Sunday 21 April 2013

শাহবাগ মঞ্চ

মীজান রহমান

শাহবাগ চত্বর নিয়ে কিছু লিখবার ইচ্ছে আমার ছিল না। তার মানে এই নয় যে শাহবাগ বিষয়ে কোন অনুভূতিই জন্মায়নি আমার মনে, বরং জন্মেছিল বলেই লিখতে চাইনি। জীবন থেকে শেখা একটি জিনিস আমি মানিঃ সব অনুভূতিকে সবসময় বিশ্বাস করতে নেই। বিশেষ করে আবেগজাত অনুভূতিগুলো। বাঙালি আবেগ সম্পর্কে আমার বড় ছেলে মজার কথা বলে। তার মতে আমাদের আবেগে সংযমের বালাই নেই---এটা নাকি ইমোশন নয়, ইমোশনাল ইনকন্টিনেন্স! শুনতে খুব প্রীতিকর নয়, কিন্তু ভাববার মত।
গোড়া থেকেই একটু অস্বস্তি ছিল মনে। এ তো এক নতুন ঝড়ের সঙ্কেত মনে হচ্ছে। এ-ঝড় কোথায় নিয়ে যাবে দেশকে? নাকি কোথাও নেবে না----ফাঁপা বেলুনের মত চুপসে যাবে একসময়? অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছিল, এর সঙ্গে তাহরির স্কোয়ারের সঙ্গে মিলতিউনিশিয়া আর লিবিয়ার তথাকথিত আরবি বসন্তের তুলনার কথাও কানে আসছিলতাদের যুক্তিঃ আরবি বসন্তের মত শাহবাগও তরুণ প্রজন্মের নিজস্ব উদ্ভাবন----ইন্টারনেট আর ফেসবুক-টুইটার তাদের প্রধান সহায়সেটা অনস্বীকার্যঃ আধুনিক প্রযুক্তি ছিল বলেই শাহবাগে তারা জড় হতে পেরেছিল----সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের মাঝে তৈরি করে দিয়েছে এক দারুণ শক্তিশালী সেতুবন্ধন। কিন্তু তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে প্রযুক্তি যদি সেই মাধ্যমগুলো তুলে না দিত তাদের হাতে তাহলে তারা ওরকমভাবে জেগে উঠতে পারত না? বা জেগে ওঠার ভাবনাটিই প্রবেশ করত না তাদের মনে?
আমার প্রজন্মের লোকেদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা তরুণ প্রজন্মের সবকিছুতেই খুঁত খুঁজে পাওয়া। আমরা ওদের সব উদ্যোগ-আয়োজনকেই সন্দেহের চোখে দেখি। সমস্যাটি ওদের নয়, আমাদেরইআমরা পরিবর্তনকে ভয় পাই-----অতীত আর পুরাতনের মধ্যেই আমরা আরাম বোধ করি। ব্যক্তিগতভাবে, আমি নিজেকে খানিক ব্যতিক্রম ভাবতে ভালবাসি, যদিও আসলে হয়ত তা নইতবে একটা জিনিস আমি মানিঃ পরিবর্তনই সংসারের একমাত্র অপরিবর্তনীয় জিনিস ( জানি, কথাটা আরো অনেকে বলে গেছেন আগে)। এবং সে-পরিবর্তনের অগ্রনায়কের ভূমিকাটি সবসময় নবীনরাই পালন করেছে, প্রবীণরা করেনি, বরং তারা বাধা দিয়েছে বারবার। আমাদের নিজেদের দেশটিও তার থেকে আলাদা নয়। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ---সব ওদেরই কাজ। ওরাই পুরাতনের ইমারত ভেঙ্গে তার ধ্বংসস্তূপের ওপর নির্মাণ করেছে নতুন যুগের স্বপ্নপ্রাসাদ
কিন্তু সেই নতুনও একদিন পুরাতন হয়ে যায়। জরাগ্রস্ত হয় তার শরীর। ‘৭১এ যা ছিল অভিনব আজকে তার গায়ে ঘুণ ধরেছে। সেই তেজটা নেই। ’৭১ এর ত্যাগ আজ নির্লজ্জ ভোগের সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। দেশকে এই পঙ্কের আবর্ত থেকে নির্গত হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হলে আমূল একটা পরিবর্তন আশু প্রয়োজন। নইলে জাতির দম বন্ধ হয়ে যাবে
কথা হলঃ শাহবাগই কি সেই পরিবর্তনের অগ্রদূত?
হয়ত। হয়ত নয়। আর কিছু না হোক, একটি কাজ সিদ্ধ হয়েছে বটে----জাতি তার নিজের চেহারার দিকে তাকাতে পারছে শাহবাগ মঞ্চের দর্পণে। প্রশ্ন তুলতে পারছেঃ আমরা কারা? এই যে বিশাল পৃথিবীটা আমাদের চারপাশে, সেখানে আমাদের স্থান কোথায়?
