মীজান রহমান
তারা কারা? সেই হতভাগ্য দুটি
যুবক, যাদের বিষণ্ণ মুখের ছবি সারা পৃথিবীব্যাপী প্রচার হল বেশ কদিনব্যাপী, তারা
কারা?
মালিয়েশিয়ার গোয়েন্দাবিভাগ
বলছেন তারা চোর। তারা পাসপোর্ট চুরি করে পালাবার চেষ্টা করছিল। আমেরিকার
গোয়েন্দারা বলছেন, হয়ত তারও বেশি। আরো তল্লাশ-তদন্ত না করে বোঝা যাবে না ওরা
সন্ত্রাসী কিনা। ৯/১১ এর পর আমেরিকার চোখে কেবল সন্ত্রাসী। আল-কায়দা আর তালিবানের
চোখে কেবল ‘জিহাদী’। আর সাধারণ মানুষ? তাদের চোখে কেবলই আতংক। তারা আতংকতে আড়ষ্ট। তারা পালাবার পথ
খোঁজে। তারা শরণার্থী। এযুগের প্রজন্ম শরণার্থী প্রজন্ম।
আমি বলি তারা চোর
নয়, সন্ত্রাসী নয়, পলাতকও নয়, কেবলই স্বাপ্নিক। ভাগ্যহত, ব্যর্থ স্বাপ্নিক।
দুঃসাহসী স্বপ্নকে পুষে রেখেছিল তারা মনের মধ্যে, কল্পনার মধ্যে, যেমন করে মানুষ
পোষে তার নিষিদ্ধ প্রেমকে, তার অবৈধ চিন্তাকে, যেসব দেশের ছেলেমেয়েদের চিন্তার
স্বাধীনতা নেই, নিষিদ্ধ প্রেমের স্বাধীনতা নেই। তাদের স্বপ্ন ছিল পশ্চিমের কোনও
মুক্ত দেশের মুক্ত বাতাসে গিয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবে। তাদের স্বপ্ন কেবলই একটু
বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করার। গলা ছেড়ে গান গাওয়ার স্বপ্ন। হয়ত কোনও ধনী পরিবারের বাগানের মালি হবার
স্বপ্ন। তারা এযুগের বন্দী প্রজন্ম---চিরবন্দী। বন্দী তারা ধর্মান্ধ
সমাজের রুদ্ধ কারাগারে। বন্দী তারা এযুগের অন্ধ অর্থলোলুপতার কারাগারে।
পরপর দুদিন তাদের
ছবি দেখলাম টেলিভিশনে। একই ছবি, বারবার, বারবার। পৃথিবীশুদ্ধ লোক দেখল। আমার
ছেলেদুটির মুখ ভেসে আসছিল। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। তারা কোথায় এখন কেউ জানে না। মালয়েশিয়ার
গোয়েন্দাবিভাগ জানে না, চীনের গোয়েন্দাবিভাগ জানে না, এমনকি আমেরিকার গোয়েন্দাবিভাগও জানে না।
আমেরিকার গোয়েন্দাবিভাগ পৃথিবীর সব মানুষের সব খবর জানে, কেবল এই অভাগা ছেলেদুটিরই
খবর তারা জানে না। তবে অনুমান করে সবাই, কোথায় তারা, এবং তাদের সহযাত্রীরা, এবং
তাদের সেই প্রকাণ্ড বিমানখানি। সমুদ্রগর্ভে। জীবন খুঁজতে গিয়ে তারা বিপুল সাগরকে
পেয়েছে, এইটুকু জানে সবাই। কি অদ্ভুত বিড়ম্বনা, তাই না? একই রাত্রির ভেতর মহাকাশের
অবারিত অন্ধকার থেকে মহাসাগরের অতলান্ত অন্ধকারে। এক নিঝঝুম থেকে আরেক নিঝঝুমে। এ
এক অবিশ্বাস্য যাত্রা।
আঠারো-উনিশ বছরের
ছেলে তারা। শুনেছি তাদের জন্ম ইরাণে। শুনেছি তারা ইরাণ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল
মালয়েশিয়াতে। মালয়েশিয়াতে মোল্লা নেই বলে নয়, আছে জেনেই গিয়েছিল তারা কারণ
মালয়েশিয়ার মোল্লারা ইরাণের মোল্লাদের মত আলখাল্লা পড়ে না, মাথায় চব্বিশঘন্টা
পাগড়ি বাগিয়ে রাস্তা টহল দিয়ে বেড়ায় না মেয়েদের আব্রু পরীক্ষা করার জন্যে, বা
কোথাও কোনও ছেলে আরেক ছেলের হাতে হাত রেখে হাঁটছে কিনা। ইরাণে পাসপোর্ট চুরি করা
সহজ নয়, যতটা সহজ মালয়েশিয়াতে। এমনকি সেখানে সশরীরে চোর সাজারও প্রয়োজন হয়না, কটি
ডলার হাতে দিলে কেউ না কেউ সেই চুরির কাজটি সমাধা করে তার হাতে দিয়ে যাবে
পাসপোর্টখানা। বর্তমান পৃথিবীতে পাসপোর্ট চুরি আর বালক-বালিকা চুরি কোনটাই তেমন
শক্ত কিছু নয়। রাতারাতি বড়লোক হবার এক সহজ পন্থা----ইউরোপ-আমেরিকার অনেক নব্যধনীরা
