Tuesday, 4 February 2014

ফড়িং-ধরা বিকেল ♥♪♥


নূরুন্ নাহার

#বইএর নাম: ফড়িং-ধরা বিকেল।
লেখক: নূরুন্ নাহার।
আমার কথা-  আমি সবার ছোট-বড় কষ্টের সারাবেলার মানসিক সাথী।

♥♪♥ উত্‍সর্গ : পাঠককে।
স্মৃতিরা সব সময় পেছনের হয়। সেই পেছনের স্মৃতিগুলো সামনে এনে পাঠকের সাথে একাত্বতাই আমার আদর্শ উদ্দেশ্য।

প্রকাশকাল: ২০১৪ ফেব্রুয়ারী ০৪


♥♪♥ 

ফড়িং-ধরা বিকেল।
ছবি: shobdoneer.com

যাদের কাছে কৃতজ্ঞ

১/ যে আমাকে বহু যোজন দূর থেকে, মধ্য রাতে, যখন পৃথীবির সব প্রাণের সাড়া থেমে যায়, সেই সাড়াহীন সময়ে মুঠো ফোনে শব্দ ছড়িয়ে আমাকে রাতের পর রাত অনেক আন্তরিকতার ছোঁয়ায় লেখার পেছনে প্রেরণা দিয়েছে। এ প্রেরণার দায়ভার ছিল অনেক। এ দায়ভার আমাকে ওর কাছে রীতিমত ঋণী করে তুলেছে। প্রেরণার এমন তুলনা আর কোথাও মেলেনা।
কখনো হয়তো লিখতে পারছিনে, মাথা কাজ করছেনা, কাজের ব্যস্ততা অথবা শরীরটা খুব খারাপ। সেই অবস্থায় ও হয়তো বলছে, “আপা লিখছো তো? লেখা কতদূর? ওকে খুশি করতেই এবং ওর প্রেরণার মূল্যায়ন করতেই বার বার বলেছি, “হ্যাঁ চেষ্টা করছি”। ওর তুলনাহীন প্রেরণার পরিমি ঋণ পরিশোধ করতেই অনেক কারণে আমার থেমে যাওয়া কলম আবার হাতে ধরেছি

ও হলো আমার ভাইয়ের সারিতে দ্বিতীয়।
ড: শফিউল ইসলাম।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার(পি.এইচ.ডি.)
কানাডা প্রবাসী।               

২/ আবার যে আমাকে তাঁর সংগ্রহ থেকে কিছু বই পড়তে দিয়ে আমার এ লেখার মাপকাঠিতে অভিজ্ঞতা দিয়েছে।
যেমন-
  • বিদিশার -শত্রুর সাথে বসবাস।
  • এ ই হোশনার- আনুবাদ- খায়রুল আলম সবুজের--সোফিয়া লরেন, তাঁর আপন কথা।
  • নূরজাহান বোসের -আগুনমুখার মেয়ে।          

সে হলো আমার মায়ের মতো বড় বোন।
ডা: শামসুন্ নাহার।
ডেনটিস্ট।
ঢাকাতে বসবাস।
                  
৩/ এর পর যে আমাকে হুমায়ুন আজাদের “কিশোরসমগ্র” উপহার দিয়ে এ লেখার ধারাবাহিকতায় ছন্দ ফোটাতে সহযোগিতা করেছে এবং আমার এ স্মৃতিকথার ভূমিকা লেখার জন্য তাঁর ছকে বাঁধা সময় থেকে কিছুটা সময় চুরি করে ছুটে গিয়েছে খুব ব্যস্তময় মানুষ শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক আনিসুল হকের কাছে।
        
সে হলো আমার ছোট ভাই।
শফিকূল ইসলাম বাহার।
বিশিষ্ট আবৃত্তিকার, উপস্থাপক--রেডিও, টেলিভিশন।
এবং বিভিন্ন মিডিয়ার সাথে জড়িত।
       
৪/ তারঁপর যে আমাকে তাঁর ডাগর ডাগর চোখ কমপিউটরের পর্দায় রেখে ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে এ লেখা ইমেল করে কানাডাতে পাঠিয়ে আমাকে ধন্য করেছে।
     
সে হলো আমাদের পরিবারের ছোট বউ।
তাপসী মুনির।
     
৫/ সব শেষে যিনি আমাকে তাঁর সব রকম ব্যস্ততার ভার মাথায় রেখে এক চিলতে সময়ের সুযোগ করে নিয়ে আমার এ লেখার ভূমিকায় কালির আঁচড় টেনেছেন তিনি হলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক -আনিসুল হক।
তাঁর কাছে আমি কৃতঞ্জতায় একেবারে নত।

গৌরচন্দ্রিকা 


নূরুন্ নাহারের 'ফড়িং-ধরা বিকেল' একটা অপূর্ব গ্রন্থ - অপরূপ ও অভিনব! শৈশবের স্মৃতিকথাই লিখেছেন লেখক, কিন্তু লিখেছেন নতুনতর এক আঙ্গিকে, আর মর্মস্পর্শীভাষায়। স্মৃতিমেদুর এই লেখা পাঠকমাত্রকেই স্পর্শ করবে, স্মৃতিকাতর করে তুলবে, নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন করবে। লেখক শৈশব কাটিয়েছেন বেনাপোলের সীমান্ত এলাকায়, পিতার চাকরির সূত্রে। সেখানকার উদার প্রকৃতি, সবুজ মাঠ, নীল আকাশ, ঘাস, ফড়িং, লতাপাতা আর মানুষজন ভিড় করে আছে এই লেখায়। ছোট ছোট মানবিক সম্পর্ক, তার টানাপড়েন লেখার গুণে অসাধারণ হয়ে উঠেছে। এত সুন্দর গদ্য-- চমত্‍কার ছোটবড় বাক্য, কোথাও কোথাও একটু কাব্যিক-- আমি বহুদিন পড়ে উঠি নি।
নূরুন্ নাহারকে অভিবাদন এত চমত্‍কার একটি বই আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।
::
আনিসুল হক 



১/ ফড়িং-ধরা বিকেল।(স্মৃতির মেলা থেকে)
[♥♪♥ উত্‍সর্গ প্রীতিলতা ও সূর্যসেন - যাদের দেশপ্রেম এখনো সাহস ও প্রেরণা যোগায়]
সেই কবে শৈশবে বাবার হাত ধরে নাচতে-নাচতে, গাইতে-গাইতে পাশাপাশি বেড়ে ওঠা আমরা দু’বোন এসেছিলাম বেনাপোল বর্ডারে।
বাবা ছিলেন সৎ কর্তব্যপরায়ণ একজন কাস্টম-অফিসার। ত্যাগী ছিলেন কিনা জানিনে, তবে ভোগী ছিলেননা মোটেও। বাবা খুব অল্পতেই তৃপ্ত হতেন, তাই চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব তাঁকে অনেকখানি ছাড় দিয়েছিলো বুঝি।
কাস্টম-কলোনির পুরো পরিচালনার দায়িত্ব ছিলো বাবার উপরে। বাবার পরিচালনায় কাস্টম-কলোনির পরিবেশ ছিলো মমতায় বাঁধা। আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াত বাবার সুনাম। আমরা ছিলাম কলোনির দশ নম্বর বাসায়। বর্ণমালার সাথে কথা হয়েছিল বুঝি, বেনাপোল কাস্টম-কলোনি স্কুলেই। বর্ণমালার সাথিরা ছিলো মন ছুঁয়ে। কলোনি জুড়ে সবার সাথে ছিলো আত্মার সম্পর্ক।
আমরা সারাদিন কলোনির মাঠে-ঘাটে হৈ-হৈ করে ঘুরে বেড়াতাম। দুপুর গড়িয়ে গেলেই প্রজাপতি-রংয়ের জামা পরে কলোনির সাথিদের সাথে দল বেঁধে হারিয়ে যেতাম সবুজ-মাঠে, ফড়িং ধরা বিকেলে। পাল্লা দিয়ে ছুটোছুটি করে ফড়িং ধরতাম আমরা কত রংয়ের যে ফড়িং। খুশিতে এলিয়ে পড়তাম একজনের গায়ের উপরে আর একজন। তারপর আনন্দে হারিয়ে যেতাম রেললাইনের ধারে পাথরের বুকে।
আহা! কি যে সুখ ছিল সেই সুরেলা জীবনে। সুখ ছিল যেন অথৈ, আনন্দ ছিল যেন থৈ-থৈ।
আজ জীবনে বেসুর সুর শুনি। তালহীন সে সুর। আজ বার বার মনে হচ্ছে, কোথায় ফেলে এসেছি সেই আনন্দ-জড়ানো দিনগুলি। বিষাদে ভরে ওঠে মনটা। অনেক প্রশ্নেরা এসে বুকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে, বিষাদের বিষদাঁত ভেঙে আমরা কি কনো দিন ফিরে যেতে পারব না সেই আনন্দ-ছোঁয়া স্মৃতির দেশে?
স্মৃতিরা চোখ মেলতেই দেখেছিলাম বেনাপোল বর্ডার, বাবার রচিত কাস্টম-কলোনি, রেললাইনের ধার, সবুজ মাঠ, আর ফড়িং ধরা বিকেল।
আবারও ইচ্ছে করে সেই বর্ণমালার সাথীদের সাথে গলাগলি ধরে, অর্থহীন জীবনের দাঁড়িপাল্লা ছিঁড়ে, বেসুরো জীবনের বিষদাঁত ভেঙে, আমরা দু’বোন আবার হারিয়ে যাই সেই সুখ-ভরা রেল-লাইনের ধারে, আনন্দ-ঝরা সবুজ বোনা মাঠে আর ফড়িং-ধরা বিকেলে।


