নাজমীন চৌধুরী
হঠাৎ মনে হোলো ওরা ঘরের বাইরে আসতে পারে; আগে থেকেই একটু খাবার দিয়ে রাখি! বারান্দার নীচে খরগোশ পরিবারকে গাঁজর দেবার গোপন প্রয়াস। তাপমাত্রা দশে (১০ সেলসিয়াস) উঠেছে আজ; আর আবহাওয়াও খুব ভালো। আমাদের খরগোস প্রতিবেশীদের সাথে সখ্যতা করতে চেয়েছিলাম এর আগেও, বেশ ক’বার; কিন্তু ওরা দ্বিমত পোষন করেছে, প্রতিবারই। এরপর আমি খ্যান্ত দিয়েছি। তবে আমি চুপি চুপি খাবার দিই আর ওরা চুপি চুপি খেয়ে যায়। কখনও চোখা চোখি হলো তো রক্ষা নেই। তেড়ে দৌড়ে আড়ালে ছোটে! ছুটটা নিজের ঘরেও দেয় না; একদম গেটের নিচ দিয়ে বের হয়ে কোথাও চলে যায়। মনের ভয় কাটলে তবে ফিরে আসে। আমি বুঝি, জোর করে বন্ধুত্ব করা চলে না।
গতরাতের বৃষ্টিও বরফ গলতে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। ঘাস জেগে উঠেছে আপন শক্তিবলে। শরতের সদ্য ঝরা পাতা মাটি আঁকড়ে ধরে যত্রতত্র ঘোষণা করছে ওদের অস্তিত্বের কথা।
এত সুন্দর বিকেল; চার দেয়ালের বাইরে কিছু একটা করা যায়! নিজেকে তৈরি করে হাঁটতে বের হলাম। অনেকদিন প্রতিবেশী পথ গুলোতে হাঁটা হয় না। হাঁটি আর সবিস্ময়ে এদিক সেদিক তাকাই। বরফের সাদা রঙই এখানে কাল একচেটিয়া রাজত্য করেছিল। হাঁটি, দেখি আর মাঝে মাঝে শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ শ্বাস নিই। বাড়ির সামনের গাড়ি গুলো সদ্য ধৌত কাঁচের গ্লাসের মত স্বচ্ছ! বৃষ্টিস্নাত! পাতাহীন গাছ-পালা গুলোও খুব তৃপ্তি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে পেলাম, প্রায় প্রতিটি গাছেই দুএকটা উন্মুক্ত পাখির বাসা। মনে হোল যেন সেগুলো অপেক্ষায় বসে আছে; যদি মালিক ফিরে আসে কোন এক বসন্তে! লিলিউডের শেষ মাথায় চার নম্বরের মানুষটি আচমকা মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে গোটা পড়শিকে জানান দিল, তাতে বিন্দুমাত্রও ভুল নেই! নভেম্বরের শেষান্তে সুন্দর আবহাওয়া পাওয়া দুস্কর; তাই মোটরসাইকেলে সেও একটুখানি ঢুঁ দেবে বোধ করি।
লিলিউড চুকিয়ে নিকলসন ধরে দক্ষিনে হাঁটছি; আশেপাশে তাকিয়ে দেখি শুধু আমিই, আমি ছাড়া আর কেউ নেই রাস্তায়। আরও খানিক্ষন হেঁটে একজনকে পেলাম। মই বেয়ে তাঁর ঘরের রুফ টপে উঠছে; হাতে একগাদা দড়িআঁটা বাল্ব। ক্রিস্টমাস উপলক্ষে লাইট দিয়ে বাড়ির চালা সাজাবে। মনে মনে ওঁকে আশীর্বাদ করলাম। মানুষের কত গুণ! কত কাজ করতে জানে এঁরা! ঠিক তক্ষুনি একটা গ্যারেজের দরজা পলোট মুড়িয়ে উঠে গিয়ে তিন/চারটি যুবকের অট্টহাসির ধ্বনি বাতাসে মিশিয়ে দিল।
হ্যাস্কেলের মোড়ে পা দিতেই নিমিষে একটা হাঁসফাঁশ শব্দে সচকিত হলাম। একশ ষাট নম্বর বাড়ির কুকুরটি ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়াই আমার কাছে পৌঁছে গেছে, আমি তখনো ওদের সীমানা থেকে দুই বাড়ি দূরত্বে। কুকুরটি আমার বাঁ হাতে পরা ম্যেপল পাতা অলঙ্কিত লাল গ্লভটা শুঁকে নিয়ে আমার দিকে তাকালো। ইতিমধ্যে প্রভু উচ্চকন্ঠ্যে - রাইলি! হোম, নাউ!!
আমিও একমত পোষণ করি, ‘গো হোম, রাইলি!’
