মীজান রহমান
ছোটবেলায় বাবার কাছে শিখেছিলামঃ
মর্নিং সোজ দ্য ডে। সকালেই বিকেলের ইঙ্গিত। কথাটার অর্থ যে আক্ষরিক নয় সেটা আমরা সবাই বুঝতাম। প্রথম জীবনে যে
বীজ বপন করবে সে-বীজেরই ফসল তুমি ভোগ করবে সারাজীবন। দশ বছরের বাচ্চাও
সেটা বোঝে।
কিন্তু কাল সকালে অটোয়ার আকাশে সেই
অমূল্য বাণীটির আক্ষরিক রূপের আত্মপ্রকাশ লক্ষ করা গেল।
আধোঘুম আধোজাগরণে জানালার পর্দা খুলে
দেখি কিছুই দেখি না। ডিসেম্বরের নীরব অন্ধকার বাইরে দাঁড়ানো। কুয়াশা নয়, তবু
কুয়াশার মত করে চারদিক আচ্ছন্ন করে থাকা একপ্রকার বোবা বিষণ্ণতা।
লক্ষ্মণ ভালো নয়, মন বলল।
অথচ আজকেই আমার বিমানভ্রমণের দিন। বিকেল দুটোয় ফ্লাইট
ছাড়ার কথা ওয়াশিংটনের পথে। ওয়াশিংটন থেকে লাস ভেগাসে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা। ছেলে থাকবে এয়ারপোর্টে,
তারপর বাসায় গিয়ে খেয়েদেয়ে লম্বা ঘুম। ভাবনাটি আরাম দেয় মনে।
সমস্যার সূচনা ওয়াশিংটনে নয়, লাসভেগাসে
তো একেবারেই নয়, সূচনা আমার নিজের শহরেই। বলছি।
থমথমে আকাশের চেহারা দেখে সুবিধার মনে
হল না----এ-আকাশের সঙ্গে আমার দীর্ঘ পরিচয়। পরিষ্কার ঝড়ের লক্ষ্মণ। তুষারপাত হবে----ওয়েদারম্যান
বলেও ছিলেন সেটা। কখন হবে সেটাই হল প্রশ্ন। বিকেলে হলে তো বিপদ। এ-সময়গুলোতেই আমার
স্বদেশী ভাইবোনেরা আল্লার নাম উচ্চারণ করেন বারবার। আমি নাদান ব্যক্তি----আল্লারসূলের
মর্জিমেজাজের সঙ্গে অটোয়ার আবহাওয়ার কি সম্পর্ক
থাকতে পারে সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। আমার বিশ্বাস কার্যকারণ
সম্পর্কের ওপর, দৈবশক্তির কাল্পনিক হস্তক্ষেপের ওপর নয়। আমার কথা, যা হবার
হবে। ঝড় না হলে ভালো, হলে কারও কিছু করার নেই। পৃথিবীর তাৎক্ষনিক মৃত্যু ঘটবে না সেকারণে।
বারোটা বাজতে না বাজতেই আমি ট্যাক্সিতে
করে বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত। প্যান্টকোট পরা ফিটফাট ভদ্রলোক। চাইনিজ লণ্ড্রিতে
নগদ বিশ ডলার খরচ করে ধোয়ানো পোশাক। গ্রামের মেয়েরা যেমন মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বামীর সঙ্গে মিলিত
হওয়ার উদ্দেশ্যে লাল সায়া আর চুমকিওয়ালা হালকা শিফনের শাড়ি পরে প্লেনে ওঠে। মনে মনে হাসলাম। সারা গায়ে বয়সের
ছাপ পরিষ্কার, অথচ পোশাকে অনুর্ধ পঞ্চাশের ভদ্রলোক। ছোটবেলার সেই বালকটির
ছোটখাটো স্বভাবগুলো এখনো পুরোপুরি যায়নি।
বয়সের একটা বড় সুবিধা আছে। যেখানে যাই সেখানেই
‘স্যার’ সম্বোধন পাই----যা আমার ক্লাসের ছাত্ররাও বলত না সবসময়। কেউ বলত ডঃ রহমান,
কেউ মিঃ রহমান, আবার কেউবা সোজা নাম ধরে ডাকা। শিক্ষককে নাম ধরে
ডাকার অভ্যাসটা ক্যানাডায় যতনা তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিবেশী দেশ আমেরিকাতে। সেখানে অনেক জায়গায়
বাবামাকেও নাম ধরে ডাকা হয়, এবং আরো আশ্চর্যের ব্যাপার যে বাবামায়েরা সেটা অপছন্দ করা
দূরে থাক, সেটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
যা বলছিলাম। ধোপদুরস্ত পোশাকপরা প্রবীণ ‘স্যার’ এবার চেকইন কাউন্টারে উপস্থিত। আগেকার দিনে প্রথমেই দেখাতে হত টিকিট। এখন কেউ টিকিট দেখতে চায় না, আসলে টিকিট
বলে কিছু নেইও এযুগে, এখন তারা আপনার চেহারা দেখার আগে আপনার পাসপোর্ট দেখতে চায়। আপনি যে আপনি, সেটা আপনি যত চেঁচিয়েই
বলুন না কেন, পাসপোর্টের ছবিখানি সেমত সাক্ষী না দিলে আপনার অভীষ্ট গন্তব্য যা’ই হোক,
অনভীষ্ট গন্তব্য অন্যত্র হবারই সমূহ সম্ভাবনা। এই পাসপোর্ট এক মাল্টিপার্পাস দলিল। পাসপোর্টের নম্বরটি ওদের কম্পিউটারের
পেটে ঢোকাতে পারলে আপনার নাড়িনক্ষত্রের সব খবর সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে-----আপনার মায়ের
মেইডেন নাম, আপনার জন্মস্থান কোনকিছুই বাদ থাকবে না। কোনক্রমে যদি আপনার মায়ের নাম ভুলে যাচ্ছেন
বলে সন্দেহ হয়, সরকারি অফিসে যোগাযোগ করুন। উপকার হতে পারে। (অবশ্য অপকারও যে একেবারে হতে পারে না সেরকম কোনও গ্যারান্টি
কেউ দেবে না আজকাল)।
পাসপোর্ট পরীক্ষাটি কৃতিত্বের সঙ্গে উৎরাতে পারলে
দ্বিতীয় দফায় আপনার মাল পরীক্ষা। ক’টা সুটকেস আপনার? একটা হলে আটাশ ডলার উনপঞ্চাশ সেন্ট, দুটোতে
তার দ্বিগুন, তিনটেতে একটু ডিসকাউন্ট পাবেন, ইত্যাদি। আগেকার দিনে, অর্থাৎ যখন আধুনিক সভ্যতা
বলে কোনকিছু ছিল না ( মানে এই দশ বছর আগেও), তখন মালের জন্য আলাদা মাল খসানোর ব্যাপারটা
কল্পনা করারই ক্ষমতা ছিল না কারুর। যাত্রী আর মাল কি দুটি পৃথক ব্যক্তি যে তাদের জন্যে আলাদা
টিকিট লাগবে? মানলাম ঠিক টিকিট নয় ওটা, কিন্তু টাকাটা তো একই পকেট থেকে আসছে। তাহলে তফাৎটা কোথায়?