ফটো: ফেসবুক

বিস্মিতা ও কাঙ্ক্ষিতা  

২/ ফিরে যাই আবার স্মৃতির ভাটায়
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : দূরদর্শী আরজ আলী মাতুব্বর ও নূর হোসেন-কে]
আবার ফিরে যাই বেনাপোলের সেই স্মৃতির ভাটায়, রেল-লাইনের ধারে, পাথরের বুকে।
রেলগাড়ি আসার সময় হলে, দল ধরে রেল-লাইনের উপরে কান পেতে শুয়ে থাকতাম আমরা। দূর থেকে যখন রেলগাড়ি আসত তখন ঝিক্ ঝিক্ শব্দ হত। সেই শব্দ ছিল তাল-লয় আর ছন্দে গাঁথা। সেই শব্দ শোনার কত যে অপেক্ষা ছিল আমাদের, তা বুঝি আজ দূরদেশের স্মৃতির রূপকথা।
রেলগাড়ির সেই তাল-লয় আর ছন্দে গাঁথা শব্দগুলো যেন কানের ভেতর দিয়ে একেবারে বুকের ভেতর ঢুকে যেতো।
 বুকটা তখন আনন্দে ভরে উঠতো। সেই আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠতাম আমরা।
আজও চোখ বন্ধ করলেই কাছে টানে সেই রেলগাড়ির ঝিক্ ঝিক্ শব্দ আর দূরদেশের সেই স্মৃতির রূপকথারা।
চোখ খুললেই দেখি সবকিছুরিই আজ তাল কেটে গেছে। আনন্দ গেছে পালিয়ে। শব্দগুলোও কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে গেছে। এই তাল-কাটা খাপছাড়া শব্দ শোনার অপেক্ষায় কি সেদিন ছিলাম?
ভাবলেই মনটা আবার ভিজে যায়। আবারও প্রশ্নেরা এসে ভীড় করে মনের ভেতর। কোথায় পাব এর মন ছোঁয়া উত্তর?
না পাওয়া উত্তরের শূন্যতায় চোখ দু’টো জল-ছল-ছল করে ওঠে।
হাতের পিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছি--
আর স্মৃতির ভাটায় ঘুরে ঘুরে সুখ-ভরা দিনগুলি খুঁজি।


লাউয়াছড়া বন গবেষণা কেন্দ্র। শ্রীমঙ্গল চা বাগান।

৩/ আবিস্কারের খেলা।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : জগদীশচন্দ্র বসু ও ফজলুর রহমান খান - যাঁদের সৃজনশীলতায় পৃথিবী আলোকিত]
রেল-লাইনের ধারে বসে পাথর কুড়িয়ে পাঁচ-গুটি খেলতাম আমরা। খেলা শেষে পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতাম। পাথরে পাথর ঘষলে যে আগুনের মত ঝলক দেখা যায়, তা ছিল আমাদের আদিম ক্ষুদে বিজ্ঞানীর মত একরকম আবিস্কারের খেলা। এটা ছিল আমাদের শৈশব জীবনের বিশাল আবিষ্কার। এ খেলাতে ছিল আবিস্কারের মত আনন্দ।
আমরা তখন পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতাম। আর আজ জীবনে জীবন ঘষে আগুন জ্বালাতে হচ্ছে। এ যেন এক বাধ্যগত আগুনের খেলা। এ খেলাতে আছে শুধু অনাগত নিরানন্দ।
এই নিরানন্দ জীবনের টুঁটি ছিঁড়ে আবারও ফিরে যেতে ইচ্ছে করে শুধুই শীতল আনন্দে। জীবন-ঘষা আগুনের জ্বলন্ত উত্তাপের জ্বালাপোড়া থেকে নিস্কৃতি নিয়ে টুপ করে ডুব দিতে ইচ্ছে করে বর্ষায় ডোবা টলটলে দিঘি ভরা-জলে। এক নিমিষে মনের যত আগুন নিভিয়ে নিখাদ আনন্দে লুটোপুটি খেতে ইচ্ছে করে-
আর আবারও ক্ষুদে বিজ্ঞানীর মত সেই আনন্দ-ঘেরা আবিস্কারের খেলায় মেতে উঠতে ইচ্ছে করে।

৪/ পাল্টে যাওয়ার খেলা।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : দূরদর্শী চিত্রশিল্পী মোস্তফা আজিজ ও এস. এম. সুলতান-কে]
বেনাপোলের সেই স্মৃতির কোঠা থেকে বলছি।
আর একটা খেলা খেলতাম আমরা। রেলগাড়ি আসার সময় হলে তাক করে থাকতাম। তারপর রেল-লাইনের উপরে এক পয়সা, দুপয়সা আর শিশা দিয়ে রাখতাম। রেলগাড়ি যখন ওসবের উপর দিয়ে যেতো, তখন রেলগাড়ির চাপে ওগুলোর চেহারা যেতো পাল্টে। ওগুলো সব চ্যাপ্টা হয়ে লম্বা হয়ে যেতো। তখন ওগুলো আমরা হাতে তুলে নিয়ে মন ভরে দেখতাম আর ভাবতাম কীভাবে একটা জিনিসের চাপে আর একটা জিনিসের আসল-রূপ যায় পাল্টে। এটাও যেনো ছিল আমাদের সেই অবুঝ বেলার পাল্টে যাওয়ার খেলা রূপান্তরের খেলা। এ খেলাতেও ছিল যেনো আবিস্কারের মতো মধুর গন্ধ, ছন্দ, আনন্দ। সবকিছুতেই ছিল যেনো তালের মতো সুর।
আজও আমরা পাল্টে যাওয়ার খেলাই খেলছি। জীবনের চাপে কালে-কালে পাল্টে যাচ্ছে জীবনের রূপ। কিন্তু এ পাল্টে যাওয়ার রূপে নেই কোন আনন্দ, নেই কোন সুখ। আছে শুধু মন-পোড়ানো ধূপ। এই মন-পোড়ানো ধূপের গন্ধ সরিয়ে সেই মধুর মতো গন্ধে, ছন্দে, আনন্দে মন মেতে উঠতে চায়।
বার বার মন ফিরে যায় সেই পাল্টে যাওয়ার খেলায়, রূপান্তরের খেলায়।

