মীজান রহমান
Video Illustration : Shafiul Islam, VCV
আমরা
শূয়রের মাংস খাই না।
কেন
খাই না? হারাম, তাই খাই না। ভাল কথা। এতে শূয়রজাতিরই উপকার। কিন্তু কেন হারাম হল? ছোটবেলায় একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম এক
মৌলবিসাহেবকে। কারণ তারা নোংরা, ভীষণ নোংরা। বললেন তিনি। কাদায়-গোবরে গাদাগাদি করে
থাকতেই ভালবাসে বেশি। তাইতো। কাদায়-গোবরে থাকা প্রাণীদের কি খাওয়া যায়? বেশ
যুক্তিসঙ্গতই মনে হয়েছিল সেসময়।
পরে
বুঝলাম আসল কারণটা হয়ত তা নয়। আসল কারণ ইহুদীরা খায় না। শত হলেও আমাদের ধর্মের
অনেক কিছুই তো ইহুদীদের দেখাদেখি, তাই না? ওরা খৎনা করায়, আমরাও করাই। ওরা টুপি
পরে, তাই আমরাও পরি। গোঁড়া ইহুদীরা দাড়ি রাখে, গোঁড়া মুসলমানরাও তাই। ওরা তিনবার
প্রার্থনা করে, আমরা করি পাঁচবার। ওরা উপোশ করে ইয়ম কপোরে, আমরা করি রমজানে। শোনা যায় ইহুদীরা একসময় চুরির অপরাধে হাত কেটে
ফেলত। সেটা হয়ত সত্য নয়। তবে ইসলামের আগেই যে আরব বেদুইনদের মধ্যে হাত-কাটার প্রথা
প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ আছে। ইসলাম সেটা বন্ধ করতে পারত, করেনি। আমার জানামতে পবিত্র
কোরাণে ওটা বারণ করা হয়নি ( ৫ঃ৩৮ দ্রষ্টব্য)। সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের দেশে সেটা এখনো
আমদানি হয়নি, যদিও আরবদের অনুকরণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমার
দেশবাসীদের অনেকেই।
শূকরদের
‘নোংরা’ অপবাদটি এখন একটু অন্যায় বলেই মনে হয় আমার কাছে। আধুনিক প্রাণীবিজ্ঞানীরা
নির্ভুলভাবে প্রমাণ করেছেন যে চতুষ্পদী জন্তুদের মাঝে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও
দুর্গন্ধমুক্ততার দিক থেকে সর্বোৎকৃষ্ট জীব হল শূকর। কেবল তাই নয়। তারা আবেগপ্রবণ,
স্পর্শকাতর ও অভিমানী। তাদের মনে কষ্ট দিলে তারা রাগ দেখাবে না, বাচ্চাদের মত
কোনায় গিয়ে চুপটি করে বসে থাকবে। তারা খেলতে পছন্দ করে। কৌতুকপ্রিয়। একঘেয়েমি একদম
পছন্দ নয় তাদের। মা-শূকরেরা নাকি শিশু-শূকরদের ঘুমুপাড়ানি গান গেয়ে শোয়ায়! এবং কেউ
কেউ দাবি করেন যে তারা কুকুরের চাইতেও সহজপোষ্য জীব।
জীবজগতে
কারা সবচেয়ে বুদ্ধিমান তার একটা খতিয়ান দেখছিলাম ইন্টারনেটে। পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে
আগে কোন্টির কথা মনে আসে আমাদের? টিয়াপাখি, অবশ্যই। যে কথা বলতে পারে। ‘বউ কথা
কও’ বলে গানের সুরে শব্দ করতে পারে। ওদের কথা বলার ক্ষমতা দেখে কে না মুগ্ধ
হবে বলুন। কয়েকবার উচ্চারণ করলেই কি সুন্দর শিখে নেয় সেটা। আমরা হয়ত অবাক হয়ে
ভাবি, বুদ্ধির দিক থেকে ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে ওদের তফাৎটা কোথায়।
প্রশ্ন
হল, ওরা কি নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু শিখবার ক্ষমতা রাখে, না, আমাদের ঠোঁটের
নড়াচড়াই নকল করে কেবল? প্রাণীবিজ্ঞানীদের অভিমত হল যে সাধারণত তারা নকলই করে শুধু,
তোতাপাখি বলতে সচরাচর যা বোঝায়, কিন্তু নিজের উদ্যোগে কিছু একটা করা, মানুষের মত,
সেটা খুবই বিরল। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। একটা ব্যতিক্রমের গল্প পশ্চিম বিশ্বে
অনেকেরই জানা।
This is Einstein!
