Thursday 7 March 2013

কিছু মনে করবেন না


মীজান রহমান
লক্ষ্মণ ভাল নয়  প্রথমে জাপানের মন্ত্রী এবার জার্মানীর মন্ত্রী দুজনের একই কথা
“বুড়োগুলি মরে না কেন?”
“আপনারা দয়া করে বিদায় হোন”
এ কি সব্বনেশে কথারে বাবা দুনিয়াশুদ্ধ লোক হেই হেই করে উঠেছেন তাদের বিরুদ্ধে এমন হৃদয়হীন কথাবার্তা লোকে উচ্চারণ করে কেমন করে? কিন্তু এমন যদি হয় একদিন যে পৃথিবীশুদ্ধ সব মন্ত্রীরা একই কথা বলতে শুরু করবেন, তখন কি হবে? তখন কি পৃথিবীশুদ্ধ লোক হেই হেই করে ওঠার সাহস পাবে? নাকি তারা ভাবতে শুরু করবে, কে জানে, হয়ত এই “হৃদয়হীন” কথাগুলোর মধ্যেও কিছু যুক্তি আছে আমরা, মানে এই খুঁটি-ধরে-বসে-থাকা বুড়োগুলি তো ওদের ফতুর করে দিচ্ছি সব দেশে নয় অবশ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতেই কেবল, যেখানে যুদ্ধের পর থেকেই সমাজকল্যান মূলক যাবতীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে----বাচ্চাদের বিনা বেতনের স্কুল থেকে বুড়োদের ভালো পেনশন, মাগনা চিকিৎসা, মাগনা ওষুধ, সবই মজুত হয়ে গেছে সুদিনে এগুলো কোন সমস্যাই ছিল না পশ্চিম বিশ্বে তখন সবই রমরমা চারদিকে কলকব্জার কানে-তালা-লাগানো শব্দ, দেশব্যাপী নতুন নতুন দালানকোঠা আর হাইওয়ে নির্মাণ, অফিস আদালতে চাকরিজীবিদের অঢেল রোজগার, ব্যবসাবাণিজ্যে পয়সা খাটিয়ে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মুটেমজুরেরা বড় কথা, পশ্চিমের উপার্জনক্ষম প্রজন্মের ঘাড়ের ওপর এতগুলো অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো এসে সওয়ার হয়নিএখন এই বুড়োগুলোর ভারে তরুণদের পিঠ কুঁজো হবার উপক্রম
হ্যাঁ, নিজে সেই অপয়া “বুড়ো”দের একজন হয়েও আমি ওদের সংকটাবস্থা কিছুটা অনুমান করতে পারি প্রতি মাসে একবার করে যখন ফার্মেসীতে যাই ওষুধ আনার জন্য তখনই বুঝি, আমাদের এই সুদিন বেশিদিন টিকবে না ফার্মেসীতে অধিকাংশ ক্রেতাই আমার মত “অবসরপ্রাপ্ত”----অর্থাৎ আমরা ওষুধ কিনিনা, তুলে আনি মাত্র, সরকার মহাশয়ই দয়া করে কিনে দেন আমাদের হয়ে এমনকি শরীর খারাপ হলে যদি ফার্মেসীতে যাবার অবস্থা না থাকে তখন ফোন করে দিলে ফার্মেসীই লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেবে আমার ওষুধ আপনি হয়ত ভাবছেন, আহারে, কি দয়ামায়া এই ফার্মেসীর লোকগুলোর----বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে ওষুধ না ভাই, সেখানেও ওই গৌরি সেনেরই অলক্ষ্য হাত ফার্মেসীর কর্তাদের প্রাণে দয়ামায়ার উদয় হয় একমাত্র ওই সরকারি বড়কর্তারই দয়ামায়ার বদৌলতে
সমস্যা হল যে সবকিছুরই একটা সীমা আছে যা দ্রুত উর্ধমুখি তাকে কোন-না-কোনদিন নিম্নমুখি হতেই  হয় চারদিকের হালহকিকত দেখে ঠাহর করছি যে সেই নিম্নগামী পর্বটি বিসমিল্লা বলে মাঠে নেমে পড়ার উপক্রম তাঁরা, মানে পশ্চিম বিশ্বের কর্মকর্তারা, আমাদের এই ঠুঁটো বুড়োগুলোকে না পারছেন ফেলতে না পারছেন গিলতে এদিকে তাদের কোষাগার একেবারে গড়ের মাঠ ঋণের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন সবাই নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে গিয়ে উঁচু দেয়ালের দিকে তাকালে দেখা যাবে সরকারের ঋণবৃদ্ধির হার দ্রুততম কম্পিউটারকেও হার মানিয়ে দেবে অতএব বুড়োরা সাবধান কুড়োল পড়ল বলে করোটিতে
আগেকার দিনে এস্কিমোদের একটা সোজা দাওয়াই ছিল বয়স বাড়তে বাড়তে জীবন দুর্বহ হয়ে পড়ছে? ঠিক আছে, আস্তে করে বিদায় নিন নিজে থেকে চলে যাওয়া একটু শক্ত মনে হলে  আমরা সবাই মিলে আপনাকে সাহায্য করব অস্ত্র দরকার হলে আমরা অস্ত্র জোগাড় করে দেব অথবা খাদ্যের সঙ্গে কিছু গুঁড়ো মেশাতে চাইলে আমরা মিশিয়ে দেব শুধু দয়া করে রেহাই দিন আমাদের আপনাদের বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে আমরা তরুণরাই উপোসে মরব আপনারা নিশ্চয়ই তা চান না?
