Wednesday, 16 October 2013

কস্টা রিকা

মীজান রহমান
  অস্বীকার করব না। শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে আস্তে করে। রক্তের ভেতরে অনুভব করতে পারছি। কোথাও যাবার কথা উঠলে আগে যেমন উত্তেজিত হয়ে উঠতাম, এখন তেমন হই না। বার্ধক্যের বিমোহিত তন্দ্রা বুঝি এসে গেল শেষে।
  অনেকদিন থেকেই আবদার করছিল মেয়েটি। চাচা, আপনাকে কস্টারিকাতে আসতে হবে একবার। ভীষণ সুন্দর জায়গা। আপনার প্রাণ ভরে যাবে, লেখার খোরাক হবে অনেক। এখানে যতপ্রকার পাখি ততপ্রকার আর পৃথিবীর কোথাও নেই। যতপ্রকার ফুল ততপ্রকার আর নেই কোথাও। একের পর এক ফর্দ দিয়ে যাচ্ছে মেয়ে।
  লোভ যে হচ্ছিল না তা নয়। অজানার প্রতি তো সবসময়ই একটা আলাদা টান আমার তার ওপর এমন আদর করে সমুদ্রের ওপার থেকে ডাক পাঠানো, অগ্রাহ্য করি কিভাবে। অসম্ভব ভাল মেয়ে একটি----চাচা শব্দটি ওর মত মিষ্টি করে উচ্চারণ করে না আর কেউ। তার পুরো নাম শারমিন আহমাদ----ডাক নাম রিপি। বিখ্যাত ব্যক্তির জ্যষ্ঠ কন্যা----বিখ্যাত বলেই নামটা উহ্য থাকল। রিপি তার আপন গুণেতেই অনন্যা। দেখতে ভারি সুন্দর। চেহারার সঙ্গে তার বয়সের কোন সম্পর্কই নেই। ভাল করে সাজগোজ করে কোথাও দাঁড়ালে মনে হবে আরব্যোপন্যাস থেকে সোজা নেমে এসেছে রাজকুমারি। ও বলে ভাল, লেখে  ভাল, হাসে মিষ্টি করে, লোকের সঙ্গে কথা বলে আরো মিষ্টি করে। ওর গুণের শেষ নেই।




রিপি লেখক
নুয়ার্ক থেকে সোজা পাঁচ ঘন্টার ফ্লাইট কস্টা রিকার স্যান হোজে বিমানবন্দরনুয়ার্ক নিউ ইয়র্ক শহরের তৃতীয় মুখ্য বিমানবন্দর----নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত। ভালোই হল, উর্বি আর জীবনদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্ট। ওদের তো এমনিতেই আমি জ্বালাতন করি একবার করে প্রতিবছর---বাড়ির কাছে এয়ারপোর্ট হলে জ্বালাতনটা একটু কম হয়সন্ধ্যা ছ’টার ফ্লাইটের জন্যে বিকেল চারটেতে জীবন আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল টার্মিনালেএয়ারপোর্ট চত্বরে পা দিতেই শুনি ফ্লাইট দশ মিনিট লেইট। ‘দশ মিনিট’ লেইটকে সাধারণত খুব বিশ্বাস করিনা আমি----এই স্বল্পকালীন বিলম্বগুলোর ভারি বদভ্যাস চোখের পলকে তার তিন কি চার গুণে পরিণত হবার। আধুনিক বিমানভ্রমণ আমার এমনিতেই বিবমিষা সৃষ্টিকর----প্রথমত দুতিন ঘন্টা আগে গিয়ে হাজিরা দেওয়া, তারপর চেক-ইন কাউন্টার থেকে সিকিউরিটির শেষ মাথা অবধি একের পর এক লাঞ্ছনা (কোমরের বেল্ট নিয়ে সবসময়ই আমার সমস্যা, কিছুতেই ঠিক ঠিক লুপ দিয়ে ঢোকাতে পারিনা, যার ফলে নিজের চোখেই নিজেকে সাত মাসের পোয়াতি মনে হয়)যাই হোক হাতের বোঁচকাটি কোনরকমে টেনেটুনে গেটে গিয়ে যখন বীর বাঙালি সশরীরে হাজির তখন বোর্ডে ঝুলানো নোটিশে দেখতে পাই ফ্লাইট ২৩ মিনিট লেইট। অতএব ব্যাগ থেকে ভাসাঞ্জি সাহেবের নামকরা  উপন্যাসটি বের করে নির্দ্বিধায় আরাম করে বসা যায়। আজ আমার কপালে দুর্গতি আছে, মনে মনে ধরেই নিলাম।