আমার অতি-সাবধানী দৃষ্টিতে শাহবাগের বেশ কটি দিক আছে যা একটু অচিন্তিত, একটু অপরিপক্ক মনে হয়েছে। আবার কতগুলো দিক আছে যা আমাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করেছেঃ কে জানে, হয়ত এখনো সব অন্ধকার হয়ে যায়নি।
এই দুটো দিকই আমি নিজের মত করে দাঁড় করবার অনুমতি চাইছি আমার পাঠকের কাছে।
প্রথমেই নেতিবাচক দিকটা সেরা ফেলা যাক।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে শাহবাগ চত্বরের মাঝে একটা অনাবিল স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। বসন্তের বরফগলা ঝর্ণার মত তার প্রবল ধারা দুর্বার উচ্ছ্বাস আর আবেগে চারদিক প্লাবিত করে ছুটে চলবে বৃহত্তর কোনও লক্ষ্যের সন্ধানে। তারুণ্যের এই উচ্ছ্বাস আরে আবেগ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও কোন বড় পরিবর্তন আসতে পারেনি। সাথে সাথে এমনও নজির আছে যে সেই স্রোতের তীব্রতার কারণেই হয়ত শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত লক্ষস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, বরং সেই লক্ষটাই পথিমধ্যে ভ্রষ্ট হয়ে গেছে বিপরীত বাত্যায়। নজির খোঁজার জন্যে বেশিদূর যেতে হবে না, হালের ঘটনাবলীই যথেষ্ঠ। তাহরির স্কোয়ারের উদাহরণ বারবার তুলে ধরা হয় আমাদের আড্ডায় আসরে। দুবছর আগে বিরাট আন্দোলন হয়ে গেল সেখানে মিশরের স্বৈরাচারী শাসনকর্তা হুসনে মোবারকের পতন ও বিচারের দাবিতে। পরবর্তী দাবি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাএতই অনড় ছিল তাদের দাবি, এতই অনমনীয় তাদের সঙ্কল্প যে কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়াতে বাধ্য হলেন। হুসনে মোবারকের দীর্ঘ শাসনের অবসান হল অবশেষে। এমনকি আধুনিক গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত---জনগণের ভোটে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা, তা’ও মেনে নিলেন তারা। ঠিক যা চেয়েছিল সেই তরুণরা। কিন্তু তারপর? পরম বিড়ম্বনা এই যে তাদের কাংখিত ‘গণতন্ত্র’এর পথ ধরে ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে গেলেন কারা? মুসলিম ব্রাদারহুড! এই সংগঠনটির জন্ম ও উত্থান বিষয়ে যারা একটু খবরাখবর রেখেছেন তারা জানবেন যে মুসলিম ব্রাদারহুডের মূল লক্ষ্যটাই ছিল পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক পন্থা বর্জন করে শরিয়ার শাসন প্রতিষ্ঠা করা। (শরিয়া সম্বন্ধে একেকজনের একেকরকম মতামত থাকতে পারে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মতানুযায়ী ইসলামী শরিয়া আর ব্যক্তিস্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধি-মুক্তচিন্তা ভিত্তিক আধুনিক, ইহজাগতিক গণতন্ত্রের মাঝে অনেকটা সাপে-নেউলের সম্পর্ক। একটি আরেকটির সঙ্গে মেলেনি কোনদিন কোনখানে, কোনদিন মিলবে কিনা সন্দেহ)। তিউনিশিয়ার বুরগিবা এভেন্যুতে অনুরূপ একটা ‘বিপ্লব’ ঘটেছিল তাহরিয়ার স্কোয়ারেরও আগে। ওটার পরিণতিও প্রায় একইরকম। অনেকদিন পর যা’ও একজন আধুনিক চিন্তাধারার প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা এসে গিয়েছিল তা’ও টিকে থাকতে পারল না----অনতিবিলম্বে তাঁকে প্রাণ হারাতে হল আততায়ীর হাতে।
তাই, ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখে শাহবাগের সেই টগবগে তরুণ ছেলেমেয়েরা যখনএকসাথে জড়ো হয়ে জোরগলায় ঘোষণা করতে থাকলঃ না, আমরা এ-বিচার মানছি না, কাদের মোল্লার পুনর্বিচার চাই, তখন আমার বুক কেঁপে উঠল। এরা কি তাহরির স্কোয়ারের মতই এক দানবের মস্তক কেটে আরেক দানবের পথ উন্মুক্ত করে দেবার সুযোগ করে দিচ্ছে? বড় কথা, তাদের এই নবজাগরণের জন্যে কি জনগণ তৈরি?  
