Sunday 1 December 2013

নটবর আকরাম খান

মীজান রহমান
                      
                                এক
ওরা আসবে বলে আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়েই ছিলাম ছোট বাচ্চাদের মত একসময় একঝলক উজ্জ্বল আলো আছড়ে পড়ল আমার গাড়িবারান্দার কালো পীচের ওপর ওরা এসে গেছে টরন্টো থেকে অটোয়ার দূরত্ব মহাদেশ পাড়ি দেবার মত কিছু নয়, আবার শহরের একপাড়া থেকে আরেক পাড়ায় যাবার মত তুচ্ছও নয় কিছু আইনকানুন না মানলে চার ঘন্টা, নতুবা পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ
গাড়ির চালক আমার তরুণ বন্ধু, টরন্টোর সর্বজনপরিচিত মনিরুল ইসলাম----সংক্ষেপে মনি আরোহীদের মাঝে ছিল ফেরদৌস নাহার, যে আমাকে মামা বলে ডাকে, যে আমার বুকে মাথা রেখে অনায়াসে মিশে যেতে পারে আমার সঙ্গে, যাকে পেলে আমার বাড়িটা আর খালি মনে হয়না সবশেষে সেরীন, আর তার দু’টি পাখির শাবকের মত মেয়ে---বর্ণকলি ও কথাকলি সেরীনকে বর্ণনা করবার মত ভাষা আমার নেই একজন বড় মাপের কবি বা কথাশিল্পী ছাড়া কারো পক্ষেই কাজটি সম্ভব নয় ফেরদৌস হয়ত কিছুটা পারবে, কারণ সে’ও তো একজন বড়মাপের কবি, সম্ভবত মনিরও সাধ্যের বাইরে নয় কারণ তারও কথার ঝুড়িতে শব্দের অভাব নেই কোনও, কিন্তু দয়া করে আমাকে বলবেন না সেরীনের পরিচয় দিতে সেরীন কেবল সেরীনই পৃথিবীজোড়া আমি শিরিন দেখেছি অনেক, শিরিও দেখেছি বেশ, কিন্তু সেরীন কেবল একজনই যার ভৌগোলিক ঠিকানা একসময় ছিল বাংলাদেশ, এখন টরন্টো কিন্তু মানুষের ঠিকানা কি কেবলই ভৌগোলিক?
মনির গাড়িটা বিশাল কোনও ট্রাকের আকার নয়, কিন্তু আমার দোরগড়ায় স্তূপ-করে-রাখা সামগ্রী দেখে মনে হচ্ছিল গোপন কোনও গুদাম আছেবা ওই গাড়িতে তিনদিনের সফরে তারা এসেছে তিনমাসের সরঞ্জাম নিয়ে এবং তার অধিকাংশই খাবার আমি রাঁধতে পারিনা ভালো, সেটা কারুরই অজানা নয় যা পারি তা কেবল আমারই আহারযোগ্য, আর কারো মুখে রুচবে না তাই সেরীন বুদ্ধি করে বাড়ি থেকে যাবতীয় খাবার তৈরি করে এনেছে রান্নার পরিমাণ দেখে ধরে নিই যে গত তিনরাত সে ঘুমায়নি, কেবল রান্না করেছে আর রান্নাই করেছে যা কেবল সেরীনের দ্বারাই সম্ভব আমার বাড়িতে অনেকদিন ভা্লো খাবারের গন্ধ পাওয়া যায়নি সেরীনের কল্যানে সে-অভাবটি চুকল স্বল্পকালের জন্য
দিনটা ছিল বিষ্যুদবার---কাজের দিন এবং ওরা সবাই কাজের মানুষ বাচ্চাদুটির স্কুল খোলা তবু কেন তারা সব বাদ দিয়ে চলে এল আমার কাছে? দুদিন বাদে আমাদের সাথে এসে যোগ দেয় আরো একজন---মন্ট্রিয়লের মনিকা রশিদ ও আরেক পাগল মানুষ, মানে সত্যিকার পাগল যেখানে তার মনের মত থাকবে কিছু সেখানে সে চোখ বন্ধ করে চলে যাবে মৌমাছিরা যেমন ফুলের খবর জানে আমাদের মনিকাও অনেকটা তাই সে পাখা মেলে উড়াল দেবেই, কপালে যা’ই থাক ও হল একটি স্ফূলিঙ্গ মুহূর্তের সন্তান ও গাড়ি চালায় না তাতে কি? বাসের পুরো ভাড়া দিয়ে চলে এল সোজা আসার পরও তার খরচের ফর্দ কমেনি, কিন্তু তাতেই বা কি! এমনই মেয়ে এই মনিকা রশিদ
কিন্তু কেন? এই যে এতগুলো লোক দূর দূর জায়গা থেকে এতটা ত্যাগ স্বীকার করে চলে এল আমার বাড়িতে, কিসের টানে? নিশ্চয়ই আমার টানে নয়----এতটা উন্মাদ তারা কেউ নয় না, আকরাম খান এসেছেন শহরে, টানটা সেখানে আকরাম খান একটি কিংবদন্তী নাম সর্বসাধারণ্যে হয়ত নয়, তবে আন্তর্জাতিক মানের নৃত্যকলা মহলে তো অবশ্যই, যদিও ২০১২ সালে লণ্ডনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মুখ্য অংশটিতে তিনি এবং তাঁর কোম্পানির সদস্যদের চমকলাগানো নৃত্যপ্রদর্শনী সারা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হবার ফলে তিনি এখন অসংখ্য ক্রীড়ামোদীর কাছেও একটি পরিচিত নাম তিনি সমসাময়িক কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত তিনি কাজ করেছেন বিখ্যাত পাকিস্তানী-ব্রিটিশ লেখক-চলচ্চিত্রনির্মাতা-নাট্যকার হানিফ কোরেশীর (১৯৫৪--) সাথে, কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ান কন্ঠশিল্পী ও সুরকার কাইলি মিনগোর (১৯৬৮---) সাথে অরুন্ধতী রায় ও Text Box:             আকরাম খান Akram Khanঅরবিন্দ আদিজার সাথে কাজ করবেন ভবিষ্যতে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ভারত উপমহাদেশের কৃষিজীবিদের নিয়ে অরুন্ধতী রায়ের ধ্যানধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘মা’---যা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল মন্ট্রিয়লের এক মিলনায়তনে আকরাম খান বর্তমান যুগের আধুনিক নৃত্যকলার এক দুর্বার শক্তি তিনি কেবল নৃত্যেই নয়, নৃত্যের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত না হয়েও রূপকল্পের আত্মীয়তায় আবদ্ধ, শিল্পকলার এমন সব শাখার প্রতিও সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সৃষ্টি থেকে গ্রহণ করেছেন তাঁর নিজের পুষ্টিসার সেকারণেই হয়ত ভারতীয়-ব্রিটিশ ভাস্কর অনিশ কাপুর (১৯৫৪---) ও ব্রিটিশ ভাস্কর-নৃত্যশিল্পী এন্টনি গর্মলি (১৯৫০---) আকরাম খানের সঙ্গে কাজ করতে বিপুলভাবে আগ্রহী এই লোকেদের কেউই নগণ্য নন, সবাই বিবিধ পদক-পদবী প্রাপ্ত খ্যাতনামা ব্যক্তি, শিল্পকলা জগতে তাঁদের সকলেরই আকাশচুম্বী প্রসিদ্ধি ২০০৫ সালে তিনি রচনা করেছিলেন Zero  Degrees নামক একটি রূপক কাহিনী যার মঞ্চায়নে মুখ্য অংশ গ্রহন করেছিলেন বিখ্যাত বেলজিয়ান নৃত্যশিল্পী সিদি লার্বি চের্কাওয়ি কাহিনীটির মূল বিষয় ছিল, যা আকরাম খানের সকল সৃষ্টিকর্মেরই একটি অন্তঃস্রোতা সুরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট---আত্মপরিচয় আমরা কারা? পৃথিবীর বৃহত্তর মানচিত্রে আমার অবস্থান কোথায় এতে সহযোগিতা করেছিলেন এন্টনি গর্মলি ও ভারতীয় সঙ্গীতবিশারদ নিলিন নহি ২০০৮ সালে আকরাম খান অংশ নিয়েছিলেন আরো একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পী---জুলিয়েট বিনোশ(১৯৬৪---) এর সঙ্গে,  লণ্ডনের রয়েল ন্যাশনাল থিয়েটারে অনুষ্ঠিত in-I শীর্ষক নৃত্যনাটকে প্যারিসে জন্মগ্রহন করা মিস বিনোশ English Patient সহ আরো অনেক চলচ্চিত্রে মূল নায়িকার ভূমিকাতে অভিনয় করে বিশেষ খ্যাতি ও সম্মাননা অর্জন করেছেন in-I এর নির্মাণকালে মিস বিনোশ আর তিনি যখন একসাথে কাজ করছিলে‌ন, সেসময়কার অভিজ্ঞতার ওপর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ও ব্যালেরিনা বিনোশ মন্তব্য করেছিলেন পরে যে আকরাম খান যাকিছু উচ্চারণ করতেন  মুখে তাই তিনি আবৃত্তি করে যেতেন, যাকিছু অঙ্গভঙ্গি দেখাতেন তাঁকে তাই তিনি ছোট্ট খুকির মত নকল করে যেতেন----এবং পাকা দুঘন্টা, বিরামহীনভাবে নৃত্যমঞ্চে আকরাম খান একটি ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব----অন্য সকলেই তাঁর অতি বাধ্য বিনীত শিষ্য মাত্র, নিজ নিজ জায়গাতে তাঁরা যতই বিখ্যাত হোন না কেন আকরাম খানের নৃত্যপারদর্শিতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন এক প্রতিবেদকঃ “ He’s the darling of the dance world, and beyond, with artists such as Anish Kapoor and Antony Gormley lining up to work with him”. ভাবতে অবাক লাগে কত বড় মাপের শিল্পী তিনি যে ভাষ্কর্য আর কথাসাহিত্যের মত ভিন্ন জগতের নামকরা মানুষগুলোও ওঁর সাথে কাজ করার জন্যে উদগ্রীব থাকেন
ছোট আকারের এই বিশাল পুরুষটি কে?
