Sunday 26 August 2012

বাগান থেকে মহাকাশ - ১


মীজান রহমান
                         এক
     ছোটবেলা থেকেই দুটি ফলবৃক্ষের গল্প শুনে এসেছি আমরা একটি আদম-হাওয়ারনিষিদ্ধফলের গল্প, আরেকটি আইজ্যাক নিউটনের গাছ থেকে আপেল পড়ার গল্পনিষিদ্ধফল বলতে যে আসলেজ্ঞানবোঝায় সেটা বুঝতে বেশ সময় লেগেছিল, যদিও সেযুগের (এবং এযুগেও) লোকেরা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই মেনে নিয়েছিলেন গল্পটা (এবং যার সত্যতা বিষয়ে ধর্মগুরুরা যেমন নিঃসন্দেহ আধুনিক বিজ্ঞানীরা ঠিক তেমনই সন্দিহান) তবে আপেলের গল্পটি তুলনামূলকভাবে অনেক ইহজাগতিক, অতএব বিশ্বাসযোগ্য কিন্তু আসলেই কি ঘটেছিল ব্যাপারটা? আসলেই কি নিউটনের মাথাবরাবর হতভাগা আপেলটি পড়ে গিয়েছিল গাছ থেকে?
      মহৎ লোকেদের নিয়ে চুটকি-চাটকি গল্প সবারই পছন্দ আলবার্ট আইন্স্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব আমরা জন বুঝি সেটা ভাববার বিষয়, কিন্তু তাঁর কাল্পনিক যানে করে মহাকাশ ভ্রমণের চিত্তাকর্ষক কাহিনী শুনতে কার না ভাল লাগবে বলুন এটা চমক লাগানোর মত গল্প তো বটেই যে বড়ভাই শূন্যভ্রমণের পর থেকে ফিরে এসে দেখেন ছোটভাইয়ের বয়স তাঁর চেয়ে বেশি! এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কি হতে পারে আপেক্ষিক তত্ত্বের এটুকু রহস্যই আমাদের জন্য যথেষ্ট----আইনস্টাইন চিরকালের জন্য আমাদের মনে গেঁথে রইলেন সত্যমিথ্যা কি আসে যায় গল্প মজার হলেই হল
     প্রাচীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন সিরাকিউজের গ্রীক পণ্ডিত আর্কিমেডিস (খৃঃপূঃ ২৮৭-২১২) একাধারে পদার্থবিদ, প্রকৌশলি, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, এবং সর্বোপরি সেসময়কার শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে কিভাবে? একটি শব্দ দিয়েঃইউরেকা মানেঃপেয়েছি, পেয়েছি আর মনে রেখেছে শব্দটা উচ্চারণ করতে করতে তাঁর নির্বস্ত্র হয়ে বেরিয়ে পড়া বাড়ি থেকে আমরা সাধারণ মানুষ যেমন লাখ টাকার লটারি জিতে ফেলতে পারলে নেংটা হয়ে রাস্তায় বেরুবার উপক্রম হই, উনি সেরকম কোনও লটারি জেতেননি---কেবল একটা বড় আইডিয়া মাথায় এসে গিয়েছিল টবের পানিতে স্নানরত অবস্থায় থাকাকালে গল্পটা রসালো তাতে সন্দেহ নেই, এবং সাধারণ মানুষের জন্যে সেটাই যথেষ্ট কার কি গরজ পড়ে গেছে জানার যে তিনি ছিলেন প্রকৌশলিদের অবশ্যপাঠ্য বিষয় স্ট্যাটিক্স হাইড্রোস্ট্যাটিক্সের জনক, ছিলেন পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্বতত্বের (specific gravity) উদ্ভাবক, এবং এই আপেক্ষিক গুরুত্বের আইডিয়াটিই তাঁকে উত্তেজনার চরম শিখরে পৌঁছে দিয়ে গোছলের জায়গা থেকে বের করে করে দিগম্বর অবস্থায় রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিল অনেকে হয়ত জানেও না যে রোমানদের বিরুদ্ধে গ্রীকপক্ষের যুদ্ধকালে এক মূর্খ রোমান সৈন্যের অস্ত্রাঘাতে এই মহান ব্যক্তিটির প্রাণহানি হয়েছিল
      আইজ্যাক নিউটনের আপেলপতনের গল্পটি তেমন মজাদার না হলেও একটা চমকপ্রদ রোমান্টিকতা ছিল এতেও আপেলের বাগান, তরুণ নিউটন ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে ডুবে আছেন তাঁর কল্পনার জগতে এমন সময় গাছ থেকে টুপ করে একটা পাকা আপেল পরে গেল ঠিক তাঁর কপাল বরাবর আর অমনি দৈববাণীর মত তাঁর মাথায় উদয় হল এক অসাধারণ চিন্তা----তাইতো, তো মহাবিশ্বব্যাপী এক গূঢ় মহাশক্তির উপস্থিতিকে ঘোষণা করছে অনেকটা যেন ধর্মগ্রন্থের অহি-নাজেলের মতই প্রেরণাজাগানো আসলে নিউটন নিজেই নাকি ওই আপেলবৃক্ষটিকে আদিসৃষ্টির সেই বাইবেল-বর্ণিতজ্ঞানবৃক্ষবলে ধারণা করে বসেছিলেন (গল্পটি বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এটা সত্য যে মহামতি নিউটন অতিশয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন, এবং প্রচলিত ভূতপ্রেতজাতীয় গল্পের প্রতি যথেষ্ট দুর্বলতাও ছিল তাঁর) যা হোক -নিবন্ধের প্রাথমিক আলোচ্য বিষয় হল গল্পগুলো কতখানি সত্য, এবং কতটুকুই বা পুরোপুরি বানোয়াট নিউটনের বাগানে কি সত্যি সত্যি আপেল পড়েছিল তাঁর মাথায়? নাকি আর্কিমেডিসের গল্পের মতই সন্দেহসংকুল?
