মীজান রহমান
কংগ্রেসের একটি সামরিক শাখা।
১৯৪৪ সালে নেলসন ম্যাণ্ডেলা যখন ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ
দেন তখন একই সাথে বন্ধু ট্যাম্বোও যোগ দেন। কংগ্রেসের নির্বাহ কমিটির সদস্য পদে
নিযুক্ত হলেন এসবি এমদা, সিসুলু, ট্যাম্বো ও ম্যাণ্ডলা। ট্যাম্বো আর ম্যাণ্ডেলার
বন্ধুত্ব কর্মক্ষেত্র ছাড়িয়ে পরস্পরের পারিবারিক জীবনেও পৌঁছে গিয়েছিল। ’৪৪ সালে
ট্যাম্বোর বিয়েতে বরযাত্রীর প্রথম সারিতে ছিলেন ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর বান্ধবী ইভলিন
মাসি। পরে তাঁদেরও বিয়ে হয়ে যায়, সেই একই বছর, যাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন
ট্যাম্বো ও তাঁর নববিবাহিত স্ত্রী।
কার চেষ্টায়, পুলিশপ্রধানের কাছে তাদের দাবিদাওয়া পেশ
করবে বলে। তারা, মানে পুলিশ, তখন তাদের ওপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। জনতা ছত্রভঙ্গ
হয়ে জান বাঁচাবার চেষ্টায় দৌড়ুতে থাকে। কিন্তু পুলিশ তাদের গুলি থামায়নি। অচিরেই
আন্দোলনকারি লোকগুলোর লাশ পড়ে যেতে থাকে রাস্তায়। অধিকাংশ লোককে গুলি করা হয়
পালাবার সময়, তাদের পশ্চাতদেশে। রাজপথ পরিণত হয় রক্তগঙ্গায়। গণনাশেষে নিহতের
সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯, আহত চার শতাধিক। আফ্রিকার ইতিহাসে ঘটনাটি ‘শার্পাভিল হত্যাকাণ্ড’ নামে অভিহিত।
একবার পরিচিত কাউকে এসে দেখা করতে দেওয়া হত, তা’ও ৩০
মিনিটের জন্যে। চিঠি লেখা বা চিঠি পাওয়ার অনুমতি ছিল ছয় মাসে একবার। দৈনন্দিন
জীবনের অকথ্য অত্যাচার আর লাঞ্ছনার মধ্যে ছিল সকাল-সন্ধ্যা কুড়াল দিয়ে চুনের খাতে
শক্ত পাথর ভাঙ্গার কাহিনী, ছিল মানবেতর আহার্য আর পানীয়ের ব্যবস্থা, ছিল কথায় কথায়
চাবুক আর লাঠির শাসন। জেলকর্তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ওদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া,
ওদের মনোবল ভেঙ্গে নরম করে ফেলা। ম্যাণ্ডেলা না থাকলে হয়ত তাদের উদ্দেশ্য সফলও হয়ে
যেত। কিন্তু ম্যাণ্ডেলা বললেন, না, আমরা ওদের নাচে নাচব না। আমরা রুখে
দাঁড়াব----ওরা যদি বলে দৌড়াও, তখন আমরা ঢিলেতালে হাঁটব, ওরা যখন বলবে আস্তে হাঁটো,
তখন আমরা জোরে পা ফেলব। এভাবে আমরা পদে পদে বুঝিয়ে দেব ওদের যে আমাদের
মুক্তিস্পৃহাকে তারা কিছুতেই দমাতে পারবে না, পারবে না আমাদের মনোবলকে দুর্বল
করতে। প্রতি পদে পদে আমরা ওদের প্রতিহত করে যাব, ওদের ধৈর্যশক্তিকে চূড়ান্ত
মাত্রাতে নিয়ে যাব। ওরা আমাদের মেরুদণ্ড ভাঙ্গার বদলে আমরাই ভাঙ্গব ওদের মেরুদণ্ড।
নিজের হাতে পরিষ্কার করে রাখতেন, সর্বোপরি আফ্রিকাআন
ভাষায় তাঁর সঙ্গে আফ্রিকাআন ইতিহাস নিয়ে আলাপ করতেন। এমন পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে
খারাপ ব্যবহার করা কি সম্ভব কারো পক্ষে? তাঁর মন গলে গেল। একটু একটু করে ছোটখাটো
কতগুলো জিনিস তিনি দেখেও না দেখার ভাণ করে থাকতে লাগলেন। যেমন ম্যাণ্ডেলার কিছু
পছন্দের খাবার লুকিয়ে নিয়ে আসা তাঁর জেলকক্ষে। তাঁর স্ত্রী উইনিকে তাঁর ছোট্ট
নাতনিকে সঙ্গে করে দেখা করার অনুমতি দেওয়া ম্যাণ্ডেলার সাথে। সবচেয়ে যে জিনিসটা
তাদের সবার মন জয় করে নিয়েছিল সেটা হল তাঁর একটা আন্তরিক ও আপ্রাণ চেষ্টা জেলখানার
সেই শত্রুসম লোকগুলোকে কাছে টেনে আনা, তাদের জীবনকে নতুন আলোকে আলোকিত করে সমৃদ্ধ
করে তোলা। তাঁর নিজের সহবন্দীদের তো কথাই নেই। সারাক্ষণ লেগে থাকতেন তাদের পেছনে
পড়াশুনা করার জন্যে। কালে কালে তাঁদের ওয়ার্ডটির নাম হয়ে গেল ‘ম্যাণ্ডেলা
বিশ্ববিদ্যালয়’ বা ‘রবেন আইল্যাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়’। একবার তাঁর ইচ্ছে হল
সেক্সপীয়ারের পুরো সংগ্রহটাই পড়ে ফেলবেন। কিন্তু সেটা জেলে ঢোকাবেন কেমন করে।
বুদ্ধি এল মাথায়। বাইরে হিন্দু দেবদেবীর মলাট, ভেতরে পুরো সেক্সপীয়ার। ধর্মগ্রন্থতে
বাধা ছিল না বলে ঢুকতে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ বুঝেও না বুঝার ভাণ করে অন্যদিকে
তাকিয়ে থাকলেন।
পাতা থেকে চোখ তুলে শান্তস্বরে তাঁকে বললেনঃ আমার মনে
হচ্ছে প্লেনের একটা পাখা বন্ধ হয়ে গেছে। আপনি কি পাইলটকে গিয়ে জানাবেন একটু?
তথাস্তু বলে স্টেনগেন সাহেব পাইলটকে বললেন সেটা। পাইলট জবাব দিলেনঃ হ্যাঁ অবশ্যই।
আমি তো বিমানবন্দরে জানিয়েই দিয়েছি। ওরা এম্বুলেন্স আর দমকল বাহিনীসহ সব প্রস্তুত
করে রেখেছে। শুনে তো স্টেনগেল সাহেবের গায়ে ঘাম ছুটতে শুরু করেছে। সব্বনাশ, এই তাহলে
শেষ নাকি! সৌভাগ্যবশত প্লেন কোন অশুভ ঘটনা ছাড়াই নিরাপদে রান-ওয়েতে পৌঁছুতে পারল।
তারপর, কেবল তার পরই, নেলসন ম্যাণ্ডেলা বললেনঃ “বাব্বা, যা ভয় পেয়েছিলাম!”
জীবনের চরম সংকটকালে বন্ধু ম্যাণ্ডেলার পরামর্শ
চাচ্ছিলেন তখন তিনি বলেছিলেনঃ “ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তারা (জেলখানার সাদা
নিপীড়কগণ) আমার সবকিছু ছিনিয়ে নিতে পারে, কেবল দুটি জিনিস পারবে না কখনোই---আমার
মন এবং আমার আত্মা। ওদু’টি একমাত্র আমিই পারব ওদের দিতে। এবং আমি সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলাম যে ওদু’টি অমূল্য জিনিস আমি দেবনা ওদের”। তারপর ক্লিন্টনের দিকে স্নিগ্ধ
হাসিতে তাকিয়ে বললেনঃ “ আপনারও উচিত হবে না দেওয়া”। প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন পরে
বলেছিলেনঃ এই শিক্ষাটি আমি জীবনেও ভুলব না যতদিন বেঁচে থাকি। নেলসন ম্যাণ্ডেলাকে
নিয়ে লেখালেখি করেননি এমন লেখক বর্তমান বিশ্বে বিরল। আমাদের অটোয়া শহরের দৈনিক
পত্রিকা ‘ Ottawa Citizen’ এর এক কলামলেখক লিখেছেনঃ “ He had the wisdom to
present himself as the most ordinary of men, astonishingly free of public ego,
interested only in the larger good.” (এমনই এক প্রাজ্ঞপুরুষ ছিলেন তিনি যে তাঁর
বাইরের ভাবমূর্তিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ বই কিছু নন। অহম আর
আত্মাভিমান জিনিসগুলো তাঁর চরিত্রে অবিশ্বাস্যরকমভাবে অনুপস্থিত ছিল। তাঁর একমাত্র
লক্ষ ছিল সর্বমানবের বৃহত্তর কল্যান।)
এক
পৃথিবীতে এমন কোনও
দেশ বোধ হয় নেই যেখানে অতি সাধারণ মানুষও, কখনো কখনো, জীবনের কোন-না-কোন মুহূর্তে
একটা অসাধারণ কাজ করে ফেলেননি বা একটা অসাধারণ কথা উচ্চারণ করে ফেলেননি। কিন্তু অসাধারণ মানুষ হলেন তাঁরা
যারা প্রায় কখনোই কোন সাধারণ কাজ করে ফেলেন না বা সাধারণ কথা বলেন না। এই অসাধারণ
মানুষগুলোও সব সমান নন,
উঁচুনিচু ভেদ আছে, ইতিহাসের কঠোর বিচারে তাঁদের মাঝেও অল্পসংখ্যক ব্যক্তি থাকেন
যাঁরা সবাইকে টপকে একেবারে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যান। এই ব্যক্তিগুলোর মাঝে চারটে
নাম কালের উজ্জ্বলতম আলোকবর্তিকার মত ভাস্বর হয়ে আছে। তাঁরা হলেনঃ আলবার্ট
সোয়াইটসার, মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং ও “মাদিবা” নেলসন ম্যাণ্ডেলা। এঁরা
শুধু নেতা নন, আমার বিচারে এঁরা হলেন নেতার নেতা---অর্থাৎ নেতৃত্বের স্কুল বলে যদি
থাকত কিছু তাহলে এঁরা হতেন সে স্কুলের সেরা শিক্ষক। পৃথিবীর যাবতীয়
নেতৃবর্গ---রাজনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, ধর্ম,
সর্বক্ষেত্রে, তাঁরা শিখতে পারেন কিভাবে নেতা হতে হয়। উপরোক্ত চারজন মহাপুরুষের
জীবনকাহিনীর একাংশও আমি জানিনা। তবে যেটুকু জানি তার ভিত্তিতেই, এবং আমার নিজের
জীবনে যাঁর প্রভাব আমি সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি, তার ভিত্তিতে, যে এঁদের মাঝে
একেবারে প্রথম সারিতে বিশাল ব্যক্তিত্ব নিয়ে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি হলেন দক্ষিণ
আফ্রিকার সেই অসামান্য মানুষটি---নেলসন ম্যাণ্ডেলা। প্রভাতের উজ্জ্বল সূর্যের মত
তিনি উদয় হয়েছিলেন আজ থেকে ৯৫ বছর আগে, দক্ষিণ আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
অলক্ষে, অজান্তে। অস্ত গেলেন সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে, ৫ই
ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল। তাঁর দীর্ঘ যাত্রাপথের বিচিত্র কাহিনী মানবেতিহাসের গৌরবতম আখ্যানসমূহের
অন্তর্গত। বর্তমান পৃথিবীতে এমন মানুষ
বোধ হয় নেই যার জীবনকে তিনি কোন-না-কোনভাবে স্পর্শ করেননি।
তাঁর অসাধারণ
বাণীগুলোর গুটিকয় তুলে দিচ্ছি এখানেঃ
“ আমি শিখেছি যে
সাহসের অর্থ ভয়হীনতা নয়, ভয়কে জয় করার শক্তি”।
“ কারো চামড়ার রঙ,
তার বংশপরিচয় বা তার ধর্মের ভিত্তিতে তাকে ঘৃণা করতে হবে,
তেমন শিক্ষা নিয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। ঘৃণা করাটা তাকে শিখতে হয় পরে। কিন্তু
‘ঘৃণা’টা যদি শেখা যায় তাহলে ‘ভালোবাসা’টা শেখা যাবে না কেন? আসলে ভালোবাসাটি যত
সহজে স্থান পায় মানবহৃদয়ে তত সহজে তো তার বিপরীতটি পায় না”।
আরেক জায়গায়
বলেছিলেনঃ
“ দলের নেতাকে থাকতে
হয় সবার পেছনে, যাতে সামনে যারা আছে তারা ভাবতে পারে তারাই সামনে”।
অকারণে নয় যে প্রেসিডেন্ট
ক্লিন্টন বলেছিলেনঃ “আমি জীবনেও কোনদিন আমার বন্ধু আদিবা ম্যাণ্ডেলাকে ভুলতে পারব
না”।
অকারণে নয় যে দক্ষিণ
আফ্রিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গলফ খেলোয়াড়, শ্বেতাঙ্গ গ্যারি প্লেয়ার, একবার নেলসন
ম্যাণ্ডেলার অফিসে দেখা করতে গিয়ে যখন তাঁকে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলেন তখন
কি এক স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের তাড়নায় নত হয়ে তাঁর পদচুম্বন করে বললেনঃ “ জীবনে এই
প্রথম আমি কারো পা ছুঁয়ে চুমু খেলাম”। এতটাই অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন ভদ্রলোক যে
আরো এক জায়গায় বলেছিলেনঃ “ ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে করমর্দন করার পর আমি চেয়েছিলাম পুরো
একমাস সেহাতে যেন পানি না ছোঁয়াই”।
দুই
সাউথ আফ্রিকার
দক্ষিণপূর্ব এলাকার ট্র্যান্সকি অঞ্চলের এমভেজো গ্রামের থেমু গোত্রে একটি
শিশুপুত্র জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৮ সালের ১৮ই জুলাই। তাঁর বাবা, গ্যাডলা ম্যাণ্ডেলা,
প্রভাবপ্রতিপত্তিশীল গোত্রপতি, ছেলের নাম রাখেন রোলিহালা মাদিবা ম্যাণ্ডেলা।
স্থানীয় জোসা ভাষাতে “রোলিহালা” শব্দের আক্ষরিক অর্থঃ গাছের ডাল ধরে টান দেওয়া।
যার ভাবার্থ দাঁড়ায়ঃ যে কেবল সমস্যা সৃষ্টি করে, সোজা কথায় দুষ্কৃতকারি। থেমু
গোত্রের ধারা অনুযায়ী রোলিহালা ছাড়া আরও পাঁচটি নাম ছিল, যা পরবর্তীকালে তাঁর
ভক্তরা বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন উপলক্ষে ব্যবহার করেছেন। তাঁর বাবার নামও সমান
লম্বা, যার অপেক্ষাকৃত ছাঁটাইকৃত রূপ হলঃ নিকোসি গ্যাডলা ম্যাণ্ডেলা। তিনি এবং
তাঁর পূর্বপুরুষ কেউ কখনো কোনও স্কুলে যাননি, লিখতে পড়তে শেখেননি, তার প্রয়োজনও
