Thursday, 6 February 2014

নামপূজা ওরফে জিকিরবাদ

মীজান রহমান
এক
বছর দশেক আগে আমি একজায়গায় লিখেছিলামঃ ‘অঙ্ক আর ধর্ম, দুয়ের প্রকৃতি সম্পূর্ণ বিপরীত। অঙ্কের মধ্যে বিশ্বাস বলে কিছু নেই, সবই প্রমাণ। ধর্মের মধ্যে প্রমাণ বলে কিছু নেই, সবই বিশ্বাস’। কথাটি আমি এখনও সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি। দুটিকে সম্পূর্ণ আলাদা দুটি ছকের ভেতর স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে, তার কারণ এরা জৈবিক পদার্থ নয়----এদের নিজস্ব কোনও আবেগ-অনুভূতি নেই। কিন্তু মানুষের আছে। তাই মানুষের বেলায় দুটি আপাত-বিপরীত ধারাকে পাশাপাশি রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ চরিত্র দাঁড় করানো মোটেও শক্ত নয়, অবাস্তব তো একেবারেই নয়। সংসারের প্রায় প্রতিটি মানুষের মাঝেই একদিকে ডক্টর জেকিল, অপরদিকে মিস্টার হাইড, এ-দুটি বিপরীত চরিত্রের সহাবস্থান কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা হয়ত নয়। আমরা যেন ভুলে না যাই যে আধুমিক বিজ্ঞানের জনক স্যার আইজ্যাক নিউটন একদিকে যেমন মানুষের জ্ঞানজগতকে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহতারাদের মধ্যিখানে উপস্থিত করতে পেরেছিলেন, তেমনি করে আপন গৃহের গোপন অন্ধকারে ভূতপ্রেত আর দৈব-অদৈব শক্তির উপাসনাতে ব্যয় করেছেন জীবনের অর্ধেকটা সময়। খৃষ্টপূর্ব যুগের শ্রেষ্ঠ গ্রিক গাণিতিক-বিজ্ঞানী-দার্শিনিকদের অনেকেই অমূলদ সংখ্যার অস্তিত্ব মানতেন না, শূন্যের অস্তিত্ব মানতেন না, কারণ তার মানে মহাপ্রভুর অস্তিত্ব অস্বীকার করা। এমনকি বর্তমান যুগেও অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী গাণিতিক অতিপ্রাকৃতিক বস্তুর অস্তিত্ব ও তাদের ঐশ্বরিক তাৎপর্য নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করছেন, এমনকি চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্বকেও তুরুপের জোরে উড়িয়ে দেবার প্রয়াস পান কেউ কেউ প্রকৃত ও অতিপ্রাকৃতের দ্বন্দ্ব-বিরোধ কেবল বহির্বিশ্বেরই স্বাভাবিক ঘটনা নয়, মানুষের অন্তর্লোকেরও। একই মানুষ কিভাবে বিশুদ্ধ যুক্তিবাদের অবিচল অনুসারী হয়েও আপাত-অযৌক্তিক বা অপযৌক্তিক চিন্তাধারার অন্ধ উপাসক হতে পারেন, আজকের নিবন্ধটিতে আমি তারই কটি ঐতিহাসিক উদাহরণ তুলে ধরব পাঠকের কাছে।

দুই
১৩ই জুন, ১৯১৩ সাল। রুশ সম্রাট জার নিকোলাস(২)প্রেরিত নৌসেনাপতি শিপুলিন্সকি তাঁর ১১৮ সেনাসম্বলিত আক্রমণবাহিনীকে আদেশ দেন একটি গির্জার ভেতরে ঢুকে সেখানকার নিরস্ত্র পাদ্রীগুলোর ওপর হামলা চালাতে। গির্জাটির নাম প্যান্টালিমন মঠ। তাঁরা শহর-বন্দরের সাধারণ পাদ্রীদের মত নন। তাঁরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মত সংসার-বৈরাগী চিরকৌমার্যব্রতী সাধুপুরুষ, যারা রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চের শাখা হয়েও অন্তর্গত নয়, বরং বহির্ভূত একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী যাদের বলা হয় “নেইমওয়ারসিপার্স”----সোজা কথায় নামপূজারী বা জিকিরবাদী। দুদলের মূল বিবাদের বিষয় হল তাদের বিশ্বাসঃ জিকিরবাদীদের বদ্ধমূল ধারণা যে যিশুখৃস্টের নামটি বারবার, বারবার, একনিবিষ্টভাবে, বিরতিহীনভাবে, উচ্চারণ করে যেতে পারলে, একসময় তার দেহমন এমন একটা আধ্যাত্মিক উচ্চতায় পৌঁছে যায় যে সেই নাম আর আরাধ্য ব্যক্তির মধ্যে কোনও বিভেদ থাকেনা। পূজ্য আর পূজারি একে অন্যের শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। এপ্রসঙ্গে মধ্যযুগের বিখ্যাত সুফি মনসুর আল-হাজ্জাজের (৮৫৮-৯২২) এর কথা মনে পড়ে যায়। তিনি আল্লার ধ্যানসাধনাতে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে একসময় উচ্চারণ করতে থাকেনঃ “আনাল হক, আনাল হক”----বারবার, বারবার। যেহেতু “হক” শব্দটি আল্লার নিরানব্বুই নামেরই অন্যতম একটি নাম সেহেতু নিজেকে ওই নামের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার অপরাধে তাঁর বিচার হয়, ১১ বছরের কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়, শেষে ৯২২ সালে, খলিফা আল-মুক্তাদিরের আদেশে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। সেদিক থেকে গোঁড়া খৃস্টান নামপূজারিদের খানিকটা মিল আছে বই কি সুফি মনসুরের সাথে, যদিও নামপূজারিদের আচার অনুষ্ঠান উগ্র সুফিদের চেয়েও চরমপন্থি। রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চ কিভাবে এবং কেন রাশিয়ার ভূখণ্ডেই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, ইউরোপের অন্য কোথাও নয় (যদিও গ্রিক অর্থডক্স চার্চও অনেকটা রাশিয়ানদেরটিরই মত), সে ইতিহাস অনেক লম্বা। তাদের নিয়মকানুন আচারআচরণ অন্যান্য খৃস্টানদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। স্বয়ং জার সম্রাট সেই চার্চের বিধিমালার অন্ধ অনুগামী। অনেকটা ব্রিটেনের রাজা-রাণীরা যেমন এংলিকান চার্চ অফ ইংল্যাণ্ডের অনুসারী ও পৃষ্ঠপোষক। তাই নামপূজারীরা যখন অর্থডক্স চার্চের বিধিবিধান অমান্য করে নিজেদের



প্যান্টালিমন মঠ
খেয়ালখুশি মত জপসাধনাতে মগ্ন হয়ে থাকার সিদ্ধান্তে অটল হয়ে থাকেন তখন চার্চপ্রধানদের সুপারিশক্রমে জার তাদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন গ্রীসের ইজিয়ান সাগর উপকূলবর্তী ছোট্ট পার্বত্য অঞ্চল মাউন্ট এথোসে। জায়গাটি গ্রীসের মূল ভূখণ্ডের অন্তর্গত হয়েও কেমন করে রাশিয়ার সম্রাটের বলয়ের মধ্যে এসে গেল সে’ও এক লম্বা ইতিহাস। আসলে গ্রীসের বেশির ভাগ জায়গা ছিল তুরষ্কের অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঊনিবিংশ শতাব্দীর একটা সময় পর্যন্ত মাউন্ট এথোসও ছিল অটোমানের অধীন। তবে এথোসের পাদ্রীদের সঙ্গে অটোমান সুলতানরা একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছিলেন যে যতক্ষণ তাঁরা কোনও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হন ততদিন তাঁরা কার্যত স্বায়ত্বশাসনের অধিকার ভোগ করতে পারেন----তাঁদের ধর্মকর্মতে সুলতান কোনরকম বাধাসৃস্টি করবেন না। এথোস অঞ্চলটিতে কেবল নামপূজারীদেরই আখড়া ছিল তা নয়, অন্যান্য সনাতন অর্থডক্সপন্থীরাও সেখানে বাস করতে চাইতেন। প্যান্টালিমন সহ ওই জায়গাটির মোট চার্চসংখ্যা ছিল বিশটি। এবং এঁদের অধিকাংশই রাশিয়ান। তার কারণ বোধ হয় এই যে রাশিয়ান অর্থডক্স আর গ্রীক অর্থডক্স চার্চ প্রায় একই রীতিনীতির অন্তর্গত। আরো একটি কারণ পার্বত্য এথোসের নিরিবিলি পরিবেশ, বিশেষ করে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার, দারুণ আকর্ষণীয় ছিল সন্ন্যাসব্রতী পাদ্রীদের জন্য। উপরন্তু মূল রাশিয়ার ভূখণ্ড থেকে দূরে থেকেও তাঁরা জার এবং অন্যান্য চার্চ প্রতিষ্ঠানসমূহের বিপুল সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করে যাচ্ছিলেন। এথোসের পাদ্রীদের ‘স্বায়ত্তশাসন’ অনেকটা স্বৈরাচারেরই সামিল বলা চলে। সেখানে বাইরের কোনও আগন্তুকের প্রবেশ কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সবচেয়ে কড়াকড়ি পাহারা ছিল মেয়েদের ওপর---কোনও নারী যেন ভুল করেও ওই জায়গাতে ঢোকার চেষ্টা না করে, সেবিষয়ে তাঁরা ছিলেন বিশেষভাবে সতর্ক---আগুন যদি না’ই থাকে কাছে তাহলে মোম গলবে কেমন করেসুতরাং এটা ধরেই নেয়া যায় যে ওই সন্ন্যাসীদের শাসনকালে সেখানে কখনও কোন শিশুর জন্ম হয়নি। অর্থাৎ ওদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির একমাত্র পন্থা ছিল বাইরে থেকে নতুন শিষ্যের আগমন, যা সচরাচর ঘটে থাকত।
সামান্য কূটনৈতিক সমস্যা দাঁড়িয়েছিল ১৯১২ সালে, যখন এথোসের পুরোটাই চলে যায় গ্রীক সরকারের দখলে। তাঁরা কি পাদ্রীদের স্বত্বাধিকার মেনে নেবেন আগের মত? ভাগ্যক্রমে দেখা গেল গ্রীকরাও ওদের ধর্মকর্মের পথে বাধা দিতে চাননি, সেখান থেকে সৈন্যসামন্ত সরিয়ে নিয়ে ওদের কার্যত নিজেদের ঘর নিজেরাই গোছানোর অধিকার দিয়ে দেন। সমস্যা বাধায় এই বেয়াড়া ‘নামপূজারীরা’ই। যেহেতু তারা, মূল চার্চের মতানুসারে, ধর্মবিরোধী, সেহেতু সনাতন ধর্মবাদীদের দৃষ্টিতে তারা হলেন ঘরের শত্রু, অর্থাৎ বিপজ্জনক। দীর্ঘকাল জারের আনুকূল্য ভোগ করতে থাকার ফলে তাদের ওপর কোনও সহিংস আক্রমণ কখনো হয়নি আগে, কিন্তু জার নিকোলাস কোনও কারণে তাদের ওপর একটু বিরক্ত হয়েছিলেন। অথবা রাশিয়ার অর্থডক্স চার্চের হোমরা-চোমরাগণ জারের কানে নানারকম কুৎসা বর্ষণ করেছিলেন ওদের বিরুদ্ধে। যেকারণেই হোক, শিপুনিস্কির গির্জা হামলার সূত্র সেখানেইভদ্রলোক প্রথম থেকেই নিরীহ পাদ্রীগুলোর ওপর বলপ্রয়োগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। উনি চাইছিলেন ওঁরা শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করুক, অনুতাপ করে বলুক, না আমরা আর ওভাবে জিকির করব না যিশুর নাম, তাহলেই সব সমস্যা চুকে যেত। কিন্তু ঘাড়বাঁকা সন্নাসীগুলো তা হতে দেননি---বললেন, না, আমরা কিছুতেই আমাদের ধর্মের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। ফলে যা হবার তাই হল---বেশ কিছু হতাহত, বাকি প্রায় হাজার দেড়েক পাদ্রী জাহাজে করে চালান হয়ে যান স্বদেশাভিমুখে, যেখানে তাঁদের কোনও গির্জা ছিল না, কোনও প্রকাশ্য জায়গাতে তাঁদের ধর্মপ্রচার করারও ছিল না অধিকার। মানে তাঁরা নিজের দেশেই হলেন নির্বাসিত!
নামপূজারিরা তখন বাধ্য হয়ে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে নিরিবিলি জীবনযাপনের পথ বেছে নেন। তাতে তাঁদের যে খুব ক্ষতি হয়েছিল তা নয়---গ্রামের সাধারণ লোকের কাছে তাঁরা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। বেচারারা কারো সাতে নেই পাঁচে নেই, কারো ক্ষতি করছেন না, হবেনই না বা কেনকালে কালে জারেরও যেন মন গলতে লাগলো একটু একটু করে। ১৯১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নামপূজারিদের একটা ‘সাধারণ ক্ষমা’র আরজ শোনার আদেশ দেন তাঁর বড় আদালতকে। ইতোমধ্যে অর্থডক্স চার্চের পাদ্রীরাও রাজি হয়ে যান নামপূজারিদের চার্চ ব্যবহারের সুযোগ দিতে। সাধারণ ক্ষমার শুনানির সময় নামপূজারিদের পক্ষ হয়ে যে কৌঁশুলিটি যুক্তি দাঁড় করছিলেন হাকিমদের কাছে তাঁর নাম ছিল প্যাভেল ফ্লোরেন্সকি (১৮৮২-১৯৪৩)। এখান থেকেই আসে আমার এই লেখাটির মূল প্রেরণা। কারণ এই ফ্লোরেন্সকি লোকটি ছিলেন একজন উঁচুমাপের মেধাবি পুরুষ। ১৯০৪ সালে তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি করেন। না, ওকালতি বা ধর্মশাস্ত্রে নয়, গণিতশাস্ত্রে! পিউর ম্যাথেমেটিকস----দাঁতভাঙ্গা বিশুদ্ধ গণিত। এবং তার ঠিক চার বছর পর তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেন সেই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে---ধর্মশাস্ত্রে! শুধু তাই নয়, ১৯১১ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে


প্যাভেল ফ্লোরেন্সকি
পাদ্রীপদে অধিষ্ঠিত হন। এবং তখন থেকেই তাঁর ঝোঁক নামপূজারিদের প্রতি। বড় গাণিতিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি একজায়গায় বলেছিলেন যে যুক্তিবাদের ওপর ভরসা করে থাকলে মানুষ সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়----বহির্বিশ্বকে সন্নিবদ্ধ করার পরিবর্তে বস্তুনৈষ্ঠিক করে ফেলে। ১৯১৩ সালে যখন এমোসের নামপূজারিদের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী পাঠানো হয় তখন তাঁর ব্যক্তিগত সমর্থন ও সহানুভূতি পুরোপুরিই ছিল সন্ন্যাসীদের পক্ষে।
গতানুতিক চার্চের বিরাগভাজন হবার মূল কারণটা ছিল এই যে তাঁরা ভাবতেন যে নামের পূজা করতে গিয়ে নামপূজারিরা আসলে একেশ্বরবাদের পথ পরিত্যাগ করে বহু-ঈশ্বরবাদের জালে জড়িয়ে পড়ছে----কারণ তারা নামকেই ঈশ্বর বলে অভিহিত করছে। সেটা তাদের মতে ভিন্ন এক ঈশ্বরেরই সামিল। ফ্লোরেন্সকি এবং তাঁর সহচারীরা যুক্তি দেখালেন যে সনাতনবাদীরা নামপূজারিদের মূল দর্শনটাই বুঝতে পারেননি----নাম মানে একজন আলাদা সৃষ্টিকর্তা নয়, নামের ভেতরে সেই একই ঈশ্বরের আত্মাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। নাম দিয়ে একটি অদৃশ্য সত্তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব, যেমন করে গণিতের ‘সেট থিওরি’ তে নামচয়নই নিরূপণ করে সেই ‘সেট’টির অস্তিত্ব। গণিতজ্ঞ হিসেবে আসলে সেভাবেই তিনি ঈশ্বরকেও সঙ্গাবদ্ধ করতে চান----তিনি হলেন সব ‘সেট’এর বড় ‘সেট’। হয়ত সেকারণেই রাশিয়াতে সেসময়কার অনেক নামজাদা গণিতজ্ঞই ধর্মীয় নামপূজারিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দিমিত্রি এগরভ( ১৮৬৯-১৯৩১)। তিনি হয়ত ফ্লোরেন্সকির মত স্পষ্টবাদী ছিলেন না, জনসমক্ষে বড় গলায় নামপূজারিদের পক্ষ নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাহস হয়ত ছিল না তাঁর, কিন্তু তাঁর বিশ্বাসও ছিল একইরকম দৃঢ় ও অনড়তিনি ছিলেন মস্কো বিস্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অন্যতম পূর্ণ প্রফেসার। এবং তাঁরই নামকরা ছাত্রদের একজন ছিলেন প্যাভেল ফ্লোরেন্সকি। আরো কজন বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন, এবং, মজার ব্যাপার যে তাঁদের অধিকাংশই ঠিক একইভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন নামপূজারি দলটির সাথে। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর যখন জারের পতন ঘটিয়ে বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে নেন, এবং সাথে সাথে প্রকাশ্য ধর্মকর্মের সকল দুয়ার একে একে, গায়ের জোরে, দরকার হলে বন্দুকের জোরে, বন্ধ করে দিতে থাকেন তখন, সাময়িকভাবে হলেও নামপূজারিরা কমুনিস্টদের ধর্মবিদ্বেষের কবল থেকে উদ্ধার পেয়ে যান, কারণ তাঁরা তো এমনিতেই ‘নিষিদ্ধ’ ছাপ নিয়ে জান বাঁচিয়ে চলছিলেন আড়ালে আড়ালে। নিজ নিজ ঘরে দরজা লাগিয়ে যিশুর নাম একশ হাজারবার উচ্চারণ করে গেলে কমুনিস্টদের কি আসে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে সেই গোপনীয়তার সুবিধাটি তাঁরা বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। দোষটা হয়ত তাঁদের নিজেদেরই। কর্তৃপক্ষের কেউ কিছু বলছেন না দেখে বোধ হয় তাঁরা একটু সাহস পেয়ে গিয়েছিলেন। একসময় গ্রামাঞ্চলের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবরকম লোকের কাছেই তাঁরা নামপূজার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে শুরু করেন। অশিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত কৃষক-মজুর শ্রেনীর লোকেদের কাছে সেটা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও শিক্ষিতদের নিয়েই বেধে গেল সমস্যা----তাদের বেশির ভাগই তখন নিরীশ্বরবাদী চিন্তাধারায় দীক্ষিত। অতএব তাঁদের কার্যকলাপের খবর অচিরেই পৌঁছে গেল ওপরতলায়। ব্যস, আর যায় কোথায়। শুরু হল ধড়পাকড়, নামপূজারিদের তখন প্রায় নিজের নাম ভুলে যাবার অবস্থা। বড় বড় মাথাওয়ালা নামপূজারিরাও সেসময় প্রকাশ্যে কমুনিস্ট আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য হন, যদিও অন্তরে তাঁদের ধর্মনিষ্ঠা বিন্দুমাত্র লাঘব হয়নি। রাশিয়ার নামপূজারিদের জীবনে যখন এহেন সঙ্কট, ঠিক ঐ সময়টিতেই তখন ফ্রান্স এবং জার্মানির গাণিতিক জগতে ধূমায়িত হয়ে উঠছিল আরেক বিচিত্র সঙ্কট। সে-সঙ্কটকে এককথায় ব্যক্ত করা যায়, এবং আক্ষরিক অর্থেই, ‘অসীম সঙ্কট’।

