নাজনীন সীমন
যাযাবর শব্দের অর্থ যাদের নির্দিষ্ট থাকার জায়গা নেই, খাদ্যের সন্ধানে মূলত
যারা একস্হান থেকে অন্য স্হানে ক্ষণস্হায়ী বসত গাড়ে এবং খাবারের সংস্হান করতেই
আবার পথে নামে। লোহা ও ব্রোন্জ ধাতুর আবিষ্কার এবং কৃষিকাজে সম্পৃক্ত হবার আগ
পর্যন্ত মানুষ যাযাবরই ছিলো। পশু শিকার করে চলতো তাদের জীবন; তাই তাদের পেছনেই বলা
চলে চলতো এদের যাযাবর জীবন। নারীর জীবনের সাথে মানবেতিহাসের সে সময়টার অদ্ভুত এক
মিল রয়েছে। বর্তমানে পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর সাথে অতোটা না হলেও এখন পর্যন্ত
প্রাচ্যের বেশীর ভাগ দেশে এ সাযুজ্য ভীষণ ভাবে চোখে খোঁচা দেয়।
পূর্বেকার মতো এখন মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে পরিবারের সবার মুখ অতোটা ছাইবর্ণ
ধারণ করে না, মায়ের উপর অত্যাচার শুরু হয়না, বা কন্যা সন্তানকে লেখাপড়া থেকে
বঞ্চিত করা হয় না। বেশীর ভাগ জায়গায় বাল্যবিবাহ আইন করে বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মেয়েরাও তাদের অবস্হান তৈরী করে নিতে পারছে যেটা অত্যন্ত
সুখকর যদিও বলা বাহুল্য এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী বিয়ের পর বেছে নেন
কেবল সংসার জীবন অথবা বাধ্য হন তা করতে। তবে যে পরিবর্তন এখনো আসেনি, সেটি হোল
বিয়ে প্রথা এবং বিয়ের পরবর্তী সময়ে বধূরুপী নারীর জীবন যাপন পদ্ধতি। বিয়ের সময়
এখনো কন্যার পিতা, পিতার অবর্তমানে পরিবারের শীর্ষস্হানীয় অন্য কেউ, অধিকাংশ
ক্ষেত্রে পুরুষাত্নীয় সম্প্রদান বা হাওলা করে দেন তাদের মেয়েকে নতুন জামাইয়ের হাতে
অর্থাৎ তার দেখভালের দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয়, সাথে তার ভরণ পোষণের দায়িত্বেরও হাত
বদল হয়। এ দায়িত্ব সকল পুরুষ যে সঠিকভাবে করেন, তা অবশ্যই নয়। তবে এভাবেই শুরু হয়
নারীর যাযাবর জীবন।
শিশু জন্মের পর বেড়ে ওঠে মা বাবার সাথে অর্থাৎ বাবার সংসারে যেহেতু বাবাই
হর্তাকর্তা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে। বাবাই নিশ্চিত করেন তার মাথার উপরের ছাদ, পরনের
বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, এবং সর্বোপরি খাদ্য। মা অর্থ সংস্হানে নিয়োজিত থাকলেও
নগণ্য কিছু ব্যতিক্রম ভিন্ন পিতাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা থাকেন। কন্যাটি বড় হতে থাকে
অসংখ্য বাধা বিপত্তি কটুক্তি এবং পারিবারিক ভয় ভীতি আশন্কা পেরিয়ে। ভয়ের প্রথম
কারণ, কন্যার জন্য যদি পারিবারিক মান সম্মান বিঘ্নিত হয়; দ্বিতীয়টি হোল এ কন্যাদায়
থেকে মুক্তিচিন্তা অর্থাৎ তাকে কিভাবে
‘সৎ’ পাত্রস্হ করা সম্ভব তথা একটি ‘উপযুক্ত’ ছেলের হাতে তার যাবতীয় দায়িত্ব কোন
