মীজান রহমান
আমেরিকার বিখ্যাত রসিকবর ও লেখক মার্ক টুয়েন
(১৮৩৫-১৯১০) একজায়গায় বলেছিলেনঃ জীবনটা কি সুখেরই না হত যদি মানুষের আয়ুষ্কালের গণনা
শুরু হত আশি থেকে, এবং ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হত আঠারোর দিকে। আবার তিনিই বলেছিলেন
আরেক জায়গায়ঃ আপনার বন্ধুরা যখন আপনার আশ্চর্যরকম তারুণ্যময় চেহারার প্রশংসা করতে শুরু
করবে তখনই বুঝবেন যে আপনার বার্ধক্য এসে গেছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি দু’টি অবস্থাতেই
পৌঁছে গেছি। অর্থাৎ বয়স আমার আশি, এবং বন্ধুরা
বলতে শুরু করেছে আমাকে এখনও কেমন তরুণ তরুণ মনে হয় দেখতে। তবে টুয়েন সাহেবের
প্রথম উক্তিটির সঙ্গে আমি একমত নই। সময়কে উল্টোদিকে ঘোরানোর বাসনা আমার নেই। ঘোড়ার পিঠে চড়ে
তাকে উল্টোদিকে যাবার কথা বলে দেখুন তো। সময়ও তেমনি এক ঘোড়া।
আমি বরং এই মন্ত্রে বিশ্বাসীঃ বার্ধক্য
নিয়ে নালিশ করতে নেই। বহু মানুষ আছে সংসারে যাদের ভাগ্যে ঘটেনি বার্ধক্যে পৌঁছানো,
এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে না আরো অসংখ্য মানুষের ভাগ্যে। কথাটা সম্ভবত বলেছিলেন
ডগ্লাস লার্সন নামক এক খ্যাতনামা আমেরিকান কলামলেখক। আসলেও তাই। বার্ধক্য আসে কেবল
যারা ভাগ্যবান তাদেরই জীবনে। আমি সেই ভাগ্যবানদেরই একজন। লোকে বলেঃ আপনি
নিজের শরীরের যত্ন নিয়েছেন, তাই। মোটেও না। মোদ্দা কথা, ভাগ্য। যদিও ‘ভাগ্য’ বলতে
কোন জিনিসের অস্তিত্বই আমি বিশ্বাস করিনা। ভাগ্য শব্দটাতে কেমন ‘নসিব, নসিব’ গন্ধ আছে। অর্থাৎ কোনও অদৃশ্য শক্তির গোপন কেতাবে লেখা একটি পূর্বনির্ধারিত
ভাগ্যলিপি যা অলঙ্ঘনীয় এবং অনির্ণেয়। ওসব বাক্যবয়ানে বিন্দুমাত্র আস্থা আমার নেই। আমি বিজ্ঞান বিশ্বাস
করি, বিজ্ঞান যাকে প্রমানিত তথ্য বলে ঘোষণা
করেছে তাকেই আমি ‘সত্য’ বলে মানতে রাজি, অপ্রমাণিত বা প্রমাণোর্ধ কোন তত্বকথাকেই আমি নির্বিবাদে গ্রহণ
করতে প্রস্তুত নই। বিজ্ঞানের কাছ থেকে আমি শিখেছি ‘সম্ভাবনা’ (Probability) শব্দটি। সম্ভাবনা সূত্রের
আইনকানুন দিয়েই সংসারের অনেককিছু চালিত হয়। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে সম্ভাবনা প্রাকৃতিক নিয়মাবলীরই
অংশ। চুম্বক, মাধ্যাকর্ষণ, আলো বা তাপ বিকিরণের মত। আজ সন্ধ্যায় সূর্য
অস্ত যাবে এবং কাল সকালে আবার উদয় হবে, এগুলো কি ধ্রুবসত্য বলে ১০০ ভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে
বলা যায়? অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা হয়ত বলবঃ অবশ্যই যায়। কিান্তু আসলেই
কি তাই? যা নির্ভুলভাবে বলা যাবে সেটা হলঃ সূর্য উঠবে কাল সকালে তার সম্ভাবনা একেবারে
১০০ ভাগ না হলেও একশভাগের এত কাছে যে তফাৎটা গণ্য করাই হাস্যকর। এরও একটা সঠিক গাণিতিক ভাষা আছে যা কেবল বিশেষজ্ঞরাই বুঝবেন। আণবিক বা পারমাণবিক
জগতে তো বলতে গেলে সম্ভাবনাতত্বেরই রাজত্ব। ক্ষুদ্রকণারা নিউটন গ্যালিলি এঁদের মত মহারথীদেরও কোন পাত্তা
দেয় না। সেখানে বরং বিংশ শতাব্দীর হাইসেনবার্গ সাহেব যে অনিশ্চয়তা সূত্র (Uncertainty
Principle) আবিষ্কার করে গিয়েছিলেন তারই একাধিপত্য। অর্থাৎ ক্ষুদ্রকণার জগতে অনিশ্চয়তাই নিশ্চিত সত্য!
