Thursday 16 December 2010

বিজয়ের কষ্ট

বিজয়ের কষ্ট

by Naznin Seamon on Thursday, December 16, 2010 at 6:20am

মোটামুটি যখন থেকে স্মৃতির ভাণ্ডারে ঘটনাবলী বা চিত্রাবলী জমা হতে শুরু করেছে, সোনালী সেই বয়সের উপর স্তূপীকৃত ধূলা সরালে আলোছায়ার খেলায় দেখতে পাই পনেরই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাবার দোকান থেকে খুব ভাল মিষ্টি নিয়ে বাড়ী ফেরা, আর ঠিক রাত বারোটায় প্রথমে আমার মুখে এবং তারপর একে একে প্রত্যেকের মুখে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন মা। আমাদের সব ভাইবোনের জন্মতিথিতেই মা তাঁর সন্তানদের এমন করে প্রতিবছর আহ্লাদিত করতেন; সব মায়েরাই এমন করেন বোধহয় ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ ভঙ্গিতে। তফাৎ শুধু প্রতি বছর আমার বেলায় বাড়ীর সবাইকেই মিষ্টিমুখ করানো হোত আর ঘুরে এসে  আমাকে দ্বিতীয়বার; কেমন যেন অন্য ধরনের বিশেষ আনন্দ। না, না, আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি, এমন লক্ষ্নীরূপী ও নই যে আমার জন্মের পর অর্থ সমাগমে ঘরবাড়ি ভরে গেছে তাই এত আদরের ছড়াছড়ি বা অনেক সাধনার প্রথম বা বেঁচে থাকা সন্তান ও নই যে যাবতীয় আয়োজন আমাকে ঘিরে হবে। হেতু ভিন্ন। আমার মুখে তুলে দেয়া মিষ্টি ব্যক্তিগত---মায়ের বা বাবার নিত্য ভালবাসা। কিন্তু একই সাথে ওই নির্দিষ্ট দিনে অন্য সবাইকেও এই আহ্লাদ প্রদর্শনের এই রীতি শুরু হয়েছে আমার জন্মের আগে থেকেই আরো একটি জন্মোৎসব পালনের নিমিত্তে। কোন পূর্ব পুরুষ নয়, ধর্মীয় কোন চরিত্র নয়, বরং উপলক্ষ্য কাগজ পত্র্রে একটি জাতির চূড়ান্ত জন্ম হওয়া, একটি দেশের ভূ-খণ্ড শত্রুর করাল থাবা থেকে মুক্ত করা, একটি পতাকাকে নিশ্চিন্ত মনে বুক ফুলিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয়া। ১৬ই ডিসেম্বর বাঙ্গালী ও বাংলার বিজয় দিবস।
     দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর একটি স্বাধীন দেশের জন্ম যে সংগ্রামের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল আরো আগে দীর্ঘদিনের ক্রমাগত শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, বৈষম্য, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, ভাষাগত আগ্রাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে। মা বলতেন, দেশের আজকের এই দূরাবস্হার মূল কারণের একটি হোল মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা প্রাপ্তি। নয় মাস---মাত্র? আঁতকে উঠতেই পারি আমরা, দেশবিরোধী কথা মনে হতে পারে। কিন্তু তাঁর যুক্তি ছিল যে এই যে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন, এঁদের অনেকেই একই পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। বাংলার প্রতি ঘর থেকে সমান ভাবে, এমনকি অসমভাবেও মানুষ মারা যায়নি। সবাই যুদ্ধে যায়নি;   বরঞ্চ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে। যার দুটো হাতই সমান কর্মক্ষম, সে কি করে বুঝবে হাত না থাকার যণ্ত্রণা? যার ঘর বাড়ি অক্ষত থাকল, কোন রকম কোন টানাপোড়ন ছাড়া কাটল নয় মাস যখন গোটা দেশে উত্তুঙ্গ অবস্হা, যার কোন আত্নীয় অনাত্নীয় হারালো না, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত হোল না, সে কি করে বুঝবে স্বজন হারানোর বেদনা? আমরা আদতে প্রস্তুত ছিলাম না এই বিজয়ের জন্য। যে বিশাল দানবের আকারে পাকিস্তানী বাহিনী হামলে পড়েছিল দেশী চামচাদের সাথে নিয়ে এবং পরবর্তীতে বর্হিবিশ্বের অনেক মিত্রশক্তির নৈতিক এবং অর্থনৈতিক, কিয়দংশে কূটনৈতিক সহায়তায় আরো দৃঢ় হয়েছিল তাদের শক্তি, তা যে নয় মাসেই পরাজিত হবে, লেজ গুটিয়ে পালাতে হবে তা হানাদারো তো দূরের কথা, যুদ্ধরত বা মুক্তকামী আপামর জনসাধারণ কেউই বোধহয় আন্দাজ করতে পারেননি। আমাদের অন্যতম বন্ধু ভারতের সহযোগিতা ছাড়া এই দ্রুত বিজয় সম্ভবও ছিল না যদিও সেই প্রসঙ্গে এখানে কথা বলবনা।
