মীজান রহমান
ডানপাশে মধ্যবয়স্ক মা এগিডি, মাঝখানে ২৫ বছরের মেয়ে ডায়ান, আর বামদিকে
তাঁর ছেলে বার্ট্রাণ্ড, ১৯ বছরে পড়ল বলে। তাঁরা ক্যামেরার দিকে তাকাতে চাননা, কারণ
গোটা পৃথিবীটাই তো বলতে গেলে তাঁদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। এঁদের
প্রত্যেকেরই একটা ইতিহাস আছে, একটা অত্যন্ত ভয়াবহ ইতিহাস।
প্রতিমুহূর্তে, প্রতিদিন। তাই আমরা কাঁদি, আমরা
ধূমপান করি, আমরা মদ খাই----আমরা ভুলতে চাই, ভুলতে পারিনা তবু ভুলতে চাই। বলে তারা সমস্বরে।
জোয়ান সওয়ার হয়েছিল সে হিসেব রাখার মত মনের অবস্থা
তার ছিল না। দুঃখের বিষয় যে কাজ ফুরনোর পর তারা যে দয়া করে একটা গুলি ঢুকিয়ে দিয়ে
যাবে তার খুলির ভেতর, ওই করুণাটুকুও বেচারির ভাগ্যে জোটেনি। বিশ বছর পর এখন যেন
বেঁচে থাকাটাই হয়েছে তার অভিশাপ, একটি বিভীষিকাময় রাত্রির বিনিদ্র, নিরন্তর
স্মরণিকা। বিশেষ করে যখন তার নিজের এই অভিশপ্ত শরীর দিয়েই জন্ম দিতে হয়েছিল একটি
কন্যাসন্তানকে----সেই বার্ট্রাণ্ড ছেলেটিরই মত একটি ধর্ষণজাত সন্তান।
বার্ট্রাণ্ডের মা ছেলেকে একসময় বুকে টেনে
নিতে পেরেছিলেন, কিন্তু শান্টাল তার মেয়েকে পারেনি। মেয়েকে কখনোই নিজের মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেনি বেচারি। মেয়ের গায়ে হাত রেখে
একটু আদর করা, না, তা’ও হয়ে ওঠেনি। দুজনে পাশাপাশি বসে থেকেও যেন কেউ কাউকে
চেনেনা, এমন ভাব। সে এক দুঃসহরকম করুণ দৃশ্য।
ইহুদীও ছিলেন সেখানে। ৭ই এপ্রিল, ১,০৯৯। সুবিশাল এক
খৃষ্টান বাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে শহরটিকে। কেউ যেন বেরুতে না পারে শহর
থেকে, কেউ ঢুকতেও না পারে। খাদ্যদ্রব্য, পানীয় সব আটক।১৫ই এপ্রিল শুরু হয় সশস্ত্র
আক্রমণ। দুর্গের দরজা ভেঙ্গে, উঁচু দেয়ালের ওপর পাহারারত মুসলিম সৈন্যদের তীরবিদ্ধ
করে তারা প্রবেশ করে নগরের অভ্যন্তরে। মুসলিম শাসক সেই প্রবল আক্রমণের মুখে
আত্মসমর্পণ করে নগরবাসীর প্রাণরক্ষা ছাড়া আর কোনও পথ দেখতে পেলেন না। কিন্তু
খৃস্টানদের মনে তখন অন্য চিন্তা। সামরিকভাবে পরাজিত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ ছিল
না, আসল লক্ষ জেরুজালেমের মাটি থেকে মুসলমানের শেষ রক্তবিন্দুটুকু নিঃশেষ করে
দেয়া। অতএব মুসলিম সৈন্যদের পুরোপুরি পরাস্ত করার পর তারা মনোযোগ দেয় নাগরিকদের
ওপর। ছেলে-বুড়ো মা-মেয়ে-শিশু কোনও ভেদাভেদ তারা মানেনি। দুদিনের অভিযানে বড় একটা
নগর একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। ওই হত্যাকাণ্ডের মত পৈশাচিক হত্যা খুব বেশি ঘটেনি
ইতিহাসে। শত্রুকে ঘায়েল করাই প্রধান উদ্দেশ্য নয়, শত্রুর কোনও চিহ্নও যাতে দেখতে
না পাওয়া যায় কোথাও, চিরতরে নির্বংশ করে ফেলা, এই সংকল্প নিয়েই তারা এসেছিল
সেখানে। ঐতিহাসিকরা জানেন যে তার ঠিক ৮৮ বছর পর মুসলিম বীর সেনাপতি সালাদিন
খৃস্টানদের কাছ থেকে পুনরায় জয় করে নেন জেরুজালেম, অথচ তিনি সেই গণহত্যার কোনরকম
প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করেননি, বরং খৃস্টান এবং ইহুদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটা
সম্প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে ইতিহাসের অন্যতম মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব
হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এখানে আরো উল্লেখযোগ্য যে জেরুজালেম যখন মুসলমানদের
দখলে চলে যায় ৬৩৪ খৃস্টাব্দে, খলিফা ওমর (রাঃ) এর সামরিক পরিচালনাতে, তখন তিনিও
অত্যন্ত উদারপন্থী সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন তদানীন্তন অমুসলমান সম্প্রদায়গুলোর
প্রতি। পরবর্তীতে আল-হাকিম প্রমুখ শাসনকর্তার বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে মুসলমানদের
প্রতি একটা বিরূপ মনোভাবে ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে। অনেকের ধারণা, ওই বিরূপ
মনোভাবটির জন্যেই এতটা হিংস্রতা প্রকাশ পেয়েছিল ১,০৯৯ সালের প্রতিশোধ অভিযানের
সময়।
জিঘাংসা এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আরেক সম্প্রদায়ের
আর্মেনিয়া তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মূল বিরোধটা ছিল জাতিগত ও ধর্মীয় ব্যবধান।
বাহ্যিক অজুহাতটি ছিল শত্রুর সঙ্গে মিতালি। তুরস্ক ছিল জার্মানির পক্ষে, আর
আর্মেনিয়ানদের সহানুভূতি হয়ত ছিল মিত্রপক্ষের সাথে----সেটাই তাদের অপরাধ। হত্যার
প্রাথমিক পর্বে তুর্কি সৈন্যরা ২৫০ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও জননেতাকে ঘর থেকে তুলে
হাজতে নিয়ে যায়। তারপর শুরু হয় এলোপাথারি হত্যা। যে যেখানে ছিল সেখান থেকে
জোরজবস্তি করে উঠিয়ে নিয়ে বিনাবাক্যে সোজা কতল। সুস্থ সবল পুরুষগুলো একদিক থেকে
ভাগ্যবান ছিলেন, কারণ তাদের মৃত্যুটা ছিল তাৎক্ষণিক। পাকড়াও করামাত্র শেষ। কিন্তু
যুবতি আর কিশোরীদের ভাগ্যে কি তা ঘটে কখনো? তারা যে ভোগ্য বস্তু। পৃথিবীর
কোনোও সেনাবাহিনী কখনো এই জিনিসটির প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছে বলে শোনা যায়নি।
পূর্ণমাত্রায় ভোগ করার পরই ছেঁড়া কাগজের মত আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলা, এতো সৈন্যদের
চিরকালের অভ্যাস।
এক
মানুষ ভুলে যায়, ছবি ভোলেনা কিছুই।
রোয়াণ্ডার
ওপর পর পর দুটি লেখা বেরিয়েছিল স্থানীয় পত্রিকায়। এবছর রোয়াণ্ডার গণহত্যার কুড়ি
বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সে উপলক্ষেই লেখা। সু মন্টগোমারি নামক এক অনুসন্ধানী
সাংবাদিক সেখানে সশরীরে গিয়েছিলেন তথ্য নিয়ে আসার জন্যে। অনেক ছবি তুলে এনেছেন।
সেই ছবিসংগ্রহের দুটি ছবি আমার দেখার ভাগ্য হল। একটিতে তিনজন মানুষ---তিনজনই মুখ
ফিরিয়ে রেখেছেন ক্যামেরার দিক থেকে। ওঁরা একে অন্যের কোমরে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন
সামনের নিঃশব্দ নীল উপত্যকার দিকে তাকিয়ে।
বার্ট্রাণ্ড-ডায়ান-ইগিডি
|
বিশ বছর আগেকার একটি দিন। দক্ষিণ রোয়াণ্ডার
ছোট্ট গ্রাম ‘হুই’য়ের টুটসি জনগোষ্ঠী হুটু ঘাতকদের হাতে বন্দী। পুরুষদের কেউ জীবিত
নেই---লম্বা দা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে সবাইকে। মেয়েরা আটক, তারা অসহায় ‘নারী’ বলে নয়, তারা ভোজ্য, ব্যবহার্য বস্তু বলে। ইগিডির
সামনে দাঁড়ানো আটজন পুরুষ---একে একে তারা বন্য জন্তুর মত ঝাঁপিয়েপড়ে তাঁর শরীরের
ওপর। কামড়ে কামড়ে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে, ভোগ করে নেয় তাঁকে। পাশের ঘরে তাঁর ৫ বছরের বাচ্চা মেয়ে ডায়ান। তার ওপর সওয়ার
হয়েছে আরো ক’টি হুটু পুরুষ। মেয়ের চিৎকার শুনে গুণবার চেষ্টা
করেছি্লেন তিনি ওদের সংখ্যা। পুরুষজাতির জন্য শিশুকন্যা আর কিশোরী কন্যা, যুবতী আর
প্রৌঢ়া কন্যা, তফাৎ কোথায়। এরা সকলেই তো যোনিযুক্ত জীব। ভগাঙ্কুর থাকলেই হল। ইগিডি একসময় গুণতে ভুলে যান। কি হবে গুণে। মেয়ে তো মরেই
গেছে----সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাঁর নিজের বেলাতেও তাই। মৃত্যুই তখন একমাত্র
কাম্যবস্তু। কিন্তু কি আশ্চর্য, তিনি মরে যাননি, এমনকি তাঁর শিশুকন্যাটিও মৃত্যুকে
ফাঁকি দিয়ে বেঁচে রয়েছে এখনো। শুধু তাই নয়। মা আর মেয়ের সাথে যোগ
দিয়েছে এই ছেলেটি, যার নাম দিয়েছেন তিনি বার্ট্রাণ্ড, ছবির সবচেয়ে বামপাশে
দাঁড়ানো, বড়বোনের কোমর-জড়িয়ে থাকা ছেলেটি, যাকে তিনি কামনা করেননি, যে তাঁর ইচ্ছার
ফসল ছিল না। বার্ট্রাণ্ড তাঁর সেই করালরাত্রির অবর্ণনীয় কষ্ট, অপমান আর লজ্জার
সন্তান----যে তাঁকে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় সেই বীভৎস মুখগুলোর কথা।
সেই মুখগুলোর কথা ভাবতেই ঘৃণায় পেট ফেটে বমি আসে তাঁর, অথচ কেন যে কোন অভিশাপে
কিছুতেই পারছেন না তিনি একই ঘৃণাতে ভরে দিতে এই ছেলেটির মুখ। বিধাতার কি অদ্ভুত
বিচার মেয়েদের ওপর। একই মুখের ভেতর কেন তাঁকে সইতে হয় ঘৃণা আর মায়া উভয়েরই সমান
অভিকর্ষ?