তিন
হার্মান ওয়াইল (১৮৮৫-১৯৫৫) নামক এক বিখ্যাত জার্মান গাণিতিক এক জায়গায় লিখেছিলেন যে গণিত হল অসীমের বিজ্ঞান, এবং তার উদ্দেশ্য হল সেই অসীমকে সীমার মধ্যে বেঁধে গণিতের সাঙ্কেতিক ভাষায় মানুষের কাছে তুলে ধরা। ‘অসীম’ জিনিসটা কি কোনও সংখ্যা, এক, দুই, তিন, চারের মত, না, সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু, সে-প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাননি এমন দার্শনিক-গাণিতিক-বিজ্ঞানী খুব কমই দেখা যায় গত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে। গ্রিক পণ্ডিত পাইথাগোরাস (খৃঃপূঃ ৫৬৯-৫০০) বেশ ভালোভাবেই সচেতন ছিলেন ‘অসীম’ সম্বন্ধে, যদিও তাঁর চিন্তাধারাতে বিষয়টি ছিল অনেকটা প্রাচ্যদেশীয় আধ্যাত্মিকতার ধূম্রজালে সমাচ্ছন্ন। আসলে ‘অসীম’ বলতে তিনি সোজাসুজি তাঁর সৃষ্টিকর্তাকেই বুঝতেন। এরিস্টোটল (খৃঃপূঃ ৩৮৪-৩২২) স্বীকার করতেন যে, হ্যাঁ, অসীম আছে বটে, তবে অবাস্তবের গুপ্তকক্ষে, বাস্তবে নয়। ভারতে শূন্যের ধারণাতে তেমন সমস্যা হয়নি, যতটা ছিল অসীম নিয়ে। অসীম যেন দেবদেবীদের এলাকা, পরমেশ্বরের বাসভূমি সেখানে। কে জানে, সেকালের ভারতীয় গাণিতিকরা, (আর্যভট্ট, ভাস্কর, ব্রম্মগুপ্তসহ আরো অনেকে) প্রাকৃতিক সংখ্যা, পাটিগণিত, ত্রিকোণমিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, এগুলোতে গর্ব করার মত উৎকৃষ্ট অবদান রাখতে পারা সত্ত্বেও যে আধুনিক গণিতের উদ্ভব ও বিকাশের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ভূমিকা রেখে যেতে পারেননি, তার মূলেই হয়ত ছিল এই ‘অসীম’কে নিয়ে তাঁদের কোনও বিজ্ঞানসম্মত ধ্যানধারণা গজিয়ে উঠতে না পারা। আসলে ‘অসীম’ বিষয়টি মধ্যযুগীয় ইউরোপের গণিতে প্রত্যক্ষভাবে আত্মপ্রকাশ না করলেও আইজ্যাক নিউটন এবং তাঁর সমসাময়িক গাণিতিকদের কাজের মধ্যে তা পরোক্ষভাবে প্রবেশ করেছিল বটে, কারণ তা নাহলে ক্যালকুলাস (কলনশাস্ত্র) নামক মৌলিক বিষয়টি, যা বর্তমান যুগে স্কুলের ছাত্রছাত্রী সবার জন্যই অবশ্যপাঠ্য, তার সূচনাই হতে পারত না। কারণ ক্যালকুলাসের গোড়ার জিনিস হল ‘লিমিট’, এবং লিমিটের গোড়াতে আছে এই ‘অসীম’ ব্যাপারটি। পাঠক হয়ত আরো ধাঁধায় পড়ে যাবেন যদি বলি, এই অসীম সসীম সবকিছুরই মূলে গোপনে গোপনে চাবিকাঠি ঘুরিয়ে যাচ্ছে যে জিনিসটি তার নামই ‘সেট’। অতএব এই সেট নিয়েই সামান্য সময় ব্যয় করা যাক।
প্রথমেই দশটি প্রাকৃতিক সংখ্যা (Natural Number) নিয়ে শুরু করিঃ ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯,১০
এ থেকে কেবল জোড় সংখ্যাগুলো নিইঃ ২,৪,৬,৮,১০-----মোট ৫টি জোড় সংখ্যা। সোজা হিসেব।
এখন আমরা সবগুলো প্রাকৃতিক সংখ্যা একের পর এক লিখে যাব, অন্তহীনভাবেঃ ১,২,৩,৪,৫,........
গুণে শেষ করতে পারছেন নাতো? আমিও পারছিনা, তাই এতগুলো ‘ফোঁটা’ দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম। তবে আপনি-আমি দুজনই বুঝতে পারছি যে সংখ্যাগুলো কূলকিনারাহীন---‘অসীম’।
এবার আমরা ঠিক আগের মতই কেবল জোড় সংখ্যাগুলোকে আলাদা করে লিখবঃ
২,৪,৬,৮,১০,......
এবার বলুনতো কটি ‘জোড়’ সংখ্যা এখানে? আপনি বুক ফুলিয়ে বলবেন, কেন, অর্ধেক অসীম? দুঃখিত, অর্ধেক অসীম বলে কিছু নেই সংসারে, ঠিক যেমন অর্ধেক শূন্য বলে কোন সংখ্যা নেই। তাছাড়া লক্ষ করুণ, ওপরের জোড় সংখ্যাগুলো আসলে প্রাকৃতিক সংখ্যামালারই দ্বিগুণ। তার অর্থ এই দাঁড়ালো যে প্রাকৃতিক সংখ্যামালার যে সংখ্যা, জোড় সংখ্যামালারও ঠিক একই সংখ্যা!
মাথা ঘুরতে শুরু করেছে বুঝি? এটি অতি সামান্য, প্রায় শিশুতোষ ধাঁধা একটি। এর চেয়ে হাজারো জটিল ধাঁধায় ভরা পুরো গণিতশাস্ত্রটি। সীমার মধ্যে থাকলে আপনার কোন সমস্যা হবে না, সীমা ছাড়িয়ে যেমুহূর্তে অসীমের কোঠায় পা দিয়েছেন অমনি আপনার বিকার শুরু হয়ে যাবে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখবেন। ওপরের প্রাকৃতিক সংখ্যার রাশিটিকে এবার উলটো করে লেখা যাকঃ
১, ১/২, ১/৩, ১/৪, ১/৫,......
এরা কোথায় যাচ্ছে মনে হয় আপনার? যত এগুবেন ততই তারা কমতে কমতে ০ এর দিকে যাচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে একই রাশিকে একভাবে লিখলে যায় অসীমে, আরেকভাবে লিখলে যায় শূন্যে----উপরতলা আর নিচের তলার তফাৎ মাত্র। একই রাশি একদিকে ১ থেকে অসীম পর্যন্ত, আরেকদিকে ১ থেকে শূন্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রথমটি সীমাহীনতার মাঝে অসীম, দ্বিতীয়টি সীমার মাঝেই অসীমসংখ্যক। এ এক বিচিত্র লীলা।
এবার যদি বলি ১ থেকে ০, এই রাস্তাটুকু, ১,১/২,১/৩,...করে লাফিয়ে লাফিয়ে না গিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে, কোনরকম ফাঁক না রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই তাহলে কি দাঁড়ায়? ইংরেজিতে একে বলে কন্টি্নিউইয়াম, বাংলায় বোধ হয় ‘অনবচ্ছিন্নতা’ বললে কাছাকাছি একটা অর্থ দাঁড়ায়। তার অর্থ, একই সীমানার মধ্যে সম্পূর্ণ দুই প্রকারের অসীমসংখ্যক বিন্দু দিয়ে ভরাট করা হল জায়গাটি। এই ছোট্ট উদাহরণটি থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছে যে ‘ইনফিনিটি’ বা ‘অসীম’ আসলে নানারকম হতে পারে। এখানে যেদুটি উদাহরণ দেখলেন আপনারা তার একটি হল ‘গণনীয়’, আরেকটি ‘অগণনীয়’। এরকম উদাহরণ আরো হাজারটে আছে গণিতে, বিজ্ঞানে, এমনকি অন্যান্য শাস্ত্রেও। এগুলোর আভ্যন্তরীন ধাঁধা ও যৌক্তিক সমস্যার কারণেই গত আড়াই হাজার বছর ধরে পণ্ডিতরা প্রশ্নগুলো নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, এবং অনেকে প্রায় পাগল হয়ে গেছেন ঘামাতে গিয়ে। শেষে যে মানুষটি আলোর মশাল নিয়ে এলেন এই সীমা-অসীমের গাঢ় অন্ধকারে তাঁর নাম জর্জ ক্যান্টর( ১৮৪৫-১৯১৮)ক্যান্টরকে জার্মান গাণিতিক হিসেবেই ধরা হয় বটে, তবে তাঁর জন্ম রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে। তাঁর দাদা ছিলেন ইহুদী, কিন্তু তাঁর বাবা পিতৃধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টান লুথারান ধারাতে দীক্ষিত হন। ক্যান্টরের বয়স যখন এগারো তখন তাঁরা সপরিবারে জার্মানীতে এসে বসবাস স্থাপন করেন। ছোটকাল থেকেই জর্জ ক্যান্টর অসাধারণ মেধার পরিচয় রেখেছিলেন গণিতশাস্ত্রে। উপরন্তু তিনি প্রচণ্ডভাবে আগ্রহী ছিলেন দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রে। এই ত্রিধারার সংমিশ্রণেই হয়ত তাঁর মানসপ্রকৃতি এমনভাবে গড়ে ওঠে যে গবেষণাজীবনে ‘অসীম’ বিষয়টি একটা মুখ্য বিবেচ্য বস্তু হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জন্যে। দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন তিনি অসীমসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করে। তারই সুবর্ণ ফসল ‘অসীম’ জিনিসটিকে একটি সুবিন্যস্ত গাণিতিক খাঁচার ভেতর আবদ্ধ করতে পারা। তিনি বুঝিয়ে দেন আমাদের যে অসীমেরও ছোটবড় আছে। সে অনুসারে তিনি ওগুলোর নামকরণ করেন হিব্রু বর্ণমালার সাহায্য নিয়ে---আলেফ শূন্য, আলেফ এক, ইত্যাদি দিয়ে। যেমন আমাদের উপরের তিনটি উদাহরণের প্রথম দুটি আলেফ শূন্যের অন্তর্গত, তৃতীয়টি আলেফ এক’এর। (তবে আলেফ শূন্য আর আলেফ এক’এর মাঝে যে ভিন্ন কোনও আলেফ নেই, তার প্রমাণ কিন্তু সোজা নয়। এই অপ্রমাণিত উক্তিটির একটা নাম আছেঃ কন্টিনিউয়াম হাইপোথিসিস। এ যে কি শক্ত এক প্রশ্ন সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে অনেক বাঘা বাঘা পণ্ডিত প্রায় উণ্মাদ অবস্থাতে পৌঁছে গিয়েছিলেন, স্বয়ং ক্যান্টরও বাদ যাননি) অসীম সংখ্যার শ্রেণীকরণের সূত্র ধরেই তিনি আবিষ্কার করেন ‘সেট’ থিওরি। আসলে সেট থিওরির অবিসংবাদিত জনক হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত ও সমাদৃত তিনি। যদিও প্রথমদিকে তাঁর চিন্তাধারার তীক্ষ্ণ সমালোচকও ছিলেন প্রচুর, বিশেষ করে তাঁর ‘অসীম’বিষয়ক কাজগুলোকিন্তু আস্তে আস্তে প্রথম সারির গাণিতিকরা টের পেতে থাকেন তাঁর উদ্ভাবিত সেট থিওরির আশ্চর্য শক্তি। এটি যে গণিতশাস্ত্রের সর্বব্যাপী বিস্তৃত একটি বিষয় তা তাঁরা উপলব্ধি করতে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে গণিতের যে কোন উপপাদ্য-সম্পাদ্যই একপ্রকার বিশুদ্ধতা অর্জন করে নেয় যখন তাকে সেট থিওরির ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। এ-সত্যটি সবচেয়ে বেশি আগ্রহের সাথে গ্রহণ করে নেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার কতিপয় ফরাসী তরুণ গাণিতিক। প্যারিসকেন্দ্রিক ফরাসী বুদ্ধিজীবীরা এমনিতেই যুক্তিবাদী চিন্তাধারার অনুগামী, ব্রিটেন বা অন্যান্য ইউরোপীয় ধারার ফলিত গণিতপ্রীতি তাঁদের ছিল না তেমন, খাঁটি যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে যা প্রতিষ্ঠিত নয় তার প্রতি তাঁদের একটু বিরূপ মনোভাবই বরং, অতএব ক্যান্টরের সেট থিওরি তাঁরা সহজেই লুফে নেন। এই তরুণ এবং প্রচণ্ড ধীশক্তসম্পন্ন ফরাসী গাণিতিকদের মাঝে ছিলেন আনরি লেবেগ (১৮৭৫-১৯৪১), এমিল বোরেল (১৮৭১-১৯৫৬) ও রেনে-লুই বেয়ার (১৮৭৪-১৯৩২)। এই ত্রিতারকা গণিতের কতগুলো মৌলিক শাখাতে যুগান্তকারী অবদান রেখে গেছেন। পৃথিবীর যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন গণিত বিভাগের যেকোন ছাত্রকে তার গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের পাঠক্রমতে এতিনটি নামের সঙ্গে পরিচিত হতেই হয়---আধুনিক এনালিসিস কোনক্রমেই এঁদের কাজ এড়িয়ে যেতে পারবে না, এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁদের সৃষ্ট গণিত। এবং এঁদের তিনজনই ঘটনাপরিক্রমায় জড়িয়ে পড়েন তিনজন বিশিষ্ট রুশ গাণিতিক---ফ্লোরেন্সকি, এগলভ ও নিকোলাই লুজিন(১৮৮৩-১৯৫০)নামক তৃতীয় একজন লোকের সাথে। এবং এঁদের সবারই সৃষ্টিকর্মের প্রধান স্তম্ভ ছিল জর্জ ক্যান্টরের আবিষ্কৃত নতুন তত্বঃ ‘সেট’ থিওরি। এই অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ছয়জন গণিতজ্ঞ কিভাবে একে অন্যের পথের সাথী হয়ে গেলেন কালের কোনও এক সন্ধিক্ষণে, কেমন করে তাঁদের বিচিত্র জীবন ইতিহাসের চিত্রপটে রেখে গেল অক্ষয় রেখামালা তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে এই নিবন্ধটিরই বিভিন্ন জায়গাতেকিন্তু তার আগে ভাবছি, আমার অগাণিতিক পাঠককে একটু ‘সেট’ থিওরির সেটে নিয়ে যাই, একটা ভাসা ভাসা ধারণা যাতে পান তাঁরা।
আসলে ‘সেট’ শব্দটি শোনা মাত্র ভয়ে আতঁকে ওঠার কোন কারণ নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিত্যই আমরা নানারকম ‘সেট’ নিয়ে কাজ করি। বাজার থেকে এক ঝুড়ি আম নিয়ে বাসায় ফিরি না বলে এক ‘সেট’ আম নিয়ে বাসায় ফিরি বললেই হয়। এক ‘সেট’ আলু, এক ‘সেট’ মরিচ, এক ‘সেট’ অতিথি আসবে বাড়িতে, ইত্যাদি সবকিছুকেই আপনি ‘সেট’এর ভাষাতে ব্যক্ত করতে পারেন। অনেকগুলো ‘সেট’ মিলে একটা বড় ‘সেট’ তৈরি হতে পারে। যেমন এক সেট আম, এক সেট লিচু, এক সেট নাশপাতি----এগুলো মিলে একসেট ফল হতে পারে। এরকম গুটিকয় বা অনেক অনেক সেট একসাথে মিলে যে বড় সেট তৈরি হয় তাকে গণিতের ভাষায় বলা হয় ‘সম্মিলিত সেট’ বা ‘ইউনিয়ন’এখানে অন্যান্য ছোট সেটগুলোকে বড়টির ‘সেটাংশ’ বা সাবসেট বললে অত্যুক্তি হয়না। আবার এমনও হতে পারে যে দুটি ‘সেট’ পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, যেমন ধরুণ এক ‘সেট’ আম আর এক ‘সেট’ লিচু (আম কখনো লিচু হতে পারেনা), তখন বলা হয় এদুটি ‘সেট’ এর ‘ইন্টারসেকশন’ বা প্রতিচ্ছেদন ‘সেট’টি ফাঁকা, খালি, বা ‘এম্পটি সেট’ (বিশুদ্ধ সেট থিওরির ভাষায় ‘নাল সেট’)----সাধারণভাবে শূন্য ‘সেট’ বললেও চলে। ওদিকে এমন দুই সেটও থাকতে পারে যারা পরস্পর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন নয়। যেমন ধরুণ, একটা সরকারি পার্কে অনেকগুলো প্রাণীর বাস, যাদের কিছু স্থলচর, কিছু জলচর, আবার কিছু রয়েছে যারা উভচর, অর্থাৎ জলেও আছে স্থলেও আছে। তাহলে ‘জলচর সেট’ আর ‘স্থলচর সেট’----এরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, এদের প্রতিচ্ছেদন ‘সেট’টিতে রয়েছে ‘উভচর সেট’র প্রাণীগুলো।
এই সামান্য কটি উদাহরণের মধ্য দিয়েই আমরা গুটিকয়েক ‘সেট’র সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলাম----সাবসেট, ইউনিয়ন সেট, ইন্টারসেকশন সেট, নাল সেট। আরো একটা নাম অনায়াসে শিখে ফেলা যায়ঃ পরিপূরক সেট----কমপ্লিমেন্টারি সেট। যেমন ফলের সেটের ভেতরে রয়েছে আম, লিচু আর নাশপাতির সেট। অতএব আনারসের সেট, ফলের সেটের অন্তর্ভুক্ত হলেও আম-লিচু-নাশপাতি সেটের বাইরে, অর্থাৎ এদের ‘কমপ্লিমেন্টারি সেট’র অন্তর্গত। সেহিসেবে পৃথিবীর সব সেটই কোন-না-কোনও বৃহত্তর ‘সেট’এর অন্তর্গত। এবং এই জায়গাটিতেই ধর্মবিশ্বাসীরা খানিক ফাঁক পেয়ে গেছেন তাঁদের সৃষ্টিকর্তাকে ‘সেট’ থিওরির কাঠামোতে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাঁদের মতেঃ ঈশ্বর হলেন সব সেটের বড় সেট। তার অর্থ এই ‘ঈশ্বর-সেট’ এর পরিপূরক সেটটি, মানে কমপ্লিমেন্টটি ফাঁকা, শূন্য---নাল সেট। এ’ই হল তাঁদের গণিতসম্মত সংজ্ঞা সৃষ্টিকর্তার!
অবিশ্বাস্য মনে হবে হয়ত, কিন্তু উপরোল্লিখিত গুটিকয় ‘সেট’এর ওপরই দাঁড়িয়ে আছে গোটা সেট থিওরির স্থূল কাঠামোটিএই ভাষাতেই ক্যান্টরসাহেব ‘অসীম’ সংখ্যাটির একটা রূপরেখা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন-----কতরকমের ‘অসীম’ হতে পারে তা নির্ভর করে কোন্‌ অসীম কোন্‌ সেটের অন্তর্গত। যেমন প্রাকৃতিক সংখ্যামালা দিয়ে গড়া যে সেট, সেটি অনবচ্ছিন্ন বাস্তব সংখ্যার সেট থেকে ভিন্ন, যদিও প্রথম সেটটি দ্বিতীয়টির একটি সেটাংশবিশেষ (অবশ্য যদি ০ থেকে অসীম পর্যন্ত পুরো দৈর্ঘটাই ধরা হয়)। জর্জ ক্যান্টর ‘সেট’ ব্যাপারে বেশ কতগুলো আইনকানুন লিপিবদ্ধ করে গেছেন যেগুলো পালন করেই পরবর্তীকালের বড় বড় গাণিতিকরা গণিতশাস্ত্রের অনেক নতুন শাখা সৃষ্টি করে যেতে পেরেছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম হল বোরেল ও লেবেগ সাহেবের সুবিখ্যাত বোরেল ও লেবেগ মেজার, এবং লেবেগ ইন্টিগ্রেশন থিওরি, যা বলতে গেলে আধুনিক প্রবাবিলিটি শাস্ত্রের মূল মালমশল্লা।