     সম্ভবত আপেলের ঘটনাটি আসলেই ঘটেছিল নিউটনের গ্রামের বাড়িতে তার অন্তত দুটি ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে প্রথম সাক্ষ্য এসেছে তাঁরই ভাইঝির স্বামী জন কনডুইট নামক এক যুবকের লিখিত বয়ান থেকে---নডুইট পরবর্তীকালে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সহযোগী ছিলেন ইংল্যাণ্ডের টাঁকশালাতে পরিচালকের পদে নিযুক্ত থাকাকালে তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী ১৬৬৬ সালে ব্রিটেনের ব্যাপক মহামারির সময় নিউটন কেম্ব্রিজ থেকে তাঁর গ্রামের বাড়ি লিঙ্কনশায়ারে মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন ছুটিছাটাতে বরাবরই তা করতেন তিনি একদিন ভাবাকুল অবস্থায় বাগানে হাঁটাহাঁটি করার সময় গাছ থেকে একটি পাকা আপেল টুপ করে মাটিতে পড়ে তাঁর চোখের সামনে আর অমনি তাঁর মন ছুটে গেল অন্যজগতে এই পড়াটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হল তাঁর কাছে নিচে পড়ছে কেন? এবং ঠিক লম্বালম্বিভাবে, কোণাকুণি বা আঁকাবাঁকা হয়ে নয় এথেকে তিনটি জিনিস প্রতীয়মান হয়ে উঠল তাঁর মনে এক, আপেল নিচে পড়ে, ওপরে ওঠে না, কারণ নিচের দিকেই আকর্ষণধর্মী একটা শক্তি তাকে টেনে নেয় দুই, কোণাকুণি বা বাঁকানো পথে পড়ে না তার কারণ আকর্ষণটি পৃথিবীর ঠিক কেন্দ্রের দিকে----অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ একটি কেন্দ্রিক শক্তি(central force), যার একটা গভীর তাৎপর্য আছে তিন, এই আকর্ষণ কেবল আপেলের বেলায় কাজ করে তা নয়, এটাই বিশ্বপ্রকৃতি---সকল বস্তুর ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য প্রতিটি ভরযুক্ত বস্তুই আসলে একে অন্যকে এভাবে আকর্ষণ করে ছোট বস্তুর বেলায় এটা লক্ষণীয় নয়, বড় বস্তু, যেমন ভূমণ্ডল, সেক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষণীয়
   দ্বিতীয় সাক্ষ্য আমরা পাই নিউটনের ব্যক্তিগত বন্ধু (লোকটার বিশাল প্রভাবপ্রতিপত্তি ছিল বটে সমগ্র দেশজুড়ে, কিন্তু বন্ধুসংখ্যা ছিল হাতে গোণার মত) উইলিয়াম স্টুকলি (১৬৮৭-১৭৬৫) বিশিষ্ট জীবনীকার ইতিহাসবিদ তাঁর বিখ্যাত বন্ধুর জীবনীতে লিখে গেছেন যে আপেলের গল্পটি তাঁর বন্ধুর নিজের মুখ থেকে শোনা---১৭২৬ খৃষ্টাব্দে, অর্থাৎ নিউটনের মৃত্যুর একবছর আগে লণ্ডনের কেন্সিংটন পার্কে বসে দুজনে ঘনিষ্ঠ আলাপ করা কালে এবং তাঁর বর্ণনার সঙ্গে জন কনডুইটের বর্ণনা প্রায় হুবহু মিলে যায় তাতে মনে হয়, বিজ্ঞানের অন্তত -গল্পটি হয়ত একেবারে মনগড়া নয়
  কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় বিজ্ঞানের তো ধারাই এটা কোনকিছুই চূড়ান্তভাবে মিটে যায় না আপাতদৃষ্টিতে একটা প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেলে নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়, অনেকসময় সেই সমাধান থেকেই প্রশ্নের উদ্রেক হয় আপেলের ঘটনা সত্য হলেও প্রশ্ন ওঠে সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণের ধারণাটা কি হঠাৎ করে দৈববাণীর মত পেয়ে গিয়েছিলেন নিউটন, না, আগেও একটা ইতিহাস ছিল বা ছিল কোনও বৈজ্ঞানিক আভাস ইঙ্গিত সাধারণত বিজ্ঞানের কোনও বড় আইডিয়া হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়ে যায় না প্রচণ্ডরকম মেধাবি কোনও ব্যক্তি একদিন ঘুম থেকে উঠে ইউরেকা বলে ঘরের বাইরে চলে যান না তাঁর সদ্যপ্রাপ্ত বৃহৎ আইডিয়া নিয়ে বিজ্ঞানের রীতিটা এমন যে সব সৃষ্টির পেছনেই একটা দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি লাগে, লাগে একটা চিন্তাভাবনার ধারাবাহিকতা, সেটা মৌলিক চিন্তাই হোক আর যৌক্তিক চিন্তাই হোক আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বের পেছনে তিনশবছর আগে ছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি যাঁর নিজেরও একপ্রকার আপেক্ষিক তত্ব ছিল যা আইনস্টাইনের চিন্তাজগতে যথেষ্ট খোরাক যুগিয়েছিল তদুপরি ছিল নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ব যা না থাকলে চট করে এতসব যুগান্তকারি ভাবনা তাঁর মাথায় প্রবেশ করার সুযোগ পেত কিনা সন্দেহ শুধু তাই নয়, তাত্বিক বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় সহায় অন্য বিজ্ঞানীদের তত্বকথা নয়, ফলিত বিজ্ঞানীদের পরীক্ষালব্ধ ল্যাবরেটরিজাত তথ্যসমূহ