দ্বিতীয় ছবিতে দুটি রোয়াণ্ডান যুবক। একজনের নাম
লুক নুঙ্গুই (২৫), আরেকজন এলেইন নিটওয়ালি (২৭)। দুজনই বিশ বছর আগেকার সেই
তাণ্ডবলীলার জীবন্ত সাক্ষী। এরা কেউ কারো নয়, অথচ পরস্পরকে বাদ দিয়ে দুজনেরই
পৃথিবী অন্ধকার। এরা নিঃস্ব, নিঃসংগ, নির্বান্ধব----এদের বাবামা ভাইবোন সবই ছিল
একসময়, এখন তারা যাদুঘরের করোটি বই কিছু নয়। একটা অকল্পনীয় দুঃস্বপ্ন, অসম্ভব
দুর্বহ একটা স্মৃতি। তাদের দুজনেরই বিরাট পরিবার ছিল বিশ বছর আগে----এখন শুধু তারা
দুজন। তারা বেঁচে আছে, সেই বিস্ময়ই হয়ত তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে এখনো। বড্ড মনমরা
লাগে কি ক্ষণে ক্ষণে? প্রশ্নের উত্তরে তারা হাসবার চেষ্টা করে। এর চেয়ে বোকা প্রশ্ন আর কি হয়? হ্যাঁ অবশ্যই। দিনরাত।
লুক ও এলেইন
|
কিন্তু তারা জীবিত। তারা সেই জীবিত জীবনকে
দীর্ঘায়ত করতে উদ্গ্রীব। বধ্যভূমির স্মৃতিমঞ্চে তারা রোপন করতে চায় ভবিষ্যতের নতুন
জীবনের বীজ। যেমন করে কৃষক তার বিগত পূর্বপুরুষের কবরের উর্বর মাটির ওপর রোপন করে
নতুন ফসলের চারা। তাদের বেঁচে থাকতে হবে। দুঃখ আর বিমর্ষতাকে দূর করে আগামির
আনন্দশিশুকে আমন্ত্রণ জানাবার আয়োজন করতে হবে, সেই বোধটুকু তাদের লোপ পায়নি
পুরোপুরি, ওই প্রমত্ত বিষাদ আর নেশাগ্রস্ততার ঘোরের মধ্যেও। দুটিতে মিলে রীতিমত
একটা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে ফেলেছে বছরপাঁচেক আগে, যেখানে তাদেরই মত
যুদ্ধবিধ্বস্ত, স্মৃতির দুর্ভার নিপীড়নে জর্জর, জর্জর প্রজন্ম, যেতে পারে একদণ্ড
শান্তির খোঁজে, একটুখানি বুক ফাটিয়ে কাঁদবার জন্যে একে অন্যের গায়ে মাথা রেখে। বিশ
বছর আগে তাদের বাবামায়েরা হুটু খুনিদের উদ্ধত অস্ত্রের মুখে নিজেদের গা সঁপে
দিয়েছিলেন যাতে করে তারা, তাঁদের আদরের সন্তানেরা, অক্ষত থেকে যায়। অধিকাংশই থাকেনি, তাদের মুণ্ডিত মস্তকও ভদ্রলোকেরা দেখতে
পাবেন আগ্রহী হলে সেই একই মুণ্ডাগারে, এবং বিশ্বাস করুন, মরে গেছে বলে তারাই
ভাগ্যবান। কারণ তাদের আর নেশা খেয়ে ভুলবার তামাশা করতে হচ্ছে না
প্রত্যহ, তাদের আর প্রতিদিন মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরে লাখো প্রেতাত্নার সমবেত চিৎকার
শুনে চিৎকার করে জাগাতে হচ্ছে না আফ্রিকার আরণ্যক অন্ধকারকে। পশ্চিমের পণ্ডিতরা এর
নাম দিয়েছেন ডিপ্রেসন। মনোবিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন আরো কত চটকদার বিশেষ্য আর
বিশেষণ। ট্রমা। স্ট্রেস। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজর্ডার। সব্বনাশ। এতগুলি শব্দ
একসঙ্গে উচ্চারণ করতেই তো স্ট্রেস শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। পশ্চিমে এ এক নিদারুণ রোগ। আফগানিস্তানের যুদ্ধ থেকে যারা ফিরে গেছে দেশে তারা নাকি
ভোগে এরোগে। কিন্তু তারা কি চোখের সামনে বাবা আর কাকামামাদের মুণ্ডচ্ছেদের দৃশ্য দেখেছেন?কিংবা দেখেছেন
নিজের মায়ের ওপর সওয়ার হতে ছয় দশ কি বারোজন বন্য প্রাণীকে? অথবা দেখেছেন আদরের
বোনটিকে বাজারের ভোজ্য বস্তুর মত খণ্ড খণ্ড করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে কখনো? না
দেখেননি। তথাপি তারা যুদ্ধক্ষেত্রের বর্বরতা সহ্য করতে পারেননি। সহ্য করতে পারেননি
বলে তাঁদের পারিবারিক জীবনের প্রতিটি মানুষের জীবনই অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাঁরা
জানেননা তাঁরা কত ভাগ্যবান, অসহ্য করে তোলার মত লোকও আছেন তাঁদের জীবনে। কিন্তু
রোয়ণ্ডার এই তরুণ-তরুণীগুলোর তো সেভাগ্যও নেই। অন্যকে কষ্ট দিতেও যে ‘অন্য’টির
প্রয়োজন হয় রোয়াণ্ডাতে তো সেই অন্যরাই দুর্বহ স্মৃতিতে পরিণত হয়েছেন। ৭ই এপ্রিল,
১৯৯৪ সাল। ওই দিনটি কি রবিবার ছিল? হয়ত না। তবু তাঁরা ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে ঠিক
সেখানেই গিয়েছিলেন, ঈশ্বরের গৃহেতে আশ্রয় হবে সেই আশাতে। কিন্তু তাঁরা কি জানতেন
যে সেদিন ঈশ্বরের হাতেও শানিত অস্ত্র, উদ্ধত তলোয়ার? না, জানতেন না। তাই তারা আর
গির্জা নির্মাণে আগ্রহী নয়। তারা সেই পাষাণ বিধাতার কাছ থেকে উত্তর চায় এই
যুবশিবিরের নিরাপদ আশ্রয়ে। কেন? কেন এই অবিচার? কি তাদের অপরাধ?
