মীজান রহমান
আমাদের ডু স্যটয় সাহেব ঠিক এমন সব
আইডিয়া নিয়েই মগ্ন ছিলেন বরাবর। তিনি যখন কেম্ব্রিজে পড়াশুনা করতে যান তখন তাঁর
শিক্ষকদের মাঝে একজন ছিলেন জে এইচ কনওয়ে। আধুনিক গণিতশাস্ত্রে এই কনওয়ে নামটির প্রায় দেবতুল্য সম্মান----একজন
জীবন্ত কিংবদন্তী। গ্রুপ থিওরির অন্যতম শাখা সসীম গ্রুপ। সেই সসীম গ্রুপের
সর্বোচ্চ সংখ্যাবিশিষ্ট গ্রুপের নাম মন্সটার গ্রুপ, বা দৈত্য গ্রুপ। ৫৪ ডিজিটের এই
বিশাল সংখ্যাটি কনওয়ে সাহেব গড়গড় করে মুখস্ত বলে দিতে পারেন---সংখ্যার ওপর এতটাই
দখল তাঁর। তাছাড়া তিনিই তো এই গ্রুপটির অন্যতম জনক। এটা যে নেহাৎ অলস মনের কোনও
কল্পনাপ্রসূত জন্তু তা নয়, এর বাস্তব অস্তিত্বও তাঁরা প্রমাণ করেছেন। কথাটি বলছি
কেন? তার কারণ হল যে স্যটয় সাহেব যখন তাঁর সঙ্গে দেখা
করতে যান কেম্ব্রিজে তখন তিনি উপদেশ দেনঃ “ তুমি যদি সত্যি সত্যি সিমেট্রি শিখতে
চাও বাপু তাহলে স্পেনে গিয়ে গ্রানাডার প্রাসাদটি দেখে এসো। দেখবে, সেযুগের মুর
মুসলিমরা কি সব আশ্চর্য জিনিস তৈরি করে গেছেন সেখানে”।
ছিল তাঁর শাসনকালের-----আরব প্রভাব সম্পূর্ণ মুছে
ফেলা তাঁর রাজ্য থেকে। আরবদের প্রতি কতটা বিরক্ত ছিলেন তিনি তার প্রমাণ পাওয়া যায়
তাঁর এই উক্তি থেকেঃ “ পারসিয়ানরা রাজ্যশাসন করে এসেছে গত এক হাজার বছর ধরে যখন
তারা একটি দিনের জন্যেও আরবদের সহায়তা কামনা করেনি, সহায়তার কোন দরকারই পড়েনি। আর
আরবরা এদেশে রাজত্ব করেছে মাত্র একশ’ কি দুশ’ বছর, অথচ আজ আমরা ওদের বাদ দিয়ে একটি
ঘন্টাও কেন বেঁচে থাকতে পারব না”?
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্গত হয়। অনেকের
মতে তাঁর মতামতের গুরুত্ব, ইসলামিক বিশ্বে, হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এর পরপরই। দুঃখের
বিষয় যে তিনি নিজে বড়মাপের দার্শনিক হয়েও দর্শনশাস্ত্রের প্রতি তাঁর খুব বিরূপ
মনোভাব ছিল। চিরাচরিত প্রথামাফিক দর্শনের ওপর তাঁর মোটেও আস্থা ছিল না। বিশেষ করে এরিস্টোটলের
মতামত তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। সেকারণে তিনি দারুণ রুষ্ট ছিলেন ইবনে সিনা আর
আল-ফারাবির প্রতি। তীক্ষ্ণ ভাষায় সমালোচনা করেছেন তাঁদের কাজ নিয়ে। তাঁর বড় রাগটা
যেন ছিল ইবনে সিনার ওপরই। সম্ভবত অচলায়তন ইসলাম নিয়ে ইবনে সিনার কিছু ‘অশোভন’
মন্তব্যের কারণেই। তাঁর মতে ইসলাম মানবসত্ত্বাবহির্ভুত একটি ধ্রুব সত্য, তার কোনও
পরিবর্তন কাম্য তো নয়ই, সম্ভবও নয়। তা চিরন্তন, ও সর্বজনীন। অতএব ইবনে সিনার
‘ইসলামবিরোধী’ দর্শন মুসলিম জাতির জন্য ক্ষতিকর, ধর্মের মৌলিক মন্ত্রসমূহের
সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এক কথায়, ইবনে সিনা সত্যিকার অর্থে আদৌ মুসলমানই ছিলেন না।
তিনি ছিলেন ইসলামের মূল আদর্শে প্রত্যাবর্তনের পক্ষপাতী। দুঃখের বিষয় যে ইমাম
গাজ্জালির ভক্ত সেযুগে নেহাৎ কম ছিল না---বরং ইবনে সিনার চাইতে ঢের বেশি।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বৈশিষ্ট্যই তো তাই---মানুষ তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে
ভয় পায়, গুনাহ হতে পারে তার ভয়, দোজখে যাওয়ার ভয়, হাসরের দিন শক্ত সাজালাভের ভয়।
এক
আমি টেলিভিশন দেখিনা
তেমন। অনর্থক সময় নষ্ট বলে মনে হয় আমার কাছে। তবে দুটি প্রোগ্রাম আমি নিয়মিতই
দেখি। একঃ ‘জিওপার্ডি’। দুইঃ রোববার সন্ধ্যার ‘সিক্সটি মিনিটস’। ‘সিক্সটি
মিনিটস’এর প্রতি আমার আগ্রহ ওদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গভীরতা এবং সেসব তথ্য
পর্দায় পরিবেশন করবার তীর্যক ভঙ্গি। এ থেকে আমি অনেক নতুন তথ্য জানার সুযোগ পাই।
কিন্তু ‘জিওপার্ডি’ সেরকম প্রোগ্রাম নয়। এতে জ্ঞানের অনুসন্ধান নেই, আছে জ্ঞানের
পরীক্ষা। এটি দূরদর্শন শিল্পের ‘ট্রিভিয়া শো’র আওতায় পড়ে। এই প্রোগ্রামটি আমি দেখি
প্রধানত আমার নিজের অজ্ঞতার সম্মুখিন হওয়ার জন্যে----অর্থাৎ আমি যে কিছুই জানিনা
সেটুকু নতুন করে জানার জন্যে। রোববার রাতে প্রোগ্রামটি দেখার পর আমি স্মরণ করি
জ্ঞানতাপস সক্রেটিসের সেই অমর বাণীঃ “ আমি কেবল এটুকুই জানি নিশ্চিতভাবে যে আমি
আসলে কিছুই জানিনা”। তাঁর জন্যে সেটা ছিল যাকে বলে বিশুদ্ধ বিনয়। কিন্তু আমার
জন্যে সেটা বিশুদ্ধ জ্ঞান, মানে আত্মজ্ঞান।
গত সোমবার ‘জিওপার্ডি’তে তিনটে
কলেজের ছাত্র এসেছিল প্রতিযোগিতায়। তাদের জীবন সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে গিয়ে জানা
গেল, একজন ছোটবেলায় কি একটা তুচ্ছ জিনিসকে যমের মত ভয় করত। “এখনো কি আছে সেভয়?”
জানতে চাইলেন প্রোগ্রামের উপস্থাপক এলেক্স ট্রেভেক। ছেলেটা হেসে উত্তর দেয়ঃ “নাহ,
ওসব কেটে গেছে”। “নতুন কোনও ভয়?” জিজ্ঞেস করেন ট্রেভেক। একমুহূর্ত ভাবে সে। তারপর
একটু বিব্রত স্বরেই জবাব দেয়ঃ “ কোন একটা জিনিস জানিনা, তার ভয়”।
দৈনিক ‘জিওপার্ডি’ প্রোগ্রামের
দীর্ঘ ত্রিশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি নামঃ ব্র্যাড বাটলার ও কেন জেনিংস।
জেনিংসের খ্যাতিঃ তিনি একনাগাড়ে ৭৪ বার জয়ী হয়েছিলেন প্রতিযোগিতায়। ব্র্যাড
বাটলারের খ্যাতির প্রধান উৎস তাঁর নিজের কীর্তি যতটা তার চেয়েও বড় ছিল তিনি
‘জিওপার্ডি’র সর্বশেষ পরীক্ষায় জেনিংসকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। জ্ঞানের যুদ্ধ কাকে বলে
সেটা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। নিজেকে মনে হচ্ছিল ক্ষুদ্র মুষিক দুটি ভীম
ভয়াকার হার্কিউলিসের দিকে তাকিয়ে আছি। সে এক দৃশ্য বটে।
ছোটবেলায় স্কুলে শিখেছিলামঃ “Knowledge is
power”.সেটা এখনো গেঁথে আছে মনে। দুঃখের বিষয় যে মাস্টারসাহেব তখন বলেননি কথাটা কে
বলেছিলেন। সম্ভবত তিনি নিজেই জানতেন না বলে। তার মানে জ্ঞানের উপরিভাগটুকু জেনেই
তুষ্ট থাকতে হয়েছিল আমাদের, সবটুকু জানার সৌভাগ্য হয়নি। বিদেশের ভালো ভালো
স্কুলগুলোতে তারা শেখে যে প্রবাদটি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন স্যার ফ্রান্সিস বেকন (
১৫৬১-১৬২৬) নামক এক বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক-বিজ্ঞানী-প্রবন্ধকার ও রাজনৈতিক
নেতা। ওরা এ’ও শেখে যে তাঁর মূল বক্তব্যটি ছিল এরকমঃ “ For knowledge, too, is
itself power”. (জ্ঞান কেবল ক্ষমতার আকরই নয়, জ্ঞানই ক্ষমতা) তার প্রমাণ তো
ক্ষমতাবানরাই দিয়ে গেছেন যুগে যুগে। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি পৃথিবীর
সবচেয়ে পুরাতন পাঠাগার, একসময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে যার ব্যাপক
পরিচিতি ছিল। সেটিকে অগ্নিদগ্ধ করে ভস্ম করে দেবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন একাধিক ক্ষমতাধর
পুরুষ। প্রথমবার জুলিয়াস সিজার, খৃঃপূঃ ৪৮ সালে। দ্বিতীয়বার রোমান সম্রাট অরেলিয়ান
২৭০ খৃষ্টাব্দে। তৃতীয়বার, ৩৯১ সালে, কপ্টিক পোপ থিওফিলিস কর্তৃক। সর্বশেষ দাহনটির
সময়কার ৬৪২ খৃষ্টাব্দে, খলিফা ওমর যখন তাঁর ইসলামিক সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছেন।
সাম্রাজ্য আর সৈন্যবলই যাদের ক্ষমতার প্রধান উৎস, তারা নিজেরা মহাজ্ঞানী মহাজন না
হলেও এটুকু জ্ঞান নিশ্চয়ই ছিল যে জ্ঞানই তাঁদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। মধ্যযুগের
দোর্দণ্ড মঙ্গোলবাহিনী যখন বাগদাদ আক্রমণ করে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তখন তারা কেবল
শহরের দুই লক্ষ (অনেকের মতে দশ লক্ষের কাছাকাছি) নিরীহ নাগরিককে পাশবিকভাবে হত্যা
করেই ক্ষান্ত হয়নি, আব্বাসী সভ্যতার চূড়ামণি যে জ্ঞানমন্দির, বায়তুল হিকমা, হাউস
অফ উইজডম, পৃথিবীর সর্বপ্রথম জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে যার খ্যাতি বিশ্বের সর্বত্র, সেই
বায়তুল হিকমার লাইব্রেরির সমস্ত বইপত্র তারা ফেলে দেয় টাইগ্রিস নদীর পানিতে। কথিত
আছে যে ওই বইগুলোর কালো কালিতে সমস্ত নদীটাই কালো হয়ে গিয়েছিল। মূর্খ মঙ্গোল
সেনাপতি হালাকুও জানতেন যে তাঁর প্রধান শত্রু আব্বাসী সাম্রাজ্যের অস্ত্রাগার বা
শানসওকত নয়, তাঁদের লাইব্রেরিটা। অনুরূপভাবে মুসলিম সেনাপতি বক্তিয়ার খিলজি যখন
ভারতের বিহার আক্রমণ করেন দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তখন তাঁর প্রধান কর্মসূচীর
মধ্যে ছিল প্রথমেই বৌদ্ধ সম্রাটদের বহু সাধ্যসাধনা দিয়ে সৃষ্টি করা নালন্দা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত লাইব্রেরিখানা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। পাঠকের হয়ত অজানা নয়
যে ভারতের নালন্দাই ছিল পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাংগ বিশ্ববিদ্যালয়। এমন একটি উচ্চমানের