ভারি সুটকেসখানি দুহাতে জড়িয়ে বহু কষ্টে ওজনের যন্ত্রে তুলে দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড
জোরে নিঃশ্বাস নিতে হল। আজকাল দম হারিয়ে ফেলি একটুতেই----বেচারি হৃদপিণ্ড আর কত পারে
বলুন। বয়সের ওজনটা দেখেছেন?
অবশ্য সুটকেসের ওজন সবটা আমার ব্যক্তিগত মালের জন্য নয়---এবয়সে কতই বা মাল ব্যবহার
করব আমি। দুটো লুঙ্গি, ক’টা গেঞ্জি শার্ট, একটা সস্তা ট্রাউজার, একগাদা ওষুধ, আর যেখানে
যেখানে যাচ্ছি তাদের সবার হাতেই নামকা ওয়াস্তে কিছু দেবার জন্যে ওয়ালমার্টের সেল থেকে
কেনা ডার্ট চিপ দ্রব্যাদি। আসলে আজকালকার ওই চাকাওয়ালা ফ্যান্সী সুটকেসের বড় ওজনটা তো
স্বয়ং সুটকেসেরই। খালি বাক্সটা যখন বেজমেন্ট থেকে তুলে আনি তখন একটু জিরিয়ে নিতে হয়, নতুবা নির্ঘাৎ ৯১১ ডাকার প্রয়োজন দাঁড়িয়ে যাবে।
পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে, প্রবাদটা ছিল বলে রক্ষে। আজকাল ঘন ঘনই ব্যবহার করতে হয়। (অবশ্য এটাও ঠিক যে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে বোঝা যাবে প্রবাদটিতে
একটা অসঙ্গতি আছে। একদিকে মোগলাই খানা খাবার জন্যে আমরা জিহ্বাটি সবসময়ই ‘প্রস্তুত’ অবস্থাতে রেখে
দিই, অপরদিকে মোগলদের সঙ্গে খানা খেতে হবে বলে কপাল চাপড়াই!) আমি বিনা বাক্যে পকেট
থেকে নগদ টাকা বের করে অনতিরূপসী মহিলাটির কাছে বাড়িয়ে দিই। মহিলাটি সবিনয়ে একটু হাসি দিয়ে বললেনঃ
সরি স্যার। আমরা ক্যাশে ব্যবসা করি না। ক্রেডিট কার্ড ওনলি! শোন কথা! যাই কোথায়। বাঙালি দোকান থেকে হালাল মাংস কিনতে গেলে
বলে ক্যাশ ওনলি। এয়ারলাইনের চেকইন কাউন্টারে গেলে শুনি নন-ক্যাশ ওনলি। লজিকটা বুঝিয়ে দিন আমাকে। অতএব পকেট থেকে কার্ড বের করে দিতে হল
মহিলার হাতে।
আগেকার দিনে চেকইন কাউন্টারে মাল তুলে দিয়েই খালাশ। এখন তার উল্টো---ওটা শুরুমাত্র। সুটকেসটাকে গড়াতে গড়াতে, অবাধ্য বালককে
কান ধরে টেনে নেওয়ার মত করে, নিয়ে যাই আমার যাত্রার দুনম্বর চেক-পয়েন্টে----মালের আভ্যন্তরীণ
জিনিসপত্রের এক্সরে পরীক্ষার জন্যে। ভাগ্যিস পোশাকপরিচ্ছদের কখনো ক্যান্সার হয় না, নইলে এতদিনে
আমার দীনহীন বাক্সটি মরে ভূত হয়ে যেত----বেচারাকে কত হাজারবার যে ওই যন্ত্রের ভেতর
দিয়ে পার হতে হয়েছে। মালের পরীক্ষা শেষ হলে আমার পরীক্ষা। প্রথমে উলঙ্গ হও। ঠিক আছে, সেটা নাহয় কথার কথা মাত্র, কিন্তু
শার্ট কোট টুপি বেল্ট জুতো ঘড়ি পয়সা ওয়ালেট সবই তো জমা দিতে হচ্ছে আপনাকে, টুথব্রাশ-লুঙ্গি-শেভিং
কিট-দাঁত খিলুনি (আমার দাঁত না থাকলেও খিলুনি রাখি সঙ্গে প্রেস্টিজের জন্যে), এগুলোর
জন্যে হাতে-বয়ে-নেয়া যায় এমন একটা ক্যারি-অন ব্যাগ, সেটাও ‘জ্যষ্ঠভ্রাতা’র সন্ধানী
দৃষ্টির সম্মুখে দাখিল করতে হয়। ইতোমধ্যে আপনিও অনুরূপ একটি সন্ধানী কক্ষের মধ্য দিয়ে পার
হবেন। মানে হতে হবে। কোনক্রমে যদি সেই যন্ত্রমহাশয় আপনার ওপর একটু রুষ্ট হয়ে ওঠেন, অর্থাৎ পুলিশের
গাড়ির মত কর্কশ আওয়াজ করতে শুরু করেন, তাহলেই সেরেছে। তারা আপনাকে ঢোকাবে আরেকটি কক্ষে, যেখানে
আপনি স্বেচ্ছায় উলঙ্গ না হলেও যন্ত্র আপনাকে উলঙ্গ করবে, আপনার নাড়িভূড়ি সব তন্ন তন্ন
করে পরীক্ষা করবে। আপত্তিকর কিছু না পেলে তবেই আপনার মুক্তি। অবশেষে, অতিশয় অবসন্ন দেহে, আপনি জুতোজোড়া
পায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে (নাকি জুতোর ভেতরে পা ঢুকিয়ে, ইতোমধ্যে দুয়ের পার্থক্যটাও মাথায়
ঢুকতে চায় না, এতই ক্লান্ত), আস্তে আস্তে রওয়ানা হন শেষ চেকপয়েন্টের দিকে----খোদ ইমিগ্রেশন,
কথ্য ভাষায় যাকে বলা হয় বাঘের খাঁচা, অন্তত আরবি নামধারি যাত্রীদের জন্যে। আমি আরব নই, কিন্তু নামখানা আরবি (এ-বিড়ম্বনার
