Tuesday 21 August 2012

২১ শে আগষ্ট: “আট বছর আগের একদিন”


                                  নাজনীন সীমন

২১ শে আগষ্ট পৃথিবীর পটে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি? ’৮৬-তে ক্যামেরুনে লেক নিয়স আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে মৃতের সংখ্যা ছিলো ১৭৭৬ এবং একই বছর একই দেশে আগ্নেয়গিরি থেকে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমনে ২০০০ লোক মারা যান। ১৯৯৪-তে রয়্যাল এয়ার মেরক এটিআর-৪২ দুর্ঘটনায় ৪৪ ব্যক্তি নিহত হন। একই বছর টাইফুন ফ্রেডের ভয়াল থাবায় চীনে ৭০০-র বেশী মানুষ হারিয়ে যান একেবারে, আর ’৯৭-এ ১৪০ জন প্রাণ হারান টাইফুন উইনির আঘাতে। অসংখ্য ভালো ঘটনাও ঘটেছে এই নির্দিষ্ট তারিখটিতে। আবার আরো অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে যা ইতিহাসের পাতায় স্হান করে নিতে পারেনি, কিন্তু দ্বিধাহীন পারা উচিৎ ছিলো। এই তো মাত্র সেদিন “আট বছর আগের একদিন”, ২০০৪-এ ২৪ টি প্রাণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় নিহত হন, আহত হন অসংখ্য নেতাকর্মী। শোকের মাসে নতুন শোকের জন্মদিন করার সুযোগ করে দেয় ২১ শে আগষ্ট।

এই সন্ত্রাসী হামলায় যারা বেঁচে গেলেন, তাদের অনেকেই শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ যন্ত্রণায় দিনের পর দিন অতিবাহিত করছেন। কেনো এই হামলা, কারা করেছে এই বর্বরোচিত আচরণ মানুষ জানে। কিন্তু তাদের জাল বহু বিস্তৃত, কব্জি অনেক গভীরে প্রোথিত। তাই ছোঁয়া যায়না ওদের। অবশ্যি যে জাতি তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত মানবেতিহাসের জঘন্যতম যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ই না শুধু, সন্দিহানও হয় আসলে যুদ্ধাপরাধ জাতীয় কিছু হয়েছিলো কিনা(!!!) এবং যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, তাদের নিরপরাধ দাবী করে আন্দোলন ভাংচুর করে, সে দেশে এটি তো মামুলি আলু-পটল ঘটনা।

হত্যা ও বিষ্ফোরক মামলায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা সংগঠিত হয়েছে। জজ মিয়া নাটকের খবরও পড়েছে জাতি। কিন্তু থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় অবস্হায় মামলা কচ্ছপ গতিতে এগোচ্ছে। বলাই বাহুল্য, তৎকালীন সরকার এ ব্যাপারে ন্যূনতম ব্যবস্হাও নেননি। মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে যারা হাপিত্যেশ করে বেড়ান, কণ্ঠ শুষ্ক করে ফেলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্হা—যাদের দয়ার সাগরে তৃতীয় বিশ্বের হাবুডুবু দশা, তারা এখানে ভূলুণ্ঠিত হতে দেখেন না মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার অধিকার। তাই এ ব্যাপারে উচ্চকিত বা উৎকণ্ঠিত নন আর কেউ কেবল ঐসব ভূক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী, এবং সর্বোপরি দল মত নির্বিশেষে হাতে গোণা কিছু সত্যিকার মানুষ ছাড়া।

বাংলাদেশ নামক এই ছোট্র ব-দ্বীপ অসংখ্যবার রক্তের সাগরে ভেসেছে, রক্ত দিয়ে অর্জন করেছে নিজস্ব মানচিত্র। অথচ সেই মানচিত্রেই পুরনো শকুনেরা মুখোশের আড়ালে তাদের ছানাপোনা সহ রক্তনেশায় মত্ত। সেদিনকার এই ভয়াল ঘটনাকে বেশীরভাগ মানুষই দেখছে একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি নৃশংসতা হিসেবে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপাটি তাই-ই বটে; কিন্তু এর শাখা প্রশাখার বিস্তৃতি নিগূঢ় পর্যবেক্ষণে এর গুরুত্ব এবং সূত্র বোঝা অসাধ্য কোনো ব্যাপার নয়। যাদের জীঘাংসার প্রতিফলন এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, তাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এটি কেবল একদিনের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর শিকড় অন্যত্র, উদ্দেশ্য সার্বভৌমত্ব বিসর্জনের মাধ্যমে ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার বর্বর একদল শাসকের পায়ের কাছে স্বীয় পতাকা রাখা।

 বাঙালী কি বীরের জাতি নয়? বাঙালীর বিবেক, চিন্তাশক্তি কি বন্ধ্যাত্ব আক্রান্ত? যে পতাকা দিয়ে গিয়েছেন পূর্ব প্রজন্ম, তা রক্ষার ভার কি ১৬ কোটি জনগণের নয়? কেনো ঐসব দেশবিরোধী রাঘব বোয়ালদের দুষ্টচক্র ভাঙা যাবে না?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে যেমন শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ শোধ করা যাবে না, ভয়াল ২১শে আগষ্টের বিচার না হলে তেমনি এই পতাকাকে শকুনের হাত থেকে রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে যাবে; এতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের তীব্র যন্ত্রণার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐ ২১শের পোড়া ছাই থেকে নতুন ২১ জন্মের আগুন ছড়ানো বন্ধে নির্দিষ্ট কোনো দল নয়, বরং স্বাধীনতার স্বপক্ষের সকল শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে, বর্জন করতে হবে দেশ বিরোধী অপশক্তিকে।
বিনম্র শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতা সেদিনের আক্রান্তদের প্রতি। পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য দুর্ঘটনার দিন একুশে আগষ্টে বাঙালী জাতি যে নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছে তার জন্য দায়ীদের বিচার নিশ্চিতকরনের মাধ্যমে জাতি যেনো আশ্বস্ত হতে পারে আর কোনো শকুন তার নখ বসাতে পারবে না বাংলার মাটিতে। জীবনানন্দের “আট বছর আগের একদিন”-এর “চমৎকার!/ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার—” এর মতো ধেড়ে কিছু ইঁদুর ধরা অতি আবশ্যক এখন।



নাজনীন সীমন
::
নিউ ইয়র্ক
২০১২  অগাস্ট ২১
::

No comments:

Post a Comment