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন যার মনে প্রথম উদয় হয়েছিল তিনি হলেন সম্রাট
অশোক (খৃঃপূঃ ৩০৪-২৩২)। সেই স্বপ্নটিকে
বাস্তবে পরিণত করেছিলেন গুপ্তবংশের সম্রাটরা ষষ্ঠ ও দশম শতাব্দীর মাঝে। এর সবচেয়ে
গৌরবময় সময়টিতে ছাত্রসংখ্যা ছিল আনুমানিক ১০,০০০ এবং অধ্যাপক ছিলেন প্রায় ২,০০০।
নালন্দা ছিল ভারতের গর্ব----বাইরের পৃথিবী থেকে জ্ঞানাণ্বেষী ছাত্র আসত সেখানে
বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জন করার উদ্দেশ্যে। সেখানে জমায়েত হতেন চীন,
মঙ্গোলিয়া, মধ্য এশিয়া, পারস্য, গ্রীস আর মিশরের জ্ঞানার্থীরা। হয়ত ঠিক ওই কারণেই
জায়গাটি কোপদৃষ্টিতে পড়েছিল একাধিক শত্রুর। প্রথমে এলেন হুন আক্রমণকারিরা। তারপর
চড়াও হলেন হিন্দু রাজা-মহারাজাগণই, ভারতে বৌদ্ধ প্রভাব দূর করার অভিলাষে। শেষ মারটা দিলেন আমাদের মহামান্য বক্তিয়ার খিলজি সাহেব। কথিত আছে যে তিনি যে আগুণটা লাগিয়েছিলেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সে আগুণ ক্রমাগত তিনমাস ধরে জ্বলেছিল। এরপর সত্যি
সত্যি ভারতবর্ষে বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার সূর্য ক্রমেই অস্তমিত হতে থাকে।
দুই
দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবন শেষ করে যখন অবসর নিই আমি
তখন বন্ধুরা, সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার কি প্ল্যান পরিকল্পনা ভবিষ্যত নিয়ে।
আমার জবাব আগেই ঠিক করা ছিলঃ “ চল্লিশ বছর আমি অধ্যাপনা করেছি। এবার আমি
ছাত্রজীবনে ফিরে যাব”। আগে ছিলাম পূর্ণকালীন শিক্ষক, এখন হতে চাই পূর্ণকালীন
শিক্ষার্থী, যদি আমার ভাগ্যে থাকে সেজীবন। এটা কোনও কথার কথা নয়। চিরকাল ছাত্র
থাকতে পারা বড়রকম ভাগ্যের কথা। কিছুদিন আগে আমার ছেলেরা আলাপ করছিল আমার
স্মৃতিপ্রস্তরে কি লিখবে তারা। বড় ছেলের মতেঃ “He was a good teacher”. আমি তাতে যোগ করার প্রস্তাব দিইঃ
“but a better student”. ওরা হয়ত একটু থতমত খেয়েছিল, যদিও আমার কথার মর্ম তাদের
বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আমার মতে, মানুষের দুবার মৃত্যু হয়। প্রথমবার যখন সে নতুন
কিছু শিখবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়বার যখন সে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে
শারীরিকভাবেই ইহলোক পরিত্যাগ করে, যাকে আমি নেহাৎ জৈবিক লৌকিকতা বলেই মনে
করি----এ-মৃত্যুর বিশেষ কোনও তাৎপর্য নেই, মোল্লামৌলবিদের দুপয়সা বাড়তি উপার্জন আর
পাড়াপ্রতিবেশীদের একবেলা ভোজানুষ্ঠানের উপলক্ষ ছাড়া।
আমেরিকান
কবি ও প্রবন্ধকার রালফ ওয়াল্ডো এমারসন (১৮০৩-১৮৮২) একজায়গায় বলেছিলেনঃ “ Do you
know the secret of a true scholar? In every man there is something wherein I
may learn of him; in that I am his pupil”. (প্রকৃত পাণ্ডিত্যের রহস্য কি জানেন?
প্রতিটি মানুষের ভেতরই এমন কিছু আছে যা থেকে আমি নতুন কিছু শিখতে পারি। সেহিসেবে
আমি তার ছাত্র বই কিছু নই।)আমার পুরনো ছাত্ররা মাঝে মাঝে আমাকে বলে, হয়ত আমাকে
খুশি করার জন্যেই, যে ওরা আমার কাছ থেকে অনেককিছু শিখেছে। আমি উত্তর দিইঃ তোমরাও
জাননা তোমরা আমাকে কত কি শিখিয়েছ। এমনকি আমার ছেলেরাও আমাকে নতুন নতুন জিনিস শেখায়
প্রতিদিন। এখন আমি শিখতে শুরু করেছি আমার নাতি আর নাতনির কাছে। এর শেষ
নেই---জ্ঞানই একমাত্র শৃঙ্গবিহীন পর্বত। বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ টমাস হেনরি
হাক্সলি(১৮২৫-১৮৯৫) লিখেছিলেনঃ “If a little knowledge is dangerous, where is the
man who has so much to be out of danger?” (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে টমাস হাক্সলি
ছিলেন বিবর্তন শাস্ত্রের জনক চার্লস ডারউইনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর ও সমর্থকদের
অন্যতম।) কথাটির অর্থ দাঁড়ায়ঃ অল্প জ্ঞান যদি সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর হয় তাহলে কোথায়
সে ব্যক্তি যে সেই ভয়ঙ্করী অল্পবিদ্যা থেকে পুরোপুরি মুক্ত? তার মানে অতিরিক্ত
জ্ঞান বলতে সংসারে কিছু নেই। জ্ঞান সবারই সামান্য। পি এইচ ডি ডিগ্রি করার পর
অনেকের ধারণা হয় যে তাঁর আর শেখার কিছু নেই। আমি বলিঃ এই তো মাত্র শুরু। পি এইচ ডি
করা মানে শেখার পদ্ধতিটা মোটামুটি আয়ত্ত করে ফেলা, এখন শুরু হবে সত্যিকার শিক্ষা,
যার আসলে কোনও শেষ নেই।
বাংলা ভাষায় ঠিক অনুরূপ একটা প্রবাদ আছেঃ ‘অল্পবিদ্যা
ভয়ঙ্কর’। ‘বিদ্যা’ আর ‘জ্ঞান’ ঠিক এক
জিনিস নয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা ছাড়াও জ্ঞানার্জন সম্ভব, আবার হাজার বিদ্যা দিয়েও
জ্ঞান অর্জন করা হয়না সবসময়। আমার মতে জ্ঞানশূন্য বিদ্বান ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি
পৃথিবীতে। আমাদের এই প্রবাদটির উৎস কোথায় আমার জানা নেই, তবে এটি যে সপ্তদশ
শতাব্দীর কবি আলেকজাণ্ডার পোপ (১৬৮৮-১৭৪৪)বর্ণিত “ A little learning is a
dangerous thing” এর হুবহু বাংলা অনুবাদ তাতে সন্দেহ নেই। পোপ সাহেবের ওই
উক্তিটিকেই একটু ঘুরিয়ে হাক্সলি সাহেব বলেছিলেন সেই কথাটি। তবে ইতিহাসে কে কখন কার
কোন্ কথার অনুকরণ বা অনুসরণ করে কি বলেন সেটা হলপ করে বলা শক্ত। বাংলার প্রবাদটা
কি ইংরেজিটিরই অনুবাদ, না, স্বাধীনভাবে কোনও জ্ঞানীগুণি বাঙ্গালির মাথায় উদয়
হয়েছিল? জানিনা। বাংলাভাষায় আরেকটি প্রচলিত বচনঃ ফলভারে অবনত বৃক্ষ। ইংরেজিতেও
অনুরূপ প্রবাদ আছে অনেক। চীন সভ্যতার আদিগুরু, শিক্ষক, দার্শনিক কনফিউসিয়াস (খৃঃপূঃ
৫৫১-৪৭৯; মূল চাইনিজ নাম ছিল কং ফুজি) বলেছিলেনঃ “ আপনি যখন একটা জিনিস জেনেও তা
চেপে থাকেন, আবার কিছু না জানলে তা অকপটে স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না, তাকেই তখন
বলা যেতে পারে সত্যিকার জ্ঞানী ব্যক্তি”। একে আমি বিনয় বলব না, এটাই জ্ঞান---সেই
ফলভারে অবনত বৃক্ষটি। আইজ্যাক নিউটন খামোখা বলেননি যে তিনি যে মহাসমুদ্রের অপর
প্রান্তে চোখ মেলে তাকাতে পারছেন, তার কারণ তিনি তাঁর দৈত্যাকার পূর্বপুরুষদের
কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে সেদৃশ্য দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন। একমাত্র নিউটনের মত বিশাল
প্রতিভার মানুষের পক্ষেই নির্জলা বাস্তব সত্যটি সেভাবে বলা সম্ভব হয়েছিল। আলবার্ট
আইন্সটাইন কিন্তু জ্ঞানের চাইতেও উর্ধে স্থান দিয়েছিলেন মানুষের কল্পনাশক্তিকে।
তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি আছেঃ “ The true sign of intelligence is not knowledge,
but imagination”. (বুদ্ধির যথার্থ পরিচয় তার জ্ঞানের মধ্য দিয়ে নয়, তার
কল্পনাশক্তিতে)। কথাটার তাৎপর্য বোধ হয় এখানে যে কল্পনাহীন জ্ঞান দ্বারা কখনো কোনও
বড়মাপের সৃষ্টিকর্ম সিদ্ধ হতে পারে না। কথাটি যে আমাদের অভাগা দেশটির বেলাতে
অক্ষরে অক্ষরে সত্য সেটা তো কারুরই অজানা নয়। জ্ঞানী লোক কি কম আছে দেশে? কিন্তু
সৃষ্টিশীল মানুষ কজন? সৃষ্টিশীলতার জন্যে কল্পনার বাইরেও গুটিকয়েক জিনিসের প্রয়োজন
হয়, যার কোনটাই হয়ত আমাদের দেশে এখনো ভাল করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। তার মঝে আমি
প্রথমেই স্থান দেব দুটি জিনিসকে। এক, মুক্তচিন্তা ও মুক্তমনের পূর্ণ বিকাশের জন্যে
আবশ্যিকভাবে প্রয়োজনীয় উন্মুক্ত পরিবেশ। দুই, মৌলিক গবেষণা প্রচেষ্টাতে
সরকারি-বেসরকারি ও সামাজিক, সর্বপ্রকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা। আমরা যেন ভুলে
না যাই যে একটা উন্নত দেশের বড় সম্পদ তার ধনদৌলত নয়, কোষাগারের উদ্বৃত্ত উপার্জন
নয়, দেশে কজন নতুন কোটিপতি যোগ হলেন সেবিচার তো অবশ্যই নয়, সত্যিকার সম্পদ তার
স্কুলকলেজগুলো, তার উচ্চ বিদ্যানিকেতনগুলো। আধুনিক ইউরোপ আর আধুনিক আমেরিকা, তাদের
অস্ত্রাগারের প্রাচুর্য আর ঝলক দিয়ে গড়ে ওঠেনি, উঠেছে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর
ওপর ভর দিয়ে। এমনকি বর্তমান যুগের দক্ষিণ কোরিয়া,
সিঙ্গাপুর, চীন, তাইওয়ান, এরাও পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে।
আজকে আন্তর্জাতিক মানের বড় বড় প্রতিযোগিতাগুলোতে এদের ছেলেমেয়েরা নিয়তই হারিয়ে
দিচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার ছাত্রছাত্রীদের। পৃথিবীর ছোট ছোট দেশগুলোও এখন আর ছোট থাকতে
চাইছে না। বড়দের সঙ্গে শেয়ানে শেয়ানে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। তাহলে বলুন তো কেন
আমাদের চিরকাল ছোট হয়েই থাকতে হবে?