বোধ করেননি। কিন্তু তিনি স্থানীয় আফ্রিকান জাতির ইতিহাস জানতেন আগাগোড়া, বিশেষ করে
জোসা ভাষাভাষী গোত্রসমূহের। তদুপরি তিনি ছিলেন ভীষণ বাকপটু, কথা বলে আর গল্প
শুনিয়ে মানুষকে জমিয়ে রাখতে পারতেন। মাদিবা ম্যাণ্ডেলার স্থানীয় ইতিহাসজ্ঞানের অনেকটাই তাঁর বাবার কাছ থেকে শেখা। নেতৃত্বগুণেরও অভাব ছিল না তাঁর----রোলিহালার
জন্মকালে তিনি সে অঞ্চলের গোত্রপতি হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। সেসুবাদে তিনি এবং
তাঁর পরিবারের কতগুলো সুযোগসুবিধা ছিল যা অন্যদের সাধ্যে কুলোত না----সাধারণ
গোত্রসদস্যদের দৃষ্টিতে ম্যাণ্ডেলা পরিবার ছিল একপ্রকার ‘রাজপরিবার’। পিতা
ম্যাণ্ডেলার চার বিবি। রোলিহালা ছিলেন তাঁর তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত।
দুর্ভাগ্যবশত রোলিহালার
বাবার একটা বড় চারিত্রিক সমস্যা ছিল যা তাঁর কাল হয়ে দাঁড়ায়----ভয়ঙ্কর বদমেজাজ। আঞ্চলিক
শাসনকর্তার সঙ্গে রাগারাগি তর্কাতর্কি করতে গিয়ে গোত্রপতির আসন থেকে সরিয়ে ফেলা হয়
তাঁকে, ‘রাজপরিবার’এর সকল বাড়তি ফায়দাসমূহও রাতারাতি তুলে নেওয়া হয় তার সাথে। রোলিহালা তখন চলে যান তাঁর মায়ের কাছে, সন্নিহিত গ্রাম কুনুতে,
দারিদ্র্যপীড়িত, কৃষ্ণাঙ্গসুলভ সমস্যাজড়িত, কষ্টের জীবনে। তাঁর নতুন বাসস্থানে
কাঠের আসবাব বলে কিছু ছিল না, ঘুমুতেন তিনি খাটবিছানাবিহীন ঠাণ্ডা মেঝের ওপর,
বালিশ ছিল বিলাসকল্পনা, তাঁর মা, ডাকনাম ফ্যানি, রান্না করতেন তেপায়া মাটির উনুনে।
রোজ ভালো খেতে পরতে পেতেন তা’ও না। অথচ মজার ব্যাপার যে ম্যাণ্ডেলার ছোটবেলার
মধুরতম স্মৃতিগুলোর বেশির ভাগই সেই ছোট্ট গ্রামের নিদারুণ দারিদ্র্যের
দৃশ্যাবলীতে। নগ্ন, অর্ধনগ্ন, কালো ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে ফসলতোলা মাঠে গিয়ে ফুটবল
খেলার ভাণ করা, বড় গাছের ডাল কেটে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ পেটানোর খেলাতে হেসে লুটোপুটি
হওয়া, যখন তখন খালিগায়ে গ্রামের বৃষ্টিঝরা ভরা খালের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ডুবডুব
খেলা, সেসব কাহিনী তিনি কখনোই ভোলেননি। ওদিকে মস্তিষ্কশক্তিতে তিনি যে সবার থেকে
আলাদা ছিলেন তার পরিচয়ও পেতে শুরু করেছিলেন গুরুজনেরা। একজন এসে তার বাবামাকে
বললেনঃ তোমাদের ছেলেটি কিন্তু ভীষণ চালাকচতুর, মাথা আছে। আমার মনে হয় ওকে স্কুলে
পাঠানো উচিত----ভবিষ্যতে বড় হতে পারে। বাবামা তাঁর উপদেশ মেনে নিলেন। সাত বছর বয়সে
ম্যাণ্ডেলা ভর্তি হলেন স্থানীয় মেথডিস্ট স্কুলে----যেখানে ছাত্রছাত্রী সব
সমবর্ণের, কৃষ্ণাঙ্গ। প্রথম দিনের ঘটনাবলী প্রায় সবই মনে রেখেছেন তিনি আজীবন। স্কুলে যাবার আগে বাসা
থেকে পরে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম ফুলপ্যান্ট---কোমরে ফিতা দিয়ে বাঁধা। তাঁর ব্যক্তিগত
জীবনকাহিনীতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন সেটাঃ জীবনে যত সুটকোটই পরে থাকি না কেন, সেই
প্রথমবারের মত গর্ব আর উত্তেজনাতে কখনো বুক ফোলেনি। ক্লাসের শিক্ষক, মিস এমডিগানি,
কালো অবশ্যই, বললেনঃ তোমার নাম বদলাতে হবে। ইংলিশ নাম, নেলসন, বাছাই করা হল তাঁর
জন্যে। স্কুলকলেজে পড়তে চাইলে বিলিতি নাম নিতে হবে, আদিবাসী নাম দিয়ে চলবে না। ওটাই
ছিল সেসময়কার ঔপনিবেশক দক্ষিণ আফ্রিকার নিয়ম। সেই থেকে রোলিহালা ম্যাণ্ডেলা হয়ে গেলেন
এযুগের সর্বজনপরিচিত নেলসন ম্যাণ্ডেলা।
স্কুলের আবহাওয়া ছিল
এমন যে তার সঙ্গে তাঁর পরিচিত আফ্রিকান জীবনের কোনও সামঞ্জস্যই ছিল না----একেবারে
ভিন্ন দু’টি জগত। স্কুলের জগতে সবকিছুই ব্রিটিশ----শিক্ষা, চিন্তাভাবনা, আদর্শগত
ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৃটিশ জাতি অনেক
ওপরে, এটা ধরেই নেওয়া হত। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ জাতিরও যে একটা ইতিহাস আছে, আছে একটা
স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, তার কোন মূল্যই দেওয়া হত না। সাদাদের কাছে কালো কালচার একটা
উদ্ভট কল্পনা মাত্র--যার কোন অস্তিত্বই নেই বাস্তবে।
যাই হোক, তবু চলছিল
সব ভালোয় ভালোয়ই। এমন সময় ঘটল আরেক বিপর্যপয়----বাবা মারা গেলেন হঠাৎ করে,
ফুসফুসসংক্রান্ত কি এক অনির্ণীত কারণে। বালক ম্যাণ্ডেলার বয়স তখন মাত্র নয়।
আর্থিকভাবে নেলসন সেসময় বলতে গেলে একেবারে এতিম। সৌভাগ্যবশতঃ তখনকার গোত্রপতি,
অস্থায়ী রাজ্যপাল, জঙ্গিতাবা ডালিন্দিবা, নেলসনের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করে
নেন সানন্দে ও সোৎসাহে----পিতা ম্যাণ্ডেলা নিজে যখন গোত্রনেতা ছিলেন তখন এই
ভদ্রলোকের একটা বড় উপকার করে দিয়েছিলেন। সে ঋণ তিনি ভোলেননি। তাছাড়া ছেলের মেধার
খবর তাঁর কানে এসেছিল আগেই। এই ছেলের ভরণপোষণের ভার নিলে গোটা জাতিরই উপকার হতে
পারে ভবিষ্যতে তেমন একটা স্বপ্ন হয়ত মনে মনে পুষতে শুরু করেছিলেন তিনিও। তিনি
নেলসনকে আফ্রিকার আদিম অধিবাসীদের অনেক গৌরবময় ইতিহাসের কথা শোনাতেন। বলতেন যে
সাদাজাতির আক্রমণের আগে কালোরা খুব সুখেশান্তিতে জীবনযাপন করতেন পুরো
মহাদেশব্যাপী----নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি আর ক্ষমতার লড়াই, এ সবই সূচিত হয় সাদাদের
ঘাঁটি গেড়ে বসার পর----তারাই এখানে দলাদলি আর বিভক্তির বীজ ঢোকায়। তিনি আরো শোনাতেন
কৃষ্ণাঙ্গজাতির ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির কথা, যা একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে এই
হানাদার শ্বেতাঙ্গজাতি। এসব গল্প শুনে শুনে কিশোর নেলসনের মন আস্তে আস্তে বিষিয়ে
উঠতে থাকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, বিদ্রোহের বীজ উপ্ত হতে থাকে তাঁর বিদগ্ধ
চিত্তে।
মজার ব্যাপার হল যে
নেলসন ম্যাণ্ডেলার এই সদয়চিত্ত ও দেশপ্রেমিক অভিভাবক ব্রিটিশবিরোধী কথাবার্তা যতই
বলুন না কেন, তাঁর পোশাকআশাকে চালচলনে ছিল পুরো ব্রিটিশ কায়দা। ইংরেজ সাহেবদের মত
ফিটফাট সুটকোট পরা সবসময়, বাড়িতে ব্রিটিশ স্টাইলের আচার ব্যবহার আর জিনিসপত্র,
সবকিছুতেই অন্ধ অনুকরণের লক্ষণ। গোটা শহরটাই ছিল অনেকটা সেরকম----যেন ব্রিটেনেরই
একটি ক্ষুদে শহর। মেয়েরা সব মেমসাহেবদের মত সেজেগুজে, মাথায় হ্যাট চাপিয়ে মিশনারি
স্কুলের গুরুগম্ভীর মহিলাদের মত মুখ করে হাঁটছেন সদর রাস্তায়। ওদিকে শহরের স্থানীয়
শাসনব্যবস্থাতে সেই পুরনোযুগের আফ্রিকান পদ্ধতির পূর্ণ ছাপ---সেই একই শ্লীলতা
শিষ্টতার সুস্পষ্ট প্রতিফলন, সেই একই সৌজন্য, একই গতানুগতিক গণকল্যানমুখি
চিন্তাধারার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য। চিফ জঙ্গিবাতা, যাকে তিনি চাচা বলে সম্বোধন
করতেন, তাঁকে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতেন কোনও সামাজিক আসরের সভাপতিত্ব
করাকালে। অনেকটা আমাদের দেশের পঞ্চায়েতের মত। উপস্থিত সকল সদস্যকেই সমান সুযোগ
দেওয়া হত মতামত প্রকাশ করার জন্য। একজন কিছু বলতে শুরু করলে সবাই মন দিয়ে শুনতেন,
বক্তব্যের মাঝখানে কেউ তাকে বাধা দেওয়াটা ছিল একপ্রকার অভদ্রতা, অসৌজন্য। তাঁরা
হয়ত বক্তব্যের মাঝে গোত্রপ্রধানের দোষগুণ নিয়ে নানারকম নেতিবাচক উক্তিও করে ফেলেন,
তাতে কোনও দোষ ধরা হত না। যার যা বলার সেটা শেষ হয়ে গেলে তাঁর চাচা হয়ত সভার
ধারাবাহিক আলাপ-আলোচনার সারমর্মটি সবার কাছে ব্যাখ্যা করে, তার ভিত্তিতে একটা
সর্বসম্মতিক্রম সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করতেন। এর চেয়ে সহজ সুন্দর ও সুশীল
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আর কি হতে পারে। ছোটবেলার এই শিক্ষাটি পরবর্তীকালে ম্যাণ্ডেলার
কর্মজীবনে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি শিখেছিলেন কিভাবে ভালো শ্রোতা হতে
হয়, কিভাবে সবাইকে সমান অধিকার দিয়ে তাকে শক্তিশালী করে তোলার পর একটা অন্তিম
লক্ষে পৌঁছুতে হয়।
নেলসন ম্যাণ্ডেলার
বয়স যখন ষোল তখন তাঁর আফ্রিকান গোত্রের সনাতন প্রথা অনুযায়ী যৌবনব্রত পালন করার
সময়। প্রথমত আনুষ্ঠানিক খৎনাপর্ব, যার তাৎপর্য হল কৈশোর থেকে যৌবন তথা পৌরুষে
উত্তরণ। এ-পৌরুষ কেবল শারীরিক
নয়, মানসিক এবং বৌদ্ধিকও। তখন তিনি পুরুষের সম্মান যেমন পাবেন, পুরুষের দায়িত্ব
পালন করাটিও তাঁর কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে। কৈশোর
পর্যন্ত কোথাও ব্যথা পেলে কাঁদা যায়, কিন্তু যৌবনে কান্নার স্থান নেই। যত কষ্টই
হোক মুখ গুঁজে সহ্য করতে হবে, চোখে যেন জল না দেখে কেউ, তার চেয়ে লজ্জা নেই আর
কিছুতে। নেলসন ম্যাণ্ডেলার চারিত্রিক দার্ঢ্যতে এই তান্ত্রিক মন্ত্রটিও হয়ত কাজ
করেছিল কিছুটা----প্রাপ্ত বয়সে এই লোকটার মুখে মানুষ কখনো ব্যথায় কুঁকড়ে উঠা
দেখেনি, কষ্টে কাতর হয়ে কঁকিয়ে ওঠা শোনেনি। অসাধারণ শক্ত মনের মানুষ ছিলেন তিনি,
এবং ওই প্রস্তুতিটা সম্ভবত সেই ছোটবেলারই শিক্ষা। আনুষ্ঠানিক পৌরুষোৎসবের সময়
নেলসন আরো একটি গৌত্রিক নামে ভূষিত হন---দালিবুঙ্গা, যার মানে হল ‘বুঙ্গা জাতির
পিতা’, গৌত্রিক শাসক সম্প্রদায়ের নাম।
মেথডিস্ট স্কুলের
ব্রিটিশ ধারার শিক্ষাতে বিপ্লবী চিন্তাভাবনার অবকাশ ছিল না অবশ্য, কিন্তু চাচার
প্রেরণা ও উদ্দীপনাতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একটা সক্রিয় প্রতিরোধের কল্পনা
ক্রমেই দানা বাঁধতে শুরু করে তাঁর মনে। কিন্ত
সে কল্পনা কোনও সুনির্দিষ্ট কর্মপ্রচেষ্টাতে রূপান্তরিত হয়নি বিশের কোঠার
মাঝামাঝিতে পৌঁছানো না পর্যন্ত।
স্কুল থেকে
কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হবার পর নেলসন তাঁর মেধার জোরে ভর্তির সুযোগ পান কালোদের
তৎকালীন সর্বোচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়তে----পোর্ট হেয়ারের সাউথ আফ্রিকান
বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে কৃষ্ণাঙ্গ জাতির অক্সফোর্ড-হার্ভার্ড বলে গণ্য করা হয়। সেখানে
ভর্তি হতে পারা সাধারণ যদু-রহিমের কাজ নয়। ১৯৪৩ সালে তিনি সেখান থেকে বি এ ডিগ্রি
নিয়ে বের হন, পরে দুবছরের আইনের ডিগ্রিটাও শেষ করে নিয়েছিলেন। তারপর তাঁর
কর্মজীবনের শুরু---প্রিয় বন্ধু অলিভার ট্যাম্বো আর তিনি মিলে “ Tambo and Mandela” নাম দিয়ে একটি ছোটখাটো ওকালতি অফিস
খুলে ফেলেন। কালো জাতির জন্যে সেটাই ছিল সাউথ আফ্রিকার প্রথম ওকালতি ব্যবসা। ইতোমধ্যে,
কলেজে থাককালেই অন্যান্য আদর্শবাদী ও দেশপ্রেমিক ছেলেমেয়েদের সংস্পর্শে এসে, তাঁর
রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা আরো পরিপক্কতা লাভ করে, আরো তীক্ষ্ণ ও সুদৃঢ় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি শেষ করার পরের বছরই,
অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে, তিনি ANC তে যোগ দেন আরো কিছু কালো বুদ্ধিজীবিদের সাথে।
তিন
‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর উৎপত্তি ১৯১২ সালে।