লুক আর নিটওয়ালির মাথায় এই যুবশিবিরের আইডিয়াটি
ঢোকে তারা যখন স্কুলের ছাত্র। (হ্যাঁ,তারা স্কুলে যেত বইকি। না, তাদের বাবামা বা
কাকামামারা পাঠাননি, তারা নিজেরাই পাঠিয়েছিল নিজেদের, এক হিসেবে) চারদিকে সব মনমরা
ছাত্রছাত্রী----যেন শবদেহগুলি হেঁটে বেড়াচ্ছে। নেশায় বুঁদ। অলস উদাসীন
সর্বব্যাপারে। জীবনের প্রতি যেন বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাদের। স্বাভাবিক। ঘটনার
একবছর পর জাতিসঙ্ঘের ইউনিসেফ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যে জরিপ করা হয়েছিল তাতে দেখা
গেছে যে রোয়াণ্ডার শতকরা ৯৯.৯টি শিশু স্বচক্ষে দেখেছে হত্যাকাণ্ড, ৭৯.৬ টি শিশু
নিজের পরিবারের ভেতরই হত্যা দেখেছে, ৬৯.৫ টি শিশু নিজেদের চোখের সামনে অতি আপনজন
কাউকে না কাউকে খুন হতে দেখেছে, এবং তিনভাগের একভাগ শিশু প্রত্যক্ষ করেছে ধর্ষণের
দৃশ্য। তারা যদি মনমরা না হয় তাহলে কারা হবে বলুন তো। এই ‘মনমরা’ প্রজন্মটিকে বাঁচানোর প্রকল্প নিয়ে বাইরের বিশ্ব থেকে অনেক জনহিতকর
সংস্থাই জড়ো হয়েছে রোয়াণ্ডাতে। তার সাথে যোগ দিয়েছে কিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠানও, যার
অন্যতম হল লুক আর নিটওয়ালির টিনেজ শিবির। এর নাম দিয়েছে তারা
‘ইমিতালি’----রোয়াণ্ডানদের নিজস্ব ভাষাতে যার অর্থ আত্মরক্ষার তরবারি। তরবারি না
বলে হয়ত বর্ম বললেই ভালো হত, কিন্তু সারাজীবন বুকের ভেতর গভীর ক্ষত বহন করে যাদের
তারুণ্যে পৌঁছুতে হয়েছে সম্পূর্ণ নিজেদেরই চেষ্টায়, তাদের মত করে চিন্তার ক্ষমতা
আমার থাকবে কেন। ইমিতালি করে তারা কোনরকম বিশ্বরেকর্ড তৈরি করার ফন্দি আঁটেনি,
শুধুমাত্র একে অন্যকে সাহায্য করা, একটু অভয় দেওয়া, একটু আলোর মশাল জ্বালানো সবাই
মিলে। কিংবা শুধু কাঁদা, কেঁদে কেঁদে বুক ভাসানো, মুখ ভাসানো, এবং কেঁদে কেঁদেই
আবার হাসতে শুরু করা, বাঁচতে শুরু করা। হয়ত লেখাপড়া শিখে ডাক্তার হওয়া, উকিল
ব্যারিস্টার হওয়া, কলেজের অধ্যাপক হওয়া। প্রেমে পড়ে নতুন সংসারের স্বপ্ন
দেখা----বেঁচে থাকার যে কত আনন্দ, কত অপার অপার সম্ভাবনা। এই প্রকল্পের কাজ এখনো
তারা চালিয়ে যাচ্ছে পুরোদমে। এরকম বহু প্রতিষ্ঠানের বহু প্রচেষ্ঠা সত্ত্বেও
রোয়াণ্ডার প্রায় ৬ লক্ষ যুবক-যুবতী যারা তাদের বাবামাকে হারিয়েছিল সেই নরমেধ
যজ্ঞের সময়, এখনো মানসিকভাবে রুগ্ন, বিক্ষত। তাদের মানসিক চিকিৎসার জন্যে যথেষ্ট
সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা, তাতে বিশেষভাবে মনোযোগী হবার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা
হতে পারেননি বলতে গেলে কেউই----না রোয়াণ্ডান সরকার, না কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা। ফলে
বাধ্য হয়ে তারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে।
রোয়াণ্ডার ঘটনাটি আমাকে বিশেষভাবে বিচলিত করেছে,
তার অনেকগুলো কারণ। প্রথম কারণটি একান্তই ব্যক্তিগত, মানে এর সঙ্গে আমার নিজের
দেশের একটা ভয়াবহ ঘটনার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। দ্বিতীয় কারণটি খানিকটা
বহুজাতিক----কেন ইতিহাসের পাতায় পাতায় বারবার উঠে আসে এই একই গল্প, একই বর্বরতা,
একই পৈশাচিক উন্মত্ততা। সাধারণ গৃহস্থালী মানুষ কেন একেক
সময় হঠাৎ করে পশু হয়ে যায় সে রহস্য কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। কেমন করে মানুষ
বারবার ভুলে যায় ইতিহাসের শিক্ষা। কে যেন বলেছিলেন এই অমূল্য কথাটিঃ “ইতিহাসের
প্রথম শিক্ষাই হল যে পৃথিবীতে কেউ কখনোই কিছু শেখেনা ইতিহাস পড়ে”। এর চেয়ে রূঢ়
সত্য আর নেই। আমার তৃতীয় কারণটি আরো জটিল----গণহত্যার মধ্য দিয়ে কি মানবচরিত্রের
কোনও মৌলিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়? একই মানুষের শরীরে কি সুর এবং অসুর উভয়ের
সহাবস্থান সম্ভব? তা না হলে একই মানুষ, যে দুদিন আগেও আমার খেলার সাথী ছিল, একই
সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, পাড়ার মেয়েদের জ্বালাতন করেছি, শিষ দিয়েছি অসভ্যের মত, সে হঠাৎ করে আমাকে খুন করতে চাইবে কেন দুদিন
পর? ঠিক তা’ই তো ঘটেছিল রোয়াণ্ডাতে। পাড়াপ্রতিবেশী, বহুদিনের বন্ধুত্ব, এমনকি
আত্মীয়তাও হয়ে গেছে বৈবাহিক সূত্রে, তারাও একদিন রামদা’ নিয়ে উপস্থিত বাড়িতে। এই
যে আকস্মিক রূপান্তর, এই যে পরম বন্ধুকে সহসা ঘোর শত্রু হয়ে ওঠা, এর মূলটা কোথায়।
দুই
রোয়াণ্ডার
বড় শত্রু আসলে সে নিজেই। তার ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি। সীমিত সম্পদ, ঘন জনবসতি,
দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা----একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার পথে যতগুলো বাধা
সম্ভব তার সবগুলোই ছিল। এর আয়তন যেমন ক্ষুদ্র (১০,১৬৯ বর্গ মাইল, মানে বাংলাদেশের
পাঁচ ভাগের একভাগও নয়), লোকসংখ্যা তেমনি বিশাল ( প্রায় দেড় কোটি, বাংলাদেশে ষোল
কোটি)। তার ওপর চার সীমানা ঘিরেই আফ্রিকার যত সমস্যাসঙ্কুল
রাষ্ট্রসমূহ----উগাণ্ডা, বুরুণ্ডি, তাঞ্জানিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাব্লিক অফ কঙ্গো।
শতকরা ৯০ ভাগ অধিবাসী প্রধানত কৃষিজীবী। তাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বলে ধরা যায় কফি আর চা’কে। চাষের
জমির বেশির ভাগই উঁচু পাহাড়ের ওপর। আসলে গোটা দেশটাই বলতে গেলে অনেকগুলো উঁচু উঁচু
পাহাড়ের ওপর দণ্ডায়মান। তবে একটা সমস্যা রোয়াণ্ডাতে ছিল না----গোত্রভেদ। বাইরের
বিশ্বে অনেকের ধারণা হুটু আর টুটসি দুটি ভিন্ন ভিন্ন গোত্র। না, তা নয়। তারা
অনেকটা বর্ণের মত---ভারতে যেমন বৈশ্য আর শূদ্র। হুটুরা প্রধানত চাষাবাদ করে
জীবিকানির্বাহ করেন, আর টুটসিদের কাজ গরুছাগল চারণ করা (অন্তত দশটি গরুর মালিক না
হলে টুটসি হওয়া যায় না!), প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানো, আর্থসামাজিক বিষয়াদি নিয়ে
লিপ্ত থাকা। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব একটা রেষারেষির সম্পর্ক ছিল তা নয়। তবে,
কারো কারো মতে, এদের মাঝে একটা ঐতিহাসিক দূরত্ব ছিল গোড়া থেকেই। হুটুদের চোখে
টুটসিরা একপ্রকার ‘বহিরাগত’ জাতি----উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কিছুটা হয়ত মিল আছে
ভারতের আর্য-অনার্য, বা পাকিস্তানের মোহাজের-আনসার সম্প্রদায়ের সঙ্গে। যা’ই হোক,
এই ঐতিহাসিক দূরত্বের মাঝখানে এসে আসন করে নেন বাইরের বিশ্ব থেকে আগত সম্পূর্ণ
ভিন্ন একটি শক্তিঃ বেলজিয়াম। ১,৮৮৫ সালে বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ড (২) এর
পরিচালনায় বেলজিয়ান সেনাবাহিনী কঙ্গো দখল করে নেয় (যার সূত্র ধরেই এর নামকরণ হয়
বেলজিয়ান কঙ্গো)। এবং ১,৯১৮ সালে, অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধ সাঙ্গ হবার পরপরই যে
এশিয়া ও আফ্রিকার অনেকগুলো দেশ নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেয়ার হিড়িক পড়ে
যায় পশ্চিম ইউরোপের উপনিবেশিক শক্তিগুলোর মাঝে, রোয়াণ্ডা চলে যায় পুরোপরি
বেলজিয়ামের দখলে। ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে বেলজিয়াম ব্রিটেনের মত নয়, তারা কেবল দখল