পশ্চিমের সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলো ঠিক সে পর্যায়ে পৌঁছুবেন কিনা কোনদিন জানিনা, তবে বলা যায় না সেই যে কথায় আছে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পশ্চিমের এখন সে অবস্থা নেহাৎ চীন আর সৌদিরা ছিলেন বলে আপাতত রক্ষা তাদের কাছে হাত পাতলেই তারা দয়া করে টাকার বস্তা খুলে দেন, মোটা সুদের হারে যদিও, নইলে ইতোমধ্যে হাহাকার পড়ে যেত চতুর্দিকে আমেরিকা তো অনেক আগেই দেউলিয়া এখন ইউরোপেরও ত্রাহি ত্রাহি দশা গ্রীস, স্পেন আর ইতালী তো বার বার ডোবে আর ওঠে যতবার ডোবে ততবারই জার্মানী আর ফ্রান্স গিয়ে উদ্ধার করে তাদের আয়ারল্যাণ্ডের অবস্থাও তথৈবচ এবার শুনছি স্বয়ং রানীমাতার দেশ ব্রিটেনও হাবুডুবু খাচ্ছে ঋণের দায়ে
এ অবস্থায় পশ্চিমের দেশগুলো যদি বুড়োদের দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলেঃ “খেলা পেয়েছ? আর কত বাঁচতে চাও তোমরা?” তাহলে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়? আগেকার দিনে আমাদের দেশে বুড়োবুড়ির ভার পড়ত পরিবারের বড়ছেলের ওপর এদেশে আসার পর জানলাম সেটা কেবল আমাদের পূর্বাঞ্চলে নয়, পশ্চিমেও প্রায় একই অবস্থা ছিল বড় ছেলে হয়ে জন্মানোর শাস্তিই ওটা যুদ্ধের পর পশ্চিমের সমাজই হয়ে গেছে বুড়োদের বড় ছেলে আগে বাবামাকে দেখতে গিয়ে ছেলের নিজের জীবনের বারোটা বেজে যেত দুর্দিন এসে যাওয়ার কারণে এখন গোটা সমাজটারই বারোটা বাজার দশা ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় নাকি এখন ফকিরের ভিড় গৃহচ্যুত অভাগাদের ভিড় সেখানে বেশ্যাবৃত্তি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বেকার ছেলেরা মেয়েরা দিশাহারা হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে পথে পথে সস্তা নেশা টেনে কোনরকমে ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলে থাকবার চেষ্টা করছে
এ অবস্থায় বুড়োগুলির আশ্রয় কোথায় ভাবতে পারেন?