হ্যাঁ, তিনি বাঙালি
হ্যাঁ, তিনি বাংলাদেশী বাঙালি
হ্যাঁ, তিনি মুসলিম বাংলাদেশী বাঙালি
এবং হ্যাঁ, তিনি জন্মসূত্রে ব্রিটিশও

                                 দুই

আকরাম খানের জন্ম ২৯ শে জুলাই, ১৯৭৪ সাল, লণ্ডনের উইম্বলডন অঞ্চলে তাঁর বাবা, মোশাররফ হুসেন খান, ১৯৬৯ সালে লণ্ডনে এসে ওই উইম্বলডনের কাছাকাছি বালাম অঞ্চলে একটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন খান সাহেবের জন্ম নবাবগঞ্জের আলগীর চর গ্রামে আকরাম খানের মা, আনোয়ারা খান ( ডাকনাম মিতা) স্বামীর সাথে এসে যোগ দেন ১৯৭৩ সালে আনোয়ারা খানের বাবা, আজিজুর রহমান খলিফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিভাগের একটি কিংবদন্তী নাম আমি নিজে তাঁর ছাত্র ছিলাম স্নাতকশ্রেণীর পুরো তিনটি বছর----অঙ্কশাস্ত্রে যেটুকু সামান্য জ্ঞান আমি অর্জন করেছি তার অনেকটাই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া তাঁর আদিবাস নদিয়ার শান্তিপুর অঞ্চলে দেশভাগের পরপরই তিনি সপরিবারে চলে এসেছিলেন ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান পরিষদ, বিশেষ করে গণিত বিভাগে, তখন চরম শিক্ষকসংকট হিন্দু অধ্যাপকদের অধিকাংশই চলে গিয়েছিলেন ওপার বাংলায় উপযুক্ত অধ্যাপকের নিদারুণ অভাব সেসময় তখন এই লোকটি, আমাদের অতিপ্রিয় খলিফাস্যার, একা, স্নাতক ক্লাসের তিনটি পেপারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেই স্বারোপিত দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন, যা তাঁর প্রাক্তন ছাত্ররা পরম কৃতজ্ঞতার সাথে মনে রেখেছে আজীবন
খলিফাসাহেবের জীবনে অঙ্ক ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের স্থান ছিল কিনা জানিনা, তবে তাঁর মেয়ের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল যে তিনি খুব গল্পউপন্যাস পড়তে পছন্দ করতেন রবীন্দ্র রচনাবলীর পুরোটাই নাকি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল তবে গানবাজনা নৃত্যকলাতে তেমন আগ্রহ বোধ হয় তাঁর ছিল না, যতটা ছিল তাঁর স্ত্রীর আসলে মিতা খানের মা, সেসময়কার অতি রক্ষণশীল, গোঁড়া মুসলিম সমাজের চোখে ফাঁকি দিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে, তাঁর মেয়েকে নাচ শিখিয়েছিলেন নৃত্যকলার প্রতি বিশেষ একটা অনুরাগ নিয়েই হয়ত জন্মগ্রহণ করেছিলেন মিতা, আকরাম খানের অনেক গুণের উৎস হয়ত তিনিই ওদিকে তাঁর বাবা মোশাররফ হুসেনের পরিবারও শিক্ষাদীক্ষা শিল্পকলাতে একেবারে উদাসীন ছিলেন তা নয় তিনি নিজে ছাত্রবয়সে নাট্যাভিনয় করেছেন তাঁর এক ছোট বোন, বন্যা, বাফা (বুলবুল একাডেমি অফ ফাইন আর্টস) থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চমানের নৃত্যশিল্পী হিসেবে একসময় খ্যাতিলাভ করেছিলেন দেশের শিল্পানুরাগী মহলে----বাংলা টিভিতে নৃত্য পরিবেশনও নাকি করেছেন কিছুদিন সুতরাং বলা যায়, নাচের তালে তালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমাদের আকরাম খান---ওটা তাঁর রক্তে, তাঁর জিনের ভেতর
মিতা খানের শিল্পানুরাগের জীবন যে বেশিদূর এগুতে পারেনি সে তো বলাই বাহুল্য যদি তিনি জন্মাতেন অন্য কোনও দেশে, অন্য কোনও সময়, তাহলে ভবিষ্যতে একদিন মার্থা গ্র্যাহাম বা আনা পাভলোভার মত বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারতেন কিনা কে বলবে বাংলাদেশের গতানুগতিক মুসলিম পরিবারে মেয়েদের সে-স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায় বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাঁরা যখন সন্তানের মা হন তখন তাঁদের প্রাণের কোনও গোপন সুড়ঙ্গ বেয়ে সেই সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা একসময় সেই সন্তানের শরীরে রোপন করার চেষ্টা করেন তাঁর নিজের ব্যর্থ স্বপ্ন একসময় সন্তানের স্বপ্নতে পরিণত হয় শোনা যায় যে আকরাম খানের বয়স যখন দুই কি তারও কম তখনই তার পায়ের মধ্যে তাল আর ছন্দের আভাস পরিলক্ষিত হতে শুরু করে একবার তার ফুফু, বন্যা, লণ্ডনে ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে লক্ষ করেন দুবছরের শিশুর আশ্চর্য তালজ্ঞান---টিভির পর্দায় দেখা নর্তকীর নাচের সঙ্গে নিখুঁত সমন্বয় রেখে নেচে যাওয়ার চেষ্টা বন্যা তাঁর ভাবী মিতাকে বললেনঃ ওকে বোধ নাচের ক্লাসে দেওয়া উচিত ভাবী
ছেলেকে নাচ শেখানোর কল্পনা হয়ত বাবামা কারুরই ছিল না গোড়াতে, কিন্তু তার চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁদের সিদ্ধান্ত সেদিকেই মোড় নেয়----আকরামের অতিরিক্ত দুরন্তপনা আর চঞ্চল স্বভাব এতই চঞ্চল যে তার ব্যবহার তাঁদের সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল---ভেবে পাচ্ছিলেন না কিভাবে ছেলেকে শান্ত করা যায় বন্যার প্রস্তাব শুনে ওঁরা ভাবলেন, কে জানে, নাচের প্র্যাকটিস করে করে ক্লান্ত হয়ে গেলে ছেলে হয়ত সত্যি সত্যি একটু দমে যাবে তখন থেকেই আকরাম খানের নাচের তালিম শুরু এবং তার মায়ের স্কুলে নাচ শিখতে বেশ পরিশ্রম লাগে, রীতিমত ঘাম ছোটে শরীরে---তারপর অন্য কিছু করার মত তেজ থাকে না গায়ে খেয়েদেয়ে সোজা ঘুমোতে চলে যাওয়া কিন্তু নাচ শেখাতে শেখাতে তার মা আবিষ্কার করলেন যে তাঁর ছেলে আর দশটা ছেলেমেয়ের মত দায়সারা ভাবে নেচেই ক্ষান্ত হওয়ার মত নয়, তার ভেতরে আলাদা কিছু আছে স্বতন্ত্র একটা প্রতিভা, যা না থাকলে কেউই এগুতে পারেনা খুব একটা উৎসাহিত হয়ে দ্বিগুণ উদ্যমের সাথে নাচ শেখাতে থাকলেন ছেলেকে ভবিষ্যতে বড় কিছুর লক্ষণ হয়ত তখনই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন আকরাম খানের নাচের মধ্যে দৃপ্ত পদচারণা, ধনুকের মত ঋজু শরীর, দ্রুত আবর্তন, কথক নৃত্যের জন্যে যা যা প্রয়োজন সবই ছিল তাঁর শিশুপুত্রের মাঝে সর্বোপরি ছিল আকরামের দারুণ আগ্রহ নৃত্যানুশীলনের প্রতি----ওই বয়সে বাচ্চাদের দিয়ে রোজ নিয়ম করে প্র্যাকটিস করানো যেকোন বাবামায়ের জন্যে ভীষণ কসরতের ব্যাপার আকরামের বেলায় তা হয়নি তবে এটাও ঠিক যে শত হলেও আকরাম তখন ছোট বাচ্চা বই কিছু নয় তার মন ঘুরেফিরে চলে যেত টেলিভিশনের ‘নাইট রাইডার’ প্রোগ্রামের দিকে, বা মাইকেল জ্যাকসনের নাচগানের দিকে সেই বালসুলভ দুর্বলতা থেকে ছাড়িয়ে তাকে নাচের প্র্যাকটিসে নিয়ে যাবার দায়িত্বটি মিতা খান প্রায় এককভাবেই পালন করতেন
পাঠকের কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক যে আকরাম খান কি তাহলে কোনও গতানুগতিক শিক্ষা পাননি? না তা নয় অবশ্যই পেয়েছিলেন তবে খান পরিবারের অন্যান্যরা বা তাঁদের বন্ধুবান্ধবের ছেলেমেয়েরা ভালো ভা্লো প্রাইভেট স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করেছে, তারপর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বড় বড় ডিগ্রি করে ভালো ভা্লো চাকরি নিয়েছে, আকরাম খানের বেলায় তা হয়ে ওঠেনি তাঁর ছোট বোন, যার জন্ম হয়েছিল ১৯৭৮ সালে, এবং বড় ভায়ের অনুকরণে ও মায়ের তাড়নাতে নিজেও ভাল নাচ করতে শিখেছে, সে’ও প্রাইভেট স্কুলে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল আকরাম খান সেসম্বন্ধ নিজেই বলেন অকপটেঃ “নাহ, আমার দ্বারা সেটা হয়ে ওঠেনি কোন প্রাইভেট স্কুলেই আমি ভর্তিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি” তবে সাধারণ স্কুলের পড়াশুনা তাঁর অবশ্যই ছিল কিন্তু তাঁর মন ছিল প্রধানত নাচের মধ্যে তাঁর মা শেখাতেন কথক নাচ, যাতে অনেক গোণাগুণির ব্যাপার আছে----আছে অনেক ভগ্নাংশের মারপ্যাঁচ, অর্থাৎ গণিত সেগুলোতে আকরাম খানের কোন সমস্যাই হয়নি কোনদিন গোনাগুণির কাজটা অতি সহজেই করে ফেলতে পারতেন তাতে করে ছোটবেলায় একসময় এমন একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল তাঁর যে তিনি বুঝি তাঁর নানার মত গণিতের জিনিয়াস বা সেরকম কিছু হবেন বড় হয়ে তা তিনি হননি বটে, তবে মায়ের লাইনের জিনিয়াস হয়েই যে জন্মেছিলেন তার লক্ষণ সেই এতটুকু বয়স থেকেই বোঝা যাচ্ছিল বয়স যখন তিন তাঁর মা তাকে নিয়ে যেতেন প্রবাসী বাংলাদেশীদের সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে, নাচ দেখাবে বলে----ইতোমধ্যে সুনাম ছড়িয়ে গিয়েছিল পাড়ায় পাড়ায় যে খান পরিবারের তিন বছরের ছেলেটি দারুণ নাচতে পারে প্রথম প্রথম অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আকরাম খান খুব নিরুৎসাহ হয়ে পড়তেন নাচতে থাকাকালেই লোকজনের গালগল্প আর ওঠাবসাতে ভয়ানক বিরক্ত হয়ে যেতেন তিনি তখন তার মা তাকে বললেনঃ “ ওরা যাতে গল্প থামিয়ে তোমার নাচের দিকে তাকিয়ে অবশ হয়ে যেতে পারে এমন নাচ দেখানোর চেষ্টা কর, তাহলেই বুঝব তুমি কত বড় নাচিয়ে” আসলে ঠিক তাই হয়েছিল----ওটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরে নিয়ে এমন আশ্চর্য সব নাচ পরিবেশন করতে থাকলেন যে  শ্রোতা-দর্শক যেন মন্ত্রপড়া পুতুলের মত বোবা হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকলেন ওর দিকে---নড়াচড়া করতেও যেন ভুলে গেলেন অর্থাৎ দর্শকদের কিভাবে জমিয়ে রাখতে হয় সে কৌশলটি তিনি আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন বলতে গেলে শৈশবেই
অচিরেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেল মিতা খানের কাছে যে তাঁর ছেলে সাধারণ মেধা নিয়ে জন্মায়নি, অতএব তাকে সাধারণ প্রশিক্ষণের খোপে ধরে রাখা যাবে না, উচিতও না আকরামের বয়স যখন সাত তখন তিনি ওকে নিয়ে ভর্তি করালেন নামকরা কথকশিল্পী শ্রী প্রতাপ পাওয়ারের নাচের স্কুলে সত্তর আর আশির দশকে এই শিক্ষকটি ছিলেন লণ্ডনের নৃত্যকলা জগতের অবিসংবাদিত অধিপতি ভারত, ব্রিটেন, ক্যানাডা, ঘানা আর ট্রিনিদাদ মিলিয়ে তাঁর ছাত্রপছাত্রী আর শিষ্যসংখ্যা হয়ত এক হাজারে পৌঁচে গেছে ইতোমধ্যে মিতা খান নিজে ছিলেন কথকের অনুরাগী, অতএব তাঁর মেধাবী ছেলেকে কথকের সবচেয়ে ভালো শিক্ষকের কাছে নিয়ে যাবেন সেটাই তো স্বাভাবিক সেসময় আকরামের হয়ত নিজস্ব কোনও পছন্দ-অপছন্দ দানা বেঁধে ওঠেনি, সুতরাং কথক না ভারতনাট্যম না মনিপুরি, তা’ই বা সে বুঝবে কেমন করে পদ্মশ্রী উপাধিপ্রাপ্ত প্রতাপ পাওয়ার হয়ত প্রথম তালিমেই বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর এই নতুন ভর্তি-হওয়া মুসলিম বাংলাদেশী ছাত্রটি তাঁর অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের মত নয়---তাদের চেয়ে অনেক, অনেক কাঠি ওপরে তিনি নিজে ছিলেন ভারতের নামকরা গুরু, লক্ষ্ণৌ ঘরানার পণ্ডিত বিরজু মহারাজের শিষ্য শিষ্যত্বের উপযুক্ত গুণাবলি সবই তিনি দেখতে পেলেন আকরামের ভেতর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে এই ছেলেকে তাঁর সব বিদ্যা সব জ্ঞানের ভাণ্ডার ঢেলে দিতে হবে ছাত্রের গৌরব যে শিক্ষকেরই গৌরব সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন কথক শেখার জন্য ভারতীয় সঙ্গীতের আরো অনেক শাখার সঙ্গে পরিচয় থাকতে হয়, বুৎপত্তি অর্জন করতে পারলে তো আরো ভালো সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে যন্ত্রটি সেটি বোধ তবলা কথক আর তবলার তাল যেন একে অন্যের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি পরস্পরের পরিপূরক তবলা ছাড়া কথক একেবারেই নিষ্প্রাণ নিঃস্পন্দ তাই আকরাম গোড়াতেই তবলাটা ভালো করে শিখে নিয়েছিলেন ভালো করে মানে সত্যিকার ওস্তাদরা যেভাবে তবলা বাজায় ইউটিওবে ওঁর তবলা শুনে আমি তো হতবাক----আমার মাথা ঘুরছিল নাচের মঞ্চতে তাঁর পায়ের যেমন তীব্রগতি তবলার পিঠে তাঁর হাতের আঙ্গুলেরও প্রায় একই ঝড়ো গতি আকরাম খানের স্পর্শ পেয়ে বুঝি পৃথিবীর সকল জড়পদার্থই পর্বতবাহী তীব্র জলস্রোতের মত বেগবান হয়ে ওঠে
ভারতীয় সঙ্গীতের গতানুগতিক ধারা অনুযায়ী সব ছাত্রই শিষ্য হয়ে ওঠে না সবসময় শিষ্য হতে হলে কিছু বাড়তি গুণাবলির প্রয়োজন হয়, যেমন কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্র্যাকটিস করাতে কোনরকম দ্বিধা প্রকাশ না করা,  শিক্ষকের পদ্ধতির প্রতি পূর্ণ আস্থা, সর্বোপরি ভক্তি, অকপট ও অকাতর ভক্তি শিক্ষকের প্রতি আকরাম খানের চরিত্রে এগুলো ছিল বলেই হয়ত প্রতাপ পাওয়ার নিঃসঙ্কোচে ওকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করে নেন তিনি নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলেন যে এই ছেলে কেবল নিজেরই নাম ছড়াবে না, গুরুর নামও ছড়াবে একই সাথে তিন বছর যেতে-না-যেতেই তিনি ওকে Academy of Indian Dance এর এক বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটেনের Shakesperean Company Production এর স্বনামধন্য পরিচালক পিটার ব্রুকস তিনি আকরাম খানের নাচ দেখে এতই মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে তৎক্ষণাৎ প্রস্তাব দিলেন তাঁর কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে আকরাম ও তার বাবামা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন----ছেলের বয়স তখন মাত্র ১০! এমন সুযোগ কজনের ভাগ্যে ঘটে? তার একবছর পরই মঞ্চস্থ হয় পিটার ব্রুকসের বিখ্যাত মহাভারত মহাকাব্যের নাট্যরূপ, যাতে ১১ বছরের বাংলাদেশী মুসলিম ছেলে আকরাম খান নিশাদার তরুণ যুবরাজ একমন্যের ভূমিকাতে নৃত্য পরিবেশন করেন এবং তার পরের আরো দুটি বছর তিনি সেই কোম্পানির সাথে দেশবিদেশ ভ্রমণ করে বেড়ান ১৯৮৮ সালে পিটার ব্রুকস তাঁর পাণ্ডুলিপির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ চলচ্চিত্ররূপে দাঁড় করালে সেটা টেলিভিশনে প্রচার হয়, অর্থাৎ ব্রিটেনের একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে আগত একটি মুসলিম ছেলেকে ‘মহাভারতে’র অন্যতম কিশোর চরিত্রের ভূমিকাতে নৃত্যাভিনয় করতে দেখার সুযোগ পান ব্রিটেনের নৃত্যজগতে উদয় হলেন ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল তারকা
পিটার ব্রুকসের কোম্পানির সাথে দুনিয়া ঘুরতে গিয়ে স্কুলের লেখাপড়াতে বিস্তর ব্যাঘাত যে ঘটেছিল আকরামের সেটা সহজেই অনুমেয় তবুও, একটু দেরিতে হলেও, একসময় এ-লেভেলের পাটটা চুকিয়ে ফেলতে পারলেন মোটামুটি সাফল্যের সাথেই উল্লেখযোগ্য যে ওতে দুটি বিষয় তিনি বিশেষভাবে বাছাই করেছিলেন----গণিত ও বাংলা গণিতের ঝোঁক হয়ত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত, কিন্তু লণ্ডনে জন্ম-হওয়া ছেলের বাংলা শেখার ইচ্ছা? অসম্ভব কিছু নয়, তবে ওতে তার মায়ের হাত হয়তবা ছিল কিছুটা বাবাও নিশ্চয়ই চাইতেন তাঁর ছেলেমেয়েরা ভালো বাংলা শিখুক
যাই হোক পরিবারের সামনে বড় সমস্যা যেটা দাঁড়ালো সেটা হলঃ তারপর কোথায়? সাধারণ শিক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়, না ভালো কোনও নাচের স্কুল? ছেলে কি বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার-ব্যারিস্টার হবে, না নাচের লাইনে গিয়ে সারাজীবন উপোস করার ঝুঁকি নেবে? প্রশ্নটা যে খুব সহজ নয়, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান যে-কারো পক্ষে, সেটা আমি নিজের পরিবারের অভিজ্ঞতা দিয়েই জানি যাই হোক, সৌভাগ্যবশত খান পরিবার সিদ্ধান্ত নেন যে ছেলে যেরকম মেধার পরিচয় দিয়েছে এরি মধ্যে তারপর তাকে নৃত্যশিল্পের উচ্চতর জায়গায় পৌঁছুবার সুযোগ না দেওয়া রীতিমত অন্যায় হয়ে যাবে
তিনি ভর্তি হলেন লিস্টারের মন্টফোর্ট স্কুল অফ কন্টেম্পরারি আর্টসে সেখানে কিছুদিন ক্লাস করার পর তিনি এবং তাঁর অধ্যাপকরা বুঝতে পারলেন যে মন্টফোর্ট যতই উঁচুমানের শিক্ষাকেন্দ্র হোক না কেন আকরাম খানের মত মঞ্চ নাচিয়ের জন্য হয়ত খুব উপযোগী নয়----একটু বেশিরকম তাত্বিক প্রতিষ্ঠান সেটি অর্থাৎ সেখানে নাচের তাত্বিক দিকগুলো শেখানো হয় প্রচুর, কিন্তু আসল নাচটাই শেখানো হয়না তেমন গুরুত্বের সাথে তত্ব বিষয়গুলোতেও যে খারাপ করছিলেন তা নয়, তবে তাঁরা ভাবলেন তার চেয়ে বরং লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত নর্দার্ণ স্কুল অফ কন্টেম্পরারি ডান্সে গেলে আকরাম খানের নাচের প্রতিভা আরো দ্রুত বিকাশলাভের সুযোগ পাবে এবং শেষ পর্যন্ত হলও তাই----সেখান থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ডিগ্রি নিয়ে তিনি উত্তীর্ণ হলেন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এত ভালো রেজাল্ট তাঁর আগে বা পরে কেউই করতে পারে নি সাধে কি ২০০৪ সালে তাঁকে “অনারারি ডক্টর অফ আর্টস” উপাধিতে সম্মানিত করা হয় মন্টফোর্ট স্কুল অফ কটেম্পরারি আর্টস থেকে? তিনি ছিলেন উভয় স্কুলের এক অবিশ্বাস্যরকম সফল ছাত্র----এমন প্রতিভা ব্রিটেনের মত উন্নত দেশেও বড়ই বিরল