চার
১৬৬৫ সালের শেষের দিকে ব্রিটেনের স্যার আইজ্যাক নিউটন অন্তর্কলন তত্ব (Differential Calculus) আবিষ্কার করেন, যখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩! তার ঠিক পরের বছরই তিনি নিয়ে আসেন বাকিটুকু---সমাকলন তত্ব (Integral Calculus)ওদিকে জার্মানীর গটফ্রিড লাইবনিজ (১৬৭৬-১৭১৬), ঠিক একই জিনিস, একটু ভিন্ন ভাষায়, আমাদের উপহার দেন, নিউটনের আবিষ্কার সম্বন্ধে অনবহিত থেকেই। মধ্যযুগের এ দুই দিকপালের অসামান্য কাজের ফসল আজকে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি দিন তার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনেই ভোগ করে যাচ্ছে, সম্ভবত নিজেদের অজান্তেই। গণিত ও বিজ্ঞানের এই নিত্যব্যবহৃত শাখাটি পরবর্তীকালের গুণিজন দ্বারা আরো অনেক শাখা প্রশাখায় বিস্তারিত হয়েছে, পল্লবিত হয়েছে নানা বিচিত্র বর্ণশোভায়। ক্যালকুলাস আর ক্যালকুলাস থাকে না কেবল, উন্নততর ও জটিলতর এনালিসিস তত্বে পরিণত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জর্জ ক্যান্টরের নব আবিষ্কৃত ‘সেট’ থিওরির উদ্দীপনাতে নতুন প্রাণসঞ্চার হয় এই এনালিসিস শাস্ত্রের গোড়াতেএবং এই নতুন প্রেরণার প্রধান প্রবক্তা হয়ে দেখা দেন যে তিনজন তরুণ ধীমান পুরুষ, তাঁরাই হলেন আমার পূর্বোল্লিখিত প্যারিস-কেন্দ্রিক গাণিতিকত্রয়ঃ এমিল বোরেল, রেনে-লুই বেয়ার ও আনরি লেবেগ। এঁদের অসাধারণ মৌলিক চিন্তাভাবনাপুষ্ট কাজের প্রভাব পুরো একশ’ বছর ধরেই পরিলক্ষিত হয়ে চলেছে আধুনিক গণিতের বিভিন্ন শাখাতে।
এ তিনজনের জন্ম ফ্রান্সের ভিন্ন ভিন্ন জায়গাতে, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে। এমিল বোরেল জন্মগ্রহণ করেন দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের একটি ছোট্ট গ্রামের পাহাড়ি পথের উঁচুনিচু দৃশ্যমালায় লালিত সবুজ শ্যামলিমায়, যার মায়া তাঁকে জীবনভর সেখানে টেনেছে বারবার। তাঁর বাবা ছিলেন চার্চের পাদ্রী, এবং সেই চার্চসংলগ্ন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। শিশুকাল থেকেই বোরেলের অসামান্য ধীশক্তির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল। সেই ধীশক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটে যখন তিনি প্যারিসের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইকোল নরমাল সুপেরিওর, সংক্ষেপে ই-এন-এস’এতে ভর্তি হন, আঠারো বছর বয়সে। পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন প্রফেসার ডারবো’র অবেক্ষণে, সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেসময় প্যারিস ছিল ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র---জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্পকলার যাবতীয় শাখাপ্রশাখার মুখ্য লালক-বাহক, অত্যাধুনিক সব ধ্যানধারণার উৎসমূল যেন ওই শহরেই কেমন করে খুঁজে পেত তার পুষ্টিসার। গণিতের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এমিল বোরেল একজন বড়মাপের গাণিতিকই ছিলেন না কেবল, প্যারিসের সৌখিন মহলে কিভাবে চলাফেরা করতে হয় তা’ও তিনি ভালো করেই আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন, প্রধানত তাঁর রূপসী স্ত্রী মারগারিটা ও তাঁর প্রভাবশীল শ্বশুর, গণিতের বিখ্যাত অধ্যাপক, পল আপেলের সাহায্যে। বোরেল নিজেও যে সৌখিন জীবনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না তা নয়। গণিত ছাড়াও চারুকলা, সঙ্গীত, শিল্পসাহিত্য, এসবের প্রতিও আগ্রহ কম ছিল না তাঁর। ফলে তিনি যখন পদোন্নতির দ্রুত সোপান বেয়ে গণিতজগতের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে পৌঁছুতে সক্ষম হন, এবং তার ফলপ্রসূতে প্যারিসের অভিজাত পাড়াতে বিরাট বাসা ভাড়া করে বড় বড় পার্টির আয়োজন করে দেশের হোমরা চোমরা ব্যক্তিবর্গের সাথে উঠাবসা করার সামর্থ্যলাভ করেন, তখন তাঁর বাড়িটি ক্রমেই হয়ে ওঠে প্যারিসের উর্ধস্থানীয় বুদ্ধিজীবী মহলের একটি পরম আকর্ষণীয় কেন্দ্র। স্বয়ং মেরি কুরি, হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত নোবেলবিজয়ী মাদাম কুরি, যাঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন এক শোচনীয় দুর্ঘটনাতে, তিনি একবার আশ্রয় নিয়েছিলেন বোরেল আরমার্গারিটার বাড়িতে। কথিত আছে যে সেসময় মাদাম কুরি সম্বন্ধে নানারকম গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল প্যারিসের গুজব-কারখানাতে যে তাঁর সঙ্গে পল লঞ্জেভো নামক এক নামকরা বিবাহিত পদার্থবিদের কিছু একটা ফস্টিনস্টি জাতীয় ব্যাপার চলছে। তাঁর সঙ্গে মার্গারিটার গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, সে সুবাদেই বন্ধুর বাসায় গিয়ে সমাজের কুৎসা থেকে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা।
 এমিল বোরেলের সঙ্গে লেবেগ আর বেয়ারের সাক্ষাৎ ক্লাসরুমে----এঁদের দুজনই ছিলেন তাঁর ছাত্র। স্বভাবতই তাঁর সেরা ছাত্রদেরও সেরা ছিলেন এদুজন। কালে কালে এঁরা ছাত্র-শিক্ষকের পর্দা ছাড়িয়ে বন্ধুর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে সেট থিওরির প্রতি তাঁদের তিনজনেরই প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে যাবার পর। পরবর্তীকালে বোরেল সাহেবের খানিক মোহভঙ্গ হলেও গবেষণা জীবনের প্রথমদিকে তো রীতিমত একটা রোমান্টিক আকর্ষণই তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেট থিওরিতে। তাঁর নিজের ভাষাতেইঃ
 “ অনেক তরুণ গাণিতিকের মত, সেসময় আমিও দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম ক্যান্টরিয়ান থিওরির প্রতি। আজকে (এই পরিণত বয়সে)আমি প্রথম যৌবনের সেই প্রেমময় মোহাচ্ছন্নতাকে মোটেও ছোট করে দেখছি না। বরং সেসময়কার মানসিক দ্বারোন্মোচনের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল তার”।
 বোরেল সাহেবের মত অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্মনোর ভাগ্য ছিল না লেবেগ বা বেয়ারের। লেবেগের বাবা কাজ করতেন প্যরিসের বাইরে কোনও এক স্থানীয় ছাপাখানায়----মেধাবী ছেলেকে প্যারিসের কোনও নামিদামি স্কুলে পাঠিয়ে লেখাপড়া করাবেন সে সামর্থ্য তাঁর ছিল না। সেই বাবাটিও টুপ করে মারা গেলেন ছেলের বয়স যখন মাত্র তিন। তখন তাঁর মা অন্যের কাপড় শেলাই করে যৎসামান্য যা উপার্জন করতেন তাই দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালিয়ে যেতেন। রেনে-লুই বেয়ারের তো আরো দুর্দশা----তাঁর বাবা নিজেই ছিলেন দর্জি, ভাইবোন ছিল বেশ কজন। ভালো থাকাখাওয়ার ভাগ্য বেচারির সারা জীবনেও ঘটেনি কোনদিন। তার ওপর ১৪ বছর বয়স থেকে এমন এক শক্ত পেটের অসুখ ধরে বসল তাঁকে যে সেই অসুখ থেকে প্রায় কখনোই তিনি ছাড়া পাননি। পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবেই হোক আর যে কারণেই হোক বেয়ারের শরীরটা ছিল রোগা পটকা কাঠির মত----লম্বা, কিন্তু বেতের মত নাজুক। ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ না করাটা যদি দুর্ভাগ্য হয়ে থাকে তাঁর বা আনরি লেবেগের, তাহলে একই সাথে তাঁদের হাজার সৌভাগ্য যে তাঁরা ফ্রান্স নামক একটি অত্যাধুনিক উন্নত দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ওই সময়টিতে ফ্রান্স ছিল বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিন্তাধারার অগ্রদূত, ইহজাগতিক ধ্যানধারণাতে উদ্বুদ্ধ একটি সুস্থ প্রগতিশীল, মানবতাবাদী সমাজ গড়ে তোলার ব্রতে দীক্ষিত। তাঁদের জাতিগঠনের মূল মন্ত্র ছিলঃ প্রথমত খাদ্য, দ্বিতীয়ত শিক্ষা। মানে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা। এবং সেই শিক্ষালাভের পথে কোনক্রমেই আর্থিক অনটনকে অন্তরায় হতে দেওয়া হবে না। যেখানে সামান্য মেধার আভাষ পেতেন কর্তৃপক্ষ সেখানেই তাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। বড় মাপের মেধা হলে তো কথাই নেই। বাবামার সামর্থ্য থাক বা না থাক রাষ্ট্রই তাদের তুলে নিতেন আদর করে, সর্বোচ্চ মানের স্কুলকলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হত তাদের যাতে তারা দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে সাফল্যের পথে, পূর্ণ বিকাশের পথে, সৃজনশীলতার পথে। এই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাটুকু ছিল বলেই ফ্রান্স বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রায় সর্ববিষয়েই ছিল পৃথিবীর সেরা দেশ। আধুনিক গণিতশাস্ত্রের এদুটি ক্ষণজন্মা পুরুষ, লেবেগ ও বেয়ার, তাঁদের অসামান্য মেধা শতবর্ণে প্রস্ফুটিত করতে  পেরেছিলেন কারণ রাষ্ট্রচালিত সকল প্রতিষ্ঠান থেকেই তাঁরা পেয়েছিলেন পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা।
 বোরেল, লেবেগ ও বেয়ার----ঊনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে গণিতশাস্ত্রের একটি মৌলিক শাখাতে সাড়া জাগানো এই তিন মহারথি প্রায় একই সময়ে, একই প্রতিষ্ঠানে এসে মিলিত হয়ে একে অন্যের সংগে একটা গভীর পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্কে পৌঁছে গেলেও তাঁদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যতে বিভেদও ছিল প্রচুর। এমিল বোরেল ছিলেন ভীষণ দেশপ্রেমিক মানুষ, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শাসনতন্ত্রের ওপর অন্ধভাবে আস্থাবান, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে একটু ডানপন্থীই বলা যায়। মানুষ হিসেবে খুব উদারপ্রকৃতির, বন্ধুবৎসল, হাসিখুশি ও সহজ সারল্যময়। ওদিকে লেবেগ ছিলেন একটু চঞ্চল প্রকৃতির, পেটে সারাক্ষণ দুষ্টুমি বুদ্ধি, মানুষকে অপ্রস্তুত করে দেয়া সময়ে-অসময়ে, চমকে দেওয়া যখন তখন, ওরকম কতগুলো ছেলেমানসি স্বভাব তাঁর ছিল। বোরেলের স্ত্রী একবার মন্তব্য করেছিলেন লেবেগ সম্বন্ধেঃ “ লোকটার সেই লাল মোছের আড়ালে সবসময়ই যেন একটা কুটিল হাসি”। ওটা কি একধরণের আত্মম্ভরিতা? অন্যদের একটু অবজ্ঞার চোখে দেখা? নাকি কেবলই তাঁর প্রখর ধীশক্তিজাত প্রবল আত্মবিশ্বাস? রাজনৈতিক চিন্তাধারাতে আনরি লেবেগ ছিলেন পুরোপুরি বামপন্থী, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানাদির প্রতি দারুণ সন্দিহান---সুতরাং এ জায়গাটিতে বোরেলের সঙ্গে তাঁর একটা মৌলিক বিরোধ ছিল বটে।
 বোরেল আর লেবেগের তুলনায় বেয়ার সাহেব ছিলেন একেবারেই নিরীহ প্রকৃতির একটি ভালোমানুষ। একেতো গরিব পরিবারের ছেলে, তার ওপর ছোটকাল থেকেই স্বাস্থ্যসমস্যা। এত যে মেধা লোকটার, এত যে মৌলিকত্ব তাঁর চিন্তায় কাজে, তবু যেন ব্যক্তিত্বের দিক থেকে কোথায় একটু আত্মবিশ্বাসের অভাব। লেবেগকে দেখে যদি কারো মনে হত একটু অতিরিক্ত দেমাগী, বেয়ারকে দেখে নিশ্চয়ই মনে হত একটু অতিরিক্ত বিনয়ী। অন্য দুজনের মত লোকজন নিয়ে হৈহল্লা করার প্রবৃত্তি তাঁর একেবারেই ছিল না। নিজের ঘরে আপনমনে গবেষণা করে যাওয়া, ব্যস, এর বেশি তাঁর যেন কোনও চাহিদাই ছিল না।
 এঁদের তিনজনের মাঝে বয়সের ব্যবধান মাত্র তিন কি চার বছর হলেও লেবেগ আর বেয়ার দুজনই ছিলেন বোরেল সাহেবের ছাত্র, এবং দুজনই ভীষণ সম্মান করতেন তাঁদের শিক্ষককে, তাঁর অধ্যাপনার ভংগি, তাঁর অসামান্য জ্ঞান, নিজের বিশেষত্বের ওপর আশ্চর্য দখল, সবকিছুই তাঁদের জন্য ছিল খুবই প্রেরণাদায়ক। বোরেলের কাছ থেকে তাঁরা প্রধানত শিখেছিলেন ‘সেট থিওরি’ আর ‘মেজার থিওরি’। দুটিতেই তিনি ছিলেন একজন বিশ্বমাপের বিশেষজ্ঞ। ‘মেজার’ বলতে গণিতশাস্ত্রে  কি বুঝায় তার একটা ভাসাভাসা ধারণা দেওয়া যায় এভাবেঃ ‘মেজার’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল পরিমাপ। যেমন দৈর্ঘ, ক্ষেত্রফল, ঘনফল, ইত্যাদি। একটা জায়গার তাপ, বায়ুচাপ, এগুলোও পরমাপনীয়। এর সঙ্গে জ্যামিতির একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে, আবার কলনশাস্ত্র, এনালিসিস আর বীজগণিতেরও আছে। বর্তমান যুগের গণিতে ‘মেজার থিওরি’ আপন শক্তিতেই একটি স্বতন্ত্র শাখায় পরিণত হয়েছে। এবং এর সর্বাধিক প্রয়োগশীলতা বোধ হয় আধুনিক ‘সম্ভাবনা তত্ব’তেই (Probability Theory)
 কলন আর এনালিসিস, উভয় শাখারই একটি মৌলিক উপকরণ হলঃ ফাংশান। ফাংশান কাকে বলে সেটা এযুগের হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছালেমেয়েরাও শিখতে শুরু করে। গণিতের বাইরেও এর বিস্তর প্রয়োগ---অর্থনীতি, বাণিজ্য, প্রকৌশল, শূন্যভ্রমণ, বলতে গেলে সর্বত্র। যেমন ধরুণ শ্রমমূল্য বেড়ে গেলে দ্রব্যমূল্যও বেড়ে যায় সে অনুপাতে। এখানে দ্রব্যমূল্যকে শ্রমমূল্যের একটি ফাংশান ধরা যায়। একটি ভৌগোলিক এলাকার আবহাওয়া নির্ভর করে তাপ বায়ুচাপ ও বায়ুর ঘনত্বের ওপর। অতএব আবহাওয়া হল তাপ-চাপ আর ঘনত্বের একটি ফাংশান। আমরা এখানে যে ‘মেজার’ এর কথা বলছি সেটা গাণিতিক মেজার, যা স্বভাবতই একটু জটিল, এবং বিবিধ শর্তযুক্তি দ্বারা সংযুক্ত
 কথা হলঃ ‘ফাংশান’ জিনিসিটার ‘গণিতসম্মত’ সংজ্ঞা কি। ‘গণিতসম্মত’ বলতেই বা কি বুঝায়? আগেকার যুগে, আইজ্যাক নিউটন থেকে লিওনার্ড অয়লার (১৭০৭-১৭৮৩) থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ফাংশান বলতে বোঝাত যা সহজ সুন্দর, মসৃণ, কোনরকম ফাঁকফোকড় নেই, আকস্মিক চড়াই-উতরাই নেই, ভাঙ্গাচোরা নেই, এরকম সুবোধ সুশীল সব ফাংশান----যেমন ঢেউখেলানো ত্রিকোনমিতিক ফাংশান, বা বৃত্ত, পরাবৃত্ত, ইত্যাদি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশলী প্রয়োগশাস্ত্রে সব ফাংশানই সমান ভদ্র নম্র নয়। লেবেগ আর বেয়ার ছিলেন এসব বেয়াড়া প্রকৃতির ফাংশান নিয়েই মগ্ন। এবং প্রকারান্তরে বোরেল সাহেবও। কত প্রকারের ফাংশান হতে পারে? ক্যান্টর যেমন তাঁর সেট থিওরির সাহায্যে অসীম সংখ্যার অসীম সংখ্যক শ্রেণী আবিষ্কার করেছিলেন, অনুরূপভাবে কি ফাংশানকেও শ্রেণীবদ্ধ করা যাবে সেট থিওরি ব্যবহার করে? এই জিজ্ঞাসারই অন্তিম ফসল হয়ে দেখা দেয় বেয়ারের তথাকথিত ‘ক্যাটেগরি থিওরি’,  লেবেগের ‘লেবেগ ইন্টিগ্রেল’ আর বোরেলের বোরেল-পরিমাপনীয় মেজার। এগুলোর সবকটিই দারুণ প্রয়োগশীল বলে প্রমাণিত হয় পরবর্তীতে। তবে ফাংশানের শ্রেণীকরণ নিয়ে সেট থিওরি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা, বিশেষ করে তাদের ‘ নামকরণ’এর বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন আনরি লেবেগ। তাঁর নিজের ভাষাতেঃ “... একটা নতুন জিনিস তার অস্তিত্বের ন্যায়সম্মত প্রতিষ্ঠা অর্জন করে যখন তার কোন একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ করে একটা ‘নাম’ বাছাই করা হয়”। অর্থাৎ ‘নামকরণ’ই তার বৈধকরণ। এখানে তাঁর সুরের সাথে হুবহু খাপ খেয়ে যায় জর্জ ক্যান্টরের ধ্যানধারণা। ক্যান্টর তাঁর অসীমের নামকরণ করতে গিয়ে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, ওদিকে লেবেগও তাঁর ফাংশানসমূহের নাম খুঁজতে গিয়ে হাজারো রকম ধাঁধায় পড়ে আধপাগল হবার উপক্রম হয়েছিলেন। নামকরণের সঙ্গে যে একটা আধিভৌতিক বিষয়ের সম্পর্ক থাকতে পারে সেসম্বন্ধে বেশ সচেতন ছিলেন লেবেগসাহেব, যেকারণে পরবর্তী কালে রুশ গাণিতিকদের সাথে তাঁর একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেগ পেতে হয়নি। এই প্রক্রিয়াতে বেয়ার নিজেও জড়িয়ে পড়েছিলেন, তবে বোরেল সাহেব প্রথমদিকে আকৃষ্ট হলেও পরে ‘নাম’ এর মোহ থেকে খানিক দূরত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন।
 যাই হোক, প্যারিসের গণিত জগতে যখন এইসব তর্কবিতর্ক জোরদার হয়ে উঠছে, ঠিক সেই সময় বোরেলের ছাত্র হয়ে আসেন রাশিয়ার মেধাবী গণিতবিদ, নিকোলাই লুজিন। এবং যেহেতু রাশিয়াতে থাকাকালেই, এগরভ ও ফ্লোরেন্সকির প্রভাবে সেট থিওরি আর ধর্মীয় নামপূজারিদের মাঝে একটা সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন, সেহেতু প্যারিসের বিতর্কতে তিনি নিজেরই একটি প্রিয় বিষয়ের পুনরাবির্ভাব দেখতে পেয়ে বেশ উৎসাহিত বোধ করেন। তিন ফরাসীর সাথে যোগ দেন একজন তরুণ রাশিয়ান সেটবাদী লোক।
 সেট থিওরিতে আপাতদৃষ্টিতে কোনও উগ্র বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলার মত বিষয়াদি আছে বলে মনে হয়না। হাজার হলেও এতো অঙ্ক ছাড়া কিছু নয়। এতে গবেষণা করার ফলে কারুর মনোবিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা দাঁড়াতে পারে সেটা কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়, তাই না? কিন্তু আশ্চর্য, তাই হয়েছিল কয়েকবার, অন্তত সেসময়। এ বিষয়টিতে কতগুলো ধাঁধা আছে যাতে দাঁত বসানো প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। যেমন প্রাকৃতিক সংখ্যামালা আর বাস্তব সংখ্যামালা (Real Numbers) এদুয়ের মাঝে এমন কোনও অসীমসংখ্যক রাশি আছে কিনা যা এদুটি থেকেই ভিন্নপ্রকার ‘অসীম’? ভাববেন, এ আবার প্রশ্ন হল নাকি। কেউ কেউ হয়ত রসিকতা করে বলবেন তাতে কার কি আসে যায়? অসীম তো অসীমই---তার প্রকার থাকলেই বা কি না থাকলেই বা কি। না, বিশুদ্ধ গণিত নিয়ে যাদের জীবন তাদের জন্যে এ এক গুরুতর সমস্যা। গাণিতিকদের ধারণা, না, এদুয়ের মাঝে কোনও আলাদা রকমের ‘অসীম’ নাই। একে সহজ ভাষায় বলা হয়ঃ ‘কন্টিনিউয়াম হাইপোথেসিস’। ভীষণ শক্ত প্রশ্ন। এর ওপর কাজ করতে গিয়ে অনেকেই হাবুডুবু খেয়েছেন----ছোটবড় সবরকম গাণিতিকই। প্রশ্নটা তেমন কঠিন মনে না হলে চেষ্টা করে দেখুন। আপনার আয়ু ফুরিয়ে যাবে, আপনি পাগল হয়ে যাবেন, কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে যাবে।
 সেট থিওরির চৌম্বিক আকর্ষণটি বিশেষভাবে টেনে নেয় অল্পবিস্তর ইউরোপের অনেক গাণিতিককেই, কিন্তু সবচেয়ে বেশি টানে ফরাসী আর রাশিয়ানদের। রাশিয়ানদের আকর্ষণ শুধু অঙ্ক নয়, এর সঙ্গে একটু অতীন্দ্রিয়বাদ, একটু আধিভৌতিকতা বা আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ। ওদিকে ফরাসীরা ওসব রহস্য-ফহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর ব্যাপারে নেই। তাঁরা দেখেন কোথায় এর প্রয়োগশীলতা-----বাস্তব জীবনে একে কাজে লাগানো যাবে কোথায়। সেকারণে সেট থিওরির নানা প্রশ্ন ধাঁধা তাঁদের বৌদ্ধিকভাবে আকৃষ্ট করলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার পর্যায়ে পৌঁছানোর প্রশ্ন দাঁড়ায়নি। ফরাসী জাতি এমনিতেই যুক্তিবাদে বিশ্বাসী, আধিভৌতিকতাতে তাঁদের আস্থা নেই বললেই চলে। অতএব সেট থিওরি রাশিয়ানদের ওপর যেরকম প্রভাব বিস্তার কিরেছিল ঠিক সেরকম প্রভাব ফরাসীদের বেলায় ঘটেনি।
 তথাপি সেট থিওরি এবং তৎসঙ্ক্রান্ত প্রশ্নাদি নিয়ে মগ্ন থাকার একটা ছাপ থেকে পুরোপুরি ছাড়া পাওয়া সম্ভব হয়নি বোরেল-বেয়ার-লেবেগ কারুরই। পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে তিনজনই একটু-আধটু ঘা খেয়েছেন এর দ্বারা। লেবেগের খিটখিটে মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয়েছে। লোকজনের সঙ্গে কেবলই ঝগড়া বাঁধাতেন তিনি----পরম বন্ধু বোরেল আর বেয়ারও ব্যতিক্রম ছিলেন না তার। ওদিকে বোরেল সাহেব তো একসময় অঙ্কই ছেড়ে দেবার উপক্রম। সৌভাগ্যবশত গণিতের বাইরেও নানাদিকে তাঁর আগ্রহ ছিলঃ সঙ্গীত, নাটক, জীববিজ্ঞান। উপরন্তু তাঁর ছিল একটি সুখি দাম্পত্য জীবন----দুটিতে মিলে যখন তখন তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেন, এমনকি ক্ষেতখামারের প্রতিও তাঁর উৎসাহ কম ছিল না। সুতরাং তাঁর জীবন ছিল নানা রঙের বৈচিত্র্য দিয়ে পূর্ণ। সমস্যা ছিল বেচারি বেয়ার সাহেবের। একেতো দুর্বল স্বাস্থ্য, তার ওপর লাজুক নিভৃতচারি প্রকৃতির মানুষ। জীবনে মনের মত কোনও সঙ্গী জোটেনি, ভালো কোনও বন্ধুও ছিল না তাঁর, তার ওপর লেবেগের সঙ্গে অনর্থক একটা ঝগড়া বেঁধে যাওয়াসব মিলিয়ে দারুণ একটা মানসিক সঙ্কটাবস্থা এসে গিয়েছিল তাঁর জীবনে। একা একা শুয়ে থাকতেন একটা সস্তা হোটেলে। শেষে একদিন বোধ হয় আর বইতে পারলেন না জীবনের বোঝা----সাংজ্ঞ করে দিলেন সব দুঃখকষ্ট। সে এক মর্মান্তিক পরিণতি বিংশ শতাব্দীর এক শীর্ষস্থানীয় গাণিতিক প্রতিভার।

