Friday, 15 August 2014

নাম দিয়ে কাম কি?

নাজমীন চৌধুরী

' বৃক্ষ তোমার নাম কি? 
- ফলে পরিচয়!'
ছোট বেলায় এটা শুনলেই বেশ একটা ধাঁধায় পড়ে যেতাম। আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা, বরই ও লিচু এবং এরকম আর কিছু ফলের গাছপালা খুব ভাল করে চিনতাম। আর মনে মনে ভাবতাম যে সব গাছপালা অচেনা তাদের ফুল-ফল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে! ছোটবেলার সেই আক্ষরিক জ্ঞানকে আমি তুচ্ছ মনে করি না।  'বৃক্ষ পরিচয় তার ফলে' আর সাধারণ নিয়মে মানুষের পরিচয়টা আসে প্রথমত তার নাম থেকে (পারিবারিক নাম, দেয়া নাম, অর্জিত নাম, উপাধি ... তা সে যে নামই হোক)। 
তাই জন্মের আগেই আমার মা আমার ঠিক করে রেখেছিলেন - আমার নাম হবে ইয়াছমীন। কি জানি উনি কেমন করে জানতেন আমি মেয়ে হোয়ে জন্মাব, সে যুগে তো সনোগ্রাফি ছিল না। ছেলে হোলে কি নাম রাখতেন জানতে চেয়েছি অনেকবার, উত্তর মেলে নি। নামটা ফাঁশ না হয় যাতে বোধ হয়। আলট্রা-সাউন্ড তো দূরের কথা, আমার জন্মলগ্নে উনি ডাক্তার বদ্যিও পান নাই; অজ গাঁয়ে জন্মেছি। তবে আমাকে ভূমিষ্ঠ করতে মা’র সব কষ্টের কথা শুনেছি। বাকি ভাই-বোনদের জন্মবেদনা গুলোকে একসাথে করলেও তা অতটা কষ্ট নয়, উনি বলেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীনিরা বলেছেন। ব্যাপারটা জানলে নিশ্চয় ওভাবে কষ্ট তাঁকে আমি দিতাম না। যাক, নাম প্রসঙ্গে ফিরিঃ আমার নামকরণ নিয়ে মা এত উৎসুক ছিলেন যে উনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওরফে চাচাতো বোনটিকে সেটা জানান। হায়রে কপাল, মা’র চাচাতো বোনের মেয়ে আমাকে টেক্কা দিয়ে উনত্রিশ দিন আগে জন্ম নেয়। মা খুব দুঃখ পেয়েছিলেন আমার নামটা কয়েকটা দিন আগে তার হাত-ছাড়া হবার কারণে। তা আর কি করা। পরে খুঁজে খুঁজে, বাকি ভাই-বোন দের নামের সাথে মিল রেখে উনি আমার ডাক নামটা রেখেছেন।
কতগুলি বছর কাটল আমার সেই নামে। কারও আপত্তি শুনিনি তা নিয়ে। ঘর ছাড়া হতে হোল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। হলে বসবাসের শুরু। কি সেই আনন্দ! একে একে অনেক বন্ধু পেয়ে গেলাম। নাম জানতে সবাই আমাকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে, “নাজনীন?” আমি আবার বলি, “নাজমীন!” কেউ এ নাম কখনো শোনে নি আগে। আমার তাতে কিছু যায়-আসে না। আমি শুধু আমার নামটা কয়েকবার বলি যাতে তারা ঠিক মত শুনতে পায়, সেই আশায়। তিন দিন না যেতেই এক বন্ধু বলল, “শোন, আজ থেকে তোর নাম হলো নাজু। কেউ তোকে নাম জানতে চাইলে বলবি, নাজু!” আমি তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলি, “কেন?” তার খুব সোজা উত্তর, নাজু শুনতে আধুনিক। খুশী হলাম আধুনিক নাম পেয়ে। তারপর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই  আমার গেঁয়ো নামটা গেলাম ভুলে। আধুনিক ত হতেই হয়। পিয়ার-প্রেসার। ক’সপ্তাহের ভেতর বিশ্ববিদ্যালয়ে যথারীতি গণ্ডগোল!  হল ভ্যাকেট। বাড়ি গেলাম। সপ্তাহ ফিরতেই চিঠি। বন্ধুর চিঠি। মা তো পিয়ন চাচাকে বললেন, “এটা আমাদের চিঠি না গো। এই নামে এই বাড়িতে কেউ নেই”। ওদের কথা শুনে একটু এগুলাম টিনের ফটকের দিকে। কার চিঠি মা? আমাদের না, মায়ের উত্তর। চাচাকে বললাম, একটু দেখি। উনি চিঠিটা আমকে ধরিয়ে দিতেই আমি বলে উঠি “সেকি?” এটা আমার চিঠি মা! আমার বান্ধবী লিখেছে, রাজবাড়ি থেকে। পিয়ন চাচা আমার হাতে চিঠিটা দিয়ে কেটে পড়লেন। বেচারা না জানি কতটা ভেবেছেন আমাকে নিয়ে সেদিন। 
