[উত্সর্গ: দূরদর্শী পেন্সিল-স্কেচ আর্টিস্ট মোস্তফা আজিজ - আমাদের দূর আকাশের তাঁরা। কী অপূর্বভাবে শিল্পী মোস্তফা আজিজ পেন্সিল দিয়ে জীবনের গল্প ফুটিয়ে তুলতেন। আমরা তাঁকেও মানে রাখিনি ....]
শফিউল ইসলাম
১.
রানীনগরের অল্প স্বল্প গল্প ♥♪♥
রানীনগর, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ। আমার এক বাল্য-বন্ধুর সঙ্গে আমি রানীনগর যাই। গ্রামের পথ ধরে হাঁটছি। পথের ধারেই দেখি একজন তার ছুটে যাওয়া গরুকে ধান-ক্ষেত থেকে বাগে আনতে-আনতে আর এক পথিক-কে জিজ্ঞাসা করছে:
:-- 'মিয়ে ভাই, আমার গরুডা ছুটে যাওয়ার জন্যিই আমি মিটিং-ই যাতি পারিনি। তা, মিটিং-ই কি ডিসিশন হয়ছে ?'
:-- 'মিটিং-ই ডিসিশন হয়ছে, বেশী তেড়িবেড়ি করলি চোদন মারে পাড়েফেলা দিবি; তারপর, যা হয় হবি!'
এই হলো রানীনগরের অপরূপ রূপের বাহার। আমাদের গ্রামের সাদা-সিধে সংলাপ! যা আমাদের শহরের সাহিত্য থেকে অনেক সরাসরি ও সহজ-সরল! যদিও আমাদের শহুরে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্যানভাস অনেক মার্জিত ও রুচিশীলদের দখলে। ইনিয়ে-বিনিয়ে সমস্যা-বহুল সাহিত্য রচনার কারুকাজে এদের জুড়ি নেই। গ্রামের সাধারণ জনগণ সমাধান খোঁজে সরাসরি, সাদা-সিধে সংলাপে ...!
এই গ্রামে বেড়াতে যাবার আসল কথাইতো আপনাদের বলা হয় নি! ঘটনাটা আমার কাছে ভীষণ শিক্ষনীয়! জীবন-যুদ্ধ। বাঁচা-মরার লড়াই! সে লড়াইয়ে আমি হারিনি। জীবন বাঁচাতে পারার সহযোগী-সহযোদ্ধা। সেই ছোট্ট মেয়েটি এখনো বেঁচে আছে। তাকেই আবার দেখতে যাই রানীনগর। সে গল্প অন্য কোন দিন...।
♥♪♥
২.
সাদা-সিধে সংলাপ ♥♪♥
আরেকদিন রানীনগরের পথ ধরে হাঁটছি। পথের ধারেই দেখি ১০-১২ জন ছেলে-মেয়ে একসাথে মার্বেল খেলছে ও কাদা-মাটি মেখে মারামারি করছে। একটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি:
:-- 'এই তোমরা কারা ?'
:-- 'আমরা ভাই-বোন।'
:-- 'তোমাদের মা-বাবা কি করে ?'
:-- 'এই কাম-ই করে!'
♥♪♥
৩.
হোম-ওয়ার্ক করি ♥♪♥
নব্বই দশকের কথা। লীডস বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ড। প্রবাসের ছাত্র-জীবনের একটা মজার ঘটনা। সপ্তাহের শেষে আমরা কোথাও মিলে-মিশে আড্ডা দিতাম। অনেক সময় সবাই একসাথে। আবার অনেক সময় ছেলেরা ও মেয়েরা আলাদাভাবে। এরকম এক আড্ডায় ঐ ঘটনার নায়িকা তার জীবনের এক অন্তরঙ্গ মহামিলনের গল্প শোনালেন। 'আনন্দ-ধারা বহিছে ভূবনে ...!' শুনুন তাহলে ....
এক ছোট ছেলে ও স্বামী (ছাত্র)-স্ত্রী মিলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। একটাই বিছানা। এক রাতে ছেলে ঘুমিয়ে। এই সুযোগে দুজনের মিলন-মেলার কলোতান! এক পর্যায়ে যখন ''ত'-এ তুমি 'থ'-এ থামি, থামবো না তুমি-আমি' - উচ্চাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গ সঙ্গীতের তাল-বেতালে 'ছন্দে-ছন্দে দুলি আনন্দে'র ধ্রুপদী-নাচের তা-ধিন-তা তুঙ্গে চলছে - ছেলে জেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছে - 'এই তোমরা কী করো?'
ছেলের বাবার কাছ থেকে উত্তর এলো, - 'বাবা তুমি ঘুমাও। আমি হোম-ওয়ার্ক করি!'
♥♪♥
৪.