৫/ রেলের গার্ড সাহেবকে সালাম।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : স্বপ্ন-সঞ্চারী লুত্‍ফর রহমান সরকার, অধ্যাপক খলিলুর রহমান ও এম. এ. গফুর]
আমাদের বাসার সামনে দিয়েই যেতো রেলগাড়ি, যেতো ওপার বাংলা ভারতে। আমাদের খুব কাছে টানতো রেলগাড়ি যাওয়ার সেই সময়টা। সকাল, দুপুর, বিকেল, যখনই রেলগাড়ি যেতো, তখনই আমরা বাসার ঘুরানো বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে রেলের গার্ড সাহেবকে সালাম দিতাম সবাই মিলে, সুর করে। গার্ড সাহেবও তাঁর লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে, দু’পাটি সাদা শাপলার মতো দাঁতের হাসি মিশিয়ে, উত্তর দিতেন আমাদের সালামের। আমরা তখন হাসিতে কুটি-কুটি হয়ে একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরতাম আনন্দে। সবকিছুতেই কেমন যেনো সুর ছিল।
কোথায় গেল সেই সুরের মতো বাঁশি, আনন্দের হাসি, তালের মতো সুর। দূর বহুদূর!
তখন জীবন ছিল আনন্দের মেলা আর সুরের খেলা। মনের ভেতর শুধু হাতড়ে বেড়ায় কি যেনো। বহুদূর ছুটে যেতে ইচ্ছে করে, সেই আকাশ যেখানে মনে হয় মাটি ছুঁয়েছে। আকাশ আর মাটিকে জড়িয়ে ধরে কি যেনো বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছুই আর বলতে পারিনে। দৃষ্টি আছড়ে পড়ে বহুদূরে। টুপ করে গাল বেয়ে দু’ফোটা জল পড়ে। শ্বাস দীর্ঘ হয়।
বুকটা হু-হু করে ওঠে।
মনটা আবার পেছনে ছোটে।


লাউয়াছড়া বন গবেষণা কেন্দ্র। শ্রীমঙ্গল চা বাগান। [ছবি: ফেসবুক]

৬/ নিরাপত্তার ছাউনি।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : লেখক ও নাট্য-ব্যক্তিত্ব শওকত ওসমান, শাহরিয়ার কবির ও মমতাজউদ্দিন আহমেদ-কে]
এখনো বেনাপোলের সেই স্মৃতির মালাই গাঁথছি।
মনে পড়ে আমরা দু’বোন, বাবা-মা, আমাদের একটা ছোট ভাই সবেমাত্র হয়েছে, আর বাড়তি একজন মানুষ ছিল আমাদের পরিবারে, সে হলো আমার বাবার ছোট বোন। সে ছিলো আমাদের সবকিছুর সাথে জড়িয়ে-কুড়িয়ে।
বাবা ছিলেন সবার বড়, তাই বড়ত্বের দায়ভার ও ব্যয়ভারও ছিল তাঁরই কাঁধে। সংসারের সবরকম অস্থিরতার মাঝে তাঁকে ধৈর্যের মত স্থির থাকতে দখেছি। বাবার সেই মা-মরা অনাদরে বেড়ে ওঠা ছোট বোনের দায়ভারও তাই তাঁর কাঁধে কর্তব্যের মত করে তুলে নিয়েছিলেন। মা-হারা বোনটাকে বাবার ছায়া দিয়ে মায়ের মত করে বড় করেছিলেন।
বাবার সেই বোনের আঁচলের ছায়ায় ছায়ায় আমরা দু’বোন সারাক্ষণ ঘুর-ঘুর করতাম। সংসারের সবকিছুই তাঁকে গুরুদায়িত্বের মতো করে ভাবতে দেখেছি। কখনো ক্লান্তির মত কালো রং দেখিনি তাঁর চোখে-মুখে। সব কাজের ফাঁকে আমাদের নাওয়ানো-খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, চুল বেঁধে দে’য়া এসবও তাঁর দায়িত্বের ছকে বাঁধা ছিল। আমরা তাঁকে মনের মতো করে পছন্দ করতাম। আদর্শ ঘেঁষা জীবন ছিল তাঁর।
মা ছিলো অনেকখানি স্বাধীনচেতা ও একটু বদরাগী। তাই মায়ের চোখ এড়িয়ে, পালিয়ে-পালিয়ে বাবার সেই ছোটবোনের কাছে মা’য়ের মতো করে যতো তাল-বাহনা আছে করতাম। বাবার সেই ছোটবোন আমাদেরকে নিরাপত্তার মতো করে আশ্রয় দিত। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে খুব সহজেই তাই সেই নিরাপত্তার আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যেতাম। বাবার সেই ছোটবোন যেনো ছিল আমাদের সবরকম নিরাপত্তার ছাউনি। ঝড়ের পূর্বাভাস পেলেই তাই নিরাপত্তা খুঁজতে ঢুকে যেতাম বাবার সেই ছোটবোনের একেবারে বুকের ভেতর।

লেখকের মা / বাবা: বেগম হাসিনা জাহান / শাহজাহান মিঞা  


লেখকের সেই ফুফু বাড়ির আঙ্গিনায় ডালিম ফুল 

৭/ প্রথম শূন্যতা।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : স্বপ্ন-সঞ্চারী মন্নুজান, হাসিনা জাহান ও শাহজাহান মিঞা-কে]
একদিন বাবার সেই ছোট বোনের বিয়ের সানাই বাজল। বিয়ের সানাই বাজিয়ে বরের হাত ধরে সে আমাদেরকে খুব কাঁদিয়ে, সেই নিরাপত্তার জায়গাটা একেবারে শূন্য করে, আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল। বেড়ে-ওঠা জীবনে সেই প্রথম শূন্যতার সাথে দেখা হয়েছিল আমাদের। সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম শূন্যতা কাকে বলে। সেদিনের সেই সত্যের মতো স্বচ্ছ শূন্যতাকে মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল। এমন কঠিন শূন্যতার সাথে কিছুতেই যেনো সন্ধি করতে পারছিলাম না। কারো জন্য যে কারো মন অমন করে কাঁদে সেই প্রথম বুঝেছিলাম। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন, অনেকদিন। জানিনে বাবার সেই ছোটবোনের আমাদের ছেড়ে যেতে মন অমন করেছিল কিনা। হয়তো করেছিল, হয়তোবা করেনি। কিন্তু আমার মন আজও সেই শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
মনে পড়ছে গড়াই নদীর বুকের উপর দিয়ে নৌকোয় পাল তুলে বাবার সেই ছোট বোন বরের সাথে বসে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি সেদিন গড়াইয়ের পাড়ে বসে সন্ধ্যে অবধি কেঁদেছিলাম। সন্ধ্যেয় যখন বাড়ি ফিরেছি, তখন আমার মনের বিপদ সংকেত ছিল শত ডিগ্রি।
খুব রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলাম বাবার সেই ছোট বোনের বরের উপর। তাই অবুঝ মনের সমস্ত আকুতি দিয়ে সেদিন এই বলে প্রার্থনা করেছিলাম যে, আমাদের কাঁদিয়ে বাবার ছোট বোন যে বরের হাত ধরে চলে গেল, সেই বর যেনো মরে যায়। তাহলে হয়তো বাবার সেই ছোট বোন, উপায়-অন্ত না পেয়ে, ফিরে আসবে আবার আমাদের নিরাপত্তার আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে। সেদিনের সেই প্রার্থনার মাঝে কোন খাদ ছিল না। খুব অবুঝের মত ছিল সেদিনের সেই প্রার্থনা। শূন্যতার ভার এতো বেশি ছিল যে, অমন প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেদিনের সেই প্রার্থনাও ছিল বুঝি জীবনের প্রথম প্রার্থনা। এতোখানি জীবনে অমন প্রার্থনা আর কোনোদিনও করা হয়নি।
আজ অবশ্য মনে হলে হাসি পায়।
আড়ালে একটু মুচকি হাসি,
আর মনে-মনেই বলি,
কোথায় হারিয়ে গেল সেই অবুঝ বেলার দিনগুলি হায়!