কোনও সদুত্তর আমি আজ পর্যন্ত পেলাম না কোথাও), সুতরাং শ্যামচাচার শ্যনদৃষ্টি (কৃপাদৃষ্টিও
বলতে পারেন ইচ্ছে হলে) যে আমার ওপর আপতিত হবেই তাতে অবাক হবার কি আছে। আপনি দুরুদুরু বুকে সেই খাঁচাতে প্রবেশ
করলেন। বেআইনি কিছু না করেও
বুথে বসা গুমরোমুখো বড়কর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার হার্টরেট শঙ্কাজনকভাবে উর্ধমুখী
হতে বাধ্য----মনে হবে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা বসে আছেন
সেখানে। আমি সাহস করে দাঁড়ালাম
একটা বুথে। কোথায় যাচ্ছেন? লাস ভেগাস। কেন? আমার ছেলে থাকে সেখানে। (আসলে বলা উচিত ছিল, হলিউডের নায়কদের অনুকরণে, ইট ইজ নান
অব ইওর বিজিনেস, কিন্তু আমি যে নায়ক নই, হলিউড দূরে থাক, স্বগৃহেও না)। কদ্দিন থাকার ইচ্ছা? মোট পাঁচ সপ্তাহ। ইতোমধ্যে তাঁর ডেস্কের কম্পিইউটার তুমুল
বেগে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছে আমি কে, কোথাকার লোক, সিকিউরিটি রিস্কের আওতায় পড়ি কিনা,
ইত্যাদি যাবতীয় ‘জরুরি’ বিষয়াদি। শেষে প্রবেশাধিকারের সীল পাবার পর আমি দম নিতে শুরু করি,
হৃদপিণ্ডটা গলা থেকে নেমে যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করে। হাতের বোঁচকাটা এবার কাঁধে চড়িয়ে ধীরগতিতে
অগ্রসর হই ফ্লাইটের নির্ধারিত গেটের পথে, যেখানে আরো দেড় ঘন্টা বসে থাকতে হবে।
আধুনিক বিমানভ্রমণ বয়স্ক লোকেদের জন্যে নিরাপদ নয়। বিশেষ করে যাদের হৃদপিণ্ডের ইতিহাস দীর্ঘ
মহাকাব্যের মত। আমার যেমন।
অটোয়া থেকে আমার ফ্লাইট গেট থেকে বের হয়ে ওয়াশিংটনের
পথে রওয়ানা হয়ে গেল একেবারে কাঁটায় কাঁটায়। ভাবলাম নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার আছে কোথাও। ঠিক ঘড়ি ধরে প্লেন ছাড়া খুব সুবিধার মনে
হয় না। বড় জরিমানা দিতে হবে
পরে। বর্তমান যুগের ডিজিটালতাড়িত
বানিজ্যিক আবহাওয়াতে ক্রেতার সুখসুবিধার প্রতি বিক্রেতার বিশেষ মনোযোগ আসলে বিশেষরকম
সন্দেহজনক। মনে মনে তৈরি হয়ে থাকলাম অশনি সঙ্কেতের জন্যে।
অশনির প্রথম সংকেতটি পেলাম ওয়াশিংটনে নামার পরপরই। কথা ছিল আমার জন্যে হুইলচেয়ার প্রস্তুত
থাকবে গেটে----রাজা সেভাবেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল এয়ারলাইনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। নেমে দেখি, হুইলচেয়ার আছে বেশ কটা’ই,
তবে কোনটাই আমার জন্যে নয়। না, পঙ্গু আমি নই, মানে এখনো হইনি, তবে হুইলচেয়ার চাওয়ার
উদ্দেশ্য, এক গেট থেকে আরেক গেট পর্যন্ত সেই যে লম্বা হাঁটাপথ, সেটা থেকে কিঞ্চিৎ রেহাই
পাওয়া। কি আর করি, হুইলচেয়ার
নেই বলে তো যাত্রা বন্ধ করতে পারিনা। সদ্য অসুখ-থেকে-সেরে-ওঠা দুর্বল শরীরে কোনরকমে একপা দুপা
করে যেতে যেতে গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছলাম।
এবার বলি দ্বিতীয় সংকেতের কথা। ওয়াশিংটন থেকে লাস ভেগাসের ফ্লাইটখানাও,
অলৌকিকভাবে, ঠিক সময়মত রওয়ানা হয়ে গেল। রওয়ানা হল মানে আকাশে উঠে যাওয়া নয়, গেট থেকে বের হওয়া। সাধারণত গেট থেকে আকাশ খুব একটা দূ্রের
পথ নয়, কিন্তু আমার ফ্লাইটের বেলায় ‘দূর’টি আস্তে আস্তে লজিকের সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগল। পুরো এক ঘন্টা বিশ মিনিট প্লেনের ভেতরে
বসে থাকলাম। কেন থাকলাম, কি কারণে প্লেন রানওয়েতে যেতে পারছে না সেসব খুঁটিনাটি তথ্যদ্বারা
যাত্রীদের বিরক্ত করার দায়িত্ব হয়ত এয়ারলাইন ভদ্রতা করেই নিতে চায়নি। মাঝে মাঝে হাজার ডেসিবেল যান্ত্রিক হুঙ্কারের
মধ্যে সুমধুর নারীকন্ঠের একটা দুটো ঘোষণা যে কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি তা নয়, তবে আমার