মাকে আদ্য-পান্ত্য বুঝিয়ে বলি আমার নামের বিবর্তন প্রসঙ্গে। আমার মাও বেশ আধুনিক মনা। উনি ব্যাপারটা খুব সুন্দর দৃষ্টিতে নিলেন। আর নিবেনই বা কেনো? তার পছন্দের নামটা তো  দিতে পারেন নি। মায়ের চিন্তা-ধারায় যুক্তি ছিল এই যে, বাড়িতে যখন উনারা নায়র যাবেন, তাঁদের দুটো বালিকার একই নাম ভালো ত শোনাবেই না, বরং মানুষ ওদের বয়সটা জেনে ফেললে আমার মাকে কপি-ক্যাট মনে করবেন। তাতে মায়ের আপত্তি ছিল প্রবল। বিধায় আমাকে অন্য আর এক নাম দিতে হোল তাঁর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আমার নামটা ত শুধু ছাঁটলই না একটু জোড়াতালি দিয়ে বেশ আধুনিক করে ফেললো। আমার নাম রাতারাতি বদলে যাওয়ায় অনেক আত্মীয়–স্বজন এবং প্রতিবেশীরা বললেন, “ঢং দেখোনা! যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কেউ পড়ে না!”
তথাস্তু! নাম বদলে গেল বলে তো আর আত্মীয় হারা হয়ে গেলাম না। দুই পক্ষই থাকা চাই।
আমার নাম নিয়ে বিড়ম্বনার শুরু মাত্র। বিয়ের পর অর্ধাঙ্গও দিলো নামের অর্ধেকটা কেটে, তাঁর মত করে। সে কারও টাই মানলো না। বলে কোন ‘মীন’ জিনিষই তার পছন্দ না। আমি দেখি বিপদ সংকেত। এখন কি করা! উনি বলেন আমার নাম হোল “নাজ”। আমি বলি নাজুতে কোন মীননেস নেই। সে বলে, “ওটা বন্ধুদের দেয়া নাম, তাতে কোন বিশেষত্ব নেই। অনেকটা ফ্যেক  নামের মত!” বিপদের উপর বিপদ, আমার নাম নিয়ে বিপদ। সেই খালা সম্পর্কীয় আত্মীয়ার উপর খুব রাগ হোল। তার মেয়ের উপরও। ইয়াছমীন খুব মিষ্টি একটা নাম, আধুনিকও। কেউ তা বদলাতে চাইত না নিশ্চয়!    
বিয়ের পর দেশ ত্যাগ। বিদেশে পা দিতেই টনক নড়ে গেল। এখন থেকে সার্টিফিকেটের নাম চলবে। কিন্তু সার্টিফিকেটে চোখ বুলিয়েই মাথায় হাত! কোথাও আমার মা, বন্ধু ও অর্ধাঙ্গের দেয়া নাম নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ! মনে মনে নিজের নাম মুখস্ত করলাম যাতে ফস করে আবার উল্টাপাল্টা নাম না বলে বসি। বিভিন্ন নাম বললে টেররিস্টের দলে পড়ার বিপুল সম্ভাবনা।
ডাক্তারের ডাক পড়ল রুটিন চেক-আপের। তোমাদের ফ্যামিলি নাম আলাদা কেন? প্রশ্ন শুনে একটু সময় নিয়ে ভাবলাম। তারপর সাধ্যমত কালচার তুলে আনলাম।  বললাম, এটা আমাদের দেশে ব্যপার না। একটু জোকও করলাম। দেখো আবার যদি অন্য কাউকে বিয়ে করি, বার বার নাম বদলানো --- ইত্যাদি ইত্যাদি। ডাক্তার সাহেব কতটা তুষ্ট হয়েছিলেন জানার চেষ্টা করি নি। মনে মনে ভেবেছি, হ্যু কেয়ারস? হোয়াট-এভার!
শিখতে না শিখতেই ওদেশের পাট শেষ।
এবারে শুরু উত্তর আমেরিকায়।
এদেশে পাড়ি দিতে দিতে ভাবি আহা নতুন নতুন আবার কত কিছু শিখতে হবে রে! নিজের নাম ত দিব্যি মুখস্ত এখন। এরই ভেতর সংসারে লোক সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে কনফিউশনও। সন্তানদের বন্ধুরা আমাকে দুটো নতুন নামে ডাকে এখন। অনেক যোগ–বিয়োগ করে বাচ্চাদের নাম রেখেছিলাম। দুজনের নামই শুধু দুটো শব্দের বিন্যাসে রাখা। ফলে দেখা গেল এদের কোন মিডল নেম নেই। স্কুলের বন্ধুরা তো সেসবের বিন্দু মাত্রও জানে না। ওদের এটা জানার প্রয়োজনই বা কি? আমি ওদের ডাকে এখন দুটো নামেই সাড়া দেই। আর আমার সন্তানদের মিষ্টি হাসি উপভোগ করি। এরা বুঝে গেছে আমার নামে অনেক ভাঁজ।