প্রাণ-প্রিয় সেই নিরাপত্তার ছাউনিতে লেখক। লেখকের ফুফু বাড়ি। 

৮/ বেনাপোলের একটা নিদারুন মন ছোঁয়া ঘটনা।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : কথা ও সুরের যাদুকর আবু জাফর, শচীন দেব বর্মণ ও দিজেন্দ্রলাল রায়]
তখন স্মরণশক্তি, স্মৃতিশক্তি কেবল কানাকানি করছে।
বয়সটা ছিল শিশু। সেই শিশু বয়সেই মন ছুঁয়েছিল সেই ঘটনা।
কাস্টম-কলোনিতে একজন ডি.এস. সাহেব ছিলেন। সেই ডি.এস. সাহেব পরকীয়া করেছিলেন একজন চল্লিশ বছর বয়সী মহিলা ইন্সপেক্টরের সাথে। তখন পরকীয়া কি বুঝিনি।
এই পরকীয়া কাহিনী কলোনির সবার মুখে-মুখে ছিল। পরকীয়া কাহিনীর নায়িকার নাম ছিল জহুরা। আমরা তাঁকে জহুরা খালাম্মা বলে ডাকতাম।
একদিন ডি.এস. সাহেব তাঁর আগের বউকে বাবার বড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে জহুরা খলাম্মাকে বিয়ে করে ফেল্লেন। সেদিনও এমন শ্রাবণ দিন ছিল। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আগের বউটি ফিরে এলো। কিন্তু দরজা বন্ধ। কিছুতেই ডি.এস. সাহেব ঢুকতে দিচ্ছেননা ভিতরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আঝোরে কাঁদছিলেন সেই আগের বউ। কলোনির আমরা অবুঝ শিশুরা, তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কান্না দেখে আমরাও অবুঝের মতো কেঁদেছিলাম সেদিন। সেদিন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন পাখা মেলেনি মনে।
আজ বুঝতে পারছি, ডি.এস. সাহেবের আগের বউয়ের কান্নায় কি কষ্টটাই না ছিল। মনে পড়ছে আজও। কিন্তু অন্যভাবে।
সেদিন আগের বউ বার বার প্রশ্ন করছিল এই বলে যে, ডি.এস. সাহেব আমি চলে যাবো, কিন্তু কি দোষে আমাকে এমন শাস্তি দিলেন, আমি জানতে চাই! ডি.এস. সাহেব নিরুত্তর ছিলেন। যারা জ্ঞানপাপী তাঁদের নিরুত্তর থাকাটা বুঝি একটা ফ্যাশন। একথা সেদিন বুঝি নি, আজ খুব করে বুঝতে পারছি!
অবশেষে বৃষ্টির মতো করে, অঝোরে কেঁদে-কেঁদে কাক ডাকা ভোরে, ডি.এস সাহেবের সাথে এতোদিনের বোঝা-পড়ার সম্পর্ককে বলি দিয়ে, আগের বউটি তাঁর উত্তরহীন প্রশ্ন নিয়ে ফিরে গেলেন একেবারে অনিশ্চিতের পথে।
কেউ কিছুই করতে পারলো না। তাঁর বড় বড় ছেলে-মেয়েরাও না। সেদিনের সেই বিচ্ছেদের কষ্ট আজও বুকে বাজে! পুরো কলোনির মানুষ সেদিন ডি.এস. সাহেবকে বোঝাতে পারেনি। বিচ্ছেদের কষ্টে সেদিন কলোনির বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। বেনাপোল কাস্টম কলোনির সব কিছুই সেদিন ডি.এস. সাহেবের আমন ব্যবহারে হতবাক হয়েছিল। কলোনির আকাশ-বাতাশ, গাছের পাতারা, পথের ধূলোরা, পথচারীরা সবাই দুঃখে দুফোটা চোখের জল মুছেছিল।
জানিনে আজ কে কোথায়?
কিন্তু সেই স্বনামধন্য ডি.এস. সাহেব আজও আছেন আমার অভিযোগের পাতায়!

৯/ তালগাছ।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : মানবতা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের ধ্রুবতারা - সুকান্ত, নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ]
বেনাপোল কলোনির সেই ডি.এস. সাহেবের বাসার কাছে একটা তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। সেই গাছের নিচে বসে আমরা দুবোন পড়াশুনো করতাম। পড়াশুনোর থেকে মনোযোগ থাকতো তালগাছের দিকেই বেশি। কখন যেনো একটা তাল পড়ে। তাল কুড়োনোর লোভে আমরা প্রতিদিন ঐ তালগাছটার নিচে গিয়ে বই নিয়ে বসতাম। তাক্ করে তাকিয়ে থাকতাম তালগাছের দিকে। তাল কুড়োনোর সেই লোভ কী যে আকর্ষনীয় ছিল।
আজও সেই তাল কুড়োনোর লোভে আক্রান্ত হই তালগাছ দেখলেই।
মন ছুটে যায় আবার অনেক বছর আগে।
স্মৃতিরা সারি বেঁধে আবার বুকের ভেতর জাগে।


রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ।


কুঠিবাড়ির ঐতিহাসিক বকুলতলায় লেখক 

কুঠিবাড়ির ঐতিহাসিক বকুলতলায় লেখক

১০/ কাঁটাতারের বেড়া।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : ভূপেন হাজারিকা, পীট সীগার ও পল রবসন - যাদের জীবনের জয়গান প্রাণ ছুঁয়েছে]
দিন তারিখ কিছুই মনে নেই। 
কেবল স্মৃতিরা কানাকানি করছে।
এমন একদিনে আমরা দু’বোন বেনাপোল বর্ডারে বাবার অফিসে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বর্ডারের সীমানা ছিল কাঁটাতারে ঘেরা। খেলতে খেলতে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে কোন ফাঁক দিয়ে যেনো, আমরা দু’বোন ওপারে ভারতের সীমানায় চলে গিয়েছিলাম। দু’জন সীমান্ত প্রহরী ছিল, তারা খেয়াল করে নি আমাদের সীমানা পেরিয়ে যাওয়াটা। যখন তাঁদের চোখে ধরা পড়েছিলাম, তখনো আমরা আনমনে খেলছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই হৈ-চৈ পড়ে গেল।
আমাদের অপরাধ আমরা কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে সীমানা পেরিয়েছি। আমরা সেদিন বুঝি নি সীমানা পার হওয়া গুরুতর অপরাধ। কিছুতেই ছাড়বে না অমাদের সীমান্ত-প্রহরীরা। শেষ-মেশ বাবার সুপারিশে সে-যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলাম, বাবা কাস্টম-অফিসার ছিলেন বলে। নাহলে খবরের কাগজের পাতায় ফেলানীর মত খবর হয়ে যেতাম।
সেদিন একেবারেই বুঝি নি সীমানা কাকে বলে?
আজ জীবনের সীমানায় দাঁড়িয়ে বেশ বুঝতে পারছি, সীমানা কী এবং কাকে বলে?

১১/ পুকুরে সাঁতার
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : আলোর দিশারী মুহম্মদ জাফর ইকবাল, গোলাম মোস্তফা ও মুস্তাফা মনোয়ার]
বেনাপোল কলোনির কাছে হিন্দু পাড়ায় একটা পুকুর ছিল। সেই পুকুরের পানি কেমন যেনো ঘন কালো স্বচ্ছ ছিল। পানি ছিল গভীর। আমরা দু’বোন আর বাবা মিলে সেই পুকুরে সাঁতার কাটতাম পাল্লা দিয়ে।
বোন আর বাবা এগিয়ে যেতো বহুদূরে।
আমি পড়ে থাকতাম পিছে।
কী যে ভালো লাগত সেই সাঁতারের পাল্লা।
আজ লিখতে বসেই ইচ্ছে করছে সেই গহিন জলেই গা ভাসিয়ে দিতে।
বাবাকে মনে পড়ছে।
বাবা ছিলেন আমাদের দু’বোনের বন্ধু।
কোথাও আর খুঁজে পাই নে বাবাকে!
আর কোনদিনও সাঁতারের পাল্লা দেয়া হবে না বাবার সাথে!
কেন এমন করে সব মনে পড়ছে?
কেন আমকে সব কথা লতার মত ব্যথায় জড়িয়ে ধরছে?
আমার পালাতে ইচ্ছে করছে ব্যথার লতা ছিঁড়ে!
বাবা তো আর ভুলেও আসবে না সেই সরে যাওয়া দিনগুলিতে!
আবার কান্না পায়!
ব্যথা করে বুকের বা পাশে!
তবু স্মৃতিরা ঝাঁক বেধে আসে!