করেই ক্ষান্ত হয়নি, রোয়াণ্ডার মানুষগুলোকে যতভাবে অপদস্ত আর অবদমিত করে রাখা যায়
তার সবরকম ব্যবস্থাই তারা কায়েম করে নেয়। সবচেয়ে অপমানজনক ব্যবস্থাটি ছিল
‘পরিচয়পত্র’এর প্রবর্তন, ১,৯৩৩ সালে। নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক পরিচিতি
অনুযায়ী প্রতিটি রোয়াণ্ডানকে আদেশ করা হয় একটি ‘আইডি’ কার্ড রাখতে সাথে----টুটসি,
হুটু, এবং টুয়া নামক আরো একটি নিম্নবর্ণীয় গোষ্ঠী। অনেকটা হিটলারের আমলে ইহুদীদের
যেমন একটা হলদে রঙের কার্ড রাখতে হত, বা দক্ষিণ আফ্রিকাতে বর্ণভেদ অনুযায়ী কার্ড
থাকতে হত অশ্বেতাঙ্গ জাতিদের কাছে। টুয়া বলে আসলে কোনও আলাদা জাতি সেখানে কখনোই
ছিল না, ওটা বলতে গেলে বেলজিয়ানদেরই উদ্ভাবন। টুয়া হল অনেকটা আমাদের হরিজন বা
নমশূদ্রদের মত----একেবারেই নিচু স্তরের সমাজে যাদের জন্ম। ভারতবর্ষে যখন ব্রিটেনের
রাজত্ব ছিল তখনও একরকমের ‘প্রথমে ভাগ করো, তারপর শাসন করো’ জাতীয় একটা রীতি পালন
করা হত, কিন্তু সেটা এতটা উগ্র বা অপমানজনক ছিল বলে মনে হয়না। বেলজিয়ানরা এমনিতে
প্রচুর বুদ্ধিমান জাতি হওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকার মানুষগুলোকে তারা হয়ত মানুষ বলেই
গণ্য করত না, ফলে এমন একটা অদ্ভুত অমানুষিক পন্থা তারা অবলীলাক্রমে চাপিয়ে দেয়
গোটা দেশটার ওপর। সেখানে রক্তগঙ্গা বইবে একদিন, সেটা কি খুব অস্বাভাবিক মনে হয়?
বারুদের স্তূপটি তো তারাই তৈরি করে রেখেছেন।
১,৯৫৯ সালে প্রথম বিস্ফোরণের আভাস দেখা দেয়।
হুটুদের কৃষক আন্দোলন। প্রধানত টুটসিদের বিরুদ্ধে। প্রকারান্তরে হয়ত বেলজিয়ানদের
বিরুদ্ধেও। যদিও কোন কোন পর্যবেক্ষকের মতে হুটু চাষীদের উস্কে দিয়েছিলেন বেলজিয়ানরাই।
যাই হোক, সেই আন্দোলনের ফলাফল দাঁড়ায় এই যে বহুসংখ্যক টুটসি প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে (প্রধানত বুরুণ্ডিতে) গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
কথায় আছে, প্রতি ঘটনারই একটা প্রতি-ঘটনা থাকে।
ইতিহাসের স্মৃতিভ্রম নেই। ১,৯৭২ সালে বুরুণ্ডির টুটসি সৈন্যবাহিনী আশি হাজার থেকে
দুই লক্ষের মত হুটুকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়। অতএব ধারণা
করা যেতে পারে যে ১,৯৭২ সালের ভেতরই উপ্ত ছিল ১,৯৯৪ সালের বীজ। মানে ওই প্রতিশোধের
পাল্টা প্রতিশোধ।
ইতোমধ্যে আরো ক’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অবতারণা
হয় রোয়াণ্ডার ইতিহাসে। প্রথমত স্বাধীনতা। অর্থাৎ বেলজিয়ানরা তাদের তল্পিতল্পা
গুটিয়ে ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যায়, যদিও সেই বারুদের স্তূপগুলোর পুরো দায়িত্বটাই
চেপে রেখে যায় রোয়াণ্ডার দুটি নিত্য-বিবদমান সম্প্রদায়ের ঘাড়ের ওপর। ওদের
স্বাধীনতা দিবস ক্যানাডার মতইঃ ১ লা জুলাই। ১৯৬২ সাল। রাজনৈতিক প্রাধান্য তখন
হুটুদেরই বলা যায়, যদিও চাকরিবাকরি ও ব্যবসাবানিজ্যের দিক থেকে টুটসিরা ছিল অনেক
অগ্রসর। অতএব ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল দুই সম্প্রদায়ে। ১,৯৭৩ সালে রোয়াণ্ডার সামরিক
বাহিনীর হুটুজাতীয় প্রধান সেনাপতি জুভেনাল হাবিয়ারিমানা রোয়াণ্ডার শাসনদণ্ড হস্তগত
করে নেন রক্তপাতবিহীন ‘প্রাসাদ-বিদ্রোহের’ মাধ্যমে। টুটসিরা টের পাচ্ছিল যে বিপদ
ঘনিয়ে আসছে। তারা দলে ভারি হবার চেষ্টা করে, তবে রোয়াণ্ডাতে নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ
বুরুণ্ডিতে, যেখানে তাদের ওজন বেশি। রোয়াণ্ডার টুটসি ভাইবোনদের স্বার্থরক্ষার
উদ্দেশ্যে তারা ‘রোয়াণ্ডান পেট্রিওটিক ফ্রন্ট’ নামক একটি জঙ্গি প্রতিষ্ঠান গঠন
করে, ১,৯৮৮ খৃষ্টাব্দে। দুবছর পর, ১,৯৯০ সালে তারা রোয়াণ্ডার সীমানা অতিক্রম করে
রীতিমত একটা গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে ফেলার অবস্থা তৈরি করে। অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে
এগুতে থাকে তখন থেকে। একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে অচিরেই, সে-ভয়টা তখন সবার মনেই।
আবহাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত।
বারুদের কাঠিটা শেষ পর্যন্ত জ্বলে উঠল ১,৯৯৪
সালের ৬ই এপ্রিল, যখন প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানার বিমান উড়িয়ে দেয়া হয় আকাশ থেকে।
ব্যস, আর যায় কোথায়। পরের দিনই শুরু হয় অন্ধ, উন্মাদ অভিযান। ঘরে ঘরে, পাড়ায়
পাড়ায়, শহরে গ্রামে, যে যেখানে ছিল, টুটসি হলেই তার কোন রক্ষা ছিল না। ছেলেবুড়ো,
নারী শিশু, যুবক যুবতী কারো নিস্তার ছিল না। মেয়েদের তো দ্বিগুণ জ্বালা। প্রথমে
ধর্ষণ, গণধর্ষণ অবশ্যই, তারপর ময়লা গামছার মত এক কোপে মাথা কেটে ফেলা। ধর্ষকদের
জন্য সুন্দরি-অসুন্দরি, কচি মেয়ে আর বুড়ি মেয়েতে খুব তফাৎ নেই, আসল জিনিসটা থাকলেই
হল, তবে যদি কোন পোড়াকপালির চেহারা একটু বেশিরকম সুন্দর হয়ে থাকে তাহলে আর রক্ষা
নেই----ঐ ‘সুন্দর’ত্বের জন্যও আলাদা খেসারত দিতে হয় তাকে। শান্টাল মুকেষিমানা নামক
একটি মেয়ের কথা পড়লাম পত্রিকায়, যার অপরাধ ছিল অত্যন্ত প্রকটরকম সুন্দরি হওয়া।
ডাগর ডাগর দুটি চোখ, মুখে লাবণ্যের বন্যা যেন, শরীরে ভরা যৌবনের খরস্রোতা প্লাবন। সে
যদি পুরুষ হত তাহলে রক্ষা পেয়ে যেত---তৎক্ষণাৎ কল্লাটা আলাদা হয়ে যেত ধর থেকে।
কিন্তু সুন্দরি মেয়েদের ভাগ্যে তড়িৎ মৃত্যু নেই। শান্টালকে তারা পুরোপুরি নেংটা
করেনি, কোমর থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত কেবল। তাতে বোধ হয় বন্দুকধারি জন্তুর তৃপ্তি বেশি। যাই হোক, বেচারির ওপর যে কতগুলো
নিহত টুটসিদের মুণ্ডালয়
|
নির্বিচারে, নির্বিশেষে সংঘটিত হয় সে
হত্যাকাণ্ড। চার্চের ভেতর আশ্রয় নিতে চেয়েছিল অনেকে, লাভ হয়নি। চার্চের ভেতরে
গিয়েই জল্লাদরা জবাই করেছে সবাইকে। টুটসিরাই নয় কেবল, টুটসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল
হুটু, তারাও জঙ্গি হুটুদের রোষের আগুণ থেকে উদ্ধার পায়নি। ৭ই এপ্রিল থেকে শুরু করে
পুরো একশ’ দিন, অবিরত, দিবারাত্র, অব্যাহত থাকে সে তাণ্ডব, সেই অবিশ্বাস্য নরমেধ
যজ্ঞ। টুটসি জাতি আর উদারপন্থী হুটুদের জন্যে সে যে কী ভয়ঙ্কর আতঙ্কের পরিবেশ
সৃষ্টি হয়েছিল সেসময় তা কল্পনা করাও সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। রোয়াণ্ডার গণহত্যা
নিয়ে একটা ছবি তৈরি হয়েছিল কয়েক বছর আগে, ‘হোটেল রোয়াণ্ডা’ নামে। সেটা আমি দেখেছিলাম।
দুদিন ভাল ঘুম হয়নি তার পর। ঘন ঘন জেগে উঠতাম ভয়ে। তা থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়
সেসময় রোয়াণ্ডাতে থাকা টুটসিদের মনের অবস্থা কি ছিল।
দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের গণনা
অনুযায়ী, ১০০ দিনের হত্যাকাণ্ডতে রোজ প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৩০০টি প্রাণ চিরতরে
হারিয়ে গিয়েছিল। আমাদের বাংলাদেশের গণহত্যায় ধরা হয় যে ৩০ লক্ষ লোকের প্রাণহানি
হয়েছিল। ২৫ শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর----২৬৬ দিন। সেহিসেবে আমাদের দেশে তাহলে
প্রতি ঘন্টায় প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় ৪৬৯ জন বাংলাদেশী। বিশাল সংখ্যা বটে!