এলেক্সের
জন্ম ১৯৭৬ সালে। মৃত্যু ৬ই সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সাল। মানুষ হলে বলা যেত অকালমৃত্যু,
কিন্তু এলেক্স একটি পাখির নাম, আফ্রিকার গ্রে প্যারট জাতীয় টিয়াপাখি। ওর জন্যে ৩০
বছর ছিল দীর্ঘায়ু। তার কপাল ভাল যে আইরিন পেপারবার্গ নামক এক পশু মনোবিজ্ঞানীর
গবেষণাগারে আশ্রয় পেয়েছিল। পেপারবার্গ প্রথমে ছিলেন এরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে
বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন হার্ভার্ড এবং ব্র্যাণ্ডেস বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে। গোড়া
থেকেই তাঁর গবেষণার লক্ষ ছিল এলেক্সকে দিয়ে সাধারণ ওষ্ঠচালনার বাইরেও অন্য কিছু
করানো যায় কিনা, সেটা পরীক্ষা করা। যেমন নিজে থেকে একটা শব্দ বা বাক্য গঠন
করা, যা অর্থপূর্ণ, এবং যা তার নিজের আবেগকেই প্রকাশ করে। দেখা গেল যে, হ্যাঁ,
যায়। ঠোঁট নাড়ার পর্যায় অতিক্রম করে একসময় পাখিটা নিজের উদ্যোগেই বলতে শিখলঃ “
শিষ্টতা ভুলোনা যেন”, “ তোমাকে ভালবাসি”, “আমিও তোমাকে ভালবাসি”। একদিন আইরিন
দরজাটরজা বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এলেক্সের কাছে বিদায় নেবার সময়
পাখিটা বললঃ “ কাল আসবে তো?” “অবশ্যই আসব”, জবাব দিলেন তিনি। পরের দিন সকালবেলা
আইরিন পেপারবার্গ অফিসে ঢুকে দেখেন এলেক্স মারা গেছে।
কে
বলে পশুদের আবেগ নাই?
পাখিদের
মধ্যে সবচেয়ে কুৎসিৎ কে? এমনই কুচ্ছিৎ যে পৃথিবীর কোনও কবির কল্পনাতে সে কখনো কোনও
স্থান পেয়েছে কিনা সন্দেহ? আকাশের চিলেরা
পায়, এমনকি শবখেকো শকুনেরাও পায় মাঝে মধ্যে, কিন্তু এই বেচারির কপালে তা’ও নেই। পাখিটি
হল আমাদের দৈনন্দিন গৃহস্থালীর অতি পরিচিত, অতি অনাদৃত, কদাকার কাক। যেমন সে দেখতে
কুৎসিৎ তেমনি জঘন্য তার স্বভাবচরিত্র। রাজ্যের যত নোংরা, ময়লা আবর্জনা, ডোবা
নর্দমায় পড়ে থাকা পঁচা গলা কুকুর বেড়াল ইঁদুরের মরা লাশ, সেদিকেই তার তাক। অথচ মজার ব্যাপার কি জানেন? পাখিদের মধ্যে কাকই
নাকি সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। এবং সবচেয়ে বেশি স্বজাতিপ্রীতি তাদেরই। দেশে
থাকাকালে দেখতাম ওদের কাণ্ডকারখানা। কোন কারণে যদি কারো উঠানে একটা মরা কাক পাওয়া
গেল, তাহলে তার বারোটা বেজে গেল বলতে পারেন। শত শত কাক তার বাড়ির দেয়ালে, ছাদে,
আঙ্গিনায়, বারান্দায়, এমন মরাকান্না শুরু করে দেবে যে বেচারা খাওয়া-ঘুম বন্ধ করে
সপরিবারে অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য হবে সাময়িক আশ্রয়ের জন্যে। সম্ভব হলে হয়ত ওরা
বেচারিদের চামড়া ছিঁড়ে খেত। একটা কাকের মৃত্যুর খবর যে কিভাবে ছড়ায় সারা দুনিয়ার
কাকেদের কাছে সেটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকত না। এতে অবশ্য ওদের বুদ্ধির পরিচয়
প্রকাশ পায় কিনা বলা মুশকিল, তবে ওদের দলবদ্ধতা, একতা, স্বজাতির প্রতি মমত্ববোধ,
এগুলো থেকে আমাদের যে শিক্ষণীয় কিছু নেই তা নয়।
এবার
নাহয় তাদের বুদ্ধির প্রসঙ্গে আসি। ওরা গাছের ডালে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে, তাই না?