গত সপ্তাহে পত্রিকায় পড়লাম ক্যানাডার এক প্রবীণ ভদ্রলোক, প্রবীণ মানে নব্বুই ছুঁই ছুঁই প্রবীণ, আদালতে মামলা ঠুকেছিলেন তাঁর বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে গাড়ির বীমা কেন? বীমার  প্রিমিয়াম হার অন্যায়ভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর বিচারে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আওতায় পড়ে সেটা ‘বয়সবৈষম্য’ বীমা কোম্পানির যুক্তিঃ বৈষম্যের বিষয় নয় মোটেও, স্রেফ সংখ্যাবিজ্ঞান অর্থনৈতিক বিবেচনা জরিপে দেখা গেছে গাড়িচালক যারা সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা সৃষ্টি করে রাস্তায় তাদের অধিকাংশই হয় খুবই নবীন নয়ত খুবই প্রবীণ কুড়ির নিচে যেমন বিপদ আশির ওপরে ঠিক একই বিপদ অতএব কুড়ির নিচেদের প্রিমিয়াম বাড়ানো যদি অযৌক্তিক না হয়, আশির ওপরে যারা আছেন তাদের প্রিমিয়াম বাড়ানোটা অন্যায় হবে কেন উত্তম যুক্তি আদালতের হাকিম বীমা কোম্পানির সঙ্গেই একমত প্রকাশ করে রায় দিলেন বেচারি নব্বুই ছুঁইছুঁই বৃদ্ধের বিরুদ্ধে কি আর করা বুড়ো মন খারাপ করে একা একা ঘরে ফিরে গেলেন
আমার নিজের বয়স সেই অঙ্কে পৌঁছুতে এখনো বেশ অনেকটাই বাকি একান্ত বাসনা  যে সেখানে পৌঁছানোর কিছু আগেই আজরায়েল ফেরেশতা  দর্শন দেবেন কিন্তু ইতিমধ্যে জীবনটাকে কোনরকমে ঠেলে ঠুলে চালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কি এই ‘ঠেলে ঠুলে চালিয়ে যাওয়া’র প্রধান সহায় হল আমার বাষ্পশকট গাড়ি হল বুড়োদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ---এর আরেক নাম স্বাধীনতা আমার পরম ভাগ্য যে এখনও পা ভেঙ্গে পঙ্গু হয়ে পড়িনি, বা হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে হচ্ছে না, হাঁটু বা কোমর মেরামত করার জন্য মেডিক্যাল বডিশপে যেতে হয়নি, কিম্বা পাদুটো একেবারেই হারিয়ে ফেলতে হয়নি যেমন হয় অনেকের আরো ভাগ্য, হঠাৎ করে, বলা নেই কওয়া নেই, আকাশ থেকে ইংরেজির সেই ভয়াবহ C  অক্ষরটি এসে বজ্রপাত ঘটায়নি আজকাল তো যেখানে যাই সেখানেই শুনি হয় প্রস্টেট ক্যান্সার, নয় কলোন ক্যান্সার, নয় ফুসফুস, পিত্ত, গলা, রক্ত, পেট, লিভার, বা কিডনির ক্যান্সার ঐ বেটা ফাঁক পেলেই ফুস করে ঢুকে পড়ে শরীরে এবং একবার ঢুকতে পারলে সহজে ছাড়বার পাত্র নয় ফ্লোরিডার কুমির আর আফ্রিকার হাঙ্গরের মত----ভাল করে কামড় বসাতে পারলে তাকে রক্ষা করে কার সাধ্য সে তো গেলই, সাথে সাথে তার চিকিৎসার খরচ সামলাতে সামলাতে সরকারের গুদাম খালি যেসব দেশে সরকার সহায় হয়না সেসব দেশে লোকজন জমিজমা বিক্রি করে নিজে এবং তার পরিবারকে চোদ্দ পুরুষের জন্য ফতুর করে তবেই বিদায় হয় একহিসেবে তারাই ভাগ্যবান যাদের এককণা জমি নাই, এবং পরিবার পরিজনও কার্যত দিন-আনি-দিন-খাই অবস্থা ভাগ্য বলছি এজন্য যে তাদের সেই যুদ্ধটা করতে হয়না যারা এমনিতেই সর্বহারা তাদের দ্বিতীয়বার সর্বহারা হবার ভয় থাকে না----তারা চুপচাপ বিদায় নিয়ে চলে যায় শুনেছি আল্লাতা’লা সাধারণত তাদের কুড়েঘরেই বসবাস করতে ভালবাসেন তিনিই তাদের একমাত্র ভরসা