উপায়ে সুষ্ঠুভাবে হস্তান্তর করা যায় সে ভাবনা।
আর এই দায়িত্ব বদলের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নারীর যাযাবর জীবনের দ্বিতীয়
অধ্যায়; প্রথম অধ্যায় তথা পিতৃগৃহ অধ্যায় সুপ্ত থাকে। অসংখ্য বিষয়ের উপর নির্ভর
করে এর পরের জীবন কোন দিকে ধাবমান হবে এই নতুন চলার পথ। কেউ যদি সুগৃহিণী, সুমাতা
হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, ধৈর্য্য সহ্যের গভীর সাগর হতে পারেন, কানে
তুলো পিঠে কুলো মুখে ঠুলি সম্মান বোধের দরজায় তালা লাগিয়ে থাকতে পারেন, তো তিনি
তার সংসারে স্হায়ী বাসিন্দা হতে পারেন। অন্যথায় বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তাঁকে পথে নামতে হবে
আবার নতুন ঠিকানার সন্ধানে। আর এই খোঁজার নিমিত্তে তাঁর অস্হায়ী ঘাঁটি পিত্রালয়।
সেখান থেকেই রচিত হয় তাঁর নতুন বাসস্হানের ঠিকানা। আবার বিয়ের পর কোন নারী যদি
বিধবা হন, সে ক্ষেত্রেও বেশীর ভাগ সময়ে তাঁকে থাকার নতুন জায়গা খুঁজতে হয়।
বিধবা হয়ে নারীর যাযাবর জীবনের পুনরাবৃত্তির আবার একাধিক ভাগ রয়েছে: তিনি
মৃত স্বামীর সংসারেই গলার কাঁটা হয়ে থাকতে পারেন নিগৃহীত হয়ে, পিতার সংসারে ফিরে
এসে ভাই বউয়ের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে, পুনর্বিবাহ করলে নতুন স্বামীর বাড়ী, নিজের পুত্র
সন্তান থাকলে সে বড় হবার পর তার ঘর, একাধিক পুত্র সন্তান থাকলে পালাক্রমে
প্রত্যেকের ঘর হতে পারে তাঁর থাকার জায়গা। এটিও নির্ভর করছে সন্তানের আর্থিক
সঙ্গতি, পুত্রবধুর (ক্ষেত্রবিশেষে) ইচ্ছের উপর। আবার নারী যদি ‘পরকীয়া’ সম্পর্কে
জড়িত হন, তবে তাঁর বাড়ী আবার বদলে যায় এ সম্পর্কের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ঘটাতে গিয়ে। তাই নারী প্রকৃত অর্থে কখনো খোলা মনে বলতে পারেন না,
“আমার বাড়ী”। বাড়ীটি আসলে হয়তো ‘বাবার বাড়ী’, নয়তো ‘ভাইয়ের বাড়ী’, অথবা ‘স্বামীর
বাড়ী’, কিংবা ‘শ্বশুর বাড়ী’। যেহেতু তাঁর নিজস্ব কোনো ঠিকানা থাকেনা, তাই বিবাহ
পরবর্তী সময়ে দেখা যায় রাগ বা অভিমান করে স্বামীর বাড়ী থেকে বাবার বাড়ী ছুটে যান।
নারীর যে নিজের কোনো বাড়ী নেই তার বড় প্রমাণ হলো তাঁর স্বামী বা শ্বশুর
বাড়ীর লোকেরা কারণে বা অকারণে তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারেন; কিন্তু একজন
পুরুষকে বের করে দেয়ার অধিকার নারীর থাকে না যেহেতু স্হান বদল হয় তাঁর, পুরুষটির
নয়। এমনকি নার্সারী থেকে কিনে আনা গাছেরও খানিকটা নিজের মাটি থাকে, কিন্তু সমাজ
নির্মিত অনুশাসনে নারী নিতান্তই পরগাছা—পুরুষ নামক গাছকে আশ্রয় করে তাঁর বেড়ে ওঠা,
স্বপ্ন দেখা।
এসব কিছুর পর যখন জীবনের চূড়ান্ত মুহূর্তে শেষ ঠিকানার প্রয়োজন, সেটিও
