Sunday 26 August 2012

বাগান থেকে মহাকাশ - ২



মীজান রহমান

            দুই

   নিউটনের মাধ্যাকর্ষণতত্বের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হল এই যে এতে কেবল দুটি বস্তুর পারস্পরিক আকর্ষণের কথা বলা হয়েছে যতক্ষণ আমরা দুই বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি ততক্ষণ নিউটন অপরাজেয় তাঁর বিপরীত বর্গনীতি আর গতিসূত্র---দুয়ে মিলে উভয় বস্তুর গতিপথ নিখুঁতভাবে বের করে দেবে কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দুই বস্তুর মধ্যে সীমিত থাকা ঘটনা কত আর দেখা যায় বিশেষ করে গ্রহনক্ষত্রের বেলায় এটা জলের মত পরিষ্কার যে একটা গ্রহ বা উপগ্রহ একাধিক বিশাল ভর বিশিষ্ট বস্তুর নৈকট্য দ্বারা প্রভাবিত যেমন ধরুণ আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী চন্দ্রগ্রহ----বেচারা আমাদের উপগ্রহের উপাধি পেয়েছে কারণ তার কপালটিই এরকম যে ক্ষুদ্র হওয়ার অপরাধে তাকে সূর্যের চারদিকে নয়, পৃথিবীরই চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে
   কিন্তু তাতে বিষয়টা সরল হয়ে যায় না, বরং নতুন এক জটিলতার মাত্রা যোগ হয় এখন একই পাড়াতে দুটি নয়, তিনটে নায়ক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে---একদিকে সর্বাধিনায়কের আসনে নিজ গাম্ভীর্যময় আলোকসত্ত্বা নিয়ে বসে আছে সূর্যদেব আরেকদিকে তারই অমোঘ আকর্ষণের বলয়তে আবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের পৃথিবী, অপরদিকে রয়েছে ক্ষুদ্রতর চন্দ্রগ্রহ, যার আকার ছোট হলেও তারও আকর্ষণ নেহাৎ তুচ্ছুতাচ্ছিল্য করার মত নয় সুতরাং মাহাকাশের একই পরিবেশের মাঝে দুটি নয়, তিনটি খেলোয়াড় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে প্রশ্ন হল নিউটনের তত্ব যদি দুই বস্তুর সীমানাতে আবদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও অকেজো হয়ে যায় এই ত্রিদেহী জটের মধ্যে? না, সৌভাগ্যবশত তা হয় না, এখানেও দ্বিদেহী ক্রিয়ার মত মাধ্যাকর্ষণ শক্তিসহ নিউটনের বলবিদ্যার সমীকরণ সমূহ সমভাবে প্রযোজ্য সমস্যা যেটা দাঁড়ায় সেটা হল যে দ্বিদেহী তত্বের মত বস্তুগুলোর গতিপথ চট করে বেরিয়ে আসে না দুচারটে অঙ্ক কষার পর আসলে চট করে দূরে থাক আদৌ বেরুয় কিনা সন্দেহ প্রথমদিকে নবীন প্রবী সবরকম গবেষকদের ধারণা ছিল এটা কোন সমস্যা হল? নিউটনের গতিবিষয়ক সমীকরণগুলো থাকতে চিন্তা কিসের কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল ব্যাপারটা অত সহজ নয় যুগে যুগে বহু বহু জ্ঞানীগুণি মানুষ মাথা ঘামিয়েছেন ত্রি-দেহী সমস্যার সমাধান পেতে ইংরেজিতে একে বলা হয় থ্রি-বডি প্রব্লেম, যা নিউটনের সময়কার টু-বডি প্রব্লেম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবং যার জটিলতার মাত্রা একবারে সীমা ছাড়ানো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষক -সমস্যার বিশেষ বিশেষ সমাধান বের করেছেন সীমিত শর্তাদি ব্যবহার করে, এবং অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো কাজেও লেগেছে কিন্তু কোনরকম শর্ত আরোপ না করে পূর্ণ প্রয়োগযোগ্যতাশীল সমাধান বের করতে, অন্তত নিউটনের কলনশাস্ত্র ব্যবহার করে, আজ পর্যন্ত কেউই সক্ষম হননি