একটু অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে পাঠকের কাছে,
কিন্তু এখানে আমি উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না যে একবিংশ শতাব্দীর
অত্যুন্নত যান্ত্রিক সভ্যতার যুগেও পৃথিবীতে একটি জাতি আছে যাদের নামের অর্থই
হচ্ছেঃ শিক্ষার্থী, অথচ তাদের চেয়ে শিক্ষাবিরোধী জাতিও সংসারে দ্বিতীয়টি নেই।
তাদের নাম ‘তালিবান’। হ্যাঁ, শব্দটির আক্ষরিক অর্থঃ ছাত্র, জ্ঞানেচ্ছু। তাদের কাছে শিক্ষা মানে মাদ্রাসা শিক্ষা---আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা নয়। দুঃখ
এই যে আমাদের স্বাধীন দেশটির বেশ কিছু তরুণ ছেলে ক্রমেই আকৃষ্ট হয়ে উঠছে এই
উগ্রপন্থি বর্বর জাতিটির প্রতি। সম্ভবত এই কারণে যে লেখাপড়া না জানার ফলে তারা
এটুকুও মনে রাখতে পারেনি যে আল্লার রসূল হজরত মোহাম্মদ (দঃ) নিজে নিরক্ষর হওয়া
সত্ত্বেও বলেছিলেন একসময় যে মুসলমানরা যেন জ্ঞানার্জনের জন্যে, দরকার হলে, সুদূর
চীন পর্যন্তও ভ্রমণ করতে প্রস্তুত থাকে। তাঁর সেই অমর বাণীটি যুগে যুগে কতটা পালন
করেছে তাঁর অনুগামীরা সেটাই একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক।
তিন
বছর ছয়েক আগেকার কথা। ক্যালিফোর্নিয়াতে ছেলের
বাসায় বেড়াতে গিয়ে একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। হঠাৎ চোখে
পড়ল আকাশী নীল রঙের সুন্দর মলাটে মোড়া একটা বই---নাম “Symmetry”. পাতা উল্টাতে
উল্টাতে নজরে পড়ল স্পেনের আলহামরা নিয়ে কিছু আলোচনা আছে। এমনিতেই সিমেট্রি, অর্থাৎ
প্রতিসাম্য, বিষয়টির প্রতি আমার ভীষণ আগ্রহ, তার ওপর আলহামরা। কিনে ফেললাম বইটা। আজকে
আমার মনে হয়, গত ছ’বছরে যত বই কিনেছি আমি তার মাঝে সবচেয়ে প্রিয় বই আমার এটিই। এর
লেখক মার্কাস ডু স্যটয় নামক এক খাঁটি ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক, যাঁর বিশেষত্ব হল গণিতের গ্রুপ থিওরি নাম একটি শাখাতে যার ওপর তিনি পি
এওচ ডি ডিগ্রি করেছিলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
গ্রুপ আর সিমেট্রি----দুটিতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
যেখানে সিমেট্রি সেখানেই একটা-না-একটা গ্রুপ লুকিয়ে আছে। আসলে সিমেট্রি-গ্রুপ নামক
একটা আলাদা শাখাই আছে গণিতশাস্ত্রের। এই শাখাটির প্রয়োগ বিজ্ঞানের সর্বত্র। আর
সিমেট্রি? সে তো প্রকৃতির নিজেরই ধর্ম। সিমেট্রি আমাদের নিজেদের শরীরেও। শরীরের
বাঁদিকটা আর ডানদিকটা ঠিক একইরকম, তাই না? তা নাহলে কিরকম কুৎসিৎ দেখাতো আমাদের
কল্পনা করতে পারেন? একরকম বলেই আমরা যখন আয়নাতে দাঁড়াই তখন আমাদের হুবহু
প্রতিকৃতিটা দেখতে পাই। যদিও ‘হুবহু’ শব্দটা আক্ষরিকভাবে সত্য নয়---আয়না আসলে
আমাদের ডানদিকটাকে বাঁয়ে নিয়ে যায়, আর বাঁ’কে নেয় ডানে। আয়না বস্তুটি এখানে একটা
গ্রুপের কাজ সেরে ফেলল---যাকে বলা হয় ‘রিফ্লেক্সন গ্রুপ’। রিফ্লেক্সন গ্রুপ আরো বড়
জিনিস---আয়না একটা ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। গণিতের গ্রুপ থিওরি নিয়ে যারা কাজ করেন
তারা এসব বোঝেন ভালো----আমাদের এতকিছু বুঝার দরকার নেই। তবে সিমেট্রির উদাহরণ
চতুর্দিকে। যেদিকে তাকান সেদিকেই সিমেট্রি। জীবনের যাকিছু আনন্দদায়ক, যাকিছু
দৃষ্টিনন্দন, তার ভেতরেই রয়েছে সিমেট্রি। গাছপালা, জীবজন্তু, নদীনালা, বনবনানী,
পাহাড়-পর্বত, সবখানেই সিমেট্রির খেলা। এমনকি আমাদের ডি এন এ’র আকৃতিতেও
প্রতিসাম্য, মানে সিমেট্রি, আছে। ইংরেজিতে যাকে আমরা ‘ডাবল হেলিক্স’ বলি, সেটা তো
দেখতে অনেকটা সুন্দর দুটি লতানো গাছের মত, পরস্পরকে অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে রেখেছে। সঙ্গীতের
শ্রুতিমধুর সুরেতেও সেই একই সিমেট্রি। চিত্রশিল্পীর সৃষ্টিকর্মের মাঝে যে কত হাজার
রকমের সিমেট্রি লুকিয়ে থাকে ভাবতে মাথা ঘুরে যায়। সিমেট্রির বহিঃপ্রকাশ ঘটে কিসে?
তার একটা প্যাটার্ণ আছে, সেই প্যাটার্ণ পরীক্ষা করেই আমরা তার অন্তর্নিহিত
সিমেট্রির সন্ধান পাই। আধুনিক স্থপতিদের চমকলাগানো জটিল জ্যামিতিক কাজগুলোর মাঝে
নানাপ্রকারের প্যাটার্ণের খেলা দেখতে পাবেন----আমার মতে তাঁরা নিজেদের অজান্তেই বড়
বড় সব গ্রুপ-থিওরিস্ট, সিমেট্রি গ্রুপ তাঁদের নখদর্পনে!
পাঠক হয়ত মাথায় হাত দিয়ে ভাবছেন, এখানে
গাণিতিকরা ঢুকে গেলেন কেমন করে? ঢুকে গেলেন এজন্যে যে এটাই গাণিতিকদের কাজ। তাঁরা
সংসারে যাকিছু দৃশ্যমান, প্রতীয়মান, প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ, তাকে একটা শৃংখলার
মধ্যে নিয়ে আসেন। একটা নিয়মকানুন বেঁধে দেন---খানিকটা সংবিধানের মত। সংবিধানের
উনিশবিশ অনুযায়ী তাদের নামকরণ করেন, শ্রেনীবদ্ধ করেন, একে অন্যের সঙ্গে কোথায়
সম্পর্ক বা কোথায় সম্পর্ক নেই তাঁর খোঁজ করেন, যাতে পরবর্তীতে এগুলোকে নিয়ে যারা
কাজ করবেন তাদের সুবিধা হয়। এতে করে মানুষের জীবন একটু একটু করে অগ্রসর হয়, নতুন
আইডিয়া তৈরি হতে পারে, সভ্যতা এগিয়ে যায়।
এভেরসের মূর্তি কর্ডোভাতে
|
কনওয়ের মত বিশাল ব্যক্তির মুখ থেকে
এধরণের উক্তি শুনলে মনে হবে, হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এর সেই অমর বাণীতে তাঁর নিজের
বান্দারা তেমন কর্ণপাত না করলেও সত্যিকার জ্ঞানপিপাসু জাতিরা করেছিলেন নিঃসন্দেহে।
যাই হোক, তরুণ ছাত্র ডু স্যটয় ঠিক সেসময়ই তাঁর উপদেশ অনুযায়ী স্পেনে যাবার সুযোগ
পাননি, কিন্তু কর্মজীবনের প্রথমদিকেই গিয়েছিলেন তাঁর আট বছরের পুত্র এলেক্সকে সাথে
করে।
আমাদের মত সাধারণ পর্যটক আলহামরায়
যায় কেন? প্রধানত ক্যামেরার সদ্ব্যবহার করার জন্যে। এসময়কার ডিজিটাল যুগের তো কথাই
নেই। এক সপ্তাহের ভেতরই এক হাজার ছবি তুলে ফেসবুকের মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রচার
করা যায়। কিন্তু কনওয়ে আর ডু স্যটয়ের মত মাথাওয়ালা পর্যটকরা সেখানে ছবি তোলার
জন্যে যান না, যান মধ্যযুগের মুর মুসলমানদের অত্যাশ্চর্য মেধার প্রদর্শনী দেখবার
জন্যে। তাদের অবিশ্বাস্য কারুকার্য দেখবার জন্যে। যান সেখান থেকে কিছু শিখতে,
জানতে, বুঝতে। সেখানে তাঁরা এমন কিছু দেখেন যা সাধারণ ডিজিটাল-ক্যামেরাধারী
দর্শকদের চোখে পড়ে না। যেমন ডু স্যটয় আলহামরাতে গিয়ে দেখেন বহুবিচিত্র টালির কাজ। টালিতে কি থাকে? দেয়াল বা মেঝের ওপর নানারকম প্যাটার্ণ থাকে। সেসব প্যাটার্ণের সুবিন্যস্ত সমাবেশ একটা নান্দনিক
পরিবেশ সৃষ্টি করে। দর্শকদের চমৎকৃত করে। এই টালির কাজে অসম্ভব বুৎপত্তির পরিচয় দিয়েছেন মুসলিম শিল্পীরা দেশবিদেশের
মসজিদ-মাজার আর দুর্গ-প্রাসাদের মধ্য দিয়ে। ইসলামিক ইতিহাসে, বিশেষ করে মধ্যযুগের
গৌরবময় সময়টিতে মুসলিম স্থাপত্য শিল্প সত্যি সত্যি একটা গর্ব করার মত বিষয় ছিল।
কিন্তু ইসলামিক আর্ট আর তৎকালীন খৃস্টান আর্টের মাঝে মৌলিক যে পার্থক্যটা ছিল সেটা
হল খৃস্টানদের কোনও ধর্মীয় বাধানিষেধ ছিল না কোনও জীবিত জিনিসের প্রতিকৃতি আঁকা বা
নির্মাণ বিষয়ে, যা ছিল আমাদের ইসলাম ধর্মে। যার ফলটা দাঁড়িয়েছে এই যে মধ্যযুগের বড়
বড় খৃস্টান-ইহুদী শিল্পীরা (লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জ্যেলো, রাফায়েল)
যেমন ছবি এঁকে এঁকে আর মূর্তি রচনা করে সারা ইউরোপময় রেনেসাঁ নামক একটা নতুন যুগের
সূচনা করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন (আসলে রেনেসাঁই ছিল ইউরোপের আধুনিক সভ্যতা গড়ে
তোলার প্রাথমিক স্তর) তেমনটি কখনো হয়ে ওঠেনি মুসলিম শিল্পীদের দ্বারা----তাঁরা
প্রতিভায় কম ছিলেন বলে নয়, ধর্মের শেকলে তাঁদের হাত বাঁধা ছিল বলে। স্পেনের
মুসলমানরা সেই বাধাগুলো থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিলেন বলে সেখানে মুক্তমন ও
মুক্তচিন্তা বেশ অব্যাহত ভাবেই প্রকাশ পাবার সুযোগ পেয়েছিল। তাঁদের সৃষ্টিশীল মন
কেবল যে দুর্গ-প্রাসাদ-মঞ্জিলের কারুকার্য খচিত শিলকর্মতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়।
তাঁরা বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত, কবিতা,
আইনশাস্ত্র, এবং সর্বোপরি, দর্শনশাস্ত্রতে। স্পেনের ইসলামিক ইতিহাসে দর্শনশাস্ত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত নামটি হলঃ এভেরস (খৃঃ১১২৬-১১৯৮,
মুসলিম বিশ্বে যিনি ইবনে রুশদ নামে অধিকতর পরিচিত)। সারা পশ্চিম বিশ্বে তিনি এতটাই
সম্মানিত দার্শনিক যে তিনিই একমাত্র অশ্বেতাংগ পুরুষ যার ছবি স্থান পেয়েছিল
খ্যাতনামা শিল্পী রাফায়েলের (১৪৮৩-১৫২০) আঁকা যুগান্তকারি কাজ “স্কুল অফ এথেন্স”
এর একুশজন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণিব্যক্তিদের মাঝে। ছবির নাম এথেন্সের স্কুল
হলেও এতে এথেন্সের চাইতে অধিকসংখ্যক গুণিজন ছিলেন ভিনদেশীয়। এতে ছিলেন সক্রেটিস,
প্ল্যাটো, এরিস্টোটল, পিথাগোরাস, উইক্লিড, এইসব বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। ইউরোপে
তাঁর বিশেষ খ্যাতি এরিস্টোটলের ওপর অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ রেখে যাওয়ার জন্যে।
আসলে তাঁর গবেষণার মধ্য দিয়েই ইউরোপ সম্পূর্ণ পরিচিতি লাভ করে এরিস্টোটলের কাজের
সঙ্গে। এভেরস তাঁর কাজের ওপর অজস্র মূল্যবান মন্তব্য ও ব্যাখ্যা তৈরি করে গেছেন যা
দ্বারা উপকৃত হয়ে এসেছেন পশ্চিম জগতের জ্ঞানার্থীরা। তিনি আসলে ইউরোপে যতটা পরিচিত
ততটা মোটেও নন তাঁর নিজের সম্প্রদায়, অর্থাৎ ইসলামিক বিশ্বে। হয়ত তার কারণও
আছে---তিনি ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামির ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্মের অনেক
কঠোর নীতিনির্দেশই খুব একটা সম্মানের সাথে পালন করতেন বলে মনে হয়না। অতএব ইসলামিক
মোল্লাদের অপ্রীতিভাজন হবেন সেটা তো খুবই স্বাভাবিক। মুসলিম বিশ্ব হয়ত এ’ও জানে না
যে আমাদের এই স্বজাতীয় দার্শনিকটিকে বলা হয় ইউরোপের “সেকুলার” মতবাদের জনক। অবাক
হওয়ার বিষয় তো বটেই।
যাই হোক, ডু স্যটয় সাহেব গ্রানাডায়
গেলেন সপরিবারে। প্রথম দুদিন হয়ত সবার সাথে দৃশ্য দেখে বেড়ালেন ক্যামেরা হাতে্ নিয়ে,
সবাই যা করে। কিন্তু পরে যখন আলহামরাতে যান গণিতের চোখ নিয়ে তখন সাথে করে নেন তাঁর
কৌতূহলী ছেলেটিকে। যে-কোন বাবাই জানেন ওই বয়সের ছেলেমেয়েদের কৌতূহল