ধান কাঁটার গান ♥♪♥
শৈশবে সুযোগ পেলেই গ্রামে ছুটতাম। প্রকৃতির বিশালতায়, মায়া-মমতায়, হারিয়ে যেতাম। বৃষ্টির টাপুর-টুপুর ছন্দে পুকুরে সাঁতার কাটতাম। ঝড়ের দিনে আম কুড়াতাম। সোনালী-সবুজ-মাঠের রৌদ্র-ছায়ায় প্রাণ ভরে খেলতাম। মার্বেল, পাঁচ-গুটি, বৌচি, ডাং-গুলি, লাটিম, ঘুড়ি ওড়ানো, দাঁড়িয়া বাঁধা, ক্যারম বোর্ড, মাছ ধরা, আরো কতো খেলা।
আমার নানা ছিলেন গ্রামের মাতুব্বর। সেসূত্রে নানা সময়ে নানা-বাড়িতে দেখেছি নানা আয়োজন। মৌসুমী ফসল লাগানো ও ওঠানোর সময় নানা-বাড়িতে বাড়তি কৃষকের সমাগম হতো। আমার শখ হলো সোনালী-সবুজ মাঠে ধান কাঁটবো! একজন কৃষক আমাকে অনেক যত্ন-সহকারে সব কলা-কৌশল শিখিয়ে দিলেন। ভাবছিলাম এ আর এমন কী কঠিন কাজ!
কিছুক্ষণ পর আমি কিছু ধানসহ আমার বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল কেঁটে ফেলি। বুঝতে পারলাম - কাঁচির কি ধার; এবং ধান কাঁটা মোটেই সহজ কাজ নয়। আর একজন কৃষক আমাকে আরো সহজ-সরল ভাষায় বোঝালো :
:- 'ধান কাঁটা অতো সোজা ভাবিছো? চোদন আছে। চোদনের নাম কুস্টা কাঁটা!'
আমি কুস্টা কাঁটারও হাতে খড়ি নিয়েছি! কুস্টা (পাট) কাঁটা আরো কঠিন! আমার কনিষ্ঠ আঙ্গুলের দাগ এখনো আমাকে মনে করিয়ে দেয় সেই সোনালী-সবুজ দিনগুলি - কৃষকদের ধান কাঁটার গান! এখনো প্রাণের মাঝে ধ্বনি তোলে:
'হেই সামাল হো, হেই সামাল হো;
হেই সামাল ও ধান হো
কাস্তে-টা দাও শান হো
জান কবুল আর মান কবুল,
আর দেবনা আর দেবনা
রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো ...।'
(আকালের সন্ধানে, মৃণাল সেন।)
'এই স্মৃতি-ঝলোমল সবুজ-মাঠের কাছে;
আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে...!'
শফিউল ইসলাম
১.
রানীনগরের অল্প স্বল্প গল্প ♥♪♥
রানীনগর, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ। আমার এক বাল্য-বন্ধুর সঙ্গে আমি রানীনগর যাই। গ্রামের পথ ধরে হাঁটছি। পথের ধারেই দেখি একজন তার ছুটে যাওয়া গরুকে ধান-ক্ষেত থেকে বাগে আনতে-আনতে আর এক পথিক-কে জিজ্ঞাসা করছে:
:-- 'মিয়ে ভাই, আমার গরুডা ছুটে যাওয়ার জন্যিই আমি মিটিং-ই যাতি পারিনি। তা, মিটিং-ই কি ডিসিশন হয়ছে ?'
:-- 'মিটিং-ই ডিসিশন হয়ছে, বেশী তেড়িবেড়ি করলি চোদন মারে পাড়েফেলা দিবি; তারপর, যা হয় হবি!'
এই হলো রানীনগরের অপরূপ রূপের বাহার। আমাদের গ্রামের সাদা-সিধে সংলাপ! যা আমাদের শহরের সাহিত্য থেকে অনেক সরাসরি ও সহজ-সরল! যদিও আমাদের শহুরে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্যানভাস অনেক মার্জিত ও রুচিশীলদের দখলে। ইনিয়ে-বিনিয়ে সমস্যা-বহুল সাহিত্য রচনার কারুকাজে এদের জুড়ি নেই। গ্রামের সাধারণ জনগণ সমাধান খোঁজে সরাসরি, সাদা-সিধে সংলাপে ...!
এই গ্রামে বেড়াতে যাবার আসল কথাইতো আপনাদের বলা হয় নি! ঘটনাটা আমার কাছে ভীষণ শিক্ষনীয়! জীবন-যুদ্ধ। বাঁচা-মরার লড়াই! সে লড়াইয়ে আমি হারিনি। জীবন বাঁচাতে পারার সহযোগী-সহযোদ্ধা। সেই ছোট্ট মেয়েটি এখনো বেঁচে আছে। তাকেই আবার দেখতে যাই রানীনগর। সে গল্প অন্য কোন দিন...।
♥♪♥
২.
সাদা-সিধে সংলাপ ♥♪♥
আরেকদিন রানীনগরের পথ ধরে হাঁটছি। পথের ধারেই দেখি ১০-১২ জন ছেলে-মেয়ে একসাথে মার্বেল খেলছে ও কাদা-মাটি মেখে মারামারি করছে। একটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি:
:-- 'এই তোমরা কারা ?'
:-- 'আমরা ভাই-বোন।'
:-- 'তোমাদের মা-বাবা কি করে ?'