কাকের ডিম দেখেছেন কখনও? ভারি সুন্দর----হালকা নীল রঙের মসৃণ খোলশে ঢাকা একটা নিখুঁত
উপবৃত্ত যেন। সেকারণেই কিনা কাকের ডিম অন্যান্য পাখিদের কাছে খুব লোভনীয়। বিশেষ করে
বড় আকারের পাখিগুলো----বাজ, শকুন জাতীয় প্রাণীভুক পাখি। কাকেরা সেবিষয়ে বেশ
ওয়াকেফহাল, এবং তার জন্যে তারা একটা রক্ষীবাহিনীর ব্যবস্থা করে রেখেছে। ডিম পাড়ার
সময় থেকে শিশু কাক পাখা মেলে উড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা তারা
বহাল রাখে। ব্যবস্থাটি এরকমঃ একদিকে নীড়ের পাহারায় থাকবে মা-কাক তার ডিম বা
বাচ্চাকে পেটের নিচে লুকিয়ে, আরেকদিকে গাছের ওপরদিকের শাখাগুলোতে খুঁটি গেড়ে বসে
থাকবে তার দলের অন্যান্য কাকেরা। কোনরকম বিপদের লক্ষণ দেখামাত্র কা কা করে এমন
হৈচৈ শুরু করে দেবে যে শিকারি পাখি তখন বাপ বাপ করে পালাতে বাধ্য হবে।
এবার
আসুন কাকেদের খাদ্যসংগ্রহের বিষয়টিতে। ওরা পঁচা-গলা জিনিস খুব পছন্দ করে সেটা ঠিক
তবে আরো একটা জিনিসের প্রতি তাদের বেশ দুর্বলতা----বাদাম। নরম খোলের বাদাম হলে
তারা নিজেরাই ঠোঁট দিয়ে খুটে খুটে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু শক্ত খোলশের
বাদাম হলেই যত সমস্যা। তখনই তাদের বুদ্ধির পরীক্ষা।
আস্ত
বাদামটিকে যখন সে নিজের চেষ্টায় ভাঙ্গা যাবে না বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল, তখন তার
একমাত্র পথ অন্য কাউকে দিয়ে ভাঙ্গানো। প্রথমেই সে খুঁজতে লাগল একটা সুবিধামত
জায়গা। গ্রামাঞ্চলে হলে সে কি করত জানিনা, কিন্তু শহরে বন্দরে, বিশেষ করে যেখানে
যানবাহনের ভিড়, সেখানে প্রচুর সুযোগ। বাদামটাকে ঠোঁটে চেপে সে প্রথমে একটা বড়
রাস্তার ওপর কোনও উঁচু জায়গাতে গিয়ে বসে। ট্র্যাফিক লাইটের বড়সড় খুঁটি, বা
এপার-ওপার বিস্তৃত বৈদ্যুতিক তার, বা কোনও ওভারব্রিজ-----যেখানেই কাজ হাঁসিল হতে
পারে বলে সে মনে করে। উদ্দেশ্য হল বাদাম ভাঙ্গা, যে করেই হোক। ট্র্যাফিক লাইটের কাছাকাছি
জায়গাগুলিই বেশি পছন্দ তার, এবং তার কারণও আছে। বাদামটাকে সে টুপ করে ফেলে দেয়
রাস্তায়। সেটা চাপা পড়ে কোন-না-কোনও গাড়ির চাকার নিচে। কিন্তু সে কি তৎক্ষণাৎ ঝুপ
করে নেমে যায় ভাঙ্গা বাদাম কুড়িয়ে ঠোঁটে দেবার জন্যে? না, অত বোকা সে নয়। বাদাম
কুড়াতে গিয়ে যদি নিজেই চাপা পড়ে গাড়ির নিচে তাহলে লাভ হল কি। অতএব সে
ধৈর্য ধরে বসে থাকে। অপেক্ষা করে কখন ট্র্যাফিক লাইট সবুজ থেকে লাল হয়। সব
ট্র্যাফিক তখন থেমে যায়---অর্থাৎ তখনই মোক্ষম সময় নিরাপদে বাদাম কুড়ানো রাস্তা
থেকে। এরকম বুদ্ধি যে কাকের সেই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে থাকতে পারে সেটা আমি কল্পনাই
করতে পারিনি। অথচ এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছুদিন আগে স্থানীয় টেলিভিশন প্রোগ্রামেই
দেখানো হল।
Crows using traffic to crack walnut
আমাদের
গণিতশাস্ত্রে একটা বিখ্যাত সমস্যা আছে। একটা নামও আছে তার----ভ্রাম্যমান সওদাগরের সমস্যা! ইংরেজিতে বলে Traveling Salesman
Problem.