সীমাহীন----তারা সবকিছুই জানতে চায় বুঝতে চায়, কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতে চেষ্টা
করে। তাদের মনে প্রশ্নের অন্ত নেই----তাদের মন তখনো পুরোপুরি কলুষিত হয়ে ওঠেনি
সমাজের শতসহস্র বিধিনিষেধ দ্বারা। ডু স্যটয় আর তাঁর ছেলে এলেক্স খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
দেখতে থাকলেন আলহামরার অত্যাশ্চর্য কারুকার্য। টালিগুলো কিভবে সাজানো হয়েছে, তাদের
একটি থেকে আরেকটি ভিন্ন কেন, তাদের মধ্যে কতপ্রকারের প্রতিসাম্য বা সিমেট্রি। অপটু
চোখে সবসময় সম্ভব হয়না দুরকমের সিমেট্রি দেখে চট করে বুঝে ফেলা যে তারা সত্যি
সত্যি আলাদা---তাদের মাঝে মৌলিক পার্থক্যটা কোথায়। সিমেট্রি বলতে কি বুঝায়? একটা
জিনিসকে একটু ঘোরালে ফেরালে যদি পরিবর্তিত চেহারাটি ঠিক আগের মতই থেকে যায় (যেমন আয়নাতে
নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া), তখন সেটা সিমেট্রি। একটা সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের
সিমেট্রি ক’টি? দুটি---মাঝখানে একটা লম্ব এঁকে দেখতে পাবেন তার এপাশ ওপাশ করামাত্র
ত্রিভুজটি অবিকল একই থেকে যায়। আর দ্বিতীয়টি হল যদি কোন রদবদল না করা
একেবারেই---এর নাম আইডেন্টিটি ট্র্যান্সফরমেশন, বা অপরিবর্তন। ওদিকে একটি সমবাহু
ত্রিভুজের সিমেট্রি সংখ্যা ছয়----একটা ছবি এঁকে ভাবুন একদণ্ড, তাহলেই দেখতে পাবেন
কি হিসেবে। ডু স্যটয় খুঁজতে থাকলেন
আলহামরার টালিগুলোতে ঠিক কতগুলো সিমেট্রি, যা পরস্পর থেকে আলাদা। প্রথম দুদিন
বাপে-ছেলেতে খুব করে খুঁজেও তার হদিস পেলেন না। শেষে একদিন হঠাৎ করেই বুঝে ফেললেন
যে সর্বমোট ১৭ টি সিমেট্রি দিয়ে গড়া আলহামরার টালির কাজ। অর্থাৎ ১৭ টি ভিন্ন ভিন্ন
প্যাটার্ণ। কৌতূহলী দর্শকের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারেঃ এই ১৭ সংখ্যাটির কি
কোনও বিশেষ তাৎপর্য আছে? মুর আমলের টালি শিল্পীরা ১৭ পর্যন্ত এগিয়েই থেমে গেলেন
কেন? থেমে গেলেন কারণ তার বেশি প্যাটার্ণ সমতল ক্ষেত্রের ওপর সম্ভবও নয়। কিন্তু এই
যে “সম্ভব না হওয়া” ব্যাপারটি সেটা তো নবম বা দশম শতাব্দীর কারুকর্মীদের জানার কথা
ছিল না। এর সঙ্গে আধুনিক গ্রুপ থিওরির একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক। এবং গ্রুপ থিওরি এমন
একটা বিষয় যার জন্ম হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। এভারিস্ট গ্যালোয়া (১৮১১-১৮৩২)
নামক এক অসামান্য প্রতিভাবান যুবক তাঁর যুগান্তকারী গবেষণাতে এই ‘গ্রুপ’ শব্দটি
ব্যবহার করেন সর্বপ্রথম। জিনিয়াস বলতে কি বুঝায় এই লোকটি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
তবে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের যে ভিন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সে-জ্ঞান সেসময় গড়ে উঠতে পারেনি।
গ্রুপ থিওরির তখন শৈশব মাত্র। জ্ঞানবিজ্ঞানের যে কোনও শাখা জন্ম থেকে পরিণত
পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত অনেকখানি সময় অতিবাহিত হতে হয়, অনেক অনেক মেধাবী গবেষকের
যুগ্ম প্রচেষ্টাতে সেই পরিপক্কতাটি গড়ে ওঠে। গ্রুপ থিওরি বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে
এসে একটা পূর্ণ অবয়ব ধারণ করতে সক্ষম হয়। আজ আমরা মোটামুটি বুঝি সেই ‘১৭’
সংখ্যাটির বিশেষ গুরুত্ব। ‘গ্রুপ থিওরি’র প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই সমতল
ক্ষেত্রের ওপর ১৭ টির বেশি সিমেট্রি সম্ভব নয়। সেটা দশম শতাব্দীর মুর কারিগররা
অবশ্যই জানতেন না। কিন্তু তাঁদের গাণিতিক বোধবুদ্ধি যে অত্যন্ত প্রখর ছিল তাতে
কারুর কোন সন্দেহ নেই। সেই বোধবুদ্ধি দিয়েই তাঁরা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন যে ১৭ই এর
শেষ সীমা। এই যে আশ্চর্য গাণিতিক উপজ্ঞার পরিচয় গ্রুপ থিওরি আবিষ্কারের সাতশ’ বছর
আগে, সেই উপজ্ঞার বিস্ময়ই বারবার টেনে নেয় সেখানে পশ্চিমের বড় বড় গবেষকদের।
চার
স্পেনের ইসলামিক যুগ নিয়ে পৃথিবীর ১৫০ কোটি মুসলমানের বুকে দারুণ গর্ব। এবং
সঙ্গত কারণেই। বিরাট একটা সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা সেখানে। ৭১১ খৃষ্টাব্দে তরুণ
সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদের পরিচালনাতেই মুসলমানদের প্রথম প্রবেশ ঘটে ইউরোপের
ভূখণ্ডে। তাঁরা ঢুকেছিলেন মরক্কো থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জিব্রাল্টার প্রণালীর অপর
প্রান্তে। আসলে জিব্রাল্টার প্রণালীটির নামকরণই হয় তারিকের নামানুসারে। তাঁরা
ঢুকতে পেরেছিলেন প্রধানত তখনকার স্পেনবাসী ইহুদী সম্প্রদায়ের সহায়তায়। ইহুদীদের
ওপর তৎকালীন খৃস্টান শাসকবর্গের বৈষম্যমূলক অন্যায় আচরণে অতীষ্ঠ হয়ে তাঁরা ঈশারা
ইঙ্গিতে বার্তা পাঠিয়েছিলেন ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত একের-পর-এক রাজ্য জয়
করে এগিয়ে আসা আরব-বার্বার (উত্তর আফ্রিকার নব ধর্মান্তরিত বার্বার জাতিকেই
ইউরোপিয়ানরা মুর বলে অভিহিত করেন) বাহিনীর কাছে। বর্তমান যুগে ইহুদী-মুসলিমের যে
একটা বিষাক্ত সম্পর্কের পরিবেশ গড়ে উঠেছে তা কিন্তু আদৌ ছিল না আরব সাম্রাজ্যে।
সম্ভবত তাদের একই শত্রু ছিল বলে----খৃস্টান। এতটাই সুসম্পর্ক ছিল দু’সম্প্রদায়ের
ভেতর যে তারা একে অন্যকে সাহায্য করেছেন তাদের নিজ নিজ মেধাবুদ্ধি দিয়ে। ইহুদীরা
দিয়েছেন তাঁদের আর্থসামাজিক অভিজ্ঞতা, তাঁদের প্রশাসনিক চিন্তাভাবনা ও উন্নততর বিদ্যাবুদ্ধি
দিয়ে, আর আরবরা দিয়েছেন তাঁদের নিরাপত্তা ও সরকারি আমলাতন্ত্রে যথেষ্ঠ
সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি। এতে করে ইহুদী এবং মুসলমান, উভয় সম্প্রদায় উপকৃত
হয়েছে, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নীত হয়েছে।
স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্যের সূচনা
হয় টলেডো থেকে, ৭৫৬ সালের দিকে, বাগদাদ থেকে বিতাড়িত উন্মায়াদ বংশীয় মেধাবী ও
দূরদর্শী নেতা ও আমির আব্দুর রহমান (১) এর নেতৃত্বে। তারপর ইতিহাসের নির্মম ও
অনিবার্য বিধান অনুযায়ী তাদের স্পেনশাসনের যখন শেষ যবনিকা পতন ঘটে গ্রানাডাতে,
১৪৯২ খৃষ্টাব্দে (ঠিক যে বছর স্পেনীশ আবিষ্কারক কলাম্বাস জাহাজবোঝাই বেশ কিছু
ইহুদীকে সাথে করে সমুদ্রযাত্রায় বের হন নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করবেন বলে), এবং গোটা
স্পেন এবং পর্তুগালের একটা অংশ চলে যায় ইহুদী ও মুসলিমবিদ্বাষী খৃস্টান সেনাপতি
ফ্রেডারিকের দখলে তখন থেকে আবার শুরু হয় ইহুদী নিগ্রহ। সেই নির্যাতনের পরিবেশে
অসংখ্য ইহুদী পরিবার স্পেন থেকে পালিয়ে চলে যান ইউরোপের অন্যান্য দেশে, যেখানে
ইহুদী-বিরোধী মনোভাব তেমন উগ্র ছিল না। ওই সময়ই ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক
স্পিনোজার পূর্বপুরুষরা স্পেন ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন নেদারল্যাণ্ডে। তার আগ পর্যন্ত
মুর শাসনের সুদীর্ঘ সময়টিতে সেই পরিবার খুবই সুখেশান্তিতে জীবনযাপন করছিলেন।
আলহামরা কিন্তু চট্ করে তৈরি হয়ে
যায়নি। বেশ ছোট আকারেই এর প্রাথমিক নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় ৮৯৯ খৃষ্টাব্দে। পরে নতুন
একটা দালান যোগ করা হয় একাদশ শতাব্দীতে, মুর সম্রাট মোহাম্মদ বিন আল-আমার কর্তৃক।
তাঁর সময়ই বর্তমান কালের প্রাসাদ ও দেয়ালগুলোর কাজ শেষ করা হয়। শেষে গ্রানাডার
সুলতান ইউসুফ (১) দ্বারা একে রাজপ্রাসাদে পরিণত করা হয় ১,৩৩৩ সালে।
এপ্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করার
লোভ সংবরণ করতে পারছিনা। আরব এবং উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার মুসলমানরা মোটমাট ৭৮১ বছর
রাজত্ব করেন স্পেনের বিভিন্ন ভূখণ্ডতে, এত তাদের শানশওকত ধনদৌলত, তারপর যখন
সাম্রাজ্য হারিয়ে প্রিয় দেশটিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, সেই দীর্ঘ শতাব্দীগুলোর
স্মৃতিচিহ্ন কোথায় পাওয়া যাবে। একমাত্র কর্ডোভার বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদ, আর
আলহামরার প্রাসাদ ছাড়া আর কি আছে বাইরের দর্শকদের দেখবার মত? তাঁরা যে ‘বিশাল’ সভ্যতা
গড়ে তোলার কথা বারবার উচ্চারিত হতে শুনি আমার মুসলিম ভাইবোনদের মুখে সেই সভ্যতার
স্থায়ী নিদর্শন তাঁরা কোথাও রেখে যেতে পেরেছেন? আমার জানামতে একমাত্র আলহামরাই
জাতিসঙ্ঘের সংরক্ষিত হেরিটেজের আওতায় স্থান পেয়েছে। আর সব গেল কোথায়? জানি কি
বলবেন আমার সহধর্মীরা----খৃস্টান আর ইহুদী চক্রান্ত মিলে সব ধ্বংস করে দিয়েছে।
স্বীকার করি, তা তারা দিয়েছে, অনেকক্ষেত্রেই। কিন্তু তার আগে তো তাঁরাও মসজিদ তৈরি
করেছিলেন অন্যদের উপাসনাগৃহের ওপর। ক্ষমতাবানরা সবসময়ই ক্ষমতাহীনদের নিশ্চিহ্ন করে
দেয়ার প্রয়াস পায়। এটাই ইতিহাসের নিয়ম। আমার প্রশ্ন হলঃ মুসলমানরা সেখানে
জ্ঞানচর্চার কোনও নিদর্শন রেখে যেতে পারেননি কেন। ৭৮১ বছরের ভেতর তাঁরা একটা
বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার কথা ভাবলেন না কেন। একটা বড়রকমের জ্ঞানকেন্দ্র তৈরি করার
কথা তাঁদের মনে উদয় হয়নি কেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি নিশ্চয়ই তাঁদের অজানা
থাকার কথা নয়। ১,০৮৮ খৃষ্টাব্দে ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয় ইতালির বলনিয়াতে।
দ্বিতীয়টি প্যারিসের ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস, যার সুচনা ১১৫০ সালে। তারপর একে একে
অনেকগুলো উঁচুমানের বিশ্ববিদ্যালয় উঠে আসে ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত, যার
মাঝে বিশেষভাবে পরিচিত হল অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ। এবং ঠিক সেই সময়টাতেই আলহামরার
কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমাদের মুর শাসকরা। বিড়ম্বনার বিষয় হল যে ওই সময়ই
স্পেনের খৃস্টানশাসিত অঞ্চলে সেদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন গির্জার
পাদ্রীরা (১২০৮-১২১৪)! (আমার মুসলিম ব্রাদাররা হয়ত বলবেন, কেন, কায়রোতে যে
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হল ৯৭০-৯৭২ সালের ভেতর সেটা কি গোণার মধ্যে পড়ে না?