আমার পরম ভাগ্য যে পশ্চিমের যুদ্ধোত্তর শ্রীবৃদ্ধি এবং পরবর্তীকালীন নিম্নগতি, উভয় দৃশ্যই স্বচক্ষে অবলোকন করার সুযোগ হয়েছে শুধু তাই নয়, আমি যে মুহূর্তে পশ্চিমে এসে পৌচেছি, সদ্য ডিগ্রিপ্রাপ্ত চাকরিকামী যুবক, ঠিক সেসময়ই পশ্চিমের চাকরির বাজারে দারুণ চাহিদা ১৯৬৪ সালে যখন আমি চাকরির খুঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কোথায় সুবিধামত পাওয়া যায়, তখন প্রশ্ন ছিল চাকরি পাওয়া নয়, অনেকগুলো সম্ভাবনার মধ্যে কোন্‌টিকে বাছাই করা অন্টারিওতে তখন বেশ ক’টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়ে গেছে প্রাদেশিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চাকরির অভাব নেই, অভাব যোগ্য ব্যক্তির ফলে অনেকসময় যেমন তেমন যোগ্যতা নিয়েও মানুষ চাকরি পেয়ে যেত তার সঙ্গে বর্তমান যুগটাকে মেলানোর চষ্টা করুন আজকাল দেশবিদেশ থেকে হাজার হাজার লোক চলে আসছে ক্যানাডা-আমেরিকায়, আগের চাইতে অনেকগুণে বেশি বই কম যোগ্যতাধারী মোটেও নন তারা, অথচ হায়, চাকরি কোথায় একটা ছোটখাটো চাকরির জন্য মাঝে মাঝে শত শত প্রার্থী দাঁড়িয়ে যায় বছরের পর বছর কেটে যায় তাদের বেকার অবস্থায় চাকরির খোঁজে----ভালমন্দ আসে যায় না, যে কোন চাকরি
এ অবস্থাটি কি করে সৃষ্টি হয়ে গেল মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে? এর জবাব দেবার যোগ্যতা আমার নেই তবে অনুমান একটা আছে বইকি মানুষের সেই চিরকালীন দুর্বলতা----একটু পেলে আমরা আরো পেতে চাই বসতে দিলে শুতে চাই শুতে দিলে চাই ঘাড়ে উঠতে এভাবেই পৃথিবীর প্রতিটি সমাজ নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছে, যুগ যুগ ধরে আজকে পশ্চিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যাঃ খরচ বেড়েছে বহুগুণ, সে তুলনায় আয় বাড়েনি মোটেও আয় বাড়েনি কারণ ভাল বেতনে উপার্জন করার মত চাকরিজীবি করদাতার আনুপাতিক সংখ্যা নিদারুণভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত হ্রাস পেল কেন? কারণ জনসংখ্যাতে আগে যেমন একটা সমতা ছিল সেই সমতাটি এখন নষ্ট হয়ে গেছে উদাহরণঃ ক্যানাডা, সুইডেন, ফ্রান্স আর স্পেনের জনসাধারণের গড় বয়স চল্লিশের ওপর তার অর্থঃ এই দেশগুলোতে মধ্যবয়সীদের অনুপাত আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধিমান অর্থাৎ মাথায় ভারি, গায়ে হালকা। ফলে পেনশনভোগী, ভাতানির্ভর জনগোষ্ঠীর তুলনায় তরুণদের সংখ্যা কেবলই কমে যাচ্ছে একটা সময় অচিরেই চলে আসবে যখন ষাটোর্ধ নাগরিকরাই হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন আমাদের বিনি পয়সার চিকিৎসা আর মাসে মাসে একটা ভদ্রমত মাসোহারা সুদূর স্বপ্নতে পরিণত হতে বাধ্য এমনকি আগামী প্রজন্ম আমাদের মত আমৃত্যু একটা ন্যুনতম অঙ্কের পেনশন ভোগ করতে পারবে কিনা তাতেও সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ তখন কি হবে তার একটা প্রাথমিক আভাস এখনি দেখা দিচ্ছে ইউরোপের নানা জায়গায় গ্রীসের কোথায় যেন শুনলাম কিছুদিন আগে এক বুড়ো আত্মহত্যা করেছেন খোদ আমেরিকার মত ধনী দেশে শীতের প্রকোপে অনেক বুড়োই দেহত্যাগ করছেন নেহাৎ ঘর গরম রাখার মত সঙ্গতি নেই বলে  এধরণের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে যাবে তাতে অন্তত আমার কোনও সন্দেহ নেই
