ছবি: ফেসবুক
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জাতীয় শ্লোগান ছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ যার মানে পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক। চব্বিশ বছর পর পাকিস্তান যখন ভাঙ্গতে বসেছিল তখন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শ্লোগান হয়ে দাঁড়াল ‘জয় বাংলা’ যার মানে বাংলার জয়। শেষে হলও তাই, পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হল না অথচ বাংলাদেশের জয় হল।
১৯৬৯ - ৭১ এই সময়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে বাংলাদেশ। তারপর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতেই চিরতরে হারিয়ে যায় পাকিস্তানের পূর্ব অংশ, সেটাই এখন বাংলাদেশ। নতুন দেশের জন্য পতাকা ঠিক করা হল দেশ স্বাধীন হবার আগে, যুদ্ধ শুরু হবার আগেই বলে দেয়া হল শত্রু মোকাবেলার পথ। দেশ দাঁড়াবে চার স্তম্ভের উপর এমন নীতিও চূড়ান্ত। অবস্থা যখন এ ভাবেই গড়াচ্ছিল তখন জাতীয় সঙ্গীত কেন বাদ যাবে। তাই স্বাধীনতার ডাক দেবার আগেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণা করা হয়েছিল।
শোনা যায় জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচনে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটি অনেকের পছন্দের তালিকায় ছিল। যেসব কারণে এই গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয় নি তার অন্যতম কারণ সম্ভবত ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ এই লাইনটি। পাকিস্তান আমলেই মহাশ্মশান অংশটুকু বদলিয়ে গোরস্থান উচ্চারণে গাওয়া হতো, তাই বাঙালি মুসলমান তাঁদের জাতীয় সংগীতে মহাশ্মশানের মত শব্দ মেনে নিতে রাজি হতো বলে মনে হয় না। এছাড়াও এই গানের কিছু শব্দ যেমন; ‘নিম্নে উতলা’, ‘ধরণী তল’, ‘অরুণ প্রাতে’, ‘বাধার বিন্ধ্যাচল’ এসব কঠিন উক্তির মানে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। চোখে বন্ধ করে অন্তরের গভীর থেকে গাইতে না পারলে জাতীয় সঙ্গীতের প্রভাব অনেকখানি বিলীন হয়ে যায়। অন্য সব গান দেখে দেখে গাওয়া চলে কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হয় চোখ বুজে, কাজেই এই সঙ্গীত সহজ সরল হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণে আরো কয়েকটি গানও আলোচনাতে এসেছিল। যেমন, ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’। তবে, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা এবং আনোয়ার পারভেজের সুর করা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির কথা তখন বেশ বলা হতো। স্বাধীনতার শ্লোগান ‘জয় বাংলা’র সাথে মিলে গেলেও জাতীয় সঙ্গীতের পুরো আবেদন এ গানে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। বিপ্লবী গান বা বাম পন্থি গান বলে গানটিকে অনেকে পছন্দ করতেন, আবার অনেকের মতে এটা মানবতার গান (‘চারিদিকে শুনি আজ নিদারুণ হাহাকার আর ওই কান্নার শব্দ’)। এ গানে শোষণ আর বঞ্চনার একটি চিত্র এবং মানুষের মুক্তি সন্ধান পাওয়া গেলেও (‘বাংলার প্রতি ঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে’) দেশের সনাতন চিত্র খুব সামান্যই ধরা পড়েছে। গানের একটি অংশে ‘মা- বোনেদের পরনে কাপড়ের লেশ নেই’ জেন্ডার সমতা রক্ষা হয়নি। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই সমস্যায় পড়েছে কানাডার জাতীয় সঙ্গীত। ‘True patriot
love in all thy sons command’. এই sons শব্দটি আছে বলে কানাডার প্রগতিশীল মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে জেন্ডার বিভেদ থেকে জাতীয় সঙ্গীতকে মুক্ত করতে।
কথা হল সঙ্গীত গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুশ্রুত একটি দেশের গানকে কেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল? দেশকে নিয়ে গান লেখা আর গানের মধ্যে দেশকে তুলে ধরার মধ্যে যে পার্থক্য সেটা বিচার করলে দেখা যায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির স্তরে স্তরে বাংলাদেশ লুকিয়ে আছে। গ্রাম বাংলার রূপ কবির মনকে ভীষণ ভাবে নাড়া দেবার ফলশ্রুতিতে একাধিক রচনায় তিনি বাংলার সৌন্দর্য ও মহিমা তুলে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বহু দেশ ঘুরেছেন বলেই বহু দেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন এবং এই অভিজ্ঞতা তাঁকে অনেক ভাবে প্রভাবিত করেছিল কিন্তু দেশের জন্য তাঁকে যখন গান লিখতে হত তখন তিনি বারবার বাংলাদেশের কাছেই ফিরে এসেছেন। যেমন ধরুন;