রোয়াণ্ডার
গণহত্যাটি কি রোধ করা সম্ভব ছিল? অবশ্যই ছিল---পুরোপুরি না হলেও আংশিকভাবে অবশ্যই
সম্ভব ছিল অনেকগুলো জীবন বাঁচানো। কিন্তু সেটা হয়নি, কারণ বাইরের বিশ্ব খুব একটা
গা করেনি। ১,৯৯৩ সালে জাতিপুঞ্জের পক্ষ থেকে রোয়াণ্ডার রাজধানী কিগালিতে পাঠানো
হয়েছিল ক্যানাডিয়ান লেফটেনান্ট জেনারেল রোমিও ডালেয়ারকে, দুপক্ষের মধ্যে একটা
সন্ধিচুক্তি স্থাপন করা যায় কিনা সেটা তদন্ত করতে। কিন্তু তিনি সেখানে থাকাকালেই
তো সন্ধির বদলে লেগে গেল দাঙ্গা। এমন দাঙ্গা যে তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না সেই
পৈশাচিক দৃশ্য। তিনি জরুরি বার্তা পাঠিয়েছিলেন জাতিসঙ্ঘের ওপরওয়ালাদের দরবারে।
বড়রকমের হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে এখানে, আমাকে আরো সৈন্য পাঠান, আমাকে অনুমতি দিন
এদের যুদ্ধ থামাতে চেষ্টা করার। কিন্তু ওপরওয়ালারা কেউই তাঁর আবেদনে কর্ণপাত
করেননি। সৈন্য পাঠানো দূরে থাক, কোনরকম ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থানীয় সমস্যাতে জড়িয়ে
পড়ার বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয় তাঁকে। বেচারা ডালেয়ার অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে দেখতে থাকেন নিরস্ত্র মানুষগুলোকে কিভাবে তারা এক কোপে মাথা কেটে ফেলছে,
দুধের শিশুকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলছে নদীতে বা দাউ দাউ করে জ্বলতে
থাকা আগুণের মধ্যে। সারাজীবন ক্যানাডাতে বসবাস করে বেচারি হয়ত এতটা নৃশংসতা কখনো
দেখেননি আগে। তাই ওসব দেখে দেখে একসময় তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মানসিকভাবে। সেই
অসুস্থতা থেকে সেরে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল তাঁর।
সেসময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিন্টন।
তিনি যদি চাইতেন তাহলে পারতেন—অনেকগুলো জীবনই রক্ষা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল বটে।
কিন্তু তিনিও অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি সমস্যাটিকে। পরবর্তীতে বিস্তারিত ঘটনা সব
জানার পর হয়ত খানিক অনুশোচনা এসে গিয়েছিল তাঁর মনে। ২০০৯ সালে টরন্টোর এক জনসভায়
নিউ ব্রান্সুইক প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফ্র্যাঙ্ক ম্যাকেনার এক প্রশ্নের
উত্তরে ক্লিন্টন স্বীকার করেন যে তাঁর প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ের দুয়েকটি ভুলের
মধ্যে একটি ছিল এই রোয়াণ্ডার বিষয়টিকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব না দেওয়া। তিনি বলেনঃ
“হ্যাঁ, আমি যদি সচেতন থাকতাম সেসময় কি হচ্ছে বা কি হতে যাচ্ছে রোয়াণ্ডাতে, তাহলে
হয়ত ৮ লক্ষ না হলেও আড়াই বা চার লক্ষ লোকের জীবন বাঁচানো যেত”। তবু এই প্রেসিডেণ্টটিকে
আমি ক্ষমা করতে রাজি দুটি কারণে। এক, তিনি বজনিয়া-হারসিগোনিভার গণহত্যাতে
হস্তক্ষেপ করেছিলেন বটে, যার ফলে শেষ পর্যন্ত ১,৯৯৫ সালে দুপক্ষের শান্তিচুক্তি
স্বাক্ষরিত হওয়া সম্ভব হয় ওহায়োর ডেটন শহরে। দুই, রোয়াণ্ডার হত্যকাণ্ড থামানোর
চেষ্টা না করলেও হুটুদের কাছে অস্ত্র চালান করার চেষ্টা তিনি করেননি, বা তাদের
পক্ষ নিয়ে রাজনৈতিক সমর্থন সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেননি আন্তার্জাতিক পর্যায়ে, যেমনটি
নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বাংলাদেশের গণহত্যার সময়।
বড়রকমের একটা হত্যাকাণ্ড যখন ঘটে যায় একটা দেশে
তা থেকে সেরে উঠতে অনেক সময় লাগে। স্বজন হারানোর কষ্ট এমনিতেই বেদনাদায়ক, তার ওপর
সমস্ত পরিবারটাই যখন চোখের পলকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তখন তার ক্ষত সারাজীবনই থেকে
যায় মানুষের মনে। পুরো জাতিটাই তখন পঙ্গু হয়ে পড়ে। শারীরিকভাবে না হলেও
মানসিকভাবে। বাইরের বিশ্ব দেখতে পায়না তাদের সেই ক্ষতের চিহ্নগুলো, তাই কোনরকম
সহায়তা দেবার কল্পনাইও হয়ত তাঁদের মাথায় আসে না। মহামারি হলে সাহায্য যায়,
ভূমিকম্প হলে দলে দলে মানুষ চলে যায় বস্তাবোঝাই সামগ্রী নিয়ে, সুনামি হলে তো কথাই
নেই, এমনকি এইডস রোগের জন্যও স্বেচ্ছাসেবকের অভাব হয়না, অভাব হয় কেবল মানসিক রোগের
বেলায়। তাই পুরো বিশটি বছর ধরে রোয়াণ্ডার টুটসিরা ভুগেছে, নেশা করে মাতাল হয়ে ভুলে
থাকার চেষ্টা করেছে, একা একা। মনোরোগীদের যে কোনও বন্ধু নেই ভাই।
তিন
‘জেনোসাইড’ শব্দটাই একসময় ডিকশনারিতে ছিল না। চয়ন করেছেন, যতদূর জানা যায়, রাফায়েল
লেমলিন (১৯০০-১৯৫৯) নামক পোলাণ্ডের এক ইহুদী আইনজীবী। এরই বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘গণহত্যা’। জেনোসাইড শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক ‘জেনোস’ (গোত্র, জাতি বা
পরিবার) আর ল্যাটিন ‘সিডে’র (মানে হত্যা) সংমিশ্রনে। ডিকশনারিতে এর অর্থ লেখা আছেঃ
ইচ্ছাকৃত, পরিকল্পিতভাবে নির্মূল বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, আংশিক বা পূর্ণভাবে, একটা
জাতি, বর্ণ, গোত্র বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে। অনেকে মনে করেন বড় আকারের যেকোন
হত্যাকাণ্ডকেই গণহত্যার পর্যায়ে ফেলা যায়। ঠিক তা নয়। ইংরেজিতে ‘জেনোসাইড’ আর
‘ম্যাসাকার’ দুটি আলাদা শব্দ। দুটিতেই বিপুল পরিমাণ প্রাণহানি হতে পারে, কিন্তু
দুটির মূল উদ্দেশ্য এক নয়। একটিতে আছে গোটা জনগোষ্ঠিকে ভূপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে মুছে
ফেলার চেষ্টা, আরেকটিতে একটা বড়রকমের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করে দেয়া
(যেমন আনবিক বোমা নিক্ষেপ জাপানের হিরোশিমা আর নাগাশাকির ওপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের
সময়)।
গণহত্যার ইতিহাস মানবজাতির মতই পুরাতন। কোন কোন
