মীজান রহমান
চার
প্রাচীনকালে দর্শনশাস্ত্রের
সঙ্গে গণিত আর বিজ্ঞানের বড় একটা বৈষম্য ছিল না----একই বিষয়ের এপিঠ-ওপিঠ। প্ল্যাটো,
এরিস্টটোল (বিশেষ করে এরিস্টটোল), উভয়ই বড় দার্শনিকই ছিলেন না কেবল, বড়
গাণিতিক-বিজ্ঞানীও ছিলেন বটে। এরিস্টটোল যে
প্রাণীবিজ্ঞানের আদিজনক সেটা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। শুধু প্রাচীনযুগের কথাই বলি কেমন করে, মধ্যযুগের
বেলাতেও অনেকটা প্রযোজ্য কথাটি। ওমর খৈয়ামের
রুবায়েতে যে গভীর জীবনদর্শন প্রকাশ পায় তা অদ্যাবধি মানুষকে দোলা দেয়। ওদিকে তিনি ছিলেন একজন বড়মাপের গাণিতিক এবং
জ্যোতির্বিজ্ঞানী। লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চির
কথা বলতে শুরু করলে তো একবেলায় শেষ হবে না। তাঁর মত শতমুখি প্রতিভা পৃথিবীতে বোধ হয় হাজার বছরে একটি জন্মায়। সাধারণ মানুষ কেবল তাঁর মোনালিসার দিকেই চেয়ে রইল এতটা
কাল, তাঁর অন্যান্য কাজের দিকে ফিরেও তাকালো না। তিনি একাধারে মানবদেহতত্বের (Human Anatomy) অবিসংবাদিত জনক, উড়োজাহাজের
প্রথম মডেল তাঁরই হাতে গড়া, তিনি ভাস্কর, তিনি স্থপতি, তিনি গণিতের একনিষ্ঠ সাধক। উপরন্তু তিনি মানবচরিত্র সম্বন্ধে যেসব ভবিষ্যদ্বানী
রেখে গিয়েছিলেন তা বর্তমান যুগের দিকে তাকালে অবিশ্বাস্য মনে হবে----এতটাই মিল।
পাঠক হয়ত ভাবতে শুরু করেছেন,
এসবের সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কি সম্পর্ক। আছে। আছে বলেই এটুকু
ভূমিকার অবতারণা। নিউটনের সময়কালে
এটা ধরেই নেওয়া হত যে প্রকৃতি কোনও ‘ভুল’ করতে পারেনা, এখানে মনুষ্যসুলভ
বিভ্রান্তিকর বালখিল্যতার প্রশ্রয় নেই, কারণ মহান সৃষ্টিকর্তার সুপরিকল্পিত
মানচিত্রে এসবের স্থান নেই। সংসারে কোন ঘটনাই
ঘটা সম্ভব নয় একটা নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া। ধর্মগ্রন্থে পরিষ্কার লেখা আছেঃ ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের তুচ্ছ পাতাও নড়ে
না। এই সহজবোধ্য ধ্যানধারণার সঙ্গে
নিউটনীয় কার্যকারণসম্বন্ধীয় চিন্তাধারা
পুরোপুরি মিলে যায়। নিউটনের তত্ব
অনুযায়ী একটা বস্তু, যত ক্ষুদ্র বা বৃহৎই হোক, এক মুহূর্ত থেকে পরের মুহূর্তে, বা
আরো অনেক পরের মুহূর্তে কোথায় যাবে তা নির্ভর করে বস্তুটি যাত্রাকালে কোথায় ছিল,
কতটা বেগ ছিল তার তখন, এবং কিসের তাড়নাতে তার চলন, এগুলো জানা থাকলে এর ভবিষ্যত
গতিবিধির নিখুঁত মানচিত্র এঁকে দেওয়া সম্ভব। সৌভাগ্যবশত আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের তাগিদাতে যা কিছু জানা দরকার
সেগুলো এভাবেই জেনে নেওয়া হয়। লণ্ডন থেকে একটি
ঢাকাগামী প্লেন বেলা তিনটেয় রওয়ানা হলে ঠিক কটার সময় ঢাকার বিমানবন্দরে গিয়ে
পৌঁছুবে সেটা আগে থেকে জানা থাকে। কারণ প্লেন
মোটামুটিভাবে নিউটন এবং আধুনিক বিমানবিজ্ঞানীদের গণনা অনুসারে অত্যন্ত
আজ্ঞানুবর্তিতার সঙ্গে সব নিয়মকানুন পালন করে চলে।
কিন্তু প্রকৃতি সবসময় এমন সুশীল
আজ্ঞাবহতার ধার ধারে না। আগের অধ্যায়ে এর
একটা ছোট্ট আভাস দিয়েছি----ত্রিদেহী সমস্যা নিয়ে পয়েনক্লেয়ার সাহেবের যে মাথা দিয়ে
ধোঁয়া বেরুচ্ছিল তার উৎসটাই তো সেখানে। দুটির বদলে তিনটি
মিলে একে অন্যকে টানাটানি শুরু করলে কে কোনদিকে যাবে সেটা স্বয়ং নিউটনসাহেবও হয়ত
হলপ করে বলতে পারতেন না। আসলে এটা কোনও
পারিবারিক ঝগড়াঝাটির মত নয়, এটাই প্রকৃতির মৌলিক চরিত্র। এই যে ছোট ছোট বিশৃংখলা থেকে একসময় লাগামছাড়া বিশৃংখলা