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী। ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে।’
‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’... ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।’
‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। সার্থক জনম, মাগো তোমায় ভালোবেসে।’
‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা।’
রবীন্দ্রনাথ যখন দেশের জন্য গান লিখেছেন তখন দেশ ছিল বিদেশীদের হাতে বন্দী । পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পিতা থাকেন অধিপতি, তিনি বহির্মুখী। তাই পরিবারের অন্দর মহলে সন্তান বেড়ে ওঠে মায়ের আদর স্নেহে। মায়ের যত্ন পেয়ে বেড়ে ওঠা পরাধীন দেশের সন্তান তার মায়ের মলিন বদনে আবিষ্কার করে দেশের প্রতিচ্ছবি। মা’কে আগলে রাখা আর দেশকে আগলে রাখা তখন তার কাছে সমান মনে হয়। এটা রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব চিন্তা নাকি সাধারণ দেশবাসীর অনুভূতির অনুরণন সে কথা বলা মুশকিল তবে, বাস্তবতা হল রবীন্দ্রনাথ জন্মভূমিকে সেই মায়ের জায়গাতেই স্থান দিয়ে লিখেছিলেন দেশের গান। যেমন;
‘মনের আশে দেশ বিদেশে, যে মরে সে মরুক ঘুরে
তোমার ছেঁড়া কাঁথা আছে পাতা, ভুলতে সে যে পারব না মা!’
তাঁর কবিতা ও গানে যে ভাবে দেশের ছবি ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের জীবন ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে সেরকম সহজ সরলই ছিল। বাংলাদেশের মানুষকে নদীর শান্ত রূপের সাথে তুলনা করা হত। নদী-নালা, খাল-বিল, গ্রাম-গঞ্জের নাম করণের মধ্যে যেমন মিষ্টতা তেমনি মিষ্টি ছিল বাঙালির স্বভাব চরিত্র। বাংলাদেশের ফুল ফল নদী পাখির নাম শুনে সকলে বলে, আহা কি চমৎকার সব নাম। হয়তো বাংলাদেশের মানুষগুলোও মন সুন্দর ছিল বলেই মধুমতী হয়েছে নদীর নাম, ফুলের নাম সন্ধ্যা মালতী। এই সুন্দর মনের জন্ম মায়ের নরম ভালোবাসা থেকে পাওয়া। এমনও সময় ছিল যখন বাঙলা মায়ের সন্তানেরা মায়ের আঁচল ছেড়ে কোথাও যেত না। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন; ‘হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে। দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান। পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভাল ছেলে করে।’ এই যখন সন্তানদের অবস্থা তখন তিনি-ই আবার লিখলেন ‘মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।’ এ কথা সত্য যে, প্রয়োজনের তাগিদে বাঙালিরা বিদ্রোহ করেছে, হিংস্র অ-হিংস্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছে কিন্তু তাই বলে যোদ্ধা বা উগ্র জাতীয়তা বোধ কখনোই বাঙালি জাতীয় পরিচয়ের সাথে মিল খায় না। কাজেই এমন একটা জাতীর জন্য জাতীয় সঙ্গীত কি হতে পারত যাতে রণ হুঙ্কার থাকবে না, যুদ্ধে বিদ্রোহের ঢাক ঢোল থাকবে না এমন কি রাজা বাদশাহ বা ঈশ্বর বন্দনায় ভরপুর হবে না সেই সঙ্গীত। এই সব প্রয়োজন মেটাতেই বোধ করি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি নির্ধারিত হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে।