গতানুগতিক শিক্ষার প্রচলিত ধারাতে ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি-দুটি ডিগ্রি করার পরই চাকরিতে ঢোকে, বিয়েশাদি করে সংসারজীবনে প্রবেশ করে, তারপর একসময় অবসর নিয়ে সূর্যাস্তের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায় কিন্তু সৃষ্টিধর্মী শিল্পকলার জীবনে ওই ডিগ্রিগুলোর মূল্য একটুকরো কাগজের মতই নির্মূল্য সর্বোচ্চ ডিগ্রি, সর্বোচ্চ নম্বর, এগুলো সূচনা মাত্র দুর্গম দুরূহ জীবনের প্রথম সোপান ছাড়া কিছু নয় অনেক দূরের পথ এ-জীবনে---সত্যিকার ম্যারাথন রেস এখানে আকরাম খান কথক শেষ করেছেন, পশ্চিমের কন্টেম্পরারি নৃত্যের প্রাথমিক পর্যায়টিও পার হয়েছেন অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে অর্থাৎ তাঁর রক্তের স্রোতে দুটি ভিন্ন যুগ, দুটি ভিন্ন সভ্যতা, একই ধারাতে প্রবাহিত Text Box: ‘সেক্রেড মন্সটারে' একটি নৃত্যভঙ্গী হবার সুযোগ পায় কিন্তু দুটি ধারাকে একই গ্রন্থিতে আবদ্ধ করে একটা স্বতন্ত্র ধারা, একটা নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করতে হয় কেমন করে, সেটি তো শেখা হয়নি সেই শেখাটির নাম ‘কোরিওগ্রাফি’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই, অভিধান আর আন্তর্জাল খুলে কোনও হদিস পেলাম না, অতএব শব্দটা এভাবেই থাক কোরিওগ্রাফি বলতে আমি যা বুঝি, সঙ্গীতের যেমন স্বরলিপি, নাচেরও তেমনি কোরিওগ্রাফি----যার বর্ণ আর ধ্বনির সঙ্গত দেয় আবহের সমবেত যন্ত্রসঙ্গীত আর মঞ্চের আলোকসজ্জা সব মিলিয়ে তৈরি হয় একটা গল্প, একটা গীতিময় অঙ্গচালনা এই অমূল্য শিক্ষাটি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সোনালি-রূপালি কাগজের মধ্য দিয়ে আসে না ওটির জন্যে আকরাম গিয়েছিলেন ইউরোপে----সাতমাসের পূর্ণ বৃত্তি পেয়ে তিনি গিয়েছিলেন এন টেরেসা দ্য মির্সমেকারের ব্রাসেলসভিত্তিক এক্স-গ্রুপ প্রজেক্টের শিক্ষার্থী-সদস্য হিসেবে সেখানেই পান তিনি কোরিওগ্রাফি জগতের প্রথম পরিচয় এবার তিনি প্রস্তুত প্রায় সৃষ্টির ধর্মই তাই---কখনও কেউ পুরোপুরি প্রস্তুত নয় এই ক্ষুধার পূর্ণ নিবৃত্তি হবার নয় কস্মিনকালে কথা হল এই চিরন্তন তৃষ্ণাটির উৎস কোথায়? কোন্‌ গিরিকন্দর থেকে উদ্ভুত হয় এই তীব্র চেতনা যা তাকে ঈশ্বরের আসনে তুলে নিয়ে যায়? এ-প্রশ্নের জবাব হয়ত সবার কাছে এক নয় আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় এর উৎস মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে----গভীর গহন কোনও রহস্যপুরিতে তার সাথে যোগ দেয় তার নিজের জীবন, তার চতুঃপার্শ্বের জীবন----লোকজনের নিত্য চলমান দৈনন্দিনতা, তাদের সকল তুচ্ছতা আর ক্ষুদ্রতার বিচিত্র সংমিশ্রণ, তার অভিজ্ঞতার বলয়েতে বাস করা পৃথিবীর নানারঙ্গের নানা ধর্মের ছোট বড় মানুষগুলো----এ সব মিলিয়েই রচনা করে তার মোতির মালা, তার সোনার ধানের শস্যভাণ্ডার সেই সব উপাদানগুলো কতখানি উপস্থিত ছিল আকরাম খানের অস্তিত্বের ভেতর তার খবরও কিছুটা জানা যায় তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কিছু রেখাচিত্র থেকে অভিবাসী বাঙ্গালি পরিবারের জন্যে সে-চিত্র যে খুব মৌলিক বা অস্বাভাবিক তা’ও তো নয় পশ্চিম জগতের প্রায় প্রতিটি প্রবাসী পরিবারেই বলতে গেলে একই কাহিনী দ্বিতীয় প্রজন্ম আর প্রথম প্রজন্মের নিত্য ঠোকাঠুকি প্রথম প্রজন্ম দেশ ছেড়েও বিদেশকে দেশ মানতে পারলেন না, দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়ত কখনোই ‘বিদেশ’ ছাড়া অন্য কোন দেশকে ‘দেশ’ বলে মানতে রাজি নয় বাবামা রোজ দুবেলা টেবিল চাপড়ে তাদের মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করেন ‘দেশ’ হল যেখানে তাঁরা জন্মেছেন, ওরা নয় তাদের দৈনন্দিন জীবন দুটি সর্পিল পথের সংঘর্ষ দ্বারা নির্মিত---বাড়িতে বাংলা, বাইরে ইংরেজি বাড়িতে লতা মুঙ্গেশকর আর রুনা লায়লা, বাইরে মাইকেল জ্যাকসন আর এলটন জন তাদের জীবন কাগজের ভেলার মত ভাসতে থাকে এপার থেকে ওপারে, কোথাও নোঙ্গর করার উপায় নাই আকরামের জীবনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি তার বাবা সারাদিন হয়ত রেস্টুরেন্টে পড়ে থাকতেন, রাতের বেলাতেও নিশ্চয়ই অনেকটা ঘরের ভেতর বাবার ভূমিকা ছিল প্রধানত ‘ধমকানো’----বিদেশের সংগ্রামী বাবারা তো তাই করেন সচরাচর পরীক্ষায় লাড্ডু মারার ইচ্ছা? নিজের কাজকাম ছাইরা বিলাতি পোলামাইয়ার পিছে ঘোরা? ছেলে ওসব শুনতে চায় না, কানে হাত চেপে রাখে সে শুনতে চায় নতুন সব রক মিউজিক, দেখতে চায় সদ্য-বের হওয়া ভিডিও, কিম্বা খেলার মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে চায় ফুটবল প্রবাসের বেশির ভাগ পরিবারেরই প্রায় একই গল্প----বাড়িতে যুদ্ধ, বাইরে মিষ্টি হাসি গদবাঁধা রদ্দি গল্প----ডাল, বোরিং কিন্তু আকরামের সৃষ্টিশীল মন সেই ‘বোরিং’ গল্পগুলোকে বিফল হতে দেননি, কাজে লাগিয়েছেন সেই গল্পগুলো, সেই বিবাদগুলো, ইন্ধন নিয়ে এসেছে তার কল্পনার রাজ্যে, যুগিয়েছে নতুন কোরিওগ্রাফির আইডিয়া ছোটবেলার সঙ্ঘাতগুলি নাচের মঞ্চতে এসে অমর বাণীতে পরিণত হয়ে সর্বজনীনতা লাভ করেছে
ছোটবেলায় রাস্তায় খেলতে গিয়ে তিনি দেখেছেন লণ্ডনের  বহুজাতিক রূপ তাঁর নিজেরই ভাষায়ঃআমাদের বাড়ির ডানপাশে ছিল একটি নাইজেরিয়ান পরিবার, রাস্তার মোড়ে একটি চাইনীজ ছেলে, আরেকজন ছিল মরিশাস থেকে----আমি তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একসাথে স্কুলে যেতাম এদেশে এতগুলো কালচার একসাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে যে এখানে কোনও একক দেশের কালচার বলতে কিছু নেই, একটা নতুন কালচার তৈরি হয়েছে---একটা বিশ্বকালচার আকরাম খানের কাজের মধ্যে সেই বিশ্বদৃষ্টি বিশ্বানুভূতির সুস্পষ্ট ছাপ সর্বত্র বিদ্যমান
 নিজের পরিবার সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন উঠলেই একটা কথা তিনি বারবার উল্লেখ করেছেনঃ মায়ের ঋণ মায়ের কারণেই তিনি এতদূর আসতে পেরেছেন, ইত্যাদি মা তাঁকে নাচ শিখিয়েছিলেন শৈশবে, মা তাঁকে বাংলায় কথা বলতে শিখিয়েছেন, একরকম জোর করেই, মা তাঁকে বাংলা কবিতা গান রূপকথা এগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, মা তাঁকে বাংলাদেশের ধনধান্যপুষ্পে ভরা মাজননীর গল্প শুনিয়েছেন দরদের সঙ্গে----সেসব কথা, গান, দৃশ্য আর কবিতা তাঁর প্রাণের গভীরে প্রবেশ করেছে হয়ত তাঁর নিজের অজান্তেই তাঁর নৃত্যজীবনের প্রথম প্রেরণা তাঁর মায়ের কাছেই পাওয়া বাল্যকালে, কৈশোরে, প্রথম যৌবনে বাবা ছিলেন একজন দূরগত মানুষ, একজন রাগী ও ভীতিকর মানুষ অথচ কি আশ্চর্য, যতই দিন যেতে থাকে ততই বাবার একটি কোমলতর রূপ তাঁর কাছে ফুটে উঠতে শুরু করে তাঁর পিতা একটি বৃহত্তর উপস্থিতি, একজন সর্নময় সত্তা হয়ে দেখা দেন তাঁর কাছে তিনি দেখেছেন তাঁর বাবা কি অকথ্য কষ্ট আর পরিশ্রম করে সংসারের হাল ধরে রেখেছেন সারা জীবন, বিলেতের প্রতিকূল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের ভেতর কেমন করে আগলে রেখেছেন গোটা পরিবারকে, কেমন করে নিজের জীবনের সকল স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে ছেমেয়েদের সকল স্বপ্নকে সফল করে তুলতে চেয়েছেন আকরামের ছাত্রাবস্থায় মাঝে মাঝেই যেতে হত বাবার রেস্টুরেন্টে একটু আধটু ফুটফরমাশ করার জন্য ব্রিটিশ উচ্চারণ জানা ছিল বলে অধিকাংশ সময় তাঁকে ওয়েটারের পোশাক পরে কাজে নামতে হত তখনই তাঁর দেখবার সুযোগ হয়েছিল ব্রিটিশ জাতির বর্ণবাদী চেহারা একেবারে কাছে থেকে কথায় কথায় তারা তাঁর চামড়ার রঙ নিয়ে খোঁটা দিতেন, তাঁর খর্বাকার শরীর নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন তাঁর বাবার অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়----হরহামেশাই সাদা খদ্দেরদের গালিগালাজ তিনি নির্বিবাদে শুনে যেতেন, কখনোবা হাসিমুখে অপমানগুলো তাঁর গায়ে লাগত না তা নয়, কিন্তু মুখ গুঁজে সহ্য করে যেতেন জীবিকার তাগিদে, ব্যবসার খাতিরে, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছোটবেলার সেই সব অভিজ্ঞতা মন থেকে কোনদিনই মুছে যায়নি পরবর্তীতে নৃত্যজগতে ব্রিটেনের বিস্ময়কর সুনাম অর্জন করার ফলে প্রভূতভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু ছোটবেলার সেই ঘাগুলো কখনোই শুকোবার নয়---বিশেষ করে তার বাবার সারাজীবনের ক্ষতগুলো