গোড়াতে এর নাম ছিল SANC, মূলত শ্বেতাঙ্গ শাসনের প্রতিবাদে, বিশেষ করে সাদাদের
তথাকথিত “ভূমি আইন”, যার সারমর্ম ছিল, সাদা আর কালোদের আলাদা বাসভূমি, সাদারা
থাকবে অপেক্ষাকৃত ধনী এলাকাগুলোতে যেখানে ভালো ভালো জমিজায়গা, এবং বিশেষ করে স্বর্ণ
ও হীরকসহ অন্যান্য খনিজসম্পদ, আর কালোদের জায়গা হবে নিম্নমানের চাষভূমি, ভদ্রভাবে,
সম্মানের সাথে বসবাস করার মত কোনও ব্যবস্থাই যেখানে নেই, সেখানে। এগুলোকে বলা হত
‘বান্টুস্টান’। কেবল তা’ই নয়। প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে একটি পরিচয়পত্র সঙ্গে
করে থাকতে হত, যাতে তারা ভুল করেও কোন ‘নিষিদ্ধ’ এলাকাতে ঢুকে না পড়েন, অর্থাৎ
সাদাদের জন্য স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করে দেয়া এলাকা। প্রথমদিকে ন্যাশনাল কংগ্রেসের
কর্মসূচিতে কোনও সশস্ত্র বা সহিংস আন্দোলনের পরিকল্পনা ছিল না। তাদের কর্মপদ্ধতি
ছিল মূলত অহিংস প্রতিরোধ, অনেকটা গান্ধীর মত। কিন্তু পরে যখন শ্বেতাঙ্গ সরকারের অন্যায়
অত্যাচারের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে, কংগ্রেসের নেতারা সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন
যে নরম সুরে কাজ হবে না, সশস্ত্র ক্ষমতাকে ক্ষমতার অস্ত্র দিয়েই মোকাবেলা করতে
হবে। ১৯২৩ সালে গঠিত হল ‘জাতির বর্শা’ (Umkhonto we Siswe, বা Spear of the
Nation) নামক
তরুণ ম্যাণ্ডেলা
|
|
পারিবারিক জীবন যতই সুখের হোক ম্যাণ্ডেলা বা তাঁর
বিপ্লবী বন্ধুদের কেউই তাঁদের সংগ্রামের শপথ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি কখনও।
১৯৪৫ সালে ম্যাণ্ডেলাদম্পতির একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে, পরের বছর একটি ছেলে।
দুঃখের বিষয় ছেলেটি মারা যায় ৯ মাস বয়সেই। কিন্তু এ সবকিছুর মাঝেও তাঁদের
আন্দোলনের পরিকল্পনা পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেসময় নেলসন ম্যাণ্ডেলা
পরবর্তীকালের মত তেমন শান্তিবাদী বা নরম মেজাজের মানুষ ছিলেন না। বরং রীতিমত রাগী,
রগচটা, অল্পতেই বারুদের মত জ্বলে ওঠার স্বভাব বলেই জানত সবাই। তবুও তাঁর
সহকর্মীরা, বিশেষ করে মধ্যবয়স্ক, অভিজ্ঞতর সিসুলু, ম্যাণ্ডেলার মধ্যে লক্ষ করেন
একটি স্বাভাবিক নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব। অত্যন্ত সুন্দর, ব্যায়ামপুষ্ট শরীর,
সুদর্শন, দীর্ঘাঙ্গি, যেখানে যান সেখানেই যেন আলোকিত করে তোলেন, সর্বোপরি ভীষণ
বাকপটু ও সুবক্তা। পোশাক আশাকের দিক থেকেও সাদাদের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার
যোগ্য---সবসময় সাজগোজ করে ফিটফাট থাকার স্বভাব, পালিস করা জুতো, হাসিখুশি মুখ।
শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে সমানে সমানে কথা বলা ও শেয়ানে শেয়ানে দাঁড়ানো একমাত্র এই
লোকটির দ্বারাই সম্ভব সেটা তিনি এবং তাঁর অন্যান্য সহকর্মীরাও গোড়াতেই টের পেয়ে
যান। অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানগরিমার দিক থেকে সবচেয়ে যোগ্য লোক, অন্তত
আপাতদৃষ্টিতে, ছিলেন সিসুলু নিজেই। কিন্তু তাঁর নিজেরই স্বীকারুক্তি অনুযায়ীঃ “
আমাদের সামনে দাঁড়ানো এই লোকটি, একটি সহজাত জননেতা। আর আমি হলাম খর্বকায়,
মৃদুভাষী, লাজুক। আমার কি সে ক্ষমতা আছে একঘর লোকের সামনে দাঁড়িয়ে অগ্নিবর্ষী
বক্তৃতা করে তাদের উত্তেজিত করে তোলা? এদিকে দেখ, এই মানুষটি, মুষ্টিযুদ্ধে সিদ্ধহস্ত,
একগাল হাসিতে দুনিয়া কাত করে দিতে পারে, সে তো নেতা হবার জন্যই জন্মেছে”। বিশুদ্ধ
বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার কথা ভাবলে সিসুলু আর ট্যাম্বোর সমকক্ষ হয়ত তিনি ছিলেন
না তখনো, কিন্তু সে অভাবটুকু তিনি পুষিয়ে নিয়েছিলেন অন্যভাবে---বিস্তর পড়াশুনা
করে। ব্রিটেনের যত বামপন্থী লেখক ছিলেন, লাস্কি, বার্ট্রাণ্ড রাসেল, তারপর গান্ধী,
মার্ক্স, এ সবই তিনি পড়ে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ বুদ্ধিতে না হলেও বাইরের পড়াশুনাতে
তিনি বরং এগিয়েই ছিলেন সবার চাইতে। সুতরাং এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে অতি অল্প সময়ের
ভেতরই ম্যাণ্ডেলা প্রথমে সহসভাপতি, পরে সভাপতি পদে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের
পূর্ণ নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে যান (১৯৫০)।
ওদিকে শ্বেতাঙ্গদের কালোদমননীতি কঠোর থেকে কঠোরতর
হয়ে উঠছিল। ১৯৪৮ সালে উগ্র বর্ণবাদী দল আফ্রিকাআন ন্যশনাল পার্টি (Afrikaan
National Party) সাদা ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য অর্জন করে ক্ষমতায় আসার পর
সাদা-কালোর পৃথকীকরণ নীতি পূর্ণ আইনের আওতায় চলে আসে। অর্থাৎ আগে যা ছিল কেবলই প্রশাসনিক
ব্যবস্থা, তখন সেটাই হয়ে গেল আইনের বিধান, যদিও ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর সহযোগীদের
দৃষ্টিতে সেটা ছিল, যাকে বলে বেআইনী আইন, সাদা আইন, যা কালোদের মানার কোনও নৈতিক
দায়িত্ব নেই। শ্বেতাঙ্গজাতির বন্দুকবলে অর্পিত দ্বিজাতিতত্ব এভাবেই কায়েম হয়ে বসে
দেশে, যেখানে জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগই কালো, আর বাকি ১০ ভাগ বহিরাগত, আগ্রাসী,
জোরজুলুম করে পরের-ধন-ছিনিয়ে-নিয়ে-বড়-হওয়া, দস্যু জাতি।
১৯৫০ সালে শ্বেতাঙ্গ সংসদে ‘গণনিবন্ধন’ আইন
(Population Registration Act) পাস হয়ে যায়। গোটা দেশটাকে তখন চার ভাগে ভাগ করে
দেয়া হয়। অর্থাৎ চারপ্রকার বর্ণঃ সাদা, “রঙ্গিন”, ভারতীয়, কালো। অনেকটা সনাতন
হিন্দু সম্প্রদায়ের চার বর্ণের মত। একেক সম্প্রদায়ের জন্য একেক রঙের পরিচয়পত্র
থাকবে। মানে থাকতে বাধ্য করা হবে। ওই একই সালে আরেকটি আইন পাস করে নেওয়া হয়ঃ
স্বতন্ত্র বাসভূমি আইন (Group Area Act), যাতে করে প্রতিটি সম্প্রদায় তার জন্য
বরাদ্দকৃত এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে---এক এলাকা ছেড়ে আরেক এলাকাতে বাসস্থান
স্থাপন করা যাবে না, বিশেষ অনুমতি ছাড়া। শুধু তাই নয়। জনচলাচলের জন্য বাস, ট্রেন,
লঞ্চ, স্টিমার, প্লেন, কোনটাতেই কালোদের জায়গা হবে না যেখানে সাদাদের জন্য আলাদা
করে রাখা সীট। সরকারি পার্ক আলাদা, সমুদ্রসৈকত আলাদা, রেস্টুরেন্ট আলাদা, সিনেমাহল
আলাদা, বাজার আলাদা। এমনকি সরকারি শৌচাগারগুলিও আলাদা আলাদা। অথচ, ভেবে দেখুন,
গোটা দেশটাই ছিল একসময় পুরোপুরি কালোদের অধিকারে, বেশিদিনের কথাও নয় সেটা, বংশ
বংশানুক্রমে তারা বাস করে এসেছে সেখানে, যত্রতত্র ভ্রমণ করেছে যখন খুশি তখন, কারো
কোনও অনুমতির প্রয়োজন হয়নি। আজ সেখানে পরিচয়পত্র ছাড়া ঘর থেকে বেরুনো যাবে না।
সে-“আইন” তারা মানবে কেন? সে আইন মানার কোনও নৈতিক বা বৈধ বাধ্যবাধকতাও তারা বোধ
করেনি। অতএব প্রতিরোধ তাদের অধিকার নয় কেবল, দায়িত্বও। ন্যাশনেল কংগ্রেসের নেতৃত্ব
ও পরিচালনায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের আন্দোলন শুরু হয়ে যায়
পুরোদমে। সে আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধ গণবিক্ষোভের আকার ধারণ করে ১৯৬০ সালের ২১ শে মার্চ।
৫ থেকে ৭ হাজার কালো আন্দোলনকারি তরুণ ট্রান্সভালের শার্পাভিল শহরের বড় রাস্তায়,
শ্বেতাঙ্গ পুলিশের কাঁটাতারের বেড়ায় সংরক্ষিত থানার সামনে সংগ্রামী শ্লোগান দিতে
শুরু করে। তারপর দল বেঁধে এগিয়ে যেতে থাকে থানার দিকে। তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই
ছিল না---শুধুই বলিষ্ঠ মৌখিক প্রতিবাদ অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে। একদিকে বন্দুকহাতে
শ্বেতাঙ্গ পুলিশ, প্রস্তুত হয়ে থাকে হুকুম পাওয়ামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়বে জনতার ওপর। নিরস্ত্র
জনতা এগুতে শুরু করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ভেতরে ঢো
শার্পাভিল হত্যাকাণ্ড
|
সম্ভবত শার্পাভিল হত্যাকাণ্ডকেই সাউথ আফ্রিকার
কৃষ্ণাঙ্গ জাতির নিজস্ব ‘মুক্তিযুদ্ধ’এর প্রথম সোপান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
বাইরের জগতের কাছে সেই প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার কালোদের ওপর শ্বেতাঙ্গ জাতির ঘৃণ্য
বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থা, বর্বর দমননীতি, শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনকে প্রতিহত করতে গিয়ে
নিরপরাধ মানুষদের গুলি করে হত্যার খবর আর আভ্যন্তরীন ঘটনা হয়ে থাকে না,
আন্তর্জাতিক ঘটনাতে পরিণত হয়। তখন পৃথিবীর ছোট বড় সাদা কালো সবরকম দেশ থেকেই তীব্র
নিন্দা ও প্রতিবাদ ঘোষিত হতে শুরু করে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ সোজাসুজি সেই
হত্যাকাণ্ডের পুরো দোষটা চাপিয়ে দেয় সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের ওপর। দেশের
স্টকমার্কেট প্রায় ডুবুডুবু অবস্থাতে পড়ে যায়, মুদ্রামূল্য দ্রুত নামতে শুরু করে,
ভীতসন্ত্রস্ত সাধারণ শ্বেতাঙ্গ নাগরিকরা অনেকে দেশ ছেড়ে অন্যত্র অভিবাস খুঁজতে লেগে
যান। একটু করে হলেও আফ্রিকাআন ক্ষমতার আসনে কাঁপন শুরু হয়। ওদের
আকাশেও হয়ত বেজে ওঠে অশনি সংকেত।
ইতোমধ্যে আফ্রিকান কংগ্রেসের কর্মকর্তারা চুপ করে
বসেছিলেন তা নয়। বরং শার্পাভিল আন্দোলনের পশ্চাতে তাদের উৎসাহ সহায়তা ছিল বলেই
তারা ওভাবে সম্মিলিত হতে পেরেছিল। ম্যাণ্ডেলা এবং তাঁর সহযোগীরা গোড়া থেকেই,
অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে সাদাদের কালো আইন পাস হয়ে যাবার পর থেকেই তাঁদের প্রতিবাদ,
প্রতিরোধ, ভাংচুর, আর ‘আইন’ অমান্যতার সংগ্রাম অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নেলসন
ম্যাণ্ডেলা সেসময় এতটাই যুদ্ধংদেহী যুবক ছিলেন যে ১৯৫২
সালে তাঁকে আইন বিরোধিতা অভিযানের জাতীয় পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ফলে তার
পরের বছরই কর্তৃপক্ষ তাঁকে শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেয় নয় মাসের জন্য। সে’ই তাঁর রাজনৈতিক
জীবনের প্রথম কারাবাসের অভিজ্ঞতা। তাতে তিনি যে বিন্দুমাত্র দমে গিয়েছিলেন তা নয়।
বরং জেল খাটার ফলে তাঁর মানমর্যাদা খানিক বেড়েই গিয়েছিল সহকর্মীদের চোখে। সেকালে ‘জেল খেটে জাতে ওঠা’র একটা সুপ্ত আকর্ষণও ছিল বটে তরুণ সংগ্রামী মহলে।
দ্বিতীয়বার ম্যাণ্ডেলাসহ ১৫৫ জন রাজনৈতিক কর্মী একসাথে গ্রেপতার হন ১৯৫৫ সালে,
যদিও সেবার তিনি প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাশ পেয়ে গিয়েছিলেন। তবে তখনো পর্যন্ত
ম্যাণ্ডেলার সংগ্রামজীবনের আন্তরিকতা নিয়ে কিঞ্চিৎ সংশয় যে উদ্রেক হয়নি কোন কোন
সহকর্মীর মনে তা নয়। কারো কারো এমন ধারণা ছিল যে ম্যাণ্ডেলার চরিত্রে একটু
লোক-দেখানো ভাব আছে, একটু আত্মগরিমা, কি-হনুরে মানসিকতা। লোকটা কি আসলেই খাঁটি না
মেকি, এরকম একটা প্রশ্ন দাঁড়িয়েছিল তখন। এন্থনি স্যামসন নামক এক সহসংগ্রামী