আমাদের জাতির শরীরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটা গভীর, পুরনো ও কুৎসিৎ ক্ষত। বিয়াল্লিশ বছর পর সে ঘা এখনো শুকায়নি। শাহবাগের তরুণদের অনেকে সে-ক্ষত নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছে। তাই তাদের রক্তের ভেতর সেই স্মৃতি এতকাল পর আজ জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের রূপ ধারণ করেছেইতোমধ্যে দেশ বদলেছে, সময় বদলেছে, মানুষ বদলেছে। বদলায়নি কেবল ’৭১ এর ঘাতরদের বিচার হয়নি, সেই রূঢ় বাস্তবতাটি। পৃথিবীর আর কোনও দেশে এর নজির নেই----অন্তত সমসাময়িক কালের মধ্যে তো নয়ই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নুরেনবার্গের বিচার হয়ে গেল তার অব্যবহিত পরই। ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার পর ইহুদীরা কালবিলম্ব না করে দেশবিদেশে লুকিয়ে থাকা নরপিশাচদের ছলে বলে কৌশলে পাকড়াও করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল স্বদেশের উচ্চ বিচারালয়ে। রোয়াণ্ডার বর্বরতার সাজা আজো অব্যাহত। বজনিয়ার সেই পাশবিক হত্যাকারীরা এখন আন্তর্জাতিক বিচারকদের সম্মুখে নতমস্তক। বিচার হয়নি কেবল একাত্তরের ঘৃণ্য ঘাতকদের, যারা ‘ইসলাম বাঁচানোর’ দোহাই দিয়ে স্বদেশের স্বাধীনতাকামী নাগরিকদের হত্যা করেছিল নির্মমভাবে। তাই আজকের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, আজকের সজাগ সচেতন ছেলেমেয়েরা যে ধৈর্যের শেষ সীমানাতে পৌঁছে রাস্তায় নেমে সেই পুরনো অন্যায়ের প্রতিকার কামনা করছে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এরা তো রাজনীতির মারপ্যাচ বোঝে না, বোঝে না জাতির অবিশ্বাস্য স্মৃতিভ্রমের কথা, তারা শুধু বোঝে পুরনো জঞ্জাল দূর না হলে নতুন যাত্রার সূচনা করা যাবে না।
দুঃখের বিষয় হল বাস্তবতার সঙ্গে স্বপ্ন আর আদর্শের সংঘাত চিরকালীনশাহবাগের তরুণদের সমস্যা একটি নয়, অনেকগুলো। প্রথমত তারা জাতির নাড়ির খবর রাখেনি। আমাদের চারিত্রিক অবক্ষয় যে কোন পাতালে চলে গেছে গত ত্রিশ-চল্লিশ বছরে, তার সম্যক ধারণা নিয়ে তারা এই সংগ্রামে পা বাড়ায়নি। দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল, আমার মতে, তাদের নিজেদেরই বিচারবুদ্ধিতে।
তাদের মূল অভিযোগটা ছিল এইঃ হাইকোর্টের বিচারে কাদের মোল্লা নামক এক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়নি----ফাঁসির পরিবর্তে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’, যা বাংলাদেশের দূষিত রাজনৈতিক পরিবেশে বেকসুর খালাশেরই শামিল। ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রাথমিক সমস্যাটা সেখানেই। দীর্ঘকাল পশ্চিমের উন্নত চিন্তাধারার আবহাওয়াতে বসবাস করার ফলেই হয়ত আমার কাছে মনে হয়েছেঃ হাইকোর্টের বিচার তাদের মনঃপূত না’ও হতে পারে, কিন্তু তার প্রতিবাদে রাস্তার মোড়ে ভিড় জমিয়ে জোরগলায় সে-বিচার খণ্ডন করে পুনর্বিচার দাবি জানানোতে একটু অদূরদর্শিতার পরিচয় আছেএকটা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা কি? প্রথমত তারা সাংবিধানিকভাবেই সবকিছুর উর্ধে (একমাত্র আইন বাদ দিয়ে)----রাজনীতির কদর্য হাত তাদের স্পর্শ করতে পারবে না (অন্তত নীতিগতভাবে)। তাদের আনুগত্য রাজনৈতিক নেতানেত্রীর কাছে নয়, সেনাবাহিনীর কাছে নয়, এমনকি জনগণের কাছেও নয়, বিশেষ করে জনসমাগমের কাছে তো একেবারেই নয়, তাদের একমাত্র আনুগত্য সংবিধানের প্রতি। তাদের কর্তব্য, পবিত্র কর্তব্য বলতেও দ্বিধা করব না আমি, সংবিধানের প্রতিটি বিধিবিধান যক্ষের ধনের মত অক্ষরে অক্ষরে পালন করা। তার সম্মান, মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষা করা। জাতি যতই বিভক্ত হোক, যতই বিষাক্ত হয়ে উঠুক তার রাজনৈতিক আবহাওয়া, সর্বোচ্চ আদালত তার অটল গাম্ভীর্য নিয়ে স্থির হিমাচলের মত অনড় প্রহরাতে দণ্ডায়মান থাকবে----কারণ সংবিধানই হল জাতির মেরুদণ্ড। অনেকটা লণ্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের সেই মূর্তিপ্রতিম দৌবারিকদের মত----ঝড়বাত্যা প্লাবন বিপর্যয় যা’ই ঘটুক পৃথিবীতে, তারা তাদের স্থির অবস্থান থেকে একবিন্দু নড়বে না। আমাদের হতভাগ্য দেশটিতে গত চল্লিশ বছরের ভেতর একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানই শক্ত খুঁটির ওপর নির্মিত হয়ে উঠতে পারেনি----একমাত্র সর্বোচ্চ আদালতটিই ছিল সব আশার শেষ আশা, যার ওপর হেলান দিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারত। ওটা যদি কোন কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে আমাদের আর কোন আশ্রয় থাকে না, আমরা একেবারেই গৃহহীন শরণার্থীর পর্যায়ে পৌঁছে যাই। আমরা যারা ক্যানাডা-আমেরিকায় থাকি তাদের জানতে হয়েছে, নিজেদেরই সাংবিধানিক অধিকারসমূহকে শক্তহস্তে রক্ষা করার স্বার্থে, যে আমাদের বড় বন্ধু সরকার নয়, আদালত। ওই আস্থাটুকু আমরা সবাই অনুভব করি বলেই বিপদ আপদে, রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটাতে, আমরা, দূর প্রাচ্য থেকে আগত অভিবাসীরা এতটা নিরাপদ বোধ করি। বাংলাদেশের নাগরিকরাও তেমনি সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে একটা নিরাপত্তার আবহাওয়া উপভোগ করতে চায়----সে অধিকারটি তাদের আছে। তাই, হাইকোর্টের দরজাতে পাহারা দেবার দায়িত্ব দেশের ছোটবড়, ইতরভদ্র, সকলেরই পবিত্র কর্তব্য----অশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত আমজনতা সে-দায়িত্ব সম্বন্ধে পুরোপুরি সচেতন না হলেও শিক্ষিত সমাজের কোনও অজুহাতই থাকবার কথা নয় তাকে গুরুত্ব না দেবার। তার বদলে যদি আমাদের শিক্ষিত, জ্ঞানবিজ্ঞানে অগ্রসর আধুনিক ছেলেমেয়েরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ  করে, তখন রাষ্ট্র এবং জাতির ভবিষ্যৎ উভয়ই সংকটসংকুল হয়ে পড়ে। অন্তত আমার মতে। তার ওপর উন্নত বিশ্বের পর্যবেক্ষকদের একটা দৃষ্টিকোণ তো আছেই----তাদের চোখে মনে হতে পারে যে এরা তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কামনা করেনি, কামনা করেছিল কেবল মৃত্যুদণ্ড (যা যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত পশ্চিম বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে)। বর্তমান যুগে বহির্বিশ্বে এটা কি খুব ভালো ভাবমূর্তি তৈরি করতে সাহায্য করবে?
শাহবাগ মঞ্চের দ্বিতীয় যে-দিকটা আমাকে একটু চিন্তাকুল করেছে সেটা হল ওদের সাংগাঠনিক পরিকল্পনার আপাত অভাব। জানি, সংগঠনের কথা উঠলেই একটা-না-একটা রাজনৈতিক সংযুক্তির প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যেতে পারে, যা সঙ্গত কারণেই ছেলেমেয়েগুলো আপ্রাণ এড়াতে চেষ্টা করেছিল----বাংলাদেশের কোনও রাজনীতিই বেশিদিন বিশুদ্ধ থাকতে পারেনি, এবং সম্ভবত পারবেও না। কিন্তু একটা বড় উদ্যোগের পেছনে যখন একেবারেই কোন সাংগঠনিক সমর্থন থাকে না তখন তাতে অপর্যাপ্ত চিন্তাভাবনার লক্ষণগুলো খুব শীঘ্রই পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। শাহবাগের এই উদ্যোগটি যে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত ও সময়োপযোগী একটি প্রয়াস তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই, এবং হয়ত সেকারণেই এর অপরিপক্কতা ও অপরিণামদর্শিতার চিত্রটি এত মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক মনে হয়। এ যেন কতগুলো অবোধ শিশু ঘরের রুদ্ধ আবহাওয়াতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল বলে নিতান্ত প্রাণরক্ষার দায়েতেই বাইরের খোলা মাঠে বেরিয়ে গেছে শ্বাস ফেলার জন্যে----তাদের ধারণাতেই ছিল না যে সেখানে ঘরের রুদ্ধ বায়ু আর বাইরের আপাত উন্মুক্ত মাঠ, উভয় স্থানই এখন সমান বিপদসঙ্কুল।
শাহবাগের তরুণ ছেলেমেয়েগুলোর কাছে আধুনিক যুগের কোন খবরই অজানা নয় সেবিষয়ে আমি প্রায় নিঃসন্দেহ। কিন্তু তেমন নিঃসন্দেহ হতে পারছিনা তারা অতীত ইতিহাস পড়েছে কতটা বা কতখানি শিক্ষা গ্রহণ করেছে তা থেকে। এটা সত্য যে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা প্রায় কখনোই ইতিহাসের শিক্ষা থেকে কিছু শেখেন না, কিন্তু তরুণ বিপ্লবীদের তো সে দায়টা নেই। এটা তাদের বোঝা দরকার যে প্রতিটি বড় বিপ্লবের পেছনেই একটা বড় আইডিয়া থাকতে হয়। যেমন আমেরিকান বিপ্লবের পেছনে আইডিয়াটা ছিলঃ ব্যক্তিস্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা, আত্মনিয়ন্ত্রনের স্বাধীনতা। ফরাসী বিপ্লবের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত প্রকাশ করেছেন যে এই বিপ্লব শুধু