  কতটা দুর্গতি তার কোনও ধারণাই ছিল না আমার। গেট থেকে প্লেন ছেড়ে গেল তারও প্রায় আধঘন্টা পর। কিন্তু গেট ছাড়া আর ভূমি ত্যাগ করা এক জিনিস নয়। ঢাকার যানজটের মত এদেশের বিমানবন্দরেও ট্র্যাফিক জ্যাম বলে একটা কথা আছে----এবং দুটোর কোনটাই খুব হর্ষোদ্দীপক নয়। শেষ পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বিমানটি যখন ভূপৃষ্ঠের মায়া ত্যাগ করে আকাশপথে রওয়ানা হয় তখন আমার ঘড়িতে সাড়ে আটটা----পাক্কা একঘন্টা তেত্রিশ মিনিট লেইট। আপনি হয়ত বলবেন, এমন আর কি----আজকাল তো পুরো ফ্লাইটটাই বাতেল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। একটু ধৈর্য পরীক্ষামাত্র----হাসিমুখে নেওয়াই ভাল। আসলেই তাই। যা প্রতিকার করা যাবে না তাকে অম্লানবদনে মেনে নেওয়াই ভাল। এই মেনে নেওয়ার কাজটি পশ্চিমারা বেশ ভাল করেই রপ্ত করে নিয়েছে----আমরা পূর্বাঞ্চলের রগচটা মানুষগুলো সেটা কছুতেই পেরে উঠছি না। আল্লা যে কবে আমাদের একটু সহ্যগুণ দেবেন।

                                     
লম্বা ফ্লাইট। খাবার দেবে না---কিনে খেতে হবে চামড়া বা কাঠের মত শক্ত যাই পাওয়া যায়। আমি উপোশ করতে রাজি, চামড়া চিবোতে রাজি নই। অতএব আরাম করে একটু ঘুমনোর চেষ্টা করা যাকওমা, এমন ঠাণ্ডা বাতাস আসছে কোত্থেকে? বুঝলাম, এয়ারকণ্ডিশন একেবারে তুঙ্গে। পুরো ফ্লাইটটাতে মোট দুজন ‘সেবক’---- অনতিসুদর্শন দুটি পালোয়ান মত পুরুষ। একজনকে বললামঃ একটা কম্বল পেতে পারি? পালোয়ানটি আমার পুরো শরীরটা সম্ভবত দেখতে পায়নি। দারুণ গাম্ভীর্য সহকারে আমার দিকে ছুঁড়ে মারল দুটি তীক্ষ্ণ বুলেটের মত শব্দঃ নো ব্লাঙ্কেট। তারপর আর দ্বিতীয় বাক্যটি উচ্চারণ করার সাহস হয়নিভাবলামঃ এর দুটো ব্যাখ্যা। একঃ তার ধারণা আমার ইংরেজি খুব দুর্বল (সেটা যে একেবারে ভুল তা’ই বা বলি কি করে)। দুইঃ পালোয়ান মশাইর নিজেরই ইংরেজি জ্ঞান তেমন ঈর্ষণীয় নয়। সুতরাং আমি চোখ বুঁজে নিদ্রাদেবীর জপসাধনায় মগ্ন হয়ে গেলাম।
 ফ্লাইট শেষ পর্যন্ত স্যান হোজে বিমানবন্দরের রানওয়েতে----রাত তখন ১টা ২০। ইমিগ্রেশন কাস্টম ইত্যাদি সারা হবার পর নিজের অর্ধমৃত শরীরখানা এক অলৌকিক উপায়ে টেনেটুনে যখন প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে গিয়ে পৌঁছুলাম তখন রিপির প্রসারিত দুটি বাহুতে অনায়াসে সম্বিত হারিয়ে ফেলতে পারতাম----হারাইনি কারণ ওর মুখের ওই দুর্জয় হাসিটুকুর জন্যে। রাত নেহাৎ কম হয়নি ওর জন্যেও----রাত বারোটা ওর ঘড়িতেও। ভদ্রলকেরা সাধারণত তার আগেই বিছানায় চলে যায়।
 এয়ারপোর্ট থেকে ওদের বাসা প্রায় পোনে একঘন্টার পথ। বাসায় গিয়ে প্রাথমিক আলাপচারিতা আর স্বল্পাহার সেরে বিছানায় মাথা রেখে চোখ বোঁজার সময় ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখিঃ ৪টা, অর্থাৎ স্থানীয় সময়ের রাত দুটো। সে রাতে আমার ঘুম হয়েছিল কতখানি দয়া করে সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন নারাত ন’টায় যার ঘুমনোর অভ্যাস তার অবস্থাটি তখন সহজেই অনুমেয়।