যেমন করে বড়লোক হয়েছেন সরকারের চোখে ধূলো দিয়ে, গরিব দেশের চাষাভূষার ছেলেরা যেমন
করে বড়লোক হয়েছে সরকারি তহবিল লুন্ঠন করে।
তারা তো কোনদিন ধরা পড়বে না, ধরা পড়বে ওই সব হতভাগ্য ছেলেগুলি যারা সেই চোরাই
পাসপোর্ট ব্যবহার করে সীমান্ত পাড়ি দেবার চেষ্টা করবে। তবু তারা যাবে, ধরা পড়ার
ষোল আনা সম্ভাবনা আছে জেনেও। তারা বেপরোয়া। তারা বড়লোক হতে চায়না, শুধু বেঁচে
থাকতে চায়। একটু খোলা বাতাসে, মুক্তির আনন্দে, হেঁটে বেড়াতে চায়। সেই অধিকারটুকু
কেমন করে যেন হারিয়ে ফেলেছে এযুগের ছেলেমেয়েরা। জন্মের পর থেকে তারা দেয়াল ছাড়া আর
কিছু দেখেনি চারপাশে। নিষেধের দেয়াল, দারিদ্র্যের দেয়াল, অনাহার আর অর্ধাহারের
দেয়াল। একটা সময় ছিল যখন গরিবের ছেলেমেয়েদের আশার বাণী শোনানো যেতঃ লেখাপড়া শিখলে
গাড়িঘোড়া চড়তে পারবে। তাই তারা লেখাপড়া করার জন্যে স্কুলকলেজে যেত। এখন তাদের সে
রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তাদের লেখাপড়া করার জন্যেও বড়লোক হতে হয়, এমনকি
গরিবের দেশেও----বিশেষ করে গরিবের দেশে, যেখানে অন্য গরিবদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া
না শিখেই বড়লোক হয়েছে, গাড়িঘোড়া কিনেছে, এবং বড়লোক হবার পর শিক্ষার ব্যবসা খুলে
গরিবের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তারা শিখতঃ ‘অনেস্টি ইজ দ্য
বেস্ট পলিসি’। এখন তারা ঘরে ঘরে দেখছেঃ অনেস্টি ইজ দ্য ওয়ার্স্ট পলিসি। সততার
কারণে অনেক সময় জীবন হারাতে হয় আজকাল, মানুষের কাছে হাসির পাত্র হতে হয়
নিদেনপক্ষে। বর্তমান যুগ একপ্রকার বিচিত্র, বিকৃত, বিড়ম্বনার যুগ।
শিক্ষা, মানে ভালো
শিক্ষা, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা (কোরাণিক বা পৌরাণিক শাস্ত্রসম্মত শিক্ষা নয়),
তার দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন গরিবের ছেলেরা কি করে? কোথায় যায়? তারা দালালের
কাছে জমিজমা বন্ধক দিয়ে বিদেশের পেটমোটা হুজুরদের সেবা করতে যায়, যাতে করে তাদের
শ্রমার্জিত ডলার আর পাউণ্ড দিয়ে সরকারি কোষাগার ভরাট হতে পারে। অথবা তারা যায় আরবি
আমিরউজির আর রাজাবাদশাদের লালিত-পালিত মক্তব-মাদ্রাসাতে, যেখানে গিয়ে তারা শুক্রবারের
খুৎবা পড়ানো শিখতে পারে, আর শিখতে পারে গরু-ছাগল-ভেড়া-মুরগির গলাকাটা বিদ্যা।
ভাগ্য ভালো হলে তারা তালেবানের সুনজরে পড়ে। জিহাদ করতে শেখে। পেটে মোটা বেল্ট
বাঁধতে শেখে, সরাসরি বেহেশতে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে। খুব বেশিদিনের কথা নয় যখন
তারা যুবলীগ আর ছাত্রদলের পাণ্ডাদের মত মিছিল করে শ্লোগান দিয়েছিলঃ ‘বাংলা হবে
আফগান, আমরা হব তালেবান’। তাদের সবাই হয়ত বেল্ট বাঁধতে শেখেনি, কিন্তু একটা
বড়রকমের তাণ্ডব ঘটাতে অনেকগুলো বেল্টের প্রয়োজন হয় না, একটি কি দুটিই যথেষ্ঠ।
কোমরে বা পেটে তারা বেল্ট বাঁধে কেন? বেহেশতের
লোভে কেবল? না, আমার মনে হয় না। বাঁধে প্রধানত পেটেরই দায়ে। নিজেদের জীবন দিয়ে
তারা, এই ভাগ্যহত যুবকগুলো, তরুণ সদ্য-দুগ্ধাবস্থা-থেকে-উৎরে-ওঠা মায়ামুখ
কিশোরগুলো, তাদের ছোট ছোট ভাইবোনগুলোর অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়----তালেবান