  নিউটন কেবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্বই উপলব্ধি করে ক্ষান্ত হননি, তার প্রকৃতিও পূর্ণভাবে নিরূপণ করে গিয়েছিলেন দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে ঠিকই, কিন্তু সেই আকর্ষণের মাত্রা কমতে শুরু করে বস্তুদ্বয়ের দূরত্বের সাথে, ওটা প্রায় সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝার মত, কিন্তু এই কমে যাওয়ার পরিমাণটা যে দূরত্বের বিপরীত বর্গের অনুপাতে সেটা বুঝে ফেলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয় নিউটন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন সহজেই কিন্তু কিভাবে বুঝেছিলেন, এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি কিনা বিপরীত বর্গনীতি আবিষ্কারের, তারও একটা পশ্চাদকাহিনী আছে
  মহাকাশের গ্রহনক্ষত্র নিয়ে মানুষের কৌতূহল আজকের নয়, পুরাকাল থেকেই বর্তমান যুগে আমরা যেমন অমাবস্যার রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে সপ্তর্ষিমণ্ডল আর নক্ষত্ররাজির মিটিমিটি আলোর রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করি, আদিযুগের মানুষরাও ঠিক একইভাবে তারাদের গতিবিধি বুঝবার চেষ্টা করতেন এযুগে আমাদের হাতে হাজারটে যন্ত্র আছে দূর দূর নক্ষত্র, যা খালি চোখে দেখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, সেটা দূরবীন দিয়ে অনায়াসে দেখতে পারা সেযুগের মানুষ তাই খালি চোখে যা দেখতেন তারই ওপর ভরসা করে প্রকৃতির ধারাপ্রকৃতি সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতেন তাঁরা দেখতেন চন্দ্রগ্রহ কিভাবে প্রতিমাসে নিয়মিত উদয় হচ্ছে আকাশে ছোট্ট কাস্তের আকারে, তারপর দুসপ্তাহের মাঝে বৃদ্ধি পেতে পেতে পূর্ণ গোলাকার মূর্তিতে আকাশ-পাতাল উজাড় করে দিচ্ছে আলোতে আলোতে সেই যে সুনির্দিষ্ট সময়ান্তর প্রতিমাসে একইভাবে উদয় হওয়া, পূর্ণ হওয়া,আবার বুঁজে যাওয়া , সেই পর্যবেক্ষণ থেকেই জন্ম নেয় চান্দ্রবৎসর প্রাচীন যুগে প্রায় সবদেশেই চান্দ্রবৎসরের ব্যবহার ছিল এখন কোথাও তা ব্যবহার করা হয়না, যদিও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে প্রায় প্রতিটি মুসলিমপ্রধান ইহুদী রাষ্ট্র ইজরায়েলে চান্দ্রিক বৎসর অবধারিতভাবে প্রচলিত আজো পর্যন্তইহুদীদের ইহুদী পঞ্জিকা আর মুসলমানদের হিজরি পঞ্জিকা পুরোপুরিই চন্দ্রানুসারী
  আধুনিক যুগে যেমন পাশ্চাত্য সভ্যতা জ্ঞানবিজ্ঞানে র্বক্ষেত্রেই অগ্রসর প্রাচ্যের অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায়, মধ্যযুগের আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল ঠিক তার বিপরীত----পশ্চিমই বরং ছিল অনেক পশ্চাতে বিশেষ করে ভারত, চীন এবং সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের তুলনায় সেসময় ইসলামিক সভ্যতার স্বর্ণযুগ---জ্ঞানবিজ্ঞানের সর্ববিষয়ে তারাই ছিলেন নেতৃস্থানীয় ওদিকে ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী গণিতজ্ঞ আর্যভট্ট ৪৯৯ খৃষ্টাব্দে বিশ্বকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের পরিবর্তে একটি সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের মডেল তুলে ধরলেন সর্বসমক্ষে----শুধু তাই নয়, তিনি বললেন যে পৃথিবী কেবল সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণই করে না, প্রতিদিন নিজেরই একটা কক্ষপথে একবার করে ঘুরপাক খায় তারপর ১০০০ সালে আরব জগতের বিখ্যাত গবেষক আবু রায়হান বিরুনী প্রায় একই প্রস্তাব দাঁড় করালেন সুধিসমাজে, সম্ভবত আর্যভট্টের ঘোষণা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনবহিত থেকেই (সেকালে ইন্টারনেটের গুগুল সার্চ মেশিন দূরে থাক কাগজের ব্যবহারই শুরু হয়নি) দুঃখের বিষয় যে পরবর্তিতে বিরুনী তাঁর অগ্রমুখি মতামত থেকে দূরে সরে গিয়ে গতানুগতিক বিশ্বাস, অর্থাৎ বিশ্বকেন্দ্রিকতা এবং চান্দ্রবৎসরে ফিরে গেলেন তারপর ১৩০০ সালের দিকে নাজম আল-দিন আল-কাতিবি  নামক এক গবেষক নানারকম ছবিটবি এঁকে প্রমাণ করতে চাইলেন যে পৃথিবী আসলেই সূর্যের চারদিকে ঘোরে, উল্টোটা নয় কিন্তু তিনিই বা কি কারণে বিরুণী মত গতানুগতিক ধারাতে ফিরে গেলেন, সে’ও এক রহস্য বটে
  এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা কি সব বিফল ছিল তাহলে? একবার এটা একবার ওটাতে বিশ্বাস করে তাঁরা কি মানুষকে বিভ্রান্ত করছিলেন? মোটেও না গবেষণা কখনোই ব্যর্থ হয় না, যদিও তার ফলাফল সবসময় সত্য না হতে পারে দেখা গেল যে আল-কাতিবির সেই বর্জিত আঁকাজোঁকাগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যবহার করেছিলেন পোলাণ্ডের নিকোলাস কপার্নিকাস(১৪৭৩-১৫৪৩) নামক এক বিজ্ঞানমনস্ক জ্যোতির্বিদ, যদিও কথাটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি কোথাও (তাঁর নিজের আঁকা ছবির সঙ্গে কাতিবির ছবিগুলো অবিকল মিলে যাওয়াতেই বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকরা এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন) কপার্নিকাসের প্রণীত গ্রন্থ “On the Revolution of Celestial Spheres” (১৫৪৩) বলতে গেলে পশ্চিম বিশ্বে এক অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা করে খৃস্টান চার্চের তৎকালীন টলেমি আরিস্টটোলভিত্তিক ভূকেন্দ্রিক তত্বের অনড় বিশ্বাসের ভিত্তি নড়িয়ে  তিনিই প্রথম স্থির বিশ্বাসের ওপর বুদ্ধি যুক্তির  প্রাধান্য স্থাপন করে দিলেন বইটি প্রাকাশলাভের অব্যবহিত পরই তিনি মারা যান সম্ভবত মৃত্যু তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছি চার্চের অপরিসীম লাঞ্ছনা, এমনকি দৈহিক অত্যাচারের কবল থেকে তাঁর মতামত সমর্থন করার কারণেই সমসাময়িক বেশ কজন খ্যাতনামা ব্যক্তির ভাগ্যে অসীম দুর্ভোগ নেমে এসেছিল, মহামান্য গ্যালিলিও তা থেকে রেহাই পাননি কিন্তু চার্চ রুদ্ধ করতে পারেনি প্রগতির পথ বুদ্ধিকে যদি তার নিজস্ব নির্বাধ পথে অগ্রসর হতে না দেওয়া হয়, তাহলে সেজাতি আত্মদহনে কালে কালে নির্বাপিত হয়ে যেতে বাধ্য ইউরোপীয় সভ্যতা তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত কেবল ইউরোপীয়ানই বা বলব কেন, প্রাক-মধ্যযুগের ইসলামিক সভ্যতারও তো প্রায় একই ইতিহাস ইসলামের যে বর্তমান বাধার দেয়াল দাঁড় করানো জ্ঞানসাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই বাধানিষেধগুলো সেসময় তা ছিল না এবং ছিল না বলেই আজকে আমরাইসলামিক সভ্যতাবলে একটা যুগের কথা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করতে পারি
  এবার আসুন আমরা সেই পুরনো প্রশ্নে ফিরে যাই----কার আগে কে কি করেছিলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, এবং বিশেষ করে  বিপরীত বর্গনীতি, উভয় আবিষ্কারের জন্যেই আদি জনক হলেন রবার্ট হুক অথচ নিউটন যখন তাঁর মাধ্যাকর্ষণ তত্ব এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি সুবিন্যস্তভাবে প্রকাশ করেন ১৬৮৭ সালের ৫ই জুলাই, তাতে তিনি হুক সাহেবের নাম উল্লেখ করেছিলেন বটে, কিন্তুজনকএর গৌরব তাঁর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত ছিলেন না বেচারা হুক বিপরীত বর্গনীতি, আসলে কি নিউটন সাহেব নিজে থেকেই টের পেয়েছিলেন বাগানের গাছ থেকে আপেল পড়ার পর, না, তাঁর পেছনে একটা কাহিনী ছিল যা তাঁকে সাহায্য করেছিল সেটাকে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে দেখা যায় যে রবার্ট হুক নামক এক সহব্রিটন (আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষেহুকস নামক একটা সূত্র অধ্যয়ন করেছি তাদের কাছে নামটি মোটেও অপরিচিত নয়) মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্বন্ধে কেবল অবহিতই ছিলেন না, শক্তি যে বিপরীত বর্গনীতি পালন করে সে-মর্মে পেপারও লিখেছিলেন, এবং সে পেপারটি ব্রিটেনের