 কিন্তু রিপি আগেই কথা দিয়েছিল আমাকেঃ আমার পুরো সপ্তাহটিই ভরাট রাখার চেষ্টা করবে সে একটা-না-একটা কিছুতে। ওর ‘ভরাট রাখা’ কাকে বলে সেটাই বুঝিনি ভাল করে।
 সকাল সাতটাতেই ডাকঃ চাচা, আটটার সময় গাড়ি আসবে। তৈরি হয়ে নিন।
 ঘুমটা মাত্র লেগে উঠছিল তখন। গায়ে ওই শক্তিটুকু নেই জিজ্ঞেস করিঃ গাড়ি করে কোথায় যাব? তথাস্তু বলে উঠে গেলামবাথরুম সেরে রান্নাঘরে খাবার টেবিলে বসে দেখি নিরক্ষীয় রোদ গাছগাছারির ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করেছে ঠিক আমার সিরিয়েল বৌলের ওপর। বাহ বেশ তো, মনে মনে ভাবলাম। এমন করে তো সকালবেলার সূর্যালোক ঢোকেনি কখনো আমার খাবারের ওপর। বাইরে রিপির লেবুগাছের ডালে দুটি হামিং বার্ড খুব করে প্রেম করে যাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে। দুচারটে বাহারি রঙের প্রজাপতিও মনে হয় একই রঙ্গে মাতাল। মনটা সহজেই হালকা হয়ে গেল। জায়গাটা ভালই লাগবে বোধ হয়। নাহয় একটু কমই ঘুমোলাম-----সারাটা জীবনই তো বলতে গেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটলএবার কটা দিন জেগে জেগে দেখা যাক পৃথিবীটা কত সুন্দর।
  আটটায় আসার কথা, ঠিক আটটাতেই এসে উপস্থিত লোকটা তার ভাঙ্গাচূরা গাড়িখানা নিয়ে। গাড়ির মত চেহারাখানিও তাই----ভাঙ্গাচূড়া। বুড়ো, বেঁটে, দন্তহীন, তার পরিচ্ছন্ন মাড়িদুটো উন্মুক্ত করে দিয়ে আমাকে অভিবাদন জানালেন----সকালবেলার রোদের মতই ঝলমল করে উঠল মুখটা। মনে হল, একজন নিখাদ ভালোমানুষ বলতে কি বুঝায় লোকটা তারই লিখিত বিবরণ। বুঝলাম, রিপি আগেই বলে রেখেছিল ওকে যে বাড়িতে অতিথি এসেছে, ক্যানাডা থেকে নামিদামি প্রফেসার, তার চাচা---বিশেষণ প্রয়োগের ব্যাপারে রিপির সমকক্ষ কেউ আছে কিনা জানি না। ও আমাকে ভীষণ বিব্রত করে মাঝে মাঝে। আজকের মত ভদ্রলোক আমাদের গাড়ির চালক। লোকটাকে ভীষণ ভাল লেগে যাবার আরেকটা কারণ ছিল----তিনি নাকি সপ্তাহের যে-কোনদিন যে কোনসময় হাজিরা দিতে পারেন দরকার হলে, কেবল রবিবারটি বাদ দিয়েকেন, রবিবারের কি দোষ? বোকার মত জিজ্ঞেস করি আমি। কারণ,রবিবারটি সম্পূর্ণ তার স্ত্রীর দখলে----বাজার থেকে এটা-ওটা কিনে নিয়ে যান স্ত্রীর জন্যে, কখনো একটা ফুলের তোড়া, কখনো একটা হাতের বালা, সারাদিন দুটিতে কাছাকাছি থেকে সুখদুঃখের কথা বলেন। মনে পড়ে গেল অনেক আগেকার দেখা এক ছায়াছবির কথাঃ ‘নেভার অন সানডে’। সেখানেও ভেতরের সুরটি ছিল প্রায় একইরকম। মানুষ তাহলে এখনো পুরনো দিনের মত করে ভালবাসতে পারে! এখনো মানুষ পারে ছেলেমেয়ে আর নাতিনাতনিদের সামনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে, আদর করতে ছোট শিশুদের মত।