বিশেষজ্ঞের মতে, ইউরোপের নিয়েন্ডার্থাল জাতি যে ৩০ হাজার বছর আগে একবারে নিশ্চিহ্ন
হয়ে গিয়েছিল তা হয়ত প্রাকৃতিক কারণে ঘটেনি। সম্ভবত আফ্রিকা থেকে আগত আধুনিক
মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। নতুন এসে পুরাতনকে
জোর করে সরিয়ে দিয়ে তাদের জায়গা দখল করে নেবে, সেটা তো চিরকালই ঘটে এসেছে। আধুনিক
যুগের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা। ১,৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার
কলাম্বাস দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট একটি দ্বীপে পদার্পণ করেন। তার আগে উত্তর-দক্ষিণ
দুই আমেরিকাতেই কোনও শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয়ান ছিলেন বলে ইতিহাসে কোন সাক্ষ্য নেই। অথচ
আজকে দুটি মহাদেশই কার্যত শ্বেতাঙ্গপ্রধান দেশ----আদিম অধিবাসীদের অস্তিত্ব এখানে
অত্যন্ত গৌন ও হীনাবস্থায় পর্যবসিত। শ্বেতাঙ্গ পণ্ডিতরাই এখন বলছেন যে ১,৪৯২ থেকে
১,৮৯০ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী আমেরিকার ‘সু’ জাতিকে যেভাবে নিপাত
করেছে তাতে করে একসময় যাদের সংখ্যা ছিল ৫০ মিলিয়ন তারা এখন পৌঁচেছে ১.৮ মিলিয়নে -----অর্থাৎ
শতকরা ৯৫ ভাগ লোকই বিলুপ্ত! ব্রেজিলের চেহারা তো আরো শোচনীয়। কলাম্বাসের আগে যাদের
সংখ্যা ছিল ৩ মিলিয়নের মত তাদের সংখ্যা নেমেছে ৩ লক্ষতে (১,৯৯৭ সালের আদমশুমার
অনুযায়ী)। এই বিপুল পরিমাণ হ্রাসটি যে প্রাকৃতিক কারণে ঘটেনি সেটা এখন বিবেকবান
পাশ্চাত্য গুণিজনরাও স্বীকার করেন। আমেরিকার এই নীরব গণহত্যাটি কেবল গুলিগালাজ করে
হয়েছে তা নয়। ঔপনিবেশিক শক্তিমূহের প্রধান অস্ত্র ছিলঃ রোগ। দুরারোগ্য ব্যাধি,
অন্তত সেকালের চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী। সেই ব্যাধিটির নাম ‘স্মল পক্স’...বাংলায়
যাকে বলা হয় বসন্তরোগ। এসব ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা পাওয়া যাবে চার্লস সি ম্যান
নামক এক প্রত্নতাত্বিক গবেষকের অসাধারণ গ্রন্থ “ 1491” এতে।
গণহত্যায়যোগ দিতে গিয়ে হাতে রক্ত লাগেনি এমন
জাতি খুব কমই আছে পৃথিবীতে। ছোটদের গায়ে ছোট রক্ত, বড়দের বড়
রক্ত। এর দায়ভার মেনে নেওয়ার ব্যাপারে অবশ্য ছোটবড় উভয়েরই সমান দ্বিধা। তবুও
ঐতিহাসিকরা মোটামুটিভাবে একটা তালিকা তৈরি করে নিয়েছেন কখন কোন্ দেশে কিসব পাশবিক
হত্যাকাণ্ড হয়েছে, যাকে অনায়াসে ‘গণহত্যা’র পর্যায়ে ফেলা যায়। এখানে সেই তালিকারই
একটা ছোট্ট অংশ আমি তুলে ধরব।
(১) জেরুজালেমের
অকথ্য বর্বরতা
ঘটনাটি ১,০৯৯ সালের, প্রথম ক্রুসেডের সময়কার।
এর সূচনা হয়েছিল ১,০৯৫ সালে যখন পোপ আর্বান (২) নির্দেশ দেন পৃথিবীর সকল খৃস্টান
জাতিকে আক্রমণকারি ‘বিধর্মী’ শক্তিসমূহকে (অর্থাৎ তৎকালীন জেরুজালেম দখলকারি
মুসলমানদের) সমূলে উৎপাটন করে খৃষ্টধর্মের পবিত্রভূমি জেরুজালেমের পবিত্রতা
পুনরুদ্ধার করে নিতে। সেটা ছিল ইসলামিক সাম্রাজ্যের যুগ। পশ্চিমে ইউরোপের পশ্চিম
প্রান্ত থেকে ভারতবর্ষের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত ইসলামের জয়জয়াকার।
স্পেন-অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি-যুগোশ্লাভিয়া-রাশিয়ার কিয়দংশ, সবই তখন ইসলামিক
সাম্রাজ্যের অধীনস্থ----পৃথিবীর বাকি অংশটুকুও তাঁদের করায়ত্ত হবার অপেক্ষায়।
স্বভাবতই অমুসলমানদের অবস্থা কম্পমান, ধর্ম বাঁচাতে গিয়ে জীবন দেওয়া, না, ইসলাম গ্রহণ
করে প্রাণ রক্ষা করা, এই ছিল তাদের বড় চিন্তা। পোপ আর্বানের জিহাদি আহ্বান ছিল সেই
দুর্দমনীয় মুসলিম শক্তিকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার আহ্বান।
জেরুজালেম একটি প্রাকার পরিবেষ্টিত সুরক্ষিত
শহর। নগরবাসীদের অধিকাংশই মুসলমান, ছিটেফোঁটা কিছু
জেরুজালেম আক্রমণ
|
(২) আর্মেনিয়ার
গণহত্যা
প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কার ঘটনা এটি, ১৯১৫ সালে।
বর্তমান তুরস্কের একটি আদিম জনগোষ্ঠী, প্রধানত গোঁড়া খৃস্টান ধর্মাবলাম্বী, তাদের
পুরো জাতিটাকেই ভূপৃষ্ঠ থেকে একেবারে মুছে ফেলার যে একটা ভয়াবহ উদ্যোগ নেয়
তদানীন্তন তুর্কি সরকার তাকেই বলা হয় ‘আর্মেনিয়া গণহত্যা’। সে যে কি ভয়ঙ্কর
আর্মেনিয়ানদের মৃত্যু
কাফেলা
|
সবচেয়ে করুণ
অবস্থা ছিল যারা ছিলেন শারীরিকভাবে অক্ষম, রোগাক্রান্ত, বৃদ্ধ জর্জর, বা বাচ্চা
ছেলেমেয়ে, তারা। তাদের জন্য একটি সহজ পন্থা আবিস্কার করেছিলেন তুর্কি
কর্মকর্তারা----কাফেলার মত করে দল বেঁধে হাঁটানো শত শত মাইল পথ সিরিয়ার তপ্ত
অগ্নিকুণ্ডসম মরুভূমির ওপর দিয়ে, একফোঁটা পানি যেন তাদের হাতের কাছে না দেয় কেউ
সেব্যবস্থা তারা করে রেখেছিলেন সুন্দরভাবে। অনেকেই পৌঁছুতে পারেননি মরুভূমি
পর্যন্ত, তার আগেই পথের ধারে মুখ থুবড়ে
পড়ে যান। আরো একটি অবিশ্বাস্য পন্থা আবিষ্কার করেছিলেন আমাদের
তুর্কি ব্রাদারগণ। যারা একেবারেই অক্ষম অচল, মানে হাঁটবার শক্তিটুকুও ছিল না
যাদের, তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কৃষ্ণসাগরের ধারে। তোলা হয় একটা মালসামগ্রীর জাহাজে।
তারপর সেটাকে সাগরের ঠিক মধ্যিখানে নিয়ে টুপ করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়----জ্যান্ত
মানুষগুলো পানিতে হাবুডুবু খেয়ে দম নেবার চেষ্টা করে করে শেষ হয়ে যায়। এরকম অমানুষিক হত্যার কথা শুনেছেন কখনো? অনুমান করা হয় যে
আর্মেনিয়ান গণহত্যায় মোট এক থেকে দেড় মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল।
তুরষ্ক কি সরকারিভাবে কোনদিন ক্ষমা চেয়েছিল ওই
কলঙ্কময় ইতিহাসের জন্যে? না, তা কখনো হয় নাকি? দেশের সম্মান বলে একটা কথা আছে না? ক্ষমাপ্রার্থনা দূরে থাক, তাঁরা স্বীকারই করতে
রাজি নন যে আদৌ একটা ‘গণহত্যা’ সঙ্ঘটিত হয়েছিল সেখানে।
(৩)ক্যাম্বোডিয়ার