কংগ্রেসসদস্য, যাঁর সঙ্গে ম্যাণ্ডেলার পরিচয় ‘৫০এর গোড়া থেকে, এবং যিনি
পরবর্তীকালে তাঁর জীবনী লিখেছিলেন, একজায়গায় বলেনঃ “ সেযুগে নেলসন ম্যাণ্ডেলার
একটা প্রবল প্রবণতা ছিল লোকদেখানো ভাবসাব করার। একটু আত্মম্ভরিতা, একটু হামবড়া ভাব।
সেসব ছিল প্রচুরই। তখন অনেকে ভাবত, আমি নিজেও, যে লোকটার ভেতরটা বোধ হয় আসলে
ফাঁপা”। কিন্তু শার্পাভিল ঘটনার পর তাঁদের মনের সে-ভুলটা কেটে
যায়। ঘটনার পুরো মদদটাই জুগিয়েছিলেন ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর কতিপয় সহকর্মী, সেটা শুধু
দেশবাসী নয়, কর্তৃপক্ষেরও অজানা থাকে না। তখন থেকে তিনিই হলেন প্রধান
রাষ্ট্রদ্রোহী, পুলিশ হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে লাগলেন তাঁকে। ম্যাণ্ডেলা খুব ভালো করেই
জানতেন, এবার ধরা পড়লে ছাড়াছাড়ি নেই, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হবে নির্ঘাৎ। চলে গেলেন আণ্ডারগ্রাউণ্ডে।
কিন্তু দেশের বাইরে নয়, সেটা হয়ত কখনোই তাঁর মনে স্থান পায়নি----নেহাৎ আত্মরক্ষার
জন্যে নিজের দেশবাসীদের ত্যাগ করে পরের শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া, ওটা তাঁর পক্ষে আদৌ
সম্ভব ছিল না। বরং নিজের দেশেই বিভিন্ন ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন, বলতে গেলে
কর্তৃপক্ষের নাকের ডগা দিয়ে। পত্রপত্রিকায় তখন তাঁর নামকরণ হয়ে গেলঃ “কালো
পিম্পার্নেল”। পিম্পার্নেল হলেন এক কাল্পনিক চরিত্র যিনি ফরাসী বিপ্লবের সময় এভাবে
ছদ্মবেশে পালিয়ে পালিয়ে গিলোটিনের ধারালো তরবারি এড়াতে পেরেছিলেন। ম্যাণ্ডেলার
ছদ্মবেশ ছিল, কখনো দিনমজুর, কখনো গাড়ির ড্রাইভার, কখনোবা নকল দাড়িগোঁফ আর কালো
চশমাপরা রহস্যময় ভদ্রলোক। এভাবে তিনি মোটামুটি খোলাখুলিভাবেই
চষে বেড়াতেন সারা দেশ, লোকজনদের উৎসাহ দিতেন রুখে
দাঁড়ানোর জন্যে সরকারের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এমনকি দুচারবার সাংবাদিকদের
সাথে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি শেষপর্যন্ত। শেষমেশ তাঁকে ধরিয়ে
দেয় তাঁরই এক বিশ্বস্ত সহকর্মী। শুধু তিনি নন, রাষ্ট্রবিরোধী অনেক কাগজপত্র ও দলিল
প্রমাণসহ আরো নয়জন সহকর্মী।
আগেই বলেছি, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস গোড়াতে
অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন, মহাত্মা গান্ধীর অনুকরণে। কিন্তু ক্ষমতাশীল
শ্বেতাঙ্গ জাতি যতই তাদের দমননীতির ব্যাপকতা আর কঠোরতার মাত্রা বাড়িয়ে যেতে থাকে
ততই তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করতে থাকেন যে শক্তের সঙ্গে নরম থেকে কোন কাজ হবে না। ক্ষমতায়
অন্ধ যারা তারা শুধু ক্ষমতার ভাষাই বোঝে। তখন থেকে ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর তরুণ
সহকর্মীরা সহিংস বিপ্লবী পথ বাছাই করে নেন। তিনি একজায়গায় লিখেছিলেনঃ “ অহিংস
পন্থা কেবল তখনই কার্যকর হতে পারে যতক্ষণ অপর পক্ষও সেই একই নিয়ম পালন করেন। কিন্তু
অপর পক্ষ যদি গায়ের জোর ব্যবহার করতে শুরু করে তখন তোমারও
কোন গত্যন্তর থাকে না তার বিরুদ্ধে একই পন্থা ব্যবহার করা ছাড়া। শান্তিপূর্ণ পন্থা
তখন একেবারেই অকেজো”। তাই তিনি পথ খুঁজতে থাকলেন কিভাবে, কতভাবে, কর্তৃপক্ষকে
নাস্তানাবুদ করা যায়, তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়----তাদের দালানকোঠা ধ্বংস করা,
রেলস্টেশন উড়িয়ে দেওয়া, পুল ভেঙ্গে দেওয়া, ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হল যে ম্যাণ্ডেলা
সেসময় সশস্র আন্দোলনে বিশ্বাসী হলেও নিজে কখনো বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে শেখেননি। সেটা
শিখবার চেষ্টা করতে গিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি। শিক্ষার্থী হিসেবে বন্দুক দিয়ে তাক
করতে গিয়ে একটা ছোট্ট চড়ুইপাখি মেরে ফেলেন একবার। তাতে
দুটো জিনিস শেখেন তিনি। এক, আনাড়ি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তাক
ভয়াবহভাবে অব্যর্থ। দুই, ক্ষুদ্র একটি নিরপরাধ জীবকে
অনর্থক মেরে ফেলার অনুশোচনা। মূলত, ব্যক্তিগতভা্বে, নেলসন ম্যাণ্ডেলা সহিংস পন্থা
মোটেও পছন্দ করতেন না----প্রাণ দিয়ে ঘৃণা করতেন সেটা।
শার্পাভিল ঘটনার সূত্র ধরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে
ম্যাণ্ডেলা এবং তাঁর ৯ সহবিপ্লবীর বিচার শুরু হয় ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে। সাউথ
আফ্রিকার ইতিহাসে সেটা ‘রিভোনিয়া মামলা’ নামে বিখ্যাত। সরকারি দলের মোটেও বেগ পেতে
হয়নি অভিযুক্ত আসামীদের অপরাধ প্রমাণ করতে। কিন্ত বিবাদীরও তো বক্তব্য ছিল। ম্যাণ্ডেলা
নিজে কৌঁসূলি---তাঁর পক্ষ নিয়ে অন্য কাউকে ওকালতি করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তিনি
একাই একশ’। সেখানে, সেই আদালতের মঞ্চে দাঁড়িয়ে, বিপুলাকার সেই দাম্ভিক পুরুষ, সেই
মহাশক্তিধর মুক্তিযোদ্ধা, দীর্ঘ সাড়ে চার ঘন্টাব্যাপী যে তীক্ষ্ণ তীব্র জ্বালাময়ী
বক্তৃতা রেখেছিলেন, যেভাবে তিনি ধূলিসাৎ করেছিলেন মনুষ্যত্বহীন, সাধারণ মানবাধিকারজ্ঞান
বিবর্জিত, সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহকে, মানবাধিকার সংগ্রামের ইতিহাসে সে এক
গৌরবোজ্জ্বল দলিল হয়ে থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
সর্বশেষে তিনি একটা কথা দিয়ে তাঁর বক্তব্যে যবনিকা টেনেছিলেনঃ “ আমার সারা জীবন
আমি উৎসর্গ করেছি আফ্রিকার জনগণের স্বার্থে। আমি সংগ্রাম করেছি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের
বিরুদ্ধে, আমি সংগ্রাম করেছি কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে। আমি
কামনা করেছি একটি মুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজ যেখানে সকল
মানুষ সমান অধিকার নিয়ে, সমান সম্মান ও সুযোগসুবিধা নিয়ে, মিলেমিশে
শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারবে। এই আদর্শটি এতই মূল্যবান আমার কাছে
যে একে অর্জন করার জন্যই আমার বেঁচে থাকার সার্থকতা,
আমার জীবনের পরিপূর্ণতা। যদি প্রয়োজন হয়, এই আদর্শের জন্য আমি প্রাণ দিতে প্রস্তুত”।
আদালত কক্ষ স্তব্ধ, নিথর, পাথরের মত নিষ্প্রাণ।
উপস্থিত কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না যে লোকটার তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড
প্রায় অবধারিত। ম্যাণ্ডেলা নিজেও তা’ই ধরে নিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি পরে
লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত “ Long Walk to Freedom” বইতেঃ “ মৃত্যুদণ্ডের জন্যেই আমি
প্রস্তুত ছিলাম। কোনকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকা বলতে বোঝায় আসলে ঠিক তারই অপেক্ষায়
থাকা। প্রস্তুত থাকা অথচ মনে মনে আশা করে থাকা যে এটা না’ও ঘটতে পারে, তা হয় না।
না, আমরা সবাই প্রস্তুত ছিলাম মৃত্যুদণ্ড হবে বলে, তার কারণ এই নয় যে আমরা দারুণ
সাহসী মানুষ, কারণ শুধু এ যে আমরা বাস্তবতাবাদী। আমি তখন সেক্সপীয়ারের লাইনদুটোর
কথা ভাবছিলামঃ ‘ Be absolute for death; for either death or life shall be the
sweeter.’”। (ধরে নিন মৃত্যু অবধারিত, তাহলে হয় মৃত্যু নয় জীবন হবে মধুরতর)
যাই হোক সাদা জজসাহেব সেক্সপীয়ার নিয়ে মাথা
ঘামাননি। মামলার শুনানী সাক্ষীপ্রমাণ সব শেষ হবার পর রায় দিতে সর্বকূল্যে মাত্র
তিন মিনিট সময় লেগেছিল হুজুরেরঃ না, মৃত্যুদণ্ড নয়, যাবজ্জীবন। ১৯৬৪ সালের জুন। নেলসন
ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর সহকয়েদীদের সারা জীবন সশ্রম কারাবাসের হুকুম হয়ে গেল পশ্চিম
উপকূলের ‘রোবেন আইল্যাণ্ড’ নামক এক নির্জন দ্বীপের
লৌহকারাগারে। এমনই কড়া পাহারা সেখানে যে কখনও কোন কয়েদী সেখান থেকে পালাতে পারেনি
গত তিনশ বছরে মাঝে, অনেকটা আমেরিকার আল্কাত্রাজ জেলের সঙ্গে তুলনীয়।
চার
১৯৬৪ সালের ১১ই জুন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী
সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবার পর নেলসন ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর ছজন
সঙ্গিসাথীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলের নিরালা দ্বীপ রবেন
আইল্যাণ্ডের কড়া পাহারার কারাগারে। সপ্তম কয়েদী, ডেনিস গোল্ডবার্গ, তিনি গেলেন
অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক প্রিটোরিয়া জেলে, কারণ তাঁর গায়ের রঙ্গটি ছিল সাদা। হ্যাঁ,
সাদা। অবাক হবার কিছু নেই। বিবেকবান সাদা তখনকার উগ্র বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সমাজেও
ছিল, বেশ প্রচুরই ছিল। কেউ কেউ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গে যোগও দিয়েছিলেন,
যার মধ্যে এই মহৎপ্রাণ ভদ্রলোকটি ছিলেন অন্যতম।
ম্যাণ্ডেলার কারাজীবনের অভিজ্ঞতা কিভাবে প্রতিফলিত
হয়েছিল তাঁর চারিত্রিক বিবর্তনের পটভূমিতে সেসম্বন্ধে এক মন্তব্যকারের উক্তি, আমার
মনে হয়, বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্যঃ
“ কারাগারের আলোবাতাসহীন অন্ধকারে যে-যুবকটি
প্রবেশ করেছিলেন ’৬৪ সালের জুন মাসে, তিনি ছিলেন একটি বদরাগী, অধৈর্য, আত্মনিমগ্ন
পুরুষ, যার সঙ্গে ’৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে-লোকটি বেরিয়ে আসেন জেল থেকে, তার কোনও
সাদৃশ্য ছিল না। কারাবাস তাঁর ভেতরকার সকল ক্লেদ, সকল আবর্জনা ঝেঁটিয়ে সাফ করে
দিয়েছে”।
কিন্তু ’৬৪ সালের সেই ক্রুদ্ধ যুবকটিকে যখন কয়েদীর
পোশাকে ঢোকানো হয় একটা মুরগির খোপের মত ঘরে, যার দৈর্ঘ ছিল ৮ ফুট আর প্রস্থ ৭,
যাতে বিছানার নামে ছিল একটি খড়ের মাদুড়, পায়খানা ছিল একটা করুণ বালতি, জানালা
প্রায় ছাদের ওপর, তখন তার গরম মাথায় আগুণ ধরে যাওয়া তো মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তার
ওপর বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে গেলে পুরোপুরিই ছিন্ন। বছরে
রবেন দ্বীপের জেলকক্ষ
|
এভাবে, নিরব প্রতিরোধ-অবরোধের শ্বাসরোধকর আবহাওয়াতে
কেটে গেল কটি বছর। ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, অনড়, নিরাপস। একপা নড়বেন না তাঁর আদর্শ থেকে,
একবিন্দু আপস করবেন না বর্ণবাদী শত্রুর সাথে। তাঁর বন্ধুদের বললেনঃ পড়, যত পার বই
পড়। ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম (সেসময় ম্যাণ্ডেলা ইসলাম আর হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে বিস্তর
জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছিলেন), সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, যা হাতে পাও তা’ই। একবার তাঁর
হাতে আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত বইঃ “ The Diary of Ann Frank”.