 আমাদের প্রথম গন্তব্য আমরের কর্মস্থল----ইউনিভার্সিটি অব পীস। সেখানে আমর কোন এক বিভাগের ডীন এবং গোটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই রেক্টর। কিন্তু ‘ইউনিভার্সিটি অব পীস’ জিনিসটা যে কি সেটাই তো জানিনা আমি। ঢাকা-রাজশাহী আর জাহাঙ্গিরনগর সহ পৃথিবীজোড়া এত অশান্তির বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি আমি যে শুধুমাত্র শান্তির আদর্শে প্রতিষ্ঠিত কোনও
                                          রিপি ও লেখকঃ শান্তি বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে
উচ্চ বিদ্যানিকেতন থাকতে পারে বর্তমান যুগে সেটা কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। জানলাম, এরকম বিশ্ববিদ্যালয় মোটমাট দুটি সারা পৃথিবীতে-----একটি জাপানে, আরেকটি এই ল্যাটিন আমেরিকার একরত্তি দেশ কস্টারিকাতে। অন্তত কস্টা রিকার কথা যেটুকু জানি এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮০ সাল, এর পেছনে প্রেরণা ও নৈতিক সমর্থন পুরোটাই যুগিয়েছে জাতিসঙ্ঘ, যদিও এর ব্যয়বহনের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। স্যান হোজের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এক উঁচু পাহাড়ের চূড়াতে, বিশাল এলাকা জুড়ে, যার পেছনে এক স্থানীয় কফি ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত অনুদান কাজ করেছে সবচেয়ে বেশি। এতই উঁচু এর অবস্থান যে ছাত্র শিক্ষক কারো পক্ষেই সেখানে পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে করে যাবার উপায় নেই। ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই যায় ইউনিভার্সিটির বাসে করে, অনেক অধ্যাপকও তাই-----অতি অল্পসংখ্যকই হয়ত যায় নিজেদের গাড়ি করে। এমনকি গাড়িতে যাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়। রিপির সেই বিশ্বস্ত প্রবীন ড্রাইভারও  উঁচু পাহাড়ী পথের সরু আঁকেবাঁকে গাড়ির বেগ সামলাতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিলেন, পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। এত উঁচু আর এত আপাতদুর্গম একটা জায়গাতে একমাত্র ‘শান্তি’র বিশ্ববিদ্যালয়ই সম্ভব----মনে মনে ভাবলাম আমিপর্বতের উচ্চতা আর শান্তির উচ্চতা, উভয়ই প্রায় সমান দুঃসাধ্য আজকাল। সেখানে গিয়ে ছেলেমেয়েরা আন্দোলন আর ধর্মঘট করতে চাইবে না, শান্তি ও সৌহার্দ্য খুঁজতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিকএ শুধু ব্যবহারিক শিক্ষা নয়, এ এক দীক্ষা, সাধনা ও ব্রতাচার। আমি আর রিপি সেখানে পুরো তিনঘন্টা সময় কাটালাম। দেশবিদেশের ছাত্রছাত্রী সেখানে---- চাইনীজ, জাপানী, আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান, একজন বাঙালি, একজন পাকিস্তানীও। শিক্ষকদের মাঝে একজন বাঙালি, দুচারজন আফ্রিকান-আমেরিকান, মিশরী একজন (আমর), অনেকেই বেশ বয়স্ক। সেখানে কোনও বিজ্ঞানের কোর্স পড়ানো