ফ্রান্সকেই নয় গোটা ইউরোপকেই আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছেফরাসী বিপ্লবের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছিল পূর্ববর্তী অনেকগুলো ঘটনা, যার মধ্যে অন্যতম ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ। তবে সবচেয়ে বেশি সার সঞ্চার করেছে ওই দেশেরই বুদ্ধিজীবিরা----ভল্টেয়ার, রুশো, মন্টেস্কু, এদের মত জাঁদরেল চিন্তাবিদরা। তাঁরা ছিলেন আগাগোড়া ইহজাগতিকতাবাদী----রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সংযোগ কখনোই হিতকর নয় জনগণের জন্যে এই মন্ত্রে গভীরভাবে বিশ্বাসী। কেবল তা’ই নয়----তাঁরা ছিলেন ইউরোপের বুদ্ধি ও চিন্তার জগতে আলোকায়ন সৃষ্টির নেতৃত্বের ভূমিকায়। যাকে আমরা বলি এনলাইটেনমেন্ট। আসলে ইউরোপের ইহজাগতিকাবাদ (যাকে অশুদ্ধভাবে আমরা সাধারণ ভাষায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলে থাকি) ফরাসীর বিপ্লব থেকেই উৎপন্ন। এই দর্শনের মূল ভিত্তি কিন্তু ‘সকল ধর্মের প্রতিই সমান সম্মান প্রদর্শন’ নয়, ভিত্তি হল ধর্ম আর রাষ্ট্র, একে অন্য থেকে পরিপূর্ণভাবে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন----অর্থাৎ কেবল নিরপেক্ষই নয়, নির্লিপ্ত ও নির্বিকার। এরই সঠিক ইংরেজি হল Secularismসেহিসেবে আমাদের দেশটি সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু কোনক্রমেই একে সেকুলার বলা যাবে না----সেকুলার রাষ্ট্রে কখনো ‘ধর্ম মন্ত্রনালয়’ নামক কোনও উদ্ভট বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। সেকুলার রাষ্ট্রে ‘বিসমিল্লা’ বলে কোনও সংসদের অধিবেশন শুরু হতে পারে না। সেকুলার রাষ্ট্র কোনক্রমেই নিজেকে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ বলে ঘোষণা করতে পারে না। ফরাসী বিপ্লবের মত একটা প্রকাণ্ডরকম মৌলিক ঘটনার কথা বাদ দিলেও আমাদের সামনে রয়েছে রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলনের ইতিহাস-----কার্ল মার্ক্সের বিশাল পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থের প্রভাব ছাড়া কি এতটা উদ্দীপনা ও চিত্তশক্তি অর্জন করতে পারতেন সেই বিপুল গণজাগরণের নেতৃবর্গ? রাশিয়ার বিপ্লব ছিল রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমজীবি মানুষের বিদ্রোহ। তারপর দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যায় চীনের কৃষক-মজুরদের বিপ্লব যার নেতৃত্ব দান করেছিলেন চেয়ারম্যান মাও সেতুং।
এখন প্রশ্ন জাগেঃ আমাদের শাহবাগ আন্দোলনের পেছনে এমন কোন বড় চিন্তা কাজ করেছিল কিনা। আমি যতদূর জানি, তার উত্তর হলঃ না, একমাত্র গতানুগতিক অচলয়াতনতার বিরুদ্ধে একরকম তরুণসুলভ বিক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া অন্য কোনও বড়মাপের পরিবর্তন সৃষ্টির লক্ষ্য হয়ত তাদের ছিল না। মধ্যযুগীয় ইউরোপের মত তাদের চিন্তায় সমাজের মৌলিক চিন্তাভাবনার জগতে একটা বড়রকমের ঝাঁকুনি তোলার কল্পনা আদৌ ছিল কিনা সন্দেহ। এবং সেখানেই একটা বড় দুর্বলতা শাহবাগ মঞ্চতে, আমার মতে। বড়রকমের ঝাঁকুনি ছাড়া আমাদের দেশে বড়রকমের কোনও পরবর্তনই আসা সম্ভব নয়----‘হাজার বছরের’ স্থবিরতা আরো হাজার বছরই বহাল থাকবে।
আরেকটা বড় দুর্বলতা ওদের, আমার দৃষ্টিতে, যাদের বিরুদ্ধে এই ‘যুদ্ধাপরাধী বিচারের’ উদ্যোগ দেশব্যাপী, তাদের প্রকৃত শক্তির সম্যক পরিমাপ করতে না পারা। আমরা ভুলে যাই যে ’৭১ এ তারা হার মেনেছিল বটে, কিন্তু সাময়িকভাবে----অর্থাৎ খণ্ডযুদ্ধে হেরে গেলেও বৃহত্তর যুদ্ধে হয়ত হারানো যায়নি তাদের। হারানো যেত যদি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের মত তাদের সাথে সাথে বিচারের ব্যবস্থা করে ফেলা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। বরং তাদের পুনর্বাসনের সকল ব্যবস্থা সরকার নিজেই পরম যত্ন সহকারে করে দিয়েছিলেন। তারপর, আমাদের অগোচরে, অলক্ষ্যে, তারা পুর্নবাসিতই হয়নি কেবল,পুনর্গঠিতও হয়ে উঠেছে যাতে পূর্ণদ্যোমে পাল্টা আক্রমণ চালানো যায়। ইতোমধ্যে দেশের প্রতিটি দুর্বল ও চূড়ান্তভাবে দুর্নীতিপরায়ন সরকারের অবহেলা, এমনকি পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ নিয়ে ওরা অর্জন করেছে শক্তি, আর আমাদের তথাকথিত মিত্রপক্ষ ক্রমেই হয়েছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। এই আপেক্ষিক শক্তি ও দুর্বলতার পুরো ছবিটা বোধ হয় শাহবাগের তরুণ সম্প্রদায় পুরোপুরি উপলন্ধি করতে পারেনি। অর্থাৎ হিসেবে ভুল হয়ে গিয়েছিল। সে কারণেই আজকে তারা অসহায়ভাবে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টাতে হিমশিম খাচ্ছে।