সৃষ্টি হওয়া, যেটা একসময় পূর্ণমাত্রা কেয়সের আকার ধারণ করে তা প্রকৃতির বিকার নয়,
স্বরূপ।
কার্যকারণসম্পর্কহীনতা যে কেবল
বহুদেহী ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। অনেকসময় একটিমাত্র
বস্তুর গতিতেও এরকম আপাত বিকারগ্রস্ততা পরিলক্ষিত হয়----নির্ভর করে বস্তুটি কিরকম
আধারে ধারণ করা হয়েছে, কেমন তার পরিবেশ, ইত্যাদি। বাচ্চাদের খেলার মাঠে একটা দোলনায়-চড়া শিশু প্রায় কখনোই
বেসামাল গতিতে চলতে শুরু করবে না----এটা কার্যকারণের আওতার ভেতরই পড়ে। একটি গোলাকার পাত্রের কথা ভাবুন। এবং ধরা যাক পাত্রটির ভেতরকার দেয়ালটি খুবই মজবুত,
একেবারে মসৃণ মেঝের মত চকচকে। এবার কল্পনায় তার
ভেতরে একটা ছোট্ট বল ছুঁড়ে দিলেন একটা কৌণিক লক্ষ বরাবর, এবং ঠিক কতটা কোণে সেটা
ছুঁড়লেন সেটা সঠিক জেনে রাখুন। বস্তুটি সেই কোণের
মাত্রা অনুযায়ী আরেকটা দিকে প্রতিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। সেখান থেকে ওটা
সেই গোলাকার পাত্রেরই একটা বিশেষ বিন্দুতে গিয়ে ঘা খেয়ে তৎক্ষণাৎ নিক্ষিপ্ত হবে
ঠিক একই কোণেতে অন্যত্র। আরম্ভের কোণটা যদি
৩৬০ ডিগ্রির একটি ভগ্নাংশের গুণক হয় তাহলে একসময় সেই প্রথম বিন্দুটিতে
প্রত্যাবর্তন করে আবার নতুন পথে চলতে শুরু করবে। ছবিটা একটি গোলাকার (কাল্পনিক যদিও) পিং পং টেবিলের ওপর
বলটির অন্তহীন লাফালাফি করার মত। তবে গোড়ার কোণের
পরিমানটি যদি ৩৬০ ডিগ্রির ভগ্নাংশ(rational number) না হয়, তাহলে কিন্তু বলটা তার অন্তহীন চলার পথে কখনোই আর আগের
বিন্দুটিতে ফিরে আসবে না। তথাপি একটা সত্য
থেকে যায়-----একটি কোণ কেবল একটা পথই(সরলরেখা, যদি তার চিত্র আঁকা হত) নির্দেশ করে। পাত্রের আধারখানি গোলাকার না হয়ে যদি অধিবৃত্তের আকারে
হত তাহলেও গতিপ্রকৃতি মূলত একই থাকত, কেবল চিত্র, মানে গ্রাফ আঁকতে গেলে সেটা
সরলরেখা না হয়ে বাঁকা হয়ে যেত।
এই উদাহরণদুটির মধ্যে মৌলিক মিল
যেখানে সেটা হলঃ কার্যকারণ সম্পর্ক অর্থাৎ হেতুবাদ অক্ষুণ্ন থাকছে দুটিতেই। মূল সংখ্যাটি যা হবে পরবর্তি সংখ্যাগুলো সে অনুসারেই
তৈরি হবে----অর্থাৎ কারণ যেরকম ফলটাও সেরকম। নিউটনতত্বের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে
যাচ্ছে।
কিন্তু
এই সরল চিত্রটি একেবারেই ওলটপালট হয়ে যায়
যখন সেই আধারটির জ্যামিতিক প্রকৃতি আগাগোড়া বদলে যায়। ওটা যত জটিল হবে বলটির গতিপ্রকৃতিও ঠিক সেই পরিমাণে
জটিল হতে শুরু করবে। তখন এমন হয় যে বলসংখ্যা মাত্র একটি হলেও তার গতিপথের যে
ছবিটা উঠে আসে তা আর একটি সরলরেখা বা বক্ররেখা না হয়ে একটা হযবরল ধরণের জগাখিচুড়ি বা কুজ্ঝটিকাজাতীয় অস্পষ্ট জিনিস বের
হয়ে আসে। যেন একটা মেঘের
দলা। অর্থাৎ একটা পুরোদস্তুর কেয়স। বিষয়টি আমার এই চিত্রবিহীন সংক্ষিপ্ত বর্ণনাতে ভালো করে
হয়ত ফুটে উঠল না। তাই কৌতূহলী
পাঠকদের আমি উৎসাহ দিচ্ছি যেন ইভার একল্যাণ্ড-প্রণীত গ্রন্থঃ The Best of All Worlds (১), বা জেমস গ্লাইকের লেখা
কেয়সবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ বই Chaos (২) এর পাতা উল্টিয়ে দেখার
চেষ্টা করেন। এটি বর্তমান যুগের
বিজ্ঞানজগতে একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়। এতে একাধারে উঁচুমানের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন, সব একসাথে মিলে একটা
রহস্যময় জগত তৈরি হয়ে গেছে।
মীজান রহমান
অটোয়া,
২২ শে আগস্ট, ‘১২
মুক্তিসন ৪১
No comments:
Post a Comment