মীজান রহমান
তিন
১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন যুক্ত রাষ্ট্র সুইডেন আর নরওয়ের রাজা তৃতীয় অস্কার তাঁর ষষ্ঠদশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটা এককালীন পুরস্কার ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজা অস্কার ছিলেন জ্ঞানবিজ্ঞনের প্রতি দারুণ আকৃষ্ট। বিশেষ করে গণিতের প্রতি। বর্তমান যুগের রাজাবাদশাদের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্যজনক মনে হলেও এটা সত্য যে সেযুগে জ্ঞানের প্রতি প্রচণ্ড একটা আকর্ষণ ছিল অনেক নৃপতিরই। সে সুবাদেই তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সেসময়কার সুইডেন, তথা সারা ইউরোপের সেরা গাণিতিকদের মধ্যে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব মিটাগ-লেফ্লার (১৮৪৬-১৯২৭)। নামটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে হয়ত। মিটাগ তাঁর প্রথম নাম আর লেফ্লার পারিবারিক, নাকি উল্টোটা? আসলে কোনটাই না। লোকটা সত্যি সত্যি একটু ভিন্ন প্রকৃতির পুরুষ ছিলেন। ঠিক নারীবাদী না হলেও নারীর সমান অধিকার এবং সামাজিক সম্মানের প্রতি ছিলেন দারুণ সহানুভূতিশীল । এবং সেসময়কার চিন্তাধারার পরিপ্রেক্ষিতে ভীষণ মুক্তমনা। তাঁর বাবার নাম ছিল মিটাগ, আর মায়ের অবিবাহিত নামটি ছিল লেফ্লার। জন্মকালে মিটাগ হলেও পরবর্তীতে তার সঙ্গে মায়ের নামটি নিজেই যুক্ত করে নিলেন---হয়ে গেলেন মিটাগ-লেফ্লার। গণিতজগতের অত্যন্ত সম্মানিত একটি নাম। সুইডেনের অধিবাসীদের কাছে তিনি একজন জাতীয় হিরো।
মিটাগ-লেফ্লার সেকালের সর্বাধুনিক অমীমাংসিত গাণিতিক সমস্যাগুলো সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকেফহাল ছিলেন। জানতেন যে দাঁত-বসানো-শক্ত এমন সব সমস্যার মধ্যে একেবারে চূড়ায় বসে আছে ভরযুক্ত বস্তুর ত্রিদেহী, তথা বহুদেহী সমস্যা। তাই এটিই হোক রাজার জন্মদিনের নির্বাচিত সমস্যা, মনে মনে ঠিক করে ফেললেন তিনি। রাজা অস্কারের কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসার সাথে সাথে তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন এবং সে অনুযায়ী গণিত জগতে বিস্তারিতভাবে সিদ্ধান্তটি প্রচার হয়ে গেল।
প্রতিভার স্বভাবটাই এমন যে সমস্যা যত কঠিন হবে তার প্রতি আকর্ষণটাও তেমন প্রবল হবে। তারা চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে। সেকালের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টিকর গাণিতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে ত্রি-দেহী সমস্যা ছিল একেবারে প্রথম সারিতে। অতএব ঘোষণার সাথে সাথে দেশ-বিদেশের মেধাবী গবেষকদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। একেতো সমস্যাটি এমনিতেই আকর্ষণীয়, তার ওপর পুরস্কার। সে তো আরো উত্তেজনার ব্যাপার। প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল তুমুল বিক্রমে।
এই প্রতিযোগীদের মধ্যে একজন ছিলেন ফ্রান্সের তৎকালীন তরুণ গাণিতিকদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব আনরি পয়েনক্লেয়ার (১৮৫৪-১৯১২)। তিনি ছিলেন মূলত বলবিদ্যাবিশারদ----নিউটন থেকে শুরু করে,