দুর্বল কর্ণেন্দ্রিয় সেই বাণীগুলো সঠিক অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। বয়স যখন নিষ্ঠুর খেলা খেলতে শুরু করে
দেয় নিজেরই সঙ্গে তখন বুঝবেন কি বলতে চাইছি আমি। অন্যেরা হয়ত ঠিকই শুনছিল, কেবল আমিই পারছিলাম
না।
যাই হোক, একটা সময় দেখি, অনেকটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে,
যে আমাদের প্লেনটা এখন রানওয়েতে নয়, আকাশে। বাব্বা, ছেলের সঙ্গে দেখা হচ্ছে তাহলে
আজকে। মনটা মুহূর্তের মধ্যে
ফুরফুরে ভাবের ভেতরে ফিরে এল। বড্ড ক্ষিধে পেয়েছিল ইতোমধ্যে। এয়ারপোর্টে তো আর খাওয়ার সুযোগ ছিল না
(থাকবে কি করে? বোঁচকাপত্র নিয়ে এক টারমিনাল থেকে আরেক টারমিনালে দৌড়ুব না কোথাও একটু
আরাম করে বসে একটা কিছু মুখে দেব। তাছাড়া, ভাবলাম, প্লেনে তো খাবার দেবেই। জানি, তারা খাবার দেয় না আজকাল, যাত্রীদেরই
কিনে খেতে হয়।)। সুতরাং প্রায় পুরো ন’ ঘন্টা পেটে কিছু
ঢোকেনি।
প্লেন উর্ধাকাশে সগৌরবে উড্ডীন, এক ঘন্টারও বেশি হয়ে গেল। সীট বেল্ট সাইন মুছে গেছে। যাত্রীরা দাঁড়িয়ে গামোড়া দিচ্ছেন এক আধজন। এই সময়টাতেই সাধারণত টুংটাং আওয়াজ শোনা
যায়, খাবারের ট্রলি নিয়ে বিমানবালারা যখন আইলে মুখদর্শন দেন। (আগেকার দিনে টুংটাং শব্দটি আরো মধুর মনে হত, কারণ শব্দটা
প্রধানত ছিল খাঁটি চায়নানির্মিত থালাবাসন আর কাঁটাচামচের। এযুগে ‘বোন চায়না’র কাটলারি দেখতে চাইলে
ডিনার টেবিলের দিকে চেয়ে লাভ নেই, গাড়ি করে মিউজিয়ামে যেতে হবে, নতুবা কোনও অশীতিপর
বিত্তবান বিধবার সখের বাড়িতে)। কিন্তু আমার কানে কোনও ট্রলির শব্দ এল না, এল গুটিকয় কাশি
আর হাঁচির শব্দ। খালিপেটে নিজের কাশি অত্যন্ত বিরক্তিকর, অন্যের কাশি একেবারে অসহ্য। ঘাড় ফিরিয়ে পেছন তাকিয়ে দেখি প্লেন প্রায়
খালি----যাত্রীরা চাইলে লম্বালম্বি টান হয়ে শুয়েবসে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমুতে পারবে পুরো
ফ্লাইট। মনের ভেতর একটা প্রশ্ন
খোঁচাতে লাগল----আচ্ছা, ফ্লাইট যদি খালিই থাকবে তাহলে তারা এমন ঘটা করে ‘ওয়েটিং লিস্ট’
ঘোষণা করে যাচ্ছিল কেন বারবার! হঠাৎ মনে পড়লঃ ও তাইতো। মেশিনটা যে প্রোগ্রাম করে রাখা আগে থেকে
সেটা কাউকে বন্ধ করতে হবে তো। এবং তার জন্যে কাউকে-না-কাউকে নিজের মাথা ব্যবহার করতে হবে
যৎসামান্য, যা বর্তমান যুগে খুব একটা প্রচলিত নয়, দরকারও পড়ে না। যাই হোক খালি প্লেন দেখে মনটা একেবারেই
দমে গেল। আজকাল খালি প্লেন মানেই তো খালি পেট। যাত্রী না থাকলে অনর্থক মজুরি দিয়ে খাবার
এনে লাভ কি----একে তো মজুরি, ইউনিয়ন রেটে, তার ওপর ক্রেতা নাই। ভাবলাম অনেকদিনের কামাই করা রোজার দিনগুলি
আজকে নাহয় কাজা করে ফেলি। একদিকে পেটের জ্বালা কমবে, আরেকদিকে পরকালের একটু ফায়দা হলে
হতেও পারে।
অবাক, অবাক! কিছুক্ষণ পর এক বিমানবালা এলেন ট্রেতে করে কিছু পানীয় সহকারে। কি আছে ওতে, কৌতূহল সামলাতে পারিনা। ওয়াটার, স্যার (আবার সেই স্যার, সেই পীড়াদায়ক
পোশাকি স্যার!), অর সফ্ট্ড্রিঙ্কস। কমলার রস আছে? ট্রের রসদ পরীক্ষা করে বললঃ না স্যার, কোক
পেপসি আর জিঞ্জারেল ছাড়া আপাতত আর কিছু নেই। মনে মনে একটা চোশত গাল আর মুখে মধুর হাসি
একত্র করে বললামঃ ঠিক আছে, জিঞ্জারেলই চলবে। জিঞ্জারেলে চুমুক দিতে দিতে এমন একটা
ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেললাম মনে যে পানীয় থেকে মূল আহারের দূরত্ব সাধারণত খুব বেশি
নয় পশ্চিম কালচারে। অতএব এক্ষুনি আশা হারানোর কোন কারণ নেই। সফ্ট্ড্রিঙ্ক আগে খুব খেতাম, চিনির
কারণে, আজকাল খাইনা সেই চিনিরই কারণে। আজ খেলাম এই ভেবে যে আসল খাবার না আসা পর্যন্ত পেটটাকে কোনরকমে
মানিয়ে রাখা যাবে। শত হলেও চিনি মানেই তো এনার্জি!