নারীর জন্য নির্মিত হয় একজন পুরুষের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়। কবরের উপর মৃতার নামের
নীচে থাকে স্বামীর নাম; আর কুমারী কন্যার ক্ষেত্রে থাকে তাঁর পিতার নাম ঠিক
ব্যাকটেরিয়ার মতো। সু বা কু, যে কোন ব্যাকটেরিয়ার জন্যই যেমন জীবিত কোষ প্রয়োজন,
একই ভাবে জীবিত বা মৃত, নারীর জন্য প্রয়োজন পুরুষ নামবাহী ছাতা। সব মিলিয়ে পুরুষের
আশ্রয়েই তৈরী হয় নারীর জীবন এবং মৃত্যুর পরও সেই স্বৈরাচারী নিবাস থেকে তাঁর মুক্তি
হয়না। যাযাবর জীবন শেষ করেও নারী কেবল একজন “মেয়েমানুষ” ই রয়ে যান; মৃত নারীও
পুরুষের আশ্রয়াধীন থাকেন।
পশ্চিমা বিশ্বে দেখা যায় আইন করে নারীর অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। স্বামীর মোট
আয়ের ৬০ ভাগ পর্যন্তও স্ত্রী পেয়ে থাকেন দেশ ভেদে। তার চেয়ে বড় কথা, যেহেতু এশীয়
বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো নারীকে একজন পুরুষের হাওলা করে দেয়া হয়না, এবং
নারীরা বিয়ের আগেই স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন, তাই পিত্রালয় থেকে তারা আসেন নিজ গৃহে
যেখানে তাঁর ও জীবন সঙ্গীর সমান অংশীদারীত্ব। ইচ্ছে করলেই স্বামী তাঁকে তাড়িয়ে
দিতে পারেন না বাড়ী থেকে কিছু ব্যত্যয় ব্যতীত। ফলতঃ যাযাবর জীবনের প্রতিফলন এই
সমাজে অনেকাংশে কম দেখা যায়।
প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এ পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব এবং তা অপরিহার্যও বটে। এর
জন্য প্রয়োজন কেবল সুশিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলা যেখানে বিয়ে হবে দু’জন পূর্ণ বয়স্ক
আত্ন নির্ভরশীল নারী পুরুষে এবং নারীর আত্নসম্মান বোধ জাগ্রত করা। নারী কোনো পণ্য
নয় যে এক একজনের কাছে একেক রকম দায়িত্ব থাকবে তাঁকে পরিচালনা বা রক্ষা করার যেমন
নাকি কারখানায় দেখা যায় কেউ বোতলে ভরছেন খাদ্যদ্রব্যটি, কেই ছিপি আঁটছেন, কেউ
নামের কাগজ সাঁটছেন। নারীও একজন ব্যক্তি, একজন মানুষ। তাঁর দায়িত্ব গাধা সমাজের
বওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, বরং দরকার লিঙ্গ বৈষম্যের অশ্লীল অযৌক্তিক ছায়ামুক্ত
পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে ঘরে বাইরে কেবল মানুষেরই আনাগোনা থাকবে।
ফ্রেড্রিক নীটশে বলেছেন, “স্বাধীনতার মানে হচ্ছে নিজেদের প্রতি দায়িত্বশীল
হবার প্রত্যয়” (Freedom is the will to be
responsible to ourselves)। নারীর যাযাবর জীবনও
শেষ হতে পারে এই দৃঢ় প্রত্যয়ের মাধ্যমে এবং এতে পুরুষের তো বটেই, নারীর করণীয়ও অতি
প্রয়োজন।
নাজনীন সীমন
::
No comments:
Post a Comment