অয়লার, লাগ্রাঞ্জ, হ্যামিলটন, জ্যাকবি, এঁদের মত শীর্ষস্থানীয়
গবেষকদের যাবতীয় মৌলিক কাজের সঙ্গে সুপরিচিত। তিনি ত্রিদেহী সমস্যা নিয়ে আগেও অনেক ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। পুরস্কার ঘোষণার পর সেটা
মনোযোগের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। কিছুদিন একনিষ্ঠ গবেষণা করে তাঁর মনে হল উত্তর পেয়ে গেছেন---এতদিনের দাঁত-বসানো-শক্ত সমস্যাটির পূর্ণ সমাধান তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে! কাজটি একটু গোছগাছ করে সাজিয়ে মিটাগ-লেফ্লারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। মিটাগ-লেফ্লার বেশ মনোযোগ দিয়েই পারলেন পেপারটি। কোনরকম ফাঁকফোকড় কোথাও আছে বলে মনে হল না। তাছাড়া গাণিতিক হিসেবে পয়েনক্লেয়ারের সুনাম সম্বন্ধে আগে থেকেই সচেতন ছিলেন তিনি---এ লোক কোনও কাঁচা কাজ করবে না সে-বিশ্বাস তাঁর যথেষ্টই ছিল। দুরূহ সমস্যার সাবলীল সমাধান পেয়ে মিটাগ-লেফ্লার মহাখুশি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন---পুরস্কারের সুযোগ্য প্রাপক আনরি পয়েনক্লেয়ার। এই মর্মে ঘোষণা প্রচার হয়ে গেল গণিতজগতে। সাড়া পড়ে গেল চতুর্দিকে। বিজ্ঞানজগতের উত্তেজনা রাজনৈতিক উত্তেজনার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। নিশ্চয়ই কালজয়ী প্রতিভা হবে লোকটা---পয়েনক্লেয়ারের সুনাম আরো শতগুণে ছড়িয়ে পড়ল গণিতের উর্ধমহলে। রাজপ্রাসাদে যথাযথ আড়ম্বরের সাথে পুরস্কারপ্রদান পর্ব সমাপ্ত হবার পর পেপারটি মিটাগ-লেফ্লার সাহেব ছাপার জন্যে পাঠিয়ে দেন তাঁর নিজেরই প্রতিষ্ঠিত সেসময়কার এক শীর্ষস্থানীয় গাণিতিক জর্ণালে। সেটার ভুলভ্রান্তি কিছু পেলে সেগুলো শুধরে প্রুফ দেখার ভার দেওয়া হল এডভ্যান ফ্র্যাগমেনের কাছে
(এই ভদ্রলোক বয়সে তখন খুব তরুণ হলেও ভবিষ্যতের বিরাট সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে মিটাগ-লেফ্লারের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন)। ফ্র্যাগমেন প্রুফ দেখাকালে পয়েনক্লেয়ারের থেওরেমের প্রমানটিতে যৌক্তিক স্খলন দেখতে পেলেন কিছুটা, এবং সে-মর্মে মঁসিয়ে পয়েনক্লেয়ারের কাছে একটি পত্র পাঠিয়ে দিলেন, যদিও পেপার প্রকাশের ব্যাপারে কোনও সমস্যা আছে এমন কোন দুর্বিনীত ইঙ্গিত ছিল না তাঁর প্রুফ দেখাতে। যথাসময়ে পেপার ছাপা হয়ে গেল,
এবং অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে না দেখলে তাতে কারুরই কোন ফাঁকফোকড় চোখে পড়ার কথা নয়, যেমন পড়েনি স্বয়ং মিটাগ-লেফ্লারের চোখে। কিন্তু ফ্র্যাগমেনের চিঠি পড়ার পর পয়েনক্লেয়ার যখন দ্বিতীয়বার তাঁর কাজটি নেড়ে চেড়ে দেখলেন তখন তাঁর মাথা ঘুরে গেল----সর্বনাশ, এতো ডাহা ভুল। গোটা ব্যাপারটাই, প্রমাণের যুক্তিই কেবল নয়, প্রমাণিতব্য সিদ্ধান্তটিও। মানে নিউটনের কলনশাস্ত্র আর প্রথাগত কলাকৌশলগুলো ব্যবহার করে যে ফলাফল তিনি পেয়েছিলেন তা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও আসলে তা নয়। সে কি লজ্জা পয়েনক্লেয়ার সাহেবের---পত্রিকা বের হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সবাই জেনে গেছে ত্রিদেহী সমস্যার চূড়ান্ত মীমাংসা হয়ে গেছে। তিনি তখন তাড়াহুড়ো করে সম্পাদক মিটাগ-লেফ্লারের কাছে খবর পাঠালেন যে প্রকাশিত পেপারটি তিনি প্রত্যাহার করছেন, এবং সংশোধিত কাগজ শেষ হয়ে গেলে তার পুঃনপ্রকাশের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তিনি নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বহন করবেন। মিটাগ-লেফ্লার আগ্রহসহকারেই রাজি হয়ে গেলেন তাঁর প্রস্তাবে।
পরবর্তি কাহিনী গণিতজগতের এক যুগান্তকারি ঘটনা। পয়েনক্লেয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন যে গতানুতিক গাণিতিক পদ্ধতিতে এ-সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ নতুন চিন্তার সূচনা না হলে ত্রিদেহী বা বহুদেহী বিশ্বের দ্বারোদ্ঘাটন হবে না। কলনশাস্ত্র আর বীজগণিতের পথ এড়িয়ে তিনি জ্যামিতির শরণাপন্ন হলেন। এবং তাতেই হল অভীষ্টসিদ্ধি----ধীরে ধীরে প্রকৃতি তাঁর অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত করতে শুরু করলেন। কিছুদিন দিনরাত খাটাখুটি করে আনরি পয়েনক্লেয়ার এক অপূর্ব উপহার নিয়ে এলেন গণিতের বিচিত্র জগতে। তাঁর সমাধানের মধ্য দিয়ে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিদ্বারা ধাবিত গতির যে সূক্ষ্ম বিষয়গুলো কিছুতেই ধরা দিতে চাচ্ছিল না তাঁর দ্বিদেহী তত্বের বলয়তে, তার পূর্ণ সমাধান অবিশ্বাস্য এক রূপসীর রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হল। এবং সেটা হল এমনই এক নতুন সজ্জায় যে তাতে করে জ্যামিতিক গণিতের একটা পুরোপুরি নতুন শাখাই সৃষ্টি হয়ে গেল বলতে গেলে। শাখাটির নাম ‘টপলজি’ যার সঠিক বাংলা আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। (পরাজ্যামিতি বলা ঠিক হবে কি?)এই নতুন জ্যামিতি অনুযায়ী একটি বর্গক্ষেত্র আর একটি বৃত্তের মাঝে (দুয়ের ভেতরটা যেন একইরকমভাবে ফাঁকা থাকে) প্রকৃতিগত কোনও প্রভেদ নেই---দুটোই টেনেটুনে ছোট আকারে সংকুচিত করে করে বিন্দুতে পরিণত করা যায়,
সুতরাং পরাজ্যামিতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা অভিন্ন। স্পষ্টতই গতানুগতিক ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির সঙ্গে আকাশপাতাল তফাৎ।
কিন্তু তার চেয়েও বড় যে-জিনিসটি পরিষ্কার ভাষাতে ফুটে উঠেছে সেটা হল বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে পয়েনক্লেয়ারের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি পূর্ণ অনুধাবন, যেন সকল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁর সন্ধানী দৃষ্টির তীক্ষ্ণবাণে বিদ্ধ হয়ে অবশেষে নতশিরে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল এই যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যতই জটিল হোক