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতে দেশপ্রেম ও দেশের গৌরব গাঁথা নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা লেখা থাকে। তার সাথে থাকে রাজা-রানীর সুরক্ষা এবং ঈশ্বর-ভগবানের কৃপা কামনা। এসব কারণে জাতীয় সঙ্গীত দাঁড়িয়ে গাইবার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়ে গেছে। আবার কিছু কিছু দেশে গণ্যমান্য কবি সাহিত্যিকদের আশাবাদী রচনাও জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত মনোনয়নে একটু ভিন্নতা আছে এবং জাতীয় সঙ্গীত মনোনয়নে বাঙালিদের যে একটা বাহবা পাবার স্থান আছে সেটা সকলের জানা প্রয়োজন। এই সঙ্গীত কাউকে দিয়ে লেখানো হয়নি যেমন অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘কওমি তাড়ান’ ৭২৩টি রচনার মধ্য থেকে নির্বাচন করা হয়েছিল। বাংলাদেশেকে এই প্রতিযোগিতায় যেতে হয়নি কিংবা কাউকে অনুরোধ করেও জাতীয় সঙ্গীত লিখতে হয়নি। বাংলাদেশ যখন ভারতের অংশ ছিল সে সময়কার লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি দেশের গান ছিল ‘আমার সোনার বাংলা’। কোলকাতায় রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলেও জীবনের একটি মূল্যবান সময় তিনি কাটিয়েছিলেন বর্তমান বাংলাদেশে। বাউল গগন হরকরার একটি গান সেই সময় তাঁর খুব পছন্দ হয়ে যায়। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন বাংলা অঞ্চলকে পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব বঙ্গ (এখনকার বাংলাদেশ) এই দুই ভাগে ভাগ করে দেয় তখন বাঙালিরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই আন্দোলনের পক্ষে প্রতিদিন লেখা হত নতুন নতুন গান কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই সময় বেশ কিছু গান রচনা করেছেন। মনের ভেতর গেঁথে থাকা বাউল গগন হরকারের ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে-‘ সেই গানটির সুরের সাথে মিল রেখে রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন বিখ্যাত গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ লেখার পর অনেক রাজনৈতিক পালা বদল হয়ে গেল। দুইশ বছর দখলদারি শেষ করে ইংরেজরা তাঁদের নিজ দেশ ইংল্যান্ড চলে গেল। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান নামের আর একটি রাষ্ট্র বানানো হল। অখণ্ড বাংলা ভেঙ্গে দুই ভাগ করা হল। পশ্চিম বঙ্গ পেল ভারত আর পূর্ব বঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে) নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেল। দেশ ভাগ হল, বাংলা ভাগ হল তাই বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরদেশী হয়ে গেলেন না। বাংলাদেশে তার শ্বশুর বাড়ি, বাংলাদেশে তার জমিদারি, বাংলাদেশে তার সহায় সম্পত্তি ছিল। রাষ্ট্র ভাগাভাগির সাথে সাথে তাঁর সব কিছু ভাগবাটোয়ারা হল কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টিকে বাংলাদেশের মানুষ ভাগাভাগি থেকে রক্ষা করল। তিনি একই সাথে ভারতীয় এবং বাংলাদেশের হয়ে রইলেন। এমন হবার পেছনে কিছু কারণও ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল মুসলিম লীগ নামের একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে। জন্মলগ্ন থেকে মুসলিম লীগ সরকার সবকিছুকে মুসলিমী করার চেষ্টায় করেছিল। তারা মানুষদের বোঝাতে চেষ্টা করল, একজন ভারতীয় ও একজন অমুসলিমের গান কেন মুসলিম দেশে গাওয়া হবে। পাকিস্তান সরকার হিন্দু-মুসলিম এবং পাকিস্তান-ভারত এই দুই ভিন্ন জাতিসত্তার প্রচার চালিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বাতিলের চেষ্টা চালিয়ে গেল। লক্ষণীয় বিষয়, পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত যিনি লিখেছিলেন সেই হাজেফ জুলান্দ্রীও ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জুলান্দ্রীর সৌভাগ্য এই যে পাকিস্তান-ভারত ভাগাভাগির পর জন্মস্থান ত্যাগ করে ১৯৪৭ সালে তিনি পাকিস্তানে চলে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন মারা যান (১৯৪১) তখন পাকিস্তান নামে কোন দেশ ছিল না, সবটাই ছিল ভারত। অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর পরই দেশ ভাগ হয়েছিল। মৃত ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব দেয়ার বন্দোবস্তের ফাঁদে তাই বাঙালিরা পা দিল না। কেনই বা দেবে! রবীন্দ্রনাথের সমাধি স্থান ভাগ হয়েছে তাঁর কাজ নয়। তাঁর বহু সৃষ্টি বাংলাদেশের মাটি থেকেই এসেছে। বাংলাদেশের নদীর পানিতে ভেসে ভেসে নগর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে প্রবেশ করেছিল গ্রাম বাংলার ছায়াঘন রূপ। তিনি নগর জীবনের সাথে সাথে সোনালি ফসলের রূপ দেখে ষোল