পাঁচ
 ঊনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে, বিশুদ্ধ গণিতের জগতে, অগ্রনায়কের ভূমিকাতে ছিলেন ফ্রান্সের প্যারিসকেন্দ্রিক গাণিতিকরা, আর ছিলেন জার্মানীর গেটেঞ্জেন ও বার্লিনভিত্তিক গণিতগোষ্ঠী। তাঁদের দিকনির্দেশেই গণিতের গতিপথ নির্ধারিত হত বহুলাংশে। সেই গতিপথ নির্ধারণের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ছিলেন পূর্ব অধ্যায়ের তিন তারকা----বোরেল-বেয়ার-লেবেগ। ব্যক্তিগত জীবনের পটভূমি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যতে সম্পূর্ণ পৃথক হয়েও তাঁদের প্রখর ধীশক্তি, তাঁদের বিষয়নির্বাচনের সামঞ্জস্য, এবং সেযুগের বৌদ্ধিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে, তাঁদের জীবন একই সাথে গ্রন্থিত হয়ে পড়েছিল, এবং সেই সমসূত্রে বাঁধা পথের ওপর তাঁরা একটা বড় পদচিহ্ন রেখে যেতে পেরেছিলেন। অনেকটা সেভাবেই রাশিয়ার মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় আর সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আরো একটি গাণিতিক আন্দোলন, এবং প্রায় একই সময়তে, যার অগ্রভাগে ছিলেন, প্যারিসেরই মত, তিন মূর্তিঃ এগরভ, ফ্লোরেন্সকি ও লুজিন।এঁদের মাঝে কে কার চেয়ে বেশি মেধাবি ছিলেন তার বিচার হয়ত সম্ভব নয়, তার প্রয়োজনই বা কি। তাঁরা তিনজনই অক্ষয় ছাপ রেখে গেছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে। আধুনিক গণিতের প্রায় সব স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্রদেরইপরিচিত হতে হয় তিনটি নামের সঙ্গে, কোন-না-কোন সময়। প্যারিসের তিন গাণিতিকের মত তাঁরাও ছিলেন মনমেজাজ আর চিন্তাভাবনার দিক থেকে স্বতন্ত্র ধারার ব্যক্তিত্ব, অথচ পেশাগতভাবে একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্যারিসের তিনজন ছিলেন একদিকে পরস্পরের বন্ধু, অপরদিকে ছিলেন ছাত্র-অধ্যাপকের উঁচুনিচু সম্পর্কতে বাঁধা, অনুরূপভাবে রাশিয়াতেও তিনজন গভীর বন্ধুত্ববন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন বটে, তবে এগরভ ছিলেন অন্য দুজনের অধ্যাপক, জীবনের একটা সময়তে। কিন্তু দুই গ্রুপের মধ্যে গাণিতিক আর ব্যক্তিগত সাদৃশ্য যতই থাক, চিন্তাচেতনার দিক থেকে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফ্রান্স আর জার্মানীতে যেমন ছিলঃ অঙ্ক কেবল অঙ্কেরই জন্য, বৌদ্ধিক সৌন্দর্যের সাধনাই সাধকের প্রধান লক্ষ, এবং তার মুখ্য বাহক হল যুক্তি ও প্রমাণ, রাশিয়ার বেলাতে ঠিক তা নয়। সেখানে অঙ্কই নয় কেবল, জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাই একে অন্যের সাথে সংযুক্ত তাদের আভ্যন্তরীন দার্শনিক, সামাজিক ও ধর্মীয় যোগসূত্র দ্বারা। বুদ্ধিভিত্তিক সকল কর্মকাণ্ডতেই থাকতে হবে একটি ‘মহৎ’ উদ্দেশ্য।



দিমিত্রি এগরভ 

 এ তিন গাণিতিকই ছিলেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কবিভাগ থেকে পাস-করা ছাত্র। এবং তিনজনই ক্লাস নিয়েছিলেন তখনকার এক বিশিষ্ট অধ্যাপক, নিকোলাই বুগায়েভে (১৮৩৭-১৯০৩) এর কাছ থেকে। বুগায়েভের যৌবনকালে ‘সেট থিওরি’ নামক কোন জিনিসের জন্মই হয়নি, তথাপি তিনি আকৃষ্ট ছিলেন নামপূজারিদের প্রতি, কারণ তাঁর মতানুসারে ওদের নামসংস্কৃতির সঙ্গে গণিতের একটা সম্পর্ক আছে। গণিতের যে-বিষয়টির প্রতি তাঁর একটা বিশেষ মোহ ছিল সেটা হল Discontinuous Functions, বা ছেদপূর্ণ ফাংশান। যেমন একটা রেখা বা ক্ষেত্র যাতে ভাঙ্গাচোরা আছে, ফাঁকফোকড় আছে, হঠাৎ হঠাৎ লম্ফঝম্ফ করার ব্যাপার আছে। এগুলোকে তিনি মানবচিত্তের স্বাভাবিক মুক্তিকামনার সঙ্গে তুলনা করতেন। ‘ডিসকন্টিনুয়াস ফাংশান’ ছিল, তাঁর বিচারে, মানুষের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ প্রকাশেরই এক বিকল্প পন্থাওদিকে ইউরোপের যুক্তিবাদী গণিতজ্ঞরা একে দেখতেন একপ্রকার বিভীষিকা হিসেবেচার্লস হার্মিট নামক ফরাসী গণিতের এক বিশাল ব্যক্তিত্ব এর নাম দিয়েছিলেন, ‘দানব’---মন্সটারজ্ঞানের সঙ্গে মানবজীবনের সূক্ষ্মতর বিষয়াদির একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে, বা থাকা উচিত, এই মন্ত্রে যারা বিশ্বাসী, তাদের কাছে গণিতের ‘ডিসকন্টিনুয়াস’ ফাংশানের মত একটি অস্বাভাবিক বস্তুকে স্বাধীনতা কামনার অভিব্যক্তি বলে মনে হবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেইযে ফাংশান কোন নিয়মকানুনের বাধা মানে না, যা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যখন খুশি তখনই লম্ফঝম্ফ শুরু করে দেবে, তাকে মুক্ত বিহংগের মত করে কল্পনা করা তো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।
 অধ্যাপক বুগায়েভের ছাত্রদের মাঝে যে-মানুষটি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর ডিসকন্টিনুয়াস ফাংশানের প্রতি তিনি হলেন প্যাভেল ফ্লোরেন্সকি। এর সঙ্গে তিনি একটা ধর্মীয় সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশেষ করে নামপূজানামপূজারিরা যেমন একটা নাম বারবার জপ করে তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন, অনুরূপভাবে তাঁর কাছে মনে হল ডিসপকন্টিনুয়াস ফাংশানের নতুন একটা নাম চয়ন করে সেটা অসংখ্যবার উচ্চারণ করে গেলেও তো তার একটা বাস্তবতা তৈরি হয়ে যায়। ছাত্রাবস্থাতেই ফ্লোরেন্সকি এসব বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করতেন, এবং সেনিয়ে দুচারটে গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছিলেন। ওদিকে এগরভ সাহেব ছিলেন একজন পরম ধার্মিক মানুষ। নিয়মিত চার্চে যেতেন। সম্রাট জারের প্রতি তাঁর অন্ধ আনুগত্য। ব্যক্তিগত স্বভাবের দিক থেকে একটু গম্ভীর প্রকৃতিরনম্র, ভদ্র, অমায়িক, বন্ধুবৎসল। নিজের দৃষ্টিভিঙ্গী খুব রক্ষণশীল হলেও জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিকতাবাদী। নিজের লাইনে খোঁজখবর রাখতেন কোথায় কি নতুন আইডিয়া নিয়ে আসছেন কে বা কারাইউরোপের তরুণ সেট-গবেষকদের প্রতি দারুণ আকর্ষণ ছিল তাঁর। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আধুনিক গণিতের লীলাক্ষেত্র রাশিয়াতে নয়, ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্স আর জার্মানিতে। সুতরাং উচ্চমানের আধুনিক গণিত শিখতে হলে সেখানেই যেতে হবে। তিনি নিজে গিয়েছিলেন প্রথমে জার্মানির বার্লিনে, গেটিঞ্জেনে, পরে প্যারিসের গাণিতিক মহলেও ঘোরাফেরা করেছেন কিছুদিন। সেট থিওরি আর ফাংশানতত্বের ফরাসী কর্ণধার বোরেল-বেয়ার-লেবেগ গ্রুপের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করে নেন। তাঁর নিজের গবেষণার মানও কোন অংশেই কম নয় কারো চেয়ে---- স্নাতকশ্রেণীর কোন কোন পাঠ্যপুস্তকে তাঁর কাজের উল্লেখ আছে।
 রুশ ত্রিরত্নের তৃতীয়জন হলেন নিকোলাই লুজিন। সম্ভবত সবচেয়ে মেধাবীও। মজার ব্যাপার হল যে ছোটবেলায় গণিতের প্রতি তাঁর কোনরকম আগ্রহ প্রকাশ পায়নি। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষাতে সবচেয়ে কম নম্বর তিনি পেতেন অঙ্কতেই। একেবারেই মন বসত না তাঁর অঙ্কের বইতে। বরং তাঁর আগ্রহ ছিল কবিতায়, দর্শনশাস্ত্র আর সাহিত্যে। সারাক্ষণ কবিতা আর দর্শন নিয়েই ডুবে থাকতেন। তাঁর বাবা ছেলের মতিগতি দেখে ভাবলেন, এছেলে তো ভবিষ্যতে নিজের চেষ্টাতে কিছু করেকেটে খেতে পারবে না। কিছু একটা করা দরকার। একজন ভালো গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে দিলেন ওর অঙ্কের জন্যে। শিক্ষকটি সত্যি সত্যি একটু ভিন্ন ছাঁচের লোক ছিলেন। গণিতশিক্ষার গতানুগতিক পদ্ধতি, অর্থাৎ মুখস্থ করা আর ফর্মুলা মনে রাখা, এর ওপর নির্ভর না করে গণিতের আভ্যন্তরীন সৌন্দর্যটুকু, তার অন্তঃসারটুকু, ছাত্রের সামনে তুলে ধরে তার কৌতূহলী মনে আকর্ষণ তৈরি করার চেষ্টা করেন। এবং তাতে কাজ হলঃ আশাতীত কাজ। অল্প সময়ের ভেতরই লুজিন দারুণ মজা পেতে শুরু করলেন অঙ্কতে। তখন আর তাঁকে থামায় কে। তিনি তাঁর শিক্ষককে ছাড়িয়ে, তাঁর স্কুলের যাবতীয় শিক্ষককে ছাড়িয়ে, এমনকি কিছু কলেজের অধ্যাপককেও ছাড়িয়ে, দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকলেন। এভাবেই তিনি একসময় মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান, এবং এগরভ-ফ্লোরেন্সকি, এঁদের সংস্পর্শে আসেন। কিন্তু চিন্তাভাবনার দিক থেকে তখনো তিনি পুরোপুরি বামপন্থী, ঘোর জারবিরোধী, ধর্মকর্ম সম্বন্ধে একেবারেই উদাসীন, বরং রীতিমত নাস্তিক মনোভাবাপন্ন।
 অঙ্ক শেখার জন্য মস্কোতে এলেও এমন কোনও উচ্চাকাঙ্খা ছিল না লুজিনের যে সারাজীবন অঙ্কের জগতেই ডুবে থাকবেন। বরং তাঁর ধারণা ছিল কোনরকমে ডিগ্রিটা শেষ হলেই ইঞ্জিনিয়ারিঙ্গে ঢুকে যাবেন----পেশাজীবনটা প্রকৌশলী হিসেবেই আরাম আয়েসে কাটবে। কিন্তু ভর্তি হবার পর দুচারজন ভাল ভাল অধ্যাপকের সংস্পর্শে এসে তাঁর মন আবার কাত হতে থাকলো অঙ্কের প্রতি। বিশেষ করে অধ্যাপক বুগায়েভ আর এগরম যখন লুজিনকে শোনাতে থাকলেন সব