এসম্বন্ধে পরে তিনি লিখেছিলেন একজায়গায় বইটা কি গভীর দাগ কেটেছিল তাঁর মনে।
একসময় ম্যাণ্ডেলার মনে একটা অনুভূতি সৃষ্টি হল যে
তাঁর নিরব অসযোগিতা আর প্রতিবাদের আন্দোলনে কোন কাজ হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের অনড়
অবস্থান খানিক নরম হওয়ার চেয়ে বরং কঠিনই হয়ে চলছে দিন দিন। অতএব পথ বদলানো দরকার।
শত্রুর সঙ্গে মিতালি করেই শত্রুকে জয় করার পথ বেছে নিতে হবে। শত্রুকে বুঝার চেষ্টা
করতে হবে। শ্বেতাঙ্গ জাতির মগজে আঘাত না করে বরং ওদের অন্তরে আঘাত করে যদি কাজ হয়।
সিদ্ধান্ত নিলেন ওদের আফ্রিকাআন ভাষা শিখবেন। ওদের ইতিহাস পড়বেন। জানবার চেষ্টা
করবেন ওরা কেন এতটা বর্ণবিদ্বেষী হয়ে গেছে, কেন নিজেরা গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রে
বিশ্বাসী হয়েও এদেশের শতকরা নব্বুইটি মানুষের সকল অধিকার এমন নিষ্ঠুরভাবে ছিনিয়ে
নেবার চেষ্টা করছে? কিসের এত ভয় তারা পুষছে মনে? হ্যাঁ, অন্যের ওপর অন্যায়
অত্যাচারও তো একপ্রকার গুপ্ত ভীতিরই লক্ষ্মণ, তাই না? ম্যাণ্ডেলা তখন উঠেপড়ে
লাগলেন ওদের ভাষা শিখতে, ওদের ইতিহাস শিখতে। জানলেন যে সাদাজাতি দক্ষিণ আফ্রিকাতে
প্রথম বসতি স্থাপন করতে আসে প্রধানত কালোদের জায়গাজমি দখল করে চাষাবাদ করার লক্ষ
নিয়ে---তাদের বেশির ভাগই ছিল হল্যাণ্ড, জার্মানি, আর ফ্রান্সের কৃষিজীবি সমাজ।
তারপর উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সেখানে আবিষ্কার হয় সোনা আর হীরার খনি। ব্যস, আর
যায় কোথায়। লেগে গেল সোনাদানা নিয়ে মারামারি কাড়াকাড়ি। খবর শুনে চিরকালের
চিরশিকারি জাতি ব্রিটিশ, এলেন ভাগ বসাতে। শুরু হল দুই দলের যুদ্ধ, ইতিহাসে যা বুউর
যুদ্ধ নামে পরিচিত। (আফ্রিকাআন ‘বুউর’ শব্দটার অর্থ কৃষক) প্রথমবার ব্রিটিশ হেরে
যায়, কিন্তু দ্বিতীয়বার তারা জয়লাভ করে এবং স্থায়ীভাবে খুঁটি গেড়ে বসে আফ্রিকার
মাটিতে, কালে কালে আগেকার ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে মিশে এক জাতিতে পরিণত
হয়----আফ্রিকাআন জাতি। তাদের যুগ্ম শক্তি তখন প্রবৃত্ত হয়ে যায় বর্ণবাদী ব্যবস্থা
প্রবর্তন করে বিশাল কৃষ্ণবর্ণ আফ্রিকান জাতিকে গৃহতাড়িত করে তাদের কোনঠাসা করে
রাখাতে, যাতে তারা জীবনেও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। নেলসন ম্যাণ্ডেলা তাঁর
পড়াশুনার মাধ্যমে এটুকু বুঝতে পারলেন যে আফ্রিকাআন জাতি দক্ষিণ আফ্রিকার একটি
প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা, একে মেনে নিয়েই একটা সম্মিলিত রাষ্ট্রের স্বপ্ন তৈরি করতে
হবে দেশবাসীর মনে---সাদাকালো উভয় জাতির। একজন আরেকজনকে চাপা দিয়ে কর্তৃত্ব স্থাপন
করার চেষ্টা করলে কারুরই জয় হবে না। (এর সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের সংখ্যাগুরু হিন্দু
আর সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা ঐতিহাসিক সমান্তরাল ধারা খুঁজে পাওয়া যায়,
যদিও দুটি দেশের নিয়তি তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত পথে নিয়ে যায়) তিনি নিজের মনকে
বোঝালেন যে তাঁর স্বজাতির লোকেরা যেমন সুখদুঃখের সংসার নিয়েই কোনরকমে জীবনযাপন
করার চেষ্টা করে, সাদারাও ঠিক সেরকমই নিজ নিজ সংসারের সুখদুঃখ আর নিরাপত্তা নিয়ে
চিন্তিত---এবং নিদারুণভাবে সংখ্যালঘু হওয়ার ফলে দারুণ শঙ্কিতও। তাদের ভেতরের এই
শঙ্কাটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে কঠোর দমননীতি অবলম্বনের মধ্য দিয়ে।
জেলের ছোট্ট পরিসরের ভেতর আবদ্ধ থেকেই তিনি
পাহারাদের মন জয় করার চেষ্টাতে লেগে যান। ওদের সঙ্গে ভদ্র নম্র সৌজন্যশীল ব্যবহার,
ওদের পারিবারিক জীবনের টুকিটাকি খবর জানতে চাওয়া, ওদের সুখদুঃখের দৈনন্দিনতার
সঙ্গে নিজের একাত্মতা প্রকাশ করা----আস্তে আস্তে ওদের ভেতর থেকেও একটা সহজ মরমী মন
উঁকি দিতে শুরু করে। একজন তরুণ জেলারকে তিনি খুব করে বোঝালেন লেখাপড়া করে
পরীক্ষাটরীক্ষা দিয়ে চাকরিজীবনে একটু উন্নতিসাধনের চেষ্টা করতে। প্রথমদিকে লোকটা
খুব বিরক্তই হয়ে যেত তাঁর ওপর, কিন্তু তিনি ছেড়ে দেননি, লেগে থাকেন ওর সঙ্গে। শেষ
পর্যন্ত তাঁর পীড়াপিড়িতে অসহ্য হয়ে লোকটা বইপত্র নিয়ে পরাশুনা শুরু করে দেয়। এবং
সত্যি সত্যি পাসটাস করে চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে যায়। সে যে কি খুশি তার।
ম্যাণ্ডেলাকে ধন্যবাদ দিয়ে কূল পায় না। ক্রিস্টো ব্র্যাণ্ড নামক এক ওয়ার্ডেন ছিলেন
সেই রাজবন্দী ওয়ার্ডে। তাঁকেও তিনি বশ করে ফেললেন, নরম ভদ্র ব্যবহার আর ছোটখাটো
উপকার দিয়ে। কয়েদী হিসেবে তিনি ছিলেন একেবারে নিখুঁত আদর্শ কয়েদী। নিজের বিছানাটি
সবসময় নিজেই গুছিয়ে রাখতেন ( এ-অভ্যাসটি তিনি সারাজীবন বজায় রেখেছেন, এমনকি
প্রেসিডেন্ট হবার পরও), খাবার প্লেটটি
দেবদেবির মলাটে সেক্সপীয়ার
|
পরবর্তীতে ম্যাণ্ডেলার জেলরক্ষকদের প্রতিটি লোক
তাঁর অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। ক্রিস্টো ব্র্যাণ্ড তো রীতিমত পিতৃসম সম্মান দিয়ে কথা
বলতে শুরু করেন তাঁর সঙ্গে। তাই তো হওয়া উচিত। ম্যাণ্ডেলা যখন জেলে যান তখন তাঁর
বয়স ঞ্ছিল মাত্র ১৮, ছেলের বয়েসী। নেলসন ম্যাণ্ডেলার চরিত্রে আরেকটি অসাধারণ
বৈশিষ্ট্য ছিল যে কারুর উপকার বা ভালো ব্যবহার তিনি কখনোই ভুলতেন না। এই যে সাধারণ
একটি লোক, জেলখানার পাহারাদার বই কিছু নন, তাঁকেও তিনি পার্লামেন্টভবনের ভিড়ের মাঝ
থেকে চিনতে পেরে সবার কাছে ঘোষণা করেছিলেনঃ “এই যে দেখুন সবাই, ইনি আমার বন্ধু,
জেলের ওয়ার্ডেন ছিলেন”। সেসময় তিনি সারা দক্ষিণ আফ্রিকার মহাশক্তিধর প্রেসিডেন্ট
আর ব্র্যাণ্ড একজন সামান্য কর্মচারি। তার একটু পর যখন পার্লামেন্ট সদস্যদের একটা
গ্রুপ ফটো তোলার আয়োজন করছিলেন সরকারি ফটোগ্রাফাররা, তখন ব্র্যাণ্ড সাহেব আস্তে
করে সরে দাঁড়াবার উদ্যোগ নেন। ম্যাণ্ডেলা তাঁকে ধরে রাখলেনঃ “ না, আপনাকেও থাকতে
হবে আমাদের সঙ্গে। আপনি তো আমাদের থেকে আলাদা নন”। একজন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে
এধরণের ব্যবহার কি কেউ ভুলতে পারে জীবনে। এভাবেই তিনি তাঁর প্রাণের ছোঁয়া দিয়ে জয়
করে নিয়েছিলেন সকল দেশবাসীর মন, সাদা-কালো নির্বিশেষে।
রাজনৈতিক সংগ্রামের দিক থেকে ম্যাণ্ডেলার
চিন্তাভাবনাতে আমূল পরিবর্তন এলেও তাঁর মূল লক্ষপথ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
পূর্ণ স্বাধীনতা, উভয় সম্প্রদায়ের সমান অধিকার, এই আদর্শের সঙ্গে কোনও আপস নেই।
‘এক জাতির এক দেশ’ তাঁর অন্তিম স্বপ্ন হলেও প্রথমত সেই জাতির দুটি ধারাকে একসাথে
যোগ দিতে হবে, এবং একই সমতলের ওপর দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার প্রশ্নে একটাই শর্ত তাঁরঃ
ঘৃণ্য বর্ণবাদী শাসনতন্ত্র সমূলে উৎপাটন করতে হবে, তার আগে কোনও আলোচনা নেই। তাঁর
সহবন্দীরা যাতে কর্তৃপক্ষের মিষ্টি কথাতে না ভুলে যান তার জন্যে তিনি বারবার ওঁদের
মনে করিয়ে দিতেন যে, তাদের
সংগ্রামের সেই মৌলিক প্রশ্নতে আপস করলে আজীবন তাদের স্বজাতিকে
সাদাদের পায়ের নিচে গোলামি করতে হবে, যা থেকে তারা কখনোই মুক্তি পাবে না। তিনি ওদের
উইলিয়াম আর্নেস্ট হেনলির কবিতা “Invictus” থেকে উদ্ধৃতি শোনাতেনঃ “ I am the
master of my fate. I am the captain of my soul”. ইনভিক্টাস শব্দটির অর্থঃ
অপরাজেয়। বা দুর্জয়। এই ছোট্ট গল্পটির প্রেরণাতেই বোধ হয় পরবর্তীতে ঠিক এই নামেই
হলিউডের একটা চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল, যাতে ম্যাণ্ডেলার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন
বিখ্যাত কালো চলচ্চিত্র নায়ক মর্গান ফ্রিম্যান। ছবিটি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
আশির দশকে বাইরে বিশ্বে সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ
সরকারের কঠোর বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছিল।
ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর সহবন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের আশু মুক্তির দাবিতে চারদিক থেকে সৃষ্টি
হচ্ছিল দারুণ চাপ। ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী ব্রায়ান মালরুনি রক্ষণশীল দলের নেতা
হলেও মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের এই বর্বর বর্ণবাদী
নীতি। মনেপ্রাণে তিনি সমর্থন করতেন নেলসন ম্যাণ্ডেলা ও আফ্রিকান ন্যাশনাল
কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল লক্ষগুলোকে। অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে
তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর বানিজ্যিক সম্পর্ক মুলতুবি করার সিদ্ধান্ত নেন। যা
ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট
রোনাল্ড রেগান করেন নি, এবং করতে কোনরকম আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তাঁদের দৃষ্টিতে এ
এন সি একটি সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠান, অতএব অসমর্থনযোগ্য, এবং নেলসন ম্যাণ্ডেলা নামক
সেই লোকটি একজন দাগী আসামী, এবং ভয়ঙ্কর
উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী নেতা ছাড়া কিছু নয়। অনেকের হয়ত জানা নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের
সরকারি দৃষ্টিকোন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার এ এন সি প্রতিষ্ঠানটি ‘সন্ত্রাসী
প্রতিষ্ঠান’এর কৃষ্ণতালিকা থেকে নিষ্কৃতি পায়নি ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ
স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হবার ১৮ বছর পর! আরো বিস্ময়ের বিষয় যে গত সপ্তাহে যখন সমস্ত
পৃথিবী শোকে বিহ্বল নেলসন ম্যাণ্ডেলার মৃত্যসংবাদ পেয়ে, প্রতিটি দেশের প্রতিটি নগর
উপনগর প্রতিটি পথের মানুষ, মুটেমজুর ধনীদরিদ্র একদণ্ড দাঁড়িয়ে নিরব প্রর্থনায়
নতমস্তক হয়ে থেকেছেন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগোচ্ছাসে, সেখানে আমেরিকার কোন কোন জায়গার
বিজ্ঞ নগরপালেরা তাঁদের পতাকা অর্ধনমিত করতে রাজি হননি। কারণ? ম্যাণ্ডেলা একটি
টেররিস্ট নেতা, একটি কমুনিস্ট। ‘কমুনিস্ট’ শব্দটি আমার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের
কর্মকর্তাদের কানে অনেকটা পাগলা কুকুরের কামড়ের মত কাজ করে----তৎক্ষণাৎ একপ্রকার
জলাতঙ্ক শুরু হয়ে যায়, মিরকি রুগীর মত গা কাঁপতে শুরু করে থরথর করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের কাছে কালোদের