নেতারা তো সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েই তাদের পেটে বেল্ট বেঁধে দিতে সক্ষম হয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর
আগেও একটা যুগ ছিল যখন এই শিক্ষিত, সমাজকল্যান বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন ছেলেমেয়েরাই ছিল
জাতির প্রাণ, জাতির সকল সুখসাচ্ছন্দ্যের আকর। কিন্তু আর নয়। এই বিকৃত, বিচিত্র,
বিড়ম্বনার যুগে সেই সহজ স্বাভাবিক সমীকরণটি একেবারেই অকেজো হয়ে উঠেছে। সামাজিক
সমীকরণের প্রধান পরিচালিকাটি এখন শিক্ষা নয়, সমাজকল্যান নয়, বিবেক আর বুদ্ধি তো
একেবারেই নয়, পরিচালিকা হল লোভ, অন্ধ, বন্ধ, নিরঙ্কুশ, অর্থলোলুপতা। বিশ্বায়ন আর
প্রযুক্তি, দুয়ে মিলে সেই অর্থলোলুপতার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। লালসাকে করেছে
উদগ্র, উদ্ধত ও উলঙ্গ।
মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৩৭০ এর রহস্য
একদিন নিশ্চয়ই আর রহস্য থাকবে না। ২২৬জন যাত্রী, ১৩ জন বিমানকর্মী, তাদের শোকাভিভূত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব,
তারা সবাই জেনে যাবেন তাদের প্রিয়জনদের অন্তিম পরিণতির খবর। কিন্তু ওই দুটি
হতভাগ্য যুবক? তাদেরও তো বাবামা ভাইবোন থাকতে পারে। তারা কোথায়? তাদের কাছে কি
কোনও শোকবার্তা পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করবেন মালয়েশিয়ান সরকার বা মালয়েশিয়ান
এয়ারলাইন্স? সম্ভবত, না। তারা তো পাসপোর্ট চুরি করা সম্ভাব্য সন্ত্রাসী। আজকাল
নাকি পাসপোর্ট চুরি করে দুই প্রকারের অপরাধীঃ এক, আদম পাচারের ব্যবসাতে সহসা ধনী
হয়ে যাওয়া দালালরা। দুই, জিহাদী সন্ত্রাসীরা। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের সেই
ছেলেদুটি কি দালালদের শিকার ছিল, না, জিহাদী দালালদের শিকার, সে রহস্য হয়ত কোনদিনই
জানা যাবে না।
আমি বলি, না, তারা আদম-পাচার বা জিহাদ-পাচার,
কোন পাচারিদেরই শিকার ছিল না, শিকার ছিল এযুগের যান্ত্রিক কালচারের। আজকে, একবিংশ
শতাব্দীর অত্যুন্নত,প্রযুক্তিজাত বিশ্বায়িত পৃথিবীতে, যুবক-যুবতী, বিশেষ করে
সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণরা, সমাজপতিদের বৃহত্তর পরিকল্পনাতে তাদের কোনও
স্থান নেই। তাদের স্থানটি দখল করে নিয়েছে একটি যন্ত্র, হয়ত তাদের পুর্বপুরুষদেরই
নিজেদের হাতে তৈরি যন্ত্র। এই অসাধারণ যন্ত্রটির এতটাই ক্ষমতা যে নিজের
খেয়ালখুশিমত চিন্তাও করতে শিখেছে----একে বলা হয় ‘আর্টিফিশিয়েল ইন্টেলিজেন্স’ (কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা)। নামটি ‘কৃত্রিম’ হলেও তার কাজখানি, বা কাজের ফলটুকু, মোটেও কৃত্রিম
নয়। এর বাজারি নাম হল রবোট, যাতে সবচেয়ে বেশি বুৎপত্তি হল জাপানিদের। সেদিন খবরের
কাগজে পড়লাম যে জাপানি প্রকৌশলীরা একটি রবোট ‘গার্বেজ পেইল’ বানিয়েছে যা মানুষের
মত করে চোখ রাখতে পারে কোন্ বর্জদ্রব্য গ্রহণযোগ্য আর কোন্টি নয়, এবং সে অনুযায়ী
গৃহস্থকে প্রয়োজন হলে একটু গালমন্দ করে দিতে পারে। এবার বুঝুন যন্ত্র আমাদের
জীবনের কতটা পরিসর দখল করে নিয়েছে। কিন্তু বড় সমস্যা গার্বেজের পাত্র দ্বারা
আমাদের বকুনি খাওয়া নয়, ওই যন্ত্রের কারণে অনেকগুলো শ্রমিকের চাকরি হারানো। আজকের
পৃথিবীতে ছোটবড় সব দেশেই যন্ত্রের আধিপত্য। ‘মডার্নাইজেশন’ শব্দটার মানেই হল
