Sunday, 30 December 2012

অদ্ভুত এই কারাগার ~ মীজান রহমান

  যাবজ্জীবন কারাবাস কাকে বলে জানেন? নিশ্চয়ই জানেন দশবছরের বাচ্চাও সেটা জানে সেই কারাবাসের অর্থ বোঝেন? সম্ভবত না

  ধরুন আপনি একটা জগতে জীবনধারণ করছেন যেখানে এক অদৃশ্য মহাশক্তির নিরঙ্কুশ অঙ্গুলিনির্দেশ আর কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিধিমালা দিয়ে গাঁথা সবকিছু এই যে ‘জীবনধারণ’ শব্দটি অবলীলাক্রমে ব্যবহার করে ফেললাম আমি,এটিও আক্ষরিক অর্থে প্রযোজ্য নয় আপনার জীবনকে আপনি ‘ধারণ’ করেন না, যাপনই করেন কেবল আপনি ক্রিয়ামাত্র, কারক নন ‘ধারণ’ করার ক্ষমতা আপনার হাতে নয়, সেই মহাশক্তির হাতে আপনার জন্মের মুহূর্ত থেকেই আপনার জীবন পুরোপুরি তার দখলে চলে গেল ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাটেলকর্তাদের সদ্যজাত গবাদি পশুর মত আপনি কি খাবেন, কি পরবেন, কাত হয়ে শোবেন, না সোজা হয়ে, শৌচাগারে লোটা-বদনা থাকবে না মাটির ঢেলা, সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গার পর প্রথম কর্তব্য কি হবে আপনার----এর কোনকিছুই আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভালো-লাগা-না-লাগার ওপর নির্ভর করে না এগুলো সবই পূর্বনির্ধারিত আপনি হয়ত জানেন না যে আপনি একটি অস্থি-মাংসনির্মিত রবোট ছাড়া কিছু নন বাল্যাবস্থাতেই আপনার হাতে একটি গ্রন্থ দেওয়া হবে যাতে আপনার বাকি জীবনের একটা সার্বিক মানচিত্র সবিস্তারে এঁকে দেওয়া হবে একরকমের জিপিএস বলতে পারেন, যার ইঙ্গিত ইশারা অনুযায়ী আপনার গতিবিধি নির্ধারিত হতে থাকবে, যদিও আবহ কণ্ঠটি মনুষ্যনির্মিত শকটের মত তেমন সুমধুর বা সুরেলা না’ও হতে পারে
  এই গ্রন্থটিতে পরিষ্কার বলিষ্ঠ অক্ষরে বর্ণিত থাকবে যে আপনার জীবন একটি নয়, দুটি একটি সাময়িক, যা অত্যন্ত স্বল্পকালীন আরেকটি অনন্তকালীন সেহিসেবে আপনি আসলে একটি অমর প্রাণী (ঠিক যা চেয়েছিলেন আপনি, তাই না?) কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আপনি মারা যাবেন না আদৌ না না, মারা যাবেন ঠিকই, এবং কবে, কিভাবে তা’ও সেই সর্বজ্ঞ মহাশক্তির খাতাতেই লেখা (সম্ভবত আপনার জন্মের আগেই) শুধু তাই নয়, মারা যাবার আগে ও পরে, আপনার মরদেহটির কি ব্যবস্থা হবে, এবং কে বা কারা সেই ব্যবস্থার দায়িত্ব নেবে তা’ও পুংখাণুপুংখরূপে লিপিবদ্ধ ওই অমূল্য গ্রন্থখানিতে এতে অবশ্য মন খারাপ করার কিছু নেই, কারণ এই ‘মৃত্যু’ আপনার জীবনের অন্তিম পরিণতি নয়, একটা অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থামাত্র মৃত্যুর পর যে অন্তহীন জীবনটি শুরু হবে আপনার সেটিই আপনার আসল জীবন মজার ব্যাপার যে সেই ‘আপাত মৃত্যু’-পূর্ব স্বল্পকালীন জীবনটিতে আপনি যাকিছু করেছেন তার ‘ভালমন্দ’এর বিচার দিয়েই যাচাই করা হবে আপনার ‘আপাত মৃত্যু’-ত্তর জীবনে কিরকম সুখসম্ভোগ বা দুর্ভোগ প্রাপ্য হবে ‘পূর্ব’ জীবনে যা কিছু নিষিদ্ধ আপনার জন্যে (যেমন সুরাপান, যৌনাচার, ব্যভিচার, আনন্দ উপভোগ), সেগুলো