শাহী মসজিদ পুকুর পাড়, শৈলকুপা।


স্মৃতি-ঝলমল সেই নানী বাড়ির পুকুর, চতুড়া, শৈলকুপা।

১২/ আচার খাওয়া দুপুর।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : ধ্রুব এষ, সায়ানের গান ও খোন্দকার মানজারে শামীম - যাঁদের একাগ্রতাই অগ্রযাত্রার সোপান]
আর একদিনের কথা।
স্মৃতির সুতোয় টান পড়তে শুরু করেছে।
স্মৃতিরা যেনো সশব্দে কথা কয়ে উঠেছে।
মা’য়ের ছিল অনেক গুণের বাহার।
আচার বানানো গুণটাও তাঁর গুণের সংখ্যার মাঝে একটি।
মুখরোচক, খুব মজার মজার আচার বানাতো মা।
সবসময় আমাদের ঘরে আচার থাকতো।
একদিন মা বললো পুরনো আচারগুলো খেয়ে ফেলিস।
তখন দুপুর। দুপুরের খাওয়া সেরে সবাই ঘুমোচ্ছে।
সেই ফাঁকে আচারের বয়ামগুলো নিয়ে কলোনির সাথীদের ডেকে, একসাথে সব আচারগুলো খেয়ে শেষ করে ফেলেছিলাম। মা ঘুম থেকে উঠে দেখে আচারের বয়ামগুলো সব খালি। মা অবাক  চোখে মাথায় হাত তুলে বলেছিল, আচার কি হল?' আমরা বলেছিলাম, তুমি না বলেছিলে, পুরোনো আচারগুলো সব খেয়ে শেষ করে ফেলতে। তাই সব আচার খেয়ে শেষ করে ফেলেছি। মা বলেছিল, ‘আমি কি অমন করে একদিনে সব আচার খেয়ে শেষ করে ফেলতে বলেছি?'
মা মনের সব ঝাল মিটিয়ে মেরেছিল সেদিন। কেঁদেছিলামও সেদিন সারাদিন। চোখের জল যেন বাঁধ মানছিলো না। বাবার সেই ছোটবোন আমাদের কান্নার সাথে ছিল এবং মমতায় চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিল। সেদিন মা’য়ের হাতে মার খেয়ে কষ্টের নদীতে ভেসেছিলাম। কিন্তু কি সুখে যে আজ মনে পড়ছে মায়ের হাতে মার-খাওয়া সেই আচার-খাওয়া দুপুর।
কষ্টগুলো আজ যেনো সব সুখের নদী।
আহা! সুখের নদীতে ঘুরে ঘুরে
সেই আচার-খাওয়া দুপুরে-
আবার ফিরে যেতে পারতাম যদি!!


আম

১৩/ রজনীগন্ধার সাথে প্রথম পরিচয়।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : তৃপ্তি মিত্র, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ ও ফেরদৌসী মজুমদার - যাঁদের শৈল্পিক কারুকাজে জীবনের স্পন্দন খুঁজে পাই]
বেনাপোলের সেই পুকুরপাড়ে একদিন খেলতে খেলেতে ঘাসের ভেতর আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম পেঁয়াজ পাতার মত একটা গাছ। পুকুরপাড় থেকে গাছটা তুলে এনে খুব যত্ন করে বাসার উঠোনের এককোণে লাগিয়ে, রোজ পানি দিতাম। দিন যেতে যেতে কিছুদিন পর দেখলাম ঝাড় ধরা গাছ ফুঁড়ে সুগন্ধ-ভরা তন্বি তনুলতার মতো শুভ্র বসনায় একটা লম্বা ডাটার মাথায় এক গুচ্ছ আধো ফোটা ফুলের কলি বেরিয়েছে।
গন্ধে বাসা ভরে গেছে।
পরে আবিস্কার হলো এই ফুলের নাম ‘রজনীগন্ধা’
কী কাব্যিক নাম।
শুনেই সুগন্ধে মন ভরে গিয়েছিল।

সেই বুঝি প্রথম আমাদের ফুলের রাণী ‘রজনীগন্ধার’ সাথে দেখা হয়েছিল।
এখনো ‘রজনীগন্ধা’ দেখি।
কিন্তু প্রথম দেখা ‘রজনীগন্ধাকে’ যেনো আর খুঁজে পাই নে।
অমন করে আর দেখাও হয় নি কোনদিন।
এ যেনো সুগন্ধি স্মৃতি।
আর বুকের ভেতর যেনো বয়ে যাচ্ছে মধুর মতো গীতি।


রজনীগন্ধা
ছবি: risingbd.com

১৪/ ছোছরা পাতা।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : কথা সুর ও গানের পাখি কবীর সুমন, ফরিদা পারভীন ও আবু জাফর]
খুব তিক্ততার স্মৃতি খুব মধুর করে মনে পড়ছে।
ছোছরা পাতা নামে একটা পাতা আছে বনে।
ভালো বাংলায় হয়তো বা বিছুটি পাতা বলে।
সেই বেনাপোলের খেলার সাথীদের সাথে যদি কোনো মতবিরোধ অথবা ঝগড়া হতো, তাহলে সেই ছোছরা পাতা গায়ে ঘষে দিয়ে শাস্তি দিতাম আমরা একে অন্যকে।
সেই পাতা গায়ে লাগলে সারা গা চুলকিয়ে ফুলে যেতো এবং ভীষণ জ্বালাপোড়া করতো। যন্ত্রণাও হতো সারা শরীরে।
এমন সহজ উপায়ের শাস্তি বুঝি আর দ্বিতীয়টি নেই।
এ যেনো ছিল আমাদের শাস্তি-শাস্তি খেলা।
এ খেলাও খুব সুখে আমরা বহুদিন খেলেছি বেলা-অবেলা।

১৫/ ভাঙা চুড়ি।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : আবৃত্তি ও নাট্য জগতের ধ্রুবতারা শফিকুল ইসলাম বাহার, হুমায়ুন ফরিদী ও সুবর্ণা মুস্তাফা]
বেনাপোল কলোনির ড্রেনের ধারে সব বাসা থেকে ময়লা আবর্জনা ফেলা হতো। তার ভেতরে থাকতো অনেক কিছু। সেই অনেক কিছুর ভেতরে থাকতো রঙ-বেরঙের ভাঙা কাচের চুড়ি।
ময়লা-আবর্জনা ঘেটে আমরা সেই রঙ-বেরঙের ভাঙা চুড়ি সংগ্রহ করতাম। তারপর সেগুলো ধুয়ে-মুছে স্বচ্ছ কাচের বোতলে ভরে সাজিয়ে রাখতাম ঘরে, বসার ঘরে।
কী যে চমক ছিল সেই কাচের ভাঙা চুড়ি সংগ্রহের ভেতরে।
কাচের বোতলে ভাঙা চুড়িগুলো যেনো দেখতে চমৎকার শো-পিসের মতো লাগতো।
আজকের ঝকমকে শো-পিসের যুগে হয়তো তা একেবারেই ফিকে।
কিন্তু আমার কাছে আজও সেই তুচ্ছ ভাঙা কাচের চুড়ির দাম যেনো মণি-মুক্তোর মতো চিকচিকে।
তাইতো আজও স্মৃতির ঘাটে বসে তাকিয়ে আছি - সেই ফিরে-দেখা মণি-মুক্তোর দিকে!