যন্ত্রায়ন, অর্থাৎ যন্ত্র দিয়ে মানুষ তাড়ানো। কোম্পানির বড়কর্তারা এর একটি সুন্দর
নাম দিয়েছেন----‘রিস্ট্রাকচারিং’। রিস্ট্রাকচারিং=ব্যাপক ছাঁটাই, সহজ সমীকরণ। কয়েক
হাজার শ্রমিক ছেঁটে ফেলতে পারলে কোম্পানির কর্তারা মিলিয়ন ডলারের বোনাস পান, স্টক
মার্কেট হুহু করে উঠতে থাকে, ‘ইনভেস্টার’রা তাতে মহাখুশি। আমরা যারা স্টক কিনে রাখি
একদিন বড়লোক হওয়ার আশায়, তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বগল বাজাতে থাকি। বগল বাজানোর
পরিবর্তে কপাল চপটায় কেবল সেই হতভাগ্য শ্রমিকগুলো, যারা সর্বস্ব হারিয়ে সপরিবারে
রাস্তায় নামার উপক্রম হয়। ২,০০৮ সালের সেই বিশাল অর্থনৈতিক ধ্বসের সময়কার একটি
মর্মান্তিক দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলব না----একজন শ্বেতাংগ ভদ্রলোক রাস্তায় নেমেছেন
একটা সাইনবোর্ড হাতে করে। তাতে লেখাঃ ‘হাইটেক কোম্পানিতে চাকরিহারানো ম্যানেজার,
বাড়ি নেই, বউ নেই, রাস্তা আর অনাহারই আমার একমাত্র সঙ্গি’। তাঁর মত আরো হাজার
হাজার, না, লক্ষ লক্ষ, কর্মী, বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মী, বাড়ির
মর্টগেজ দিতে না পেরে হোমলেস হয়ে পড়েছিলেন সেসময়, প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রে, এবং
যুক্তরাষ্ট্রের কারণে বহর্বিশ্বেরও অনেক দেশে। চারদিকে তখন বেকার বেকার হাহাকার। নগরে নগরে
ব্যবসাবাণিজ্যের কলকোলাহলে গমগম রাস্তাঘাট সব নীরব নিস্তব্ধ, দোকানপাট
তালাবন্ধ, পরিত্যক্ত, যা আমি নিজের চোখে দেখেছি স্যান ফ্রান্সিস্কোতে, লাস ভেগাসে,
লস এঞ্জেলেসে। কিন্তু সেই আকস্মিক ধ্বসটির মূল কারণটা কি ছিল? শেয়ার বাজারের অপ্রত্যাশিত
পতন? উৎপাদন খাতে কোনও তুমুল বিপর্যয়? না, তার কোনটাই না। মূল কারণটা ছিল অতিরিক্ত
লোভ, রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাবার অন্ধ, উণ্মাদ আকাঙ্ক্ষা আমেরিকার বড় বড় ব্যাঙ্ক আর
বীমা কোম্পানিগুলোতে----ছোট কেরানী থেকে শুরু করে ছোটম্যানেজার, বড় ম্যানেজার,
এডভাইজার, ডিরেক্টর, সব। এই যে রাতারাতি ধনকুবের হয়ে যাবার তীব্র লালসা, সেই
লালসাতে আক্রান্ত আজকের গোটা পৃথিবী। অত্যুন্নত আমেরিকা থেকে অত্যুনুন্নত আফ্রিকান
রাষ্ট্রসমূহ, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ, সব এই একই পথের পথিক। এবং সেই লোভ-লালসা
পূর্ণমাত্রায় চরিতার্থ করে দেয়ার পথে পূর্ণ সহায়তা দিয়েছে, আধুনিক যুগের সেই
সর্বজনের সর্বসহায় ও সর্বব্যাপ্ত প্রযুক্তি। কম্পিউটার। ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের
কারণে আজ মুদ্রণশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে, ডাকবিভাগ বিলুপ্তির পথে, পাব্লিক
টেলিফোন বিলুপ্তির পথে। অর্থাৎ যেখানে সজীব সচল মানুষের শ্রম আর মেধা দিয়ে একটা পণ্য তৈরি করা হত
সেখানে কোম্পানির কর্তারা ‘রিস্ট্রাকচারিং’এর দোহাই দিয়ে মানুষটিকে সরিয়ে একটি যন্ত্র বসিয়ে দিয়েছেন। কারণ যন্ত্রকে বেতন
দিতে হয়না, তারা কখনো পদোন্নতি দাবি করে না, কখনো ধর্মঘট করে না, ইউনিয়ান করে না।
বেতন আর পদোন্নতি হয় কেবল যারা সেই যন্ত্রগুলোকে বসিয়ে মানুষগুলোকে পথে বসাতে
পারেন, তাদের। শুধু কি তাই? কোনও কাজ যদি একেবারেই সম্ভব না হয় মানুষের হাত ছাড়া,
তখন তারা ‘বিশ্বায়ন’ নামক আরেকটি চতুর বুদ্ধি প্রয়োগ করে সেই কাজগুলো চালান করে