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি সময় কিভাবে বদলে গেছে ১৯৭২ সালে আমি সপরিবারে লণ্ডনে গিয়েছিলাম পুরো একটা বছর ছুটি কাটাবার জন্যে সেসময়ই ধরা পড়ে, আমার স্ত্রীর কিডনি সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে তাকে ডাক্তার হাসপাতাল করতে হল পাকা তিনমাস আমরা ক্যানাডার নাগরিক, তা’ও জন্ম বাংলাদেশে ইংল্যাণ্ডের কোষাগারে একপয়সা ট্যাক্স আমি দিই নি অথচ আমার স্ত্রীর যাবতীয় খরচ সব অম্লানবদনে বহন করে নেয় ব্রিটিশ সরকার----অর্থাৎ ব্রিটেনের করদাতারা তিন মাসে নিশ্চয়ই দুয়েক লক্ষ পাউণ্ড খরচ হয়েছিল, যা আজকের যুগে হলে প্রতিটি পয়সা গুণে গুণে দিতে হত আমাকে। ১৯৭২ সালে পয়সা দেওয়া দূরে থাক, আমি জানতামই না কত টাকা খরচ হয়েছে সেযুগে ইংল্যাণ্ডের সোশালিজমের সময়টি মাত্র শুরু হয়েছে, লোকজনের টাকাপয়সার অভাব নেই, সরকারে কোষাগার ভর্তি, ব্যবসাবাণিজ্যের রমরমা অবস্থা, সুতরাং ক্যানাডা থেকে আসা প্রফেসারের স্ত্রী আবার পয়সা দেবেন কেন----তিনি তো আমাদের অতিথি সেই আতিথেয়তাটি এখন মৃতপ্রায় হাজার ভাগ্য যে আমাদের সেই পারিবারিক দুর্যোগের সময়টি বর্তমান যুগে ঘটেনি
পক্ষান্তরে প্রাচ্যের প্রায় সবগুলো দেশেরই সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্নরকম----পশ্চিমের দম্পতিরা জীবনযাত্রার মান ক্ষুণ্ন হয়ে যেতে পারে সে ভয়েতে সন্তান উৎপাদন ভীষণ কমিয়ে দিয়েছেন, আর ওদিকে প্রাচ্যের দম্পতিরা সেসব কথা ভাবেন না, ভাবেন পুত্রসন্তান হবে ক’টি----কারণ ঐ পুত্রসন্তানগুলিই, তাদের বিচারে, ভবিষ্যতের রক্ষাকবচ, এবং বংশবৃদ্ধির একমাত্র সহায়ক তার ফলটা দাঁড়িয়েছে এই যে পুরো আফ্রিকা মহাদেশটিতে জনসংখ্যার গড় বয়স হল ১৪ আর ২০ এর মাঝে এবার বুঝতে পারেন সেখানে কর্মসংস্থানের অভাবে কত লক্ষ যুবক বেকার অবস্থায় কতখানি রোষ আর ক্ষোভ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায় অথচ এই রোষ নিবৃত্তির ক্ষমতা কোন সরকারেরই নেই ফলে তৈরি হবে, এবং হচ্ছেও, রাজনৈতিক উশৃংখলা, অরাজকতা, অপরাধপ্রবণতা, আইন শাসনের দ্রুত অবনতি, নাগরিক জীবনের চরম নিরাপত্তাহীনতা গ্যারি ফুলার (১৯৯৫) আর গুনার হাইনশন (নামক ২০০৩) নামক দুই সমাজবিজ্ঞানী প্রায় একই সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন যে সেসব দেশে অচিরেই সামাজিক বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সন্ত্রাস, ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যেতে পারে
এসব দেখেশুনে বুঝতে পাচ্ছি পৃথিবীর চেহারা কি দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, এবং সেই ঝড়ের মধ্যে আমি নিজে কতটা নিরাপদ অবস্থানে বার্ধক্যের শেষ কটা বছর অতিবাহিত করে যাচ্ছি আমার নাতি আর নাতনির জীবন সম্ভবত এতটা সংরক্ষিত পরিবেশের ভেতরে কাটবে না এমনকি আমার দুটি প্রায়- মধ্যবয়সে-পৌঁছে- যাওয়া ছেলের ভাগ্যেও আমার মত দরাদ পেনশন বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা ভোগ করা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ সেজন্যে খানিক অপরাধবোধ যে নেই আমার মনে তা নয় কিন্তু কি করব বলুন আমি তো চাইলেই ওদের ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে যেতে পারব না
শুধু বলতে পারি, কিছু মনে করবেন না ভাই আমরা ইচ্ছে করে আপনাদের ঘাড়ে উঠিনি---সময়ই তার জন্য দায়ী
অটোয়া,
৭ই মার্চ, ২০১৩
মুক্তিসন ৪২

মীজান রহমান

No comments:

Post a Comment