সম্মানিত প্রতিষ্ঠানরয়েল সোসাইটিতে পাঠ করেছিলেন ১৬৭০ সালের ২১শে মার্চ তারিখে তদুপরি পেপারটি তিনি স্বয়ং আইজ্যাক নিউটনের কাছে ডাকযোগে প্রেরণ করেছিলেন ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে এতে কি প্রমাণ হয় যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সত্যিকার জনক ছিলেন রবার্ট হুক, নিউটন নন? নিউটনের বৈজ্ঞানিক নিবন্ধসমূহ (মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সহ) মুদ্রিত আকারে প্রকাশলাভ করে ১৬৮৭ খৃষ্টাব্দে, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ Philosophiae Naturalis Principia Mathematica তে তাতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিপরীত বর্গনীতির আইডিয়াটির দ্যোপান্ত ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন, এবং হুক সাহেবের যেটুকু কৃতিত্ব প্রাপ্য বলে মনে হয়েছিল তাঁর তার স্বীকৃতি দেওয়াতে মোটেও কার্পণ্য করেননি রবার্ট হুকের রয়েল সোসাইটিতে পড়া পেপার এবং তাঁ ব্যক্তিগত পত্র সবই তিনি উল্লেখ করেছেন, যা আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন যে-কোন গবেষকের জন্যে অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং পেশাগতভাবে শোভন অভীষ্ট কিন্তু তা সত্বেও মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, বিপরীত বর্গতত্ব, এবং এসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যের মূল আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর নিজস্ব দাবি প্রত্যাহার করতে রাজি ছিলেন না তাঁর যুক্তিটা ছিল এরকমঃ ঠিক আছে, মানছি যে রবার্ট হুক এবং তাঁর আগে আরো দুএকজন গবেষক এই শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন, এমনকি এই শক্তি যে দূরত্বের সাথে বিপরীত বর্গের নিয়মে হ্রাসপ্রাপ্ত হয় সেটাও তাঁদের কাজের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু এই তথ্যগুলো যে সত্যি সত্যি প্রকৃতির সকল পদার্থের বেলাতে প্রযোজ্য তার কোনও প্রমাণ তাঁরা দেননি কোনও গাণিতিক গণনাকার্যদ্বারা তাঁদের সিদ্ধান্তগুলোকে সুদৃঢ় যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পারেননি তিনি বললেন যে তত্বগুলোর নির্ভুল প্রমাণের জন্যে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষানিরীক্ষা দরকার যেহেতু মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই গ্রহনক্ষত্রের নিত্য এবং নিয়মিত প্রদক্ষিণ, বিশেষ করে আমাদের সৌরমণ্ডলের সূর্যের চারদিকে পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহের বাৎসরিক আবর্তন, সেসব চাক্ষুশ তথ্যাবলির সঙ্গে হুবহু না হলেও অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ না ওয়া পর্যন্ত কোন তত্বই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে না তিনি যেসমস্ত তত্ব দাঁড় করিয়েছেন তা সেই কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে করে, কিন্তু হুক বা তাঁর পূর্ববর্তী অন্য গবেষকরা সেধরণের পাকাপাকি কোনও যুক্তি দাঁড় করাতে পারেননি উপরন্তু নিউটন যুক্তিসঙ্গতভাবেই দাবি করলেন যে তিনি বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইউহান কেপ্লারের (১৫৭১-১৬৩০)প্রামাণিক তথ্যসমূহ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে তাঁর গাণিতিক ফলাফলের সঙ্গে সেগুলো সুন্দরভাবে মিলে যায় সর্বোপরি তিনি গণিতের যে অংশটি আবশ্যিকভাবেই ব্যবহার করেছিলেন সেটা তাঁর আগে কেউ ব্যবহার করতে পারেন নি, কারণ তাঁর প্রণেতা নিউটন স্বয়ং----ক্যালকুলাস, বা কলনশাস্ত্র