সমস্যাটা এরকম। ধরুন একজন সওদাগরকে একই দিনের ভেতর অনেকগুলো বাড়ি চক্কর দিতে হবে
একটা পাড়ার মাঝে। তাকে অঙ্ক কষে বের করতে হবে, কিভাবে, কোন্ পথে, কোন বাড়ি প্রথম,
কোন্টা দ্বিতীয় করে যেতে যেতে সবচেয়ে কম সময়ে সবগুলো বাড়ি সেরে ফেলা যায়। পাঠক
হয়ত ভাবছেন এটা কোন সমস্যা হল? এর জন্য অঙ্ক কষতে হবে কেন। আল্লার নাম করে সোজা
রওয়ানা দিলেই হয়----প্রথমে সবচেয়ে দূরেরটা, পরে একটু কাছেরটি, এভাবে এগুলেই তো হয়ে
গেল। হ্যাঁ যায়, যদি বাড়িগুলো একই সরলরেখাতে থাকে। কিন্তু লোকজন বাড়ি বানায়
সওদাগরের বেচাকেনার সুবিধার জন্যে নয়, তাদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের কথা ভেবে।
তারা থাকে অনেকগুলো এলোমেলোভাবে ছড়ানো এলাকাতে। সেই এলোমেলো মানচিত্রের মাঝে “সবচেয়ে
সোজা পথ” বের করা সাধারণ লোকের কাজ তো নয়ই, বড় বড় মাথাওয়ালা পণ্ডিতরাও দীর্ঘকাল
মাথা ঘামিয়েছেন এ-সমস্যা নিয়ে। গণিতের ভাষায়, একরকম সমতল বহুভুজের ওপর একটি কঠিন
অপ্টিমাইজেশন সমস্যা এটি। মজার ব্যাপার কি জানেন, মানুষের মাথায় যত কঠিনই হোক, মৌমাছিদের জন্য কিন্তু
সেটা একেবারে জলবৎ তরলং। ওরা হাসবে আমাদের দিশাহারা অবস্থা দেখে। ওরা কিভাবে ফুলের
গন্ধ পাওয়ামাত্র গোটা শহর চষে বেড়ায় মধুসংগ্রহের জন্যে? ফুলগুলো ঠিক কোথায় কোথায়
আছে সেটা বলে দিলেই যথেষ্ঠ----ওরা নিজে থেকেই বের করে ফেলবে কোন্ পথে সবচেয়ে কম
পরিশ্রম ও সময় ব্যয় হবে। অর্থাৎ যে সময়টুকু আমরা মাথা চুলকাতে চুলকাতে ব্যয় করি সে
সময়ের মধ্যে তারা কাজ হাঁসিল করে ফেলে।
মৌমাছিদের
বাড়িঘরের দিকে ভাল করে তাকিয়েছেন কখনো? ওরা কিভাবে মৌচাক বানায়? হ্যাঁ, ওদের মৌচাক
থেকেই তো মোম চুরি করি আমরা, কিন্তু আমি বলছি মৌচাকের ছোট ছোট খুপরিগুলোর কথা।
সেগুলো দেখতে কিরকম? প্রথমত ভীষণ সৌসাম্যময়-----প্রতিটি ঘর ঠিক একই ডিজাইনে তৈরি
করা। ( মনে হবে কোনও নিখুঁত স্থপতির পরিকল্পনায় গড়া একটা সুসংহত ‘রো হাউস’) কিন্তু
ডিজাইনটা কি? খেয়াল করে দেখবেন, সবগুলো ঘরই একেকটি পঞ্চভুজ। চতুর্ভুজ নয়, ষষ্ঠভুজ
বা অষ্টভুজ নয়, পঞ্চভুজ। তার কারণ কি? জ্যামিতি আর কলনশাস্ত্র থেকে অনায়াসে বের করা
যায় যে পঞ্চভুজের বৈশিষ্ট্য হল যে এতে সবচেয়ে কম মোম খরচ করে সবচেয়ে বেশি আয়তনের
আবাসস্থল তৈরি করা যায়। পাঠক হয়ত ভ্রূ কুঁচকে বলবেনঃ মৌমাছিদের কোনও হাই স্কুল আছে
নাকি? না, নেই। ওরা ঠেকে শিখেছে----প্রকৃতির কাছ থেকে। আমরাও মূলত সেভাবেই শিখি।
এই যে শেখা ব্যাপারটি, তাতেও বুদ্ধিপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় কিঞ্চিৎ, তাই না?