অবশ্যই পড়ে। তবে আমরা যেন ভুলে না যাই যে আল-আজহার তখন সত্যিকার অর্থে
‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ছিল না মোটেও, ছিল একটা বড়সড় মাদ্রাসা, যেখানে মুসলিম ছেলেরা ইসলাম
ধর্ম শিখত, তার বাইরে একটি বিষয়ও ছিল না উল্লেখ করার মত। ধর্মের বাইরে একমাত্র
একটা জিনিসই ছিলঃ চন্দ্রকলার গণনাপদ্ধতি! আসলে আল-আজহারকে একটি আধুনিক
বিশ্ববিদ্যালয়তে পরিণত করেন মিশরের সামরিক নেতা কর্নেল নাসের, ১৯৬১ খৃষ্টাব্দে। ওই
বছরই আল-আজহারের পাঠক্রমতে প্রবেশ করে অর্থনীতি, বাণিজ্য, প্রকৌশল, এধরণের সেকুলার
বিষয়াদি) তাহলে কেমন করে বলি মুসলমানদের জ্ঞানস্পৃহা অন্য কোনও জাতির চাইতে কম নয়?
কেমন করে বলি যে তাঁরা মোহাম্মদের (দঃ) “চীন ভ্রমণের” বাণী অক্ষরে অক্ষরে পালন করে
এসেছেন? তাঁরা লক্ষ লক্ষ মসজিদ বানিয়েছেন (যা তাঁরা এখনো করে যাচ্ছেন পৃথিবীর এক
প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে), তাঁরা অজস্র মাজার আর কবর বানিয়ে যাচ্ছেন যেখানে
সুযোগ পান সেখানেই, অথচ একটা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার চিন্তা যেন কারুর
মাথায়ই উদয় হতে চায় না। এই মজ্জাগত দুর্বলতাগুলোর জন্যেই পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থে
কোনও ইসলামিক “সভ্যতা” তৈরি হতে পারেনি, অন্তত আমার মতে।
পাঁচ
ইতিহাসের ওই যুগটাই ছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের যুগ। যাকে আমরা, বর্তমান যুগের
কিঞ্চিৎ লেখাপড়া জানা লোকেরা, খানিক হীনদৃষ্টিতে দেখি, যাকে আমরা ‘ঘৃণ্য
সাম্রাজ্যবাদ’ বলে অভিহিত করি। কিন্তু এই ‘ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদ’এর দায়ে দায়ী ছিলেন
না এমন কোনও বড় শক্তির উদাহরণ খুব একটা দেখিনা ইতিহাসে। এই মহৎ কাজটিতে সবচেয়ে
বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী জাতিগুলো। মধ্যযুগের একটা সময় তো
তারা পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তার করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এবং তারা
যেখানে গেছেন সেখানে কেবল সৈন্যসামন্ত আর আমলাদেরই নিয়ে যান নি, জাহাজবোঝাই
ধর্মযাজকও নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে এটাও অনস্বীকার্য যে তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গঠন
করেছেন সর্বত্র। আজকে পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার সিংহভাগই যে খৃষ্টান ধর্মের অন্তর্গত
তার কারণ এই ধর্মটির অপার মহিমা হয়ত ততটা নয়, যতটা ওই ধর্মের সাথে ক্ষমতাবান
শাসকদের মিলমহব্বতের সম্পর্কটি। তবে আমরা, মুসলমানরা, সবসময় যা মনে রাখতে পারিনা,
সেটা হল যে আমাদের মুসলিম রাজাবাদশা আর আমির ওমরাগণও এব্যাপারে খুব একটা পিছিয়ে
ছিলেন, তা নয়। ৬৩৪ সাল থেকে তাঁরা ক্রমাগত রাজ্য জয় করে গেছেন, যেখানে যা তাঁদের
চোখে পড়েছে, এবং যা তাঁদের সামরিক ক্ষমতার আয়ত্তের ভেতর ছিল। এই সাম্রাজ্য দখলের
প্রক্রিয়াটি তাঁদের অব্যাহত থেকেছে বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত। আজকে সারা বিশ্বে
মোট ১৫০ কোটি মুসলমান দেশে দেশে ছড়িয়ে আছেন, সেটাও সম্ভবত ইসলাম ধর্মের মহান
আদর্শের জন্যে ততটা নয় যতটা ক্ষমতার তাগদের জন্যে। (আশা করি আমার এই উক্তিটি কোনও
পাঠকের কোমল ধর্মানুভূতিতে আঘাত করবে না। এটা কেবল ঐতিহাসিক সত্যতার জন্যেই উল্লেখ
করা)। তফাৎ হল এই যে খৃষ্টানরা গির্জা যত বানিয়েছেন স্কুলকলেজও বানিয়েছেন
প্রচুরপরিমাণ। এবং বেশ উঁচুমানের,
আধুনিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। যার প্রমাণ আমাদের নিজেদের দেশেই। ঢাকাতে একসময়
“ভালো” স্কুল বলতে যা বোঝাত তার মধ্যে অন্যতম সেরা ছিল সেন্ট গ্রেগরি স্কুল আর
নটার্ডাম কলেজ----আর মেয়েদের জন্যে ছিল হোলি ক্রস। এগুলো সবই খৃষ্টান পাদ্রীদের
দ্বারা পরিচালিত।
কিন্তু স্বদেশের প্রসঙ্গ নিয়ে
আলোচনা করার আগে একটু মধ্যযুগীয় ইতিহাসের পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক। মধ্যপ্রাচ্যে
ইসলামিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে আরবের উম্মায়াদ বংশের রাজত্বকালের সময়
তাঁদের রাজধানী ছিল সিরিয়ার দামাস্কাসে। উম্মায়াদ বলতে কি বুঝায়? তাঁরা ইসলামের
অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা মোয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের বংশধর। খোলাফায়ে রাশেদিনের তৃতীয়
খলিফা হজরত উসমানের (৬৪৪-৬৫৬) শাসনকালে তিনি ছিলেন দামাস্কাসের স্থানীয় শাসনকর্তা।
তারপর ৬৬১ খৃষ্টাব্দে, মুসলমানদের প্রথম গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পর তাঁরা নিজেরাই
খলিফাত্ব ঘোষণা করে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করেন দামাস্কাসকে কেন্দ্র করে।
উম্মায়াদদের সেই যুগটাই ছিল তৎকালীন ইসলামিক সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বর্ণযুগ। পূর্ব
এবং পশ্চিম উভয় দিকে দ্রুতবেগে তাঁরা রাজ্য জয় করে যাচ্ছিলেন একের পর এক। পশ্চিমে
তাঁরা চলে গিয়েছিলেন সুদূর স্পেন পর্যন্ত। পূর্বে ভারতবর্ষের সিন্ধু প্রদেশ ও মুলতান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁদের রাজত্ব। (১৭ বছর বয়ষ্ক আরব সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসেমের (৬৯৫-৭১৫)কথা কে না পড়েছে
ভারতবর্ষের ইতিহাসে? কার জানা নেই যে তাঁকেই পরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় যখন তাঁর বয়স
যখন মাত্র ২০!) তবে একটা গুণ ছিল উম্মায়াদদের----সহনশীলতা। অমুসলমান প্রজাদের ওপর
বিদ্বেষমূলক আচরণের নীতি তাঁরা অনুসরণ করেননি। মোয়াবিয়ার স্ত্রী, অর্থাৎ
কারবালাখ্যাত এজিদের মা, তিনি নিজেই ছিলেন খৃষ্টান। অতএব খৃষ্টানদের প্রতি তাঁদের
মনোভাব ছিল খুবই সৌহার্দপূর্ণ। চাকরিবাকরির উচ্চপদস্থ আসনে অমুসলমান নিয়োগের ব্যাপারে
তাঁদের কোনও বাধানিষেধ ছিল না। তারপর মুসলমানদের পরবর্তী গৃহযুদ্ধটি (মূলত সেটা
ছিল আরব-অনারবের যুদ্ধ) যখন সমাপ্ত হয় ৭৫০ খৃষ্টাব্দে, তখন উম্মায়াদদের বিতাড়িত
করে সাম্রাজ্য দখল করে নেন আব্বাসী বংশের প্রথম খলিফা আল-মনসুর, এবং তাঁরা
দামাস্কাস থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান
বাগদাদে, যাতে করে পারস্যের কাছাকাছি চলে যেতে পারেন আরব প্রভাব যথাসম্ভব এড়িয়ে। আব্বাসী বংশের উৎপত্তি হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এর ছোট
চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মোত্তালিবের (৫৬৬-৬৫৩) নামানুসারে। খলিফা মনসুরের সময়
থেকেই আসলে ইসলামি ‘স্বর্ণযুগ’এর প্রথম আলোকরশ্মি ফুটে ওঠে ইতিহাসের পাতায়। বদ্ধ
দুয়ার একটু একটু করে উন্মোচিত হতে থাকে। ইসলামিক জগতে বইতে শুরু করে সংস্কারের
হাওয়া, যা কিছুদিন আগেও ছিল সম্পূর্ণ অভাবনীয়। আরবদের শক্ত মুষ্ঠিবন্ধন থেকে মুক্ত
করে তিনি তাঁর পারস্যপ্রভাবিত নব্য মুসলমানদের তুলে আনার উদ্যোগ নেন তাঁর দীর্ঘ
শাসনকালে (৭৫০-৭৮৬)। তিনি সামরিক শক্তির চাইতে বেশি মূল্য দিতেন বুদ্ধিশক্তিকে।
তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে এরকমঃ “ একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কলমের কালি একজন শহীদের
রক্তের চেয়েও পবিত্র”। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দূরদর্শী ছেলে হারুনুর রশীদ (শাসনকাল
৭৮৬-৮০৯) সেই সংস্কার প্রক্রিয়াটি অব্যাহতই রাখেননি কেবল, তাকে আরো জোরদার করে
তুলেছিলেন। বাগদাদের ‘জ্ঞানভবনের’ পরিকল্পনা আসলে তাঁরই। তাঁরই তত্বাবধানে এর
নির্মাণকর্ম শুরু হয়েছিল, যদিও তা পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়িত করেছিলেন তাঁর ছোট ছেলে
খলিফা আল-মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩)। খলিফা হওয়ার কথা ছিল বড় ছেলে আল-আমিনের, যদিও হারুনুর
রশীদ ভাল করেই জানতেন যে সেই ছেলের যথেষ্ঠ যোগ্যতা নেই খলিফা হবার। যাই হোক, অনেক পারিবারিক
কোন্দল আর ঝগড়াঝাটির পর বাবার মৃত্যুর প্রায় চার বছর পর মামুন কায়েম হয়ে বসেন
খলিফার আসনে। বিরাট ভাগ্য ইসলামিক বিশ্বের! প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন একপ্রকার
বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন মানুষ। গতানুগতিক চিন্তাধারাতে মোটেও আস্থা ছিল না তাঁর। বিশেষ করে তিনি ছিলেন মোল্লাতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। কথিত আছে যে খলিফা মামুন মনেপ্রাণে সসময়কার চাঞ্চল্যকর
মুতাজিলা আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। প্রশ্ন হলঃ ‘মুতাজিলা আন্দোলন’ বিষয়টা আসলে কি।
এর সূত্রপাত হয় অষ্টম শতাব্দীতে, বর্তমান ইরাকের বসরা শহরে, যখন ওয়াসিল ইবনে আতা
নামক এক শিক্ষার্থী তাঁর রক্ষণশীল চিন্তাধারার শিক্ষক হাসান-আল-বাস্রির সাথে ইসলাম
বিষয়ক কোন একটা প্রসংগ নিয়ে তর্কাতর্কি করে রাগ করে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। সেই
অপরাধে তাঁকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়। এই যে রাগ করে বেরিয়ে যাওয়া,
প্রতিবাদ করে শিক্ষকের কথা অমান্য করা, তাঁকে কঠিন প্রশ্নের সম্মুখিন করা, এটা ছিল
ইসলামের গতানুগতিক ধারাতে সব নিষিদ্ধের সেরা নিষিদ্ধ। মুতাজিলার মূল মর্মটি তার বিপরীতঃ অন্ধ বিশ্বাস নয়, যুক্তি এবং বিতর্কের মাধ্যমে ধর্মকে পরীক্ষা করা, তার চর্চা করা, তাকে