(এবং আকর্ষণ-বিকর্ষণের অমোধ বিধান দ্বারা নিবদ্ধ বস্তুর সংখ্যা নিউটনের দ্বিদেহী সংস্থার গণ্ডী পার হয়ে তিন বা তারও উর্ধ সংখ্যাতে পৌঁছে গেলে), যতই জটিল থেকে জটিলতর পথ পরিক্রম করুক না কেন,
‘শেষ পর্যন্ত’ প্রতিটি চলমান বস্তুই তার যাত্রাবিন্দুতে প্রত্যাবর্তন করে, সাময়িকভাবে হলেও। শর্ত হল যে তাদের পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতের নিরন্তর প্রক্রিয়াটি অবিরাম যেন চলতে থাকে। সেখানে কোনরকম বিরতি ঘটলে চলার শকটটিও স্থিতাবস্থাতে সমাপ্ত হয়ে যাবে। কিছুটা ঘড়ির কাঁটার মত। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে আমি একটা গুরুত্ব আরোপ করেছি ‘শেষ পর্যন্ত’ শব্দযুগলের ওপর----তার কারণ এই যে ফিরে আসাটা, এটি কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে মোটেও টের পাওয়া যাবে না। আসলে অধিকাংশ গতিই এরকম প্রত্যাবর্তী আচরণ প্রদর্শন করে না----অনেক অনেক কাল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারলে তবেই সে ধরা দেবে। অবশ্য সব বস্তু পূর্বাবস্থানে ফিরে এসে অন্তহীন
পরিক্রমায় ঘুরতে থাকবে তা’ও নয়----কিন্তু যারা আসে তাদের প্রতিই আমাদের বেশি জোর
দিতে হয়। যেমন সূর্যের
চারপাশে নিত্য ঘূর্ণমান পৃথিবীএকবার ঘুরে এসে আবারও ঠিক একই পথে চলতে শুরু করে। পয়েনক্লেয়ার সেকথাটার ওপরই জোর দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর নিজেরই ভাষায়ঃ “The reason the periodic solutions are so precious to us is that they
are the only opening by which we can enter this inaccessible fortress”. (এই পৌনঃপুনিক সমাধানগুলো এত মূল্যবান আমাদের কাছে কারণ এই একটিমাত্র উপায় আমাদের যাতে করে আমরা প্রকৃতির দুর্ভেদ্যে রহস্যপুরিতে প্রবেশ করতে পারি)
জটিল গণিতের সাধকরাও যে কখনও কখনও কাব্যিক ভাষাতে তাঁদের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন এই পংক্তিটি যেন তারই খানিক ইঙ্গিত দেয়।
আমরা সাধারণ মানুষ হয়ত বিজ্ঞের মত মুচকি হেসে বলবঃ এগুলো সব পাগল গাণিতিকদের উর্বর কল্পনার উদ্ভট আবিষ্কার ছাড়া কিছু নয়। এর সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক কি?
হ্যাঁ আছে। আমরা অজ্ঞ বলেই বুঝেও বুঝি না, দেখেও দেখিনা। পয়েনক্লেয়ারের কথাগুলো যে বর্ণে বর্ণে সত্য তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো আমাদের চোখের সামনে---রোজই ডগডগ করে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। মানে আমাদেরই চিরপরিচিত সূর্য-চন্দ্র-পৃথিবী নিয়ে যে ত্রিদেহী সমাবেশটি উর্ধগগনে, আমি তারই কথা বলছি। এরা তো তিনটিতে মিলে সেই একই দৃশ্যের অবতারণা করে চলেছে অনাদিকাল ধরে---একে অন্যকে টানছে নিজ নিজ ভরমাফিক ক্ষমতা দিয়ে, অতএব তিনটিরই তো কিছু-না-কিছু নড়াচড়া হবার কথা ঐ কারণে। হয়ও। তবে সূর্য তারকাটি আকারে এত বিশাল অন্যদুটির তুলনায় যে তার গায়ে বলতে গেলে সামান্য একটু আঁচড়ও লাগে না। লাগে অপরদুটির গায়ে। লাগে বলে পৃথিবী বছরে একবার করে সূর্যবাবার চারদিকে ঘোরে,