'রিনিঝিনি কাচের চুড়ি'
ছবি: banglanews24.com

১৬/ রেডিও শোনা।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : দূরদর্শী শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির রূপকার আহমেদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী]
বেনাপোলে আমাদের জীবন-যাপন ছিল খুব হিসেবের।
যেনো ঠিক নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো।
কারণ আগেই বলেছি, বাবা ছিলেন একজন সৎ কাস্টম-অফিসার।
উপরি কোনো  পয়সা ছিল না।
বিনোদনের জন্য আমাদের ঘরে কিছুই ছিলনা।
খুব ইচ্ছে করতো রেডিওর গান শুনতে।
মনে হতো, একটা যদি রেডিও থাকতো আমাদের কী ভালোই না হতো। সাধ মিটিয়ে গান শুনতে পারতাম।
কিন্তু তখন রেডিও কেনার মতো স্বচ্ছল অবস্থা আমাদের ছিল না।
পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য খাবার, লজ্জা নিবারণ করার জন্য কাপড় - এসবই রেডিও থেকে বেশি জরুরি ছিল।
যখন দুমুঠো খাবার পেটে থাকতো, তখনই রেডিওর গান শোনার কথা মনে হতো।
চ্ছেটা যখন খুব তীব্র হতো, তখন পা টিপে-টিপে চুরি করে পাশের বাসার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে গান শুনতাম কান ভরে। কী যে ভালো লাগতো সেই লুকিয়ে গান শোনা।
মাঝে-মাঝে এদিকওদিক আড়-চোখে তাকিয়ে দেখতাম কেউ দেখে ফেলে কিনা। লজ্জাও লাগতো এভাবে কারো জানালার ধারে দাঁড়িয়ে গান শুনতে। কিন্তু উপায় তো ছিল না কিছু।
ছুটে যেতেই হতো ওভাবে চুপি চুপি, গানের টানে।
আজ চারদিকে কতো মিডিয়া আর সারা বেলা ভরে থাকে-
কতো যে সুরে-সুরে, গানে-গানে তা তো সবাই জানে।
তবু মন ফিরে যায় সেদিনের সেই চুপি-চুপি
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে শোনা গানে!


'রৌদ্র-ছায়া'য় লেখক 

১৭/ ভয়ঙ্কর সেদিন।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : সাহিত্য জগতের অগ্রদূত সত্যেন সেন, পূরবী বসু, নির্মলেন্দু গুণ ও মহাদেব সাহা]
খুব ভয়ঙ্কর সেদিনের কথা!
আমরা দু’বোন আর বাবা শীতের ছুটিতে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। হঠাৎ টেলিগ্রাম এলো। মায়ের অবস্থা খারাপ।
বাবার এক বন্ধু করেছিলেন।
আমরা তড়িঘড়ি করে রাতের ট্রেন ধরেই বেনাপোলে এলাম।
এসে দেখি আমার মা’য়ের ডান হাতের উপর তিন ইঞ্চি সমান পুরু জিলাপির মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ফোস্কা পড়ে আছে।
তারপর সবকিছু শুনলাম, জানলাম।
মায়ের কাপড়ে আগুন ধরেছিল। তখন ছিল সূর্য-ওঠা ভোর।
আমার পরের ভাইটা মায়ের কোলে ছিল।
শাড়ির আঁচল ঝুলে পড়েছিল চুলোয়। চুলো থেকেই আঁচলে আগুন ধরেছিল।
আমার ছোট ভাইটিকে বাঁচাতে গিয়ে মা দিশেহারা হয়ে সেই শাড়িতে ধরা আগুন ডান হাত দিয়ে চিঁপে-চিঁপে নিভোতে গিয়েছিল। ঐ আগুনেই ডান হাতটা পুড়ে একেবারে ঝলসে গিয়েছিল।
মায়ের হাতে বাবার দেয়া দু’টো সোনার  চুড়ি ছিল।
সোনার চুড়ি পুড়ে কঠিনভাবে হাতের মাংসের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। স্বর্ণকার এনে সেই পোড়া চুড়ি বের করতে হয়েছিল।
আমাদের বাসার ভেতরে ছিল মা’য়ের হাতের সবজি বাগান।
মায়ের হাতে সবজি খুব ভালো হতো।
বাসার উঠোনে শাক্, মটোরশুটি, ঢ্যাড়োশ, বেগুন আরো অনেককিছু লাগানো ছিলো।
মায়ের কাপড়ে ধরা আগুন নিয়ে সেই সবজি বাগানের ভেতর পাগলের মতো ঘুরেছিল। বাগানের সব সবজি পুড়ে গিয়েছিল।
মনে হলে আজও সেই সবজি পোড়া গন্ধ পাই,
আর বিষাদে অনেক দূরে হারিয়ে যাই।


ছবি: ফেসবুক 

১৮/ বিহারী পরিবার।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : বহুমুখী জ্যোতির্ময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বেগম রোকেয়া ও শকুন্তলা দেবী]
আমাদের পাশে ফ্লাটে ছিলো এক বিহারী পরিবার।
ঐ পরিবারের সাথে আমাদের খুব সখ্যতা ছিল।
মায়ের সেই দুর্দিনে ঐ পরিবারের সবাই মায়ের জন্য যা করেছিল তা আজও ইতিহাস হয়ে রয়েছে।
বিশেষ করে যিনি গৃহকত্রী ছিলেন, আমরা যাকে খালাম্মা বলে ডাকতাম, তিনি আমার মাকে চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনা করতেন।
মানুষ মানুষের জন্য যে অমন নিবেদিত ভাবে কিছু করতে পারে সেই প্রথম দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে যায়।
খালাম্মাকে কৃতজ্ঞতায় আজও মনে পড়ে।
সত্যি বুঝি অমন দিন কোনদিনও আসবে না।
স্মৃতিরাও কোনদিন সরে যাবে না।


ছবি: ফেসবুক 

১৯/ বিহারী পরিবারের দুর্দিনে।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : দূরদর্শী ও স্বপ্ন-সঞ্চারী বাঘা যতীন, কেশব চন্দ্র ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু]
আর একদিনের কথা।
সেই বিহারী পরিবার একবার বেড়াতে গিয়েছিল ভারতে। ফেরার পথে ট্রেনে চোর ঢুকে সবাইকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তাঁদের সবকিছু চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে পাসপোর্টও। শেষ-মেশ পাসপোর্টের অভাবে পুরো পরিবার বর্ডারে এসে আটকে গেলো। সেদিন বাবা তাঁদের জন্য অনেক করেছিলেন।
মা’য়ের দুর্দিনে তাঁরা যেমন করে করেছিল। সেদিন বুঝি বাবার সুযোগ এসছিল তাঁদের ঋণ পরিষোধের।
বাবাকে দেখেছিলাম খুব ছুটোছুটি করে সেদিন তাঁদেরকে বর্ডার থেকে উদ্ধার করেছিলেন। বাবার নিবেদিত সহানুভুতি আর সুপারিশে পরিবারটি অনুকূলে এসেছিলো।
মনে পড়ে সেদিন পুরো পরিবারই আমাদের ফ্লাটে ছিলো। তাঁদের ঘরের চাবিও চুরি হয়ে গিয়েছিলো। একেবারে খালি হাতে তাঁদের বর্ডার পেরুতে হয়েছিলো। তাঁরা বার বার আতঙ্কিত হয়ে, হাউ-মাউ করে আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো সেদিন। আমরাও সারাটা রাত তাঁদের চোখের জলে ভেসেছিলাম। সেটাও ছিলো এক দুঃখের রাত। তারা কৃতজ্ঞতায় সে রাতের কথা মনে রেখেছিলো। সে রাতও কেটে গেছে। আছে শুধু সেই বুক শির-শির করা স্মৃতি!
তাঁদের সাথে আমাদের অনেকদিন যোগাযোগ ছিলো। বাবা বদলি হয়ে এসেছিলেন রংপুরের ডোমারে, আর ঐ পরিবার বদলি হয়েছিলো নিলফামারিতে।
তারপরেও বহুদিন একটানা যোগাযোগ ছিলো এমনি করেই।
স্বাধীনতা-যুদ্ধের বছরে তাঁরা হারিয়ে গেলো। যোগাযোগের সুতো ছিঁড়ে গেলো। কারণ তাঁদেরকে পাকিস্তানে চলে যেতে হয়েছিলো।
হয়তো বা আর কোনদিনও যোগাযোগের সেই সুতো বাঁধা যাবে না।
কিন্তু মনের সেই দেয়া-নেয়ার জায়গাটা হয়তো কোনদিন মুছে যাবেনা।