আমি মনে করি আমাদের ব্যক্তিজীবনেরও অনেক ঘটনাই সেরকম----সম্ভাবনার
আপাতদুর্বোধ্য আইনকানুন দ্বারা পরিচালিত। আমরা সেসব বুঝিনা বলে ভাগ্য, কপাল, নিয়তি ইত্যাদি বলে চালিয়ে
দিই। আমি যে এখনও বেঁচে আছি, হার্ট এটাক জাতীয় শক্ত অসুখ হবার পরও, এবং ঠিক একই অবস্থাতে
অনেকেই বেঁচে থাকেননি তার প্রধান কারণ আমার ব্যক্তিগত শরীরচর্চা নয়, নিতান্তই আমার
ভাগ্য। মানে বেঁচে থাকবার একটা সম্ভাবনা সকলেরই ছিল, তবে আমার বেলায় সেটা কার্যকরি
হয়েছে, এই যা। আমরা যাকে ‘আল্লার ইচ্ছা’ বলে অভিহিত করে পুণ্যবানের পুলক বোধ করি সেটাও মূলত
তাই----সম্ভাবনা। জর্জ বার্ন্স (১৮৯৬-১৯৯৬) নামক এক
কমেডিয়ান একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে মঞ্চে দাঁড়িয়ে রসচ্ছলে বললেনঃ একবার যখন একশ’র কোঠা
পার হতে পারলাম এখন আর মরার ভয় নেই আমার। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে ঠিক সেবছরই তিনি মারা গেলেন। তার অর্থ এই নয়
যে আয়ু নিয়ে বড়াই করার অপরাধেই তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। ওই বয়সে যেকোন
মুহূর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনাটি ১০০ ভাগের এত কাছে চলে যায় যে মৃত্যু না ঘটাই বরং অস্বাভাবিক
মনে হয়। এর সঙ্গে বড়াই করা বা না করার কোন সম্পর্ক নেই----এখানে কার্যকারণবিধি একেবারেই
অকেজো।
তবে আরো একটা জিনিস আমি মানি----সংসারে
কোনকিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ মূল্য অবশ্যই আছে, প্রতিটি বস্তুরই,
যত ক্ষুদ্রই হোক সে বস্তু। আশিতে পৌঁছানোর এই যে বিশাল ভাগ্য আমার তারও একটা মূল্য আছে। আমাকে যখন লোকে
বলে আপনার দীর্ঘজীবন কামনা করি তখন আমার ইচ্ছে হয় হো হো করে হেসে উঠি। জীবন আর কত দীর্ঘ
হবে বলুন। আর কেনই বা হবে? পৃথিবীকে তো কিছুই দেবার নেই আমার, বরং আদায় করে নিচ্ছি অনেক
সুযোগসুবিধা যা হয়ত অন্য কাউকে বঞ্চিত করেই----ঐ যে বললাম সংসারে কোনকিছুই মাগনা মেলে
না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার দুটো জীবন---একটা শারীরিক, একটা মানসিক। আমার বয়সে অনেকের
বেলাতে দুটো জীবনই চলে যায়। আমার মনটা হয়ত এখনও পুরোপুরি যায়নি, যদিও তার বিচার আমিই
বা করি কেমন করে। তবে শরীরের ব্যাপার আলাদা। আমি আদৌ আমার শরীরের ভেতর থাকি কিনা সন্দেহ হয় কখনো কখনো। শরীরের জীবনকে
আমি ভাবি এরকমঃ On life support system. কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে
টিকে আছে। হাসপাতালের মরণাপন্ন রুগিকে যেমন হাজারখানেক নল সংযোগে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে
রাখা হয় আই সি ইউনিটে। আমি যেখানে যাই সেখানেই ওষুধের বাক্সটা সাথে নিতে ভুলি না। ওষুধগুলো যদি একদিন
না খাই বা কোনও বিশেষভাবে জরুরি ওষুধ পরপর দুদিন বা তিনদিন খেতে ভুলে যাই তাহলে আমার