হয়না, প্রকৌশল নেই, চিকিৎসা নেই----কেবলই মানবকল্যানমুখি বিষয়সমূহ রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, আইন, মনোবিজ্ঞান, কূতনৈতিক সম্পর্কাদি। এদের সবচেয়ে বড় জোর গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ওপর। সারা পৃথিবীজোড়া শান্তির মন্ত্র প্রচার করে বেড়াবে তাদের ছাত্রছাত্রীরা, গড়ে তুলবে গভীর মানবিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ, এই তাদের অন্তিম লক্ষ্য।
 ছোট পরিসরের বিশ্ববিদ্যালয়----দেখেশুনে মনে হল যেন সবাই সবাইকে চেনে। রিপি সেখানে পড়ায় না, তবুও মনে হল ওকে সবাই চেনে। দেখামাত্র হাসিমুখে ‘হাই শারমিন’ বলে সম্ভাষণ, ওর অতিথি অর্থাৎ আমার সঙ্গে উষ্ণ করমর্দন, আলাপচারিতা, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওদের কর্মকাণ্ড দেখিয়ে বেড়ানো আমাকে। এমনকি একটা ক্লাসরুমেও ঢোকার অনুমতি পেয়ে গেলাম----প্রফেসার বক্তৃতা করছেন, ছেলেমেয়েরা গভীর মনোযোগের সঙ্গে নোট নিচ্ছে। আমার নিজেরই অবসরপূর্ব জীবনের কথা মনে করিয়ে দিল। ওদের একটা ফিল্ম রুমের ভেতর উঁকি মেরে দেখারও সৌভাগ্য হয়ে গেল আমার---সবই রিপির সৌজন্যে। দুচারটে ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপচারিতা করার সুযোগ হয়ে গেল কাফেটারিয়াতে চা খেতে গিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম একটি বাঙালি ছেলেকে, সে ভবিষ্যতে কি করতে চায় নিজের জীবন নিয়ে। শান্তির পর কোথায় তার গন্তব্য? ছেলেটা খুব সহজভাবেই উত্তর দিলঃ ক্লাসরুমে শেখা শান্তির বাণী বাইরের বিশ্বে নিয়ে যাওয়া। হয় জাতিপুঞ্জের কোনও দাতব্য প্রকল্পে, নয় কোনও এন জি ওতে, নয়তবা কোনও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। মনটা আনন্দে ভরে গেল।ওয়াকম ছেলেমেয়েও আছে এখনো যারা মানবকল্যান আর মানবসেবাকে তাদের জীবনের উচ্চাকাংখা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
  ছোট্ট বিশ্ববিদ্যালয়টির পুরো চত্ত্বরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম রিপির সাথে, আর ভাবছিলাম নিজের মনেঃ বর্তমান বিশ্বের এই চরম অশান্তির পারাবারে এ যেন ক্ষুদ্র এক ভাসমান তেলের প্রদীপ-----বিগত দিনের কোনও এক শান্তিময় পৃথিবীর শবাস্ম বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এক বন্দর হতে আরেক বন্দরে, কিসের আশায় কে জানেহোক না তার অবস্থান দূর সাগরের কোন এক অজানা দেশের দুর্গম গিরিশৃঙ্গেতে, হোক না সে সপার্থিব কোনও দূষিত রাজনীতির নাগালের বাইরে, হোক না তার সীমিত স্তিমিত কলেবর, সীমিততর আকাঙ্ক্ষা, তবুও তো সে এই পৃথিবীরই অংশযেখানে হত্যা হয় হত্যারই আনন্দে, অঙ্গচ্ছেদ হয় অঙ্গচ্ছেদনেরই দানবিক হর্ষে, যেখানে শিশুহরণ হয় হরণলব্ধ অর্থেরই লালসাতে, যেখানে ধর্মের নামে বর্বরতার পরাকাষ্ঠা চলেছে অব্যাহত গতিতে,  সেখানে কেমন করে সম্ভব হল এমন একটি