যুগের আলোকে নতুন করে ঢালাও প্রস্তরখণ্ড নয়। মুতাজিলা মতবাদের তিনটি মূল স্তম্ভঃ
(১) আল্লা একটি ধ্রুব সত্ত্বা, এবং তিনি সৃষ্ট, অসৃষ্ট নন;
(২) মানুষ একটি মুক্ত প্রাণী;
(৩) মানুষের নির্বাণের জন্য অপরিহার্য যে জ্ঞান তার উৎস তার নিজেরই যুক্তি
দিয়ে সবকিছু যাচাই করবার ক্ষমতা। পবিত্র গ্রন্থ নাজেল হওয়ার আগে, এবং পরে, মানুষের
জ্ঞানের প্রধান উৎস তার বুদ্ধিজাত যুক্তি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে
জ্ঞানার্জনের দায়িত্বটি প্রতিটি মানুষের জন্যে বাধ্যবাধকতামূলক হয়ে ওঠে।
দারুণ বিপ্লবী কথাবার্তা। নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বজ্রধ্বনির কথা
স্মরণ করিয়ে দেয়।
খলিফা মামুন এই বিপ্লবী চিন্তাধারার
সমর্থকই ছিলেন না কেবল, সচেতন পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। আরো একটা বৈশিষ্ট্য
ইবনে সিনা
|
গোড়া থেকেই তাঁর সাধের স্বপ্ন ছিল,
না, রাজ্যবিস্তার নয়, ক্ষমতার আস্ফালন নয়, মার্বেল পাথরের বিশাল সব অট্টালিকা নির্মাণ
তো অবশ্যই নয়, তাঁর স্বপ্ন ছিল সেই জ্ঞানমন্দিরের কাজটি সমাপ্ত করা, এবং সেখানে
রাষ্ট্রের সকল জ্ঞানীগুণি ব্যক্তিদের জড় করে নতুন জ্ঞানসৃষ্টির উন্মাদনাতে মাতিয়ে
তোলা। ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুব আকৃষ্ট
ছিলেন গ্রীক দর্শনের প্রতি। প্ল্যাটো আর এরিস্টটোল ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়
দার্শনিক। সুতরাং জ্ঞানভবন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে প্রথমেই ছিল সেই গ্রীক
পণ্ডিতদের বইগুলো, তাঁদের রচিত অন্যান্য পুঁথিপত্র, সব আরবি ভাষায় অনুবাদ করে তার
মূল নির্যাসটুকু আহরণ করার সুযোগ দেয়া সবাইকে। গ্রীকরাই নয় কেবল, ভারতীয়
গাণিতিকরাও সেসময় পৃথিবীর সেরা পণ্ডিত বলে পরিচিত ছিলেন। অতএব তাঁদের কাজও তিনি
আরবিতে অনুবাদের আয়োজন করেন। উদ্দেশ্যঃ গ্রীক এবং ভারতীয়রা যা জানতেন তার ওপর
ভিত্তি করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা, নতুন আলোকে আলোকিত করে তোলা আপামর জনসাধারণকে। তিনি
এতটাই উৎসাহী ছিলেন সেই জ্ঞানভবনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে যে তিনি নিজে
প্রায় প্রতিদিনই যোগ দিতেন তাদের তর্কবিতর্কের অনুষ্ঠানগুলোতে---জানতে চাইতেন ওঁরা
কি নিয়ে আলাপ করছেন, কতটা গভীরে তাঁরা যেতে পারছেন জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতে।
দুর্ভাগ্যবশত খলিফা মামুনের সেই
অমর কীর্তির ফসল তিনি নিজে উপভোগ করে যেতে পারেননি। জ্ঞানভবনের নির্মাণকর্ম শেষ
হবার এক বছরের মাঝেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। কিন্তু তাঁর কাজ ব্যর্থ হয়নি।
জ্ঞানবৃক্ষের যে বীজ তিনি বপন করে গিয়েছিলেন তা অচিরেই পুষ্পেপত্রে পল্লবিত হয়ে
দিকবিদিক সুশোভিত ও সুসুরভিত করে তোলে। দিকবিদিকের জ্ঞানপিপাসু মানুষ সেখানে
আকৃষ্ট হতে থাকেন। মুক্তমন আর মুক্তচিন্তার উদার উন্মুক্ত পরিবেশে মুসলিম-অমুসলিম
সর্বপ্রকার সৃষ্টিশীল মানুষের উপোসী মন উদ্দাম ধারাতে উত্তাল হয়ে ওঠে। ইসলামিক
বিশ্বের স্বর্ণযুগ বলতে যা বোঝায় তার সত্যিকার সূত্রপাত হয়ত তখনই হয়, সাম্রাজ্যবিস্তারের
কারণে নয়। সাম্রাজ্যবিস্তার যদি সত্যি সত্যি কোনও জাতিকে উচ্চ সম্মানের অবস্থানে
তুলে নিয়ে থাকে তাহলে আমি বলব, তার সিংহভাগই এসেছে তার অর্থসম্পদের মধ্য দিয়ে নয়,
জ্ঞানসম্পদের মধ্য দিয়ে। ইসলামিক সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল পারস্য, যেখানে
একটা বড়মাপের সভ্যতা ছিল, এবং যার ইতিহাস গ্রীসের মতই প্রাচীন ও সমৃদ্ধ।
ভারতবর্ষের তৎকালীন গাণিতিক উৎকর্ষের সুফল তাঁরা নিজেদের দেশে নিয়ে যেতে
পেরেছিলেন----শূন্য আর দশমিক সংখ্যার ব্যবহার তার অন্যতম উদাহরণ। পারস্য আর
ভারতবর্ষের বিপুল সভ্যতার সংস্পর্শে এসে মরুভূমির শুষ্ক বালিতে উদয় হওয়া আরবজাতিও
মার্জিত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়, সভ্য হয়ে ওঠে আস্তে আস্তে।
খলিফা মামুনের মৃত্যুর পর পরবর্তী
দুজন খলিফা, আল-মুতাসিম (৮৩৩-৮৪২) ও আল-ওয়াহিক ( ৮৪২-৮৪৭), তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি
হিসেবে জ্ঞানভবনের মহান ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছিলেন, কারণ তাঁরা নিজেরাই
ছিলেন মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সমর্থক---ধর্মীয় গোঁড়ামির চেয়ে মৌলিক চিন্তা ও
জ্ঞানস্পৃহার গোঁড়ামি তাঁদের অধিকতর পছন্দ ছিল। কিন্ত সেই মুক্ত বাতাসের গতি একটু
একটু করে উল্টোদিকে বইতে শুরু করল পরবর্তী খলিফা আল-মুতাওয়াক্কি (৮৪৭-৮৬১) এর সময়
থেকে। তাঁর মনোভাব ছিল তাঁর পূর্বপুরুষদের বিপরীত। তিনি মুতাজিলা মতবা মোটেও পছন্দ
করতেন না। তিনি ইসলামের আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও প্রতিপালনে বিশ্বাসী। গ্রীক দর্শনকে
তিনি অবজ্ঞার সাথে দেখতেন, ভাবতেন ওটা ইসলামবিরোধী। অতএব বর্জনীয়।
মুসলিম জগতের জ্ঞানচর্চার সেই
স্বর্ণযুগটুকু যে কেবল বাগদাদের জ্ঞানভবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। ওই একটা
সময় ছিল যখন পুরো ইসলামিক বিশ্বতেই মানুষ সজাগ হয়ে উঠছিলেন যে জ্ঞানচর্চার চাইতে
বড় আর কিছু হতে পারেনা----সব চর্চার বড় চর্চা হল জ্ঞানের চর্চা। ইবনে সিনা
(৯৮০-১০৩৭), যাঁকে আভেসিনা বলে অভিহিত করা হয়য় পশ্চিমে, তাঁর বড় পরিচয় আধুনিক
চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিসেবে। কিন্তু তিনি বড়মাপের দার্শনিকও ছিলেন। তাঁর আগে
ছিলেন দামাস্কাসের আল-ফারাবি (৮৭০-৯৫০) নামক আরো এক বড়মাপের দার্শমিক। ইবনে সিনার
মত তিনিও ভীষণভাবে আকৃষ্ট ছিলেন প্ল্যাটো আর এরিস্টোটলের প্রতি। আসলে এরিস্টোটলের
ওপর আল-ফারাবির জ্ঞানগর্ভ কাজ থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ইবনে সিনা, এবং
পরবর্তীকালের ইবনে রুশদ। মজার ব্যাপার হল আল-ফারাবি আর ইবনে সিনা দুজনই প্রায় একই
রকম মনোভাব পোষণ করতেন ধর্ম ও দর্শন ব্যাপারে। তাঁরা দুজনই বিশ্বাস করতে্ন যে দর্শন
ও ইসলাম পরস্পরের সঙ্গে একই সূত্রে বাঁধা, একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয়। তবে দর্শন
নিয়ে আলাপ-আলোচনাগুলো কেবল উন্নত মানের জ্ঞানীজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত,
সাধারণ মানুষের পর্যায়ে তাকে নামিয়ে আনা ঠিক নয়। এই বিষয়টিতে তাঁরা যেন প্ল্যাটোর
সেই দার্শনিক-নৃপতির নীতটিকেই সমর্থন জানাচ্ছেন। প্ল্যাটোর ধারণা ছিল যে একটি
আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতার যোগ্যতা কেবল উচ্চমানের জ্ঞানীগুণি ব্যক্তিদেরই। ইবনে
সিনা ও আল-ফারাবি দুজনেরই মতানুসারে সাধারণ মানুষের জন্যে কোরানের আক্ষরিক শিক্ষাই
যথেষ্ঠ---তাদের কাছে কোরানের গভীর দার্শনিক অর্থ বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ নেই (সেই
একই প্ল্যাটোনিক কথাবার্তা)।
ইসলামের গৌরবযুগের অবসান ইতিহাসের
ঠিক কোন্ মুহূর্তে সূচনা হতে শুরু করে তা বলা সম্ভব নয়। তবে আমার ব্যক্তিগত মত এই
যে পরিবর্তনের বাতাস উল্টোদিকে বইতে আরম্ভ করে সেই মধ্যযুগেই। এবং তা ঘটে কোনও
খলিফা-সুলতানের খেয়ালখুশি বা তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতার জন্যে নয়। ঘটে ইসলামের কিছু
বড় বড় পণ্ডিতদেরই কারণে। খলিফা মামুনের সময় যে একটা বলিষ্ঠ জ্ঞানসাধনার পরিবেশ গড়ে
উঠেছিল তা আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়তে থাকে দু’একশ’ বছরের মাঝেই। কিন্তু প্রগতিশীল
চিন্তার পথে বড় বাধাটা তৈরি হয়, নিশ্চয়ই তাঁর নিজেরই অজান্তে, একজন বিশাল
ব্যক্তিত্ব দ্বারা---তাঁর নাম ইমাম গাজ্জালি (১,০৫৮-১,১১১)। তাঁর জন্ম ইরানের
ইস্ফাহান শহরে। অসম্ভব মেধাবী মানুষ ছিলেন তিনি। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতে
ছিল তাঁর অসামান্য বুৎপত্তি। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ এখনো
ইমাম গাজ্জালি
|
পরবর্তী যুগে যখন ইবনে রুশদ ইবনে
সিনা ও আল-ফারাবির গভীর চিন্তামূলক লেখালেখি পড়ে অনুপ্রাণিত বোধ করেন তখন ইমাম
গাজ্জালিকে বেশ কঠোর ভাষাতেই সমালোচনা করেছিলেন ইবনে সিনার বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ
মন্তব্য প্রকাশ করার জন্যে।
মধ্যযুগের সেই স্বর্ণখচিত ইতিহাস
ইসলামের, তার পূর্ণ সুফল কারা ভোগ করেছে বেশি? আমি মনে করি, পশ্চিম। ইউরোপের
নবজাগরণের যুগ আসলে আরবদেরই দান, এবং সেটা পশ্চিমের ঐতিহাসিকরা নির্দ্বিধায়
স্বীকার করেছেন। তাঁরা গণিত শিখেছেন মুসলমানদের কাছ থেকে, আধুনিক চিকিৎসা শিখেছেন,
ভূগোল শিখেছেন, পদার্থবিজ্ঞানও কম শেখেননি, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতার মূল আদর্শটুকুও
মধ্যযুগীয় মুসলমানদের কাছ থেকেই পাওয়া। সেগুলো আমরা ইউরোপিয়ানদের লেখা বইপত্র
থেকেই জানতে পারি।
বড় প্রশ্নঃ এত বড় একটা সভ্যতা কেমন
করে ক্ষয় হয়ে গেল আস্তে আস্তে। ধর্মপরায়ন মুসলমানদের বলতে শুনেছিঃ তার কারণ আমরা
ইসলামের মূল আদর্শগুলো থেকে সরে এসেছি; আমাদের ঈমানের জোর কমে গেছে। কিন্তু আসলে
কি তাই? সত্যিকার কারণটা কি এই নয় যে মধ্যযুগের মুসলিম গুণিজনরা জ্ঞানের যে মূল্য
দিতেন, মেধার যে সম্মান দিতেন, সৃষ্টিশীলতাকে যতটা স্বীকৃতি দিতেন, সেই গুণগুলোই
পরবর্তীকালের ধর্মান্ধরা বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে উল্টোদিকে যাত্রা শুরু
করেছিলেন? জ্ঞানসাধনার চেয়ে শ্রেয় মনে করেছিলেন ধর্মপালন?