বৃহদাকার
চতুষ্পদী জীবেদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমান কারা? ভালুক? গরিলা? না হাতী? বলা মুশকিল।
একেকজনের একেক মত। তবে বেশির ভাগ পণ্ডিতই মনে করেন বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে হাতীর
তুলনা নেই। একাবার টেলিভিশনে তার ছোটখাট নিদর্শন দেখেছিলাম। এক গবেষক হাতীর বুদ্ধি
পরীক্ষার জন্যে তার জন্যে একটা প্রিয় খাবার ঝুলিয়ে রাখলেন একটা মাঝারি উচ্চতার
গাছের শাখাতে, যাতে সে ওটা তার শুঁড় দিয়েই উদ্ধার করে নিতে পারে। সে ওটা সহজেই
পেরে গেল---খুব একটা বুদ্ধি খরচ করতে হয়নি। তারপর সেই একই খাবারের উচ্চতা একটু
একটু করে বাড়ানো হতে লাগল। হাতী দেখল, এ তো ভারি মজার ব্যাপার, খাবার একই, অথচ
উচ্চতা কেবল বেড়েই যাচ্ছে। যাই হোক, যতক্ষণ পর্যন্ত তার শুঁড়ের ওপর ভরসা করে
পৌঁছানো যায় ততক্ষণ তার কোনও চিন্তা ছিল না। সমস্যা দাঁড়িয়ে গেল যখন সেই গবেষকটি
চালাকি করে ওই খাবারটি এতই ঊঁচুতে নিয়ে গেলেন যে কেবল শুঁড়ের সাহায্যে সে পর্যন্ত
পৌঁছানোর কোন উপায়ই রইল না। এ তো মহা মুশকিল। টেলিভিশনে দেখছিলাম হাতী বেচারার বিমূঢ়
অবস্থা। সে একটা বুদ্ধি খুঁজে যাচ্ছে মনে মনে----কি করা যায়। কি করা যায়!
পুরো জায়গাটা বেশ কবার চক্কর দিয়ে গেল। এমন কিছু চোখে পড়ল না যার সাহায্য নেওয়া
সম্ভব হতে পারত। অবশেষে নজরে পড়ল সেই এলাকার বাইরে, গেট পার হয়ে, একটা উঁচু টুলের মত
জিনিস। আহা, এবার পেয়েছি, মনে মনে হয়ত ভাবল সে। তড়িঘড়ি করে গেট পেরিয়ে শুঁড় দিয়ে
ঠেলে ঠেলে সে টুলটিকে নিয়ে এল সেই গাছটির নিচে ঠিক ওই খাবার বরাবর। তারপর তার
সামনের পা-দুটি সেই টুলের ওপর স্থাপন করে তৈরি করে নিল তার প্রয়োজনীয় মইটুকু। এবার
আর কোন সমস্যাই থাকল না তার স্বাদু আহার্যটি উদ্ধার করে নিতে।
টেলিভিশনের
পর্দার দিকে চেয়ে আমি থ হয়ে রইলাম। মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে তার তফাৎটা কোথায়!
কিছুদিন
আগে দেখলাম আরো এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য----টেলিভিশনেই। থাইল্যাণ্ড না কোথায় ঠিক মনে
নেই। হাতী তার মাহুতের সঙ্গে ফুটবল খেলছে! না, ঠাট্টা নয়, সত্যি সত্যি খেলছে।
মাহুত একটা ফুটবল ছুঁড়ে মারছে তার দিকে, আর হাতী তার শুঁড় দিয়ে ওটাকে মাটিতে পড়তে
না দিয়ে উলটো ছুড়ে মারছে মাহুতের দিকে। দুচারবার দেখলাম সে ফুটবলটাকে শুঁড়ের ওপর
স্থিরভাবে ভর করে রেখেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল যখন দেখলাম সেই ভর-করে-রাখা বলটিকে
পেছেনের দিকে ছুড়ে মাটিতে পড়ার আগেই ওটাকে পেছনের পা দিয়ে লাথি মেরে ঠিক গোলপোস্ট
বরাবর তাক করে। এবং আরো আশ্চর্য, ঠিক গোল হয়ে গেল! এটা হয়ত রোনাল্ডো বা
ম্যারিডোনার মত ওস্তাদ খেলোয়াড়দের পক্ষে সম্ভব, কিন্তু একটা দৈত্যাকার হস্তী?