থেকে যদি সত্যি সত্যি বিরত থাকতে পারেন তাহলে আপনি ‘উত্তর’ জীবনে ঠিক সেই সুখগুলোই ( যেমন সুরার পাত্রহস্তে হাস্যমুখে দণ্ডায়মান অনাঘ্রাতা, অনাস্বাদিতা, অনন্ত লাস্যময়ী, লীলাময়ী উদ্যানবালারা, অফুরান, অনন্তধারে) তার মানে যাকিছু পাপ বলে চিহ্নিত করে রেখেছে সেই মহাশক্তি, ঠিক তা’ই পরিগণিত হবে পরম পুণ্য বলে অর্থা এ-জীবনের কষ্ট, সে-জীবনের অন্তহীন সুখ এজীবনের আনন্দহীনতা সেজীবনের চিরানন্দময়তা পক্ষান্তরে এজীবনের সুখ পরজীবনের সীমাহীন কষ্ট (একটিমাত্র ব্যতিক্রমী পুরুষকে বাদ দিয়ে অবশ্য) এদিক ওদিক তাকালে বোঝা যাবে, এই ‘ব্যতিক্রমী’ পুরুষগুলোর (খেয়াল করুন ব্যতিক্রমী নারীর কথা একবারও উল্লেখ করা হয়নি কোথাও) সংখ্যাও নেহা কম নয় পরম ভাগ্যবান এই বিশেষ পুরুষগুলোকে বাদ দিলে, আপনি-আমিসহ  ইহজগতের আপামর জনসাধারণ যারা বেঁচে আছি পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করে, তাদের ভাগ্যে এ-জীবন ও-জীবন উভয় জীবনই আসলে এক অন্তহীন অশ্রুভরা মহাসমুদ্র ছাড়া কিছু নয় কারণ এই মহাশক্তির নিজের বর্ণনাতেই পরিষ্কার উল্লেখ করা আছে যে আমরা যা করি বা ভাবি বা স্বপ্ন দেখি তার প্রতিটি বিষয়ই তার ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত অর্থা ভাল কিছু করলে যেমন তার ইচ্ছা, খারাপ করলেও তারই ইচ্ছা যদিও এ’ও বর্ণিত হয়েছে যে খারাপের দায়িত্বটা আমাদের, আর ভালোর কৃতিত্বটা তার উল্টোপাল্টা বিচার মনে হচ্ছে কি? হতে পারে তবে এই মনে হওয়াটাও আপনার ইচ্ছায় ঘটছে না, ঘটছে সেই অদৃশ্য শক্তিরই ইচ্ছায়
  এই মহাশক্তির অস্তিত্বটি এমনই ব্যাপক ও সর্বগ্রাসী যে আপনার কর্মটিই নয় কেবল তার নিয়ন্ত্রণে, আপনার মনের ভাবনাখানিও সুতরাং আপনি আসলে কেউ নন, কিছু নন, একটি অস্তিত্বহীন কাল্পনিক জীব
  এমন একটি অবস্থানকে আপনি কারাবাস না বলে আর কি বলতে পারেন? সাধারণ মানুষ কারাবাস থেকে যথাসত্ত্বর মুক্তিই কামনা করে, তাই না? কিন্তু এই কারাটি এমনই এক অদ্ভুত তন্তু দিয়ে গড়া যে আমরা, সাধারণ মানুষ, বুঝতেই পারিনা যে সারাটি জীবন এক সীমাপরিসীমাহীন, অন্ধকার, শ্বাসরোধকর কারাগারেই কাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেবল তাই নয়, আমরা, মূর্খ জনসাধারণ, কালে কালে এমন একটা অবস্থাতে পৌঁছে যাই যে এর থেকে ‘মুক্তি’ যে একটা কাম্য বস্তু তা’ও কল্পনার মধ্যে স্থান দিতে পারিনা
  এবার বলুন তো সেই মহাশক্তিটি আসলে কি কোন ব্যক্তি, না সত্তা, না তত্ব, না এসবেরই এক বিচিত্র সংমিশ্রণ? ধরতে পারেননি এখনো? তাহলে থাক চলুন অন্য প্রসঙ্গে যাই