ইউটোপিয়ান প্রতিষ্ঠান বুদ্ধমূর্তির মত সগর্বে দাঁড়িয়ে ওঠার স্পর্ধা। তবুও মজার ব্যাপার কি জানেন? গাড়িতে করে ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই বুঝতে পারলাম ভূমি থেকে তিন হাজার ফুট ওপরের মেঘালয়তেও প্রবেশ করেছে আধুনিক যুগের সর্বগ্রাসী ‘নিরাপত্তা ব্যাধি’। পূর্বানুমোদিত কাগজপত্র প্রস্তুত না থাকলে দ্বাররক্ষকরা কোমক্রমেই ঢুকতে দেবে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে-----এই হল নিয়ম। রিপি সেখানকার পরিচিত মুখ, আমি নই। অতএব আমাকে নিয়েই বেশ কিছুক্ষণ সালিশ সুপারিশ করতে হল রিপিকে।


রিপির লিভিংরুমের সোফাতে
ঘন্টাদুয়েক পর আমরা গাড়িতে ফিরে এলাম। এবার কোথায়? আশা ছিল বাসায় ফিরে যাব। ঘুম দরকার---রাতে ঘুম হয়নি তেমন। আমি এমনিতেই একটু ঘুমকাতর মানুষ, তার ওপর বয়সের ভার। কিন্তু রিপির গাভরা তখন উত্তেজনা----এতদিন পর তার প্রিয় চাচাকে কাছে পেয়েছে। তাঁকে সবকিছু দেখানো দরকার!
 পীস বিশ্ববিদ্যালয়ের পর তারই গাঘেঁষা একটা আরণ্যক পরিবেশ-----নিঝঝুম নিশুতিভরা গাঢ় নির্জনতা, গাছ গাছারিতে আচ্ছন্ন একটি পরিকল্পিত অবাস্তবতা। বিরাট বিরাট সব বৃক্ষ, সারি করে দাঁড়ানো, যেন কোনও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর কুচ কাওয়াজের ভঙ্গীতে। ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম একটা বড় সড় ফাঁকা জায়গা, যেখানে কোনও লোকজনের মুখ দেখা গেল না একেবারেই। রিপি বললঃ জায়গাটির নাম পীস পার্ক। মজার ব্যাপার যে স্যান হোজে শহরে পীস পার্ক একটি নয়, দুটি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে, আরেকটি নগরের পৌরসভার আয়ত্তাধীন। দুটোই দেখবার মত জায়গা----শান্তি নামটি সার্থকতা লাভ করেছে উভয় ক্ষেত্রে।
একটা নড়বড়ে কাঠের দরজা দিয়ে আমরা ঢুকলাম ইউনিভার্সিটির পীস পার্কের ভেতর। গেটে একজন পাহারাদার থাকার কথা ছিল, সে’ও হয়ত একাকিত্ব আর আলস্যের ক্লান্তি ঘুচানোর আশাতে কোথাও গেছে ইয়ার-বন্ধুদের সাথে একটু গালগল্প করার জন্যে। এমনই এক নিরালা জায়গা সেটি যে ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতেও বিরক্ত হয়ে যাওয়ার কথা। এই গেটের পাহারাদারের মত বোরিং চাকরি সংসারে আর কি হতে পারে। নেহাৎ ছোট পার্ক নয়-----সুড়কি-ঢালা কাচা রাস্তার দুধারে দুটি মাঝারি আকারের পুকুর, পরিষ্কার স্বচ্ছ জল, এত গাছাপালার মাঝেও পুকুরের পানিতে একটি ঝরা পাতার চিহ্ন দেখা গেল না কোথাও । অনুমান করে নিলাম কেন একটি নয়, দুটি,  পুকুর রাখা হয়েছে এখানে----হয়ত পূর্ব আর পশ্চিম, বা উত্তর আর দক্ষিণ,এদের নিয়েই আমাদের এই বিশ্বজগত, যাদের মাঝে বিভেদ শুধু একটি সরু পথ। একদিকে যা পশ্চিম অপরদিকে সেটাই পূব, একদিকে যা উত্তর অন্যদিকে তা’ই দক্ষিণ। ভেদাভেদমুক্ত পৃথিবীই মানবজাতির অন্তিম লক্ষ, এই কথাটিই বোদ হয় জলের মত স্বচ্ছ অক্ষরে প্রকাশ করা হয়েছে এখানে