তাঁর স্কুলজীবনেও তিক্ততার অভাব ছিল না সাদা ছেমেয়েদের অবজ্ঞা অবহেলা অহরহই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে ক্লাসরুমে, খেলার মাঠে একেতো বাংলাদেশী, তার ওপর দেখতে ছোট---অতএব সাদাকালো সবারই হাসির পাত্র, ব্যঙ্গবিদ্রূপের মোক্ষম শিকার ছাত্র হিসেবেও খুব তুখোড় ছিলেন তা নয়, সুতরাং আকরাম খানকে সামান্য সম্মানটুকুও কেউ দেখাবার গরজ বোধ করেনি একমাত্র নাচের কেরামতি দেখিয়েই শেষমেশ ওদের নজরে পড়েছিলেন তাঁর নিজেরই ভাষায়ঃ
“ My real break was winning a junior school disco competition dancing to Michael Jackson Thriller. It was the first time I got respect from my classmates. Before that I was this shy, insecure, geeky, skinny, boring little Asian boy.” (গার্ডিয়ান, ২০০৯, ডার্সি জাডকে প্রদত্ত সাক্ষৎকারে)
জাতিধর্মবর্ণবিভেদ একেক মানুষকে একেকভাবে প্রভাবিত করে কেউ চায় প্রতিশোধ, কেউ খোঁজে উগ্রপন্থা, কেউ হয় পরম ধার্মিক, কেউবা পরম নাস্তিক অধিকাংশ মানুষই কোন-না-কোনও ভাবে একটা আত্মধ্বংসী পথই বাছাই করে নেয় কিন্তু আকরামের মত বিপুল মেধার সৃষ্টিশীল মানুষগুলি তা করে না তারা সেগুলোকে, সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে, অপমানগুলোকে, অভিনব আলোতে আলোকিত করে মানবচিত্তের গভীরতম কিছু তথ্যের খবর পৌঁছে দেয় তাদের স্রোতা-দর্শকদের কাছে সাধারণ মানুষ সেই সৃষ্টির মাঝে নিজেদের প্রতিকৃতি দেখতে পায়, নিজেদের আনন্দবেদনা চাওয়া-পাওয়ার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় আকরাম খানের ‘দেশ’ তেমনি এক সৃষ্টি এই ‘দেশ’ দেখার জন্যেই টরন্টো আর মন্ট্রিয়ল থেকে ওরা চলে এসেছিল আমার বাসায় আমরা সবাই মিলে আকরাম খানের চোখ দিয়ে আমাদের দেশকে দেখতে যাব দেখতে যাব আমাদের দেশকে তাঁর নাচের মধ্য দিয়ে, তিনি যেভাবে তাঁর দেশকে আবিষ্কার করেছেন, তাঁর কল্পনাতে, ধ্যানধারণাতে যেভাবে ধরা দিয়েছে সেই দেশ কেবল আমরাই নয়, অটোয়ার অনেক, অনেক শিল্পানুরাগী, নৃত্যানুরাগী দর্শক, তারাও হয়ত একই কারণে গিয়েছি্লেন সেখানে----নিজের দেশকে, স্মৃতিকে, অতীতকে, খুঁজে পাওয়ার আশাতে আকরাম তার মায়ের দেশ, বাবার দেশের যে ছবি তৈরি করেছেন এতে, তার ভেতর দিয়ে দেশ নিয়ে পৃথিবীর সকল মানুষেরই মৌলিক আকুলতাগুলোকে তুলে ধরেছেন আশ্চর্য নৈপুন্যের সাথে

                            তিন
ন্যাশনাল আর্টস সেন্টার---NAC, ক্যানাডার জাতীয় প্রমোদাগার পারফর্মিং আর্টসের প্রাণকেন্দ্র সঙ্গীত, নৃত্য আর নাট্যজগতের শ্রেষ্ঠ তারকাদের সমাবেশ হয় এখানে রাজধানী অটোয়ার নগরকেন্দ্রে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি নিউ ইয়র্কের যেমন আছে লিঙ্কন সেন্টার আর ফিলহার্মনিক অর্কেস্ট্রা, লণ্ডনের রয়েল অপেরা হাউস আর রয়েল ফেস্টিভেল হল, আমাদেরও তেমনি এন এ সি---প্রায় একই সমতলে, একই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এর একদিকে ক্যানাডার পার্লেমেন্ট ভবন, আরেকদিকে ঐতিহ্যবাহী শ্যাটা-লরিয়ে হোটেল, লর্ড এলগিন হোটেল, পেছনদিকে বিশ্ববিখ্যাত রিডো ক্যানাল যেখানে শীতের ঋতুতে তৈরি হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম স্কেটিং রিঙ্ক, গ্রীষ্মে যার শান্ত জলের ওপর নৌকাবিহারীদের সমাগম হয় দেশবিদেশের নানা জায়গা থেকে রাস্তা পার হলেই শহরের প্রাচীনতম বাণিজ্য ও প্রমোদকেন্দ্র বাইওয়ার্ড মার্কেট, ওদিকে আলোঝলমল রিডো স্ট্রীট, টুরিস্টদের ভিড়ে কোলাহলে মুখর সারাক্ষণ আর্টস সেন্টারে শ্রোতারা শোনে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত---বাখ, মোৎসার্ট, বেথোফেন, মেণ্ডেলসন, শোঁপা আর চাইকোভস্কির অমর রচনাবলী তাঁরা দেখেন সেক্সপীয়ার, শ’, মিলার, ইবসেন আর উইলিয়মসের নাটক কখনোবা বড় বড় জ্যাজ শিল্পীরাও আমন্ত্রিত হয়ে আসেন জ্যাজপ্রেমিকদের চাহিদা মেটাবার জন্যে আর্টস সেন্টারের দরজা কখনো বন্ধ হয় না----সারা বছরব্যাপীই চলছে তাদের অনুষ্ঠান বিপুলাকার এই প্রতিষ্ঠানটিতে দুটি বড় বড় প্রেক্ষাগৃহ একটিতে নাচ নাটক ইত্যাদি আরেকটিতে প্রধানত অর্কেস্টাকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানাদি টিকেটের দাম দুজায়গাতেই একটু উঁচু----পাড়ার সস্তা সিনেমাহলের মত নয় সবচেয়ে কম দামের টিকেটই সেখানে ৪০ ডলারের মত সবচেয়ে দামি টিকেট বোধ হয় ১০০ কি তারও ওপর----ওটা আমার জানবার কথা নয় ন্যাশনাল আর্টস সেন্টারের অনুষ্ঠান যারা দেখতে যান নিয়মিত তারা কেবল উচ্চরুচিসম্পন্নই মন, উচ্চবিত্তসম্পন্নও পাঠকের মনে প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে তাহলে আমরা ক’জন আধো গেঁয়ো বাঙ্গাল কেমন করে এত দামের টিকেট কিনে গেলাম সেখানে টিকেট কিনে গেলাম না অন্য কোনভাবে গেলাম সেটা নাহয় না’ই বললাম এখানে, তবে এটুকু বলতে পারি যে একশ’ ডলারের টিকেট কিনে হলেও বোধ হয় আমরা যেতাম কারণ আমরা তো আসলে আর্টস সেন্টারে যাই নি, গিয়েছিলাম আমাদের দেশের ছেলের অনুষ্ঠান দেখতে----না, ঠিক তা’ও নয়, গিয়েছিলাম আমাদের হতভাগা দেশটিকেই ভিন্ন একটা রূপে, ঝলমল করা সাজে, দেশবিদেশের অনেক বোদ্ধা দর্শকের মুগ্ধ, সপ্রশংস দৃষ্টির বীক্ষণ দিয়ে দেখতে সেখানে গিয়ে আমরা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম দেশের করুণ অবস্থাটি, ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনা-রাজশাহীর অন্তহীন হরতাল আর অবরোধের কথা, রেললাইন উপড়ে ফেলে মানুষ মেরে ফেলার কথা, যাত্রীবোঝাই বাসের ভেতর আগুণ ধরিয়ে দেবার কথা NAC-এর দেয়ালে দেয়ালে, ছাদের ওপরে টাঙ্গানো বিজ্ঞাপনে, আকরাম খানের ছবি দেখে, নাম পড়ে গর্বে বুক ফুলোতে চেয়েছিলাম----অনেকদিন আমরা, অভিবাসী, উপবাসী বাংলাদেশীরা, সে-স্বাদটুকু পাইনি
শনিবার, ১৬ই নভেম্বর আকরাম খানের শেষ অনুষ্ঠান সেদিন এসময় অটোয়াতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হতে পারত, হতে পারত আচমকা তুষারঝড় কিন্তু হয়নি বরং আশাতীতরকম উষ্ণ আবহাওয়া ছিল সেদিন সন্ধ্যা আটটাতে অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা আমরা সাতজন বাংলাদেশী বাঙ্গালি, সেজেগুজে, গর্বে বুক ফুলিয়ে উপস্থিত হলাম নাচঘরের বাইরে, লাউঞ্জে টরন্টো থেকে আগত চারজন, আমি, মন্ট্রিয়লের মনিকা, অটোয়ার অহনা আর অমিয়া এরা আমার শ্বশুরালয়ের সম্পর্কে নাতনি, অসম্ভব ভালো আর গুণি দুটি মেয়ে, আমার ভয়ানক প্রিয়, দুজনই পাসটাস করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে, শিল্পকলাতে দুজনই দারুণ উৎসাহী, ছোটবেলা থেকে ক্যানাডায় বসবাস করা সত্ত্বেও দেশ বলতে তারা বাংলাদেশকেই বোঝে প্রেক্ষাগৃহের দরজা তখনো খোলেনি আমি ছাড়া আর সকলের হাতেই স্মার্টফোন, আইফোন অতএব সকলেই সকলের ছবি তোলার কাজে মগ্ন----ডিজিটাল প্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষই এখন তাৎক্ষণিক ফটোগ্রাফারে পরিণত হয়ে গেছেন ওদের জন্যে ছবি তোলার মত বিষয়বস্তু প্রচুরই ছিল সেখানে----আকরাম খানের ছবি, বিজ্ঞাপন, তাঁর অনুষ্ঠান থেকে নেওয়া বিভিন্ন চমকপ্রদ দৃশ্য সেদিন ওরা সবাই গর্ব করে ঘোষণা করতে পারত সেখানে যে এই দেখুন, আমরা সেই দেশেরই লোক যার ছবি দেখে আপনারা মুগ্ধ হচ্ছেন আকরাম খান আর আমরা একই ভাষায় কথা বলি, একই খাবার খাই, একই গান পছন্দ করি
Text Box:        ‘দেশ’ এর একটি অসাধারণ দৃশ্যে আপাত ঝুলন্ত আকরাম খানDESH
লাউঞ্জে তখনও হালকা ভিড়---ভয় হচ্ছিল পাছে না খালি হলের ভেতর অনুষ্ঠান করতে হয় আকরামকে ঠিক পৌনে আটটাতে হলের দরজা খোলা হল আমরা একে একে নিজেদের সীট দখল করে নিলাম দশ মিনিট আগ পর্যন্তও মনে হচ্ছিল অর্ধেকের বেশি লোক হবে না হয়ত তারপর কি হল, শেষ পাঁচ মিনিটের মাঝে রীতিমত একটা ঢল নেমে এল যেন দেখতে দেখতে চারদিকের সবগুলো সীট দখল কি আশ্চর্য শৃঙ্খলার সাথে এতবড় একটা হল এত অল্প সময়ের ভেতর ভরাট হয়ে গেল ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখলাম মনের ভেতর----এই সহজ জিনিসটা কেন শিখে উঠতে পারছে না আমার দেশের মানুষগুলি