আবার হাঁটছি। ইস, প্রতিটা দিন যদি এমন হতো! কোথাও ব্যস্ততার ছোঁয়া নেই। অথবা থাকলেও আমি তা দেখতে পাচ্ছি না। বেসিরভাগ বাড়ির পারকিং লটে গাড়ি বসে। যে দুএকটি বাড়িতে গাড়ি দেখছি না, তাঁদের টা হয়ত গ্যারেজে, কিংবা দোকান-পাটে বা রেস্তোরায় অথবা অন্য কোথাও। কিছু কিছু লোকজন ভ্রমনেও আছেন এখন; এসময় ভ্রমন বিলাস সাধারনত গরম দেশ গুলোতেই। তাঁদের সব আনন্দস্থান ও আমার মনপটে আঁকা বীচের কথা ভাবি, হাঁটি আর সতেজ শ্বাস টানি। চলছি আমি। মাঝে মধ্যে সান্ধ্য খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসেঃ উত্তপ্ত ওভেনের কড়া পোড়া গন্ধ, ক্ষুদা জাগানো বারবেকিউয়ের এরমা; এমনকি দারুচিনি দিয়ে মাংস রান্নার সুগন্ধও। কয়েক মুহূর্তেই ওয়েস্ট-পয়েন্ট ও ব্রুক-লেনের সন্ধিক্ষনে চোলে এসেছি। কানে এলো পাখির কলরব। কিচির মিচির শব্দের উল্লাস। চোখকান দিয়ে খুঁজতেই দেখি একটা ঘুঘু তার উষ্ণ পালকের নিচে ঘাড় গুঁজে লাইটপোস্টের 'পরে বসে আছে। একা। নড়া চড়া করছে না। বেশ শান্তিতে ঘুমোচ্ছে বলে মনে হোল। ওর শান্তি আমাকেও আশ্বস্ত করেছে বৈকি! আমি দাঁড়িয়েই আছি। ঘুঘুটাকে দেখছি। পাখির কলরব শুনছি। দশ-বার বছরের এক কিশোরী ওর কালো পুডল্কে কোলে নিয়ে কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টের পাই নি। পাখির কিচির মিচির শব্দের ভলিউম বেড়ে হৈহুল্লর পর্যায়ে উঠে যাচ্ছে, মুহূর্তে মুহূর্তে! আমরা শুনছি।
– হুম! পেয়েছি! এই তো, সিডার ঝোপে!
বাংলো বাড়িটার উত্তরপশ্চিম কোণের ঝোপএ এক ঝাঁক পাখি (খুব সম্ভবত সিডার ওয়াক্সউইং) নাচের তালে উড়ছে, সাথে কলরবও অটুট! গভীর শীত এড়াতে এই পাখিসব দক্ষিনে কবে যাবে, আদৌ যাবে কি না জানি না; তবে, আজ ওরা দলবেঁধে মহানন্দে চঞ্চল।
নভেম্বর ২৩/১৪
বিকেল ৫ টা
ক্যেম্ব্রিজ, অন্টেরিও, ক্যানাডা
গতরাতের বৃষ্টিও বরফ গলতে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। ঘাস জেগে উঠেছে আপন শক্তিবলে। শরতের সদ্য ঝরা পাতা মাটি আঁকড়ে ধরে যত্রতত্র ঘোষণা করছে ওদের অস্তিত্বের কথা।
এত সুন্দর বিকেল; চার দেয়ালের বাইরে কিছু একটা করা যায়! নিজেকে তৈরি করে হাঁটতে বের হলাম। অনেকদিন প্রতিবেশী পথ গুলোতে হাঁটা হয় না। হাঁটি আর সবিস্ময়ে এদিক সেদিক তাকাই। বরফের সাদা রঙই এখানে কাল একচেটিয়া রাজত্য করেছিল। হাঁটি, দেখি আর মাঝে মাঝে শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ শ্বাস নিই। বাড়ির সামনের গাড়ি গুলো সদ্য ধৌত কাঁচের গ্লাসের মত স্বচ্ছ! বৃষ্টিস্নাত! পাতাহীন গাছ-পালা গুলোও খুব তৃপ্তি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে পেলাম, প্রায় প্রতিটি গাছেই দুএকটা উন্মুক্ত পাখির বাসা। মনে হোল যেন সেগুলো অপেক্ষায় বসে আছে; যদি মালিক ফিরে আসে কোন এক বসন্তে! লিলিউডের শেষ মাথায় চার নম্বরের মানুষটি আচমকা মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে গোটা পড়শিকে জানান দিল, তাতে বিন্দুমাত্রও ভুল নেই! নভেম্বরের শেষান্তে সুন্দর আবহাওয়া পাওয়া দুস্কর; তাই মোটরসাইকেলে সেও একটুখানি ঢুঁ দেবে বোধ করি।