    কিন্তু কেপ্লারের পরীক্ষিত তথ্যগুলি কি সেটা তো বলা হল না এখনো কেপ্লার সম্পূর্ণ নিজের কল্পনাতেই সৌরমণ্ডলের গ্রহউপগ্রহদের গতিবিধি নির্ধারণ করতে পেরেছিলেন তা নয় সেকালের বড় মাপের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কেপ্লারের পূর্বসূরি ছিলেন টাইকো ব্রাহি ( ১৫৪৬-১৬০১) নামক এক অসাধারণ প্রতিভাশীল বিজ্ঞানী তাঁর জন্ম ডেনমার্কে, যদিও তাঁর জন্মস্থানটি বর্তমানে সুইডেনের অংশ তিনি ছিলেন দূরবীণের পোকা----সারাক্ষণ দূরবীণ নিয়ে মজে থাকতেন আকাশের তারাদের গতিপথ আবিষ্কারের আশায় একটু রগচটা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক---কারো সঙ্গেই খুব একটা সুসম্পর্ক রাখতে  পারতেন না এমনকি ডেনমার্কের রাজার সঙ্গেও রাগারাগি করে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন চেকোশ্লাভাকিয়ার প্রাগ শহরে সেখানে তাঁকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয় মনের খুশিতে গ্রহনক্ষত্রের দিকে দূরবীণ উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকার বেশ বড়রকমের একটা প্রেক্ষাগৃহও তৈরি করে দিয়েছিলেন প্রাগের তৎকালীন শাসনকর্তা কা একা সব কাজ কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না বলে ইউহান কেপ্লার নামক একটি মেধাবী জার্মান তরুণকে নিযুক্ত করলেন সহকারী হিসেবে সেটা ছিল ১৬০০ খৃষ্টাব্দ শুরুতেই দুই প্রতিভার ঠোকাঠুকি লেগে গেল, প্রধানত কেপ্লারের পারিতোষিক নিয়ে যাই হোক সেটা মীমাংসা হয়ে যাবার পর দুই বিজ্ঞানী উঠে পড়ে লেগে গেলেন সৌরমণ্ডলের সঠিক প্রকৃতি নির্ধারণ করার কাজে ভাগ্যের এমনই লিখন যে তার ঠিক একবছর পরই মান্যবর ব্রাহি অন্তর্ধান করেন তাঁর অবর্তমানে প্রাগের বিচক্ষণ শাসনকর্তা কেপ্লারকেই নিযুক্ত করে ফেললেন ব্রাহির স্থলে কেপ্লার ব্রাহির দূরবীণলব্ধ  বেশ কিছু তথ্য সৌরমণ্ডলের নিয়মকানুন হিসেবে গ্রহণ করে দুটি সূত্রের ওপর আস্থা স্থাপন করেন সেগুলো এরকমঃ
  সৌরমণ্ডলের যাবতীয় গ্রহাদি (পৃথিবীসহ) অধিবৃত্ত পথে প্রদক্ষিণ করে সূর্যের চতুর্পাশ্বে (কপার্নিকাসের ধারণা ছিল গ্রহপথগুলো বৃত্তাকার বৃত্তের প্রতি পুরাকাল থেকেই মণীষীদের একটা দারুণ পক্ষপাতিত্ব ছিল তাঁরা ভাবতেন যে বৃত্ত, গোলক, এগুলো হলনিখুঁত’, এবং যেহেতু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনাতে খুঁত থাকা সম্ভব নয় সেহেতু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যাবতীয় জ্যামিতিক আকৃতিকেও নিখুঁত হতে হবে কপার্নিকাস নিজেও সেই আদর্শ বিশ্বাস করতেন)
  এই প্রদক্ষিণের বেগটা এমন যে গ্রহ থেকে সূর্যবরাবর একটি সরলরেখা আঁকতে পারলে দেখা যাবে যে রেখাটি সমান সমান সময়ে সমান সমান এলাকা অতিক্রম করে যাচ্ছে
  তিনি দাবি করেন যে সূত্রগুলো দূরবীণের সূক্ষ পর্যবেক্ষণ দ্বারা দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নির্ধারণ করা হয়েছে এই ঘোষণাটির সময়কাল ছিল ১৬০৯ সাল কেপ্লারের তৃতীয় একটি সূত্র আছেঃ
  সূর্যের চারপাশে পুরো একবার ঘূর্ণনের জন্যে যে সময় ক্ষেপন হয় তার বর্গ হল তার অধিবৃত্তটির পরাক্ষের অর্ধাংশ নিয়ে তার তৃতীয় মাত্রার সমানুপাতিক সম্পর্কে সংযুক্ত এতে করে প্রতিটি গ্রহের সৌরবৎসরের সাথে তার জ্যামিতিক অধিবৃত্তের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায় অর্থাৎ সূর্য থেকে দূরত্ব যত হবে ততই লম্বা হবে তার বৎসর সেটা হয়ত সাধারণ বুদ্ধিতেই বুঝে নেওয়া যায়, কিন্তু ঠিক কি নিয়মে তা ঘটে সেটা কেপ্লারের দূরবীণ তাঁকে সে সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে উল্লেখ্য যে এই সূত্রটি পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁকে পুরো দশ বছর ধরে চিন্তাভাবনা করতে হয়েছিল এর প্রকাশকাল ছিল ১৬১৯ খৃষ্টাব্দ
   এখন কথা হল রবার্ট হুক কেপ্লারের সূত্রগুলো সম্বন্ধে জানতেন কিনা কিছু যদিবা জেনে থাকেন তার ব্যবহার প্রকাশ পায়নি তাঁর সপ্তদশ শতকের সপ্তম দশকের প্রকাশিত গবেষণার মধ্যে খুব সম্ভব উপায়ও ছিল না তাঁর এবং সেকারণেই হয়ত তাঁর বৈজ্ঞানিক ঘোষণাগুলোকে কোনও পরীক্ষাগারিক তথ্য দ্বারা সমর্থন করতে সক্ষম হননি নিউটন তা পেরেছিলেন, কারণ তাঁর হাতে তখন এক মোক্ষম হাতিয়ার তৈরি হয়েছিল, যার নাম ক্যালকুলাস, যেটা তাঁর নিজেরই আবিষ্কার উপরন্তু তাঁর কাছে দ্বিতীয় আরেকটি মোক্ষম অস্ত্র ছিল---বস্তুর  গতিসূত্রত্রয় (Three laws of Motion), যা নিউটনের নিজেরই উদ্ভাবন ক্যালকুলাসের