একটা কথা এদেশে বলা হয় ঘন ঘন----তোমার শত্রু যখন ঘায়েল হয়ে গেছে বলে মনে হয় তখন তাকে কখনোই কোণঠাসা করার চেষ্টা করো না। মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখনই সে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর ওপর, প্রধানত নিজেরই জান বাঁচাবার তাগিদে। ‘৭১এ সেকাজটি করেছিলাম আমরা। এবার শাহবাগের তাড়া খেয়ে সেই একই কাজটি শুরু করেছে আমাদের সেই পুরনো শত্রু, যাকে দুধকলা দিয়ে পোষণ করা হয়েছিল আমাদেরই কতিপয় অর্বাচীন নেতৃবর্গ দ্বারা। মজার ব্যাপার হল, ‘৭১এ  ‘ইসলাম গেল’ ‘ইসলাম গেল’ জিকির তুলে যারা বাঙ্গালি মুসলমানদের ক্ষিপ্ত করে তোলার চেষ্টা করে সফল হয়নি, আজ তারা ঠিক একই জিকির তুলে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মুসলমানদের জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে বিপুলভাবে সাফল্য অর্জন করছে---এর চেয়ে বড় এবং নিষ্ঠুর বিড়ম্বনা আর কি হতে পারে।
কথায় আছে প্রতিটি বিপ্লবেরই একটা প্রতিবিপ্লব থাকে----খানিকটা ম্যাটার-এন্টিম্যাটারের মত। শাহবাগ মঞ্চ হয়ত অজান্তে মোল্লাদের সেই প্রতিবিপ্লবের পথটিই উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ‘৭১এ যা সম্ভব হয়নি আজকে তা’ই সম্ভব হয়ে গেছে ওদের জন্যে। সশস্ত্র বিপ্লব সম্বন্ধে ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা, জ্যাঁক ড্যাঁটো (১৯৫৯-১৭৯৪), মৃত্যুর কিছু আগে একটা সুন্দর কথা বলেছিলেনঃ “ Revolutions devour their own children”. (বিপ্লব তার আপন সন্তানদেরই গিলে খায়)। কথাটি তাঁর নিজের বেলাতেই অত্যন্ত করুণভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। ১৭৮৯ সালে বিপ্লবীপক্ষের চূড়ান্ত জয়লাভের পর তিনি মন্ত্রীত্ব পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন, এবং ১৯৯৩ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন সম্রাট ষোড়শ লুই’র মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ভোটও দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নিষ্ঠুর বিড়ম্বনা যে তার ঠিক পরের বছর তিনি নিজেই সেই একই গিলোটিনের নিচে মাথা পেতে দিতে বাধ্য হলেন। তাঁর অপরাধ? একটু নরমপন্থী, অন্যান্যদের তুলনায়। ফরাসী বিপ্লবের নেতাদের কাছে ‘নরমপন্থা’ ছিল মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ!
না, শাহবাগের ছেলেমেয়েদের আন্দোলনকে কোনক্রমেই বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করা যাবে না, সশস্ত্রের তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের দাবির প্রত্যুত্তরে মোল্লাদের মাঝে যে প্রতিবিপ্লবের ঝড় সৃষ্টি হয়ে গেল তার হিংস্রতা মনে হচ্ছে অনেক সন্তানকেই জীবন্ত গিলে খাবার উপক্রম। একমাস যেতে না যেতেই তারা রাজিব হায়দার নামক এক প্রখর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন, মুক্তিকামী-জীবনবাদী-ইহজাগতিক চিন্তাধারার যুবককে পাকড়াও করে কসাইখানার গরুর মত জবাই করেছে। তার অপরাধ শাহবাগ মঞ্চে যোগ দেওয়া নয়, ধর্মের অবমাননা, সর্বোপরি আল্লারসূলের প্রতি অসম্মানসূচক মন্তব্য প্রকাশ করা তার নিজস্ব ব্লগে, ইত্যাদি। অর্থাৎ সেই মধ্যযুগের বর্বর ইঙ্কুইজেশনের বিভীষিকাতে  প্রত্যাবর্তন। ইউরোপের খৃস্টান, মুক্তিপিপাসী বুদ্ধিজীবিরা যার শেকল ভেঙ্গে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন, আনয়ন করেছিলেন যুক্তিযুগের আলোকিত প্রভাত, বাংলাদেশের রক্তস্নাত ‘স্বাধীন’ জাতি এখন সেই অবরোধেরই পুনঃপ্রবর্তন দ্বারা মধ্যযুগকে আহ্বান জানাবার আয়োজন করেছে। ধর্মের শ্লোগান দ্বারা ’৭১ এ  যে অমানুষিক ইতিহাস রচিত হয়েছিল আমাদের রক্তাক্ত বক্ষের ওপর সেই একই শ্লোগানকে আমরা কেমন করে বরণমাল্য পরাবার আয়োজন করছি ২০১৩ তে সে রহস্য কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকবে না। সাধে কি বলি আমি যে এজাতি কিছুই মনে রাখতে পারেনা। আজকে মনে হচ্ছে তাদেরই জয়জয়াকার। আমাদের সেই অশীতিপর জেনারেল এরশাদ, যাঁর দীর্ঘ শাসনকালের একমাত্র স্বরণীয় ঘটনা হল দেশটাকে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ বলে ঘোষণা করা, যাঁকে গলায় জুতো পরানোর মত অপমান করে বহিষ্কার করা হয়েছিল ১৯৯১ সালে, সেই একই মানুষ আজকে  বীরদর্পে প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে কয়েক সহস্র আরবি, অর্থাৎ ইসলামী পোশাক পরিহিত হুজুরদের উপস্থিতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারলেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই আমি ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করেছিলাম। দেশবাসী সেটা সমর্থন করে কি করে না গণভোটে পরীক্ষা করে দেখুন না! হ্যাঁ, আসলেই তাই। গণভোটে কিন্তু তাঁর কথাই সত্য প্রমাণিত হবে। ইসলাম শব্দটা উচ্চারণ করামাত্র আমার দেশের আপামর জনসাধারণ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত লম্ফ দিয়ে উঠবে। সব্বনাশ! ইসলামকে বাদ দেবার সাহস কার? ধর তাকে, মারো তাকে, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাও। না ভাই, এদেশে এখন আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব নয়। বরং সময় এখন ওদেরই দখলে চলে গেছে। বিচার হতে হলে বরং ওদেরই কাঠগড়াতে দাঁড়াতে হবে আমাদের। তাই বলি সময় সুযোগ জীবনে একবারই আসে। সে সুযোগ একবার হাতছাড়া হতে দিলে দ্বিতীয়বার তাকে ধরার চেষ্টা করা বৃথা----তখন দড়িটা উল্টো নিজের কন্ঠতেই ধারণ করতে হবে
শাহবাগ মঞ্চের এই আন্দোলন কোথায় গড়াবে শেষ পর্যন্ত তা সঠিকভাবে নির্ণয় করে ফেলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয় এমুহূর্তে। এমুহূর্তে বেচারিরা নিতান্ত জৈবিক তাড়নাতেই পশ্চাৎপরায়ন, আত্মরক্ষার খাতিরে ধর্মের দোহাই দিয়েই তাদের ঘোষণা করতে হচ্ছেঃ না না, আমরা মোটেও নাস্তিক নয়, আমরা পরম ধার্মিক আল্লাবিশ্বাসী নাগরিক, আমরা পাঁচ ওক্ত নামাজ আদায় করি। এর চেয়ে করুণ দৃশ্য আর কি হতে পারে জানিনা। এমুহূর্তে কারো সন্দেহের অবকাশ নেই যে মোল্লাদের ফাঁসি দূরে থাক, আদৌ তাদের বিচার হবে কিনা কোনদিন তা’ও খুব পরিষ্কার নয়। সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা কি জানেন? স্বাধীনতার পর প্রগতিপন্থী দলগুলো যখন আরামকেদারাতে বসে পরম আত্মতৃপ্তিতে মশগুল, তখন আমাদের বিরোধীপক্ষ, মধ্যপ্রাচ্যের তৈলাক্ত শেখসাহেবদের বদান্যতা ও পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে গিয়ে গরিব কৃষকদের ঘরে ঘরে খাদ্যবস্ত্র ওষুধপথ্য বিতরণ করেছে, তাদের ছেলেমেয়েদের বিনা খরচে স্কুলকলেজ আর মক্তব-মাদ্রাসায় পাঠিয়েছে। এবং এভাবেই কালে কালে মাঠপর্যায়ে তৈরি করে নিয়েছে একটা বিশাল অনুগত গোষ্ঠী। তারই ফলশ্রুতিতে আজকে তারা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে একটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক বাস্তবতাঃ এদেশে এখন সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ বলতে কি বোঝায়? খুন? ধর্ষণ? গণহত্যা?  গণধর্ষণ? না, তার কোনটাই না। সবচেয়ে গুরুতর, এবং অমার্জনীয় অপরাধ হল নাস্তিকতা, ইসলামের অবমাননা, মোমিন মুসলমানদের কোমল ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা! এই কঠিন কাজটি অতি নিপুনভাবে তারা সাধন করে নিয়েছেন। তার বিপরীতে আমরা বারান্দার মনোরম বায়ুতে বসে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছি যে আমাদের দেশে ধর্মান্ধতা বলে কোনও জিনিস নেই।
অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে এখন আর কোনও আশাই নেই। সাময়িক একটা বিপর্যয় ঘটেছে বটে, তাই বলে কি আমরা ধরে নেব যে শাহবাগ মঞ্চ একটা পুরোপুরি ব্যর্থ প্রচেষ্টা? না, আমি তা বলব না। আর কিছু না হলেও একটা জিনিস তারা অতি সুন্দরভাবে ফাঁস করে দিয়েছে। সেটা হল জাতির ছদ্মবেশ। সেই বেশটি আর ছদ্ম থাকতে পারছে না। মুখোশটি পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে গেছে----সম্রাটের অঙ্গে এখন কোনও পোশাক নেই। সে নগ্ন, উলঙ্গ। সে কুৎসিৎ, সে বিকলাংগ। সে রুগ্ন, জরাজীর্ণ। এখন যেন কেউ আমাকে শোনাতে না চায় যে আমার এই সোনার দেশের সোনার মানুষগুলো নিষ্পাপ নিস্কলুষ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। যে দেশে ‘ইসলামের শত্রু’ ‘ইসলামের শত্রু’ বলে রব তোলামাত্র শত শত নেকবান্দা লুঙ্গির কাছা তুলে কাস্তে কুড়াল নিয়ে ‘ইসলাম রক্ষার’ পবিত্র জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সেই গুজবটির সত্যমিথ্যা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামিয়ে, সে দেশটি আর যা’ই বলুন দয়া করে সহনশীল আর পরম শান্তিকামী বলবেন না। আর যা’ই বলুন দয়া করে সে দেশটিকে গণতান্ত্রিক দেশ বলে আখ্যায়িত করবেন না---এদেশে যেটা আছে তার নাম ডেমোক্রেসি নয়, মবক্রেসি। এদেশে কেউ সংবিধানের ধার ধারে না, দাও কুড়াল থাকতে সংবিধান আর ‘গণতন্ত্রের’ থোরাই পরোয়া করে তারা।
শাহবাগের হতভাগা ছেলেমেয়েগুলো যতই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ুক না কেন তাদের জানা দরকার যে তারা একটা বিরাট উপকার করে দিয়েছে দেশবাসীদের। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘পরমতসহিষ্ণুতা’ , ‘বাকস্বাধীনতা’, ‘বুদ্ধি ও চিন্তার স্বাধীনতা’ -----এসব যে মুখের বুলি ছাড়া কিছু নয় সে সত্যটা একেবারে নগ্নভাবে উঠে এসেছে ওদের কল্যানে। আরো উঠে এসেছে এই অপ্রিয় বাস্তবটি যে আইনের শাসন কেবল আমাদের আইনরক্ষকরাই লঙ্ঘন করেন না, তথাকথিত আমজনতাও এর খুব একটা তোয়াক্কা করেন না----প্রায়সঃই তারা আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিতেই পছন্দ করেন। কারো বাড়িতে চুরি হলে কোনও ব্যক্তিগত শত্রুকে ঘায়েল করার সুবর্ণ সুযোগ দাঁড়িয়ে যায়----রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একবার চিৎকার করুন, চোর যায় চোর যায়, ব্যস আপনার কর্ম ফতে। না ভাই, আমাদের সমাজ এখনো মধ্যযুগীয় আদিমতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। যত গালভরা বাক্যই উচ্চারণ করিনা কেন ডিকশনারী আর ইন্টারনেট ঘেঁটে, মোদ্দা কথাটা অস্বীকার করা যাবে না যে আমরা আসলে আফ্রিকার ভ্রাতৃরাষ্ট্র সোমালিয়া, সুদান, মালি, লিবিয়া আর চাড থেকে খুব পৃথক নই----ধর্মে তো এক বটেই, আচার আচরণেও প্রায় একইরকম।  সেটাও খুব পরিষ্কারভাবেই উঠে এসেছে শাহবাগের ঘটনাবলী থেকে। কে যেন সেদিন বলছিল যে আমাদের সোনার দেশটা বোধ হয় শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানের তালিবান রাষ্ট্র হয়ে যাবে। সেটা যে হয়ে যেতে পারে তার লক্ষণ তো অনেক আগেই দেখা দিচ্ছিল। মনে আছে ৯/১১ এর পর পর ঢাকার বড় রাস্তায় মিছিল করে মৌলবিসাহেবরা শ্লোগান দিচ্ছিলেনঃ আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান? কই, তখন তো কেউ কর্ণপাত করেননি তাতে। মনে আছে কি আপনাদের যে সেই আমলেই একবার চট্টগ্রামের বন্দর থেকে গোপনে ট্রাকবোঝাই অস্ত্রচালানের খবর বেরিয়েও সেটা বেরুতে দেওয়া হয়নি সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে? সেই অস্ত্রই আজকে শাহবাগের কল্যানে সম্মুখপ্রাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ  করেছে। কিন্তু তখন কেউ গ্রাহ্য করে নি। বুদ্ধিজীবিরা বুদ্ধির চাকচিক্য প্রদর্শন করে তাঁদের স্কন্ধ ঝাঁকিয়ে ঘোষণা করেছিলেনঃ না না, আমাদের দেশবাসী কখনোই উগ্র মতবাদের পক্ষে সমর্থন দেবে না। তাই নাকি? তাহলে আজকে কেন নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে ‘বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে গেল’ বলে বিরাট জনসমাগম করে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে? আজকে সেই ‘নরমপন্থীরা’ কোথায় গেলেন? কোথায় সেই অনুগ্র মতবাদের দেশবাসীরা?
শাহবাগ মঞ্চ থেকে বিতাড়িত হয়ে যেন নিরুৎসাহ না হও তোমরা। কারণ তোমরাই আমাদের শেষ ভরসা। সভ্যতাকে জিইয়ে রাখতে হলে, স্বাধীনতাকে শত্রুর কবল থেকে পুনরুদ্ধার করতে হলে তোমরাই পারবে, আজ হোক কাল হোক, কারণ আমাদের দ্বারা সেকাজটি কখনোই হবে না। আমাদের মাথায় কিঞ্চিৎ বুদ্ধি থাকতে পারে, কিন্তু অন্তরে আমরা একেবারেই ফাঁকা।
তোমরা সংগ্রাম অব্যাহত রেখো।

অটোয়া, ২১ শে এপ্রিল, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২

মীজান রহমান

No comments:

Post a Comment