পাঁচ
ইসলামিক ইতিহাস ও কালচারের ওপর
অনেকগুলো জ্ঞানগর্ভ বই লিখেছেন অধ্যাপক বার্ণার্ড লুইস (১৯১৬-)। অত্যন্ত সম্মানিত
নাম একটি, এমনকি ইসলামিক জগতেও। তাঁর বহুলপঠিত ও নন্দিত বইগুলোর মধ্যে একটির নামঃ
“ What went wrong?” মূলত তুরষ্কের অটোমান সভ্যতার উত্থান ও পতনের কাহিনীর ওপর
ভিত্তি করে লেখা। তবে এতে কেবল তুরষ্কের কথাই নেই, সমগ্র মুসলিম বিশ্বেরই একটা
মোটামুটি ছবি তুলে ধরা হয়েছে। বইটির নামকরণের পেহনে মূল চিন্তাটির উৎস কোথায় তার
আভাস পাওয়া যায় ২২-২৩ পৃষ্ঠাতে। তিনি বলছেন যে যখন একটা জাতির পতন শুরু হয় গৌরবের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে তখন তারা
প্রথমদিকে স্বীকারই করতে চায় না যে তারা আর সামনে এগুতে পারছে না, বরং পিছিয়ে পড়ছে
অন্যান্য জাতির তুলনায়। তারপর যখন বাস্তবতার সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয় একসময় তখন
তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় এভাবেঃ “কার দোষে এই দুর্দশা আমাদের?” মধ্যযুগের ইউরোপে
এ’ই ছিল প্রশ্নের ধারা। এবং বর্তমান যুগের মধ্যপ্রাচ্যেও ঠিক একই প্রশ্ন তোলা হয়ঃ
কে সেই শত্রু আমাদের? তারা অজুহাত খোঁজে। সাধারণত তাদের সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়গুলোতে, বা বহিরাগত জনগোষ্ঠীর প্রতি। কিন্তু সেকালের প্রশ্নটি ঠিক এরকম
ছিল না। তাঁরা বরং জানতে চাইলেনঃ “কোথায় ভুল হয়ে গেল আমাদের”? সেই প্রশ্নের
প্রতিধ্বনিতেই বোধ হয় বইটির নামকরণ।
অটোমান সাম্রাজ্যের মূল
প্রতিষ্ঠাতার নাম ওসমান বে। ১,২৯৯ খৃষ্টাব্দে, দুর্ধর্ষ অম্বুজ তুর্কি বাহিনীর
সাহায্যে তিনি আনাতোলিয়ার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলটি দখল করে রাজ্য স্থাপন করেন। এবং
অতি অল্প সময়ের ভেতরই তাঁদের সাম্রাজ্য চতুর্দিকে বিস্তৃত হতে থাকে। দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ,
পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস, উত্তর আফ্রিকা, একের পর এক সবই তাঁদের দখলে চলে আসে। দীর্ঘ
ছয়শ’ বছর ধরে তাঁরা রাজত্ব করেন সেই বিশাল সাম্রাজ্যের ওপর। তাঁদের প্রথমদিককার
বিজয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল মহা পরাক্রান্ত রোমানদের হারিয়ে রোমান
সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল, কন্সটান্টিনোপল, দখল করে নেয়া, ১,৪৫৩ খৃষ্টাব্দে। একসময়
কন্সটান্টিনোপলের নাম ছিল বাইজেন্টিয়াম, এবং তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছিল নিরাট
এক খৃস্টান সভ্যতা----বাইজেন্টাইন সভ্যতা বলে যা আমরা পড়েছি ইতিহাস বইতে।
কনস্টান্টিনোপল চলে যাওয়া মানে পূর্ব ইউরোপে খৃস্টান প্রভাব-প্রতিপত্তির মেরুদণ্ড
ভেঙ্গে যাওয়া। তুর্কিরা পরে এই শহরটিরই নামকরণ করেনঃ ইস্তাম্বুল। এরপর অটোমান
সাম্রাজ্যের বিস্তার প্রতিহত করার মত শক্তি পৃথিবীতে আর একটিও ছিল না। তাঁদের
অপ্রতিরোধ্য সৈন্যবাহিনী জয় করে নেয় সমগ্র বলকান রাষ্ট্রসমূহ, দক্ষিণে গ্রীস এবং
সিসিলি। সেসময় গোটা মধ্যপ্রাচ্য অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। বর্তমান যুগের অনেক
মুসলমান পর্যবেক্ষকই হয়ত ভেবে দেখছেন না যে মধ্যপ্রাচ্যের এই যে চরম দুরবস্থার
দৃশ্য দেখছি আমরা তার পেছনে কেবল পাশ্চাত্য ‘সাম্রাজ্যবাদ’ই হয়ত একমাত্র দায়ী নয়,
ঐতিহাসিকভাবে অটোমানদেরও সম্ভবত একটা ছোট্ট ভূমিকা ছিল।
অটোমান সাম্রাজ্যের ছয়শ’ বছরের
রাজত্বকালকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেন পশ্চিমের পর্যবেক্ষকরা। ১,২৯৯-১,৪৫৩ঃ
উত্থান। ১,৪৫৩-১,৬৮৩ঃ বৃদ্ধি। ১,৬৮৩-১,৮২৭ঃ স্থবিরতা। ১,৮২৭ সাল থেকেই তাঁদের
পতনপর্বের সূচনা। ১,৯২২ সালে সেই পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে পাশ্চাত্য শক্তিসমূহের
কাছে তাঁদের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর, যখন শেষ সুলতান মেহমেদ(৬)কে নির্বাসিত করে
তুরষ্কের একচ্ছত্র ক্ষমতা দখল করে নেন আধুনিক মনোভাবাপন্ন তরুণ সামরিক নেতা কামাল
আতাতুর্ক। কিন্তু সেপ্রসঙ্গ আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্গত নয়। আমরা দেখতে
চাই, যে শক্তিটি বিশ্বব্যাপী একটা বিরাট ভূখণ্ড অধিকার করে রইলেন ১,২৯৯ থেকে ১,৯২২
সাল পর্যন্ত, শেষ হিসেবনিকাশের খাতায় তাঁদের সত্যিকার অর্জনগুলো কোথায়, তারা কি
দিয়ে গেছেন পৃথিবীকে যার সুফল প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ ভোগ করে এসেছে, সম্ভবত
ভবিষ্যতেও করবে? একটা জাতির লেগাসি বলতে তো তাই বোঝায়, তাই না?