দেন চীন-ভারত-পকিস্তান আর বাংলাদেশে। কারণ ঐসব দেশের শ্রমিকগুলোকে প্রায়
বিনামূল্যেই কাজ করানো যায়----পশ্চিমের শ্রমিকদের তুলনায় তাদের উপার্জন নস্যিতুল্য। অতএব বেকার কারা? যারা লেখাপড়া
শিখে নতুন চাকরিতে ঢোকার চেষ্টা করছে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা, বুদ্ধিমান,
কর্মঠ, তরুণ স্বাপ্নিকরা। ওই অভাগা ছেলেদুটির মত।
একটা জাতির সুখ-সমৃদ্ধি বলতে কি বোঝায়? জাতীয়
সমৃদ্ধির প্রধান সূচকগুলি কি? আমি অর্থনীতির পণ্ডিত নই, শাস্ত্রটির স্বরবর্ণ
ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গেও আমার পরিচয় নেই, অতএব এ-প্রশ্নের জবাব আমার এক্তিয়ারের
বাইরে। তবুও সাধারণ বুদ্ধির যদি কোনও দাম থাকে তাহলে আমি সাহস করে এটুকু বলতে পারব
যে সমৃদ্ধির অন্যতম সূচক, সেজাতির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের বার্ষিক উপার্জনের
তারতম্য। যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ইনকাম-গ্যাপ’। অতি অল্পসংখ্যক লোকের অতি উচ্চ উপার্জন, আর অতি অসংখ্য
লোকের অতি নিম্ন উপার্জন একটা দেশের সমৃদ্ধির লক্ষণ নয়, বরং একটি অতি অনুন্নত,
দরিদ্র দেশেরই পরিচায়ক। আসলে গরিব দেশ বলতেই বুঝায়ঃ একটি সর্বহারা মহাসাগরে
গুটিকয়েক ভাসমান কোটিপতি। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি গরিব দেশের এই একই বৈশিষ্ট্য।
হাইতি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ফিলিপিন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ----এদের সবার বলতে
গেলে একই চরিত্র। গরিব শ্রমিকরা ধন উৎপাদন করে, কিন্তু ভোগ করার অধিকার নেই তাদের,
ভোগ করে গুটিকয় সুবিধাবাদী ভোক্তা। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের উদাহরণ, বা অন্য
যে-কোন ‘উন্নয়নশীল’ দেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির করুণ কাহিনী, কারুরই অজানা থাকার
কথা নয়। শ্রমিকরা দৈনিক ১২ ঘন্টা অমানুষিক পরিশ্রম করে মাসিক বেতন পায় সর্বকুল্যে ৪০
কি ৪৫ ডলার, আর মালিকরা পান কয়েক কোটি। এর নাম সমৃদ্ধি নয়, এর নাম লজ্জা। জাতীয়
লজ্জা।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকান যুক্তিরাষ্ট্র
একটি সত্যিকার আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল----রাজনৈতিকভাবে না হলেও সামাজিকভাবে। আমেরিকা
ছিল পৃথিবীর সব দেশের সব তরুণের স্বপ্নের দেশ, যাকে বলা হত সব-পেয়েছির-দেশ। পথের
ভিখিরিও যেখানে সোনার মুকুট পরে সিংহাসনে বসার সুযোগ পায়---আমেরিকা ছিল
চিরস্বাপ্নিকের চিরসুযোগের দেশ। কিন্তু কেন? কিভাবে তারা সক্ষম হয়েছিলেন দেশটাকে
ঠিক ওইরকমভাবে গড়ে তুলতে? নিন্দুকরা যে যাই বলুন না কেন এটা অস্বীকার করা যাবে না
যে এদেশে একসময় শ্রমের মূল্য ছিল, স্বপ্ন ও নিষ্ঠার মূল্য ছিল, অধ্যবসায়ের মূল্য
ছিল। এবং, ছিল সামাজিক সুবিচার, সুযোগসুবিধার দিক থেকে কোনরকম বৈষম্য, অন্তত জাতীয়
পর্যায়ে অতটা ছিল না যতটা পরিলক্ষিত হয় আজকাল। বড় কথা, ইনকাম-বৈষম্য---এটা
মাত্রাতিরিক্ত কোনও অশ্লীল কিছু ছিল না। অর্থনীতিবিদরা এবিষয়ে একমত যে ১৯৭০ সাল
পর্যন্ত এই বৈষম্যটি একটি সহনীয় মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বেশ ক’টি দশকব্যাপী।