কিন্তু তারপর সব চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই। যেন সবাই সাইটসিইং করতে বেরিয়েছে আমাকে
ছাড়াই। কিন্তু তাই বা কেমন
করে হয়। এ তো ঢাকা-চিটাগঙ্গের
বাস নয় যে পথে থামবে আহামরি সরষের ফুল দেখবার জন্যে। বুঝলাম যে ক্ষিধেটা বেশ পেয়ে বসেছে আমাকে। অথচ খাবার কোথায়। এ তো শ্মশানের চিতাভূমি, এখানে কেউ খাবার
পরিবেশন করে না, করে শুধু একপাত্র গঙ্গাজল! একবার ভাবলাম মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করব ‘আসল
খাবার’ কখন আসছে। লজ্জা হল। আমরা বাঙ্গালিরা সারাজীবনই তো খালি খাই খাই করে কাটালাম, ৩৫,০০০ ফুট ওপরে উঠেও
সেই একই জিগির গেয়ে যেতে হবে কেন। নাহ, নিশ্চয়ই খাবার আসবে একটু পরেই, সাধারণত যা হয়। প্রথমে পানীয়, তারপর মূল, কঠিন পদার্থ।
ঠিক তাই হল। অনতিকাল পরে এক মহিলা এলেন সশরীরে। তবে খাবারের ট্রলি নিয়ে নয়, খাবারের খবর
নিয়ে। যাত্রীদের সেবার কথা
মনে রেখেই বিমানকর্তারা অমুক অমুক খাদ্যবস্তুর ব্যবস্থা রেখেছেন, ৭.৯৯
মূল্যে। তালিকাটি বিশাল কোনক্রমেই বলা যাবে না, এবং তার একটিও প্রচণ্ডরকম আকর্ষণীয় মনে
হয়নি আমার কাছে। আচ্ছা বলুন, কোল্ড টার্কি স্যাণ্ডুইচ আর কোল্ড বিফ র’লএর কথা শুনে পৃথিবীর কোন্
বাঙালি উত্তেজনায় ফেটে পড়বে? একটি হল মরা গরুর চামড়া, আরেকটি লোহার পাত, স্রেফ খনিজ
পদার্থ। এগুলো মানুষে খায়? ভদ্রমহিলাকে
যথাসাধ্য মিষ্টি করে বললাম, আচ্ছা, আপনাদের কোনও গরম খাবার আছে? হ্যামবার্গার বা চিজবার্গার
হলেও চলবে। (যদিও মনে মনে ভাবলাম,
আমার ডাক্তার শুনলে হার্ট ফেল করবে।) মেয়েটি তার মোটা নখটি
থুতুনিতে ঠেকিয়ে, যেন থুতুনি আর মোটা আঙ্গুলের সঙ্গে ফ্লাইট কিচেনের একটা সূক্ষ্ণ যোগাযোগ
আছে। কয়েক সেকেণ্ড ভাবার
পর বলল, খুশিতে উদ্ভাসিত মুখাবয়ব সহকারেঃ খুব সম্ভব চিজবার্গার আছে আমাদের। আমি দেখছি। কয়েক মিনিট পরে এসে মুখ কালো করে বললেনঃ
সরি স্যার, আই এম রিয়েলি রিয়েলি সরি (ওর দ্বিতীয় ‘সরি’টা বেশ আন্তরিকই মনে হল), আমাদের
সব বার্গারই শেষ হয়ে গেছে। অনন্যোপায় হয়ে বললাম, ঠিক আছে, কি আর করা, কোল্ড মিটই দিন
তাহলে (চিতার আগুন তো মেটাই আগে, মনে মনে বলি)। এবার কি হল জানেন? একেবারে অবিশ্বাস্য। মেয়েটির মুখ দিয়ে রা বেরুতে চাইল না---একেবারে
বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। কি বলবে বুঝতে পারছিল না বলেই হয়ত। কিম্বা হয়ত ভাবছিল আহা, ভদ্রলোকের মাতৃভাষাটি
যদি জানা থাকত তাহলে কাজটা অত শক্ত হতনা হয়ত। অতি কষ্টেও শেষ পর্যন্ত অস্ফুট স্বরে
যে শব্দগুলো বহির্গত হল ওর মুখ দিয়ে তার সারমর্ম হল এই যে তাদের কোল্ড খাবারও শেষ হয়ে
গেছে! আই এম সো সো সরি স্যার, নো, এশেম্ড একচুএলি। এই বলে বেচারি হন হন করে হেঁটে পালিয়ে
গেল আমার সামনে থেকে। দেখলাম, পয়সা বাঁচানোর জন্যে কোম্পানি মনুষ্যত্ব বিসর্জন
দিলেও কর্মচারীদের পক্ষে কাজটা তত সহজ নয়।
কি আর করা। কাজা রোজাগুলি এ-সুযোগে আদায় হয়ে যাবে, তাই বা মন্দ কি। ক্ষিধের জ্বালা ভুলে থাকার জন্যে অগত্যা
সিদ্ধান্ত নিলাম চোখের সামনে ওরা যে টিভি সেটগুলো সাজিয়ে রেখেছে সেগুলোর সুযোগ নেওয়া
যাক। প্রোগ্রাম বাছাই করতে
গিয়ে দেখি বড় ফ্যাকড়া----৭.৯৯ ভাড়া। নগদ নেবে? না, নগদের বালাই নেই এখানে,
বলল মেয়েটি। সব ক্রেডিট কার্ড। ঠিকমত এঙ্গেল করে কার্ড খানা এক ঝটকাতে টেনে নিতে হবে ফাঁক
বরাবর, তাহলেই ছবি দেখার অনুমত মিলবে। একে বলে কার্ড ‘সোইয়াপ’ করা। আবার সেই একই কথা মনে পড়ে যায়ঃ পড়েছি
মোগলের হাতে, খানা...। সোয়াইপ করলাম। কোন সাড়া পেলাম না। যন্ত্রমহাশয় হয়ত আমার গায়ের চামড়া দেখে
ভাবলেন লোকটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না। এক সেকেণ্ড পর বার্তা এল মনিটারে যে আমার কার্ডের পরিচয় তারা
জানে না। অতএব অন্য কার্ড ব্যবহার করুন। কিন্তু ‘অন্য’ কার্ড যে আমার নেই। আমি কার্ডপন্থী নাগরিক নই, এই সহজ কথাটি
আজ পর্যন্ত কাউকে বোঝাতে পারলাম না। যে বস্তু নগদ টাকা দিয়ে কেনার সামর্থ আমার নেই, সে-বস্তুর
কোন প্রয়োজনও আমার নেই। এই হল আমার অত্যন্ত সহজ সরল নীতি। অর্থাৎ সেকেলে, আনাড়ি, গেঁয়ো, প্রস্তরযুগের
মানুষরা যেভাবে জীবনযাপন করত। ঠিক আছে, যা ইচ্ছে তাই বলুন, আমি আমিই। মুভি দেখে ক্ষিধে ভুলতে চেয়েছিলাম, তবু
দ্বিতীয় কার্ড ব্যবহার করা কোনভাবেই সম্ভব নয় আমার পক্ষে। যে লোক তার প্রথম কার্ড ব্যবহার করে ইচ্ছার
বিরুদ্ধে তার পকেটে দ্বিতীয় কার্ড ঢোকাবার চেষ্টা কি কারুর করা উচিত? না তাতে কোন ফল
হবে?