অনর্থক কি সার্কাসের লোকেরা এত পছন্দ করে হাতীর খেলা দেখাতে।
Elephant playing Soccer
হাতীর
কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না। ওদের যে নিজস্ব ভাষা আছে একটা সেটা গবেষকরা আস্তে
আস্তে বুঝতে শিখছেন। ওদের সমাজব্যবস্থা, ওদের সহমর্মিতা, একাত্মবদ্ধতা, আমাদের
চাইতে খুব একটা নিম্নপর্যায়ের বলে দাবি করা যাবে না। কেউ মারা গেলে যে ধরণের শেষকৃত্য
তারা পালন করে সেটা দেখে অভিভূত হতে হয়। ওরা আমাদেরই মত সন্তানকে যেমন আদর করে,
দরকার হলে শাসনও করে বিস্তর। ওরা রাগ করে, ধমক দেয়, হাসে, মস্করা করে, খেলে।
দক্ষিণ
কোরিয়ার এভারল্যাণ্ড চিড়িয়াখানায় ‘কোশিক’ নামক একটা হাতী আছে যে গোটাপাঁচেক
কোরিয়ান শব্দ উচ্চারণ করতে পারে তার মুখ আর শুঁড়ের সাহায্যে-----‘হ্যালো’, ‘না’,
‘বসুন’, ‘ভালো’ আর ‘শুয়ে পড়ুন’। কিভাবে আয়ত্ত করল সেগুলো? গবেষকদের মতে,
চিড়িয়াখানার পরিবেশে শৈশব থেকেই কোরিয়ানদের সঙ্গে সারাক্ষণ মেলেমেশা করার ফলে সে
ওদের মুখের ভাষা শুনে শুনে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে বাচ্চা হাতীরা যেমন করে তাদের
বাবামায়ের কাছ থেকে নতুন জিনিস শেখে শুনে শুনে আর দেখে দেখে, ঠিক অমনি করে মানুষের
ভাষাও শিখে ফেলেছে। এতই পরিষ্কার তার উচ্চারণ যে কোরিয়ান শ্রোতারা অনায়াসে তার
অর্থ বুঝতে পারে।
তবু
কেন ওদের দাঁতের তৈরি অলঙ্কারের লোভে আমরা, মূর্খ মানুষ, বন্দুক দিয়ে ওদের
নিশ্চিহ্ন করে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছি জানিনা।
আমরা
যে বানরের বংশধর সেখবর এখন আর গোপন নেই, যদিও আমি বলছিনা যে আদম আর হাওয়া, দুজনের
একজনও, বানর ছিলেন। বানরজাতির মাঝে সবচেয়ে চালাকচতুর হল শিম্পাঞ্জী। এদের বিষয়ে
রাজ্যের যত সংবাদ, সবই এক মহিলা গবেষকের সৌজন্যে পাওয়া----জেইন গুডেইল তাঁর নাম।
৭৮ বছর বয়ষ্ক এই অসাধারণ মহিলাটির জন্ম ব্রিটেনে, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পি
এইচ ডি করা প্রাণীবিজ্ঞানী তিনি। ছোটবেলায় তাঁর বাবা একটা বড় আকারের খেলনা
শিম্পাঞ্জী কিনে দিয়েছিলেন তাঁকে। তখন থেকেই শিম্পাঞ্জীদের প্রতি তাঁর বিশেষ
আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে যায়। তারপর বলতে গেলে সারাটি জীবনই কাটিয়েছেন শিম্পাঞ্জীদের
সঙ্গে----প্রধানত আফ্রিকার তাঞ্জানিয়া দেশটির এক সরকার সংরক্ষিত পশু আশ্রমে।
ইতোমধ্যে বিয়েশাদী করে সংসারধর্ম যে পালন করেননি তা নয়। বিয়ে আসলে একবার নয়,
দুবারই করেছিলেন। প্রথমটি টেকেনি, দ্বিতীয়টি তাঞ্জানিয়ারই এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীর
সঙ্গে যার সহায়তায় পশুনিকেতনের প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি
পেয়েছিলেন। আজকে জেইন গুডেইলকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিম্পাঞ্জীবিশারদ বলে গণ্য করা হয়।
এটা তাঁরই আবিষ্কার যে শিম্পাঞ্জীরা প্রস্তরযুগের মানুষদেরই মত পাথর কেটে শক্ত
খাদ্যদ্রব্য ভাঙ্গার মত অস্ত্র তৈরি করতে পারে। এটা তাঁরই আবিষ্কার যে ওদের আচার
আচরণ, চলাফেরা, ভাবভঙ্গী, অনেকটা আমাদেরই মত। ওদের সামাজিক জীবন আমাদের মত মূলত
পরিবারকেন্দ্রিক, তাদের মধ্যে স্বামীস্ত্রীর ভালবাসা আমাদের চাইতে কোন অংশেই কম
নয়। তাদের সন্তানদের তারা যেমন প্রচণ্ডরকম আদর করে, আবার দরকার হলে শক্ত হাতে
শাসনও করে। তাদের দৈনন্দিন জীবন যেন আমাদেরই প্রতিচ্ছবি। দুপুরবেলায় খেয়েদেয়ে একটু