গণহত্যা
উগ্র ধর্মান্ধতা যেমন যুগে যুগে অনেক নৃশংস
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তেমনি উগ্র ধর্মহীনতাও কম ঘটায়নি বিগত শতাব্দীতে। তার উৎকৃষ্ট
দৃষ্টান্ত হল পলপট নামক এক রক্তোন্মাদ কমুনিস্ট নেতার পরিচালনাতে ক্যাম্বোডিয়ার
খুমার রুজ বাহিনী যে অসম্ভব একটা বধ্যভূমির ইতিহাস তৈরি করে গেল সত্তুর দশকের
মাঝামাঝিতে। মার্শাল স্ট্যালিন আর চেয়ারম্যান মাও’এর মতাদর্শে
দীক্ষিত পলপট ভাবলেন, দেশে কৃষকমজুরদের প্রাধান্য সৃষ্টি করতে চাইলে প্রথমেই দরকার
শিক্ষিত, পেশাজীবী, মধ্যবিত্ত শ্রেণীটিকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়া। মানে
আক্ষরিকভাবেই নিপাত, লুপ্ত। এমনই বিভীষিকাময় একটা পরিস্থিতি তারা তৈরি করে ফেলেছিল
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ এর ভেতর যে মানুষ চশমা পরে রাস্তায় বেরুতে সাহস পেত না, কারণ মূর্খ
খুমার রুজদের ধারণা ছিল এরকম যে চশমা পরাটা শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবীর লক্ষণ, কারণ
মানুষ চশমা পরে কেবল লেখাপড়া করার জন্যই, তাই না? অতএব তারা রাষ্ট্রের শত্রু!
এভাবে বাছবিচারহীন পেশাজীবী আর বুদ্ধিজীবী নিধন করে করে তারা দেড় থেকে তিন মিলিয়ন
মানুষের অকালমৃত্যু ঘটায়, যা সেসময়কার গণশুমার অনুযায়ী ক্যাম্বোডিয়ার জনসংখ্যার
চার ভাগের একভাগ। অবস্থা যখন চরম আকার ধারণ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভিয়েতনাম পর্যন্ত
ছড়াবার উপক্রম হয় তখনই ভিয়েতনামের নেতারা ভাবলেন, অনেক হয়েছে, আর চোখ বুঁজে থাকা
যায় না। তাদের সেনাবাহিনী তখন আক্রমণ চালায় খুমার রুজদের ওপর, এবং সহজেই তাদের
পরাস্ত করে ক্যাম্বোডিয়ার জনসাধারণের কৃতজ্ঞতা অর্জন করে। পরবর্তীকালের তদন্তে
ভিয়েতনামের কর্মকর্তারা ক্যাম্বোডিয়ার মাটিতে মোট ২০,০০০ গণকবর আবিষ্কার করেছিলেন।
‘কিলিং ফিল্ডস’ (বধ্যভূমি) কথাটি তখনই চালু হয় বহির্বিশ্বে।
(৪) বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ডিসেম্বরের ১৬
তারিখ। এই সময়টুকুর মাঝে, বাংলাদেশের সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ
হারায় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী আর তাদের স্থানীয় চেলাচামুণ্ডাদের হাতে। কারো
কারো মতে ’৩০ লক্ষ’ সংখ্যটিতে একটা “শূন্যের” হেরফের আছে----ভুল করে একটা বাড়তি
শূন্য বসে গেছে ডানদিকে। সেটা সত্য কিনা তা হয়ত কোনদিনই প্রমাণ করা সম্ভব হবে না।
তবে ত্রিশ লক্ষ হোক আর তিন লক্ষই হোক, এ যে একটা বড়রকমের ‘গণহত্যা’ ছিল তাতে
সন্দেহ থাকতে পারে কেমন করে সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। গোড়া থেকেই তো হানাদার
বাহিনীর তাক ছিল বাংলাদেশের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রতি----সংখ্যালঘু হিন্দু
সম্প্রদায়। তাদের একেবারে শেষ করে দিতে হবে, এই পরিকল্পনা নিয়েই তো তারা গুলিগালাজ
শুরু করেছিল ২৫ শে মার্চের মধ্যরাতে। ‘হিন্দু’ হলেই আর রক্ষে নেই---তৎক্ষণাৎ গুলি।
অন্য যাদের প্রতি রাগ ছিল তাদের তারা ছিল, পাকিস্তানীদের মতে, হিন্দুদের বন্ধু
অর্ত্থাৎ ভারতের দালাল, বাংলা
সংস্কৃতিপন্থী বাঙালি, আওয়ামী লীগের
সমর্থক, স্বাধীনতার সমর্থক, এরা। এই যাদের উদ্দেশ্য তাদের আপনি কেমন করে গণহত্যার
দায় থেকে অব্যাহতি দেবেন তা বোঝার সাধ্য আমার নেই।
(৫) হলকস্ট
এবার আসা যাক সকল হত্যার সেরা হত্যাকাণ্ড,
১৯৩৯-১৯৪৫ সাল ব্যাপী ইহুদীনিধন যজ্ঞতে। ইতিহাসে যা ‘হলকস্ট’ নামে আখ্যায়িত, এবং
যার সূত্র ধরেই ‘জেনোসাইড’ শব্দটির উৎপত্তি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সময়কার ইহুদী হত্যার
ঘটনাটিও কম বিতর্কিত নয়। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে গোটা পৃথিবীটাই বলতে গেলে কতগুলো
বিপরীত মতবাদের শিবিরে বিভক্ত হয়ে
গেছে----ইহুদী, ইহুদীপ্রেমিক, ইহুদীবিদ্বেষী। পশ্চিম বিশ্বে এটা মোটামুটিভাবে
প্রতিষ্ঠিত সত্য যে এডলফ হিটলার এবং তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদী নাৎসি খৃস্টানদের চরম
ইহুদীবিদ্বেষের কারণে তাঁরা যে ‘চূড়ান্ত সমাধানের’ ভয়াবহ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন
জার্মানি-পোলাণ্ড-হাঙ্গেরি-চেকোশ্লোভাকিয়া-ইটালি-স্পেন-পর্তুগাল আর ফ্রান্স সহ
প্রায় সমগ্র ইউরোপে, তার শেষ ফল দাঁড়ায় ৬০ লক্ষ নিরপরাধ ইহুদীর প্রাণিহানি, এবং
অত্যন্ত পাশবিকভাবে। সেসময় ‘ইহুদীহত্যা’ ব্যাপারটি রীতিমত একটা লাভজনক ব্যবসার
আকার ধারণ করেছিল। একটা সূত্র অনুযায়ী সারা ইউরোপে তখন মোট ৪০,০০০ হত্যা কারখানা
তৈরি করা হয়, অর্থাৎ যেখানে ইহুদীদের পাঠানো হত তাঁদের শেষ যাত্রায়। কত সহজে এবং কত
স্বল্পব্যয়ে কত বেশি ইহুদীকে মেরে ফেলা যায়, সেটা যেন পরম আকর্ষণীয় কোনও গবেষণার
বিষয় তখন। ঘটনাটি এমনই অবিশ্বাস্যরকম বিশাল এবং ব্যাপক যে এটা যে আদৌ ঘটা সম্ভব
তা’ই মেনে নিতে পারছেন না অনেকে। বিশেষ করে ‘ইহুদী’ জাতির প্রতি যাদের মনোভাব খুব
একটা উষ্ণ নয় তাঁরা তো কিছুতেই মানতে রাজি নন যে সত্যি সত্যি ষাট লক্ষ ইহুদী মারা
গিয়েছিল তখন। নানারকম ‘তথ্য’, বাস্তব বা মনগড়া যা’ই হোক, দাঁড় করিয়ে তাঁরা প্রমাণ
করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে সংখ্যাটি ‘ষাটের চেয়ে অনেক কম’। আমি ঐতিহাসিক নই, ইহুদীপ্রীতি
বা বিদ্বেষ কোনটাই আমার নেই, অন্তত তা’ই আমার বিশ্বাস, অতএব এসব অবান্তর
সংখ্যাতত্ব নিয়ে সময় নষ্ট করার কোনও যৌক্তিকতা আমি দেখি না। এতগুলো দেশ থেকে
এতগুলো মানুষকে একই সঙ্গে পৃথিবী থেকে চিরতরে নির্মূল করে দেওয়ার ভাবনাটাই তো
ভয়াবহ শোনায় আমার কাছে। তখন তাদের সংখ্যাটি কি ষাট না ছয়, না তারও কম, তাতে কি আসে
যায়? বিশেষ করে যখন তাদের একমাত্র অপরাধ ইহুদী হয়ে জন্মগ্রহণ করা? একে যারা