আটলান্টিকের অপর পারের যাত্রীরা এখনো এই কার্ড বিভ্রাট থেকে মুক্ত। এবং টাকা-দিয়ে-খাবার-কেনার অপমান তাদের সহ্য করতে হয়না প্রতিটি ফ্লাইটে। পাঁচ ছয় বছর আগে উত্তর আমেরিকার দূরপাল্লার
বিমানভ্রমণেও সেটা ছিল না। ভাড়ার টাকার মধ্যেই সব খরচ ধরা থাকত। কিন্তু তারপর, শিল্পপতিদের উর্বর মস্তিষ্ক
থেকে একে একে অভিনব সব বুদ্ধি নির্গত হতে শুরু করল। কিভাবে খরচ কমানো, এবং মুনাফা বাড়ানো,
উভয় কাজটি অতি নৈপুন্যের সাথে সমাধা করা যায়, একই সাথে। তারা নিশ্চয়ই ধরে
নিয়েছিলেন যে বিমানযাত্রীরা বুদ্ধিশুদ্ধির দিক থেকে অতিশয় নিম্নশ্রেনীর প্রানী যারা
কোনক্রমেই টের পাবে না কতটা চালাকি আর তীক্ষ্ণবুদ্ধির ছাপ রয়েছে এই কার্ড-সোয়াইপ-মুভিচ্যানেল
আর আহার্যবস্তু প্রাপ্তির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পেছনে। তারা কাউকে জোর করে বলছে না যে এই খাবার আপনাকে কিনতেই হবে, বা, ছবি দেখার জন্যে
কার্ড ঘুরিয়ে ভাড়া দিতেই হবে। দেখেছেন, কি সুন্দর করে একটা ফাঁদ রচনা করেছেন তারা আপনার
জন্যে। নগদ টাকার পরিবর্তে
কেবল কার্ডের নিয়মও সেই মুনাফারই কারণে। প্রথমত কার্ড কোম্পানিগুলোর নরখাদকদের
সঙ্গে তাদের নিশ্চয়ই কোন গোপন চুক্তি আছে, যে আমরা সুযোগ পেলেই একে অন্যের পিঠ চুলকাবো। দ্বিতীয়ত টাকার ঝামেলা না থাকলে কোনরকম
খুচরো পয়সা আদানপ্রদানের বালাই থাকে না, যার ফলে ঘন্টাপ্রতি মজুরি কমে যায়। বাহ, কি চমৎকার ব্যবস্থা। সমস্যা হল আমার মত কতগুলো বেকুব মানুষদের
নিয়ে, যারা কার্ড ব্যবহারের পক্ষপাতী নয়, এবং কারো সঙ্গে কোনরকম আপোষ করে নিজের আদর্শবিরোধী
কাজ করতে কিছুতেই রাজি হবে না, মরে গেলেও না। এই সব ‘নীতি’ওয়ালা মানুষগুলোই হল আধুনিক
বিশ্বায়িত বানিজ্যের বড় মাথাব্যথা। সৌভাগ্যবশত, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে, এই উদ্ভট উন্মাদ লোকগুলোর
সংখ্যা ক্রমশ হ্রস্বমান, অনেকটা উত্তর মেরুর শ্বেতভল্লুকদেরই মত। আসলে উপমাটা নেহাৎ মন্দ নয়। দুটোই সমান দ্রুততার সঙ্গে অপসৃয়মান। নীতিওয়ালা লোকগুলোকে আপনি শ্বেত ভল্লুক
বলবেন না তো কি বলবেন। ওরা শুধু ভল্লুকই নয়, উজবকও!
আমার দৃঢ় বিশ্বাস অচিরেই একটা সময় আসবে যখন শুধু
খাবার নয়, টেলিভিশন প্রোগ্রাম নয়, বাথরুম ব্যবহারেও কার্ড সোয়াইপের প্রচলন শুরু হয়ে
যাবে। তৎক্ষণাৎ হয়ত ৭.৯৯ মূল্য ধার্য না করে বলবেঃ ২.৯৯
বা সেরকম কোনও সংখ্যা। তারপর লোকজন যতই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে ততই তারা সাহসী হবে একটু
একটু করে মূল্য বাড়াতে। কিম্বা হয়ত বলবে, ছোট কাজের জন্যে, ব্যবহারপ্রতি, ২.৯৯, বড় কাজের জন্যে, ধরুন, ৩.৫০?
অযৌক্তিক মনে হয় কি? আপনার আমার মত মূলত গ্রাম্য বাঙ্গালদের কাছে একেবারে দুনিয়াছাড়া বিষয় মনে হতে পারে, কিন্তু সাধারণ আমেরিকানদের চোখে
সংসারের সবকিছুই মূল্যসাপেক্ষ। সার্ভিস, বা জনসেবা, তা’ও। আমরা যারা এমন দেশ থেকে এসেছি যেখানে,
গ্রামেগঞ্জের মানুষ এখনো পাকা পায়খানা ব্যবহারের চেয়ে বরং পাটক্ষেত আর বেগুনক্ষেতের
ব্যবহারই বেশি আরামদায়ক বলে মনে করে, তাদের জন্যে পেচ্ছাব-পায়খানার মত জরুরি বিষয়গুলোর
জন্যে ট্যাক্স বসানোর মত হাস্যকর জিনিস আর হতে পারে না। অতএব এই পাটক্ষেতে-মলত্যাগী মানুষগুলি
যখন টিকিট কেটে প্লেনে উঠে দেখবে কার্ড সোয়াইপ না করলে তাকে বাথরুমে ঢুকতে দেওয়া হবে
না, তখন বেচারির মনের অবস্থা কি হতে পারে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। অনেকের হয়ত কার্ড থাকবে না। তারা কোথায় যাবে? ছোট কাজের জন্য বাড়ি
থেকে বোতল নিয়ে গেলে হয়ত কোনরকমে কাজ চালানো যায় (যদিও সহযাত্রীরা কি ধারণা নিয়ে বাড়ি
যাবেন এই ‘অসভ্য’ লোকগুলো সম্বন্ধে সেটা নাহয় চিন্তার বাইরে রাখাই ভাল), কিন্তু বড়
কাজের বেলায় কি উপায় হবে? আয়েতুল কুরসি যত হাজারবারই পড়ুন ওখানে, খুব একটা কাজে দেবে
বলে মনে হয়না। অতএব আমার পাটক্ষেতের সহব্যবহারিগণ, স্কুলকলেজে লেখাপড়া করুন বা না করুন, তাতে
খুব একটা আসে যায় না, যতটা যাবে আপনি কার্ডের ব্যবহার শিখতে না পারলে। এযুগ প্লাস্টিক কার্ডের যুগ। এই কার্ডই হল বেহেশতের চাবিকাঠি। এটা সোয়াইপ না করতে না পারলে সংসারে কোথাও
আপনার জায়গা হবে না। আমেরিকায় এসে পড়েছেন, সুতরাং প্রথম সবক হিসেবে জেনে রাখুন