     এই ২০১০ সালে আমরা ৪০তম বিজয় দিবস পালন করছি; অনেক আনন্দ, উল্লাস, উচ্ছ্বাস রয়েছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা আনীত স্বস্তি, শান্তি, সাবলীলতা কি আমরা ভোগ করছি, না এ যাবৎ কখনও করতে পেরেছি? কি করে পারব? মানুষ আর অমানুষ কি একসাথে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে? যে দেশে রাজাকারেরা হয়ে যায় সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য আর মুক্তিযোদ্ধারা হন অবহেলিত, সেই দেশে স্বাধীনতার ফসল ভোগ করা কি সম্ভব? অন্ততঃ কোন সুস্হ মানুষ তা পারেনা। এদের ঔদ্ধত্য দেখে সবাই অবাক হই আমরা, আহত হই, বোবা কান্নায় ফেটে পড়ি, কিন্তু তথাপি নির্বাক থাকি। দীর্ঘ দিনের অগণতান্ত্র্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্হা আমাদের বিবেককে মুষ্টিবদ্ধ করেছে, প্রতিরোধের শক্তি কেড়ে নিয়েছে। আমরা বোবা প্রতিবাদ করি, ঘৃণা প্রকাশ করি, কিন্তু জোরালো গলায় কিছু বলতে পারিনা। ’৭১ এর মত তেমন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আমাদের আর আসেনি। তাই সব কলন্ক, নির্যাতন আমরা কোন না কোনভাবে মেনেই নিই।
     এমন কয়েকজন নারীকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি যারা পায়ের নিচে শক্ত মাটি না থাকার জন্য পতিদেবের শারীরিক, মানসিক সব অত্যাচার সহ্য করেন অনেকটাই নীরবে। বাংলাদেশের কি তেমনই অবস্হা? এখনও যে দেশে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, নতুন প্রজন্ম যেখানে সচেতন, আপামর জনসাধারণ যেখানে স্বাধীনতার পক্ষে, সেখানে হাতে গোণা কিছু রাজাকার, তাদের নষ্টবীজে জন্মানো ছানা আর ওদের পৃষ্ঠপোষকদের হাতে গোটা দেশকে জিম্মি হয়ে থাকতে হবে? তাহলে আমরা বীর বাঙালী কেমন করে হলাম? দেশের আজ যে অবস্হা, বিরোধী শক্তির এই যে উথ্থান, এর পেছনে কি আমাদের সহনক্ষমতা দায়ী নয়?
     মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স হয়েছে, অনেকে ইতিমধ্যে মারা গেছেন অতৃপ্তি আর যন্ত্র্ণা বুকে নিয়ে। আমার জন্মদাত্রী যিনি ঘাতক দালালদের বিচারের দাবীতে অসুস্হ শরীর নিয়েও নির্মূল কমিটির মিছিল মিটিং এ সক্রিয় থেকেছেন, যিনি বারংবার বলতেন প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে “দালালদের বিচার কি হবে না কোনদিন” তিনিও চলে গেছেন। আস্তে আস্তে যাবেন আরো সবাই এই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে। একই দুঃখের কথা আমি প্রকাশ করতে শুনেছি আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। তাঁরা ব্যক্তিলাভের জন্য যুদ্ধ করেননি, কিন্তু তাই বলে দেশের এই চেহারা দেখার জন্যও কিন্তু প্রাণের ঝুঁকি নেননি, অবর্ণনীয় কষ্ট করেননি। কেন তাঁদের এই অপমান? কেন দেশের প্রতি এই অবহেলা আমাদের? কেন মুক্তিযুদ্ধের এই ঘৃণ্য ইতিহাস বিকৃতি?
     স্বাধীনতার এই ৪০ বছর পর, (আমার না কিন্তু! অনেকেই উদারভাবে আমাকে বেশ কয়কেটি বছর বয়স বাড়িয়ে দিয়েছেন জন্মদিনের উপহার হিসেবে, যদিও খুব একটা অসুবিধা হয়নি তাতে। বরং ’৭১ এ জন্মালে আরো একটু বেশী গর্বিত হতাম।) এখন আর সময় নেই চুপ করে বসে থাকার, নির্জীব সময় পার করার। এখন সময় প্রতিবাদে ফেটে পড়ার, বিচারের দাবীতে সোচ্চার হবার। সব বিভক্তি ভুলে এখন রাজাকারদের বিচার নিশ্চিত করতে যে যেভাবে পারি সহায়তা করতে হবে। আর কোনদিন মা আমাকে দু’বার করে মিষ্টিমুখ করাবেন না, জন্মদিনের আশীষ দেবেননা মনে হলেই ভীষণ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাই নিজের ভিতর নিজে, অসহায় বোধ করি, গুমরে গুমরে কাঁদি; কিন্তু যখন মনে হয় আগামী বছরও হয়ত রাজাকারগুলো সদর্ভে বাংলার মাটিতে স্বাধীন ও সদম্ভ পা ফেলবে সেই কষ্ট সত্যি অসহ্য, যন্ত্রণায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাই। সেই যন্ত্রণাকাতর মন থেকে সব্বাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা এই প্রত্যাশায় যেন আগামী বছর রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশে বিজয়ের পতাকা পতপত ওড়ে।
· · · Share