আনা বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে না এলে তিনি হয়তো বাঙালি কবি না হয়ে ভারতীয় কবি হয়ে যেতেন কি না সেটাও ভাবার বিষয়। কাজেই যে মাটি তার সন্তানকে বিশ্বকবি হতে রসদ যুগিয়েছিল তাকে কেন সীমান্তের খুঁটি দিয়ে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে বিশ্বকবির স্বীকৃতিতে বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশ সমান ভাবে অংশীদার। এই বোধ থেকেই রবীন্দ্রনাথকে ভৌগোলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে রেখে বলা হয় বাংলার কবি। এখনো নব্য মুসলিম লীগ ঘরনার বুদ্ধিজীবীরাও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে একাধিক খুঁত ধরার কাজে ব্যস্ত। তাঁরা বলেন জাতীয় সঙ্গীতে উচ্চারিত ‘মা’ (‘ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’) হিন্দু ধর্মের দেবী মায়ের থেকে এসেছে কাজেই এই জাতীয় সঙ্গীতকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এখনো কিছু কিছু লোক হিন্দু কবি, মুসলিম কবির তর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন। অথচ মুসলিম কবি মোহাম্মদ ইকবালের ‘সারে যাঁহা সে আচ্ছা - হিন্দুস্থান হামারা’ গানটি যখন ভারতে জোরেশোরে গাওয়া হয় তখন বাংলাদেশের মুসলিম লীগ ঘরনার বুদ্ধিজীবীরা হিন্দু কবি মুসলিম কবির তর্কটা সুকৌশলে এড়িয়ে চলেন।
‘আমার সোনার বাংলা’য় ব্যবহারিক ‘মা’ মানে যে ‘দেশ’ সে কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে সক্ষম হলেও ধর্মীয় চেতনায় যারা সব কিছুকে দেখেন তারা সেই সত্যটুকু মেনে নিতে পারেন না। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বন্দে মাতরমে (বাহুতে তুমি মা শক্তি, হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি, তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে) জন্মভূমিকে যে ভাবে দেবী মায়ের সাথে তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেটা কোন ভাবেই করেন নি। ‘মা তোর বদন খানি মলিন হলে’ এ কথাতে কি পরিষ্কার হয় না যে দেব দেবীদের বদন মলিন হয় না। তাঁদের দুঃখ বেদনা নেই যেমনটি দেশের থাকে। হুমায়ূন আহমদে যেমন বলেছেন ‘মানুষের আত্মার মতো দেশেরও আত্মা থেকে’ (দেয়াল)। তাছাড়া মানুষ দেবীকে ভালবাসে না, তাঁদের ভক্তি করে এবং পূজা অর্চনা দেয়? অন্যদিকে পৃথিবীর সব দেশের নাগরিকই তাদের দেশকে ভালোবাসে। বাংলাদেশের মানুষও ভালোবাসে তাঁদের দেশকে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। আরেকটা দিক লক্ষ্য করুন, দেব দেবীর বিচরণ কিন্তু সর্বত্র, তাঁরা শুধু আকাশে বাতাসে থাকে না, তারা প্রাণে বাঁশিও বাজায় না। দেব দেবীর ফাগুন অঘ্রান মাস নেই, প্রতিটি দিনই তাঁদের, প্রতিটি ক্ষণই তাঁদের। তবে, দেশের থাকে ফসলের মৌসুম। ফাগুনে আম পাকে, অঘ্রান মাসে ক্ষেত ভরে যায় ফসলে। এগুলো সবই দেশের চিত্র, দেব দেবীর নয়। এতোগুলো কথা এ জন্য বলতে হল কেননা বিশেষ একটি রাজনৈতিক মতের লোকজন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের ‘মা’ নিয়ে নানান সব বিরোধিতা করে যাচ্ছে। এই সমস্ত নিন্দুকেরা আরো কিছু মন্তব্য করেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে। তার মধ্য উল্লেখযোগ্য হল; বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা নেই এই গানে, নেই তাঁদের জীবন ব্যবস্থার কোন বিবরণ। এভাবে ভাবতে বসলে দেখা যাবে আরো অনেক কিছুই নেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে। বাংলাদেশের নামটাই নেই এই গানে। যেমন অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীতে দেশের নাম স্পষ্ট করে লেখা থাকে। সিঙ্গাপুরের জাতীয় সঙ্গীতে বলা হয়েছে, ‘May Singapore