কিন্তু তারপরই কেমন করে সব ওলটপালট হতে শুরু করে। ১৯৭৯ থেকে ২০০৯---এই ত্রিশটি
বছরের মাঝে আমেরিকার প্রথম এক শতাংশের আয় বেড়েছে শতকরা ২৭৫ ভাগ, আর মধ্যবিত্ত
সম্প্রদায়টির বেড়েছে মাত্র ৪০ থেকে ৬০ ভাগ। ২০১২ সালের জরিপে দেখা যায়, ওপরের
একভাগের আয় আর নিচের ৯৯ ভাগের আয়ের মাঝে যে দূরত্ব তা ১৯২০ থেকে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে
বেশি। ২০১২ সালে ধনী সম্প্রদায়ের আয় বেড়েছে শতকরা ২০ ভাগ, আর বাকি ৯৯ ভাগের বেড়েছে
১ ভাগ। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত (২০১৩) অর্থনীতিবিদ রবার্ট
শিলার বলেছেনঃ “ আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের ক্রমবর্ধমান উপার্জন-বৈষম্যই হল
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা”।
১৯৮২ সালে গোটা বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ছিল
মাত্র ১৩ জন। ১৯৯০ সালে, অর্থাৎ ১৭ বছরের মাঝে সংখ্যাটি হুহু করে বৃদ্ধিলাভ করে
পৌঁছায় ৯৯ তে। পাঠক হয়ত মাথায় হাত দিয়ে ভাবছেন এই ১৭ বছরে এমন কি ঘটনা ঘটেছিল যাতে
করে এতগুলো মানুষের হাতে এত এত টাকা এসে গেল এত অল্প সময়ে? তার সহজ উত্তর,
প্রযুক্তি। হ্যাঁ, আধুনিক প্রযুক্তি ঠিক ওই সময়টিতেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে শুরু
করেছিল। প্রথমে আসে মুঠোফোন, তারপর আসে ইন্টারনেট। তাতে করে বড়লোকের হাতে যায় দামি
দামি খেলনা তৈরি করার সস্তা ফর্মুলা, আর গরিবের হাতে যায় সেই খেলনাতে আসক্ত হবার
নব নব পন্থা। ২০০৫ সালে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়ে ৬৯১ তে পৌঁছায়। মাথা ঘুরতে শুরু
করেছে বুঝি? তাহলে শুনুন। তিন বছর পর, অর্থাৎ ২০০৮ সালে এই সংখ্যাটি তীরের মত ছুটে
যায় ১,১২৫ এতে। ঠিক সে বছরই আমেরিকার ওয়াল স্ট্রীটের বাতি নিভে যায় হঠাৎ করে----সংখ্যাটি ধস
করে নেমে যায় ৭৯৩ তে। আহারে! সে যে কি কষ্ট বেচারিদের! সনটার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে
আপনাদের। ওই বছরই তো আপনার এতদিনের আরামের চাকরিটি হারাতে হয়েছিল। আপনার বাড়ি উঠে
গিয়েছিল মর্টগেজ ব্যাঙ্কের নিলামে, আর আপনি বালবাচ্চা নিয়ে পথে বসেছিলেন। হয়ত
আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন, এবং যাবার সময় ছেলেমেয়েগুলোকে
সঙ্গে নিতে ভোলেননি। আমেরিকার বড় বড় শহরগুলোতে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সে
কি হায় হায় রব চারিদিকে। তখন আমেরিকার
সদয়চিত্ত প্রেসিডেন্ট ওবামা তড়িঘড়ি করে ওই বিলিয়নিয়ারদের ব্যবসা ও মান বাঁচানোর লক্ষে
সরকারি কোষাগার খুলে দেন, এবং তার নাম দেওয়া হয় ‘স্টিমিউলাস প্রোগ্রাম’। কোষাগার
খোলা বলতে কি বোঝায়? করদাতাদের তহবিল খুলে দেওয়া। অর্থাৎ সেই গরিবের কষ্টার্জিত ধন
দিয়েই বড়লোকের ধন বৃদ্ধি করা। চিরকাল যা হয়ে এসেছে। কিন্তু তাতে তো পুঁজিবাদের
কোনও ক্ষতি হয়নি। ওবামার ‘স্টিমিউলাস’এর সরাসরি ফল কি দাঁড়াল? পরের বছর, ২০১০ সালে
বিলিয়নিয়াররা তাঁদের ভারকেন্দ্র ফিরে পেলেন, আবার ভারি হলেন তাঁরা জনে মালে ধনে,
৭৯৩ থেকে ধাই করে উঠে গেলেন ১০১১ তে। এবং তার পর থেকে সেই সংখ্যা কেবলই বর্ধমান।
এবছরের জরিপে শেষ সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১৬৪৫ তে, যার মাঝে খোদ আমেরিকাতেই ৪৪২ জন। এঁদের মাঝে সবার