    • Mollha Lablu ভাল লাগা রেখে গেলাম ...চমৎকার শব্দ মালা। বিচার হোক সকল অন্যায়ের। সুখী সমৃদ্ধি এক দেশের অপেক্ষায়। আমাদের পূর্বসূরিরা অনেক ত্যাগ স্বিকার করে, একটি স্বাধীনদেশ দিয়ে গেছে তাদের উত্তরসূরিদের । আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য একটি যুদ্ধাপরাধী মুক্ত , রাজকার মুক্ত দেশ দিতে চাই!

    • Shafiul Islam ‘... মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়...’
      জন্মদিন ও বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা (♥♪♥)

    • Robiul Manik
      আজ এখানে দাড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
      অভিশাপ দিচ্ছি।
      আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ঞপক্ষ
      দিয়েছিলো সেঁটে,
      মগজের কোষে কোষে যারা
      পুতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ
      দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,

      যারা গনহত্যা
      করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
      আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
      পশু সেই সব পশুদের।

      ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
      সারিবদ্ধ দাঁড়
      করিয়ে নিমিষে ঝা ঝা বুলেটের বৃষ্টি
      ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
      হত্যাকে উতসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
      ক্যাম্পাসে বাজারে
      বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভতস গন্ধ দিয়েছে
      ছড়িয়ে,
      আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না
      কামনা।
      আমাকে করেছে বাধ্য যারা
      আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
      সিড়ি ভেন্গে যেতে আসতে
      নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে
      অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেইখানে দজ্জালদের।
      (অভিশাপ দিচ্ছি – শামসুর রাহমান)

    • Motashim Al Razi সুন্দর করে লিখেছেন আমার কথাগুলো নাজনীন। ধন্যবাদ আপনাকে।

    • Abul Kalam Azad Valobasi ,ami Bangladesh-k Valobasi.Bissas hosse Valobasar sokti.Amar bissas 2011 Bijoy Dibos Chinnito Rajakar'der asfalon mukto palon korte parbo inshallah.

