছে। তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমি এদের হাতে আমার পরবর্তী প্রজন্মের দায়দায়িত্ব নির্দ্বিধায় সঁপে দিতে প্রস্তুত। মানবজাতির অস্তিত্বরক্ষা হতে হলে একমাত্র এদের দ্বারাই সেটা সম্ভব।

অটোয়া, ২১ শে জুলাই, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২


মীজান রহমান