নিকোলাই লুজিন
চাঞ্চল্যকর গল্প ইউরোপের গণিতের জগতে কি হচ্ছে না হচ্ছে, সেট থিওরি, নাম্বার থিওরি আর অসীমতত্বের অন্তহীন রহস্যভরা মায়াবী বিশ্বের কি কুহকিনী রূপ। লুজিনের কাছে মনে হচ্ছিল যেন রূপকথার কেচ্ছা শুনছেন। তাঁর উৎসুক মন, তাঁর রোমান্টিক কল্পনায় ভরা মন, অনায়াসে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ল সেট আর সংখ্যার জগতে। সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন, এতেই তাঁর মুক্তি, তাঁর আনন্দ। তাঁর প্রাণের তৃষ্ণা নিবৃত্তির এই একমাত্র পন্থা। এখন আর প্রকৌশলের গড্ডালিকা প্রবাহতে নয়, গণিতের উচ্চুঙ্গ শৃঙ্গেতেই তাঁর নিবাস।
 সেসময় তাঁর সমসাময়িক, সহপাঠী, ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে প্রধানত ছিলেন ফ্লোরেন্সকি এবং অধ্যাপক বুগায়েভের ছেলে বিলাই। এঁরা দুজনই পরম ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। ধর্মীয় দর্শন, ইতিহাস, বিশেষ করে ধর্মীয় নামপূজারিদের বিষয়ে ভীষণভাবে আগ্রহী। বিলাই হয়ত ততটা নয় যতটা ছিলেন ফ্লোরেন্সকি। লুজিন নিজে ধর্মকর্মের প্রতি উদাসীন হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের দার্শনিক দিকটিতে তাঁর আগ্রহের কোনও ঘাটতি ছিল না। বুদ্ধিবৃত্তিক যেকোন আলোচনাতেই অংশ নেবার মত উদারমনস্কতা তাঁর অবশ্যই ছিল। সমাজের গতানুগতিক বিশ্বাস, রীতিনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তাধারাতে সংশয়ের অবকাশ ছিল প্রচুরই, কিন্তু ফ্লোরেন্সকি-বিলাইএর সঙ্গে এতটাই ঘনিষ্ঠতা তাঁর, এবং তাঁদের জ্ঞানগরিমা ও বুদ্ধিমত্তার প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাবোধ যে ওঁদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে নিজের যুক্তিতর্ক দিয়ে উড়িয়ে দেবারও ক্ষমতা বা ইচ্ছা তাঁর ছিল না। ধীশক্তির দিকে থেকে বিচার করতে গেলে হয়ত লুজিনের সমকক্ষ কাউকে পাওয়া যেত না সেসময়, কিন্তু ব্যক্তিত্বের দিকে থেকে সম্ভবত লোকটা তাঁর কাছের লোকেদের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়ার একটা প্রবণতা ছিল।
 ১৯০৫ সালে নিকোলাই লুজিনের জীবনে একটা ছোটখাটো সঙ্কট দেখা দেয়। জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে রাজতন্ত্রবিরোধি বিপ্লবী দলগুলো। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হতাহতের সংখ্যা দ্রুত বর্ধমান, উভয়পক্ষেই। চারিদিকে ধ্বংস। সাধারণ মানুষের অন্তহীন দুঃখদুর্দশা, যা তাঁর কাছে নিতান্তই অহেতুক বলে মনে হয়, যা তাঁর স্পর্শকাতর মনকে অনায়াসে বিচলিত করে ফেলে। রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলগুলোর প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন থাকলেও যুদ্ধের ধ্বংসলীলা তাঁকে গভীরভাবে আহত করে। তার ওপর পরাজয়ের গ্লানি----জারের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী অল্প সময়ের ভেতরই বিপ্লবীদের হারিয়ে দিতে সক্ষম হয়। তাতে তরুণ লুজিনের মন আরো ভেঙ্গে যায়। তিনি দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েন। জীবনের সকল উদ্যম উৎসাহ হারিয়ে কেমন মনমরা হয়ে সময় কাটাতে থাকেন। বেঁচে থাকারই কোন যৌক্তিকতা দেখতে পেলেন না একসময়। অবস্থা দেখে তাঁর শুভাকাক্ষীরা সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। লোকটাকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তাঁর নিজেরই মানসিক বিপর্যয়ের কবল থেকে। সৌভাগ্যবশত তাঁর আন্তরিক শুভাকাক্ষীদের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁরই প্রাক্তন অধ্যাপকঃ দিমিত্রি এগরভ। এগরভ সাহেব তাঁর প্রিয় ছাত্রটির অবস্থা দেখে ভাবলেন ওকে বাঁচাবার একমাত্র পন্থা হচ্ছে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা, এমন এক জায়গায় যেখানে তার প্রখর বুদ্ধি নিজেকে উন্মুক্ত ও ব্যাপ্ত করার পথ পাবে, যেখানে সে পাবে তার মনের খোরাক। এগরভের দৃষ্টিতেঃ পৃথিবীতে তখন একটিমাত্র জায়গা যেখানে লুজিন তার বিশাল প্রতিভার ঠাঁই খুঁজে পাবে। সেটি হল প্যারিস, যেখানে পৃথিবীর সেরা গাণিতিকদের বাস, যেখানে সেট থিওরি আর সংখ্যাতত্ব নিয়ে চাঞ্চল্যকর কাজ হয়এগরভের পরামর্শে লুজিন ঠিক তা’ই করলেন। প্যারিসযাত্রাঃ এগরভ নিজেই তাঁর জন্যে একটা ভালো বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন।
 কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে প্যারিসের প্রচণ্ড বুদ্ধিবৃত্তিক আকর্ষণও লুজিনের ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকর হতে পারেনি। বরং যেন উলটো ফল হয়----তিনি আরো বিমর্ষ হয়ে পড়তে থাকেন দিন দিন। তাঁর অন্তরের গভীর নৈরাশ্যবোধ, তাঁর সীমাহীন নিঃসঙ্গতা, তাঁকে ক্রমেই পিষে খেতে থাকে। জীবনের কোনও লক্ষ, কোনওগন্তব্যই তাঁর কাছে অর্থময় মনে হয় না। সেসময় তাঁর একমাত্র আশ্রয় ছিল রাশিয়ার ফেলে আসা বন্ধুদের সঙ্গে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান----প্রধানত পরম বন্ধু ফ্লোরেন্সকির সঙ্গে। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে যত ঘনিষ্ঠতাই হোক, এই একটি বন্ধুকে তিনি বিশেষভাবে ভা্লোবাসতেন। মনের প্রকোষ্ঠে যাঁর সান্নিধ্য কামনা করতেন তিনি সবচেয়ে বেশি, যে তাঁর কথা ও বাণী দিয়ে তাঁর প্রাণে শান্তির প্রলেপ মাখাতে পারেন, সেই লোকটি ছিলেন প্যাভেল ফ্লোরেন্সকি। দুই বন্ধুর পারস্পরিক চিঠিপত্র এখনো অনেক পাঠকের কাছে চিত্তাকর্ষক মনে হবে। এক চিঠিতে লুজিন লিখেছিলেন ফ্লোরেন্সকিকেঃ
“ বেঁচে থাকাটাই যেন এক ভারবহ, কষ্টকর জিনিস হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমার জন্যে। কেন বেঁচে থাকব? জীবনের এই যে অন্ধ বস্তুমুখি আনুগত্য, এই লক্ষবিহীন বন্ধ্যা কাফেলা, এ তো আমার মনের তৃষ্ণা মেটাতে পারছে না, আমার ক্ষুন্নিবৃত্তি হচ্ছে না বিন্দুমাত্র। আগে একসময় আমি বস্তুবাদকেই একমাত্র বাস্তব বলে মনে করতাম, কিন্তু এখন সেই ভ্রান্ত বিশ্বাসের ওপর হেলান দিয়ে আমি যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমি হারিয়ে যাচ্ছি বন্ধু, হারিয়ে যাচ্ছি কোনও অতল গহ্বরে। তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় আমি যখন বালকমাত্র। যখন গণিতের গতানুগতিক ধারাবাহিকতা, তার অবিচ্ছিন্নতার মোহতে আচ্ছন্ন অন্তহীন কলনযোগ্যতা, টেইলার সিরিজ, এসব নিয়ে গড়া এক অলীক বিশ্বের মায়াতে ডুবে থাকা যেত
কিন্তু এখন ঠিক সেগুলোই হয়ে উঠেছে আমার সকল অশান্তির মূল”। তার এক পরের চিঠিতে তিনি আশঙ্কাজনকভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন নিজের “এই অর্থহীন জীবনের অন্তিম অবসান” ঘটানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে।
 বন্ধুর এই চরম সঙ্কটের মুহূর্তে ত্রাতার ভূমিকাতে হাত বাড়িয়ে দেন পুরোহিত-গাণিতিক ফ্লোরেন্সকি। নিজের অতীত স্মৃতির পাতা থেকে দুটি একটি আশ্বাসবাণী চয়ন করে তুলে ধরেন তাঁর সংশয় আর প্রশ্নজর্জরিত প্রিয় বন্ধুটির কাছে ফ্লোরেন্সকি বলেন যে তিনি নিজেও একসময় সংশয় আর অবিশ্বাসের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারপর অন্তরীক্ষ থেকে দৈবদূতের মতই অবতীর্ণ হয় এক পরম শান্তির বাণী----হঠাৎ করেই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ‘সত্য আর সুন্দরের’ আলোকরশ্মি। তিনি খুঁজে পান জীবনের সত্যিকার আনন্দ কোথায়। বস্তুর অন্ধ অন্বেষণে নয়, বস্তুবহির্ভূত বিশ্ববিধাতার চরণতলেসেখানেই মুক্তি, সেখানেই আত্মার পরম আশ্রয়ফ্লোরেন্সকি তাঁর বন্ধুকে উপদেশ দেন সে’ও যেন ঠিক একইভাবে নিজেকে সমর্পন করে দেয় সেই পরমাত্মার কাছে। তিনিই তাঁর অন্তহীন স্নেহে, ভালোবাসায় বরণ করে নেবেন তাঁর পথভ্রষ্ট বিপন্ন সন্তানকে।
 প্যারিসের দুটি নিস্ফলা বৎসর অতিবাহিত করার পর লুজিন দেশে ফিরে যান----সম্ভবত বন্ধু ফ্লোরেন্সকির সান্নিধ্যলাভেরই আকাঙ্খাতে, একটু শান্তি পাবেন সেখানে সে আশায়। ঠিক ঐ সময়তেই ফ্লোরেন্সকির গভীর গবেষণাসমৃদ্ধ অভিসন্দর্ভ “ On Religious Truth”, রুশ ভাষাতে প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে তার ইংরেজি অনুবাদ মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয় “ The Pillar and Foundation of Truth” নামে। সেসময়কার ধর্মবিশ্বাসী সুধীজনদের মাঝে তৎক্ষণাৎ একটা সাড়াজাগানো ঢেউ তুলে দেয় বইটি। লুজিন অবশ্য তার আগেই, অমুদ্রিত আকারেই পড়ে ফেলেছিলেন বইটা। পড়ার পর একপ্রকার মোহাবিষ্ট ভাব নিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেনঃ “আমি ওটা এক রাত্রির মাঝেই, দম বন্ধ রেখে, পড়ে ফেলেছি। এ এক অবিশ্বাস্য বস্তু। আমার সকল বোধশক্তি যেন কেড়ে নিয়েছে, আমি তার জাদুর শেকলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। আমার সকল ব্যাধির পরম বিশল্যকর এক মহৌষধী। আমার সকল জিজ্ঞাসার জবাব এখানে, সকল সংশয়ের মীমাংসা এখানে। আজ আমি মুক্ত মানুষ। আজ আর কোনও সমস্যা নেই আমার”।
 দুবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা এমনই এক নিবিড়তার পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে লোকজনের চোখে অনেকটা অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে। তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেঃ এদের মাঝে কোনও যৌন সম্পর্ক নেই তো? না, আসলে তা ছিল না। ওঁরা দুজনই গতানুগতিক ধারার বিবাহিত পুরুষ, পারিবারিক জীবন পরম সুখের হোক বা না হোক, যৌনতা নিয়ে কোন সমস্যা দুজনের কারুরই ছিল না। কিন্তু ওঁরা দুজনই ছিলেন বিপুল মেধার অধিকারি মানুষ, গণিত এবং দর্শন উভয় বিষয়তেই তাঁদের সমান আগ্রহ, দুজনই তীব্র অনুভূতির মানুষ। তাঁদের একজন ছিলেন আরেকজনের অগ্রজসম----একাধারে বন্ধু, মন্ত্রগুরু, পথপ্রদর্শক। লুজিন ছিলেন মানসিকভাবে পরগাছা লতার মত, দুর্বল, নির্ভরশীল, অপ্রত্যয়ী পুরুষ। ফ্লোরেন্সকি দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আত্মবিশ্বাসী মানুষ, যে লুজিনকে অনুজতুল্য স্নেহমমতায় আশ্রয় দিয়ে তাঁকে জীবনের সকল ঝড়ঝাপটা থেকে আড়াল করে রেখেছেন। আসলে এগরভ-লুজিন-ফ্লোরেন্সকি, এঁদের মাঝে সবচেয়ে শক্ত মনের মানুষ হয়ত তিনিই ছিলেন। তাঁর সেই বইখানা যখন বের হয় প্রকাশকের আঙ্গিনা থেকে তখন তাঁর শিক্ষক এগরভ সাহেবও দারুণ অভিভূত হয়ে পড়েন সেটা পড়ার পর----ধর্মের দার্শনিক দিকটা নিয়ে এতটা জ্ঞানগর্ভ গভীর আলোচনা তিনি আগে পড়েননি। ছাত্রের কাজ অধ্যাপককেও প্রভাবিত করে ফেলে।
 লুজিন-ফ্লোরেন্সকির পত্রালাপের আরো একটি অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ছিল----এঁরা বিভিন্ন চিঠিতে একে অন্যকে ভিন্ন ভিন্ন নামে সম্বোধন করতেন। আমরা, সাধারণ বাংগালিরা, যেমন আদর করে ছোট বাচ্চাকে নানারকম নাম ধরে ডাকি, অনেকটা সেরকমই। তবে ওঁদের বেলায় তার একটা আলাদা উদ্দেশ্যও ছিল----প্রিয়জনদের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করা নাকি খৃস্টধর্মেরই একটা ছোট্ট অংশ। এতে করে দুজনের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিটা আরো মজবুত হয়। আসলে এই আপাত তুচ্ছ অভ্যাসটিই পরবর্তীকালে নামপূজারিদের আনুষ্ঠানিক ব্রতের আকার ধারণ করে---‘নাম’ যে শুধু একটা শব্দ নয়, শব্দের চেয়েও শক্তিশালী একটা বস্তু, যা একটি আপাত অদৃশ্য বস্তুকেও বাস্তবে পরিণত করে দিতে পারে, এই বিশ্বাসটি ফ্লোরেন্সকি, এগরভ আর লুজিন তিনজনেরই ধর্মীয় অনুভূতির আওতায় প্রবেশ করে। তাঁরা মনেপ্রাণে গণিতবিদ বুদ্ধিজীবী হয়েও এথস পর্বতের নামপূজারি সাধুদের মত ‘নাম’ভক্ত সাধক হয়ে ওঠেন, যদিও সেসময় হয়ত তাঁরা নামপূজারীদের নামও শোনেননি

ছয়

 নিকোলাই লুজিন কালে কালে রাশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গাণিতিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। একসময় মস্কো বিস্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন তিনি। সাথে সাথে ধর্মের প্রতি তাঁর যে গভীর ভক্তি ও আনুগত্য যা গড়ে উঠেছিল বন্ধু ফ্লোরেন্সকির সংস্পর্শ ও সাহচর্যে, তা’ও বৃদ্ধি পেতে থেকে ক্রমশঃ। অঙ্ক আর ধর্মের মাঝে একটা সহজ স্বাভাবিক যোগসূত্র আছে, এ-বিশ্বাসটি দৃঢ়তর হয়ে ওঠে তাঁর মনে। বিশেষ করে রাশিয়ান ধর্মীয় সংস্কৃতিতে ‘নামকরণ’এর যে বিশেষ শক্তির কথা তিনি শিখেছেন ফ্লোরেন্সকি, এগরভ আর বিলাইয়ের কাছ থেকে, এবং তার সঙ্গে গণিতের সংযোগটি কিভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রুশ গাণিতিক কেবল নয়, কতিপয় বিশিষ্ট ফরাসী গবেষকদের সৃষ্টিকর্মেও, সেই সংস্কৃতির সাথে তিনি একান্তভাবে একাত্ম বোধ করেন। নামমাহাত্ম্যের ওপর তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি আছেঃ “ নামকরণ মানে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকাশ”। তাঁর বন্ধু ও সহপাঠী আঁন্দ্রে বিলাই বলেছিলেনঃ “ যখন আমি একটা নতুন নাম দিই কোনকিছুকে তখন সেই নামকরণের মধ্য দিয়েই জিনিসটা জন্ম নিয়ে নেয়”।
 আসলে নাম নির্বাচন, শব্দচয়ন, এসব কিন্তু খৃস্টান সমাজের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে নতুন কিছুই নয়। বাইবেলের গোড়াতেই আছেঃ “আলোময় হোক চতুর্দিক”। সাথে সাথে আলোতে আলোময় হয়ে উঠল দিকদিগন্ত। অর্থাৎ সেই মুহূর্তেই জন্ম নিল ‘আলো’ নামক বস্তুটি। আরেক জায়গায় আছেঃ “ প্রথমে ছিল একটি শব্দসেই শব্দ ছিল ঈশ্বরের অধীনস্থ। তারপর শব্দ ও ঈশ্বর হয়ে গেলেন এক ও অভিন্ন”। সংশয়ী মনে প্রশ্ন হয়ত উঠবেঃ কোনটি আগে? শব্দ না ঈশ্বর? কে দেবে তার উত্তর!
 উল্লেখযোগ্য যে এথস পর্বতের গির্জাহামলার ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯১৩ তে, যখন খবরটা জানাজানি হয় সারা রাশিয়াব্যাপী। তার আগে, ১৯০৫-০৮ এর দিকে, রাশিয়ার গাণিতিকরা এথসের নামপূজারিদের সম্বন্ধে কিছু জানতেন কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা মুস্কিল। এ’ও হতে পারে যে তাঁরা, এবং প্যারিসের কতিপয় গাণিতিক, ধর্মের কারণে না হলেও গণিতের কারণেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন নামের প্রতি। এবং তার মূলটি ছিল জর্জ ক্যান্টরের পূর্ববর্ণিত সেট থিওরি, আর তার ব্যবহার দ্বারা ‘অসীম’ সংখ্যাকে শ্রেণীবদ্ধ করার প্রয়াসএপ্রসঙ্গে ক্যান্টরের একটা উক্তি আছে এরকমঃ “গণিতের আসল সারবস্তুই হল তার আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতাটুকু”। আর সেই স্বাধীনতার উৎস হল নিজের ইচ্ছামত একটা নাম নির্বাচন করে তাকে অস্তিত্ত্বময় করে তোলা। লেবেগের একটি বিখ্যাত গাণিতিক প্রশ্নঃ “ একটা নতুন তত্বের নামকরণ না করেই কি তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব”? সেই গাণিতিক প্রশ্নটিকে ধর্মশাস্ত্রের ভাষাতে ভাষান্তরিত করে ফ্লোরেন্সকি অনুরূপ প্রশ্ন তুলেছিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কেঃ “ মহাপ্রভুর নাম-পরিচয়টি প্রতিষ্ঠিত না করেই কি তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা সম্ভব?” অর্থাৎ নামকরণের বিষয়টিতে গণিত এবং ধর্ম একই পথের পথিক, তাদের একই জিজ্ঞাসা, একই উদ্দিষ্ট। অন্তত এ’ই ছিল তাঁদের বিশ্বাস।
 যা’ই হোক, নামসাধনাতে এতটাই ডুবে গেলেন ফ্লোরেন্সকি সাহেব যে অঙ্কের বড় মাথা হয়েও সেটা কোনও কাজে লাগল না শেষ পর্যন্ত----অঙ্ক হেরে গেল ধর্মের কাছে। তিনি পুরোপুরি ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দেন। বাকি রইলেন এগরভ আর লুজিন, গণিতের বিজয়পতাকা সগর্বে ধারণ করে থাকার জন্যে। দেখা গেল যে তাঁরা কেবল ধরেই থাকেননি, অনেকখানি এগিয়েও নিয়ে গিয়েছিলেন।
 প্রথম মহাযুদ্ধের পর মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সুনাম আস্তে আস্তে ছড়াতে শুরু করে বাইরের জগতে। এবং তার ষোল আনা কৃতিত্বের দাবিদার দুটি পুরুষঃ দিমিত্রি এগরভ ও নিকোলাই লুজিন। যুদ্ধ বাধে ১৯১৪ সালে। তার ঠিক আগে আগে দুটিতে মিলে এক অভিনব বস্তুর সূচনা করেন গণিত বিভাগেঃ স্নাতকশ্রেণী বা আণ্ডারগ্র্যাজুয়েট সেমিনার। গতানুগতিক প্রথামাফিক নির্ধারিত পাঠ্যসূচি অনুক্রমী কোনও কোর্স নয়, এতে পাস-ফেলের বালাই ছিল না, নম্বর দিয়ে তুলনামূলক বিচার আচারের বালাই ছিল না। এর প্রধান লক্ষ ছিল মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কাছে গণিতকে একটি পরম আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য বিষয়তে পরিণত করা, গণিতশাস্ত্রের সবচেয়ে দুরূহ প্রশ্নগুলোকে ওদের সামনে তুলে ধরে ওদের প্রলুব্ধ করা, অভুক্ত প্রাণীর মত যাতে করে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েওগুলোতে। বড়মাপের মেধার প্রকৃতিই তাই----যা অসাধ্য বলে মনে হয় সবার কাছে, যাতে দাঁত বসাতে পারেননি অতীতের মহাজন মহারথিরা, ঠিক সেগুলোই তাদের জন্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ওগুলোই তাদের চাই----সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত তাদের আহারনিদ্রা সব হারাম। একটা চ্যালেঞ্জ পেলে তারা জোঁকের মত লেগে থাকবে তাতে। ঠিক এরকমই কিছু ছাত্র তাঁরা বাছাই করে ঢোকালেন মস্কোর গণিতবিভাগে।
 স্নাতক সেমিনারের আইডিয়াটি প্রথমে কার মাথায় উদয় হয়েছিলঃ এগরভ না লুজিন, সেসম্বন্ধে সঠিক কিছু দলিলপত্র না থাকলেও এটা অনুমান করা যায় যে দুজনের মাঝে তরুণতর যে লোকটি, অর্থাৎ লুজিন, এটি তাঁরই উদ্ভাবন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিতে অবশ্য এগরভের সঙ্গে কারো তুলনা ছিল না সেসময়কার রাশিয়ান গণিতে, বিশেষ করে মস্কো বিস্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু নতুন আইডিয়ার কারখানা তো পুরনো প্রজন্ম নয়, সে অধিকার প্রায় পূর্ণমাত্রাতেই নতুনদের অন্তর্গত। তাছাড়া লুজিনের ব্যক্তিত্বের ভেতরেও একটা অদম্য উৎসাহের উৎস ছিল কোথাও, নিত্য চঞ্চল উচ্ছাসে উল্লাসে টগবগ, আনন্দ উদ্যমে ভরপূর একটি চরিত্র। লোকটার ছাত্র পড়ানোর পদ্ধতিটাও ঠিক গতানুগতিক ছিল না। ক্লাসে গিয়ে তিনি অন্যান্য অধ্যাপকদের মত ঘূণে-ধরা নোটের পাতা খুলে বোর্ডের ওপর লিখতে শুরু করতেন না। তিনি গল্প করতেন----গণিতের গল্প, দর্শনশাস্ত্রের গল্প, ইতিহাসের গল্প। তারপর বোর্ডে দাঁড়িয়ে অঙ্ক কষতে গিয়ে এমন ভাব দেখাতেন হঠাৎ হঠাৎ যেন অঙ্কটা ঠিক মেলাতে পারছেন না। নিজের অঙ্কে নিজেই আটকে গেছেন। তখন চোখেমুখে অসহায় ভাব ধরে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলতেনঃ “দয়া করে তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কি একটু সাহায্য করবে আমাকে?” তখন তাঁর ছাত্ররা, মেধা-অমেধা নির্বিশেষে, সাহস করে এগিয়ে আসত বোর্ডে। কেউ পারত, কেউ পারত না। পেরে গেলে খুশিতে আটখানা হয়ে তিনি ছাত্রটিকে সাধুবাদ জানাতেন। সেকারণে ছাত্ররা সবসময় সজাগ থাকত তাঁর ক্লাসে, আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ঢুকত ক্লাসে, যাতে করে “শিক্ষকের ভুল ধরিয়ে” সহপাঠীদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেলুজিনের ক্লাস কেউ কামাই করতে চাইত না---বরং তাঁর ক্লাসে যাওয়ার জন্যে অন্যের ক্লাস কামাই করত দরকার হলে। অসম্ভব জনপ্রিয় অধ্যাপক ছিলেন এই মানুষটি। লুজিনের শিক্ষাপদ্ধতির ওপর তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র পরে উক্তি করেছিলেনঃ “ অন্যান্য অধ্যাপকদের কাছে আমরা শিখেছিঃ গণিত একটা সুন্দর ছবির মত, যা আঁকা শেষ হয়ে গেছে। লুজিনের ক্লাসে গিয়ে শুনতাম, হ্যাঁ, সুন্দর বটে, অসম্ভব সুন্দর একটি ছবি তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু অসমাপ্ত একটি ছবি, যার কাজটি এখনো শেষ হয়নি। ওটা শেষ করার দায়িত্বটি আমাদের”
 তাঁর ছাত্ররাই একসময় সেই ‘সেমিনার’টির নামকরণ করেছিলঃ লুসিটানিয়া। শব্দটার উৎপত্তি কোথায় সেনিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু বড়কথাঃ নামকরণএ বিষয়টির ওপর অনেককিছুই তারা শিখেছে লুজিন আর এগরভের কাছ থেকে। নাম দিয়ে একটা কিছু সৃষ্টি করে ফেলা যায় তার উদাহরণ তারা দেখেছে। নাম দিয়ে যেমন ধর্মীয় সত্ত্বা তৈরি করা যায় তেমনি গাণিতিক সত্ত্বাও। ক্যান্টরের পুরো সেট থিওরিটাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটা বারবার দেখা দিয়েছে প্যারিসের খ্যাতনামা গবেষকদের কাজের মধ্য দিয়েঃ বোরেল, বেয়ার এবং সর্বোপরি, লেবেগ। লুসিটানিয়ার তরুণ ছাত্রছাত্রীরা আরো শুনেছে তাদের প্রিয় শিক্ষকদের মুখে যে গণিতের একটা দার্শনিক দিকও আছে, এমনকি একটা আধ্যাত্মিক দিকও। এবং এই একটি ব্যাপারে রাশিয়ান গণিত অন্য সবার চেয়ে স্বতন্ত্র—সে তার আপন মহিমাতে ভাস্বর। ফরাসী গণিত ভীষণ শক্তিশালী সন্দেহ নেই, কিন্তু ভীষণ বস্তুকেন্দ্রিকও বটে, সে তার যুক্তির গণ্ডীর বাইরে পৃথিবীর আর কিছু দেখতে পারেনা। এই কথাগুলি তারা মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে, এবং পরবর্তীতে একারণে তাদের অনেকেই সোভিয়েট শাসকদের বিরাগভাজনও হয়েছে। কিন্তু সারকথা যা থেকে যায় তা হলঃ লুসিটানিয়া কেন্দ্র থেকে যারা বের হয়েছে সেসময় তাদের অনেকেই গণিতের ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারি হয়েছেন। যেমনঃ আন্দ্রে কল্মগরভ (বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গাণিতিক), প্যাভেল আলেকজান্দ্রভ, লেজার লিস্টারনিক, প্যাভেল উরিসন, প্রমুখ। একজন নামকরা মহিলা গাণিতিক, নিনা বারি (১৯০১-১৯৬১), তিনিও লুসিটানিয়ারই ফসল। গণিতের ‘ট্রিগনেমেট্রিক সিরিজ’ নামক একটা শাখা যাতে তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের পরিচয় রয়েছে। এই মেয়েটিকে কেন্দ্র করে একসময় একটা সরস গুজবও রটে যায় মস্কোর উচ্চ বিদ্যালয়ে----তাঁর সঙ্গে নাকি নায়কতুল্য অধ্যাপক নিকোলাই লুজিনের কি একটা গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কথাটার সত্যমিথ্যা নির্ধারন করা দায়, তবে এটা ঠিক যে লুজিন এতই সুদর্শন, সুবক্তা ও প্রাণপ্রাচুর্যে উচ্ছল উদ্দাম একটি পুরুষ ছিলেন যে তাঁর ক্লাসের অধিকাংশ মেয়েরাই নাকিতাঁর প্রেমে পড়ে যেত। তিনি নিজে তাতে কতখানি সাড়া দিতেন জানিনা, তবে এনিয়ে তাঁর বৈবাহিক জীবনে কোনরকম সমস্যা দেখা দিয়েছিল, সেরকম কোনও খবরও আমাদের জানা নেই
 যুদ্ধ এবং সেসময়কার রাজনৈতিক অস্থিরতা, বলশেভিক আন্দোলন, এসবের কারণে জাতির অর্থনৈতিক জীবনের চরম দুরবস্থা, ব্যবসাবাণিজ্যের নিদারুণ মন্দা, খাদ্যদ্রব্যের অগ্নিমূল্য এবং দুষ্প্রাপ্যতা, সবকিছু মিলে সাধারণ মানুষের জীবন অচিরেই দুঃসহ অবস্থায় পৌঁছে যায়। এবং তার সরাসরি প্রভাব পড়ে লুসিটানিয়ার জিনিয়াসপ্রতিম ছাত্রছাত্রীদের ওপর। তাদের অনেকে সকালবেলা প্রায় না খেয়েই ক্লাসে যেতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেসময় ক্যাফেটারিয়া বলে কিছু ছিল না। থাকলেও লাভ হত না---পয়সা দিয়ে কিনে খাবার মুরোদ থাকলে তো খাবে। তার ওপর ছিল না শীতাতপের ব্যবস্থা ক্লাসরুমের ভেতর। জ্বালানি তেলের অভাবে প্রচণ্ড শীতের সময়ও ঘর গরম করার কোনও ব্যবস্থা থাকত না। ক্লাসরুমের ভেতরে কখনো কখনো তাপমাত্রা -৫ ডিগ্রি (সেন্টিগ্রেড) পর্যন্ত নেমে যেত। অথচ অঙ্কের মত অসম্ভব সুন্দর জিনিসের আকর্ষণ উপেক্ষা করে তারা শীতের মত তুচ্ছ ঠাণ্ডা বস্তুর কাছে মাথা নত করবে সেরকম ঠুনকো জ্ঞানপিপাসু ছাত্র ছিল না সেকালের লুসিটানিয়া সদস্যরা। তারা গায়ে দুতিনপ্রস্থ গরম কাপড় জড়িয়ে ঝড়তুফান সব অগ্রাহ্য করে চলে যেত ক্লাসে। অধ্যাপকরাও ঠিক একই রকম নিষ্ঠাবান ছিলেন তাঁদের ব্রতের প্রতি, তাঁদের আপন হাতে গড়া সেমিনার ক্লাসটির প্রতি। তাঁরা তবুও একটা সুবিধা ভোগ করতেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে----যথেষ্ঠ খাবারদাবার, যা তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা পেত না। অনেক সময় প্রফেসার এগরভ বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতেন কোন কোন অভাবী ছেলেমেয়ের জন্যে। নিজেরা কম খেয়ে ছাত্রদের খেতে দিতেন। এতটাই উদারপ্রকৃতির মানুষ ছিলেন এই ভদ্রলোক। তাঁর একটি পোষা কুকুর ছিল, যা অন্তত সেসময়কার অর্থনৈতিক অবস্থাতে রীতিমত একটা বিলাসিতা। কিন্তু তাই বলে কি পোষা কুকুরকে না খাইয়ে রাখা যায়? অন্তত এগরভের মত মানুষের জন্য তা সম্ভব নয়। তিনি নিজের খাবার থেকেই তুলে তুলে তাঁর আদরের কুকুরটিকে খেতে দিতেন।
 এই অসম্ভব একটি দয়ালু, নিখাদ নির্মল, ভালোমানুষকে কিরকম অমানুষিক দুরবস্থা ভোগ করতে হয়েছিল আদর্শগত বিরোধের কারণে, সে এক গা কাঁটা-দেয়া কাহিনী
 ১৯১৭ সালে যুদ্ধের দুর্ভোগ শেষ হয়নি, তার আগেই সাধারণ মানুষের জীবনে দেখা দেয় আরেক অনিশ্চয়তা----ক্রেমলিনের নতুন শাসকবর্গ, কমুনিস্ট সরকার, তাদের কল্পনা-পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের জীবনধারা নিয়ে। ধর্মকর্ম তখন বেআইনি হয়ে গেছে। চার্চগুলি একে একে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। পাদ্রীদের ধরে ধরে জেলে পাঠনো হচ্ছে। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় গির্জাটি ভেঙ্গেচুরে ছাত্রদের ক্লাব, নৃত্যমঞ্চ আর মিলনায়তনে পরিণত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেছে পুলিশ। অনেক অধ্যাপককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে পত্রপাঠ। একজনকে তো ধরে নিয়ে তৎক্ষণাৎ গুলি করে মেরেই ফেলেছে। বেশ কিছু প্রফেসার আত্মহত্যা করেন সেসময়। এগরভ, লুজিন, এবং তাঁদের মত আরো অনেক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, রাজনীতির সাথে বিন্দুমাত্র জড়িত নয় কেউ, তাঁরা সবাই ভীতসন্ত্রস্ত----কখন কার কপালে কি দুর্গতি নেমে আসে

