জীবনভর গণিতের সাধনা
আমিই বাংলাদেশবাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে মানুষের সম্মিলিত ও ব্যক্তিগত চেষ্টায়। বাংলাদেশ মানে শুধু নেতিবাচক খবর নয়। দেশে ও বিদেশে নিজের কাজ দিয়ে যাঁরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন, তাঁদের কথা নিয়ে আমাদের এই আয়োজন
জীবনভর গণিতের সাধনা
হাসান ফেরদৌস | তারিখ: ২৯-০১-২০১৩
মিজান রহমান
এখন তাঁর বয়স ৮১। জীবনের অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করেছেন গণিত নামক দুর্বোধ্য এক শাস্ত্র অধ্যয়নে। মিজান রহমান মনে করেন, গণিত আছে প্রকৃতি ও মানব অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে। এর জটিল সূত্রগুলো উদ্ধার না হলে বিশ্বের অধিকাংশ জটিলতাই আমাদের অবোধ্য থেকে যাবে। এসব কথা ছাত্র ও নবীন বিজ্ঞানীদের বোঝানোর কঠিন এক নিরন্তর সাধনায় জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন কানাডা-প্রবাসী এই গণিত বিজ্ঞানী।
গণিতজ্ঞ হিসেবে মিজান রহমানের খ্যাতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলজুড়েই। জর্জ গ্যাসপারের সঙ্গে যৌথভাবে লিখেছেন বেসিক হাইপারজিও মেট্রিক সিরিজ নামের একটি বই। বইটি গণিত বিজ্ঞানের শাখা কিউ-সিরিজ ও অর্থোগোনাল পলিনোমিয়ালসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। ১৯৯০ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে একটি সবিস্তার পাঠ্যপুস্তক গণিতের অগ্রসর শিক্ষার্থীদের হাতে আসে।
অথচ একদম নবীন নয় গণিতশাস্ত্রের এই শাখা। ১৮৪৬ সালে জার্মান গণিতবিদ এডোয়ার্ড হাইন বেসিক হাইপার জিওমেট্রিক সিরিজ বিষয়ে বই রচনা করেন। এরও আগে আরেক জার্মান বিজ্ঞানী হাইনরিশ আউগুস্ট রথ ১৮১১ সালে কিউ-বায়োনোমিনাল থিয়োরাম নামে এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। বিশ শতকের দুই বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ভারতের রামানুজান ও জার্মানির আইনস্টাইনও একই বিষয়ে গবেষণা করেছেন।
২০০ বছর ধরে গণিতের এই শাখায় গবেষণা ও অধ্যয়নের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, মিজান রহমান ও জর্জ গ্যাসপার তাঁদের এই পাঠ্যপুস্তকে তা সহজবোধ্য ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রকাশের ২০ বছর পরও সেই গ্রন্থ অনন্য ও অপরিহার্য।
বেসিক হাইপার জিওমেট্রিক সিরিজের প্রায়োগিক কার্যকারিতা রয়েছে বিজ্ঞানের নানা শাখায়। পদার্থবিজ্ঞানে আলো ও শব্দের তেজ এবং কম্পনাঙ্ক পরিমাপ করতে হলে চাই উপান্তিক ধারণা (এপ্রক্সিমেশন)। সেই উপান্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে জিওমেট্রিক সিরিজের ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর। মহাকাশ গবেষণা থেকে আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তিতেও এই তাত্ত্বিক সিরিজের ব্যবহার অপরিহার্য।
বিশ্বখ্যাত গণিতজ্ঞ উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড এশকি মিজান রহমান ও জর্জ গ্যাসপারকে সিম্বলিক ক্যালকুলেশনের ক্ষেত্রে ‘মাস্টার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মিজান রহমান ও জর্জ গ্যাসপারের গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি মন্তব্য করেছেন, গণিতের এই শাখায় ‘এটিই শ্রেষ্ঠ বই’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন মিজান রহমান। গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর গবেষণা করেছেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একই বিষয়ে পিএইচডি করেছেন কানাডার নিউ ব্রানসউইক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চার বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পর ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত একটানা ৩৩ বছর কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষকতায় কাটিয়েছেন। কাগজে কলমে অবসর নিয়েছেন বটে, কিন্তু কাজ করা থামাননি। সম্মানিত ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে এখনো নিয়মিত কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, আন্তর্জাতিক গণিত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন, এখনো এই প্রায় অধরা শাস্ত্রের জটিল গ্রন্থিসমূহ উন্মোচনে নিরলস সাধনা করে যাচ্ছেন।
অটোয়া শহরে মিজান রহমানের বাসভবন থেকে টেলিফোনে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানালেন, স্কুল থেকেই গণিতে তাঁর আগ্রহ। সাহিত্যেও প্রবল আগ্রহ ছিল। লেখালেখি করে বন্ধু ও পাঠক মহলে খ্যাতিও জুটেছিল। কবি শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী তাঁর কাছের বন্ধু। মিজান রহমান একসময় দর্শন নিয়ে অধ্যয়নের কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেছে নেন পদার্থবিজ্ঞান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি অতিরিক্ত পাঠ্য বিষয় ছিল রসায়ন ও গণিত। ‘রসায়ন আমি দু চোখে দেখতে পারতাম না। বিরক্তি কমাতে একসময় অঙ্কের দিকেই ঝুঁকে পড়লাম।’