ছবি: ফেসবুক 

ছবি: ফেসবুক 

২০/ খেলার সাথী ফরহাদের সাথে।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তি লালন, হাসন রাজা ও বাউল শাহ আব্দুল করিম]
বেনাপোলের আর একদিনের মন-পোড়ানো কথা।
একদিন খেলার সাথী ফরহাদের সাথে বেনাপোল কলোনি থেকে কিছুটা দূরে পুকুর-পাড়ে আম গাছে আম পাড়তে গিয়েছিলো বড় বোন। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।
আগেই বলেছি, মা ছিলো বেশ রাগী।
বাড়িতে বড় বোন ফিরতে না ফিরতেই, মা দড়ি দিয়ে পেঁপে গাছের সাথে বেঁধে খুব পিটিয়েছিল। অপরাধ, কেনো ফরহাদের সাথে আম পাড়তে গেল।
আমার বুক-কাঁপানো খারাপ লেগেছিলো। কিন্তু করার কিছুই ছিলোনা। মা’য়ের উপর কথা বলার সাহস ছিল না।
মা’য়ের অমন নিষ্ঠুর মারের কথা মনে উঠলে আজও চমকে উঠি।
সেই আম-পাড়া সাথী ফরহাদেরও খুব শাস্তি হয়েছিলো।
ভা’য়ের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো। এই অপরাধে ভাবীর অভিযোগে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলো। ফরহাদকে বাসা থেকে বের করে দিল তাঁর ভাই।
আমার বড় বোন সেদিনই প্রথম বুঝেছিলো অমন করে যখন-তখন আর কোথাও যাওয়া যাবে না। সেদিনের পর থেকে বড় বোনের কোথাও আর যাওয়া হয়নি।
বড় অপরাধবোধে ফরহাদকে মনে পড়ে।
কিন্তু শেষ-মেশ ফরহাদের কী হল তাও আর জানা যায় নি।


লেখকের বড় বোন: ডা: শামসুন নাহার 

২১/ যেনো দূরে কোথায়।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : কাব্য, সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারের অগ্রদূত জসীমউদ্দিন, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর]
আবারও গুটি-গুটি পা’য়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছে সেই স্মৃতির পাড়াতে।
বেনাপোল থেকে ট্রেনে করে আমরা দু’বোন যেকোন অবকাশে নানা ও দাদা বাড়িতে যেতাম। সেখানে আমরা রাত-দিন চরে বেড়িয়েছি। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই আমরা দু’বোন স্মৃতির মেলায় হাত ধরাধরি করে হাঁটছি আর হাঁটছি।
গ্রীষ্মের ছুটিতে নানা ও দাদা বাড়িতে আমরা যে অবকাশ যাপনে যেতাম, তা যেনো ছিলো বিলেত ভ্রমণের মতো।
কখনো মনে হতো দার্জিলিংয়ে এসেছি বিনোদনের জন্য। আবার কখনো মনে হতো কল্পনার প্যারিসে হাঁটছি।
আমরা গ্রীষ্মের দুপুরে নানা বাড়িতে পুকুর পাড়ে মাদুর বিছিয়ে, গাছ থেকে আম পেড়ে, ঝিনুক ঘষে ফুটো করে সেই ঝিনুকের আঁচড়ে কাঁচা আম ছিলে খেতাম। সেই ঝিনুকে-ছিলা আম মনে হতো অমৃতের মতো।
বর্ষায় যখন পুকুরের চার পাড়, নদীর দু’কূল ছেপে গেছে তখন মাছের মতো করে গা ভাসিয়ে সাঁতার কেটেছি।
শরতে সাদা মেঘের ভেলায় ভেসেছি।
হেমন্তে চুলোর পাশে বসে ভাঁপ-ওঠা নানীর হাতের পিঠে খেয়েছি মধুর মতো করে।
সাধ মিটিয়ে শীতের সকালে আগুন তাপানোর ছলে, নাড়ার আগুনে ছোলার হোড়া পুড়িয়ে খেয়েছি দু’হাত ভরে। সেই হোড়ার ছাইগুলো যেনো মনে হতো হীরের গুড়ো।
বসন্তে ছুটে গেছি আকাশ ছোঁয়া কাঁঠাল অথবা আম গাছের তলে, কোকিলের মিষ্টি কুহু-ডাক শুনবো বলে।
এমনি করে ছয় ঋতুর সাথে আমরা দু’বোন খেলেছি দিনভর।
সন্ধ্যে হলে উঠোনে বসে জোসনা আর চাঁদের বুড়ির সাথে কথা কয়েছি আনমনে।
এমনি করেই দাদা বাড়িতেও পুকুর পাড়ে, জোনাক-জ্বলা বাঁশের বনে, জ্যোৎস্না ভেজা ঝির-ঝির নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে, মিল-মিল বাতাসের আদরে, বারান্দার বুকে শুয়ে জীবনের অনেকগুলো সন্ধ্যে কাটিয়েছি আমরা দু’বোন।
আজও আছে সেই পুকুর পাড়, নদীর কুল, জ্যোৎস্না রাত।
কিন্তু নিঃসঙ্গ যেনো সবই, সেই।
চোখ ছল-ছল চোখে আবার তাকিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই।


লেখকের ফল ও ফুলের বাগান। সীমানা পেরুলেই পুকুর।


নানী বাড়ি থেকে ফুফু বাড়ি যাবার পথে....

২২/ বার বার মন ফিরে যায়।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : আলোর পথযাত্রী শামসুর রাহমান, বেগম সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমাম]
তারপর একদিন যখন বেনাপোল কাস্টম-কলোনির সব সুখগুলো পেছনে ফেলে বাবা বদলি হয়ে গেলেন রংপুরে। বার বার মন ফিরে যায় পিছনে।
বেনাপোলে থাকতেই আমাদের পরিবারে আরো দু’ভাই এসেছিলো।
বেনাপোলের সেই উড়ন্ত শৈশব ছেড়ে এসে আমরা একেবারে বোবা হয়ে গেলাম যেনো। স্মৃতির শহর ছিলো বেনাপোল বর্ডার।
আবার একটা না বলা কষ্ট দানা বাঁধলো। এ কষ্টের বোঝা কাউকেই দে’য়া গেলো না।
বেনাপোল কলোনির মাঠ-ঘাট, খেলার সাথীরা, বর্ণমালার সাথীরা ছিলো বুকের বাঁশি। সেই বাঁশির সুর কান্নার মতো করে বাজলো বুকের একেবারে শেষ বিন্দুতে। আবার একটা অন্যরকম শূন্যতা জড়িয়ে ধরলো।
কিছুতেই যেনো মন বসে না। বারবার মন ফিরে যায় বেনাপোলের সেই দুরন্ত দুপুরে।
এমনি করেই দিন আসছিলো, রাত যাচ্ছিলো। তারপর কখন যেনো বাস্তবতার মতো কঠিন সত্যে সব শূন্যতা সয়ে গেলো।
বড় হয়ে উঠলাম আমরা পাশাপাশি দু’বোন। জীবনবোধও নিয়মের বিধি-নিষেধে বেড়ে উঠলো। কৈশর ডাক দিলো। শূন্যতাগুলো আবার স্মৃতি হয়ে উঠলো। দায়িত্ববোধগুলো একে একে জড়িয়ে ধরলো। কর্তব্যবোধগুলো এসে শূন্যতাগুলোকে সরিয়ে রূঢ় বাস্তবতার সাথে সন্ধি করলো।
তবু যেনো বার বার মন ফিরে যায় সবকিছুর ফাঁকে, সেই সুদূরের দুরন্ত দুপুরের ঝিলে,
ফড়িং-ধরা বিকেলে!!!
ছবি: ফেসবুক 


২৩/ পাওয়ার হাউস।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : সুরের আকাশের ধ্রুব-তারা ফিরোজা বেগম, অতুল প্রসাদ ও রজনীকান্ত সেন-কে]
বেনাপোলে আমাদের বাসার কছেই ছিলো পাওয়ার হাউস নামের একটা একটু অন্যরকম ঘর। সেই ঘরে সারাক্ষণ একটা শাঁ-শাঁ শব্দ হতো। সেখান থেকে সমস্ত কলোনির ইলেকট্রিক সরাবরাহের কাজ চলতো।
আজ স্মৃতির সারিতে দাঁড়িয়ে সেই শাঁ-শাঁ শব্দও যেন সুরে গাঁথা ছন্দের মতো কানের পর্দা যাচ্ছে ছাড়িয়ে।
   