    • Azad Chowdhury Bravo, naznin dear friend thank u also .Very well & feel very good .

    • Hasan Mohisopan
      ও-রে ঐ রাজাকারের চামড়া ছিলে লবন লাগিয়ে দে
      ওরা যে করছে শোষণ বাংলা মাকে- নিদারুণ সর্বনাশে!
      ওদের ওই খোলা বুকে তপ্ত তরল সিসা ঢেলে দে
      ওরা সব সাজছে সাধু- আহা হা সোনা যাদু- সর্বগ্রাসে
      ও-রে ঐ আল-সামসের বুকে চড়ে চক্ষু উপড়ে নে
      ওরা নয় মোটেই মানব- ও ভীষণ দৈত্য-দানব
      ওদের ঐ নকল মুখের মুখোশ খুলে দে!
      আহা রে- আল-বদরে বসেছে বেশ কদরে
      ওদের ঐ তকমা আঁটা প্রাসাদ ঘরে আগুন লাগিয়ে দে!

    • নীল কন্ঠ
      চল্লিশ বছর পার অইছে।রাজাকার আইজ সত্যই রাজা, বড় নেতাগো বড় কুটুম।
      একদলা থুতু ছিটাই হেই নেতাগো নামের উপরে। আর যারা ভোট দেয় রাজাকারে্রে।গোলামের পুত আজম, কামরুইজ্যা, মোল্লা কাদেইর‍্যা মুইত্যা ছাইদি বেবাক আলবদর কোর্দন পাইরা বুক ফুলাইয়া লুঙ্গির কো
      না ধইরা হাঁটে!

      হ্যাগো বেজাগার একডা পশমও কেউ ছিড়বার পারলো কই স্বাধীন দ্যাশে?

      মুক্তিসামু অহন জীবনের নৌকায়
      লগি ঠেলে ভিক্ষার ফুটপাতে আর বুইড়া মুক্তিকরিম
      শীতে হাড় কাঁপায় রিস্কার পেদালে পেদালে।
      বিমলের পরাণডারে আইজো পোড়ায় পোড়া মইচের লাহান।বিরঙ্গনা বউ
      আর একটা মোটে বুইনের স্মৃতি;
      পোলাডার লাশের গন্ধ আইজো ঠিক ঠাহর করে সত্তর বছরের তসরুদ্দি।
      বাতাসে জাগে বারুদের নেশা ঠিক চল্লিশ বছর পর!ভাঙ্গা চোড়া গতরে
      উঁকিদিয়ে যায় একজন মুক্তিসেনার অশিতীপর আস্ফালন!

      কি পেল এরা আর কি পেল দেশ?এই কি চেয়েছিল সবাই?
      জানি ষোল তারিখ এলেই রাস্তায় নামবে আনন্দের মিছিল
      আর নিভৃতে সামু, করিম মাঝি, বিমল কিম্বা তসরুদ্দির
      খেরো জীবনের হতাশার গাঙে জাগবে জোয়ার কান্নার জলে।

      হাছাই তো!জীবনডা য্যান একখান আন্ধা জঙ্গলের জোনাক!
      লম্বা নিশুতী রাইতে এট্টূ এট্টূ জ্বলে, আবার নিব্যা যায়।

    • Hassanal Abdullah
      বেয়নেট দিয়ে ছিঁড়লো দেহ
      চৌরাস্তায়, ঘরে;
      মায়ের চোখের সামনে গুলি
      করলো ছেলের পরে,
      বউয়ের সামনে করলো যারা
      স্বামীকে জবাই,
      সেই দালালের বিচার চাই।
      দালালের বিচার চাই।
      দালালের বিচার চাই।

    • Mojaffor Hossain ‎'shai dalaler bichar chai !' thanks for sharing such an important writin'

    • Biswajit Barua apnake asonko dhonnobad.....akti osadharon lekha hoyeche....porar moto.......ato valo likhen !


বিজয়ের কষ্ট





নাজনীন সীমন
::
নিউ ইয়র্ক
c২০১০ ডিসেম্বর ১৬

No comments:

Post a Comment