‘গণহত্যা’ বলে মেনে নিতে চাননা, তাঁরা যে একদিন অন্য কোথাও অন্য কোনও গণহত্যাকে মনে
মনে সমর্থন দেবেন না সেবিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ নই।
গণহত্যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
চিরকাল হয়েছে, সম্ভবত চিরকাল হবেও। সভ্যতার বড়াই যতই করিনা কেন আমরা, যতদিন আমাদের
জৈবপ্রকৃতির সঙ্গে ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আর ক্ষমতার দম্ভ একসাথে মিশে একটা
বিষাক্ত ভিন্নতার দেয়াল দাঁড় করিয়ে রাখবে আমাদের সামনে ততদিন আমরা হয়ত এর
পৌনঃপুনিকতাকে রোধ করে রাখতে পারবনা।
চার
স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়াবেঃ একবিংশ শতাব্দীর
যান্ত্রিক যুগেও কি তা অপরিহার্য? আজকে যখন মানুষ শূন্যভ্রমণের উদ্যোগ নিতে শুরু
করেছেন, মঙ্গলগ্রহতে বিকল্প আবাস স্থাপনের সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখছেন, এমনকি
মৃত্যুর মত একটা আপাত-অবশ্যম্ভাবী বিষয়কেও অদূর ভবিষ্যতে একটি আরোগ্যকর রোগের
পর্যায়ে পরিণত করার চিন্তাভাবনা করছ্রেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা, সেযুগেও কেন গণহত্যার
মত একটি মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে মানুষ প্রশ্রয় দেবে, সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রশ্ন।
হয়ত দেবে না, এবং তার কারণ শুধু যান্ত্রিক সভ্যতার দ্রুত অগ্রগতিই নয়, বড় কারণ ওই অগ্রগতির
কারণেই মানুষে-মানুষের পারস্পরিক বিবাদ-বিরোধগুলো
মীমাংসা করার অনেকগুলো পন্থা আজকে আমাদের জানা হয়ে গেছে, এবং সে পন্থাগুলোর
মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হল সেই পুরাকালীন পন্থাটিঃ গণহত্যা। আধুনিক মানুষ ভবিষ্যতে
কখনো সেই দুরূহ পথটিকে বাছাই করে নেবেনা সেটা আশা করা হয়ত অমূলক নয়।
কিন্তু তাই কি? বিবর্তনতত্ব কি তাতে সায় দেবে?
আমরা কি সত্যি সত্যি একদিন নিজেদের অভ্যন্তরের অন্ধকার সুড়ঙ্গগুলো পুরোপুরি বর্জন
করে আলোর দিকটাই বাছাই করে নিতে সক্ষম হব? হব, যদি কতগুলো শর্ত পালন করা হয়।
প্রথমত প্রতিটি মানুষকে পরিপূর্ণভাবে ‘আধুনিক’ হয়ে উঠতে হবে। এই আধুনিক হয়ে ওঠাটি
কিন্তু কোনও স্বতঃসিদ্ধ বিষয় নয় মোটেও----আধুনিক যুগে জন্মানো মানেই আধুনিক হওয়া
নয়। বড় শর্ত তার জন্যে, এবং এটা মস্তবড় শর্তঃ আধুনিক শিক্ষা।আধুনিক সেকুলার
শিক্ষা, যেখানে জাতিধর্ম গোত্রগোষ্ঠী বিষয়ক কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। বিজ্ঞানসম্মত,
বিবর্তনপন্থী, ও আদ্যোপান্ত একজন ইহজাগতিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা। পরজগত বলে
কোনকিছু আছে কি নেই তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় বা প্রয়োজন নেই আধুনিক মানুষের, কারণ
এই ‘পরজগত’ নামক জগতটির অস্তিত্ব কোন সম্মানজনক গবেষকের গবেষণাতে ধরা পড়েনি আজ
পর্যন্ত। আরেকটি শর্ত হল, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় র্যাশনালিজম----তার
প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন। অর্থাৎ যা যুক্তিতে টেকে না তাকে বর্জন করে
যুক্তিনির্ভর জীবনকে নির্বাচন করে নেয়া, এবং তারই ভিত্তিতে পুরো একটা সমাজ গড়ে
তোলার চেষ্টা করা। পশ্চিম ইউরোপে ওরা বেশ এগিয়ে গেছেন
এ-পথটিতে, কিন্তু উত্তর আমেরিকাতে সেই উন্নত মানের সমাজটি এখনো গড়ে উঠতে পারেনি
বলেই আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। তবুও বলা যেতে পারে উত্তর আমেরিকাতে একদিন এই
শর্তগুলোর প্রায় সবগুলোই পালন করার মত সমাজ হয়ত গড়ে উঠবে। কিন্তু আমাদের দেশে কি
তা সম্ভব বলে মনে হয় আপনার? বা ভারতে? বা মধ্যপ্রাচ্যে? ইন্দোনেশিয়াতে? চীন বা
তাইওয়ান আর দক্ষিণ কোরিয়াতে? আমার মনে হয়না। তাদের অর্থনীতি গড়ে উঠছে তাতে সন্দেহ
নেই, কিন্তু আধুনিকতা? আমি যে আধুনিকতার কথা বলছি সে আধুনিকতা ওসব দেশে গড়ে উঠতে
অনেক, অনেক সময় লাগবে, যদি সেটা আদৌ সম্ভব। আধুনিক বলতে ওরা যা বোঝে তা কেবল
কতগুলো আধুনিক যন্ত্রপাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ----মবিল, টেক্সটিং, টুইটার, ফেসবুক,
ইন্টারনেট, এবং সেজাতীয় আরো সহস্র উপকরণ। এগুলো আধুনিক যন্ত্র বটে, কিন্তু এদের
সঙ্গে আধুনিক মন বা মননের কোনও সম্পর্ক নেই।
১৯৪৮ সালে ইজরাইল নামক একটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত
হয়, একহিসেবে প্যালেস্টাইন জাতির শরীরের ওপর। ইজরাইল জাতিটির প্রতি সংসারে কারুরই
সহানুভূতি বা সদিচ্ছার অভাব থাকবার কথা নয়, কারণ এরাই তো ইউরোপের নাৎসিতাড়িত সেই
ইহুদী জাতি, যারা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল চল্লিশ দশকের গোড়াতে।
তবু কেন পৃথিবীতে এত শত্রু সৃষ্টি হয়ে গেল তাদের? কারণ তারা নিজেদের ইতিহাসের যে
বড় শিক্ষাটি, একটা মহৎ জাতিকে কখনোই দমিয়ে রাখা সম্ভব নয় চিরকালের জন্য, সেটা থেকে
তারা আসলে কিছুই শেখেনি। তারা নিজেরা একটি বড়মাপের গণহত্যার শিকার। তাদের পক্ষে কি
সম্ভব অন্য কোন জাতির ওপর অনুরূপ গণহত্যার অভিযান চালানো? যুক্তি অনুযায়ী তার সহজ
উত্তর---না, তা কি করে হয়? কিন্তু হয়। দুঃখের বিষয় যে হয়। প্যালেস্টাইন জাতিকে
তারা যেভাবে কোনঠাসা করে রাখার চেষ্টা চালিয়েছে, তাতে মনে হয় একদিন হয়ত পুরো
জাতিটাকে তারা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করবে। অতএব আধুনিক হই বা না হই, জাত্যাভিমান এমন
এক জিনিস যা কখনোই আধুনিক হয়না----আজকে যারা হত্যার শিকার, আগামিকাল তারা অনায়াসে
শিকারীর বেশে দেখা দিতে পারে।
সূত্রঃ (১)
সু মন্টগোমারি, মন্ট্রিয়ল গ্যাজেট, ও অটোয়া সিটিযেন, মার্চ ২৯ ও ৩১
(২) ইন্টারনেট
অটোয়া, ১৩ই
এপ্রিল, ২০১৪
মুক্তিসন ৪৪
No comments:
Post a Comment