    তর্কের খাতিরে প্রশ্ন তোলা যায়ঃ আচ্ছা, আমরা থাকি এই মরবিশ্বে, মাধ্যাকর্ষণ বলয়ের বাইরে কোনদিনই আমাদের যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, অতএব আমদের সাধারণ জীবনধারণের জন্যে একাধিক গ্রহের পারস্পরিক ঠোকাঠুকি নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারই বা কি অনর্থক একটা কাল্পনিক বিষয় নিয়ে অজস্র টাকা খরচ করে কি লাভ হবে আমাদের -প্রশ্নের অন্তত দুটি উত্তর, যা মানবকূলের সকলের জন্যেই প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয় প্রথমটি হল আমাদের জ্ঞানের সীমানা কোথায় সেটা তন্নতন্ন করে খুঁজে নেওয়ার অন্তহীন প্রচেষ্টা আমাদের মনুষ্যত্বকে একটা ভিন্ন মাত্রা দান করে এই যে প্রতিদিন রাতের আকাশে এত এত গ্রহনক্ষত্রের সমাবেশ যা কবি আর বিজ্ঞানীকে সমভাবে অনুপ্রাণিত করে গেছে অনাদিকাল থেকে তাদের সঙ্গে আমাদের এই ভূখণ্ডটির আসল সম্পর্কটা কি এটা যদি জানতে পারি তাহলে আমাদের আদি ইতিহাস---আমাদের অস্তিত্বের আগাগোড়া পরিক্রমা---কোথায় আমাদের যাত্রা শুরু, কোথায়ই বা শেষ, তার কিছুটা হদিস হয়ত  পাওয়া যেতে পারে
   তবে দ্বিতীয় একটি মাত্রা আছে যা আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক জরুরি---শূন্যভ্রমণ বলবেন, শূন্যেই বা যেতে হবে ভ্রমণের জন্যে কে বলল লোকে ফ্লোরিডা যায়, মেক্সিকো যায়, বড়জোর ইউরোপে শূন্যে যাবে কোন পাগল? হ্যাঁ, পাগল বটে বড় বড় বিজ্ঞানীরা, গবেষকরা আসলেই পাগল পাগল না হলে কি জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দিনরাত ল্যাবের ঘিঞ্জি ঘরের ভেতর যন্ত্রপাতি নিয়ে সময় কাটায়? কি জানেন? ওরা কাটায় বলেই আমাদের জীবন আজকে এত আরাম আয়েসময় বিলাসদ্রব্য দ্বারা পরিপূর্ণ হতে পেরেছে এত সব ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটের মহাপ্লাবনে ভেসে যাচ্ছে আমাদের জীবন, সেই পাগলগুলোর কারণেই তাছাড়া আমরা সবাই জানি ১৯৬৯  সালে মানুষ সশরীরে চন্দ্রগ্রহে গিয়েছে মাহাকাশের শূন্যযানে করে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত মঙ্গলগ্রহেও যাওয়া হয়ে যাবে এই যে শূন্যভ্রমণের ব্যাপারটি, এখানেই অনিবার্যভাবে দাঁড়িয়ে যায় বহু-দেহী আকর্ষণ তত্বের প্রয়োজনীয়তা আমরা দূরদর্শনেই দেখেছি, উর্ধলোকের একটা উচ্চতায় পৌঁছানোর পর যাত্রীরা কার্যতওজনহীনঅবস্থায় দাঁড়িয়ে যায়---যানের অভ্যন্তরে তারা ভাসতে শুরু করে নদীর মাছের মত এর পর যতই ওপরে উঠতে থাকে ততই নতুন গ্রহ-উপগ্রহদের পরিপার্শ্বে চলে আসে একসময় তখন আবার নতুন করে ভিন্নরকম মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বলয়ের মধ্যে নিজেদের অবস্থিতি উপলব্ধ হতে শুরু করে হয়ত একটি নয় একাধিক বিপুলদেহী বস্তুর টানে তারা একপ্রকার দিশেহারা হয়ে যায়---সে টানে এদিকে, টানে দিকে অর্থাৎ একটি অতিবাস্তব বহুদেহী পরিস্থিতি এর মাঝে নিউটনের বিপরীত বর্গনীতি অকেজো হয়ে যায় তা নয়, কিন্তু শূন্যযানের যাত্রাপথের মানচিত্রটি চট করে অঙ্ক কষে বের করে ফেলা একরকম দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে অথচ মহাশূন্যে যানপ্রেরণের আগেই তার যাত্রাপথ সঠিকভাবে নিরুপণ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না তার মনে যে করেই হোক একটা নিখুঁত বা প্রায় নিখুঁত মানচিত্র দাঁড় করাতেই হবে, সেটাই হল যাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের জ্ঞানীগুণি বিজ্ঞানীদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব
    কিন্তু তার উপায় কি নিউটনের মত সোজা অঙ্ক কষে যদি সেটা জানা সম্ভব না হয় তাহলে বিকল্প আর কি পন্থা আছে?
    সেসব কারণে ত্রিদেহী এবং বহুদেহী তত্বের প্রতি গাণিতিকদের মনোযোগ একটা জরুরি পর্যায়ে পৌঁছে যায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তাঁরা উঠে পড়ে লেগে যান প্রথম তিন বস্তু, পরে বহু বস্তু সম্বলিত সমাবেশে তাদের গতিপথের প্রকৃতি কি হবে তা গণিতের মাধ্যমেই উদ্ধার করা রীতিমত একটা থমথমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায় বলবিদ্যাবিষয়ক গণিতের গবেষণাতে ঠিক এই সময় ঘটে এক অভিনব ঘটনা



মীজান রহমান
অটোয়া,
২২ শে আগস্ট, ‘১২
মুক্তিসন ৪১

No comments:

Post a Comment