আন্দোলন যতনা ক্ষতিকর তার চেয়ে হাজারগুণ ক্ষতিকর হয়ে উঠছিল বাইরের পৃথিবীতে যে
তুমুল প্রতিবাদ ও অর্থনৈতিক অসহযোগের আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল। ক্রমেই তারা
বাইরের জগতের চোখে একটি ত্যাজ্য রাষ্ট্র, একটি বর্জ্যরাষ্ট্র হয়ে উঠছিল---যেখানে
মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করা হয়না যদি তার গায়ের রংটি তাদের পছন্দমত না হয়, যেখানে
গণতন্ত্র একটি মুখের বুলি ছাড়া কিছু নয়, যেখানে মুক্তি মানে সাদাদের মুক্তি আর
কালোদের চিরদারিদ্র্যের অন্ধকারে যাবজ্জীবন কারাবাস, তাদের নিজেদেরই দেশে। এ এক
পরম বিড়ম্বনা যে কালো জাতিকে পৃথক করতে গিয়ে তারা নিজেরাই পৃথক হয়ে যাচ্ছিল সমস্ত
পৃথিবী থেকে। বর্ণভিত্তিক বিচ্ছিন্নতার প্রত্যুত্তরে মানবতাভিত্তিক বিচ্ছিন্নতা।
আশির দশকের শেষের দিকে সাদা কর্তৃপক্ষ ভীষণ
বেকায়দায় পড়ে গেলেন। তখন তারা ফাঁক খুঁজতে লেগে গেলেন কিভাবে উভয়কূল রক্ষা করা
যায়। ভাবলেন ম্যাণ্ডেলাকে একটু খাতিরযত্ন করলে হয়ত তাঁর মন গলানো যাবে, এবং কিছু
সুযোগসুবিধা আদায় করে নেওয়া যাবে ওদের স্বজাতির জন্যে। তাঁকে সাধারণ জেলখানা থেকে
সরিয়ে ওদের বড়কর্তার নিজের বাসগৃহের লাগোয়া একটা সুন্দর সুসজ্জিত বাগানঘেরা দ্বিতল
বাড়িতে থাকতে দেওয়া হল। আর বলা হলঃ আপনাকে কিছুই করতে হবে না, শুধু বলুন সহিংস পথ
বর্জন করবেন, ব্যস, তৎক্ষণাৎ খালাশ। কেবল আপনি নন, আপনার সঙ্গীসাথীরাও। কিন্তু
ম্যাণ্ডেলাকে তারা তখনো ভালো করে চেনেনি। বললেনঃ উঁহু, তা হবে না। প্রথমে আপনাদের
সহিংসতা ছাড়ুন, তারপর আমরা ছাড়ব। বর্ণবৈষম্য পুরোপুরি উৎখাত করতে হবে, তার আগে
কোনও আপস নেই। আমাদের গুটিকয় মানুষের ‘খালাশ’ আর জাতির মুক্তি এক জিনিস নয়। খালাশ
হতে হলে হবে শর্তহীন, তার কম কিছু আমরা মানব না। অগত্যা তাই করতে হল আফ্রিকাআন
সরকারকে। ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃবর্গ নিঃশর্ত
মুক্তি নিয়ে বের হলেন জেল থেকে, পুরো ২৭ বছর পর। ম্যাণ্ডেলার ব্যক্তিগত জীবনের
একটা বড় অংশই ছাঁটাই করে ফেলা হয়েছিল, বিশেষ করে তাঁর পারিবারিক জীবন। স্ত্রীপুত্র
পরিজনের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই রাখতে দেওয়া হয়নি প্রথম দশ এগারো বছর। এমনকি যখন তাঁর
বড় ছেলে মারা যায় তখনো তাঁকে শেষকৃত্য উপলক্ষেও কয়েক ঘন্টার জন্য বেরুতে দেওয়া
হয়নি। নাতিনাতনির জন্মবৃদ্ধি, নিজের ছেলেমেয়েরা বড় হল, বিয়েশাদী করল, বাবামা হল,
তা’ও উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। কিন্তু সেজন্যে কি কোনও অনুশোচনা ছিল তাঁর?
মোটেও না। দেশের মুক্তির আগে তাঁর নিজের মুক্তি, তা ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখকষ্ট
থেকে হোক আর গোষ্ঠীগত সমস্যা থেকেই হোক, অর্থহীন। সেই পূর্ণমাত্রিক মুক্তির
প্রাথমিক স্বাদটুকু তিনি পেলেন সেই কারাদ্বার দিয়ে বহির্গত হবার সময়, যখন তাঁর
একপাশে স্ত্রী উইনি ম্যাণ্ডেলা, আরেকপাশে তাঁর ছেলেমেয়ে আর আত্নীয়স্বজনেরা,
সম্মুখে বিপুল জনতা হর্ষধ্বনিতে সম্বর্ধনা জানাতে দাঁড়িয়েছে তাদের বীর নেতাকে।
পাঁচ
জেলখানাতে খাকাকালেই ম্যাণ্ডেলা জানতেন যে তাঁর
‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ সারাজীবন যাবজ্জীবন থাকবে না----শ্বেতাঙ্গ সরকারের পতন
অবশ্যম্ভাবী এবং আসন্ন। নৈতিক মানবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে কোন শক্তিই বেশিদিন
রাজত্ব করতে পারেনি, ইতিহাস পড়ে এটুকু শিক্ষা তিনি পেয়েছেন। এবং তাদের পতন মানেই
হবে তাঁর স্বজাতির মুক্তি ও উত্থান। কিন্তু প্রশ্ন হলঃ সেই উথান কি মূর্তি ধারণ
করে আবির্ভূত হবে? প্রতিশোধের দাবানল হয়ে, না, ক্ষমা ও উদার দাক্ষিণ্যের বর্তিকা
হয়ে। ৭২ বছর বয়স্ক ম্যাণ্ডেলা কতগুলো বিষয় সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন
জেলখানার দরজা দিয়ে পা বাড়াবার সাথে সাথে। সম্মুখে ‘দুর্গম গিরি, দুস্তর পারাবার’।
তাঁর প্রাণপ্রিয় দেশটি এমুহূর্তে একটি বারুদকুণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, দেশলাইর টোকা
পড়ামাত্র প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে বিপুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে সারা দেশ।
সেই দাবানল, সেই রক্তগঙ্গার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা যদি কারো হাতে থাকে
সে-মানুষটি কেবল তিনিই। সারাজীবন তাঁর স্বজাতির জন্য নিঃস্বার্থ, নিরাপস ও নির্ভীক
সংগ্রাম করে, নিজের ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্য সব অকাতরে বিসর্জন দিয়ে, সর্বোপরি
তাঁর অসামান্য চারিত্রিক শক্তি ও ব্যক্তিত্বময় নেতৃত্বের পরিচয় দিয়ে, জাতির অকৃপণ
শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করেছেন। জাতির কাছে নেলসন ম্যাণ্ডেলার ভাবমূর্তি তখন এতটাই
উঁচুতে যে তার সঙ্গে একমাত্র ১৯৭১ সালের শেখ মুজিবুর রহমানেরই তুলনা চলে। তিনি
যেদিন ছাড়া পান জেল থেকে সেদিন এক ঠেম্বু গোত্রের নেতা মন্তব্য করছিলেনঃ “ আজকে
মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে স্বর্গ নেমে এসেছে মর্ত্যে, একজন মহাপুরুষকে বরণ করতে হবে
বলে”। তিনি জানতেন যে জনগণ পছন্দ করবে না
এমন কোন পদক্ষেপও যদি নিতে হয় তাঁকে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে তাহলেও
তারা অকপটে তাঁকে সমর্থন করবে। এমনই অন্ধ বিশ্বাসের গুরুদায়িত্ব তাঁর স্কন্ধে তখন।
কিন্তু জেলখানার শেষের ১৬টি বছরে তাঁর অন্তর্লোকের যে আমূল বিবর্তন সংঘটিত হয়ে
গেছে, যে সুস্পষ্ট অন্তর্দৃষ্টি তিনি অর্জন করেছেন, তাতে করে তাঁর সামনে চলার পথটি
অতি সহজভাবেই আঁকা হয়ে গিয়েছিল। কোনরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না তখন তাঁর মনে।
মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে কাছে টানো, মানুষ তখন ভালোবাসা নিয়েই কাছে চলে আসবে।
মানুষের শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা স্থাপন করো, মানুষ তার অন্তরে আপনা থেকেই খুঁজে পাবে
শুভবুদ্ধির উৎস। সবচেয়ে শক্তিশালী যে শক্তি তার নাম অস্ত্র নয়, গোলাবারুদ আর
ঢালতলোয়ার নয়, অমানুষিক দমননীতি তো একেবারেই নয়, প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসা হল সবচেয়ে
দুর্বল ও অকেজো শক্তি, সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতা হল ক্ষমা। ক্ষমা দিয়েই কেবল মহা
ক্ষমতাবানকে অক্ষম করে ফেলা যায়, অন্য কিছু দিয়ে নয়। এ সত্যটি তাঁর দেশবাসীকে
বোঝাতে হবে, সেদায়িত্বটি তিনি সানন্দে গ্রহণ করে নেন নিজের ওপর।
ম্যাণ্ডেলাকে নিরঙ্কুশ মুক্তিদানের পেছনে
শ্বেতাঙ্গশক্তির একটি মানুষের বিশেষ অবদান ছিল----তখনকার রাষ্ট্রপতি ড্য ক্লার্ক।
তিনি দিব্যচক্ষে দেখতে পেরেছিলেন ইতিহাসের চাকা কোনদিকে আবর্তিত হচ্ছে। তাঁর নিজের
সাদা সম্প্রদায়ের বিরোধিতার ঝুঁকি নিয়েই এগিয়ে এসেছিলেন ম্যাণ্ডেলা ও তাঁর দলবলের
কাছে আপস আর সম্প্রীতির হাত বাড়িয়ে। রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গদের অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে
উঠেছিলেন তাঁর প্রতি। ওদিকে কালোদেরও সবাই সমান উৎসাহের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর
সঙ্গে একাত্মতা বোধ করছিলেন তা নয়। পূর্বাঞ্চলের জুলু জাতির চীফ মঙ্গোসুথু
বুথেজিলি প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শেষে ম্যাণ্ডেলার
বিপুল ব্যক্তিত্বের ছায়াতলে তাদের কেউই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি।
কারামুক্তির পর একাধারে অনেকগুলো দেশ তিনি ঘুরে
বেড়ালেন, শিখলেন কোন দেশে কিধরণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে। সেগুলোর
অন্যতম ছিল ক্যানাডা----প্রধানত ক্যানাডা সরকারের নিঃশর্ত সমর্থনের জন্য, সে ঋণ
ভোলার মত মানুষ তো তিনি ছিলেন না। তদুপরি ক্যানাডার আর্থিক সাহায্য, এবং এদেশের
গণতান্ত্রিক কাঠামো থেকে কিছু চিন্তার খোরাক নিয়ে যাওয়া। কারামুক্তির গোড়াতেই
ম্যাণ্ডেলা তাঁর কথাবার্তায় পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন সবাইকে যে কোনরকম তিক্ততা তিনি
পোষণ করছেন না কারো বিরুদ্ধে। সবার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েই তিনি অতীত ভুলে নতুন
সূর্যের নতুন পথ তৈরি করে নিতে চান। ঘাতসংঘাত ঢের হয়েছে গত সাড়ে তিনশ’ বছর ধরে,
সেই দিনগুলো স্মৃতির গোপন কোঠাতে ঢুকিয়ে রেখে এগিয়ে যেতে হবে সামনে।
১৯৯৪ সালে, সাদা-কালো উভয় জাতির সম্মিলিত ভোটে
নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলেন নেলসন ম্যাণ্ডেলা। অভিষেক অনুষ্ঠানে
তিনি বলেছিলেনঃ “ কখনো নয়, আর কখনোই এই সুন্দর দেশটিতে এক জাতি আরেক জাতির ওপর
আধিপত্য স্থাপন করার উদ্যোগ নেবে না। সূর্য কোনদিনই অস্ত যাবে না মানবজাতির এমন
গৌরবান্বিত অর্জনের ওপর”।
ক্ষমতাসীন হবার পর অন্যতম প্রধান কাজটিই ছিল জাতির
পুরনো ক্ষত কেমন করে ঘোচানো যায়। গঠন করা হল ‘সত্য ও সমন্বয় সন্ধান কমিশন’ (Truth
and Reconciliation Commision)। কোথায় কোথায় গর্হিত মানবতা লঙ্ঘনের
ঘটনা ঘটেছে, তা উদ্ঘাটন করে সবাইকে জানতে দেওয়া----শাস্তি
দেওয়ার জন্যে নয়, মার্জনা করে সামনে চলার শপথ নেবার জন্যে। আস্তে আস্তে আগেকার
শত্রুপক্ষ, সাধারণ সাদা নাগরিক, তারা আশ্বস্ত বোধ করতে থাকেন যে হয়ত, হয়ত, এ-লোকটির
ওপর আস্থা স্থাপন করা যায়, হয়ত আসলেই কোনও প্রতিশোধের মতলব নেই তাঁর মনে, একটি
সত্যিকার খাঁটি মানুষ। তাদের শ্রদ্ধা জাগতে শুরু করে। কিন্তু ম্যাণ্ডেলা জানতেন
সাড়ে তিনিশ’ বছরের ব্যবধান এত সহজে দূর হবার নয়। দূরত্ব কমাতে হলে দুপক্ষেরই
জনগণকে একসাথে মিলিত হতে হবে, একজনের সুখে আরেকজনকে শরিক হতে হবে, একজনের কষ্টে আরেকজনকে
কষ্ট বোধ করতে হবে। বিশেষ করে উভয়জাতির প্রাণে জাগাতে হবে একটা সম্মিলিত
জাতীয়তাবোধ, একটা একক অহঙ্কার তাদের দেশকে নিয়ে। দেশের গৌরবে উল্লসিত হবে সাদাকালো
নির্বিশেষে। দেশপ্রেম বলতে বোঝাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, একটি দেশ, একটি জাতি। তাঁর
সোনার দেশ, যার বিকল্প নাম দিয়েছিলেন তিনিঃ রেইনবো নেশন। বর্ণালি জাতি। নানা রঙের
নানা বর্ণের পাঁচমিশেলি জাতি, একই পতাকার তলে, একই শপথের বন্ধনে আবদ্ধ, একই জাতীয়
লক্ষস্থলের সহযাত্রী।
কিন্তু সেই অলীক স্বপ্নপুরিতে তাদের কেমন করে নিয়ে
যাবেন তিনি? কেমন করে সিদ্ধ হবে সেই অসাধ্য সাধন?