সুখের নিদ্রা, তাতে তাদের কোনও অনীহা নাই। ওরা একে অন্যের মাথার উকুন বেছে দেয়,
একে অন্যের চেহারা নিয়ে হাসিঠাট্টা করে, অথবা ঈর্ষান্বিত হয়। এরা দারুণ
কৌতুকপ্রিয়। সি বি এস’এর 60 Minutes প্রোগ্রামে একবার দেখছিলাম মিস মর্গানের সঙ্গে হাসিমস্করা করার জন্য
একদল শিম্পাঞ্জী তাকে ঘিরে ধরেছে, আর মর্গান বেচারি ভয়ে কুঁচকে আছেন। কিন্তু জেইন
গুডেইল ওদের সঙ্গে এমন সহজভাবে খেলছিলেন যেন উনি তাদেরই একজন খেলার সাথী। সাথে
সাথে এ’ও দেখছিলাম রেগে গেলে তারা কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দেখছিলাম কেমন করে
আমাদেরই মত তারা প্রতিহিংসাপরায়ন হতে পারে তাদের শুত্রুদের প্রতি, বা তাদের
প্রতিপক্ষের প্রতি। জেইন গুডেইলের গবেষণা থেকে আরো এক আশচর্য খবর পেলাম যে
শিম্পাঞ্জীরা নাকি প্রেমেও পড়ে, ঠিক আমাদেরই মত। কারু প্রতি আকৃষ্ট বোধ করলে সে
তার মন জয় করার জন্য কত যে পাঁয়তারা করে। অনেকসময় হয়ত একটা মেয়ে শিম্পাঞ্জীর প্রতি
একাধিক শিম্পাঞ্জীর চোখ লেগেছে। তখন তাদের দুজনের মাঝে লেগে যায় জোর প্রতিযোগিতা---কে
কতটা বীরত্ব দেখাতে পারে সুন্দরীকে ইম্প্রেস করতে। কোনক্রমে যদি সুন্দরী একজনকে
ছেড়ে আরেকজনের সঙ্গে ফস্টিনস্টি শুরু করে দেয় তাহলে আর রক্ষা নেই, বেধে যায়
কুরুক্ষেত্র। হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরার ক্ষমতা কেবল আমাদের নয়, ওদেরও আছে।
এসব
দেখেশুনে এটা সহজেই বিশ্বাস করা যায় যে বানরের ডি এন এ’র সঙ্গে আমাদের ডি এন এ’র
খুব একটা তফাৎ এই----আমাদের ৯৪ শতাংশ তারা।
অনেকের
ধারণা জীবজন্তুরা মানুষের অধম শ্রেনীর প্রাণী হওয়াতে তাদের কোনও বোধ অনুভূতি বলতে
কিছু নেই। তারা শুধু বোবাই নয়, বোকাও। অতএব আমরা যখন ওদের গলায় ছুরি বসাই জবাই
করার জন্যে ওরা ঠিক বোঝে না কি হতে যাচ্ছে না। কষ্ট হয়ত
পায়, কিন্তু কষ্ট বোঝার ক্ষমতা তাদের দেননি সৃষ্টিকর্তা।
না
বন্ধুগন, আমরা সৃষ্টিকর্তার মনের কথা যেমন জানিনা, তাঁর সৃষ্ট জীবেদের কথা জানি
আরো কম। আধুনিক প্রাণীবিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, প্রানীরা বোবা হতে পারে, তবে
বোকা তারা মোটেও নয়। বরং আমরা, বোবা নই বটে, কিন্তু কথা বলি বোকার মত, বেশির ভাগ
সময়। অন্তত জীবজগতের বেলায় আমরা, পৃথিবীর অধিকাংশ মাংসাশী মানুষ, আশ্চর্যরকম
অজ্ঞ এবং অসংবেদনশীল। আমরা বিশ্বাসই করতে চাইনা যে একটা গরু, ছাগল বা উটকে যখন জোরজবরদস্তী
করে মাটিতে শোয়ানো হয় তার গলা কাটার জন্যে, সে সেটা খুব ভাল করেই বোঝে----শোয়ানোর
পরে নয়, তার অনেক আগেই। গরুর চোখের পানি দেখেছেন? না, দেখেননি। কারণ আপনি দেখতে
চাননি, দেখতে চাওয়ার মত কৃপা আপনার মনের ভেতরে নেই----আপনি ওর মাংস খাবেন বলে
মনস্থির করে রেখেছেন, সুতরাং আপনার ছুরিচালনায় বাধা দেবার শক্তি কার। ঠিক আছে,
ছুরি চালাতে চান চালান, সে-অধিকার আপনার আছে। কিন্তু দয়া করে বলবেন না যে
জন্তুগুলো আপনার একবিন্দু করুণার জন্যে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করছে না। বলবেন না যে
একটা খাশির গলায় ছুরি চালাবার সময় অদূরে খুঁটিতে বাঁধা খাশির মা কেঁদে কেঁদে
আল্লার আসর কাঁপিয়ে তুলছে না। হ্যাঁ ভাই, তুলছে, ঠিক আপনি আমি যেমন করে আসর
কাঁপিয়ে তুলি।
হয়ত
বলবেন, ঠিক আছে গৃহপালিত জন্তুরা নাহয় মানুষের দেখাদেখি কিছু বোধ অনুভূতির পরিচয়