সাত
  সদ্য ক্ষমতায় আসা কমুনিস্ট সরকারের বড় নেতাদের প্রায় সকলেই ছিলেন কট্টর নাস্তিক। কেউ খানিক নরমপন্থী, কেউ বেশ উগ্র। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মূলোৎপাটন করার জন্যে সবাই মোটামুটি বদ্ধপরিকর। কিন্তু সেটা কিভাবে কার্যকরি করা যাবে সেপ্রশ্নতে কিছুটা মতবিরোধ ছিল ওপরতলায়। বেশির ভাগেরই ইচ্ছা চার্চগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হোক। আবার কারো কারো ধারণা, হঠাৎ করে এতটা চরম পন্থা অবলম্বন করলে গ্রামাঞ্চলের ধর্মভীরু কৃষক সম্প্রদায় একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়বে। তার চেয়ে বরং আস্তে আস্তে তাদের মন সনাতন ধর্ম থেকে সরিয়ে এনে কমুনিজমকেই একরকম নতুন ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হোক। শুরুতে এমন একটা উদ্যোগ আসলেই তাঁরা নিয়েছিলেন। তবে আগেকার পাদ্রীদের বেলায় কোনও দয়ামায়ার অবকাশ রাখেন নি তাঁরাপাদ্রী এবং গির্জা এদুটোতে কমুনিস্ট সরকার একেবারেই অনড়। চতুর্দিকে ধড়পাকড় শুরু হয়ে গেছে। চার্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে যেখানে ছিলেন পালাবার পথ খুঁজছেনপুরোহিতরা গতানুগতিক পোশাক ছেড়ে সাধারণ মানুষের জনতায় মিশে থাকবার চেষ্টা চালালেন। সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশ পরে কারো সামনে মুখ দেখানোর মানুষ আর যে’ই হোক, প্যাভেল ফ্লোরেন্সকি ছিলেন না। তিনি এক জনসভায় গিয়ে হাজির হলেন যেখানে স্বয়ং ট্রটস্কি উপস্থিত ছিলেন। চার্চের সনাতন উর্দিপরা ফ্লোরেন্সকিকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করেন এক সহচরকেঃ “Who’s that?” (এ-লোকটা কে?) যেন কোনও উজবক জানোয়ার। ভাগ্য ভালো যে সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে পাকড়াও করে জেলখানায় নেওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর এই “বেয়াদপি” যে কর্তৃপক্ষকে বিরক্ত করেছিল তার প্রমাণ মেলে অনতিকাল পরে। ওদিকে এগরভ সাহেবও কম গোঁয়ার ছিলেন না ধর্মের ব্যাপারে। ফ্লোরেন্সকির মত প্রকাশ্যে বাহাদুরি না দেখালেও জান বাঁচানোর তাগিদে নিজের ধর্মকে লুকিয়ে রাখারও পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। অনেকটা যা হবার হবে মনোবৃত্তি নিয়ে ঠিক আগের মতই আপন মনে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো চালিয়ে যেতে থাকেন। শুধু নিকোলাই লুজিনই ছিলেন একটু সাবধানী পুরুষ। ১৯২০ সালের দিকে, তখন তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে অন্যত্র অধ্যাপনা করছিলেন---মস্কো থেকে সামান্য দূরে। জারের আমলে তিনি নিয়মিত চার্চে যেতেন---সে অভ্যাসটা ছেড়ে দেন। ধর্মচর্চা বাদ দেননি, কিন্তু নিজের বাড়ির ভেতর, লোকচক্ষুর আড়ালে।
 এগরভ সাহেব নরম প্রকৃতির মানুষ হলেও ব্যক্তিগত নীতি আদর্শের দিক থেকে কোনরকম আপস করার মত লোক তিনি ছিলেন না। রাশিয়ার নতুন প্রভুদের যদৃচ্ছ আচার আচরণ, যাকে-তাকে ধরে জেলে ঢোকানো তাদের সঙ্গে সামান্য মতবিরোধ হওয়ামাত্র, অন্য কারো মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে সবাইকে ভেড়ার পালের মত একই রাস্তায় চলতে বাধ্য করা, এসব তিনি অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। মুস্কিল হল যে ‘এই পছন্দ না করাটা’ ভদ্রলোক একটু রেখেঢেকে করবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি। বরং খোলাখুলিভাবেই কমুনিস্ট শাসকদের সমালোচনা করতেন। একবারও হয়ত ভাবেননি যে সেগুলো ওপরওয়ালাদের কানে যাবে, এবং তার একটা ভয়াবহ পরিণামও হতে পারে। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে এগরভ তখন একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব----সুতরাং সেখানে তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্যে দুর্ব্যবহার করার সাহস হয়ত কারো ছিল না সেসময়। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে ভদ্রলোক একটা পার্ট-টাইম অধ্যাপনার কাজ নিয়েছিলেন স্থানীয় প্রকৌশল ইন্সটিটিউটে, যেখানে তাঁর আন্তর্জাতিক মানমর্যাদা নিয়ে কারো কোনও মাথাব্যথা ছিল না----সেখানে তিনি সামান্য বেতনভোগী পার্টটাইমার মাত্র। বেচারার এমনই পোড়া কপাল যে একদিন আর্ন্সট কোলম্যান নামক এক গাণিতিক এলেন সেই ইন্সটিটিউটে আমন্ত্রিত অতিথি বক্তা হিসেবে। সেসময় রাশিয়ার নামীদামী গণিতজ্ঞদের অধিকাংশই কমুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি। যাঁরা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন বেশ উঁচুমানের----অটো স্মিট (১৮৯১-১৯৫৬) আর কোলম্যান (১৮৯২-১৯৭৯)। দুজনের মধ্যে মেধার দিক থেকে স্মিট অনেক উঁচুতে। চিন্তাভাবনার দিক থেকেও ভদ্রলোক অনেক উপরের স্তরের। তুচ্ছ ব্যক্তিগত কারণে কারো কোন ক্ষতি করার মত মানসিকতা তাঁর ছিল না। কোলম্যান অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের হলেও তাঁর গুণের অভাব ছিল না। গণিতের দুয়েকটা শাখার ওপর বেশ ভালো দখলই ছিল তাঁর। চার পাঁচটা ভাষা জানতেন, ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন, ভালো লিখতেনও। সমস্যা একটাই। ভয়ঙ্কর একরোখা, নিজের মতামতের ওপর অন্য কারো মতের কোনও মূল্য দিতেন না, উগ্রমনা, হিংসুটে প্রকৃতির মানুষ। কাউকে পছন্দ না হলে তার চূড়ান্ত ক্ষতি করতেও তাঁর বিবেকে বাধত না। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের নিরীহ ভালোমানুষ এগরভ সাহেব ঠিক এই লোকটিরই বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন।
 প্রকৌশল ইন্সটিটিউটে বক্তৃতা দেবার সময় এগরভ উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু কোলম্যান তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে তীব্র সমালোচনার ঝড় তুলে দেন “এইসব ক্ষীণমনা পাঁতি বুর্জোয়া্দের” বিরুদ্ধেসরাসরি এগরভের নাম করেই তাঁর ধর্মভক্তির তীব্র সমালোচনা করেন। এঁরা মার্ক্সবাদের শত্রু, এঁরা রাষ্ট্রের শত্রু, ইত্যাদি ইত্যাদি। খবর পেয়ে এগরভ ভীষণ ক্ষিপ্ত। তিনিও বিনা প্রতিবাদে অপমান সহ্য করার পাত্র নন। কোলম্যানের ভয়ে, আত্মরক্ষার খাতিরে, নতশিরে ঘোষণা করবেন যে, না আমি দুঃখিত, আর আমি ধর্মকর্ম করবনা, তার বদলে জোরগলায় প্রচার করে বেড়ালেন যে তাঁর ধর্মবিশ্বাসে তিনি অটল, সেখান থেকে কোনও শক্তিই তাঁকে টলাতে পারবে নাব্যস, আর যায় কোথায়----ইন্সটিটিউট থেকে তৎক্ষণাৎ ছাঁটাই---ঠিক যা চেয়েছিলেন কোলম্যান সাহেব। এগরভের পদটিতে বসানো হল নিকোলাই চেবোটারিয়োভ নামক এক ৩০ বছর বয়স্ক আপাতনাস্তিক, মার্ক্সবাদী, সরল সহজ প্রকৃতির যুবককেঅঙ্কের লোক, মেধাবী, উচ্চাকাঙ্খী। এবং, বড় সমস্যা, বিবেকবান। কারো ওপর অন্যায় অবিচার হলে তিনি তা সমর্থন করতেন না, নিজের ব্যক্তিগত মতাদর্শের সাথে তার যত বিরোধই থাক। নতুন চাকরিতে নিয়োগলাভের আগে বেচারির কোন ধারণাই ছিল না যে যে-মানুষটিকে পদচ্যুত করে তাঁকে চাকরিটা দেওয়া হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, রাশিয়ার সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত ও সম্মানিত গাণিতিক দিমিত্রি এগরভ, একসময় যার ছাত্র ছিলেন তিনি। শোনার পর সে যে কি মনোযন্ত্রনা তাঁর। যেন মুখ দেখাতেই লজ্জা। তাঁর নববিহাতিত স্ত্রী মারিয়া তখন মস্কোরই একটা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনা করছিলেন। তাঁরা দুজনই আধুনিক মার্ক্সবাদী চিন্তাধারায় দীক্ষিত। ধর্মবিরোধী তাঁরা দুজনই। কিন্তু একটা নিরীহ মানুষকে শুধুমাত্র তার ধর্মবিশ্বাসের জন্য অনর্থক হয়রানি করার পক্ষপাতী তারা কেউই ছিলেন না। ব্যাপারটা নিকোলাইকে এতোটাই বিচলিত করে ফেলল যে আর কিছু না হলেও অন্তত এর বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ করার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বড় আকার নিয়ে দাঁড়ালো তাঁর সামনে। মারিয়ার সঙ্গে আলাপ করে একদিন ঠিক তা’ই করে ফেললেন। কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠালেন অধ্যাপক এগরভকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করার জন্যে। সাথে সাথে নিজের পদত্যাগপত্রও। তাতে উল্লেখ করতে ভোলেননি ভদ্রলোক যে এগরভের মত বড় গাণিতিকের শূন্যস্থান ভরাট করার যোগ্যতা তাঁর নেই, অতএব এই পদে অধিষ্ঠিত থাকার কোনও নৈতিক যৌক্তিকতা তিনি মানতে পারছেন না। ব্যস, আর যায় কোথায়।  অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটা যে আরেকটা অন্যায় সেটা বেচারির ভালো করে জানা ছিল না। মেধাবী ছাত্র, এমনিতে অন্য কোথাও একটা ভালো চাকরি পেতে তার কোনও সমস্যা থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি তখন বেড়ার অতিক্রম করে নিষিদ্ধ এলাকাতে পা বাড়িয়ে দিয়েছেন। অতএব তিনি একটি চিহ্নিত চরিত্র তখন, যতই তার মার্ক্সভক্তি থাক। অনেক কষ্টেসৃস্টে একটা ছোটখাটো চাকরি তিনি পেলেন শেষ পর্যন্ত, মস্কো থেকে অনেক দূরে, কাজান শহরের নিকটবর্তী ওডেসা নামক ছোট এক গ্রাম্য কলেজে। কিছুদিন পর অবশ্য কাজান বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অধ্যাপনার নিয়োগ পেয়ে যানতাঁর স্ত্রী মস্কো থেকে মেডিক্যাল ডিগ্রি শেষ করার পর তাঁর সাথে এসে যোগ দেন। তিনিও কাজান হাসপাতালে একটি চাকরি পেয়ে যান।
 ইতোমধ্যে এগরভ সাহেবের কি অবস্থা? একটু একটু করে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে শুরু করেইন্সটিটিউটের অপমান কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়ে গেল গুপ্তহস্তের অঙ্গুলিচালনা। প্রথমে গণিতশাস্ত্রের বিভাগীয় প্রধানের পদটি হারালেন। তারপর হারাতে হলমস্কো ম্যাথেমেটিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্টের পদ---এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানটি তাঁরই নিজের হাতে গড়া। অবশেষে তিনি পুরোপুরিই বরখাস্ত হয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে। অথচ এতসবের মাঝেও লোকটি নিজের বিশ্বাসটি অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। নিয়মিত চার্চে যাবার সুযোগ না পেলেও গোপনে গোপনে সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রার্থনাপর্ব অব্যাহত রাখা হয়েছিল। এমনকি তাঁর প্রিয় নামপূজাটিও। কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের কারণে সেসময় সনাতন চার্চগামীদের সঙ্গে নামপূজারীদের একটা সদ্ভাব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা দুটিতে মিলে একরকম যুক্তফ্রন্টের মত ব্যুহ তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাঁরা একসাথে, সাধারণত কোনও পুরনো বাড়ির নিচের তলার আলোবাতাসহীন ছোট্ট ঘরের ভেতর, বা কারো বেইজমেন্টে, তাঁদের ধর্মকর্ম করতেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এঁরা তখন মার্কামারা রাষ্ট্রদ্রোহী। দেশের শত্রু। বুর্জোয়া পুঁজিবাদী। এগরভের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযোগঃ তিনি গণিতের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেছেন। তিনি প্রতিবিপ্লবী। একদিন তারা তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে মস্কোর জেলখানাতে নিয়ে যায়। কিন্তু তাতেও যেন তৃপ্তি হয়না তাদের শেষ পর্যন্ত বেচারিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয় মস্কো থেকে অনেক, অনেক দূরবর্তী একটি কারাগারে। জায়গাটির নাম? ভাগ্যের বিচিত্র পরিহাসঃ কাজান। যেখানে চেবোটারিয়ভকেও আশ্রয় নিতে হয়েছিল, ঠিক এগরভেরই কারণে!
 এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা রাশিয়ার মত একটি উন্নত দেশের----দিমিত্রি এগরভ, রাশিয়ার গাণিতিক ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল তারকা, যার লেখা বইপত্র পড়ে ইউরোপ-আমেরিকার ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হত এবং এখনো হয়, মস্কো ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি কাটাতে হল লোকচক্ষুর বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনও এক অন্ধকার নির্জন কারাগারে। সেখানে তাঁর কি’ই বা করার ছিল, একমাত্র উপাসনা ছাড়া। তা’ই তিনি করছিলেন সেখানেঃ ঈশ্বরের নামবন্দনা, সত্যিকার নামপূজারীরা যেভাবে করেন। যেভাবে তিনি অসীম সংখ্যার পূজা করেছেন। কিন্তু তাতেও জেল কর্তৃপক্ষের আপত্তি। না, সোভিয়েট জেলখানাতে ধর্মের স্থান নেই----উপাসনা চলবে না। তোমরা আমাকে উপাসনাও করতে দেবে না? ঠিক আছে, আমি তোমাদের খাদ্য স্পর্শ করব না। সত্যি সত্যি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলেন। অনশন ধর্মঘট। বেচারির এমনিতেই অম্ল সমস্যা, নানারকম গোলযোগ পাকস্থলীতে। তার ওপর দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা। আস্তে আস্তে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। ভীষণ দুর্বল অবস্থায় একদিন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল কাজানের বড় হাসপাতালে----এবং সেই মারিয়া নামের মেয়েটিরই তত্ত্বাবধানে। মারিয়া যথসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন লোকটাকে বাঁচাতে। কিন্তু ততদিনে তাঁর বাঁচার স্পৃহাটাই হয়ত মরে গিয়েছিল। একসময় মারিয়া বুঝতে পারলেন যে আর সময় নাই। যে কোন মুহূর্তে বায়ু ফুরিয়ে যাবে। তিনি জানতেন যে কমুনিস্টদের নতুন আইন অনুযায়ী কাউকে ধর্মীয় কায়দায় সমাধিস্থ করা যাবে না। মারিয়া নিজে নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও তার স্বামীর মতই, অন্যের বিশ্বাসকে অসম্মান করার পক্ষপাতী মোটেও ছিলেন না। তখন ডাক্তার হিসেবে একটা ভূয়া সার্টিফিকেট লিখলেন জেলগার্ডের জন্যে যে লোকটা মারা গেছেন, এবং তার দেহের আইনসম্মত সৎকারের ব্যবস্থা করা হবে হাসপাতালেরই পক্ষ থেকে, এই বলে গার্ডকে মানিয়ে মুনিয়ে পাঠিয়ে দিলেন জেলখানাতে। এদিকে তিনি, স্বামী নিকোলাই আর গুটিকয় হাসপাতাল কর্মীর
সহযোগিতা্‌ একটা স্ট্রেচারে করে ওঁকে খোলা রাস্তায়গড়িয়ে গড়িয়ে নিজেদের বাসায় নিয়ে যান। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক পরের দিনই তিনি মারা যান। ‘সৌভাগ্যবশত’ এইজন্যে যে কর্তৃপক্ষের কানে যাবার আ্গেই তারা তাঁর মরদেহের ধর্মীয় সৎকারের ব্যবস্থা করার সুযোগ পান, যা তিনি একান্তভাবেই কামনা করেছিলেন। ইতিহাসের এই এক উজ্জ্বল উদাহরণ যেখানে একজন অবিশ্বাসীর পক্ষেও সম্ভব হয়েছিল একজন পরম ধার্মিক পুরুষের মরদেহকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। তাঁর কবরে নাম খোদাই করার সাহস কারুরই ছিল না।
 আর্ন্সট কোলম্যানের এক নম্বর শত্রুটিকে তিনি শেষ পর্যন্ত নিপাত করতে সক্ষম হলেন। ইতোমধ্যে প্যাভেল ফ্লোরেন্সকির ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা বলা দরকার পাঠককে।