সাথে গতির ত্রিসূত্র ব্যবহার করে তিনি অনায়াসে দেখিয়ে দিলেন যে গাণিতিক গণনার সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীত বর্গসূত্র জুড়ে দিলে কেপ্লারের সৌরমণ্ডলের গতিবিষয়ক তিনটি সূত্রই অনায়াসে বের হয়ে আসে, যা বর্তমান যুগের স্নাতকশ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা ঘরে বসেই কষে ফেলতে পারে ইউনিভার্সিটির ফলিত গণিতের ক্লাসে আমি নিজেও করেছি সেটাঅবশ্য নিউটন গোড়াতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন কেপ্লারের সূত্র প্রমাণ করতে তাতে ক্যালকুলাস প্রয়োগ করা হয়নি, প্রয়োগ করেছিলেন সেকালের জনপ্রিয় জ্যামিতিক পদ্ধতি সেটা আজকের ছেলেমেয়েদের জন্যে চট করে বুঝে ফেলা সহজ হবে না বলা যায় তাঁর জ্যামিতিক যুক্তিগুলো বেশ জটিলই মনে হবে এযুগের ছেলেমেয়েদের কাছে
  এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, গ্রামের বাড়ির আপেলবাগানে যখন গাছ থেকে আপেল পড়ে গেল তাঁর মস্তক বরাবর তখন কি তিনি আগেকার গবেষকদের মাধ্যাকর্ষণবিষয়ক চিন্তাভাবনার কথা জানতেন? সেসময় তাঁর বয়স ২৪, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা গণিতের সেরা ছাত্র ফ্রান্সের ইসমায়েল আর আরব বিজ্ঞানীদের কাজের কথা শুনেও থাকতে পারেন কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যে বিপরীত বর্গের আইন পালন করে সেটা কেউ হলপ করে বলতে পারেননি, কারণ তাঁদের কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীরা কেউ কেউ অনুমান করে বলেছেন বিপরীত বর্গের কথা, এমনকি কেপ্লার এমন মতামত রেখে গেছেন যে আইনটি সম্ভবত বিপরীত বর্গ নয়, শুধু বিপরীত মাত্রাই----অর্থাৎ দূরত্ব যত বাড়বে আকর্ষণের তীব্রতা ততই কমবে, তবে ভগ্নাংশটি /(দূরত্ব) অনুসারে, /(দূরত্ব)* অনুসারে নয় সমস্যা হল যে কেপ্লার সাহেবও কোন প্রমাণ দাঁড় করাতে পারেননি
    আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আপেলপতনের দৃশ্য থেকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রকৃতি সম্বন্ধে নিউটনের মনে যে প্রেরণা উদয় হয় সেটা ছিল পুরোপুরি মৌলিক, কারো কাছ থেকে ধার করা নয়, এবং তাতে তাঁর তীক্ষ্ণ ধীশক্তির পরিচয়ই শুধু প্রকাশ পায়না, তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি অবরোহী ক্ষমতার স্বাক্ষর বহন করে এই মানুষটি আপাদমস্তক একজন বিশুদ্ধ সৃষ্টিশীল প্রতিভা ছিলেন যাঁর সমকক্ষ বিজ্ঞানী হাজার বছরে একজন হয়না
   আমার নিজের অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে, ছাত্রাবস্থায়, কল্পনা করেছি এমন কোন শক্তির অস্তিত্ব প্রকৃতির মধ্যে যেখানে আকর্ষণ বা বিকর্ষণের শক্তি বর্গের নিয়মে ঘটে না, সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়মে চলে অর্বাচীন মন, যৌবনের আকাশকুসুম কল্পনা এখন বুঝি যে প্রকৃতির নিয়মগুলি এমনই যে তার থেকে একটু উনিশ বিশ হলেই আমাদের কোনও অস্তিত্বই থাকত না নিউটন তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত গাণিতিক পদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে কেপ্লারের সৌরমণ্ডল সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো সত্য হলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিপরীত বর্গ পালন করতে বাধ্য তার উল্টোদিক থেকে ভাবতে গেলে বিপরীত বর্গের একমাত্র ফলাফলই হল কেপ্লারের সূত্র নির্ভুল
   মজার ব্যাপার হল যে এই বিপরীত বর্গের প্রতি প্রকৃতির যেন একটা বিশেষ পক্ষপাতিত্ব আছে পদার্থের পারস্পরিক আকর্ষণের ক্ষেত্রেই কেবল নয়, চুম্বক, স্থিত তড়িত (Static Electricity), আলো বিকীরণ----এসবের মধ্যেও সেই একই নিয়মের প্রভাব দেখা যায় দুটি বিদ্যুতকণা যেমন একে অন্যকে টানে বিপরীত বর্গের নিয়মে, দুটি চুম্বককণাও ঠিক সেভাবেই টানে বা ঠেলে দেয় (বিপরীত মেরু বা সমমেরু অনুসারে) অনুরূপভাবে, একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে টর্চলাইট জ্বেলে যদি সে আলোর বিকীরণ লক্ষ করা হয় গোলাকার (যার