খেলা। হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ খেলার পাগল। কালোরা
পাগল গরিবের খেলা ফুটবলে, আর সাদারা পাগল তাদের বড়লোকের খেলা রাগবি আর ক্রিকেটে।
বিশেষ করে রাগবি। খেলাটি প্রধানত চারটে শ্বেতাঙ্গ জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ----ব্রিটেন,
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় রাগবি দলকে
বলা হয় ‘স্প্রিঙ্গবক্স’। ক্রিকেট আর ফুটবলের মত রাগবিরও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা
হয় কয়েক বছর পর পর। ১৯৯৫ সালের প্রতিযোগিতাটি হওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার
প্রিটোরিয়াতে। ম্যাণ্ডেলা ভাবলেন, এই এক সুবর্ণ সুযোগ। এবার যদি দুই সম্প্রদায়কে
এক স্টেডিয়ামে জড় করে একই দলের পেছনে মাতোয়ারা করে তোলা যায়।
’৯৪ সালে তাঁর বাসভবনে চায়ের নিমন্ত্রণপত্র
পাঠালেন রাগবিদলের সাদা ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস পিনারকে। পিনার হয়ত একটু থমমত খেয়ে
গিয়েছিলেন দাওয়াত পেয়ে। সারাজীবন তিনি শুনে এসেছেন যে এই লোকটা, যে এখন সংখ্যাগুরুত্বের জোরে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন, তিনি একজন
সন্ত্রাসী, ঘৃণ্য কমুনিস্ট। দুই সম্প্রদায়ের মাঝে একটা রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টি
হয়েছে বটে, এবং প্রধানত তাঁরই উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণাতে, কিন্তু কতটা আন্তরিকতা সত্যি
সত্যি আছে তাঁর সেসম্বন্ধে সব সাদাদের সংশয় পুরোপুরি দূর হয়নি। পিনার ছিলেন সেরকম
সংশয়ী শ্বেতাঙ্গদের একজন। কিন্তু রাষ্ট্রভবনের সহজ সুন্দর পরিবেশে একটি আশ্চর্যরকম
ভদ্র মার্জিত ও জ্ঞানীগুণি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপের পরই তাঁর মনে হল
তিনি কোনও সাধারণ মানুষের সামনে এসে বসেননি----একজন সত্যিকার ঋদ্ধপুরুষ, একজন মহৎ
নেতা, একজন জাতীয় নেতা, কালোদের নয় কেবল, সাদাদেরও। ম্যাণ্ডেলা ওঁকে বললেনঃ আমি
চাই আপনাদের রাগবি দল আগামি বছরের প্রতিযোগিতাতে অন্যান্য দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান
হোক। আমি চাই এই দল কেবল সাদাদের জাতীয় দল থাকবে না, সত্যিকার জাতীয় দলে পরিণত
হবে, যাতে সাদা-কালো উভয় জাতি সমান গর্ববোধ করবে, সমান হর্ষধ্বনিতে কাঁপিয়ে তুলতে
পারবে খেলার স্টেডিয়াম। এর জন্যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব
আমি অকৃপণভাবে সেটা করব, এই প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি আপনাকে। এতটাই আবেগ আর
আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন তিনি কথাগুলি যে পিনার একেবারে অভিভূত হয়ে গেলেন। তিনি
নিজেকে দেখতে পেলেন এক নতুন যুগের বার্তাবহ নায়ক হিসেবে---ভাবলেন, এতো চমৎকার
আইডিয়া, রাগবি দিয়ে জাতিকে এক করা। প্রেসিডেন্ট তাঁকে বুঝালেন যে সাধারণ মানুষের
মনে তিনি এই বাণীটুকু গেঁথে দিতে চান যে এখন থেকে এদেশের সবকিছুই এক জাতি, এক গান
এক খেলা এক হার এক জিত----কোনকিছুই পৃথক পৃথক নয়, যা ছিল গত সাড়ে তিনশ’ বছর। এ এক
অসাধারণরকম সরল সুন্দর আইডিয়া, অথচ কি দারুণ শক্তিশালী। পিনার নিজেকে সেই অসীম
শক্তির কেন্দ্রমূলে অবস্থিত হতে দেখে ভাগ্যবান মনে করলেন। জাতির এই মৌলিক
পরিবর্তনের স্রোতের প্রবাহতে তিনি একটা বড় দায়িত্বের ভূমিকাতে দাঁড় করালেন নিজেকে।
তার পরের ঘটনাবলী এক অবিশ্বাস্য রূপকথার মত।
ম্যাণ্ডেলা যখনই সময় পেতেন তখনই গিয়ে হাজির হতেন রাগবি খেলোয়াড়দের খেলার মাঠে, ওদের সঙ্গে
কথাবার্তা বলে ওদের উৎসাহ দিতেন----আপনাদের জিততে হবে খেলাতে, সমস্ত জাতি তাকিয়ে
আছে আপনাদের দিকে, আপনাদের জয় হবে সমগ্র জাতির জয়, সমগ্র
জাতির গৌরব।ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসের মনে আছে তাঁর পরিষ্কার উৎসাহবাণীঃ “ Get out there
and win, wear that shirt with pride certain of my support”. (চলে যান ওই মাঠে, গর্বের
সাথে গায়ে দিন এই জামা, আর জানবেন আমি আছি আপনাদের পেছনে, প্রতিমুহূর্তে)
খেলোয়াড়রা তাদের প্র্যাকটিসের সময় স্বয়ং প্রেসিডেন্টকে পেয়ে, তাঁর এধরণের
কথাবার্তা শুনে দারুণ অনুপ্রাণিত বোধ করতেন। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে তিনি বুঝিয়ে দিতেন
তাদের যে তিনি তাদেরই একজন। এই একটা জিনিস ছিল ম্যাণ্ডেলার চরিত্রে----হাসিমুখ। এই
লোকটার গুমরো মুখ বোধ হয় জীবনেও কেউ দেখেনি----পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মত একগাল হাসি
তাঁর লেগেই থাকত মুখে। তাঁর প্রিয় বচনটিই ছিল এরকমঃ “ Tread softly, breathe
peacefully, laugh hysterically”.( পা রাখুন যাতে শব্দ না হয়, শ্বাস নিন শান্তিতে,
হাসুন প্রাণ খুলে”)
১৯৯৫ সাল। ফাইন্যাল খেলা নিউজিল্যাণ্ড আর
স্প্রিঙ্গবক্সের মাঝে। অপরপক্ষ অনেক বেশি শক্তিশালী দল সেটা সবাই জানত। দক্ষিণ
আফ্রিকা হেরে যাবে সেটা একরকম ধরেই নিয়েছিল বাজিব্যবসার কুশীলবেরা। কিন্তু দক্ষিণ
আফ্রিকা হারেনি, হেরেছিল বাজিবাজরা। তারা বুঝতে পারেনি যে এবারকার দক্ষিণ আফ্রিকা
দলের সঙ্গে আরেকজন বড় খেলোয়াড় ছিলেন যার নাম নেলসন ম্যাণ্ডেলা, যার খাতাতে
হেরে-যাওয়া বলে কোন শব্দ ছিল না। সেদিন খেলার মাঠে সাদা দর্শকরাই ছিল না কেবল,
বিপুল সংখ্যক কালো আফ্রিকানও ছিল। তার মূলে কে ছিল সেই জাদুকরি শঙ্খবাদক সেটা কি
বলার অপেক্ষা রাখে? খেলাশেষের শিঙ্গা বেজে ওঠার সাথে সাথে বিশাল জনতা, সাদা-কালো
নির্বিশেষে, আনন্দোচ্ছাসের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণে কাঁপিয়ে তুলল আকাশপাতাল। রাগবি
দলের ছাপমারা একটি সবুজ জামা, যা অল্পকটি বছর আগেও ছিল উগ্র বর্ণবাদী শাসনের
নির্লজ্জ প্রতীক, সেই একই পোশাক সগর্বে নিজের গায়ে চাপিয়ে নেলসন ম্যাণ্ডেলা আনন্দে
আটখানা হয়ে মাঠে নেমে প্রিতিটি খেলোয়াড়কে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানালেন, সাধুবাদ
জানালেন। ক্যাপ্টেন পিনারকে যখন ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন কতবড় একটা উপকার তাঁরা করলেন
সমস্ত দেশটির, তখন পিনার তাঁর ভুল সংশোধন করে জবাব দিলেনঃ “ No Madiba, you’ve got
it wrong. Thank you for what you’ve for South Africa”. (না মাদিবা, আপনি
ভুল বললেন। ধন্যবাদ পাবেন আপনি, আপনি যা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার জন্যে)
শুধু রাগবি নয়, পেশা স্তরের সব খেলাতেই তিনি
ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন যার অন্যতম ছিল গলফ, যেসম্বন্ধে আগেই
বলা হয়েছে একটু। কি আশ্চর্য বিচারবুদ্ধি ছিল লোকটার----ঠিক ধরতে পেরেছিলেন যে খেলা
দিয়ে যত সহজে দুই জাতিকে একত্র করা যাবে তত সহজে হয়ত অন্য কিছুতে সম্ভব হবে না।
তা’ই তো হয়েছিল। সেই রাগবি খেলাতে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতে যাওয়ার পর মানুষের সে কি
খুশি। রাস্তায় রাস্তায় মানুষে-মানুষে মুক্তমনে কোলাকুলি করছিল সাদা-কালো-তামা-সীসা
সকল বর্ণের সকল ধর্মের সাধারণ মানুষ। দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে এমন দৃশ্য জীবনেও
কেউ দেখেনি।
খেলাতে মানুষকে একসাথে নিয়ে আসাটা যত সহজে করতে
পেরেছিলেন তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিন্তু এত সহজ ছিল না কিছুই। ’৯০ সালে
কারামুক্তির পর বেশ কিছুটা সময় তিনি দেশবিদেশ ঘুরে বেরিয়েছিলেন, যার মধ্যে
ক্যানাডা ছিল প্রথম ক’টির একটি। তার বড় কারণ ঋণ---সেই যে বড় সমর্থনটা তিনি এবং
তাঁর এ এন সি পার্টি পেয়েছিলেন তাঁদের দুঃসময়ে, সেই ঋণটি শোধ না করা গেলেও সকৃতজ্ঞ
স্বীকৃতিটা তো নিশ্চয়ই সম্ভব। সেটা তিনি করেছিলেন ক্যানাডায় শুধু নয়, ইউরোপের বেশ
ক’টি দেশ এবং কিউবাতেও। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিডেল কাস্ট্রোর কাছ থেকে তিনি
পেয়েছিলেন অকুন্ঠ সমর্থন তাঁর চরম বিপদের সময়---অতএব কিউবা কোন মহাশক্তির শত্রু আর
কার মিত্র ওসব তিনি গ্রাহ্য করেননি, তাঁর যা কর্তব্য বলে মনে হত তাই করতেন।
রাজনীতিতে এমন নীতিবান নেতা যে বর্তমান যুগেও থাকা সম্ভব সেটা একমাত্র নেলসন ম্যাণ্ডেলাই
দেখিয়ে যেতে পারলেন। কট্টির রক্ষণশীল সাদাদের কেউ কেউ ভাবতেন, লোকটা আসলে অতিরিক্ত
চালাক, মানুষকে ভুলিয়ে ভুলিয়ে কাজ আদায় করে নিচ্ছে, এগুলো সবই তাঁর কূটনৈতিক চাল।
হায়রে মূর্খ জাতি। তারা কল্পনাই করতে পারত না যে এই মানুষটার শরীরের একটি
রক্তবিন্দুতেও কূট বলে কিছু ছিল না, সবই তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত
পবিত্র বারিধারা।
সংবিধান নিয়ে আফ্রিকাআন সরকার ও এ এন সি’র ভেতর যে
আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছিল সেটাই ছিল সবচেয়ে শক্ত পরীক্ষা। কে কাকে কতটা ছাড় দেবে
সেই ছিল বড় প্রশ্ন। সাদাদের ভয় তারা না কালো সংখ্যাধিক্যের ভারে সর্বস্ব হারিয়ে
একবারে গুঁড়িয়ে যায়। কালো নেতাদেরও অনেকেই শ্বেতাঙ্গদের যথাসম্ভব দাবিয়ে রাখারই