আট
সোভিয়েট ইউনিয়ানে তখন মার্শাল স্ট্যালিনের রাজত্ব (শাসন না বলে আমি ইচ্ছে করেই ‘রাজত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করছি)। ১৯২২ সালে কমরেড লেনিন পরপর বেশ ক’টি স্ট্রোকের শিকার হন। শরীর একেবারেই ভেঙ্গে যায় তাঁর, আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে হতে ১৯২৪ সালে তিনি মারা যান। তারপর রাষ্ট্রচালনার দায়িত্ব চলে যায় স্ট্যালিনের হাতে। লেনিনযুগের অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী চিন্তাধারা, একটু মায়ামমতা, একটু হৃদয়াবেগ, ওসব ‘সস্তা’ বুর্জোয়া ভাবালুতার শেষ। শক্ত হাতে সকল মার্ক্সবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। সমূলে উৎপাটন করতে হবে জারের সময়কার সকল সামন্তবাদী চিন্তাধারার উৎসগুলোকে---সেটা রাজনৈতিক অঙ্গনেই হোক আর উচ্চ বিদ্যালয়ের মহা মহা জ্ঞানমন্দিরেই হোক। নিকোলাই বুখারিন আর আনাতল লুনাচার্স্কির মত নরম মেজাজের সহনশীল মানুষগুলো, মনেপ্রাণে নিরীশ্বরবাদী মার্ক্সিস্ট হওয়া সত্ত্বেও স্ট্যালিনবাদীদের কাছে হয়ে উঠলেন সন্দেহের পাত্র। ওদিকে কোলম্যানের মত অন্ধ চরমপন্থীদের তখন সুখের স্বর্গ। এগরভকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে ফেলার পর তিনি মনোযোগ দিলেন লুজিনের প্রতি।
 তার আগে অবশ্য ফ্লোরেন্সকির কাহিনীটা সেরে ফেলা উচিত।
 জারের পতনের প্রথম ক’টি বছর ফ্লোরেন্সকি মোটামুটি নির্বিঘ্নেই তাঁর ধর্মকর্ম এবং তার পাশাপাশি গণিত ও বিজ্ঞানসাধনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মস্কোর ৪৫ মাইল দূরবর্তী সেইন্ট সারগির ট্রিনিটি মনাস্টারিতে। বিপ্লবের সময় জার আমলের দুচারজন হোমরাচোমরাসহ বেশ কিছু পাদ্রী-পুরোহিত সেখানে আত্মগোপন করেছিলেন প্রাণরক্ষার জন্যে। ফ্লোরেন্সকি লোকটার মনে বোধ হয় ভয়ভীতি বলে কোনও জিনিস ছিল না। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন চারদিকে সমানে ধরপাকড় চলছে ধর্মের গন্ধ পাওয়ার সাথে সাথে, সেখানে তিনি দিব্যি গোঁফে তেল দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁর জোব্বাজাব্বা পুরোতের পোশাক পরে। নেহাৎ মস্কোর বাইরে একটা নিরিবিলি জায়গা ছিল সেটা, নইলে এত সহজে ছাড়া পাবার কথা নয় কমুনিস্টদের হাত থেকে। অবশ্য লোকটার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মত চরম ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কোনও কথাবার্তা বা কার্যকলাপের প্রমাণ দাঁড় করানো যায়নি বলেও হয়ত ওরা চট করে পা বাড়াতে চায়নি। কিন্তু স্ট্যালিনের যুগে সেই বাধাটাও ভেঙ্গে যায়। ১৯২৮ সালে সোভিয়েট পুলিশ তদন্ত করতে আসে ফ্লোরেন্সকির বাড়ি ও তাঁর চার্চ। বড়িতে তখন তাঁর স্ত্রী ও সাতটি সন্তান। এবং কতিপয় পলাতক রাজকর্মচারী ও নামপূজারী। ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় ফ্লোরেন্সকির বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা চালানো হয় এই বলে যে তিনি নিজে ‘বুর্জোয়া’ হোন বা হোন, জার আমলের ঘৃণ্য বুর্জোয়াদের সমর্থক তিনি, তাদের আশ্রয়দাতা, অতএব তিনিও সমান দোষে দোষী। ২১শে মে’তে তারা তাঁকে বন্দী করে পাঠিয়ে দেয় সুদূর নিশ্নি নভগরড শহরে তিন বছরের নির্বাসনেসৌভাগ্যবশত সোভিয়েট ইউনিয়ানে সেসময় যেমন তাঁর শত্রুর অভাব ছিল না তেমনি কিছু শক্তিশালী বন্ধুও যে ছিল না তা নয়। তাঁদের মাঝে একজন ছিলেন বিখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির প্রাক্তন স্ত্রী ইয়াকেটারিনা পেশকোভা, যিনি ফ্লোরেন্সকির গুণগান গেয়ে একটি আবেদনপত্র পাঠান কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর শাস্তি মকুব করার জন্যে। তাতে তিনি জানান যে ভদ্রলোক কেবল একজন সৎ সজ্জন নাগরিকই নন, সোভিয়েট রাষ্ট্রের একজন অনুগত কর্মীও বটে। তিনি সোভিয়েট সামরিক বিভাগের পক্ষ নিয়ে তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কাজে লাগিয়েছেন উন্নততর যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্যে। তিনি একবার জারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বন্দীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্যে। তাইতো! জারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ জানায় সে আবার জারের সমর্থক হয় কি করে? অতএব তাঁর নির্বাসনের মেয়াদ কমিয়ে দুয়েক মাসের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হয়পরের গোটাচারেক বছর মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই কাটে তাঁর জীবন। কিন্তু তার মানে কি যে তাঁর শত্রুরা হার মেনে লেজ গুটিয়ে বসে থেকেছিল? না, মোটেই না। তারা ওঁৎ পেতে ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। সে সুযোগটি ফ্লোরেন্সকি সাহেব নিজেই ওদের হাতে তুলে দেন, তাঁর বেপরোয়া স্বভাবের জন্যে। একবার কিছুদিন নির্বাসনের অভিজ্ঞতা হওয়ার পর তাঁর যথেষ্ঠ সাবধান থাকা উচিত ছিল, যা তিনি থাকেননি। ধর্ম সম্বন্ধে সরকারের মনোভাব তাঁর ভাল করেই জানা ছিল, তবুও তিনি পাদ্রীদের পোশাক পরেই নানা জায়গায় ভ্রমণ করতে থাকেন। এমনকি সরকারি বিদ্যুতবিভাগের এক বিশেষ অধিবেশনে একটি বৈজ্ঞানিক পেপার পড়তেও তিনি সেই জোব্বাজাব্বা পোশাকই পরে যান। একবারও ভাবেনি লোকটা যে এসব করে কেবল শত্রুকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে। তাদের হাতে প্রত্যক্ষ প্রমাণ হয়ত আগে অতটা ছিল না; তাঁর উদ্ধত ব্যবহার সেই প্রমাণটি সোনার থালায় করে এনে দেয় তাদের কাছে। ১৯৩৩ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে প্যাভেল ফ্লোরেন্সকি দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হন পুলিশের হাতে। এবং এবার তারা ভাল করে কাছা বেধে মাঠে নেমেছে----কাগজপত্র যা যেখানে ছিল সব যোগাড় করে রেখেছে। তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগঃ এক, “ পাদ্রী-প্রফেসার, যে তার চিন্তাচেতনায় চরম ডানপন্থী, রাজতন্ত্রবাদী ব্যক্তি”; দুই, প্রতিবিপ্লবী পার্টি “ পার্টি অব রিবার্থ অব রাশিয়া”র সক্রিয় সদস্য। যার মানে দাঁড়ায় এই যে জারের শাসন ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র---অর্থাৎ সরাসরি দেশদ্রোহিতা। হাজতের জেরাঘরে যখন তাঁকে জেরা করছিলেন মস্কোর গুপ্ত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান, এবং এধরণের উদ্ভট অভিযোগগুলো একের পর এক শুনিয়ে গেলেন তাঁকে, তিনি তখন হাঁ করে থাকেন। “পার্টি অব হুয়াট? সদস্য হওয়া দূরে থাক, এর নামও তো শুনিনি আমি কোনদিন”।
 পুলিশকর্তা নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবলেনঃ শোননি বাছা, তাহলে এবার ভাল করেই শুনিয়ে দিচ্ছি। মজাটা বুঝবে এখন। শুরু হয়ে গেল অত্যাচার। যতরকম অত্যাচারপদ্ধতি জানা ছিল তাদের ভাণ্ডারে তার কোনটাই বাদ রাখা হয়নি। লোকটার মুখ দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা স্বীকারোক্তি আদায় করা, এই ছিল তাদের লক্ষ। রাশিয়ার তদানীন্তন কমুনিস্ট সরকারের গুপ্ত বাহিনীর সেসব পদ্ধতি খুব ভাল করেই রপ্ত করা ছিল। তাদের অবর্ণনীয় নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে বেচারি বাধ্য হয়ে সই করে দেন এক ভূয়া স্বীকারপত্রতেঃ “ আমি সোভিয়েট সরকারের নীতিমালা ও আইনকানুন লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অপরাধ স্বীকার করছিএই স্বীকারোক্তিতে আমি অনুশোচনা প্রকাশ করছি একটি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট দলের সঙ্গে বেআইনিভাবে জড়িত থাকার জন্যে”।
 ঘটনার বহুকাল পর কোনও এক নতুন যুগের আলোকে, ১৯৫৮ সালে, সোভিয়েট ইউনিয়ানের এক বিচারপতি ঘোষণা করেন যে, সেসময় প্যাভেল ফ্লোরেন্সকির মত একজন বড়মাপের সাধু সন্ন্যাসী বিজ্ঞানীর ওপর অত্যন্ত অন্যায় আচরণ করা হয়েছিল---মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে অকথ্য দুর্ভোগের শিকার করা হয়েছিল। 
 উত্তম কথা। কিন্তু তাতে ফ্লোরেন্সকি বেচারার কোনও লাভ হয়নি। ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে তাঁকে রেলবিভাগের একটি কয়েদি বগিতে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পূর্ব রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, আমুর নদীর ধারে, স্কভর্ডিনো নামক এক নাম-না-জানা শহরে। প্রথমদিকে বেচারা খুব মনমরা হয়ে থাকতেন। বেঁচে থাকাটাই যেন অর্থহীন হয়ে উঠছিল তাঁর কাছে। কিন্তু ফ্লোরেন্সকির মত একজন প্রখর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে কতদিন আর সম্ভব হয় “সৃষ্টিসুখের উল্লাস” থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখা? তিনি অচিরেই নেমে গেলেন সাইবেরিয়ার ওদিকটার আঞ্চলিক ভাষাগুলোর একটি অভিধানিক সঙ্কলন প্রস্তুত করার কাজে। ওই অঞ্চলের “পার্মাফ্রস্ট” বিষয়টিও তাঁর বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের আরো একটি মূল্যবান খোরাক হয়ে ওঠে----তাতেও বিস্তর পড়াশুনা শুরু করে দেন। কিন্তু এসব করে জেলকর্তৃপক্ষের মন গলানো যায়নি। তারা নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনামত তাঁকে পাঠিয়ে দেয় একেবারে তুন্দ্রা অঞ্চলে, শ্বেতসাগরের এক কুখ্যাত দ্বীপের সলোভেস্ক কারাগারে, যা সলসেনিশ্চির বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুলাগ আর্কিপেলেগো’র গুলাগেরই অন্তর্গত। সেটা ১৯৩৪ সালের কথা।
  এই দ্বীপটি কি এক অজ্ঞাত কারণে সেকালের সোভিয়েট সরকারের ভীষণ প্রিয় জায়গা ছিল তাদের ‘বিপজ্জনক’ বন্দীগুলোকে চালান করার জন্যে। বিপজ্জনক বন্দীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সত্যিকার সৃষ্টিশীল শ্রেণীটি----লেখক, শিল্পী, গাণিতিক, বিজ্ঞানী, স্থপতি, ভাস্কর, সঙ্গীতজ্ঞ---এঁরা। এঁরা নিজেরা রাস্তায় নামেন না, কিন্তু অন্যদের নামাবার ক্ষমতা ধারণ করেন, সেটুকু বুঝবার মত ঘিলু ওদের মস্তিষ্কে ছিল। ফ্লোরেন্সকিকে তো ওরা পরিষ্কার বলেই ছিলঃ “হ্যাঁ আমরা জানি আপনি সরাসরিভাবে কখনো কোনও রাষ্ট্রবিরোধিতা করেন নি। কিন্তু আমরা জানি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মে লিপ্ত হওয়ার “সম্ভাবনা” আপনার আছে। আমাদের দায়িত্ব আপনার অপরাধ “প্রমাণ” করা নয়, অপরাধের সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠিত করে তাকে বিদূরিত করা। সেকারণেই আপনাকে ধরে নিয়ে এসেছি আমরা”।
 নির্জন দ্বীপের সীমাহীন নিঃস্তব্ধতার মাঝে সৃষ্টিশীল লোকেরা কিভাবে সময় কাটাতেন? কিভাবে আবার? নতুন কোনও সৃষ্টির পথ খুঁজে। নতুন কোনও অসম্ভাব্য জীবনের পথ খুঁজে। কল্পনার কোনও নতুন সুড়ঙ্গের সন্ধান খুঁজে খুঁজে। আমাদের ফ্লোরেন্সকি সাহেবও ঠিক তাই করছিলেন। সেখানে তিনি একটা ছোটখাটো নাট্যগোষ্ঠী তৈরি করে ফেললেন। একটা ছোটখাটো পাঠাগার। একজায়গায় গোল হয়ে বসে ভবিষ্যতের মানচিত্র আঁকার চেষ্টা করেনকিন্তু, সেকালের রাষ্ট্রচালকদের কাছে সেসবের কোন মূল্যই ছিল না। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিকে কোন এক সময় জেলকর্তৃপক্ষ তাঁকে নিয়ে যায় লেনিনগ্রাডের বড় কারাগারে, সোভিয়েট গুপ্ত পুলিশবাহিনীর হেডকোয়ার্টার যেখানে। সেখানে কয়েকদিন রাখার পর তাঁকে উলঙ্গ করে, হাতদুটি পেছনদিকে বেঁধে, আরো শ’কয়েক বন্দীসহকারে, মালবাহী ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় ২০ মাইল দূরবর্তী এক নিরালা জায়গায়। সেখানে সবাইকে লাইনবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াড তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। এই অবিশ্বাস্যরকম বর্বর কাহিনীগুলো বহুদিন পর্যন্ত চেপে রাখা হয়েছিল। ২০০২ সালে রাশিয়ার মানবাধিকার সংস্থা পুরনো সরকারি কাগজপত্র ঘাঁটাঘাটি করে এই তথ্যগুলো উদ্ধার করেছে।
 এবার দেখা যাক নিকোলাই লুজিনের কপালে কি ছিল। বেচারা এমনিতেই একটু ভীতু প্রকৃতির মানুষ, তার ওপর চোখের সামনে দেখেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক এগরভকে ধরে নিয়ে যেতে, দেখেন তাঁর সহপাঠী ও প্রিয় বন্ধু প্যাভেল ফ্লোরেন্সকিকে ধরে নিয়ে যেতে। তিনি বুঝতে পারছিলেন এবার নিশ্চয়ই তাঁর পালা। এমনই এক ভয় ঢুকে গিয়েছিল তাঁর মনে যে কোন কাজেই মন বসাতে পারছিলেন না। ভয় একসময় গা-কাঁপানো আতঙ্কে পরিণত হয়। ফলে তাঁর মানসিক ভারসাম্য খানিকটা নষ্ট হতে শুরু করে। তাঁর এসময়কার মানসিক অবস্থার বর্ণনা করেছিলেন তাঁর সহযোগী গাণিতিক খিঞ্চিন (রাশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত গাণিতিক) এভাবেঃ “ তিনি প্রাণের ভয়ে ভীষণ কাতর হয়ে পড়েছিলেন। এতটাই কাতর যে রীতিমত থরথর করে কাঁপতেন, সেকাঁপুনি এখন পর্যন্ত (১৯৩৬) দেখতে পাচ্ছি আমরা”।
 লুজিন ছিলেন আগাগোড়া একজন সৎ মানুষ---ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, গাণিতিক জীবনেও তাই। গণিতের পাশাপাশি তাঁর একটা আধ্যাত্মিক জীবনও ছিল, এবং তাতেও তাঁর আন্তরিকতার কোনও ঘাটতি ছিল না। কিন্তু এগরভ আর ফ্লোরেন্সকির মত তিনি সেসব বড়গলায় প্রচার করে বেড়াতেন না। তিনি স্বভাবতই একজন সাবধানী পুরুষ ছিলেন। গণিতের সঙ্গে ধর্মীয় দর্শনের যে একটা সূক্ষ্ণ যোগসূত্র আছে সেটা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন বটে, কিন্তু তা নিয়ে অনর্থক লোকের কাছে বলাবলি করে বেড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন না। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যে আদ্যোপান্ত বদলে যাচ্ছে সেটা তিনি অনুভব করতে পারছিলেন। সুতরাং সাবধানতা অবলম্বন করাটা বিচক্ষণই নয় কেবল, রীতিমত জরুরি। তাই ১৯২২ সাল থেকেই তিনি তাঁর ভেতরের কথাগুলি বাইরের লোকের কাছে লুকিয়ে রাখতে শুরু করেছিলেন। ১৯২৯ সালে তো মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাই ছেড়ে দেন। তার বড় কারণ তাঁর নতুন যুগের রক্তগরম ছাত্ররা। তারা সবাই মার্ক্সিজমে পূর্ণমাত্রায় দীক্ষিত---পুরনোদের প্রতি স্বভাবতই সন্দিহান, এবং আগেকার ভক্তিশ্রদ্ধাও প্রায় অনুপস্থিত। তারা সুযোগ পেলেই প্রফেসারের খুঁত ধরার চেষ্টা করে, এবং সেটা তারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাচার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। তার চেয়ে বরং তাদের সংস্পর্শ একেবারেই ছেঁটে ফেলা উচিত, ভাবলেন তিনি। ছাত্র এলাকার বাইরে, অপেক্ষাকৃত ‘নিরাপদ’ একাডেমি অফ সায়েন্সেতে আশ্রয় খোঁজেন। সেসময় লুজিন একজন গণমান্য সদস্য একাডেমির। গণিত জগতে তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি। মানমর্যাদার দিক থেকে তখন তিনি দিমিত্রি এগরভের চাইতে কোন অংশেই কম নন। ভাবলেন, সেখানে নিশ্চয়ই কেউ তাঁর ক্ষতি করতে সাহস পাবে না।
   কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে হয়তবা ক্ষতি করবার মত ক্ষমতাশীল লোক সেখানেও ছিলেন---সাক্ষাৎ যমের মত যার উপস্থিতি সেখানে। তাঁর নাম আর্ন্সট কোলম্যান। এগরভ ছিলেন সেলোকটার বড় কাঁটা। সেই কাঁটাটি সাফল্যের সাথে সরাতে পারার পর তিনি মনোযোগ দেন লুজিনের প্রতি। পথ খুঁজতে থাকেন কিভাবে লুজিনকে অপদস্থ করা যায়---রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও গাণিতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, উভয়দিকে। মূল উদ্দেশ্য, কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণ দাঁড় করানো যে এই লুজিন মানুষটি সোভিয়েট রাষ্ট্রের মৌলিক মার্ক্সিস্ট ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতিহীন, যে একটি গুপ্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, যার মতামত নবযুগের সোভিয়েট চিন্তাধারার বিপরীত। তাতেই ক্ষান্ত হননি কোলম্যান, তিনি লুজিনের গণিত নিয়েও নানারকম প্রশ্ন তোলেন। গণিতের মান কতটা ওপরে বা নিচে তা নিয়ে নয়, গণিতের লক্ষ নিয়ে। কোলম্যান ছিলেন মার্ক্সিস্ট চিন্তাধারার অন্ধ সমর্থক----এখানে তাঁর সাথে ধর্মীয় অন্ধদের খুব একটা পার্থক্য ছিল না। জীবনের প্রতিটি বিষয়ই মার্ক্সিস্ট লক্ষ দ্বারা চালিত হবে এই আদর্শ তিনি প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এবং তা থেকে গণিত কোনও ব্যতিক্রম নয়। বিশুদ্ধ গণিত, যা বাস্তব জীবনের সঙ্গে কোনভাবে সংশ্লিষ্ট নয়, তার প্রয়োজনীয়তা, এমনকি অস্তিত্ত্বও তিনি স্বীকার করতেন না। সত্যিকার গণিত মানুষের অলস কল্পনার ফসল নয়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল, এই বস্তুবাদী মন্ত্রে তিনি গভীরভাবে বিশ্বাসী। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তথাকথিত ‘বিশুদ্ধ গণিত’ বুর্জোয়া মনেরইএক বিকৃত সৃষ্টি, যা আধুনিক সোভিয়েট সমাজের জন্যে ক্ষতিকর।