এই দীর্ঘজীবনের যবনিকা পতন প্রায় অবধারিত। আমি নিয়মিত শরীরচর্চা করি বটে, কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি হয়ে
গেলেই শরীর খবর পাঠায়। হুমকি দেয়ঃ এসব কি হচ্ছে? রক্তচাপ তুঙ্গে উঠে যায়, হৃদপিণ্ড
দ্রুতগামী ট্রেনের গতিতে চলতে শুরু করে। মানে তুলকালাম লেগে যায় শরীরে। একে লাইফ সাপোর্ট
বলব না তো কি বলব।
এবার আসি ইন্দ্রিয়সমূহের দুরবস্থাতে। অনেকদিন হল নিজের
দাঁতের সঙ্গে ঘুমুতে পারিনা। দাঁত থাকে একদিকে আমি আরেকদিকে। তারপর ধরুণ চোখজোড়া। নিজের চোখ দিয়ে দেখেছি জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর। তার পরই তো শুরু
হল চশমা। বছরপাঁচেক আগে তাতেও কাজ হয়নি। নিজে চোখের কোন ব্যবহারই থাকল না বলতে গেলে। থাকবে কেমন করে----দুটো
চোখেই তো ক্যাটারাক্ট সার্জারি করে নকল চোখ বসানো হয়েছে, যার আরেক নাম কন্টাক্ট লেন্স। আগে ছিল এরকম যে
ঘুমুতে যাওয়ার আগে তুলে ফেলা যেত, এখন সেটা চোখের মনির সঙ্গেই আঁট করে লাগানো। একদিন হয়ত সেগুলোও
যাবে। তারপর কি হবে বুঝতেই পারছেন। একটাই সান্ত্বনাঃ মধ্যযুগের স্বনামধন্য বিজ্ঞানী গ্যালিলিও
গ্যালিলি দারুণ শক্তিশালী দূরবীণ আবিষ্কার করে মানুষকে দূর নক্ষত্র প্রত্যক্ষ করবার
ক্ষমতা দিয়ে শেষ বয়সে নিজের চোখের দৃষ্টি হারিয়ে পূর্ণ অন্ধত্ব বরণ করেছিলেন নতমস্তকে। আমি সংসারে কাউকে
কিছু না দিয়েও সে অবস্থা সহজেই মেনে নিতে পারব না কেন বলুন তো।
এবার শুনুন আমার কর্ণেন্দ্রিয়ের করুণ
কাহিনী। আমার বয়েসী লোকেরা বোধ হয় এই ইন্দ্রিয়টির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর----কাণে
কম শুনি, অর্থাৎ কাণে কালা, এর চেয়ে বড়
অপমান যেন আর নেই। আগে হাসতাম এনিয়ে, যখন অন্য কাউকে রেগে উঠতে দেখতাম ‘কালা’ বলাতে। এখন আমি নিজেই
রেগে উঠি---আমাকে সেই একই অপবাদ শুনতে হচ্ছে বলে। আমার বড় ছেলে আর
বৌমা দুজনই সুর মিলিয়ে বলার চেষ্টা কচ্ছিল গত দুতিন বছর ধরে যে আমার উচিত হবে কোনও
নামকরা কর্ণচিকিৎসকের কাছে যাওয়া। ইঙ্গিতটা ভাল লাগত
না বলে আমি উল্টো চোখ রাঙ্গিয়ে বলতামঃ আমার কাণের কোন ত্রুটি নেই, যত ত্রুটি তোমাদের
উচ্চারণে। এভাবে মুখের ভেতরে কথা জড়িয়ে রাখলে কার বাবার সাধ্য বারবার ‘পার্ডন মি পার্ডন মি’ না করে মাথামুণ্ডু
কিছু বোঝা। আমার গোঁয়ার্তুমি দেখে তারা আশা ছেড়ে দিয়েছিল কিছুদিন পর। এখন আমার নাতি(১৭)
আর নাতনি(১৩), বিশেষ করে মুখরা নাতনিটি, কথায় কথায় আমাকে খোঁটা দিতে শুরু করেছে আমার
শ্রবণশক্তি নিয়ে। এদের রসিকতা দেখে আমার মনে পড়ে যায় সেই পুরনো দিনের গল্প। কোলকাতার এক সাপ্তাহিক
কাগজে একটা কার্টুন দেখেছিলাম দুজন প্রতিবেশী কালা বন্ধুকে নিয়ে। এক কালা বেরিয়েছে
বাজারের থলে নিয়ে। দ্বিতীয় কালা তাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে বললেনঃ বাজারে যাচ্ছেন বুঝি?