যে এদেশে তারা গীর্জায় যায় বটে প্রতি রোববার, কিন্তু তাদের আসল গডের নাম ‘ডলার’। এবং রোববার বাদে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে
তাদের গীর্জা হল রাস্তার ব্যাঙ্কগুলো। উত্তর আমেরিকা অর্থের পূজারি। (সত্যি কথা বলতে কি, এমন কোনও দেশ আছে কোথাও, এই বিশ্বায়িত
প্রযৌক্তিক যুগে যেখানে তারা ডলার বা পাউণ্ড বা ইয়েন বা ইউরোর পূজা করে না? অন্তত আমার
চোখে পড়ে না। অবশ্য আমার চোখের জ্যোতি আগের মত ভালো নয়। সুতরাং আপনিই বলুন।) ভারত উপমহাদেশে মুখের বুলি হিসেবে তারা আধ্যাত্মিকতা আওড়ায়,
কপালে তিলক আর স্কন্ধদেশে পৈতা পরে, বা মাথায় টুপি-পাগড়ি হাঁকিয়ে অজু করে নামাজে দাঁড়ায়
দিনে পাঁচবার, কিন্তু পেটের তলায় একটু ডলারের খোঁচা দিয়ে দেখুন কেমন ঝিলিক ওঠে সারা
অঙ্গে। টাকার চেয়ে বড় পুরোত
কোথাও নেই, যেমন নেই ডলার আর পাউণ্ডের চেয়ে বড় মৌলবি। মান্ধাতার আমলের ‘আধ্যাত্মিকতা’ এখন চড়ুই
পাখির খাবার। ওতে কারো মেয়ের বিয়ের যৌতুক ওঠে না, বা বনানী-বারিধারাতে দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি
তৈরি হয়না।
ও হ্যাঁ, আমার ভেগাসযাত্রার শিহরণগুলি পুরোপুরি ব্যক্ত
করা হয়নি এখনো। সংক্ষেপে সেটা নাহয় সেরেই ফেলি। লাস ভেগাস তখন একঘন্টা দূরে। ক্ষিধেটা প্রায় মরে গেছে ইতোমধ্যে। না, ক্ষিধে মরেনি, আমারই প্রায় মরণদশা। বোধশোধ সব ভোঁতা হয়ে গেছে। ক্ষিধে আছে কি নেই তা’ও বুঝতে পারছি না। কেবল একটি চিন্তাই আমাকে কোনরকমে ধরে
রেখেছে সেসময়---- একঘন্টা পরেই আমার ছেলের মুখ দেখব এরাইভেল গেটে। এর চেয়ে আরামের চিন্তা আর কি হতে পারে। ছেলে নিশ্চয়ই তৎক্ষণাৎ একটা কিছু কিনে
খাওয়াবে আমাকে। আহা, কি শান্তি, অবশেষে!
( বিধাতা সেসময় আড়াল থেকে মুচকি মুচকি
হাসছেন। )
বিধ্বস্ত দেহ আর সম্বিৎহারা অবস্থায় লাস ভেগাস বিমানবন্দরের নবনির্মিত তিন নম্বর
টার্মিনালে যখন নিজেকে কোনরকমে ঠেলেঠুলে প্রবেশপথের গেটে ঢোকালাম তখন শুধু একটা ভাবনাই
আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলঃ আর দু’কদম হাঁটামাত্র। তারপরই হুইলচেয়ার! হুইলচেয়ারের ওপারে
ছেলে দাঁড়িয়ে আছে অধীর অপেক্ষায়। ক্লান্তিজড়িত তন্দ্রাচ্ছন্নতায় কল্পনা করছিলাম, আমার ছেলে
দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, বাবাকে আবার চোখে দেখার আনন্দে আত্মহারা, এক হাতে তার গুটিকয় টাটকাভাজা
পাকুড়া, অন্য হাতে একগাছা টসটসা আঙ্গুর। আমার শুকনো জিব আপনা থেকেই সিক্ত হয়ে
উঠল।
কিন্তু, ওই যে বললাম, রসিক বিধাতার মুচকি হাসি। যেন বলছেনঃ হুইলচেয়ার? সে আবার কি জিনিস?
হুইলচেয়ার একেবারে ছিল না তা নয়। কিন্তু সেই ওয়াশিংটনেরই মত----আমার জন্য
নয়, অন্য কারো বাবা-মায়ের জন্য। আমারটির কি হল এমন উদ্ধত প্রশ্ন কাউকে জিজ্ঞেস করব তার কোনও
উপায় খুঁজে পেলাম না। সারা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে-থাকা অবস্থায় একটি মানুষও আমার দৃষ্টিগোচর
হয়নি। সবাই ছুটছে, যেন বোমা
পড়েছে কোথাও, আগুন লেগেছে কোথাওবা। কারো একবিন্দু সময় নেই আমার জন্যে। এদিকে আমার ছিল না সেলফোন। ঠিক ছিল না বলব না, ছিল, কিন্তু ক্যানাডার
বাইরে চলার মত ফোন নয়। যন্ত্রের ব্যবহার আমি ন্যুনতম স্তরে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছি। কাজটা হয়ত ঠিক করিনি----আধুনিক জীবন তো
কারো নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর চলে না, চলে বড় বড় আন্তার্জাতিক বনিকদের বানিজ্যিক স্বার্থের
ভালোমন্দ বিচারের ওপর। একটা কথা আপনারা বুঝিয়ে দিন আমাকে। বিশ বছর আগে তো এই ছোট্ট যন্ত্রটি, যাকে
বাংলাদেশীরা আদর করে মুঠোফোন বলে অভিহিত করে, সেটা তো ভালো করে বাজারেই নামেনি। কিন্তু তখনও তো সভ্যতা ছিল, তাই না? ছিল
বড় বড় উড়োজাহাজ, বড় বড় বিমানবন্দর, নৌবন্দর, ছিল মানুষে-মানুষে যোগাযোগ, বন্ধুত্ব,
সখ্য, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা। আজকে তাহলে এই ক্ষুদ্র যন্ত্রটি ছাড়া এসবের কোনকিছুই সম্ভব
হচ্ছে না কেন? কেন আমি পারছিনা আমেরিকার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বানিজ্য ও বিনোদনকেন্দ্র লাস ভেগাসের প্রধান বিমানবন্দরে নেমে, এই অঙ্গুলিপ্রতিম
তুচ্ছ দ্রব্যের সহায়তা ছাড়া দু’শ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে?