কেন্দ্র হচ্ছে সেই আলোর উৎসটি) কোনও পাতের ওপর তাহলে দেখা যাবে পাতটি যতই দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই আলোর বিন্দু থেকে ততই তার জ্যোতি কমে যাচ্ছে ঠিক সেই অনুপাতেই, অর্থাৎ বর্গের নিয়মে এর একটা সহজবোধ্য কারণও আছে---কেন্দ্র থেকে পাতটির মাঝখান পর্যন্ত যে দূরত্ব সেটি হল গোলকের ব্যাসার্ধ, এবং ওই গোলকাংশটুকুর আয়তন সেই ব্যসার্ধের বর্গেরই অনুপাতে, অতএব এটা সহজেই অনুমানসাপেক্ষ যে ওই টর্চের আলো থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মির তীব্রতা হ্রাস পাবে বিপরীত বর্গেরই অনুসারে, যতই তার দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে আলোর উৎস থেকে অর্থাৎ এখানে সেই একই বিপরীত বর্গনীতির প্রযোজ্যতা প্রকাশ পেল
   নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আর বিপরীত বর্গনীতির সঙ্গে পূর্ববর্তী গবেষকদের একটা জায়গায় বড় পার্থক্য----অন্যেরা এই তত্বের প্রয়োগশীলতা যে কেবল স্থানীয় পরিবেশে অবস্থিত দুটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, উর্ধাকাশের গ্রহনক্ষত্রসহ সমগ্র বিশ্বচরাচরেই সমানভাবে প্রযোজ্য সেটা তাঁরা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি, সম্ভবত তাঁদের কাছে কোন পরীক্ষিত প্রমাণ ছিল না বলেই কিন্তু নিউটনের তা ছিল, এবং সেকারণেই তাঁর তত্বে ছিল বিশেষভাবে আকর্ষণীয় একটি উপাদান---সর্বজনীনতা, যা ওঁদের তত্বে ছিল না
   কথা হল নিউটনের তত্ব কি একেবারেই নিখুঁত নির্ভুল? বহুলাংশে তাই সাধারণ ব্যবহারের জন্যে তাঁর প্রদত্ত তথ্যসমূহ এখনও পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়, এমনকি বর্তমান যুগের মহাশূন্যযানের প্রকৌশলশাস্ত্রেও তবে সংসারের অন্যান্য বিষয়ের মত বিজ্ঞানেরও বিবর্তন বলে একটা কথা আছে---সময়ের সাথে তার আভ্যন্তরীন চিন্তাভাবনাগুলো নতুন যুগের আলোকে পুনঃপরীক্ষার বিষয় হয়ে ওঠে উঠে আসে উন্নততর যন্ত্রপাতি, তৈরি হয় আধুনিকতর গবেষণাগার উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে বিজ্ঞানীদের উপলব্ধির নাগালে এসে গেল যে নিউটনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তত্বে একটা জিনিস স্বতসিঃদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও, যে আলোর গতি অসীম সেটা আসলে সত্য নয়----আলবার্ট আইনস্টাইনের গবেষণা থেকে সেটা অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ফুটে উঠেছে তদুপরি তাঁর গবেষণা প্রকাশলাভের বেশ আগেই আমেরিকান পদার্থবিদ মাইকেলসন আর মর্লির পর্যবেক্ষণে সেই একই তথ্য পরিষ্কারভাবে বের হয়ে এসেছে তবে কথাটা হলঃ এই নবার্জিত জ্ঞান কি নিউটনের বলবিজ্ঞান আর বিপরীত বর্গনীতিসহ মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ক যাবতীয় তত্বকে একেবার নাকচ করে দেয়? মোটেও না সাধারণ ব্যবহারের জন্যে নিউটন এখনও রাজার আসনে বসে আছেন, এবং সম্ভবত থাকবেনও আজীবন পরিবর্তন যা হয়েছে সেটা কতগুলো ছোটখাট বিষয়ে, যেমন বুধগ্রহটির গতিপরিক্রমাতে একটা সূক্ষ্ম ব্যাপার ছিল যা নিউটনের তত্বের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছিল না, কিন্তু আইনস্টাইনের অভিনব তত্বপ্রদত্ত গণনাতে সেগুলো প্রায় নিখুঁতভাবে মিলে যায় তদুপরি নিউটনের তত্ব অনুযায়ী বিশ্বব্রম্মাণ্ডের কোনও সীমা নেই, আইনস্টাইন বলছেন, না, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য নয় সীমা আছে বইকি, মহাবিশ্বের সীমানা সেখানে যতদূর আলোকরশ্মি ভ্রমণ করতে পারে অপ্রতিহত অবস্থায় তাঁর যুগান্তকারি যুক্তিসমূহের মাঝে একটি হল যে আলো ভরশূন্য হলেও বড় নাক্ষত্রদ্বারা প্রভাবিত, আলো তার কাছে এসে বেঁকে যায়, কারণ সেই নক্ষত্রটি তাকে টেনে নিচ্ছে, যেমন নে ভরযুক্ত বস্তুকে স্বভাবতই এসব সূক্ষ্ম বিষয়গুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একেবারেই প্রযোজ্য নয়---আমরা নিউটনকে পেয়েই খুশি



মীজান রহমান
অটোয়া,
২২ শে আগস্ট, ‘১২
মুক্তিসন ৪১

No comments:

Post a Comment