প্রথম কালাঃ না, একটু বাজারে যাচ্ছি।
দ্বিতীয় কালাঃ অ, আমি ভাবলাম বাজারে যাচ্ছেন বুঝি।
মনে পড়াতে উপকার হল। নাতি-নাতনির সঙ্গে আমি নিজেও এখন হাসতে পারছি। অবশেষে মস্তিষ্কে
প্রবেশ করেছে যে সত্যি সত্যি একটা সমস্যা আছে আমার কাণদুটিতে। ডাক্তার দেখানো
দরকার, তাতে সন্দেহ নেই। ডাক্তারবদ্যি এমন কোন নতুন জিনিস নয় আমার জন্যে। আমার বয়সী লোকেদের
বেলায় দিবারাত্রির একটা বড় অংশই তো কাটে ডাক্তারের অফিসে আর ওষুধের হিসাব রেখে। কোন্টার কত ডোজ,
এক ওষুধের সঙ্গে আরেকটা মিশে গেল কিনা, কোন ওষুধ কোন্ বেলা খেতে হবে, ভাত খাবার আগে
না পরে, ভাইরে, এ বড় কঠিন হিসাব। বুড়োরা বসে বসে ঝিমায় সারাক্ষণ ভেবেছেন? মোটেও না। এতসব ওষুধের হিসাব
রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। বয়স হোক, বুঝবেন।
সৌভাগ্যবশত এখনও হাঁটু বা কোমর মেরামতের
দরকার পড়েনি। শুনেছি হাঁটুর ব্যথা যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলে তখন হাড়ের ডাক্তাররা
করাত দিয়ে কেটে ইস্পাতের হাঁটু বসিয় দেন সেখানে লোহাবল্টুর সাহায্যে। ডাক্তারদেরও যে
কাঠুরে আর কামলার কাজ করতে হয় মাঝে মাঝে সেকথা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাণে গেলে তাঁরা
হেসে লুটোপটি যেতেন। হাঁটুর মত কোমরেরও প্রায় একই খবর। কোমর মানে পশ্চদদেশে
যে বড় বড় পাত থাকে দুটি, যাকে আমরা সুন্দরি মেয়েদের ক্ষেত্রে নিতম্ব বলে অভিহিত করে
থাকি, সেগুলো বার্ধক্যের ভার সবসময় সইতে পারেনা। শুনেছি কারো কারো
বেলায় হাড়গুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে এমন অবস্থায় দাঁড়ায় যে সেগুলোকে না বদলালে হাঁটাচলা করা
অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন সেই একই ঘটনা----আবারও করাত-কুড়ালের ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয়। অনেকটা বডিশপে
গিয়ে ভাঙ্গা গাড়ি জোড়া লাগানোর মত। আসলেও তাই। আমাদের বয়সে শরীরটা রদ্দিমার্কা পুরনো গাড়ির মতই হয়ে যায়----বারবার
গ্যারাজে নিয়ে যাও, পার্টস বদল কর, তেল ভর ঘনঘন, রেডিয়াটার পরীক্ষা কর দিনে একবার। খামোখা বলিনি ভাই
যে আমি যেন শরীরের বাইরে বাস করা কোনও ভিনজগতের এলিয়েন।
তবুও বলি অনেকের তুলনায় আমি হাজারো
ভাগ্যবান। নিজের নাসারন্ধ্র দ্বারা বায়ু সেবন করতে পারছি এখনও কেবল তা’ই নয়, সবচেয়ে বড়
আশীর্বাদ আমার যে আমার মস্তিষ্কটি এখনও পুরোপুরি
অচল হয়ে যায়নি। আমি এখনও আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হতে পারছি, বাগানের সদ্যফোটা ফুলের
কাছে এসে মৌমাছিদের আনন্দমেলা উপভোগ করতে পারছি, পারছি হ্রদের জলে বালকের ঢিল ছোড়ার
শব্দ শুনে উদ্বেলিত হতে। আমি এখনও অঙ্ক কষে কঠিন ধাঁধার সমাধান বের করতে পারছি, পেপার
লিখে গাণিতিকদের সম্মেলনে গিয়ে উপস্থাপন করতে পারছি----সেখানে কেউ আমার পেপার পড়া দেখে
বয়সের কথা ভাবছে না, ভাবছে তাতে বিষয়বস্তু কিছু আছে কিনা কোনও। মানুষ কখনোই বৃদ্ধ