আটটা বেজে একমিনিট পর হলের সবগুলো আলো নিভে গেল---ঘুটঘুটে অন্ধকার চতুর্দিকে, যেন বাংলাদেশের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের ঘন অরণ্যের ভেতর প্রবেশ করেছি হলশুদ্ধ মানুষ নিঃস্তব্ধ, নিশ্চুপ টুঁশব্দটি নেই কোথাও----সেলফোন বাজছে না কারো পকেটে, কাশিহাঁচির শব্দ নেই একটুও অনুষ্ঠান চলাকালে স্রোতাদর্শকদের কেউ কথা বলবে না, ফোন বাজা বন্ধ রাখবে, সামান্য নড়াচড়ার শব্দও চেপে রাখার চেষ্টা করবে, এটুকু সৌজন্য পশ্চিম জগতের সভ্যসমাজে সবাই আশা করেন
এমন সময় পর্দার আড়াল থেকে বের হলেন একটি ছোটখাটো লোক, হাতে তাঁর সলতে-জ্বালানো নিভুনিভু হারিকেন, পরণে খয়েরি রঙ্গের লুঙ্গি আর কোর্তা খুঁজছেন, প্রত্যন্ত গ্রামের আরণ্যক অন্ধকারের ভেতর কি যেন খুঁজছেন সামনে পড়ল একটা মাটির ঢিবি---কবরের মত তার পাশে একটি ছোট গাছ পোঁতা তারই সংলগ্ন একটা শক্ত জায়গা, লোহার পাতের মত কিছু একটা বস্তু এর সবকিছুই যে কোনও গল্পের রূপক, কোনও প্রাচীন কাহিনীর স্মৃতিফলক সেটা হয়ত কারুরই দৃষ্টি এড়ায়নি একসময় তাঁর হাতে একটা প্রকাণ্ড হাতুড়ি দেখা গেল এবং সেই হাতুড়ি দিয়ে তুমুল জোরে ঘা দিতে শুরু করলেন সেই শক্ত পাতের ওপর একটা নয়, দুটো নয়, পরপর আটবার যেন সেই ঢিবির মাটি খুঁড়ে কিছু বের করতে চাচ্ছেন অতীতকে স্মৃতিকে সেই কবরের নিচে যেন তার বাবাই শুয়ে আছেন তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বাবার ঘুম ভাঙ্গাতে, তাঁকে জাগিয়ে তুলতে তাঁর মুখ থেকে আবার সেই গল্পগুলো শুনতে চান যা উনি প্রাণমন দিয়ে ওকে শোনাতে চাইতেন ছোটবেলায় কিন্তু তিনি তখন কান দেননি তাতে হে স্মৃতি, জাগ্রত হও অতীত তুমি আবার দাঁড়াও আমার সামনে একসময় তিনি নিজেই বাবার ভাণ করে পুরনো গল্পগুলো বলতে শুরু করলেন কেশমুক্ত নেড়ে মাথায় রাগী বাবার মুখ এঁকে তাঁর অনুকরণে ছেলেকে ডাকছেন নিচে এসে সবার সাথে খাবার টেবিলে বসার জন্যে তুই কি ওসব পচা বিলাতী বাজনা বন্ধ করবি? সমানে বকাবাজি করে যাচ্ছেন নিচের তলার সিঁড়ি থেকে, আর ওপরে নিজের ঘরে বসে ছেলে নির্বিকার কানে মাইকেল জ্যাকসনের গানেতে বাবার গলা ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা এখন, এতকাল পর, সেই রাগী গলা, তাঁর রেস্টুরেন্ট জীবনের অকথ্য কষ্টের গল্প, তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশ, যেদেশের কথা তিনি এককানে শুনেছেন, আরেক কানে বের করে দিয়েছেন ছোটবেলার সেই অর্বাচীন বয়সে, সেই গল্পগুলি তিনি আবার কবর খুঁড়ে বের করে আনতে চান শোনাতে চান তাঁর কাছে বসা ছোট্ট খুকি, ভাগ্নি ইশিতার কাছে, সেই একই গল্প কিন্তু বাবার মত করে নয়, মায়ের মতও নয়, তাঁর নিজের মত করে, যেমন করে বড়রা ছোটদের রূপকথার গল্প শোনায়, রাজরানী আর অচিনপুরের গুপ্তধনের গল্প শোনায়----বাড়িয়ে বাড়িয়ে, নানা রঙের রঙ মিশিয়ে, নাচে গানে তালে তালে অবিশ্বাস্যরকম সৌন্দর্যময় করে তোলার পর ‘দেশ’ আকরাম খানের সেই ছোটবেলার গল্প বলারই এক অনবদ্য ভঙ্গি যা দেশকাল পার হয়ে অনায়াসে সর্বজনীন মানবতার মন্দিরে গিয়ে পৌঁছায়
‘দেশ’ নিয়ে একটা বড় কাজ করবেন এমন একটি ভাবনা অনেক আগেই উদয় হয়েছিল তাঁর মনে----এটি তাঁর অত্যন্ত ব্যক্তিগত ভাবনা যা তাঁকে একাই করতে হবে জানতেন এই বিশেষ ‘দেশ’টির সন্ধান তাঁকে একাই করতে হবে চিন্তাটি মনের ভেতর ঘুমিয়ে থেকেছে অনেকগুলো বছর----ঘুরপাক খেয়েছে কর্মব্যস্ততা বা মানসিক-দৈহিক প্রস্তুতির অসম্পূর্ণতা, সব মিলিয়ে সেটা হয়ে ওঠেনি এদ্দিন মৌলিক যে-ভাবনাটি তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল বারবার সে-ভাবনা তো মানবজাতির প্রাচীনতম অন্বেষাগুলোরই অন্যতম----আমি কে, আমার সত্যিকার পরিচয় কি আকরাম খানের মত প্রবাসে জন্মলব্ধ ছেলেদের জীবনে তো সে-প্রশ্নের পরিধি সঙ্কটের শেষ সীমানাতে পৌঁছে যায় যৌবনের প্রাক্কালে প্রশ্ন তখন দ্বন্দ্ব হয়ে দাঁড়ায়---কখনোবা রীতিমত যুদ্ধ তার জন্ম যেদেশে, যেদেশের আলোবাতাসে তার বৃদ্ধি ও বিকাশ, তার খেলার সাথীরা যেখানে বাস করে, সেদেশ নাকি তার নয়, সেকথা তাকে শিখতে হয় তার বাবামার কাছে, আত্মীয়স্বজনদের কাছে এমনকি স্কুলের ক্লাসরুম আর খেলার মাঠে গিয়েও তাকে শুনতে হয় যে এই যে জন্মভূমি বলে এতকাল জানল যে-দেশটিকে সেটিও আসলে তার নয় তখন তার মনে হতে থাকে তার আসলেই কোন ঠিকানা নেই, বাড়ি নেই, সে একটি জলজ উদ্ভিদ বই কিছু নয় সেই সংশয়, সেই অসহায় আর একাকিত্বের বোধ তাকে পরিচয়হীনতার গহ্বরে শুষে নিয়ে যায় আকরাম জানতেন এটি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অভিযান, এতে কারুরই অংশ নেবার উপায় নেই তাঁর নিজের ভাষাতেইঃ
“ It’s about different generations, about how we carry memories and how we keep memories. It’s much universal story than Bangladesh. At its centre is a child in crisis”.
এই সর্বজনীন আইডিয়াটিকে তিনি শিল্পকলার অঙ্গভূষণে সজ্জিত করে একটি স্বপ্নিল রূপ দিতে চেয়েছিলেন দুই প্রজন্মের সংঘাত, স্মৃতি আর অতীতের সাথে সমসাময়িক কালের দ্বন্দ্ব----এগুলোর মাঝ দিয়ে তিনি তৈরি করে নিয়েছেন একটা সুষম সহাবস্থানের এলাকা, যা সম্ভব হয়েছে তাঁর পরিণত বয়সের আত্মপ্রত্যয়ী চিন্তার সূত্র ধরে তাই তিনি যখন দেখতে পান তাঁর বোনের মেয়েটি, তাঁরই মত বর্তমান যুগের জমকালো তারকা লেডি গাগার পোশাক-আশাক আর গানবাজনাতে বিভোর হয়ে থাকতে চায় কেবল, আর তাঁর মা তাকে কেবলই শোনাতে চান তাঁর দেশের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, স্বাধীনতা আর গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের গল্প, তখন তিনি যেন নিজেরই বাল্যকালে ফিরে যান, এবং সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে তাঁরই মত করে বলতে চান ইশিতাকে তখনই মঞ্চের ওপর একঝাঁক আলোর ঝলক অগ্নিশিখার তীব্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে চারদিকে বেজে ওঠে অগণিত গাড়ি, রিক্সা, ট্রাক আর জনতার কানফাটানো চিৎকার আর কোলাহল----সেখানে তিনি এক বিভ্রান্ত পথভোলা বালক, শব্দের তীক্ষ্ণতা দ্বারা, চারপাশের প্রবহমান জীবনের চরম উচ্ছৃখলা দ্বারা প্রহৃত ও পরাভূত সেখানে বিশাল আকারে সহসা আবির্ভূত হয় বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক শোভাযাত্রার দৃশ্য স্বাধীনতার দাবি, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি, তারা নিশান উড়াচ্ছে, চিৎকার করে ঘোষণা করছে তাদের দাবিদাওয়া মিছিলের একেবারে সম্মুখভাগে হঠাৎ করে দেখা দেয় একটি বালক, তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত শূন্যে উঁচানো----মুক্তি চাই মুক্তি চাই বলে তারও সেই একই ঘোষণা সেই ছবির সামনে, বিশাল মিছিলের মাঝে আকরাম যেন নিজেকেই খুঁজে পান, ওই বালকের মত তিনিও মুষ্ঠি আবদ্ধ করে ঘোষণা দেনঃ মুক্তি চাই, আমিও মুক্তি চাই কেবল তাঁর কাঙ্খিত ‘মুক্তি’ আর মিছিলের অগ্রভাগে থাকা বালকের কাঙ্খিত মুক্তি এক নয় কিম্বা কে জানে, হয়ত সেখানেও আছে কোনও গূঢ় ঐক্যসূত্র কিন্তু তিনি মুক্তি খোঁজেন তাঁর নিজেরই দ্বন্দ্বের কারাগার থেকে এখানেই আকরাম খান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে নিজের অন্তর্যুদ্ধের সাযুজ্য খুঁজে পান এই কামনা আর দাবির মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর পিতামাতার মাতৃভূমির সাথে একাত্ম বোধ করেন, সে দেশটি অলক্ষ্যে তাঁর নিজেরই দেশ হয়ে ওঠে
