Sunday, 31 May 2020

অশনি সংকেতের অঙ্ক

 দুইটি অঙ্ক। একটি যোগ, অন্যটি বিয়োগ।

- "এক মুজাহিদ জেহাদের ময়দানে প্রথম দিন ২৪জন, দ্বিতীয় দিন ১৮জন এবং তৃতীয় দিন ১২জন শত্রুকে মেরে ফেলল। তিনি মোট কতজন শত্রুকে মেরে ফেলল?"
- "তোমার শত্রুরা ৬৫ মাইল দূরে আছে। তোমার অস্ত্র ৬২ মাইল পর্যন্ত পৌঁছাবে। আর কত মাইল এগিয়ে গেলে তোমাদের অস্ত্র তাদেরকে আঘাত করবে?"

এই অঙ্ক দুইটি পড়ার পরে কি ভাবছেন আপনি? হ্যাঁ এটাই অঙ্ক। কওমী মাদ্রাসা পাবলিকেশন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত কওমী মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত যোগ বিয়োগ অঙ্ক। একটি শিশু পাঁচ কিংবা ছয় বছর বয়সে স্কুলের চৌকাঠে পা রেখে যোগ বিয়োগ অঙ্ক শেখার মধ্য দিয়ে পরিচিত হচ্ছে শত্রু, অস্ত্র ও যুদ্ধের সঙ্গে। অর্থাৎ শিশু শিখছে তাকে মুজাহিদ হতে হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে! অস্ত্র চালনা শিখতে হবে! মারতে মারতে সে গুনবে কতজনকে মেরেছে, কতজন মরেছে? প্রশ্ন হলো, কে কার শত্রু? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? মানুষের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ? যে কোন কারণ কিংবা যত বড় অপরাধ মানুষ করুক না কেন, তাকে হত্যা করার অধিকার কি মানুষের আছে? মানুষ হত্যা করে মানবতার বিরুদ্ধে শিক্ষা, এটা কি বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান পরিপন্থী নয়? ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তির ভেতরে অশান্তির বীজ রোপন করে চলেছে কারা? তারা কেন ইসলামের শত্রু নয়? ধর্মের নামে এই কওমী মাদ্রাসা প্রদীপের সলতের মধ্যে যে আগুনের শিখা জ্বালছেন তাতে গোটা বাংলাদেশ একদিন জ্বলে পুড়ে ছাইভস্ম হতে বাধ্য

আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, ১ জুলাই ২০১৬ ঢাকার গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান এর লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। পরের দিন সকালে পাঁচজনের নাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নিব্রাস ইসলাম, আন্দালিব আহমেদ, রাইয়ান মিনহাজ, মীর সামি মোবাশ্বির সকলেই 'ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী' বা আইএসআইএস এর সদস্য ছিল বলে জানা যায়। ধর্মের নামে কতজন সন্তান বিপথে পা দিয়েছিল। সেদিনের সে ঘটনায় কতগুলো মানুষের প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছিল? এখন আপনারা বলতেই পারেন, তারা তো মাদ্রাসা ছাত্র ছিল না। তার তো ধনীর ঘরের দুলাল ছিল, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া শিক্ষিত যুবক ছিল। তারা কেন সন্ত্রাস করলো? আপনারাও একবারও এটা ভাবছেন না, কে বা কারা তাদের ভেতরে ধর্মের নামে জেহাদ এবং জেহাদ মানে মানুষ হত্যা করতে শেখাল? ধর্মীয় জেহাদে কেন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে শেখায় না? কেন এরা আমাদের সন্তানদের ধর্মের নামে খুন খারাবি করতে শেখায়? এর সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আজকের বাবা-মায়েরাও পরোক্ষ ভাবে দায়ী, আপনাদের সরল বিশ্বাস দায়ী। কেন, কিভাবে? কেউ ধর্ম মানলে বা পালন করলে তাকে মানুষ ভাল বলে, তার প্রতি মানুষের ভাল ধারণা তৈরি হয়। বাবা-মায়েরাও নিশ্চিন্ত থাকেন যে আমাদের সন্তান খারাপ কিছু করছে না। ধর্মের মধ্যে থাকলে মানুষ থাকে। আপনাদের সরলতা ভাল, কিন্তু আপনারা এটা খেয়াল করেন না, আপনার সন্তানদের আচরণ ও ব্যবহারে দৈনন্দিন জীবনে কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা! পরিবর্তন হলেও তা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক! ধর্ম পালন, মানা বা না মানা প্রত্যেক মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। একটি পরিবারের সকলেই সমানভাবে ধর্ম বিষয়ে ভাবে না মানে ধর্ম বিষয়ে কেউ খুব বেশী সক্রিয় কেউ বা নিস্ক্রিয়। কাউকে ধর্ম পালন করতে বাধ্য করার অধিকার আপনার ধর্ম গ্রন্থের কোথাও লেখা হয়নি। আপনি বড়জোর কাউকে ধর্মীয় রীতিনীতি মানতে উৎসাহিত করতে পারেন। কিন্তু শাস্তি কিংবা কোন কিছুর ভয় বা লোভ দেখিয়ে ধর্ম মানতে এবং পালন করতে বাধ্য করতে পারেন না। হোলি আর্টিজান ঘটনার পরেও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে ধর্মের নামে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বহু প্রাণ অকালে ঝরে গেছে। কারো টনক নড়েছে কি? ঘটে যাওয়া হৃদয় বিদারক এসব সন্ত্রাসী ঘটনার পরেও আমরা সচেতন হয়েছি কি? আমাদের সন্তান বিষয়ে আমরা কি ভাবছি? বর্তমানে এরা নিষ্ক্রিয়, যে কোন সময় আবার এই সন্ত্রাস জেগে উঠতে পারে, এটা ভাবা অমূলক নয়। ধর্ম পালন, ধার্মিক বা ধর্মভীরু হওয়া দোষের নয়। কিন্তু আমাদের উদাসীন মনোভাব, অপরিকল্পিত সাংসারিক জীবন, আমাদেরকে পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে পৃথক করে, কেউ কারো খবর রাখি না। এই পৃথক থাকাকে আমরা স্বাধীনতা বলে ভাবি ও এই স্বাধীনতাকে ভালবাসি। ফলে, আমাদের ভুল কর্ম ধরিয়ে দেয়ার কেউ থাকে না, এভাবেই আমরা ভুল করতে করতে অন্যায়, পরে অপরাধ জগতে পা দেই। ফলে, আমাদের মতবাদ, আমাদের বিশ্বাস সন্ত্রাসবাদ জঙ্গীতে পরিণত করে এবং অপরাধের পাহাড় কাঁধে নিয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হই