হয় না যতক্ষণ সে সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারে। একটু আগে যে আমেরিকান
কমেডিয়ান জর্জ বার্ন্সের কথা বললাম, তিনি আরেক জায়গায় বলেছিলেনঃ যতদিন মানুষ কাজ নিয়ে
থাকে ততদিন তার পক্ষে বুড়ো হওয়া সম্ভব নয়। আমি বুড়ো ছিলাম যখন আমার বয়স ছিল একুশ এবং আমি ছিলাম বেকার। এখন আমি আশি বা
নব্বুই, কিন্তু বুড়ো নই, আমি ব্যস্ত, বার্ধক্য নিয়ে ভাববার সময় আমার নেই।
আমি বার্ন্স সাহেবের মত মঞ্চাভিনেতা
নই। আমি লিখি, পড়ি, গান শুনি, রান্না করি, ঘর গুছাই, জানালার পর্দা তুলে পাখিদের
ডালে-ডালে অকারণে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখি। আমি ঘুরে বেড়াই দিকবিদিকে, দেশ থেকে দেশান্তরে, প্রাণ থেকে
প্রাণান্তরে। ভালোলাগা মানুষদের হৃদয়ে হৃদয়ে, দুয়ারে দুয়ারে আমি ভিক্ষার পাত্র নিয়ে যখন তখন
উপস্থিত হই। আমি মৃত্যুঞ্জয়। আমি আকাশে উড়ি, জলেতে ভাসি, স্বপ্নেতে বিভোর হই। আমি একঝুড়ি আনন্দ,
একফোঁটা অশ্রুমাখা স্নিগ্ধ হাসি পেলেই উল্লসিত হয়ে উঠি----পরম কৃতজ্ঞতায় অর্ঘ্য নিয়ে
যাই চিরসুন্দরের পুণ্যমন্দিরে।
আমি জানি আমি অজ্ঞ, তাই জ্ঞানই আমার
একমাত্র উপাসনা। অন্তহীন এর ভাণ্ডার। যত পাই তার কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি যেন হারাই বারবার। জ্ঞানদেবতার একি
অদ্ভুত খেলা জানিনা, কিন্তু এই খেলার মাতনে আমি যেন আজীবন মেতে থাকতে পারি। আমার অজ্ঞতার পরিসরটুকু
যদি জেনে যেতে পারি শেষবিদায়ের আগে, ভাবব, এজীবন সার্থক হয়েছে। এই সীমানার সন্ধানই
যেন হয় আমার শেষ প্রার্থনা।
ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট নামক এক প্রসিদ্ধ
ব্যক্তিও জর্জ বার্ন্সের মত একশ’ বছর বেঁচেছিলেন। তাঁর একটা মূল্যবান
উক্তি ছিল এরকমঃ বয়স যত বাড়ছে জীবন যেন ততই আনন্দময় হয়ে উঠছে।
তবে এজীবন অর্থহীন, অর্থাৎ মৃত বা জীবিত তাতে কিছু আসে যায় না, যদি তার কৌতূহল নামক
অমূল্য জিনিসটি মরে যায়, যদি তার উৎসাহ থাকে না নতুন
কিছু জানবার শিখবার। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে মৃত্যু বলতে বোঝায়ঃ জ্ঞানাকাঙ্খার
মৃত্যু, কৌতূহলের মৃত্যু। দৈহিক মৃত্যু একটা লৌকিকতা মাত্র-----নেহাৎ জৈবিক নিয়মের অনিবার্য ঘটনা। সত্যিকার মৃত্যু
দৈহিক নয়, আত্মিক।
আমেরিকার বিখ্যাত প্রধান বিচারপতি
আর্ল ওয়ারেন( ১৮৯১-১৯৭৪) ঠিক একই সুরে বলেছিলেন যে, হাজার রোগশোক দুঃখকষ্ট সত্বেও,
মানুষ তার চরম অবক্ষয়ের পরও, অত্যন্ত সুস্থ সুন্দর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে যদি
সে নির্ভয়ে গ্রহণ করতে পারে পরিবর্তনের ধারা, যদি অনির্বান থাকে তার বুদ্ধিবৃত্তিক
অনুসন্ধানের প্রজ্জ্বলিত শিখা, যদি থাকে তার
বিপুল কৌতূহল বিপুলতর ঘটনার প্রতি, সাথে সাথে থাকে পরম তৃপ্তি যৎসামান্য প্রাপ্তিতে।
মীজান রহমান
স্ট্যাটেন আইল্যাণ্ড, নিউ ইয়র্ক
৬ই সেপ্টেম্বর, ‘১২
মুক্তিসন ৪১
No comments:
Post a Comment