এরা এটুকুও বুঝে গেছে যে, অভিবাসিদের নাম শুনলেই তাদের আদিবাস আঁচ করা যায়, অনেকটা। 'সিভিক্স এন্ড ক্যারিয়ারস প্রোজেক্ট' এ কাজ করতে গিয়ে এরা জেনেছে বেসিভাগ চাইনিজ বংশোদ্ভূতরা কেন ইংরেজি নাম বেছে নেয় এখানে। ওরা কেন ইংরেজি নামের পাশাপাশি নিজের জন্মগত নামটাও রাখে। ওদেরকে নাম জিজ্ঞেস করলে বলে আমার ইংলিশ নাম ‘এই’ আর চাইনিজ নাম ‘ওটা’। এদের নাম এডপশন নিয়ে লেখার অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তা  আমার এত্তটুকুও নেই। সুতরাং বিপদ এড়াচ্ছি। তবে আমি চাইনিজ বংশোদ্ভূত অনেক ছোট ছোট বাচ্চাদের সান্নিধ্যে এসেছি। এদের অনেকেরই ডাক নাম আছে। নামগুলো শুনতে বেশ মিষ্টি এবং তাতে রিদমও আছে। অনেকটা এরকমঃ 'টিয়ানটিয়ান', 'ইয়াইয়া' এবং আরও অনেক নাম। সঙ্গত কারণে আমরা যেমন ছোটোবেলায় শুধু সার্টিফিকেটের নামটা খাতায় লিখতাম, এরাও তাই করে। পুবের কালচার?
কাজের মাধ্যমে এই বাচ্চাদের সাথে আমার যোগাযোগ। আমার কর্ম ক্ষেত্রে আমি সংখ্যায়, কালচারে ও রঙ্গের দিক থেকে একা। তবে তা অনুভব করি না, অত সময় কই? অবশ্য উপলব্ধি করি মাঝে মধ্যে। একটু আলাদা ধরনের নামধারী কেউ এলেই আমার কাছে কাগজ পৌঁছে যায় খুব তাড়াতাড়ি, “এই নামটা কিভাবে উচ্চারণ করতে হয়? আমি কি এই নামটা ঠিকমতো বলছি?” মাঝে মাঝে রাগ হয় আমার। আরে বাবা ডেকেই দেখনা, সে ব্যক্তি নিজেই তোমাকে শিখিয়ে দেবে তাঁর নাম! এটা বললে ওরা আমাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে। বলে, “না না বল কি? ফার্স্ট ইম্প্রেশন, নাম টা ঠিক মত বলা চাই। প্যারেন্টদের সাথে একটা ট্রাস্ট-ওয়ারদি রিলেশন বিল্ড করতে হবে”। কি জানি বাপু, মনে হয় পিয়ার-প্রেসার। ইনস্টিটিউশন এর মান ঠিক রাখার যুক্তি। তবে তাই হোক। আমিও চেষ্টা করি নাম গুলো ঠিকমতো উচ্চারণ করে দিতে। তারপর মনে মনে বলি, যাও আমার ঘরে গিয়ে দেখো, অর্ধাঙ্গ কয়বার ‘র’ ও ‘ড়’ শুধরে দিচ্ছে আমার। আর সন্তানেরা ইংরেজি। আর তোমরা কি না নামের উচ্চারণ নিয়ে দিশেহারা! যেন 'কাম নাই তাই ধান ঝাড়!'  
একদিন ব্যক্তিগত পাওনা ছুটিতে সময় কাটাচ্ছি। হঠাৎ ফোন এলো কাজ থেকে। মনে করলাম, নিশ্চয় কোন কিছু ওলটপালট করে রেখে এসেছি। বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘হোয়াট নাউ?” উত্তর এলো, “তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।" একটা নামের বানান জানিয়ে বলল, “এটা কিভাবে উচ্চারণ করো? ছ্যেবর?" আমি বলি, সাবীড়! তারপর দ্বিতীয় নামের বানান দিয়ে, "এটা?" আমার তীক্ষ্ণ উত্তর, “এটা স্প্যানিশ নাম! আলেহান্দ্রকে জিজ্ঞেস করো, আমার উচ্চারণ ঠিক হবে না!“

ক্যামব্রিজ, ওন্টারিও, ক্যানাডা
রচনাকাল: ২০১৪ অগাস্ট ১৫
প্রকাশকাল: ২০১৪ অগাস্ট ১৫
শেষ সম্পাদনা: ২০১৪ অগাস্ট ১৯


Garden Composition: SNC. Photo Credit: VCV.

No comments:

Post a Comment