আর চন্দ্র ঘোরে পৃথিবীর চারদিকে মাসে একবার। ওদের মধ্যে যে ইতোমধ্যে নানারকম টানাটুনি হয়ে যাচ্ছে তা আমরা খালিচোখে টেরও পাচ্ছি না। তবে নভোদর্শীরা পায় তাঁদের শক্তিশালী দূরবীণের সাহায্যে। তাঁরাই কেবল টের পান যে প্রায় প্রতিবছরই পৃথিবী এবং চন্দ্র, দুটিই সামান্য পরিমাণে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে তাদের গ্রহপথ থেকে,
যদিও পয়েনক্লেয়ারের সেই
“দীর্ঘকাল অপেক্ষা”র পর দেখা যায় তারা আবার সেই একই জায়গায় ফিরে এসেছে। এভাবেই বিশ্বচরাচর তার চিরকালীন স্থিতিস্থাপকতা অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছে।
পয়েনক্লেয়ারের যুগান্তকারি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির আরো এক বিচিত্র বৈশিষ্ট্য একটু উঁকি মারতে শুরু করেছে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়
Chaos, সাধারণ অর্থে যাকে আমরা চরম বিশৃংখলা হিসেবে বুঝি। এর বৈজ্ঞানিক অর্থ তার চেয়ে অনেকটাই গভীর---বর্তমান যুগে ফলিত গণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পরিণত হয়েছে বলা যায়। যেখানেই বহু বস্তুর যুগপৎ সংঘাতের ব্যাপার সেখানেই কেয়সের সম্ভাবনা। ঢাকা শহরের বহু-আলোচিত, প্রায়-কিংবদন্তীতে-পরিণত-হওয়া যানজটের সঙ্গেই তুলনীয় বলা চলে। শব্দটির বিজ্ঞানসম্মত কোনও বাংলা প্রতিশব্দ বেরিয়েছে কিনা জানিনা, তবে শব্দটির বৈজ্ঞানিক অর্থের সঙ্গে সাধারণ ব্যবহারিক অর্থের এতটাই দূরত্ব যে আমার মনে হয় এর কোন তরজমাই হওয়া ঠিক হবে না।
যা’ই হোক, উপরের কথাগুলোর সারমর্ম এই যে পয়েনক্লেয়ারের গবেষণার একটি উপরি প্রাপ্তি বিজ্ঞানের এই নতুন চিন্তার ধারাটি। কিন্তু এটা হল তাঁর পরোক্ষ ফলাফল, প্রত্যক্ষ নয়। প্রত্যক্ষটি হল ভরযুক্ত বস্তুর গতি বিশ্লেষণের এক অভিনব পন্থার আবিষ্কার----জ্যামিতিক পন্থা। নিউটন আমাদের শিখিয়েছিলেন কিভাবে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাথে বস্তুর ত্বরণ সমীকরণীকৃত করে কলনবিদ্যার রীতিনীতি (যা নিউটনের নিজেরই আবিষ্কৃত)দ্বারা সোজা অঙ্ক কষে বের করে ফেলা যায় আদ্যোপাত সব সমস্যার সমাধান। অবশ্য এখানে বলে রাখা দরকার যে জ্যামিতির পদ্ধতিতে আঁকা চিত্রচিত্রায়নের এই প্রক্রিয়াটি গতানুগতিক ইউক্লিডিয়ান ছবির মত ঠিক নয়। এগুলো সাধারণত অবস্থানভিত্তিক স্পেসে আঁকা নয়, অবস্থান এবং গতি দুটোকেই সমান মর্যাদা দেওয়া স্পেসে, যাকে গণিতের ভাষায় বলা হয়
‘ফেজ স্পেস’। এখানে বস্তুর অবস্থানকে দেওয়া হয় একটি অক্ষ,
আরেকটি থাকে গতির দখলে। অর্থাৎ এই মানচিত্রে একটা বিন্দু দৈর্ঘ-প্রস্থ-উচ্চতা ইত্যাদি সূচিত করে না, করে একটি চলমান বস্তুটি তার চলার পথে এ-মুহূর্তে কোথায় অবস্থিত এবং এর গতিবেগ কত। এই চিত্রটিতে একটি পরীক্ষমান বস্তুর গতিবিধি অনুসরণ করে কিধরণের ছবি সৃষ্টি করে যাচ্ছে তার গোটা ইতিহাসটিই কেবল বোঝা যায় না,
এই গতির প্রকৃতিটাও পরিমাপন করা যায়----স্থিতিশীল, সুশৃংখল না একেবারেই এলোমেলো, বিভ্রাটময় (অর্থাৎ কেয়টিক)। বহুমাত্রিক এবং বহুদেহী পরিস্থিতিতে এই তথ্যটুকু অত্যন্ত প্রয়োজন।
মীজান রহমান
অটোয়া,
২২ শে আগস্ট, ‘১২
মুক্তিসন ৪১
No comments:
Post a Comment