গণিত আসলে প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা, তার ‘কোড ল্যাংগুয়েজ’। প্রকৃতির আন্তসম্পর্কিত জটিলতা, তার গঠনপ্রণালি বুঝতে হলে গণিতের আশ্রয় নিতেই হবে বলে জানালেন তিনি। মিজান রহমান বললেন, ‘গণিত আসলে সর্বত্র। নদীর ঢেউ, গাছ ও পাতার বিন্যাস, শব্দতরঙ্গ অথবা মৃত্তিকার স্তরভেদ—এসবের জটিল গ্রন্থিসমূহ উদ্ধার করতে হলে গণিতের নিয়মতান্ত্রিকতা প্রয়োগ করতে হবে।’
আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: ab@prothom-alo.info
গণিতজ্ঞ হিসেবে মিজান রহমানের খ্যাতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলজুড়েই। জর্জ গ্যাসপারের সঙ্গে যৌথভাবে লিখেছেন বেসিক হাইপারজিও মেট্রিক সিরিজ নামের একটি বই। বইটি গণিত বিজ্ঞানের শাখা কিউ-সিরিজ ও অর্থোগোনাল পলিনোমিয়ালসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। ১৯৯০ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে একটি সবিস্তার পাঠ্যপুস্তক গণিতের অগ্রসর শিক্ষার্থীদের হাতে আসে।
অথচ একদম নবীন নয় গণিতশাস্ত্রের এই শাখা। ১৮৪৬ সালে জার্মান গণিতবিদ এডোয়ার্ড হাইন বেসিক হাইপার জিওমেট্রিক সিরিজ বিষয়ে বই রচনা করেন। এরও আগে আরেক জার্মান বিজ্ঞানী হাইনরিশ আউগুস্ট রথ ১৮১১ সালে কিউ-বায়োনোমিনাল থিয়োরাম নামে এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। বিশ শতকের দুই বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ভারতের রামানুজান ও জার্মানির আইনস্টাইনও একই বিষয়ে গবেষণা করেছেন।
২০০ বছর ধরে গণিতের এই শাখায় গবেষণা ও অধ্যয়নের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, মিজান রহমান ও জর্জ গ্যাসপার তাঁদের এই পাঠ্যপুস্তকে তা সহজবোধ্য ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রকাশের ২০ বছর পরও সেই গ্রন্থ অনন্য ও অপরিহার্য।
বেসিক হাইপার জিওমেট্রিক সিরিজের প্রায়োগিক কার্যকারিতা রয়েছে বিজ্ঞানের নানা শাখায়। পদার্থবিজ্ঞানে আলো ও শব্দের তেজ এবং কম্পনাঙ্ক পরিমাপ করতে হলে চাই উপান্তিক ধারণা (এপ্রক্সিমেশন)। সেই উপান্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে জিওমেট্রিক সিরিজের ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর। মহাকাশ গবেষণা থেকে আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তিতেও এই তাত্ত্বিক সিরিজের ব্যবহার অপরিহার্য।
বিশ্বখ্যাত গণিতজ্ঞ উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড এশকি মিজান রহমান ও জর্জ গ্যাসপারকে সিম্বলিক ক্যালকুলেশনের ক্ষেত্রে ‘মাস্টার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মিজান রহমান ও জর্জ গ্যাসপারের গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি মন্তব্য করেছেন, গণিতের এই শাখায় ‘এটিই শ্রেষ্ঠ বই’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন মিজান রহমান। গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর গবেষণা করেছেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একই বিষয়ে পিএইচডি করেছেন কানাডার নিউ ব্রানসউইক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চার বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পর ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত একটানা ৩৩ বছর কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষকতায় কাটিয়েছেন। কাগজে কলমে অবসর নিয়েছেন বটে, কিন্তু কাজ করা থামাননি। সম্মানিত ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে এখনো নিয়মিত কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, আন্তর্জাতিক গণিত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন, এখনো এই প্রায় অধরা শাস্ত্রের জটিল গ্রন্থিসমূহ উন্মোচনে নিরলস সাধনা করে যাচ্ছেন।
অটোয়া শহরে মিজান রহমানের বাসভবন থেকে টেলিফোনে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানালেন, স্কুল থেকেই গণিতে তাঁর আগ্রহ। সাহিত্যেও প্রবল আগ্রহ ছিল। লেখালেখি করে বন্ধু ও পাঠক মহলে খ্যাতিও জুটেছিল। কবি শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী তাঁর কাছের বন্ধু। মিজান রহমান একসময় দর্শন নিয়ে অধ্যয়নের কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেছে নেন পদার্থবিজ্ঞান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি অতিরিক্ত পাঠ্য বিষয় ছিল রসায়ন ও গণিত। ‘রসায়ন আমি দু চোখে দেখতে পারতাম না। বিরক্তি কমাতে একসময় অঙ্কের দিকেই ঝুঁকে পড়লাম।’
গণিত আসলে প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা, তার ‘কোড ল্যাংগুয়েজ’। প্রকৃতির আন্তসম্পর্কিত জটিলতা, তার গঠনপ্রণালি বুঝতে হলে গণিতের আশ্রয় নিতেই হবে বলে জানালেন তিনি। মিজান রহমান বললেন, ‘গণিত আসলে সর্বত্র। নদীর ঢেউ, গাছ ও পাতার বিন্যাস, শব্দতরঙ্গ অথবা মৃত্তিকার স্তরভেদ—এসবের জটিল গ্রন্থিসমূহ উদ্ধার করতে হলে গণিতের নিয়মতান্ত্রিকতা প্রয়োগ করতে হবে।’
আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: ab@prothom-alo.info
সৌজন্যে : প্রথম-আলো :
No comments:
Post a Comment