লিলিউড চুকিয়ে নিকলসন ধরে দক্ষিনে হাঁটছি; আশেপাশে তাকিয়ে দেখি শুধু আমিই, আমি ছাড়া আর কেউ নেই রাস্তায়। আরও খানিক্ষন হেঁটে একজনকে পেলাম। মই বেয়ে তাঁর ঘরের রুফ টপে উঠছে; হাতে একগাদা দড়িআঁটা বাল্ব। ক্রিস্টমাস উপলক্ষে লাইট দিয়ে বাড়ির চালা সাজাবে। মনে মনে ওঁকে আশীর্বাদ করলাম। মানুষের কত গুণ! কত কাজ করতে জানে এঁরা! ঠিক তক্ষুনি একটা গ্যারেজের দরজা পলোট মুড়িয়ে উঠে গিয়ে তিন/চারটি যুবকের অট্টহাসির ধ্বনি বাতাসে মিশিয়ে দিল।
হ্যাস্কেলের মোড়ে পা দিতেই নিমিষে একটা হাঁসফাঁশ শব্দে সচকিত হলাম। একশ ষাট নম্বর বাড়ির কুকুরটি ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়াই আমার কাছে পৌঁছে গেছে, আমি তখনো ওদের সীমানা থেকে দুই বাড়ি দূরত্বে। কুকুরটি আমার বাঁ হাতে পরা ম্যেপল পাতা অলঙ্কিত লাল গ্লভটা শুঁকে নিয়ে আমার দিকে তাকালো। ইতিমধ্যে প্রভু উচ্চকন্ঠ্যে - রাইলি! হোম, নাউ!!
আমিও একমত পোষণ করি, ‘গো হোম, রাইলি!’
আবার হাঁটছি। ইস, প্রতিটা দিন যদি এমন হতো! কোথাও ব্যস্ততার ছোঁয়া নেই। অথবা থাকলেও আমি তা দেখতে পাচ্ছি না। বেসিরভাগ বাড়ির পারকিং লটে গাড়ি বসে। যে দুএকটি বাড়িতে গাড়ি দেখছি না, তাঁদের টা হয়ত গ্যারেজে, কিংবা দোকান-পাটে বা রেস্তোরায় অথবা অন্য কোথাও। কিছু কিছু লোকজন ভ্রমনেও আছেন এখন; এসময় ভ্রমন বিলাস সাধারনত গরম দেশ গুলোতেই। তাঁদের সব আনন্দস্থান ও আমার মনপটে আঁকা বীচের কথা ভাবি, হাঁটি আর সতেজ শ্বাস টানি। চলছি আমি। মাঝে মধ্যে সান্ধ্য খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসেঃ উত্তপ্ত ওভেনের কড়া পোড়া গন্ধ, ক্ষুদা জাগানো বারবেকিউয়ের এরমা; এমনকি দারুচিনি দিয়ে মাংস রান্নার সুগন্ধও। কয়েক মুহূর্তেই ওয়েস্ট-পয়েন্ট ও ব্রুক-লেনের সন্ধিক্ষনে চোলে এসেছি। কানে এলো পাখির কলরব। কিচির মিচির শব্দের উল্লাস। চোখকান দিয়ে খুঁজতেই দেখি একটা ঘুঘু তার উষ্ণ পালকের নিচে ঘাড় গুঁজে লাইটপোস্টের 'পরে বসে আছে। একা। নড়া চড়া করছে না। বেশ শান্তিতে ঘুমোচ্ছে বলে মনে হোল। ওর শান্তি আমাকেও আশ্বস্ত করেছে বৈকি! আমি দাঁড়িয়েই আছি। ঘুঘুটাকে দেখছি। পাখির কলরব শুনছি। দশ-বার বছরের এক কিশোরী ওর কালো পুডল্কে কোলে নিয়ে কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টের পাই নি। পাখির কিচির মিচির শব্দের ভলিউম বেড়ে হৈহুল্লর পর্যায়ে উঠে যাচ্ছে, মুহূর্তে মুহূর্তে! আমরা শুনছি।
– হুম! পেয়েছি! এই তো, সিডার ঝোপে!
বাংলো বাড়িটার উত্তরপশ্চিম কোণের ঝোপএ এক ঝাঁক পাখি (খুব সম্ভবত সিডার ওয়াক্সউইং) নাচের তালে উড়ছে, সাথে কলরবও অটুট! গভীর শীত এড়াতে এই পাখিসব দক্ষিনে কবে যাবে, আদৌ যাবে কি না জানি না; তবে, আজ ওরা দলবেঁধে মহানন্দে চঞ্চল।
নভেম্বর ২৩/১৪
বিকেল ৫ টা
ক্যেম্ব্রিজ, অন্টেরিও, ক্যানাডা
Picture Credit: Vision Creates Value VCV
http://www.somoyerkonthosor.com/news/188598
ReplyDelete