২৪/ শেওড়া গাছ।
[♥♪♥ উত্‍সর্গ : আমার জন্মভূমি। 'যে মাটির মায়া-মমতা আমার অঙ্গে মাখা ....' 'স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা ....']
বেনাপোলে আমাদের বাসার ঠিক সমনেই ছিল একটা শেওড়া গাছ। (গ্রাম্য কথায় শড়া গাছ বলে) সেই শেওড়া গাছের পাতা এতো চক্ চকে সবুজ ছিলো যে দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যেতো। পাতাগুলো ছোট ছটো এবং ঘন। গাছটার ভেতরে কেমন যেনো একটা গুরু-গম্ভীর ভাব ছিলো। জনশ্রুতি ছিলো ঐ গাছে ভূত থাকে।
সারাদিন যেনোতেনো, সন্ধ্যে হলে গাছটির দিকে তাকিয়ে আমরা ভয়ে একেবারে জড়োশড়ো হয়ে যেতাম।
কিন্তু আজ স্মৃতির পাতা খুলে দেখছি সেই ভয় জড়ানো শেওড়া গাছও যেনো আজ কতো আদর মাখানো।


কুমার নদের পাড়ে লেখক ও তাঁর অনুজ ড: শরিফুল ইসলাম।
দু'জনে মিলে লিখেছেন কবিতার বই 'বিপ্লবের পোস্টমর্টেম'।




ই-বইএর নাম- ফড়িং-ধরা বিকেল।
লেখকের নাম- নূরুন্ নাহার।
আমার কথা-  আমি সবার ছোট-বড় কষ্টের সারাবেলার মানসিক সাথী।
প্রকাশক: শফিউল ইসলাম ও রঞ্জনা সাহা 
প্রকাশকাল: ২০১৪ ফেব্রুয়ারী ০৪

প্রকাশকের কথা 
লেখকের স্মৃতিচারণে জীবনের ছন্দ খুঁজে পাই। প্রায় চার যুগ আগে আমাদের সময়, শৈশব জীবন-বোধ ও মায়া-মমতা কেমন ছিলো - পাঠক খুঁজে পাবেন খুব সহজ-সরল অল্প-স্বল্প গল্পে। 'ফড়িং-ধরা বিকেল' প্রথম ই-বই আকারে প্রকাশ পেয়েছে ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৪ - 'Vision Creates Value' ব্লগে। 

প্রিয় পাঠক, আশা করি অচিরেই 'ফড়িং-ধরা বিকেল' ই-বই, বই, ও অডিও-বই আকারে প্রকাশ পাবে। আর অনুগল্প-গুলো চলবে লেখকের স্মৃতিচারণে - লেখকের শৈশব, কৈশোর ও জীবনের সীমানা পেরিয়ে। আমাদের অগ্রযাত্রায় সাথে থাকুন। 

অপার কৃতজ্ঞতা কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক-কে। উনি সময় করে বইটি পড়েছেন ও গল্পগুলোর পর্যালোচনা করেছেন।

প্রকৃতির সাথে লেখকের নিবিড় প্রেম। মধ্যবিত্ত জীবনের মূল্যবোধ ও শৈশবের  আনন্দ-বেদনা লেখক অপূর্ব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্প-গুলো-কে ফুটিয়ে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি ছবি সংযোজিত হলো। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।   

অনুগল্পগুলো উত্সর্গ করেছি যাঁরা আমাদের আলোর পথ-যাত্রী। লেখক পুরো বইটি উত্সর্গ করেছেন তাঁর প্রিয় পাঠক-কে। প্রিয় পাঠক আশা করি লেখকের অল্প-স্বল্প গল্প-গুলো অপার আনন্দ দেবে। আপনাদের স্মৃতি-তে দোলা দেবে - আনন্দ-বেদনার ঢেউ তুলবে কোনো এক 'ফড়িং-ধরা বিকেল'-এ ...!
♥♪♥


'ওড়ার ইচ্ছে জাগলে মনে
মনের পাখায় হও না ফড়িং।' 


বিস্মিতা ও কাঙ্ক্ষিতা 
বিস্মিতা ও কাঙ্ক্ষিতা 

বিস্মিতা ও কাঙ্ক্ষিতা 

বিস্মিতা ও কাঙ্ক্ষিতা 


Author: Nurun Nahar
Illustration: Shafiul Islam
Publisher: Shafiul Islam & Ranjana Saha
Pictures Credit: Internet, Travel Trail Album, Shakila Haseen, Probir Saha, Biddyut Saha, Tapashi, Bismita, Kangkhita, Joy, Shuvo, Jhimli
Proofreading: Shafiqul Islam Bahar
Recitation: Shafiqul Islam Bahar and Munib Rezwan (TBC)
Email Communications: Shehab Mallik
Copy Right: Nurun Nahar & Vision Creates Value :: 20014 Feb 04
Courtesy of: Vision Creates Value
This project is in progress. Stay tuned. More to come....

প্রকাশক ও লেখক 


'রৌদ্র-ছায়া'য় দীপ সন্দীপন  ও  লেখক 

লেখক 

লেখকের পরিচয়-
নূরুন্ নাহার।
জন্ম: ১৯৫৫ সেপ্টেম্বর ২৮।
স্থান: ঝিনাইদহ জেলা।
শৈলকুপা থানা।
গ্রাম: কাতলাগাড়ির কীর্তিনগর।
বাবা: মো: শাহ্ জাহান মিয়া।
মা: হাসিনা জাহান।
 
  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যা থেকে বি. এ (অনার্স) এম. এ. (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য)। ১৯৮১ সন।
  • লেখালেখিতে বিচরণ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে।
  • লেখালেখির জগতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা।
  • নিয়মের বেড়িতে কোনকিছু বাঁধা নেই।

   
লেখা প্রকাশ-
  • দৈনিক বাংলা।
  • দৈনিক ইত্তেফাক।
  • দৈনিক আযাদ।
  • প্রথম আলো (ছুটির দিনে)।
  • সাপ্তাহিক চরম পত্র।
  • শৈলকুপা উপজেলা ভিত্তিক বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশ।
  • কিংশুক (অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা) কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ।

লেখা প্রকাশিত হচ্ছে।
   
সম্পাদনা-
  • দু:সাহস (১৯৭৯ ইং, ১৩৮৫ বাং সন)
  • দু:সময় (১৯৭৯ ইং, ১৩৮৫ বাং সন)
  • মূল্যবোধ (জূন, ১৯৮৯)
  • বিপ্লবের পোষ্টমর্টেম (কবিতার বই, ১৯৯০)।
  • নাট্যগুরু মুস্তাফা কামাল বুলুল শোকগাথা। (শৈলকুপা নগরিক কমিটি)। ২৩ মার্চ ২০১৪।    
  • সদস্য, (আজীবন) শৈলকুপা পাবলিক লাইব্রেরি।
  • সদস্য, (শৈলকুপা নাগরিক কমিটি)।

 
সম্প্রতি যে কবিতাগুলো যেখানে প্রকাশিত-
  • তুমি নেই, তবু তুমি আছো-নাট্যগুরু মুস্তাফা কামাল বুলুর শোকগাথা। ৯ চৈত্র, ১৪২০ বাং সন, ২৩ মার্চ, ২০১৪। শৈলকুপা নাগরিক কমিটি, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ।
  • হিমালয়ের কাছে তরুলতার চাওয়া-পত্রিকা কিংশুক- ঈদ শারদীয় সংখ্যা। অক্টোবর, ২০১৩।
  • বিশ্বাসের গ্যারান্টি চাই -পত্রিকা কিংশুক (ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)।




 লেখকের আস্তানায়  প্রকাশক ও লেখক। এখান থেকেই রচিত - 'ফড়িং-ধরা বিকেলে' ♥♪♥ 




লেখকের বাগান  ও সময়ের সাথী প্রকৃতি 

লেখকের আরো কয়েকটি লেখার লিঙ্ক:

Courtesy of Vision Creates Value.

2 comments:

  1. খুব প্রাঞ্জল বর্ননা। হৃদয় ছুঁয়ে গেলো টুকরো টুকরো লেখাগুলো। আমারো অনেক শৈশব স্মৃতি এসে ভীড় করল মনের জানালায়। লেখকের জন্য অনেক শুভ কামনা।

    ReplyDelete
  2. শুভেচ্ছা চারু কন্ঠ! ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো| লেখক-কে আপনার শুভেচ্ছা জানাবো| আপনাকেও অনেক শুভকামনা|

    ReplyDelete