:-- 'এই কাম-ই করে!'
♥♪♥
৩.
হোম-ওয়ার্ক করি ♥♪♥
নব্বই দশকের কথা। লীডস বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ড। প্রবাসের ছাত্র-জীবনের একটা মজার ঘটনা। সপ্তাহের শেষে আমরা কোথাও মিলে-মিশে আড্ডা দিতাম। অনেক সময় সবাই একসাথে। আবার অনেক সময় ছেলেরা ও মেয়েরা আলাদাভাবে। এরকম এক আড্ডায় ঐ ঘটনার নায়িকা তার জীবনের এক অন্তরঙ্গ মহামিলনের গল্প শোনালেন। 'আনন্দ-ধারা বহিছে ভূবনে ...!' শুনুন তাহলে ....
এক ছোট ছেলে ও স্বামী (ছাত্র)-স্ত্রী মিলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। একটাই বিছানা। এক রাতে ছেলে ঘুমিয়ে। এই সুযোগে দুজনের মিলন-মেলার কলোতান! এক পর্যায়ে যখন ''ত'-এ তুমি 'থ'-এ থামি, থামবো না তুমি-আমি' - উচ্চাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গ সঙ্গীতের তাল-বেতালে 'ছন্দে-ছন্দে দুলি আনন্দে'র ধ্রুপদী-নাচের তা-ধিন-তা তুঙ্গে চলছে - ছেলে জেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছে - 'এই তোমরা কী করো?'
ছেলের বাবার কাছ থেকে উত্তর এলো, - 'বাবা তুমি ঘুমাও। আমি হোম-ওয়ার্ক করি!'
♥♪♥
৪.
ধান কাঁটার গান ♥♪♥
শৈশবে সুযোগ পেলেই গ্রামে ছুটতাম। প্রকৃতির বিশালতায়, মায়া-মমতায়, হারিয়ে যেতাম। বৃষ্টির টাপুর-টুপুর ছন্দে পুকুরে সাঁতার কাটতাম। ঝড়ের দিনে আম কুড়াতাম। সোনালী-সবুজ-মাঠের রৌদ্র-ছায়ায় প্রাণ ভরে খেলতাম। মার্বেল, পাঁচ-গুটি, বৌচি, ডাং-গুলি, লাটিম, ঘুড়ি ওড়ানো, দাঁড়িয়া বাঁধা, ক্যারম বোর্ড, মাছ ধরা, আরো কতো খেলা।
আমার নানা ছিলেন গ্রামের মাতুব্বর। সেসূত্রে নানা সময়ে নানা-বাড়িতে দেখেছি নানা আয়োজন। মৌসুমী ফসল লাগানো ও ওঠানোর সময় নানা-বাড়িতে বাড়তি কৃষকের সমাগম হতো। আমার শখ হলো সোনালী-সবুজ মাঠে ধান কাঁটবো! একজন কৃষক আমাকে অনেক যত্ন-সহকারে সব কলা-কৌশল শিখিয়ে দিলেন। ভাবছিলাম এ আর এমন কী কঠিন কাজ!
কিছুক্ষণ পর আমি কিছু ধানসহ আমার বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল কেঁটে ফেলি। বুঝতে পারলাম - কাঁচির কি ধার; এবং ধান কাঁটা মোটেই সহজ কাজ নয়। আর একজন কৃষক আমাকে আরো সহজ-সরল ভাষায় বোঝালো :
:- 'ধান কাঁটা অতো সোজা ভাবিছো? চোদন আছে। চোদনের নাম কুস্টা কাঁটা!'
আমি কুস্টা কাঁটারও হাতে খড়ি নিয়েছি! কুস্টা (পাট) কাঁটা আরো কঠিন! আমার কনিষ্ঠ আঙ্গুলের দাগ এখনো আমাকে মনে করিয়ে দেয় সেই সোনালী-সবুজ দিনগুলি - কৃষকদের ধান কাঁটার গান! এখনো প্রাণের মাঝে ধ্বনি তোলে:
'হেই সামাল হো, হেই সামাল হো;
হেই সামাল ও ধান হো
কাস্তে-টা দাও শান হো
জান কবুল আর মান কবুল,
আর দেবনা আর দেবনা
রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো ...।'
(আকালের সন্ধানে, মৃণাল সেন।)
'এই স্মৃতি-ঝলোমল সবুজ-মাঠের কাছে;
আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে...!'
♥♪♥
শফিউল ইসলাম
কেমব্রিজ, ওন্টারিও, ক্যানাডা
২০১৪ মার্চ ০৯ (১-২)
২০১৪ মার্চ ১৪ (৩-৪)
Picture Credit: Shakila Haseen & Internet
Courtesy of: Vision Creates Value
শফিউল ইসলাম
কেমব্রিজ, ওন্টারিও, ক্যানাডা
২০১৪ মার্চ ০৯ (১-২)
২০১৪ মার্চ ১৪ (৩-৪)
Picture Credit: Shakila Haseen & Internet
Courtesy of: Vision Creates Value
No comments:
Post a Comment