অনন্যোপায় হয়ে নিজের প্রায় অচল দু’টি পায়ের ভরসাতেই
আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম ব্যাগেজ ক্লেম এলাকার দিকে। রাজা নিশ্চয়ই সেখানেই অপেক্ষা করছে আমার
জন্যে। আমার নিজের চলনশক্তি
আর বিচারবুদ্ধি ততক্ষণে প্রায় অবলুপ্ত। হাঁটছি, কারণ আমার সামনের লোকগুলি হাঁটছে, এবং আমার পেছনের
লোকগুলো আমাকে সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ আমি স্রোতের টানে হাঁটছি। আমি একটি ভাসমান মৃত কাষ্ঠখণ্ড। এই স্রোতের বেগে আমার লক্ষ করা হয়নি যে
দুতিনবছর আগে এই যে নতুন টার্মিনালটি তৈরি হল লাস ভেগাসে, তার সাথে তো একটা নতুন ব্যাগেজ
ক্লেম এলাকাও তৈরি করতে হয়েছিল! সাধারণ বুদ্ধি অনুযায়ী তাই হওয়া উচিত। কিন্তু সেসময় আমার সাধারণ-অসাধারণ কোনরকম
বুদ্ধিই ছিল না। অতএব জনস্রোত অনুসরণ করে করে শেষ পর্যন্ত আমি গিয়ে পৌঁছুলাম সেই পুরনো, পরিচিত
টার্মিনালে। কোথায় তিন নম্বর, আর কোথায় এক নম্বর! দুয়ের দূরত্ব একমাইলের কম নয়।
বুঝতেই পারছেন, বেশ একটা বড়রকমের জট লেগে বসে আছে। যদিও আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল
না যে আমি কোনও ভুল করিনি---বারে, আমার তো সব চেনা! কতবার এসেছি এখানে। চোখ বুঁজে চলে যেতে পারি যেখানে ইচ্ছে
সেখানে। তাই, এস্কেলেটারে নিচে
নেমে যখন দেখি রাজা নেই, তখন আমার মনে হল, ওটা আমার দেখার ভুল, ক্ষুধার চোটে চোখেমুখে
অন্ধকার দেখছি। রাজা থাকবে না সেখান, অসম্ভব বলে যদি সংসারে থাকে কিছু এ হল তাই। কেয়ামত এসে গেলেও রাজা থাকবে ওখানে, সে
আমার এমনই ভক্ত ছেলে। প্রথমত আমার ফ্লাইটের আদ্যোপান্ত খবর তার কম্পিউটারে, তার
ওপর প্লেন দেড় ঘন্টা বিলম্ব। ওর পক্ষে এয়ারপোর্টে না থাকাটা অসম্ভব।
কিন্তু অসম্ভবও যে সম্ভব হতে পারে কখনো কখনো এবার
তার প্রমাণ পেলাম। রাজা নেই। মানে আমার কনিষ্ঠ পুত্র রাজা লাস ভেগাসের এক নম্বর টার্মিনালের ব্যাগেজ ক্লেম
এলাকাতে সশরীরে অনুপস্থিত! ওদিকে আমার সুটকেসেরও কোনও পাত্তা নেই। সবার সুটকেস আসছে, কেবল আমারটিরই কোন
লক্ষণ নাই। হাতে নেই মুঠোফোন। পাব্লিক ফোনে চেষ্টা করব, পকেটে নেই মার্কিন মুদ্রা। ক্যানাডার ভিসা কার্ডের প্রতি আমেরিকার
যন্ত্রগুলির একটা অসুস্থরকম অনীহা আছে বলেই মনে হল। এখানেও সেই একই বার্তাঃ অন্য কার্ড
ব্যবহার করুন। ইতোমধ্যে আমি প্রায় অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গেছি। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলে
কি হবে ভাবতেই গা শিউরে উঠল। চোখে পড়ল এক ট্যাক্সিওয়ালাকে, হয়ত কোনও বিশেষ যাত্রীর
জন্যে অপেক্ষা করছেন। কাচুমাচু হয়ে বললামঃ আপনার সেলফোনটা ব্যবহার করতে পারি এক মিনিটের
জন্যে? ছেলের জন্যে একঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি, অথচ ওকে ফোন করতে পারছিনা আমার সেল নেই
বলে। ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হল না যে আমার অনুরোধ শুনে তিনি দরদে গলে গেলেন। নেহাৎ
ভদ্রতার খাতিরেই হয়ত তিনি রাজার নম্বর জানতে চাইলেন। শেষে, আহা সে যে কি স্বস্তি আমার,
ছেলের গলা ফোনের অপরপ্রান্তে। বুঝতেই পারছিলাম, ছেলে ওদিকে পাগলের অবস্থায় আমাকে না
দেখে। সব যাত্রী একে একে মাল নিয়ে যে যার বাড়ি চলে যাচ্ছে আপনজনদের সাথে, কেবল তার
বুড়ো বাপটারই কোন হদিস নেই। আমার ফোন পেয়ে সে প্রায় চিৎকার করে উঠল। আব্বা তুমি কোথায়?
রাজার বাড়িতে পৌঁছানোর কথা ছিল সন্ধ্যা
আটটায়। শেষমেস সেটা দাঁড়ালো এগারোটায়, অর্থাৎ আমার ঘড়িতে সকাল দুটো। হাতমুখ ধুয়ে যখন
খেতে বসলাম তখন সাড়ে এগারোটা।
ক্ষুধা কাকে সেটা ছোটবেলায় শিখেছিলাম দুর্ভিক্ষের
সময়। এবার সেটা নতুন করে শেখা হল আধুনিক প্রাচুর্যময়তার সৌজন্যে।
এবারের বিমানভ্রমণটি নেহাৎ বিফল হয়নি।
লাস ভেগাস,
১২ই ডিসেম্বর,’১২।
মুক্তিসন ৪১।
Mizan Rahman, মীজান রহমান
No comments:
Post a Comment