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। কোন শিশুকে জগত সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। বয়স অনুযায়ী শিশু বুদ্ধি ও চিন্তার বিকাশের উপযোগী শিক্ষা পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কেননা শিক্ষা একটি প্রক্রিয়া মাত্র। এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে জগতে সকল বিষয় সমূহের সঙ্গে। যাতে ক্রমশ শিশুর মনোজগতের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। যেন সে ভাল ও মন্দ চিনতে, জানতে, বুঝতে পারে। কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে পারার ক্ষমতা বা তাকে সৃষ্টিশীল করে তোলার উপযোগী শিক্ষা শিশুকে দিতে হবে, যাতে সে এই পৃথিবীর একজন মানুষ হিসেবে তার ভেতরে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। সমাজের মানুষ হিসেবে সে যেন সামাজিক প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। নেতিবাচক চিন্তা থেকে খল তৈরি হয়, ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠে তারা। কেননা খলেরা শুধুমাত্র অন্যকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে না বরং তারা নিজেরাও ধ্বংস হয়ে যায়

অনেক অভিভাবক আছেন, যারা সন্তাদের মাদ্রাসায় পড়াতে আগ্রহী এবং সরল বিশ্বাসে মাদ্রাসায় সন্তানকে ভর্তি করান। তারা একটু ভেবে দেখবেন, আপনাদের সরল ধর্মানুভূতিকে পুঁজি করে একদল ধর্মের নামে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবসায়ীরা আপনাদের সন্তানকে একজন ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পরিবর্তে একজন সন্ত্রাসী তৈরি করছেন কি না!

এসব কথা লেখায় আপনাদের বিশেষ অনুভূতিতে আঘাত প্রাপ্ত হতেই পারেন! আমি যদি আপনাদের এহেন কর্মকাণ্ড দেখেও এড়িয়ে যাই, তবে আমার শিক্ষকগণ, যারা আমাকে ভাবতে, জানতে, শিখতে ও যুক্তি সহকারে কথা বলার শিক্ষা দান করেছেন, তবে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। যদি শিশুদের ধর্ম শিক্ষার নামে অস্ত্র চেনানো, যুদ্ধ-সন্ত্রাস-ধর্মীয় স্বাধীনতা/পরাধীনতা শেখানোর অধিকার আপনাদের থাকে, তাহলে একটি সন্ত্রাস মুক্ত সুন্দর পৃথিবীর জন্য আপনাদের অপশিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকারও আমার আছে এবং থাকবে। আমার লেখা ও বলার উদ্দেশ্য ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, ধর্মের নামে সন্ত্রাস শিক্ষা ও জঙ্গীর বিরুদ্ধে। শিশু সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে কুশিক্ষায় শিক্ষিত করার অধিকার আপনার কিংবা আমার, আমাদের কারোরই নেই। বর্তমানের বাবা-মায়েরা শিশুদের প্রতি যত্নবান হউন, সন্ত্রাসী জঙ্গীর পিতামাতা হিসেবে আপনার নাম যেন ইতিহাসে লিপিবদ্ধ না হয়


ভায়লেট হালদার,
বার্গেন, নরওয়ে।

৩১ মে, ২০২০  
বাংলা ১৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৭

ভায়লেট হালদার :: Violet Halder

যোগ অঙ্ক

বিয়োগ অঙ্ক

প্রথম শ্রেণির অঙ্ক বই

PC: Violet Halder, Facebook, 20200531
PC: Math Book Pictures: Facebook 20200415
Last Edited: 20200531

Last Updated: 20200531

No comments:

Post a Comment