শীর্ষে আছেন মাইক্রোসফটের বিল গেইটস----মোট ৭৬ বিলিয়ন ডলারের মালিক তিনি। আমেরিকান
বিলিয়নিয়ারদের মাঝে একটি আরামের জায়গা করে নিয়েছেন ২৯ বছর বয়স্ক ধনকুবের মার্ক
জুকারবার্গ, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। গতবছর তাঁর মোট সম্পদ ছিল ১৩.৩ বিলিয়ন, এবছর তিনমাস যেতে-না-যেতেই সেটা সাঁ করে উঠে
গেছে ২৮.৫ এ। এমনকি তাঁর কোম্পানির বেতনভোগী চিফ অপারেটিং অফিসার, শেরিল
স্যাণ্ডবার্গ, তিনিও বিলিয়ন ক্লাবে প্রবেশাধিকার পেয়ে গেছেন। এতে অবশ্য আশ্চর্য
হবার কিছু নেই। জুকারবার্গ সাহেব এমন এক জিনিস আবিষ্কার করেছেন যাতে ডুব দেবার লোভ
সংবরণ করা ছেলেবুড়ো কারো পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। ফেসবুক একাউণ্ট নেই এমন লোক আজকাল
কোথায় পাবেন আপনি? একে আমি বলি একপ্রকার নার্সিসাস দীঘি। গ্রীক পুরাণের সেই
নার্সিসাস গল্পটি যার জানা আছে তাকে বোঝাতে হবে না এই দীঘির কি অর্থ। একবার
সেদীঘির স্বচ্ছ জলেতে নিজের শ্রীমুখটি অবলোকন করার সুযোগ পেলে কার সাধ্য সেখান
থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনে। মার্ক জুকারবার্গ ও তাঁর সুযোগ্য সহচররা পৃথিবীর দুচার
বিলিয়ন অহমপ্রেমিককে সেই মায়াবী পুকুরের ধারে বসিয়ে রেখে নিজেদের পরম সুখের বিলিয়ন
পুলেতে আত্মমগ্ন হয়ে থাকার সুযোগ করে নিয়েছেন।
বড়লোক, মানে উৎকটরকম বড়লোকদের একটা
জিনিস আছে----একতা। একাত্মবোধ। এক দেশের কুবের আরেক দেশের কুবেরকে একটু সহায়তা
দিতে কার্পণ্য করবেন না। যে কারণে বিলিয়ন ডলারের হুজুগ এখন কেবল আমেরিকারই
একচেটিয়া নয়, ছোটবড় সব দেশেই সমান দৌড়। এমনকি খাতায়-কলমে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র,
চীন, সেখানেও বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ১৫২ জন। রাশিয়াতে ১১০ জন। পাঠকের যদি স্মৃতিভ্রম না হয়ে থাকে তাহলে ৭০ বছর আগেকার সোভিয়েট ইউনিয়ানের সঙ্গে বর্তমান রাশিয়ার মিল খোঁজার চেষ্টা
করে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। চীনেরও তো একই কাহিনী। মাও সে তুং নামক এক ভদ্রলোক
ছিলেন সেখানে যার কথা হয়ত অনেকেরই মনে আছে। তাঁর দেশে এত ধনদৌলত, শুনলে খুশিতে
বাগবাগ হতেন কি তিনি? ভেবে দিশাহারা হই মাঝে মাঝেঃ মানবচরিত্রের কোন্ উপাদানটি
মৌলিক? পরোপকার, না, আত্মোপকার? বৃহত্তর সমাজের স্বার্থ, না, একান্তই নিজের
স্বার্থ? তুলনামূলকভাবে আমাদের নিরীহ দেশ ক্যানাডাতে, এখনও কিছুটা সমাজতান্ত্রিক
কথাবার্তা চলে। অন্তত এটুকু বলা যায় যে আমাদের ক্যানাডাতে ‘সমাজতন্ত্র’ ও
‘লিবারেলিজম’, এদুটি শব্দ এখনো বুক ফুলিয়ে উচ্চারণ করা যায়, যা আমেরিকাতে একেবারেই
সম্ভব নয়---দুটি শব্দই সেখানে বিস্ফোরক দ্রব্যের মত কাজ করে। হয়ত সেকারণে,
আমেরিকার নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও ক্যানাডার বিলিয়নিয়ার সংখ্যা মাত্র ২৯
জন। তার চেয়ে হাজার ধনী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী, ভারত। সেখানে ৫৫
জন বিলিয়নিয়ার। পাকিস্তান, সেই মহান তালিবান রাষ্ট্র, যেখানে আজানের আওয়াজ আর
বোমাবারুদের আওয়াজ ছাড়া অন্য কোন আওয়াজ খুব একটা শোনা যায় না আজকাল, সেখানেও,
আল্লার রহমতে, ১ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের গরিব দেশ বাংলাদেশে