পক্ষপাতী ছিলেন। এ-দুয়ের মাঝে একটা আপস মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত জাতির পুরণো ক্ষত
কখনোই মোচন হবে না, সেটা কেবল ম্যাণ্ডেলাই হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন। সে প্রসঙ্গে তিনি
একবার মন্তব্য করেছিলেনঃ “ One of the things I learned when I was negotiating
was that until I changed myself I couldn’t change others”. (আলোচনার টেবিলে বসে
দরাদরি করতে গিয়ে একটা জিনিস আমি বুঝতে পেরেছিলামঃ আমি যদি নিজেকে বদলাতে না পারি
তাহলে অন্য কাউকে পারব না”) কত সরল সহজবোধ্য একটা উক্তি, অথচ কি অসাধারণ।
দক্ষিণ
আফ্রিকার দু’টি বিপরীত জনস্রোতকে একটি একক ধারাতে প্রবহমান করে তোলা, এবং এমন দুটো
জাতি, যারা সাড়ে তিন শতাব্দীব্যাপী ছিল শাসক আর শাসিতের সম্পর্কতে বাঁধা, শোষক আর
শোষিত, অত্যাচারি ও অত্যাচারিত, ঘৃণক আর ঘৃণিত, সেই কঠিন পরীক্ষাতে জীবনের প্রতিটি
মুহূর্তকে বিসর্জন দিতে হয় তাঁর, বিসর্জন দিতে হয় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের যৎসামান্য
সুখসম্ভোগ, বিসর্জন দিতে হয় তাঁর সমস্ত পরিবারকে। জেলখানার সাতাশটি বছরে তাঁর
ফেলে-আসা পরিবার ফুলে ফেঁপে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল----তাঁর ছেলেমেয়েরা, তাদের বড় হয়ে
ওঠা, তাদের বিয়েশাদি করে আপন আপন জীবন গড়ে তোলা, এসব কিছুই তাঁর নিজের চোখে দেখা
সম্ভব হয়নি। স্ত্রীসঙ্গ তো ছিল এক অসাধ্য স্বপ্ন। একটি কন্যাসন্তানের মুখ দেখেন
তিনি যখন মেয়ের বয়স টিনেজে পৌঁছে গেছে। সে-ঘাটতিটা কখনোই পুরণ হতে পারেনি।
প্রেসিডেন্ট হবার পর জাতি তাঁকে যতটা পেয়েছিল তাঁর পরিবার হয়ত ততটা পায়নি। তাঁর
নিজেরই ভাষাতেঃ “ When one is father to all, one is less a father to his own”. (যাকে সমস্ত জাতির পিতা হতে হয় তার নিজের বাড়িতে পিতার ভূমিকাটি অনেকটাই
হ্রাসপ্রাপ্ত হয়) সবচেয়ে বড় কষ্টটা ছিল তাঁর প্রাণপ্রিয় জীবনসঙ্গি, যাকে তিনি
জেলখানার অন্ধকার গুহাতে বসে প্রতিদিন একটা করে চিঠি লিখতেন যা কখনো ডাকে পাঠানো
সম্ভব হত না, সেই অসামান্য রূপগুণের অধিকারি বীর নারী ও সহবিপ্লবী উইনি
ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া ১৯৯৬ সালে, নানা কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে। প্রকাশ্যে
বলেননি কখনো, কিন্তু ঐ ঘটনাটি ভীষণ কষ্টকর ছিল তাঁর জন্য। না, কষ্ট তিনি কখনোই
প্রকাশ হতে দিতেন না। যে কোন কষ্ট বা ভয়কে চেপে যাওয়ার একটা অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল
লোকটার। একবার তাঁর জীবনীকার রিচার্ড স্টেনগেল আর তিনি ছোট্ট একটা প্লেনে করে
যাচ্ছিলেন কোখাও দক্ষিণ আফ্রিকারই সীমানার মধ্যে। খুবই ছোট প্লেন, চাপাচাপি করে
বসতে হয়েছিল। ম্যাণ্ডেলা আপনমনে পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন। এক সময় পত্রিকার
প্রেসিডেন্ট ম্যাণ্ডেলা
|
রিচার্ড স্টেনগেল তখনই বুঝতে পারলেন কেন লোকটাকে
মহৎ নেতা বলা হয়। ভয় যখন অন্য সবাইকে আড়ষ্ট করে ফেলে তখন তাঁর চোখেমুখে ভয়ের
লেশমাত্র দেখা দেবেনা, যার অর্থ এই নয় যে তিনি ভয় পাননি, অর্থ কেবল এই যে সে-ভয়টা
তিনি অন্যকে দেখতে দেননি।
প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যাণ্ডেলা তাঁর
রাষ্ট্রপরিচালনার প্রথম দফাটি সমাপ্ত হবার পর দ্বিতীয় টার্মের জন্য প্রতিযোগিতায়
নামেননি। তিনি বলতেন, আশি পার হলে কারুরই কোন নেতৃত্ব পদে থাকা উচিত নয়। আহা, এই
মূল্যবান শিক্ষাটি যে আমাদের হতভাগা দেশটির মূর্খ ‘নেতারা’ গ্রহণ করতে পারতেন। বা
পারতেন অন্যান্য আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধানরা!
ছয়
আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেঃ আচ্ছা বলুন তো, নেলসন
ম্যাণ্ডেলার চরিত্রে কি সেই বিশেষ বস্তুটি, কি সেই অমূল্য কোহিনুর, যা তাঁকে
সূর্যের মত জ্যোতির্ময়, বিধাতার মত করুণাময়, বর্ষার বারিধারার মত অপার কল্যানময়
একটি ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল? যে-গুণটি তাঁকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে পৃথিবীর
হাজারো নেতা হাজারো অধিনায়ক থেকে? কেন এই মানুষটার কাছে গিয়ে ছোটবড় গরিবধনী
রাজামহারাজ থেকে শুরু করে পাদ্রী-পুরোহিত-পোপ-মোল্লা, সকলেরই মাথা হেঁট হয়ে যেত,
হাঁটু বেঁকে পড়ত ভয়ে নয় ভক্তিতে, তাদের ভেতরকার সকল অপূর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা,
অক্ষমতা আত্মপ্রকাশ হয়ে ফেলত? না, এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। ক্ষুদ্র
বারিবিন্দুর পক্ষে মহাসাগরের সঠিক পরিমাপ জানা কি সম্ভব কখনো? আমি সেই বারিবিন্দু
এই বিশাল ব্যক্তিটির সম্মুখে।
তবুও বলবঃ সারল্য আর শিশুর বিশুদ্ধ মন, শিশুর
বিশুদ্ধ হাসি, আর শিশুর বিশুদ্ধ ভালোবাসা। যা দিয়ে তিনি প্রথমে স্পর্শ করেছিলেন
মানুষের হৃদয়, তারপর স্পর্শ করেছিলেন তার চিন্তার কেন্দ্রমূলে। সেই যে জেলখানার
নিরালা কক্ষের নির্জনতায় বসে হঠাৎ করে দৈববাণীর মত উদয় হয়েছিল তাঁর মনেঃ তাইতো,
আমাদের শত্রুকে জয় করতে হলে তার মস্তিষ্কে টোকা দিয়ে লাভ হবে না, লাভ হবে তার
অন্তরে টোকা দিয়ে, সে’ই ছিল ম্যাণ্ডেলার আসল ছবি, তাঁর সহজাত প্রকৃতির পরিচয়।
প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন যখন তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক
ম্যাণ্ডেলা ও ক্লিন্টন
|
এতই সরল সৌন্দর্যময় ছিল মানুষটার মন যে তাঁর
সান্নিধ্যে গিয়ে কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না ভেতরে কোনও দ্বেষ-বিদ্বেষ, ক্ষোভ-ঘৃণা
তিক্ততা অভিমান পুষে রাখা। দক্ষিণ আফ্রিকার সাড়ে তিনশ’ বছরের বর্বর শ্বেতাঙ্গ
শাসনের জগদ্দল পাথরও তাঁর প্রাণবহ্নির তাপে বিগলিত হয়ে গিয়েছিল। এ-ব্যক্তি কেবল
এ-শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ নন, সর্বযুগের সর্বজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ।
মরণশীল মানুষ অমর হয় কিসে? প্রধানত কর্মে। এবং তার
কথায়, বাণীতে। কেউ শুধু কাজ দিয়ে, অনেকে কাজ এবং কথা উভয়তেই। এই ‘উভয়তে অমর হওয়া’
মানুষগুলোরও প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছেন এই বিশাল মানুষটি। তাঁর জীবনী লেখার
যোগ্যতা বা সাহস কোনটাই আমার নেই। তাই আমার বাতুলতা্র অত্যাচার থেকে পাঠককে
নিষ্কৃতি দেব ম্যাণ্ডেলার কতগুলো উদ্ধৃতি দিয়েঃ
“ For to be free is not merely to cut off one’s
chains, but to live in a way that respects and enhances the freedom of others.”
“স্বাধীন হওয়া বলতে কেবল শেকলভাঙ্গাই বোঝায় না,
বোঝায় এমন একটা জীবন গড়ে নেওয়া যাতে করে অন্যদের স্বাধীনতার প্রতিও সম্যক সম্মান
দেখানো হয়, তাকে পল্লবিত হবার সুযোগ দেওয়া হয়”।
“ I detest racialism, because I regard it as a
barbaric thing, whether it comes from a black man or a white man”.
“ বর্ণবৈষম্যকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি, কারণ একে
আমি একটা বর্বর জিনিস বলে গণ্য করি, তা কালোরঙ্গের মানুষই হোক বা সাদারঙ্গেরই
হোক”।
“If you want to make peace with the enemy, you
have to work with your enemy. Then the enemy becomes your partner”.
“আপনি যদি শত্রুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করতে চান
তাহলে শত্রুর সঙ্গে একটেবিলে বসেই কাজ করতে হবে। তখন শত্রু আর শত্রু থাকে না,
অংশীদার হয়ে যায়”।
(এই কথাগুলি যদি বাংলাদেশের ‘নেতানেতৃ’দের বোঝানো
যেত তাহলে যদি সাধারণ মানুষ একটু স্বস্তির শ্বাস নিতে পারতেন)
“Money won’t create success, the freedom to make
it will.”
“অর্থ দিয়ে সাফল্য ক্রয় করা যায় না,
অর্থোপার্জনের স্বাধীনতা দিয়ে হয়”।
“If there are dreams about a beautiful South
Africa there are also roads that lead to that goal. Two of the roads could be
named Goodness and Forgiveness”.
“একটি সুরম্য সুন্দর দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন যদি
পোষণ করতে হয় হৃদয়ে তাহলে সেই লক্ষস্থলে পৌঁছুনোর অনেকগুলো পথ আছে। তার মাঝে দুটি
রাস্তার নামকরণ করা যায়ঃ শুভবোধ ও ক্ষমা”।
“It is wise to persuade people to do things and
make them think that it was their own idea”.
“এটা বরাবরই বুদ্ধিমানের কাজ মানুষকে দিয়ে একটা
ভালো কাজ করিয়ে নেবার পর তাকে ভাবতে দেওয়া যে বুদ্ধিটা আসলে তার মাথা থেকেই
এসেছিল”।
“I cannot conceive of Israel withdrawing if Arab
states do not recognize Israel, within secure borders”.
“আমি ভাবতে পারিনা ইজরাইল কখনো আরবদের জায়গাজমি
ছেড়ে দিতে রাজি হবে যতক্ষণ আরব রাষ্ট্রসমূহ তাকে স্বীকৃতি না দিচ্ছে, তাদের
নিরাপত্তা বলয়ের সীমানাতে”।
“I have been influenced in my thinking by both
west and east.”
“আমার চিন্তাজগতে আমি প্রাচ্য এবং প্রতিচ্য উভয়
দ্বারা প্রভাবিত”।
অটোয়া, ১৪ই ডিসেম্বর, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২
No comments:
Post a Comment