Progress,’ কিংবা কানাডার 'O Canada', পাকিস্তানের বেলায় ‘Arz-e-Pakistan.’ ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে না মানার আর একটি যুক্তি দেয়া হয় এই ভাবে, আশি নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে কেন এমন একটি গানকে জাতীয় সঙ্গীত বলা হবে যেখানে আল্লাহ খোদার নাম নেই। তাঁদের কথা হল ইংল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীতেও বলা আছে, ‘God save our gracious Queen’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে নয় কেন? জাতীয় সঙ্গীত যে ভজন কীর্তন কিংবা নাত হামদ না এ কথাটি বুঝলে তাঁরা হয়তো এমন ভাবে ‘ আমার সোনার বাংলা’র পেছনে লেগে থাকত না। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে বিশ্বস্রষ্টার কাছে নিবেদন এবং প্রার্থনা নেই এই জন্য যে, এই দেশ সব ধর্মকে নিরপেক্ষ ভাবে সমান অধিকার দিয়েছে। ভিন্নতা থেকে কাউকে আলাদা না করে ছোট বড় সকলকে এক সূত্রে গাথা এবং কাছ’কে দূরে না ঠেলে কি করে সাথে রাখা যায় সে চিন্তা থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম। বাংলা ভাষার সাথে মিল রেখে যেমন জাতির নাম হয়েছে বাঙালি জাতি তেমনি বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতে বিরাজমান মিশ্র জাতির অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এখানে বিচিত্রতার সমন্বয় ঘটেছে। তাই ‘আমার সোনার বাংলা’কে মনে করা যেতে পারে ধর্ম গোত্র বর্ণ বিলীন করা এক শিলালিপি। ধর্মীয় অধিকারের কথা বিবেচনা করলে আল্লাহ, যিশু, ভগবান, বৌদ্ধ লিখে সকল ধর্ম বিশ্বাসীদের খুশি করতে হবে। অথচ এই গানে কোন ধর্ম বা গোত্রকে ছোট বা বড় করে দেখা হয়নি। সেটা করা যাবে না বলেই ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল। পুণ্য হউক,পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’ কিংবা ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ এই গানগুলোকে বিবেচনায় আনা হয় নি।
এভাবে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়ত করা যেতে পারে। বাস্তবতা হল ফুলে ও ফসলে, অশ্বত্থের ছায়া ঘেরা পরিবেশে বেঁচে থাকা জনপদের জন্য জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’র চাইতে উত্তম আর কি হতে পারত। রবীন্দ্রনাথের লেখা অন্য একটি গানকে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত করা হয়েছে। সে গানে যেমন জল স্থল সীমানার বহুতা (পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ, বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা ) রয়েছে কিংবা পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতে যেমন ভাষার নানাত্ব (ফার্সি, আরবি, সিন্ধী, পাঞ্জাবী, বেলুচ, পস্তু) দেখা যায় সেখানে স্বাভাবিক কারণে এক ভাষা এক জাতির দেশের জাতীয় সঙ্গীত সুর ও বানীতে নিজস্ব রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে। ডাইভার্সিটি হিসেব কষে গারো চাকমা ইত্যাদি আদিবাসীদের কথা থাকলে ভাল হত তবে জাতিগত বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় কিংবা আঞ্চলিক ভিন্নতার প্রশ্নও তুলতে পারত। যেমন নদীর কথা বলা হয়েছে তাই কিছু মানুষ প্রশ্ন করতে পারত তাঁদের অঞ্চলের পাহার পর্বতের কথা নেই কেন।
পরিশেষে বলা যেতে পারে, দেশ এবং দেশের মানুষের সত্যিকার পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় যে গানে সেটাই দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে সেটা খুঁজে পেতে কোন কষ্ট হয় না। এই গানের কথা, সুর এবং পটভূমিতে ষোলআনা বাংলা ও বাঙালির রূপ ভেসে উঠেছে। যেমন ধরুন; আকাশ, বাতাস, ফাগুন, আম, বন, ঘ্রাণ, অঘ্রান, ক্ষেত, ছায়া, বট, নদী, ইত্যাদি উল্লেখই প্রমাণ করে ‘আমার সোনার বাংলা’ দেহ মানুষ, অদৃশ্য শক্তি কিংবা বীরত্বের বদলে পরিবেশ ও প্রকৃতি পক্ষে সাফাই গেয়েছে। এটাই বাংলাদেশের প্রকৃত পরিচয়। এখানেই জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচনে বাহবা রয়েছে। সুজলা সুফলা ফুলে ও ফলে ভরা চির সবুজের দেশ বাংলাদেশ তার সঠিক জাতীয় সঙ্গীত বেছে নিতে পেরেছে মনে করাটাই যুক্তি সঙ্গত। আর অন্যের উপর বীরত্ব কিংবা আধিপত্য দেখানো হয় নি বলে এই সঙ্গীত সমতা ও শান্তির প্রতীক।
আকতার হোসেন
নাট্যকার ও ছোট গল্প লেখক।
টরন্টো, ওন্টারিও, ক্যানাডা
২০১৪ মার্চ ২৫
Technical Communications: 2015 March 18
Edited & Updated: VCV, 2015 March 18
সৌজন্যে: http://arts.bdnews24.com/?p=5769
No comments:
Post a Comment