মিছিলের বালকটির ধারণা কিভাবে উদয় হয়েছিল তাঁর মনে এনিয়েও একটা ছোট কাহিনী আছে ‘দেশ’ তৈরি করার জন্যে তিনি সেই প্রথম বাংলাদেশে গিয়েছিলেন কোরিওগ্রাফির কাজে----আগে যতবার Text Box:             হাতীর মুখোমুখি আকরাম খান গিয়েছেন ততবারই হয় জীবন নয় মৃত্যুর কাজে, অর্থাৎ হয় বিয়ে উপলক্ষে নতুবা কারো কুলখানি-চল্লিশা তাঁর সঙ্গে ছিলেন কবি কার্তিকা নায়ার আর ইপ-হালস-জসেলিন পুকসহ ছবি নির্মাণের পুরো দলটাই ওদের সবার সঙ্গে তিনি তাঁর দেশটিকে নতুন করে, তাঁর শিল্পীমনের চোখ দিয়ে, তাঁর প্রাণের রুদ্ধ পিপাসার দৃষ্টি দিয়ে, দেখতে চেয়েছিলেন মোট কথা, তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন সে-দেশটিকে  নিজের মত করে আবিষ্কার করার আশাতে সেখানে গিয়ে রাস্তাঘাট ও লোকজনদের ছবি তুলছিলেন একাধারে, পশ্চিমের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী কারো অনুমতির অপেক্ষা না করেই সামনে পড়ল একটি অর্ধনগ্ন বালক আকরাম তার ছবি তুলে নিলেন বেশ ক’টি তাঁর ছবি তোলা শেষ হতে-না-হতেই, অবাক অবাক, ওই ছেলেটিই তার পকেট থেকে একটা ফোন ক্যামেরা বের করে আকরামের ছবি তুলতে শুরু করল দৃশ্যটা খুব অসাধারণ মনে হল তাঁর কাছে শিল্পী আকরাম কি এক দুর্বোধ্য উপায়ে ছেলেটির মাঝে নিজেরই একটা সূক্ষ্ম প্রতিবিম্ব দেখতে পেলেন দুজনের চোখে তো একই কৌতূহল---দুজনই দেখছে, খুঁজছে, আবিষ্কার করতে চাইছে এই আইডিয়া থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ‘দেশ’ এর সেই মিছিলের ছেলেটির অনুকরণে তাঁর নিজের মুষ্ঠিবদ্ধ হস্ত উত্তোলন
ছোটবেলার সেই নির্বোধ সময়গুলোতে বাবার-মুখে-শুনতে-না-চাওয়া গল্পগুলো আজকে, এতকাল পর, যখন গল্পের পাত্রপাত্রীদের রূপকথার চরিত্র বলে আর মনে হয়না, তখনই, বিচ্ছিন্নতা আর একাকিত্বের নিবিড়ে নির্বাসিত শিল্পী তাঁর বিমোহিত দর্শকদের নিয়ে যান সেই হারানো গল্পের কল্পরাজ্যে, যেখানে প্রতিটি বস্তুই কি এক জাদুর স্পর্শে শতগুণে বৃদ্ধি পেয়ে যায় কলেবরে বাস্তব হয়ে যায় অধিবাস্তব একটা দৃশ্যে আমরা দেখলাম তাঁর মধু খেতে ইচ্ছে হয়েছে কিন্তু মধু তো বাজারে চলে গেছে বিক্রি হবে বলে এখন মধু পেতে হলে মৌমাছির শরণাপন্ন হতে হবে তখন তিনি নিজেই মৌমাছি হয়ে যান মৌমাছির মত পাখা ঝাপটাতে থাকেন কথক নাচের ভঙ্গিতে কথক তাঁর রক্তের মধ্যে, বরাবরই তা বলেন তিনি সংসারের সবকিছুকেই তিনি কথকের চোখ দিয়ে দেখেন তাই কন্টেম্পরারি নাচের ভেতরও প্রায়ই একটি-দুটি কথক মিশে যায়, সেটি তিনি অকপটে স্বীকার করেন আরেকটি দৃশ্যে ইশিতার জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছিলেন কিন্তু ফিতে আর ফিতে থাকে না-----প্রথমে একটি লতানো গাছ, তারপরি একট বড় ডাল হয়ে ক্রমাগত উর্ধমুখি হতে থাকে সেই উর্ধ চলে যায় সীমাহীন অন্তরীক্ষতে শিল্পী আকরামের কল্পনা যেন মহাশূন্যেরই এক নিঃসংগ সারথি
দেশে যাবার পর প্রথমেই চোখে পড়ে তাঁর চরম বিশৃংখলা এবং তারই মাঝে খুঁজে পান তিনি এক সৌম্য সুসাম্য আধুনিক বিজ্ঞানে যেমন আমরা নিত্যই বলে থাকি ক্যায়সের মাঝে হার্মনির কথা-----চূড়ান্ত এলোমেলোর মাঝেই পরম ঐকতান, যা প্রকৃতিরই আপন ধর্ম নগরের রাজপথে যে উন্মত্ত কোলাহল তিনি দেখেছেন সেটাই যে বাংলাদেশ নয়, তা তিনি নিজেই আবিষ্কার করেছেন সেই দেশেরই বৃক্ষলতা পত্রপুষ্পশোভিত প্রকৃতির দুয়ারে গিয়ে, যেখানে তিনি দেখেছেন আকাশভরা মেঘ, ঢেউ খেয়ে খেয়ে চলছে তারা এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে, দেখেছেন অঝোর অঢেল বৃষ্টি, বর্ষার Text Box:   Text Box:            'দেশ'এর একটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য জলে ভেসে যাওয়া পথঘাট প্রান্তর ঘন অরণ্যের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের ভেতর তিনি নিজেকে পেয়েছেন এক বিভ্রান্ত, বিস্মিত বিমোহিত বালকের মত সেখানে শ্বাপদ জন্তুদের নিত্য আনাগোনা, সেখানে প্রকাণ্ড অজগর পেঁচিয়ে ধরে বড় বড় গাছের ডাল, সেখানে বর্ষার ক্ষুরধার স্রোতে টলমল করে কাঠের নৌকা, সেখানে বৃষ্টি নামে গানের মত শব্দ করে, ইচ্ছে হয় তিনিও সেই বৃষ্টির সাথে অঝোর ধারায় বর্ষিত হতে থাকেন উপর থেকে দুলতে থাকেন ঝুলতে থাকেন শূন্যে, মহাশূন্যে সেসব অলীক অপরূপ দৃশ্যগুলো আমরা ভোগ করতে পেরেছিলাম আকরাম খানের কাব্যিক কল্পনা আর তাঁর সহযোগীদের অসাধারণ কারিগরি নৈপুণ্যের সহায়তায় হলভর্তি এতগুলি মানুষ আমরা পুরো দেড়টি ঘন্টা দম ফেলতে ভুলে গেলাম, আমরা নিজেদের অজান্তে অলক্ষে চলে গেলাম ভূলোক থেকে দূর দ্যুলোকে আকরাম খানের মত করেই আমরা যেন ঝুলতে থাকলাম মেঘের রাজ্য থেকে, ঝরতে থাকলাম অবারিত বারিধারার মত
অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ দৃশ্যটিতে তিনি আবার সেই কবরের পাশে উপস্থিত এবং হাতে সেই একই হাতুড়ি এবারও ঠিক একই ভাবে হাতুড়ি পেটাচ্ছেন একবার, দুবার, বহুবার কিন্তু এবারের পেটানো আর সেই প্রথমবারের পেটানো এক নয় এবার তিনি গাছটিকে উপড়াতে চাচ্ছেন না, মাটিতে গুঁজে দিতে চাইছেন পুনরায় এবার তিনি বোঝাপড়া স্থাপন করে ফেলেছেন তাঁর অতীতের সাথে সন্ধি হয়ে গেছে অতীতের সঙ্গে, স্মৃতির সঙ্গে এবার তিনি স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন এবার, হে অতীত, তুমি কেবল ইতিহাস হয়েই বিরাজ করতে থাকো
আকরাম খান নৃত্যমঞ্চের এক অবিশ্বাস্য জাদুকর, নিঃসন্দেহে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমরা সাত আটশ’ দর্শক একরকম যন্ত্রচালিত অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে গেলাম তৎক্ষণাৎ----করতালিতে ফেটে পড়ল বিরাট প্রেক্ষাগৃহ আকরাম খান স্টেজে এসে বিনয়নম্র সৌজন্যের সাথে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আড়াল হলেন পর্দার পাশে কিন্তু করতালি তখনই থেমে যায়নি মুহুর্মুহু বেজে চলল এভাবেই  সবাই জানিয়ে দিলেন তারা কতখানি আনন্দ নিয়ে যাচ্ছেন সেখান থেকে--একবার, দুবার, তিনবার একটা অনন্য সন্ধ্যার ঘোর তখন আমাদের দেহেমনে অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে থাকল আমার অপরূপা দেশটির গান কবিতা গল্প আর বৃষ্টি
                               
                             চার

আগেই ঠিক করা ছিল সব আমাদের সাতজনের মাঝে চারজন চলে গেল মনির গাড়িতে করে, বাসায় গিয়ে খাবারদাবার তৈরি করবে আমি অহনা আর অমিয়াকে নিয়ে চলে গেলাম স্টেজের পেছনদিকে, আকরামকে তুলে নেব বলে সেখানে রীতিমত ভিড় জমে গেছে ইতোমধ্যে লোকজন এসেছে ওর সঙ্গে দেখা করতে, করমর্দন করতে, অটোগ্রাফ নিতে, কেউবা টুকিটকি আলাপ করতে আমরা অপেক্ষা করে থাকলাম ঘরের বাইরে অহনা-অমিয়া দুই বোন তখনও যেন স্বপ্নের ঘোরে আবিষ্ট হয়ে আছে----এমন অভিজ্ঞতা তাদের আগে হয়নি কখনো
বাসায় গিয়ে পৌঁছুলাম যখন ঘড়িতে সোয়া নয়টা ক্ষিধে পেয়ে গেছে সবারই সবচেয়ে বেশি নিশ্চয়ই আকরামের---পরিশ্রমটা তো ওরই হয়েছে সবচেয়ে বেশি পাকা আশি মিনিট ধরে একা একা নেচে যাওয়া এতগুলো লোকের সামনে, এবং কঠিন শারীরিক পরিশ্রমের আধুনিক নাচ---যে কোন লোকের পক্ষে কাবু হয়ে যাবার কথা কিন্তু আকরামকে দেখে তা মনে হল না, মনে হল যেন জিম থেকে একটা ওয়ার্কআউট করে এসেছে মাত্র, তার বেশি নয় ও যে আমাদের মত সাধারণ নাম-না-জানা ব্যক্তি নয় সেটা তো নতুন করে বলতে হবে না কাউকে আমার মত নগণ্য লোকের বাড়িতে এসে একবেলা খেতে রাজি হওয়াটাই এক বিরাট ব্যাপার সৌভাগ্যবশত আমাদের পরিচয়ের সূত্রটা পারিবারিক সেই যে বললাম ওর মা আমার প্রিয় শিক্ষকের মেয়ে তদুপরি আমার লণ্ডনবাসী বোনের মেয়ে সুহানা কথক শিখেছে আকরাম খানের কাছে ওই পরিচয় আস্তে আস্তে দানা বেঁধেছে
আমার বাড়ির অন্যান্য অতিথিরা, আকরামকে কিভাবে আদরযত্ন করবে, কিভাবে তার সঙ্গে কথা বলবে, লোকটা অহঙ্কারি কিনা, নাক উঁচু ভাব আছে কিনা তার, থাকাটা খুব অস্বাভাবিকও নয়, সেসব প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঁকি দিয়েছিল ওদের মনে কিন্তু ওকে দরজায় ঢোকার সময়তেই হয়ত ওরা বুঝতে পারল এই লোকটাকে নিয়ে ওসব ভাববার কোনও কারণ নেই আকরাম সত্যি সত্যি একটি ‘ফলভারে অবনত বৃক্ষ’ এমন নম্র ভদ্র অমায়িক স্বভাবের মানুষ আপনি কচিৎ কদাচিৎ পাবেন সংসারে ও ঘরে ঢুকেছে অত্যন্ত সরল সাধারণ পোশাক পরে তার বিখ্যাত টেকো মাথাটির প্রতি স্বভাবতই সে খুব যত্নবান----খুব ঠাণ্ডা ছিল না সেদিন তবু গরম টুক দিয়ে আঁট করে ঢেকে রেখেছে কথা বলে খুব নিচু গলায়, প্রায় ফিসফিস শব্দে ওকে এক সাংবাদিক একবার প্রশ্ন করেছিলেন বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার কিরকম সম্পর্ক তা নিয়ে আকরাম উত্তরে বলেনঃ “ আমি কক্ষণোই সমাজের কারো সঙ্গে জোর গলায় কথা বলিনি”