 সমস্যা ছিল যে লোকটা লুজিনকে আক্রমণ করছিলেন তাঁর নিজেরই খেলার মাঠে----গণিত ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে। যেহেতু কোলম্যান নিজেও একজন সম্মানিত গাণিতিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন দেশে, (যদিও লুজিন বা অন্যান্য বিশিষ্ট সমসাময়িক গাণিতিকদের তুলনায় একেবারেই বামনসম), এবং যেহেতু তিনি ছিলেন অত্যন্ত অনুগত একজন পার্টি সদস্য, সেহেতু তাঁর অবাধ যাওয়া-আসা ছিল গণিত মহলের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত। বিশেষ করে লুজিনের নিজস্ব এলাকা---মস্কো ম্যাথেমেটিক্যাল কংগ্রেস। সেখানে গিয়ে কোলম্যান সাহেব আস্তে আস্তে লুজিনের আসন টলানোর চেষ্টাতে কলকব্জা ঘুরাতে থাকলেন। তাঁকে আক্রমণ করতে থাকলেন গাণিতিক গবেষণা নিয়েই। লুজিনের গণিতের লক্ষ কি? প্রশ্ন তোলেন তিনি। পুরনো মুনিব জারের অন্ধ বশ্যতা ছাড়া আর কি উদ্দেশ্য সাধন করতে পারছে লুজিনের সেই মার্বেল পাথরের প্রাসাদে স্থাপিত গণিত? লুজিন তাঁর ভাল ভাল পেপারগুলো প্রকাশ করেন ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলোর পত্রিকাতে, আর তাঁর নিম্নস্তরের লেখাগুলো পাঠান স্থানীয় সোভিয়েট কাগজে (যে অপরাধে শুধু লুজিনই নয়, সেসময়কার সব বড় বড় রাশিয়ান গাণিতিক-বিজ্ঞানীই অপরাধী ছিলেন), যাতে করে বোঝায় লুজিন কতটা হেয় করে দেখেন তাঁর নিজের দেশকে। সর্বোপরি লুজিন প্রচণ্ডরকম ধর্মঘেঁষা মানুষ, ফ্লোরেন্সকির মত ঘৃণ্য পাদ্রীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব, এগরভের মত নামপূজারিদের সঙ্গে ছিল তাঁর নিত্য উঠাবসা। কোলম্যান লোকটার এতই ছোট মন যে লুজিন যে পেশাগত ও ব্যক্তিগতভাবে ফ্রান্স ও জার্মানীর অনেক গণ্যমান্য গাণিতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সেটাকেও তিনি দেখাতে চাইলেন অতিরিক্ত পশ্চিমপ্রীতির, অতএব স্বদেশবিমুখী, প্রবণতা হিসেবে। তারপর যখন হিটলারের হাতে জার্মানীর শাসনক্ষমতা চলে যায় ১৯৩৩ সালে, তখন তিনি যেন এক নতুন অস্ত্র পেলেন হাতে----যেহেতু জার্মানীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন লুজিন সেহেতু তিনি হয়ত গোপনে গোপনে হিটলারকেও সহায়তা দিচ্ছেন তাঁর গাণিতিক জ্ঞানের মাধ্যমে। যা ছিল সেসময়কার উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহাওয়াতে অত্যন্ত মারাত্মক অভিযোগ।
 দুঃখের বিষয় যে লুজিনের শত্রু তখন চতুর্দিকে। এমনকি তাঁর পুরনো ছাত্ররাও, যারা একদিন তাঁকে নায়কের মত করে ভেবেছে, যারা তাঁর গাণিতিক-সাংস্কৃতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, উপকৃত হয়েছে, তারাও। সবচেয়ে নিকৃষ্ট পথ অবলম্বন করেছিলেন আন্দ্রোপভ নামক এক প্রাক্তন ছাত্র, অত্যন্ত মেধাবী ও পরবর্তীকালে গণিতের টপলজি শাখাতে বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন ছাত্র, কি কারণে যেন ভীষণ হিংসাপরায়ন ছিলেন লুজিনের প্রতি। লুজিনের নামটাই যেন সহ্য করতে পারতেন না। আন্দ্রোপভের এরকম বিরূপ মনোভাবের উৎসটা কোথায় সে নিয়ে অনেকেই চিন্তাভাবনা করেছেন। হয়ত কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে----মেয়েরা লুজিনের জন্যে পাগল ছিল, তাঁর জন্যে ছিল না, তা’ও হতে পারে। আবার আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং মানসম্মানের দিক থেকেও লুজিন অনেকটাই ওপরে, এটাও হয়ত তাঁর সহ্য হয়নি। যা’ই হোক, লুজিনের বিরুদ্ধে তাঁর নিজের রাগ মেটানোর জন্যে খুবই উৎসাহের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দেন কোলম্যানের প্রতি। ত্রিশ দশকের শেষ দিকে লুসিটানিয়া ভেঙ্গে গেছে---লুজিন তখন অধ্যাপনা ছেড়ে শুধুমাত্র গবেষণাতে লিপ্ত। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংশ্রব প্রায় পুরোপুরিই ছিন্ন। কেবল স্নাকতোত্তর পরীক্ষাদির সময় তাঁর একটা বড় ভূমিকা ছিল বটে। যেমন থিসিস পরীক্ষা। পরীক্ষার অংশ হিসেবে পরীক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা তাদের গবেষণা নিয়ে। সেখানে তিনি কাউকে কোনও পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন না----গাণিতিক মানের দিক থেকে তিনি একেবারেই নিরাপস। নিম্নমানের কোনও প্রার্থীকে তিনি সহজে ছাড় দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না। সেকারণে বেশ কিছু ছাত্র, যারা সাথে সাথে  পার্টি রাজনীতিতেও জড়িত ছিল, তারা তাঁকে একহাত দেখিয়ে দেবার জন্যে ওঁৎ পেতে ছিল। কোলম্যানের উৎসাহ পেয়ে তারাও সদলবলে যোগ দিতে আসে তাঁর সঙ্গে। উপরন্তু কংগ্রেসের ভেতরেই কিছু শত্রু গড়ে উঠেছিল লুজিনের। তাদের কেউ কেউ আশা করেছিলেন কংগ্রেসের সদস্য পদে মনোনীত হয়ে যাবেন, যা অতি বড় এক সম্মানের পদবী ( অনেকটা ফেলো অফ দ্য রয়েল সোসাইটির মত)। কিন্তু লুজিন সহজে কাউকে মনোনয়ন করতে চাইতেন না, যথেষ্ট উঁচুমানের গবেষণা ও নামধামের পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত। অতএব সেখানেও তাঁর মিত্রের অভাব। তার মানে চতুর্দিক থেকে তাঁর গলায় দড়ি বাঁধবার উদ্যোগ আয়োজন চলছিল তাঁর অজান্তে। কোলম্যান নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছিলেনঃ ‘বাছাধন, এবার ধরেছি তোমায়’।
 শত্রুনিধনের জন্যে এমনই গাঁট বেঁধে লেগেছিলেন তিনি যে গায়ের শেষ রক্তবিন্দুটুকু শুষে না নেয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবেন না।  তাঁর সর্বশেষ চাল হিসেবে কাজে লাগালেন কমুনিস্ট পার্টির সরকারি পত্রিকা ‘প্রাভদা’র সম্পাদক মেখলিসকে। প্রথমত মেখলিসের কানে নানারকম কুৎসা ঢেলে লুজিনের বিরুদ্ধে গুটিকয় লেখা ছাপানোর আয়োজন করেন ‘প্রাভদা’য়। তাতে করে সাধারণ নাগরিকরাও সচেতন হয়ে ওঠেন যে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি মস্কোর গণিত পরিষদের সর্বোচ্চ আসনে বসে দেশের শত্রুতা চালিয়ে যাচ্ছে। গণিত জগতের তো কথাই নেই---তাঁরা যাকে সম্মানের শীর্ষস্থানে বসিয়ে রেখেছিলেন এতদিন সেই মানুষটি এতটা নিচে নেমে যান কেমন করে, তাঁরা ভাবতে থাকেন। বিভিন্ন গাণিতিক সংস্থা থেকে জরুরি সভার আয়োজন করা হয় ‘লুজিন সমস্যা’র কিভাবে সমাধান করা যায়, সেটা নিয়ে আলাপ করতে। মানে একটা সোরগোল পড়ে যায় চতুর্দিকেঅনেকেই এগিয়ে আসে লুজিনের বিরুদ্ধে একটা-না-একটা অভিযোগ নিয়েখন সোভিয়েট একাডেমি সাইয়েন্সের কর্মকর্তারা বুঝতে পারলেন যে বিষয়টা নিয়ে জরুরি বৈঠক করা দরকার। একাডেমির সহসভাপতিদের মধ্যে ক্রিশানোভস্কি নামক এক ভদ্রলোকের ওপর ভার দেওয়া হয় ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত তদন্ত করার জন্যে। তাঁর সভাপতিত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় যাতে ছিলেন লুজিনের সহকর্মীসহ এগারোজন সদস্য। সদস্যদের মধ্যে সবাই যে লুজিনের বিপক্ষে ছিলেন তা নয়, কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক আবহাওয়া এতই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যে তাঁর বিরুদ্ধে মুখ না খোলাটাও যেন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য তাঁর ঘোর শত্রুও যে ছিল না তা’ও নয়। এঁদের মধ্যে ছিলেন তিনজন প্রসিদ্ধ গাণিতিক---আন্দ্রোপভ, শার্লমেন ও খিঞ্চিন। এঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিভা। কিন্তু এঁদের মত মানুষ যে কেন এমন উঠেপড়ে লেগেছিলেন লুজিনের মত একজন ক্ষণজন্মা গাণিতিকের জীবন ধ্বংস করতে সেরহস্য বড়ই দুর্বোধ্য মনে হয়। সদস্যদের বেশির ভাগই ছিলেন কমুনিস্ট পার্টির সঙ্গে কোন-না-কোনভাবে জড়িত, অতএব তাঁরা যে কোলম্যানের দিকেই ঝুঁকবেন তা ধরেই নেয়া যায়। দুয়েকজন সদস্য হয়ত মনে মনে লুজিনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, কিন্তু তাঁরা সাহস করেননি অন্যদের বিপক্ষে কথা বলতে। সেসময় নিনা বারি, সেই মহিলাটি, লুজিনের প্রিয় ছাত্রী, যার প্রতি তাঁর একটা গোপন দুর্বলতা হয়তবা ছিল (নিনার যে ছিল সেটা কারুরই অজানা ছিল না), এবং যে তার নিজেরই উৎকৃষ্ট কাজ দ্বারা ইতোমধ্যে বিশ্বপরিচিতি লাভ করে ফেলেছিলেন, তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না লুজিনের তদন্ত কমিটিতে অংশ নিতে। ‘যে লোকটিকে আমি মনের মধ্যে উচ্চ আসনে স্থাপন করে এসেছি, যার কাজ ও কথা আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে রেখেছে, তার কোনও ক্ষতি করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না’। এ নিয়ে কমিটির এক সদস্য লুজিনকে খোঁটা দিয়েছিলেন পরেঃ “আপনার সেই প্রাণের মানুষটি, যার নাম আমি করতে চাইনা এখানে”। (বহু বছর পর, লুজিন যখন প্রয়াত, এবং তাঁর গবেষণা কাজের পূর্ণ সঙ্কলন বের হয়ে গেছে বাজারে নিনা বারিরই উদ্যোগ ও সম্পাদনায়, তিনি আত্মহত্যা করেন মস্কোর পাতাল ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েসেই করুণ কাহিনী কেবল টলস্টয়ের এনা কারেনিনার কথাই মনে করিয়ে দেয়।)
তদন্ত কমিশনের প্রথম কি দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে লুজিনের সহকর্মীদের মাঝে একমাত্র বার্নস্টিন ছাড়া কেউ তাঁর পক্ষ নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাননি, বা বলতে সাহস করেননি---লুজিন যে রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি খ্যাতিশীল গাণিতিক সেসময় সেই কথাটুকুও যেন সবাই ভুলে বসেছিলেনএমনকি পরবর্তীকালের কিংবদন্তী গণিতবিশারদ, সবলেভ, কল্মগরভ, খিঞ্চিন, লুস্টার্নিক, তাঁরাও। এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে। মেধায় যাঁরা পর্বতপ্রমাণ তাঁরা কেন মাঝে মাঝে নেমে আসেন কাদায় মাটিতে মানবচরিত্রের সে এক দুর্ভেদ্য রহস্য
 লুজিনের আন্তর্জাতিক খ্যাতির পেছনে তাঁর ফরাসী বন্ধুদের হাত ছিল অনেকটাইবোরেল, লেবেগ, বেয়ার, এঁরা সবাই লুজিনের গভীর চিন্তামূলক কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তাঁর গবেষণা দ্বারা উপকৃত হয়েছেন পৃথিবীর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। প্যারিসে তাঁর বিশেষরকম সম্মান সেসময়। ভাগ্যের এমনই অদ্ভুত বিড়ম্বনা যে সেই সম্মানটিও তাঁর মস্কোর শত্রুদের হাতে একটি অস্ত্রের মত হয়ে দাঁড়ালো। তাঁরা ওঁকে পশ্চিমের পা-চাটা দালাল বানিয়ে ফেললেন। পশ্চিমের বুর্জোয়া ধ্যানধারণার প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও সমর্থন প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। অর্থাৎ যতভাবে লোকটাকে ঘায়েল করা সম্ভব তার কোনটাই তাঁরা বাদ রাখেননি। এবং এসবের ফলাফল কি দাঁড়ালো শেষ পর্যন্ত সেটা তো বলাই বাহুল্য। রায় বেরুলঃ তিনি দোষী! হ্যাঁ, লুজিন রাষ্ট্রদ্রোহী। দেশের শত্রু। তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার, ইত্যাদি বলে কমিশনের সভাপতি সাহেব তাঁর সুপারিশ পাঠিয়ে দিলেন একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মলোটভের কাছে। ব্যাপারটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে মলোটভ সাহেব নিজে থেকে এর কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে বড়কর্তা, অর্থাৎ স্বয়ং স্ট্যালিনের সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করলেন। সাধারণত স্ট্যালিনের মেজাজটা এরকম ছিল যে তাঁর বা তাঁর দেশের সামান্যতম ক্ষতি করার সম্ভাবনা যখনই দেখতে পেতেন কোথাও, বাস্তব আর কাল্পনিক যা’ই হোক, তৎক্ষণাৎ তার একটা বিহিত করার ব্যবস্থা নিয়ে ফেলতেন---মানে ফায়ারিং স্কোয়াড। কিন্তু লুজিনের ব্যাপারে একটু চিন্তায় পরে গেলেন ভদ্রলোক। তার কারণ ছিল। একটা গোপন চিঠি পেয়েছিলেন তিনি পিটার ক্যাপিটসার কাছ থেকে, যাতে ক্যাপিটসা লিখেছিলেন যে লুজিন একটি অমূল্য সম্পদ সোভিয়েট রাষ্ট্রের জন্যে----দেশকে তিনি অনেককিছু দিয়েছেন, এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু দেবার সম্ভাবনা আছে। ঠিক আছে, লুজিন নাহয় একটু বেয়াড়া গোছের মানুষ, আজেবাজে জিনিস নিয়ে সময় কাটায় মাঝে মাঝে, কিন্তু তাই বলে তিনি জেনেশুনে দেশের ক্ষতি করবেন সেরকম চরিত্র নিশ্চয়ই তিনি নন। ক্যাপিটসা আরো বললেনঃ “ ভেবে দেখুন একবার আইজ্যাক নিউটনের কথা, যিনি আমাদের হাতে দিয়েছেন মাধ্যাকর্ষণ তত্ব। অথচ লোকটা ছিলেন পাঁড় ধর্মান্ধ। তারপর ইতালির বিখ্যাত কার্ডিয়ানো, গণিতে যার অসামান্য অবদান, তিনি ছিলেন একজন অসচ্চরিত্র নচ্ছার ব্যক্তি। এই লোকগুলি যদি আজকে সোভিয়েট ইউনিয়ানের নাগরিক হতেন তাহলে আপনি কি করতেন ওঁদের নিয়ে? গুলি করে মেরে ফেলতেন,না, দেশের ভেতর আটকে রেখে ওদের বলতেন, এবার বাছারা, ঘরে বসে তোমাদের জ্ঞানসাধনা চালিয়ে যাও?” ক্যাপিটসার নিজেরও সেরকম অভিজ্ঞতা ছিল ‘ঘরে বসে সাধনা’তে লিপ্ত থাকা কাকে বলে। তিনি একসময় কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেণ্ডিস ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন, এবং মনে মনে বাকি জীবনটা ইংল্যাণ্ডেই কাটিয়ে দেবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু স্ট্যালিনের মনে ছিল অন্য ভাবনা। ১৯৩৪ সালে ক্যাপিটসাকে একরকম বাক্সবন্দী করে মস্কোতে নিয়ে যায় সোভিয়েট গোয়েন্দাবাহিনী। অর্থাৎ ঘরের ছেলে ঘরেই নির্বাসিত! ক্যাপিটসা সোভিয়েট ইউনিয়ানের নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের অন্যতম, পদার্থবিদ্যায়।
 হ্যাঁ, স্ট্যালিন ক্যাপিটসার কথার যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিতেন। তার ওপর তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোলম্যান লোকটাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। জানতেন যে লোকটা একটু কুটিল প্রকৃতির---নিজের উদ্দেশ্যসাধনের জন্যে যে-কারো বিরুদ্ধে একটা ভূয়া মামলা ফাঁসিয়ে দেবার মত কুচক্রী মানুষ তিনি বরাবরই। যাই হোক, কোলম্যান বা তদন্ত কমিশনের সুপারিশ, কোনটাকেই খুব একটা দাম দেননি তিনি যতটা দিয়েছিলেন ক্যাপিটসার কথাগুলোকে। ফলে লুজিন রক্ষা পেয়ে যান। তাঁর প্রস্তাবিত শাস্তি মকুব করা হয়। শর্ত শুধু এই যে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে, ধর্মচর্চা বন্ধ করতে হবে, সুশীল বালকের মত ঘরে বসে কেবল জ্ঞানসাধনা করে যেতে হবে, যাতে তার দেশের উপকার হয়, দেশের সুনাম হয়।
এবং নিকোলাই লুজিন ঠিক সেভাবেই কাটিয়েছিলেন বাকি জীবনটা। এরপর তাঁর কোনও পেপার পশ্চিমের জার্নালে প্রকাশিত হয়নি---সব সোভিয়েট কাগজেই।
সূত্রঃ “Naming Infinity” A true story of religious mysticism and mathematical creativity, by Loren Graham and J.M. Kantor, Harvard Unversity Press, Cambridge, Mass. USA, 2009
ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে তোলা।
অটোয়া, ৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
মুক্তিসন ৪৩



 মীজান রহমান

No comments:

Post a Comment