   স্বজাতি বলতে কি বোঝায়? ব্যক্তিগতভাবে আমি বুঝি গোটা মনুষ্যজাতিটাকে জানি, এ-পরিচয় দিয়ে বর্তমান যুগে কোথাও পার পাওয়া যাবে না একটা-না-একটা খোপে আমাকে ঢুকতেই হবে হ্যাঁ, একধরণের কবুতরের খোপ বই আর কি বলা যায় একে খোপের ভেতরে বসবাস আমার মোটেও পছন্দ নয়, তবু তর্কের খাতিরে বা সামাজিক প্রয়োজনীয়তায় একটা খোপ যদি বাছাই করতেই হয় আমাকে, (ধরে নিচ্ছি যে বাছাই করার স্বাধীনতাটুকু আমাকে দেওয়া হচ্ছে, যা সবসময় স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া যায় না), তাহলে বলব ‘বাঙালি খোপ’ অর্থা ভাষা আর সংস্কৃতি দিয়ে আলাদা করে চিহ্নিত করা যে খোপ আসলে এমন কোনও খোপ সত্যি সত্যি আছে কিনা তা’ও আমার জানা নেই ভাষা নিয়ে আমরা গণ আন্দোলন করি ঠিকই, কিন্তু ভাষাকে কিভাবে সম্মান করতে হয়, তাকে মর্যাদা দিতে হয় ধর্ন্মীয় সংস্কৃতির সমান্তরাল অবস্থানে, সেসম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা আমজনতার তেমন আছে বলে আমার মনে হয় না ভাষার চেয়েও জটিল এবং সর্বসাধারণের জন্যে খানিক ধাঁধাময় বিষয় হল ভাষাজাত সংস্কৃতি, যেমন সঙ্গীত, শিল্প ও নৃত্যকলা, সাহিত্য, চলচ্চিত্র এগুলোকে একসাথে জড় করে একটা পরিচয় সৃষ্টি করা, আমাদের উপমহাদেশের জন্যে সেটা এবস্ট্রাক্ট আর্টের মতই দুরূহ ও দুর্বোধ্য অথচ এই পরিচয়ের খোপটি ছাড়া অন্য কোন খোপই আমার জন্য আকর্ষণীয় তো নয়ই, ন্যুনতম বিবেচনায় গ্রহনীয়ও নয়
   আমজনতা বলতে আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি, এবং যাদের নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা মাঠে-ময়দানে বিপ্লব উৎপাদন করেন, তাদের কাছে ভাষা একটা রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার হাতিয়ার মাত্র, পরিচয়ের অংশ নয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে তারা একবাক্যে বলবেঃ কেন, আমরা যে মুসলমান বা আমরা যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-জৈন-গারো, সেটা কি যথেষ্ঠ নয়? অর্থা ঘেটেঘুটে সেই একই কথাঃধর্ম সবচেয়ে সহজ যে-পরিচয়টি এবং তাদের মতে, সবচেয়ে পবিত্র, খাঁটি ও সনাতন ধর্মীয় পরিচয় আর মধ্যযুগীয় গৌত্রিক পরিচয়তে খুব একটা তফা আছে কি? যখন ধর্ম ছিল না তখন ট্রাইব ছিল----ট্রাইব ছাড়া বেঁচে থাকাটাই ছিল একটা বড় সমস্যা তারপর যখন ধর্মপ্রচারকরা তাদের কল্পনার রঙ মিশিয়ে একটা নতুন জিনিস নিয়ে এলেন তাদের জন্যে এবং তারা আস্তে আস্তে দলে ভারি হয়ে উঠল তখন সেই ভারিত্বটাই ওদের একটা নতুন পরিচয়ের পথ তৈরি করে দিল এখন খৃস্টান বললে সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বব্যাপী ১৫০ কোটি মানুষ দাঁড়িয়ে যাবে মুসলমান বলতে দাঁড়াবে ১২০কোটি ( তার কারণ অবশ্য এক ধর্ম আরেক ধর্মের চেয়ে কোন অংশে খাটো তা নয়, তার অর্থ কেবল এই যে একদল যত রাজ্য দখল করতে সক্ষম হয়েছে আরেক দল তত পারেনি এটা ইতিহাসের উনিশ-বিশের ব্যাপার মাত্র)
  মুসকিল এই যে ধর্ম বা গোত্র কোনটাই অর্জিত পরিচয় নয়, অর্পিত জন্মসূত্রে প্রাপ্ত একরকমের পারিবারিক শীলের মত----বাপদাদা চোদ্দ পুরুষ ধরে এই শীল এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হাতবদল হয়েছে দলিল করা জমির মত বাপের জমি ছেলেমেয়েরা যেভাবে পায় বাপের ধর্মও ঠিক সেভাবেই পায় তারা এর মধ্যে চেষ্টাচরিত্রের ব্যাপারাদি নেই, স্কুলকলেজে যাওয়াযাওয়ির ব্যাপারাদি নেই এক মূর্খের জমি যেমন পাবে আরেক মূর্খ, তেমনি তার তথাকথিত ‘বিশ্বাস’ও পাবে সেই একই বংশপরিক্রমায় আধুনিক শিক্ষিত, প্রযুক্তিতাড়িত, বিশ্বদৃষ্টিসম্পন্ন সতেজ সজাগ বিশ্বনাগরিকের জন্য সেই একই পরিচয় প্রচলিত হতে থাকবে সেটা কেমন অদ্ভুত মনে হয়না? আপনার না হতে পারে, কিন্তু আমার হয়