দিতে শিখল, কিন্তু বন্য জন্তুদের নিশ্চয়ই কোন আবেগানুভূতি বলে কিছু থাকতে পারে না।
যেমন বাঘ, সিংহ, কুমির, হায়েনা----এরা তো দারুণ হিংস্র প্রাণী। এদের আবার
ভাবানুভূতি কিসের? তাহলে বলি।
এই
গল্পটাও টেলিভিশনেই দেখা। আফ্রিকার এক গভীর বনের ভেতর একটা সিংহ পরিবার----তিনটে
নবজাত শিশুসিংহ, মা, আর শিকারের খোঁজে এদিকসেদিক-ঘুরে-বেড়ানো বাবা। শিশু তিনটি
আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে এবং মায়ের শাসন অগ্রাহ্য করে অচেনা জায়গাতে উঁকিজুঁকি দিতে
শুরু করেছে। ওদের বাসার কাছেই একটা ছোট নদী। সেখানে কুমিরের বাসা। সিংহীর জানা ছিল
সেটা। কিন্তু বাচ্চাগুলোর জানা ছিল না। ওরা একদিন মাকে না বলে তদন্ত করতে বেরিয়েছে----কোথায়
কি আছে দেখা যাক। চোখে পড়ল নদীর পানি। স্বচ্ছ সুন্দর জল, লোভ হল খেতে। তিন ভাইবোন
মিলে পানির ধারে দাঁড়িয়ে চুক চুক করে পানি খেতে শুরু করল। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই
কোত্থেকে এই বিপদ এসে হাজির----এক ঝটকাতে একটা বাচ্চার গায়ে দাঁত বসিয়ে পানির নিচে
টেনে নিতে চাইল। অন্য দুটি বাচ্চা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে গেল মায়ের কাছে। খবর
শুনে মা সিংহটি তৎক্ষণাৎ তীব্রবেগে এসে উপস্থিত সেখানে। বাচ্চাটি প্রায় পানির নিচে
তলিয়ে যাবার উপক্রম, অমনি তার মা কুমিরের মাথা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে এমন জোরে চাপ
দিয়ে ধরল সে কুমিরবাবা তখন নিজের জান নিয়ে বাঁচতে পারলে ভাল। বাচ্চাটিকে উগড়ে ফেলে
কোনরকমে পালাই পালাই করে ছুট দিল পানির নিচে।
সিংহ
তার বাচ্চাকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করে পরম শান্তি। কিন্তু বাচ্চাটির গায়ে কুমিরের
কামড় এতই গভীর হয়ে বসেছিল যে সেই ক্ষত সহজে সারাবার উপায় ছিল না। অনেক রক্তক্ষরণ হওয়াতে বেচারা নিজের পায়ে
হাঁটবারও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। তখন আর কি করা। মা ওর ক্ষুদ্র শরীরটা নিজের
দাঁতের ফাঁকে পুরে রওয়ানা হল বাড়ির দিকে। কিন্তু বাচ্চাটির তখন মরণদশা। ব্যথায়
কোঁকাবে সে-শক্তিটুকুও বোধ হয় ছিল না তার। তারপর একসময়, সেই বুকফাটা মুহূর্তটিতে,
মা বুঝতে পারল যে আর আশা নেই। আমার বেবিকে বনের দেবতাদের কাছেই রেখে যেতে হবে। সে
মুখের বাঁধ শিথিল করে ফেলল। শিশু পড়ে গেল মাটিতে। মা আস্তে আস্তে রওয়ানা হল
উল্টোদিকে। দ্বিধাযুক্ত পদক্ষেপে। শিশু একবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। কুঁ
কুঁ করে ডাকল দুচারবার তার মাকে। যেন বলতে চাইল, মা, আমাকে ছেড়ে যেওনা, ছেড়ে
যেও না দোহাই তোমার। মা তার কান্না শুনে থামল খানিক। একটা নির্বাক,অতলান্ত
মুহূর্ততে এই হিংস্র শ্বাপদ জন্তুটি জীবহৃদয়ের
সমস্ত আবেগ উচ্ছ্বাস মন্থন করে দাঁড়িয়ে থাকল তার মরণোদ্যোত সন্তানের অসহায়
কান্নার শব্দকে না শোনার ভাণ করে। একটি নুহূর্ত মাত্র। তারপর সে আবার যেতে শুরু
করল যেদিকে যাবার জন্য মুখ ফিরিয়েছিল। যেদিকে রয়েছে শবদেহকে রাস্তার ধারে ফেলে
রেখে বাস্তবতার নিষ্ঠুর জগতে চলে যাবার কাফেলা।
তথ্যসূত্রঃ
১।
CBS এর 60 Minutes প্রোগ্রাম
২।
ইনটারনেট
৩।
CBC র Nature of Things প্রোগ্রাম
৪।
রনজিৎ দত্ত, ব্যক্তিগত পত্রালাপ
অটোয়া, ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২
Video Illustration : Shafiul Islam, VCV
মীজান রহমান
No comments:
Post a Comment