বিস্মিত সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, কেন আকরামের সোজা জবাবঃ “কারণ তাতে অসম্মান হয় লোকটার”
বিস্মিত শুধু সাংবাদিক ভদ্রলোকটিই হননি, আমিও হয়েছিলাম ওটা পড়ে লণ্ডনে জন্মানো এ-প্রজন্মের কোন ছেলের পক্ষে এতটা বিনয়নম্র স্বভাব যে আদৌ সম্ভব সেটাই কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয় সুতরাং আমার বাসাতে আকরামের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে কথা বলাতে কোন সমস্যা দাঁড়াবার প্রশ্নই ওঠে না তাই অতি অল্প সময়ের মাঝেই ওরা সবাই হাজার রকমের গল্পে মজে গেল ততক্ষণে সেরীন-ফেরদৌস আর মনিকার খাবার টেবিলে সব প্রস্তুত আকরাম যে পুরোপুরিই বাঙালি এবং সম্ভবত একেবারে ভেতো বাঙ্গালি তার প্রমাণ পাওয়া গেল তার খাবারের প্লেট দেখেই দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাঝে এটা কিন্তু বেশ বিরল---বাবামা দেশী খাবার খেলেও ছেলেমেয়েদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা Text Box:           বাঁ থেকেঃ সেরীন, আকরাম ও ফেরদৌসরাখতে হয় আকরামের বেলায় তার ব্যতিক্রম দেখার কারণ কেবল তার বাবামার শিক্ষাই হয়ত নয় বিয়ের আগ পর্যন্ত তিনি বাবামার সাথেই থাকতেন, এবং একই খাবার খেতেন, নিজের পছন্দেই খেতেন, সেটা আমি আগেই জানতাম অতএব তার আগমন উপলক্ষে দেশী খাবারের আয়োজন করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি খাওয়াদাওয়া সারা হলে পাকঘরের সিঙ্কে প্লেট রাখতে গিয়ে আকরাম ফেরদৌসকে বলেনঃ আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন ফেরদৌস তো হতবাক----এতবড় একটা মানুষ ওকে বলছে তুমি করে বলতে, শুধুমাত্র কিছু বয়সের ফারাক থাকার কারণে? এতেই বোঝা যায় কোন দরজার মানুষ আমাদের বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি শিল্পী আকরাম খান
মনি আর সেরীন দুজনেরই সামান্য সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা অতএব দুজনের হাতেই লম্বা ফর্দ প্রশ্নের আকরাম মোটামুটি সবগুলো প্রশ্নেরই জবাব দিয়ে গেলেন ভদ্র নম্রভাবে, সৌজন্যের সাথে ওর প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতেও একটা নিজস্বতা আছে কঠিন বিষয়টিকেও অত্যন্ত সহজ করে বুঝিয়ে দিতে পারে শৈল্পিক ব্যাপারগুলোতে ওর দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনও আঁকাবাঁকা পথ খোঁজার প্রয়াস নেই---সবকিছু একেবারে জলের মত পরিষ্কার তার কাছে যেসব দৃশ্য একটা আপাত অর্থ নিয়ে দেখা দেয় আমাদের চোখে সেখানে তিনি একটা প্রতিকী তাৎপর্য তুলে ধরেন আমাদের কাছে আসলে সমসাময়িক নৃত্যকলার বৈশিষ্ট্যিই বোধ হয় তাই----অনেকটা আধুনিক কবিতা বা আধুনিক ছবির মত যা প্রতীয়মান বা দৃশ্যমান তা’ই তার বক্তব্য নয় এসম্বন্ধে আকরাম খানের প্রযোজক, অন্তরংগ বন্ধু, পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ফারুক চৌধুর্‌ যাকে আকরাম তার “আপন ভাই আর প্রাণের বন্ধু” বলে মনে গণ্য করেন, এবং যে নিজেও একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ নৃত্যশিল্পী, একবার বলেছিলেনঃ “ আধুনিক নৃত্যশিল্প আর ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পের তফাৎটা খানিক আধুনিক কবিতা আর গদ্য সাহিত্যের পার্থক্যের সঙ্গে তুলনীয়ঃ গদ্যের একটা একক অর্থ থাকে, যা আধুনিক কবিতায় থাকে না----কবিতার গূঢ় অর্থটি একেক পাঠকের কাছে একেকভাবে প্রকাশ পায় আধুনিক নাচও তেমনি একেক দর্শকের চোখে একেক রূপে দেখা দেয়” এই কথাগুলি আকরাম যত সহজে বোঝাতে পারে্ন মানুষকে অন্য কাউকে ততটা সহজভাবে বোঝাতে দেখিনি আমি
প্রায় ঘন্টাতিনেক চলল আমাদের ঘরোয়া আড্ডা তখন আর কোন বেড়াই থাকল না কে কত বড় কে কত ছোট---কেউ কারও চেয়ে ছোট বা বড় নয় আমরা সবাই মানুষ, আমরা সবাই আমাদের দেশকে ভালোবাসি, এবং সেই গণ্ডীবদ্ধ ভালোবাসার মধ্য দিয়েই আমরা ভালোবাসতে শিখেছি পৃথিবীর আপামর মানবজাতিকে আকরাম তার ‘দেশ’এর মধ্য দিয়ে যেমন দেখিয়েছেন সংসারের আরো অনেক দেশের মানুষকে, আমরাও তেমনি সেই মোহন রাত্রির আনন্দ মদিরার মাঝে দেখতে পেলাম বৃহত্তর মানবজাতির আনন্দবেদনার একক মূর্তিকে
বিদায় নেবার আগে আকরাম কথায় কথায় একটি চমৎকার গল্প শুনিয়ে গেলেন আমাদের একবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন অনুষ্ঠান করতে অনুষ্ঠান শেষ হবার পর হল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি করে হোটেলে ফেরার উদ্যোগ নেন সামনে ট্যাক্সি দাঁড়ানো ট্যাক্সিওয়ালা দরজা খুলে দেয় তার জন্যে তিনি ঢুকবেন ট্যাক্সিতে ঠিক ঐ মুহূর্তে ঝাঁ করে ট্যাক্সির খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল একটি মধ্যবয়সী শ্বেতাংগ দম্পতি কোনরকম মাপজোক চাওয়ার বালাই নেই, যেন এ’ই তাদের জন্মগত অধিকার, কালোরা দরজা খুলে দেবে, আর সাদারা কষ্ট করে তাতে ঢুকবে কেবল! অপমানে রাগে আকরামের গা জ্বলে যাচ্ছিল চোখে পড়ল আরেকটি ট্যাক্সি থামতে বললেন ওকে ট্যাক্সিতে পা রেখে ওর হঠাৎ করে দারুণ ইচ্ছে হল বাবাকে ডাকতে তার সেলফোনে বাবাকে পেয়ে গেলেন এক চেষ্টাতেই কথা বলছেন বাবার সঙ্গে, হয়ত তার ট্যাক্সিগত তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতেই এমন সময় তার দ্বিতীয় ট্যাক্সির ড্রাইভারটি ফোঁড়ন কেটে জানতে চাইলেন “আপনার বাবার বাড়ি কোথায়”, কারণ আকরামের কথাবার্তা থেকেই টের পেয়েছিলেন ওর বাবার নাম মোশাররফ হুসেন খান আকরামের তখন মেজাজ খারাপ আমার বাবার বাড়ি জেনে আপনার দরকার কি? আহা, বলুন না, কোথায়? দরকার আছে আকরাম তাতে আরো বিরক্ত হয়ে ভাবলেন ঠিক আছে মিয়াসাহেব, আমাকে হোটেলে নিতে হবে না, এখানেই নামিয়ে দিন ড্রাইভার এবার একটু নরম সুরেই বললেন, গ্রামের নাম জানলে আমার মনের একটা পুরনো ধাঁধা দূর হতে পারে, তাই তখন আকরাম তার বাবার গ্রামের নাম বললেন ড্রাইভারকেঃ আলগীর চর তারপর এক অবিশ্বাস্য ঘটনা স্বভাবতই সেই ড্রাইভারটি বাংলাদেশ থেকে আসা গ্রামের নাম আর তার বাবার নাম শোনামাত্র লোকটি ছোট বাচ্চার মত ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করলেন সেকি, আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে? আকরাম একটু অপ্রস্তুত হয়ে যা্ন---- একটা বয়স্ক মানুষ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠা হঠাৎ করে, নিশ্চয়ই গুরুতর কোনও কারণ আছে তখন ভদ্রলোক বললেন সবটা গল্প আজ থেকে বহু, বহু বছর আগে যখন এই ট্যাক্সি ড্রাইভার আর তার বাবা একই গ্রামের একই পাড়াতে বাস করতেন, গভীর বন্ধুত্ব ছিল দুজনের মাঝে, এতটাই বন্ধুত্ব যে একজনের ভালোর জন্যে আরেকজন তার সর্বস্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তখন একটা সুযোগ এসে যায় বিলেতে গিয়ে চাকরি নিতে কিন্তু কেবল একজনই যেতে পারবে, দুজন নয়, এবং নিজের খরচে যেতে হবে দুঃখের  বিষয় যে ওই সামর্থ্যটি দুজনের বাবাদের কারুরই ছিল না দুজনের মাঝে ছাত্র হিসেবে আকরামের বাবাই ছিলেন একটু মাথাওয়ালা তখন সেই বন্ধুটি নিজের উদ্যোগে, টাকা ধার করে, বন্ধুকে বললেন, তুমিই যাও দোস্ত, আমার তো গোবর মাথা, তার চাইতে বিলেতে গিয়ে তুমিই পারবে উন্নতি করতে সেই বন্ধুর ধার-করা টাকা নিয়েই বিলেতে এসেছিলেন আকরাম খানের বাবা তারপর কেমন করে যেন, জীবনের নানা টালমাটাল স্রোতের টানে ভেসে ভেসে একে অন্যের সূত্র হারিয়ে ফেলেছিলেন একসময় কেউ জানতে পারলেন না কে কোথায় আছে
গল্পটি আকরাম খান পরের দিন হলভর্তি দর্শকদের কাছে বর্ণনা করেছিলেন অনেকে তখন বললেন ওকে যে সেই অভদ্র দম্পতিটি আসলে ছিলেন তার দৈবদূত, ট্যাক্সির ব্যাপারটা ছদ্ম ঘটনামাত্র
সেদিন আমার বাসার ঘরোয়া ভোজানুষ্ঠানে আমরা ক’টি গুণমুগ্ধ বাংলাদেশী আকরাম খানের একটি প্রচণ্ডরকম মানবিক মূর্তির পরিচয় পেয়ে ধন্য হলাম উচ্চমার্গের গুণিজনেরা সবসময় উচ্চমানের মহৎ ব্যক্তি হয়না আকরাম খানের মাঝে সেদিন তার বিরল ব্যতিক্রম দেখে আমাদের মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল

অটোয়া, ৩০শে নভেম্বর, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২




Text Box:

No comments:

Post a Comment