  তবুও, এই কৃত্রিম, অর্পিত, সংকীর্ণ পরিচয়টির কথাই যে বলেন আপনি তাহলে আমি বলতে বাধ্য হব যে আমি মুসলমান আমি মুসলমান কারণ আমার বাবা-মা মুসলমান, কারণ তাঁদের বাবামা মুসলমান, এবং আমার জানামতে তাঁদের বাবামা’ও মুসলমানই ছিলেন আমার মুসলমানিত্বের মধ্যে একমাত্র নামটি ছাড়া আর কিছুই উল্লেখযোগ্য বা চমৎকারক চোখে পড়ে না আমার নামের ব্যাপারেও আমার আপত্তির অনেক কারণ প্রথম কারণঃ আমি আরবদেশে জন্মগ্রহণ করিনি, পিতামাতার কেউই আরব বংশোদ্ভুত নন, আমার চোদ্দ পুরুষের কোথাও আরব মুল্লুক থেকে আসা বনিক বা দস্যু বা দরবেশের অবস্থান বিষয়ে আমি অবজ্ঞাত নই, অথচ আমার নামখানা আরবি হয়ে গেল কেমন করে বলা হয় যে আরবি নাম মাত্রই মুসলমান নাম সেটা যে সত্য নয় তার প্রমাণ তো আমার নিজের কাছেই আমার এক ছাত্র ছিল যার নাম নাসরুল্লাহ---খাঁটি আরবি নাম ওর জন্ম লেবাননে----পুরোদমে আরবি রাষ্ট্র নাসরুল্লাহ আরব কিন্তু মুসলমান নয়, খৃস্টান এবং এটা লেখাপড়াজানা লোকেদের কারুরই অজানা থাকবার কথা নয় যে লেবাননে ড্রুজ খৃস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক আজকের নয়, পুরো শতাব্দী ধরেই চলে আসছে সেটা আরো একটা উদাহরণ দেওয়া যাক তারেক আজিজ আরবি নাম কিন্তু তিনি যে ইরাকের মুসলিম মন্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন খৃস্টান ধর্মাবলম্বী মন্ত্রী, সেটা ওয়াকেফহাল মহলে কারুরই অজানা নয় অতএব আরবি নাম মাত্রই মুসলমান নাম নয় এমনকি সব দেশের সব মুসলমান নামও আরবি নয় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, এবং আফ্রিকার একাধিক দেশে অনেক মুসলমান রয়েছেন যাদের নাম আরবি নয় কেবল আমাদের উপমহাদেশেই এই প্রথাটি আঠার মত লেগে রয়েছে এর পেছনে আরবিপ্রীতি কতখানি কাজ করেছে, আর মোগল সাম্রাজ্যের ফারসি-আরবি ভাষার প্রতি মাত্রাধিক আনুকূল্য কাজ করেছে কতটা সেটা ভাববার বিষয় মোট কথাঃ এর সঙ্গে মুসলমানিত্বের আদৌ কোন সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করিনা, সম্পর্ক যেটা আছে সেটা হল সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বশ্যতাবোধের মোগল চলে গেছে তিনশ বছর আগে, ফারসি-আরবি বিদায় হয়েছে একই সঙ্গে বলা যায়, কিন্তু বাংলাভাষাভাষী মুসলিম সমাজের ঐতিহাসিকভাবে হৃত পরিচয়ের সঙ্কট এখনও কেটে ওঠেনি অদূর ভবিষ্যতে সেটা উঠবে তারও কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না দেশ স্বাধীন হবার পর একটা ছোটখাটো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, হয়ত এবার বাঙ্গালিজাতি নিজেকে খুঁজে পাবে ইতিহাসের পাতায় হয়ত এবার ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বদলে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরি করার কাজে উদ্যোগী হয়ে উঠবে বাংলাদেশের মুসলমান তাদের অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠিদের সাথে হাত মিলিয়ে অন্তত সেই প্রতিশ্রুতিতেই তো সৃষ্টি হয়েছিল দেশটা, তাই না? সেই প্রতিশ্রুতিতেই তো হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খৃষ্টান একসাথে যুদ্ধ করেছিল ধর্মোন্মাদনা তাড়িত বর্বর জাতি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে, তাই না? কিন্তু তারপর? তারপর কেন, কেমন করে সব স্বপ্ন সব আশা আকাঙ্ক্ষা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল? কেমন করে, কেন, কেন সেই পাকিস্তানের দালালরাই আবার দেশের ভাগ্যনিয়ন্তার আসন দখল করে ফেলল? আজ কোন শিশুর বাংলা নাম রাখা যায় না, কোনও জাতীয় অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ শব্দদুটি একসাথে উচ্চারণ করা যায় না ,কারণ বাংলা নাম বলতে বোঝায় হিন্দু নাম, জয়বাংলা বলতে বোঝায় ভারতের গোলামি এ কি সেই একই দেশ যেখানে বাংলা ভাষার সম্মান বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিল সালাম-বরকত-রফিক-জাব্বার, এবং যেখানে আজ বাংলা বলতে বোঝায় ‘হিন্দু’?  বাংলার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হবে পাকিস্তানের উর্দু নয়, তার চেয়েও নিকৃষ্ট আরব জাতির আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি, এমন এক উষ্ট্রপৃষ্ঠে আরূঢ় জাতিগঠনের স্বপ্ন নিয়েই কি প্রাণ দিয়েছিলেন ত্রিশ লক্ষ বাঙালি বীর সন্তান, সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারী-কিশোরী-বালিকা? আমার মনে হয় না কিন্তু চারদিকে তাকালে তো বারবার সেই দৃশ্যটাই পীড়া দিতে থাকে চোখকে, মনকে আজকে যত নারী স্বেচ্ছায় ইসলামি আব্রু-হিজাব-বোরখা পরিধান করছেন তার একাংশও দেখা যায়নি ‘৭১এর আগে আজকে মানুষ নির্দ্বিধায় বাপদাদার আমল থেকে প্রচলিত ‘খোদা হাফেজ’কে বাদ দিয়ে ‘আল্লা হাফেজ’ আওড়াতে শুরু করেছে----স্রেফ আরব হুজুরদের অনুকরণে যেন আল্লাতা’লা ফারসি ‘খোদা’ শব্দটা ভালো বোঝেন না, তাঁর সঙ্গে কেবল আরবি ‘আল্লা’ই বলতে হবে একে আপনি মানসিক, আত্মিক, সার্বিক বশ্যতা না বলে আর কিভাবে ব্যক্ত করবেন? একে আপনি মূর্খতা আর অজ্ঞতার অন্ধ উপাসনা ছাড়া আর কি বলবেন? না, এই বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের কারুরই মনে ছিল না, কিন্তু এই বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনও বাংলাদেশের যোগ্যতাও হয়ত আমাদের ছিল না সেই যে প্রবাদ আছে, তুমি যা চাও তা পাবে না, যেটুকু যোগ্যতা কেবল সেটুকুই পাবে তুমি
  লোকে বলে বাঙালি মুসলমান ভীষণ ধর্মপ্রাণ আমি বলি বাংগালি মুসলমান ভীষণ বশ্যতাপ্রিয়----তারা মূলত স্বাধীনতাবিরোধী

ফ্রিমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া
৩০শে ডিসেম্বর, ‘১২
মুক্তিসন ৪২  

মীজান রহমান :: Mizan Rahman