এখনও ওই মাপের বিলিয়নিয়ার গজিয়ে উঠতে পারেননি, অন্তত আমেরিকান ডলারের হিসেবে নয়।
তবে আচার-ব্যবহারে আমরা কারো চেয়ে ছোট নই---১৯৯৭ সালে মুসা বিন শমসের (১৯৪৫-) নামক
এক বাংলাদেশী জনদরদী হুজুর ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ারের লেবার
পার্টিকে ৫ মিলিয়ন পাউণ্ড দান করার খায়েস প্রকাশ করেছিলেন, যদিও সেটা সবিনয়ে
প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তৎকালীন লেবার পার্টির কর্মকর্তারা।
পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর একটা
পলিটিকেলি কারেক্ট নাম আছেঃ ডেভেলাপিং কান্ট্রি। উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। আরো একটা নামঃ
থার্ড ওয়ার্ল্ড----তৃতীয় বিশ্ব। (প্রথম বিশ্ব আছে, তৃতীয় বিশ্ব আছে, দ্বিতীয় বিশ্ব
কোথায় গেল বলুন তো।) যাই হোক, এই ‘ডেভেলাপিং কান্ট্রি’সমূহের ছোটবড় ছেলেবুড়ো প্রায়
সকলেরই ধারণা যে আমেরিকা এমন দেশ যেখানে গরিবদুঃখি বলে কিছু নেই। দেশে যখন বেড়াতে
যাই তখন ছেলেমেয়েরা বারবার এপ্রশ্নটাই করে আমাকেঃ চাচা, সেখানে সুযোগসুবিধা কেমন।
এর দুটো উত্তরঃ একটা সৎ ও অপ্রিয়। আরেকটি আরামপ্রদ, কিন্তু অসত্য। না, আমেরিকাতে
প্রচুর দারিদ্র্য। সেটা নতুন ইমিগ্র্যান্টরা হাড়ে হাড়ে টের পায় অতি অল্প সময়ের
মাঝেই। এই নির্মম সত্যটি ভালো করে উপলব্ধি করেছেন বলেই প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্প্রতি
প্রস্তাব তুলেছেন কংগ্রেসের কাছে যাতে সর্বনিম্ন আয়ের হার ঘন্টাপ্রতি ৭ ডলার ২৫
সেন্ট থেকে বাড়িয়ে ১০ ডলার ১০ সেন্টে তোলা হয়। এতে করে, তাঁর এবং তাঁর উপদেষ্টাদের
হিসেবে, হয়ত ৫ লক্ষ লোক চাকরি হারাবে, কিন্তু সাথে সাথে ৯ লক্ষ শ্রমিক দরিদ্র দশা
থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মধ্যবিত্ততে পৌঁছে যাবার সুযোগ পাবে। কিন্তু কংগ্রেসের
রিপাব্লিকান সদস্যরা এতে রাজি নন। তাঁদের মতে সর্বনিম্ন আয় বেড়ে গেলে
সর্বোচ্চওয়ালাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে, তখন কি তারা কাউকে বেতন দিয়ে কাজ করাতে পারবেন?
না, পারবে্ন না। ফলে, ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি হবে গরিবদেরই----বেকারত্বের হার বেড়ে
যাবে হহু করে। এই ‘না’ দলটির বড় মদদদাতা হলেন রিচার্ড বার্মান নামক ‘ক্ষুদ্র
ব্যবসায়ীদের’ একজন বড় নেতা। তিনি গোঁ ধরে বসেছেন---কিছুতেই এ-আইন পাশ হতে দেবেন
না।
বর্তমান পৃথিবীর ধরণধারণ আমি কিছুই
বুঝি না। একদিকে অন্ধ অর্থলোলুপতা, আরেকদিকে অন্ধ
ধর্মপরায়নতা। একদিকে অসৎ পন্থায় টাকার পাহাড় গড়ে তোলা, আরেকদিকে সেই হারামের টাকা
দিয়েই পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ মন্দির তৈরি করার হিড়িক, বছর বছর তীর্থভূমির পবিত্র
মাটিতে চিত্তের অপবিত্রতা দূরিকরণের ব্যর্থ প্রয়াস। এরোগটি কেবল গরিব দেশেই হচ্ছে
তা নয়, তথাকথিত প্রথম বিশ্বেরও একই খবর। আসলে আমার কি মনে হয় জানেন? মনে হয় এযুগের
মানুষের জন্যে গড একটি নয়, দুটি। একটির নাম ঈশ্বর বা আল্লা, আরেকটির নাম ডলার।
অর্থাৎ যথার্থ বিচারে সত্যিকার একেশ্বরবাদী প্রায় কেউ নন আজকের জগতে----তাঁরা
দ্বৈতপূজারী।
অটোয়া, ২৭শে মার্চ, ২০১৪
মুক্তিসন ৪৪
মীজান রহমান ♥♪♥ Mizan Rahman