ছোটবেলায় ইতিহাসে পড়তাম ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্ত যায় না। সেটা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই সত্য ছিল। কিন্তু
তার আগে প্রায় অনুরূপ একটা জায়গা দখল করে ছিলেন তুরষ্কের অটোমান সাম্রাজ্য। সেসময়
তাঁরা এক দুর্জয় দুর্বার শক্তি পৃথিবীতে। উত্তরে রাশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণে
গ্রীস, বুলগেরিয়া, পশ্চিমে অস্ট্রিয়্ হাঙ্গেরি সব তাঁদের পদানত। ওদিকে পারস্য আর ভারতবর্ষেও
অনেকখানি জায়গা তাঁদের দখলে। তাঁরা ছিলেন সেকালের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। তবে ব্রিটিশ
এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিক জাতিগুলোর সঙ্গে ওঁদের তফাৎটা ছিল যে তাঁরা
আস্তে আস্তে একটা নতুন যুগের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। দুটি বড় বড় ঘটনা ইউরোপের চেহারা
বদলে দিতে শুরু করে----রেনেসাঁ ও সংস্কার (যাকে বলা হয় রিফর্মেশন)। তদুপরি আধুনিক
বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ। ওদিকে যখন তুর্কিরা সেকেলে ঢাল-তলোয়ার আর ঘোড়াশাল নিয়েই
সন্তুষ্ট, সেখানে ইউরোপিয়ানরা উন্নত অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করে যাচ্ছেন,
যন্ত্রচালিত নৌবহর তৈরি করে ফেলছেন। সর্বোপরি ১,৪৩৯ খৃষ্টাব্দে জার্মানীর উইহান
গুটেনবার্গ (১,৩৯৫-১,৪৬৮) পশ্চিম বিশ্বকে এক অমূল্য জিনিস উপহার দেন---মুদ্রণযন্ত্র,
যার ফলে প্রথমে জার্মানীতে, পরে সারা ইউরোপে ব্যাপক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা
সম্ভব হয়ে ওঠে। একদিকে অটোমান সুলতান তাঁর বিশাল ধনসম্পদ আর শৌর্যবীর্যের
আকাশচুম্বি দম্ভতে বিভোর হয়ে বসে আছেন তাঁর সিংহাসনে, অপরদিকে পশ্চিমের ‘বিধর্মী’
ও ‘বর্বর’ জাতিরা দ্রুত অগ্রসর হয়ে চলেছে সম্মুখদিকে। তাদের নবার্জিত শক্তি ও
অটোমান মুসলমানদের ক্রমক্ষীয়মান ক্ষমতার প্রথম পরীক্ষা হয় ১,৬৮৩ খৃষ্টাব্দে, যখন
অটোমান বাহিনী হেরে যায় ভিয়েনার যুদ্ধে। বৃদ্ধির পালা সাঙ্গ হয়ে সূচিত হয় অটোমান
সাম্রাজ্যের বিন্দু বিন্দু রক্তক্ষরণ। কেন? কোথায় ভুল হয়েছিল তাদের? ঐতিহাসিকদের
মতে, ভুল তাঁদের নিরাপস আত্মগরিমাতে। “আমরা কি কম জানি”, সেই চিরাচরিত অর্বাচীন
মনোভাব। রসূলুল্লার সেই অমর বাণী “দরকার হলে চীনে যাও নতুন কিছু শেখার জন্যে”কে
লঙ্ঘন করার জন্যে। বিধর্মীদের কাছ থেকে শিখবার কিছু নেই, শিখতে চাওয়াটাও অনৈসলামিক,
এই বিশ্বাসের ওপর গোঁ ধরে বসেছিলেন তাঁরা। এমনকি ‘বিধর্মী’দের মুদ্রণযন্ত্রটিও
গ্রহণ করতে তাঁরা নারাজ। এই মুদ্রণযন্ত্রের কল্যানে জার্মানী থেকে পৃথিবীর সর্বপ্রথম
সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ১,৬০৫ খৃষ্টাব্দে। প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র বের হয় ব্রিটেনের অক্সফোর্ড থেকে---তার নাম ছিল ‘অক্সফোর্ড গ্যাজেট’। অটোমানদের প্রথম খবরের কাগজ? তুর্কি
ভষায়? প্রায় দুশ’ বছর পর, ১,৮৬০ খৃষ্টাব্দে। ‘কাফের’দের কাছ থেকে কেবল দুটি জিনিসই
গহণ করেছিলেন তাঁরা----বন্দুক আর সৈন্যদের পোশাক! পশ্চিম বিশ্বে নবযুগের সূচনার
সাথে সাথে অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়েও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল। ব্রিটেনে
দাসত্বপ্রথা আইন করে তুলে নেওয়া হয় ১,৮৩৩ সালে। তার পঁচিশ বছর আগেই সেখানে
দাসব্যবসা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যে তার কোনটাই হয়নি। বিবেকবান
সমাজকর্মীরা চাইলেও মোল্লারা ধর্মের দোহাই দিয়ে তাতে বাধা দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তিঃ
পবিত্র কোরাণ তো দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেনি, মানুষ করবে কোন্ অধিকারে? অকাট্য যুক্তি
বটে! তুরষ্ক আর পারস্যে দাসপ্রথা উঠে যায় বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে। সৌদি আরব আর
ইয়েমেনে তো ১,৯৬২ এর আগ পর্যন্ত দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। শোনা যায় যে মুসলিম বিশ্বের
কোন কোন জায়গায় এখনো দাসত্ব বহাল রয়েছে, আইনত না হলেও চোরাপথে তো বটেই।
ওদিকে জ্ঞানচর্চার কথা তুলতে গেলে
তো আরেক করুণ কাহিনী। জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ যে কতটা নিচে নেমে গিয়েছিল একসময় তার
একটা আভাস দিতে গিয়ে বার্নার্ড লুইস সাহেব তাঁর গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখছেনঃ “ Until
the late eighteenth century, only one medical book was translated into a Middle
Eastern language----a sixteenth-century treatise on syphlis, presented to
Sultan Mehmed VI in Turkish 1655.” ( অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক পর্যন্ত, মধ্যপ্রাচ্যীয় ভাষাতে সবেধন ণীলমনি
একটিমাত্র বই অনূদিত হয়েছিল, চিকিৎসাশাস্ত্রে। সিফিলিস
রোগের ওপর, ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে লেখা এ-বই সুলতান মেহমেদ (৬) এর হাতে তুলে দেওয়া
হয়েছিল ১,৬৫৫ খৃষ্টাব্দে)লেখক এখানে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ভোলেন না ইতিহাসের
একটি বিচিত্র বিড়ম্বনার প্রতি। ঐতিহাসিক সময়ের মাপকাঠিতে খুব বেশিদিনের কথা নয়,
মাত্র কয়েক শ’ বছর, যখন এই মুসলমানরাই ছিলেন সমগ্র ইউরোপিয়ান জাতির শিক্ষক। তাদের
এই ‘আলোকায়নের’ যুগ, এই ‘সংস্কারের’ যুগ, তার সূচনাই হয়ত সম্ভব হত না বাগদাদ আর
স্পেনভিত্তিক জ্ঞানীগুণি মুসলমান পণ্ডিতদের কাছ থেকে শিক্ষা না পেলে। সেসব কথা
ইউরোপিয়ানরা কোনদিন অস্বীকার করেননি----ইতিহাসের ঋণ যে জাতি ভুলে যায় সে জাতি
বেশিদূর এগুতে পারেনা। আরবরা গণিতের সংখ্যামালা শিখেছেন ভারতীয়দের কাছ থেকে। পরে
ইউরোপিয়ানরা শিখেছেন আরবদের কাছ থেকে। তার স্বীকৃতি তারা দিয়েছেন সেই সংখ্যামালাকে ‘আরবি সংখ্যা’ বলে অভিহিত করে,
ভারতীয় সংখ্যা নয়। অনুরূপভাবে বাগদাদের আরবরা যখন তৎকালীন আধুনিক জ্ঞানের প্রতি
উন্মুখ হয়ে ওঠেন, তখন তাদের প্রথম কাজটি ছিল বাইরের পৃথিবীতে যত জ্ঞানের বই আছে,
বিশেষ করে গ্রীক দর্শন, গ্রীক বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা,
সেগুলো সব আরবিতে তরজমা করে ভালো করে আয়ত্ত করে নেওয়া। তারপর নিজেদের মেধা ও
বুদ্ধি প্রয়োগ করে নতুন জ্ঞান সঞ্চার করা। এভাবেই একটা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। গ্রীকরা
শেখেন কোথায়? প্রধানত মিশর আর বেবিলনের কাছ থেকে। জ্ঞানবিস্তারেরও একটা সেতুবন্ধন
আছে---এক জাতির জ্ঞান আরেক জাতি আহরণ করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে। বর্তমান যুগের মত
দ্রুত জ্ঞানের প্রসারণ অবশ্য সম্ভব ছিল না সেসময়, কিন্তু জানার আকাঙ্ক্ষা থাকলে
একটা যোগাযোগ সূত্র তৈরি হয়েই যায়। দুর্ভাগ্যবশত ইতিহাসের এই মূল্যবান শিক্ষাটি
তুরষ্কের অটোমান সান্রাজ্যের মহামান্য সুলতানগণ কখনোই গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। বিষয়বৈভব
আর বিলাসবহুল জীবনের মদমত্ততায় এতটাই বিভোর তাঁরা যে চোখে ঠুলি দিয়ে আর কানে তালা
লাগিয়ে বসে আছেন এই ভেবে যে ‘এরা নিকৃষ্ট জাতি। এদের কাছ থেকে আমাদের কিছু শেখার
নেই’। তাদের পূর্বপুরুষদের যদি বলা যায় জ্ঞানপিপাসু, তাদের বেলায় বরং অজ্ঞতাপ্রিয় শব্দটাই বেশি
প্রযোজ্য।
উপসংহারে
আমাদের উপমহাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর দুয়েকটি মন্তব্যের লোভ সংবরণ করতে পারছি
না। সেখানে মুসলমানদের সাম্রাজ্য কায়েম হয়ে ছিল প্রায় ছয়শ’ বছর। এই এতগুলো বছরের
ভেতর মুসলিম সম্রাটরা কত না কীর্তি রেখে গেছেন ইতিহাসের পাতায় তাঁদের নাম
স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা হবে, সে আশায়। কিন্তু আসলেই কি তা’ই? হ্যাঁ, অজস্র মসজিদ তাঁরা
বানিয়েছেন যাতে মুসলমান প্রজারা সারাদিন সেখানেই পড়ে থাকতে পারে। অজস্র দুর্গও
বানিয়েছেন তাঁরা। বহু বড় বড় কবরও----এমনকি তাঁদের পরম গর্বের ধন তাজমহলটিও তো মূলত
বিশাল একটি কবর ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয়? একটা বড় লাইব্রেরি?
বাগদাদের ‘জ্ঞানমন্দির’এর মত একটি গবেষণাকেন্দ্র? ভারতের ইতিহাস আমি ভালো জানিনা,
তবে এমন কোনও প্রতিষ্ঠানের কথা অন্তত আমার কানে আসেনি।
তারপর
১,৬০০ খৃষ্টাব্দে মুগলদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাধারণ বনিকের বেশে প্রবেশ করেন
ব্রিটিশরা। এবং আস্তে আস্তে শক্ত করে দড়ি পাকাতে থাকেন মুসলিম শাসকদের গলায়। শেষে
সমগ্র ভারতবর্ষ ব্রিটিশ রাজের অন্তর্গত হয়ে যায় ১,৮৫৮ সালে। তারা ঔপনিবেশিক শাসক
ছিলেন অবশ্যই, ভারতীয়দের প্রতি ব্যবহার করেছেন ঠিক মুসলিম শাসকরা যেমনটি করেছেন
অটোমান সাম্রাজ্যের অমুসলমান প্রজাদের প্রতি। কিন্তু সাথে সাথে তারা বেশ কিছু
অবকাঠামোও তৈরি করে গেছেন যার সুফল আমরা এখনো ভোগ করছি। অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়,
ভালো ভালো কতগুলো উচ্চ বিদ্যালয়, লাইব্রেরি---এগুলো তারা করেছেন সেটা অস্বীকার
করবার উপায় নেই। ওদিকে ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় একদিকে যেমন ব্রিটিশ রাজের
বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন ওদিকে তাঁরা ব্রিটিশদের মাধ্যমে
পাশ্চাত্য জ্ঞানও অর্জন করে নেয়ার সুযোগ অগ্রাহ্য করেননি। কিন্তু আমাদের
সাম্রাজ্যহারা মুসলমান জাতি কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালেন? সেই অটোমানদের মতই অভিমান
করে থাকলেন বেশ কিছু সময় যে এই বিধর্মীদের কাছ থেকে কোনও শিক্ষা আমরা নেব না।
এভাবে প্রায় পঞ্চাশ বছর গোসা করে থাকার পর একদিন হঠাৎ খেয়াল হল তাঁদের যে, তাইতো,
সর্বনাশ, হিন্দুরা তো অনেক এগিয়ে গেছে আমাদের চাইতে। তখন তাঁরা তড়িঘড়ি করে একটা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলে ফেললেন মুসলমান ছেলেদের জন্যে, স্যার সৈয়দ আহমেদ নামক এক
বিচক্ষণ মুসলমান নেতার উদ্যোগে, যাকে আমরা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় বলে জানি। আসলে
গোড়াতে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় মোটেও ছিল না। তার নাম ছিল ‘মাদ্রাসাতুল উলুম’, ১,৮৭৫
খৃষ্টাব্দে। অর্থাৎ একটি বড়সড় মাদ্রাসা! সেটা পরে মোহামেডান-এংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজে
পরিণত হয়, এবং পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ১,৯২০ সালে। তখমই এর নামকরণ হয় ‘আলিগড়
বিশ্ববিদ্যালয়’।
আমাদের
মুসলমান জাতির সেই জ্ঞানবিমুখতা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। এখনো সেই অভিমান কাটেনি
আমাদের। এখনো মধ্যযুগের সেই স্বর্ণযুগের জাবর কেটে
যাচ্ছি----কোথায় গেল, কারা কেড়ে নিল, কারা সেই দুষমণ আমাদের, এ বলে মাথা
চাপটাচ্ছি। এখনো আমরা সুযোগ পেলেই মসজিদ বানাই, হাতে দুটি পয়সা এলে প্রথমে যাই হজ
করতে, তারপর দুটি গরু কোরবানি। তার পরিবর্তে যে একটা স্কুল বা কলেজে কিছু দান করলে
সমূহ উপকার হত সমাজের সে ভাবনাটি আমাদের কারুরই মাথায় যেন উদয় হতে চাইছে না। তাই
বলি দোষটা অপরের ঘাড়ে আরোপ করার আগে একটু আয়নার দিকে তাকালে ভালো হয়।
সূত্রঃ
(১) What went wrong? by Bernard Lewis, 2002,
Oxford University Press
(২) Symmetry, by Marcus du Sautoy, 2008, Harper Collins, NY
(৩) God’s Crucible, Islam and the Makings of
Europe, by David Levering Lewis, 2008, Norton and Co., Inc. NY
(৪) Rubaiyat-e-Omar Khayyam, translated by Edward Fitzerald, Garden City
Books, 1932
(৫) Internet
(৬) The Story of Philosophy, by Will Durant, 1933, Pocket Books, Inc. NY
মীজান রহমান :: Mizan Rahman
অটোয়া, ৮ই মার্চ, ২,০১৪
মুক্তিসন ৪৩
No comments:
Post a Comment