 পুরো পার্ক ঘুরে আমার মনে হল আমরা দুজনসহ গোটা পাঁচেক পর্যটক হয়ত ছিল সেখানে। রীতিমত ভয় পাওয়ার মত নির্জনতা। ওই কাচা রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা একটা উঁচু টিলার মত জায়গাতে পৌঁছুলাম। মানুষের তৈরি টিলা, খানিকটা উপাসনাগৃহের মত, স্থির গাম্ভীর্যপূর্ণ একটা পরিবেশ। সেখানে সার করে স্থাপন করা কতগুলো সাদা মার্বেলের মূর্তি-----সবই কস্টা রিকার গুটিকয় বিশিষ্ট কৃতীজনের। মাঝখানের সবচেয়ে বড় মূর্তিটি হল এক নোবেল বিজয়ীর-----অস্কার এরিয়াস স্যানচেজ (১৯৪০-----) এর। ১৯৮৭ সালের শান্তি নোবেলটির একমাত্র প্রাপক ছিলেন এই বিশাল ব্যক্তিটি। এবং অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই। সেসময় তিনি ছিলেন কস্টা রিকার প্রধানমন্ত্রী। তখন পার্শ্ববর্তী দেশ নিকারাগুয়া ছিল কমুনিস্ট পন্থী স্যাণ্ডিনিস্টাদের কর্তৃত্বাধীন----এবং সেকারণে রোনাল্ড রেগান শাসিত যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল। স্যাণ্ডিনিস্টাদের প্রভাব সঙ্কুচিত করার লক্ষতেইও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেসময়কার কুখ্যাত কন্ট্রাচক্র, যা রেগানের ইরান-কন্ট্রা এফেয়ার নামে পরিচিত ইতিহাসে। স্যাণ্ডিনিস্টার নিকারাগুয়াকে কাবু করার লক্ষে যুক্তরাষ্ট্র  পাশাপাশি দুটি দেশের ভেতর চরম অশান্তির বীজ ছড়িয়ে যাচ্ছিল-----উত্তরের হণ্ডুরাস, আর দক্ষিণের শান্তিকামী দেশ কস্টা রিকা। অস্কার স্যানচেজ কোনও সাধারণ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ইংল্যাণ্ডের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পি,এইচ, ডি করা অতি বিদ্বান ব্যক্তি, অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় একজন আধুনিক মনের মানুষ, এবং আগাগোড়া গণতন্ত্রবিশ্বাসী সৎ পুরুষ। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে ১৯৮৭ সালে একটি পঞ্চরাষ্ট্র সম্বলিত শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয়, যাতে সর্বসম্মতিক্রমে স্বাক্ষর রাখেন কস্টা রিকা, গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, স্যান স্যালভ্যাদর, হণ্ডুরাস, এই দেশগুলির প্রতিনিধিরা। এমনকি সেন্ট্রাল আমেরিকাতে চিরকাল যারা দাদাগিরি করে অভ্যস্ত, অর্থাৎ আমাদের অতিপরিচিত শ্যামচাচা যুক্তরাষ্ট্র,

      এরিয়াস স্যাঞ্চেজ
তাঁরাও বোধ হয় শেষমেশ মুখরক্ষার খাতিরে হলেও সই করতে বাধ্য হলেন। সেই শান্তিচুক্তি এখনো বলবৎ রয়েছে গোটা ল্যাটিন আমেরিকাতে। অতএব এরিয়াস স্যাঞ্চেজের মূর্তি সবচেয়ে বড় করে ফলাও করা হবে কস্টারিকার একটি খোলামেলা পার্কে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আশ্চর্য হবার মত যা ছিল আমার জন্যে সেটা হল শহরের অন্য কোথাও স্যাঞ্চেজের মূর্তি বা স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে বাড়াবাড়ি করার প্রবণতা একেবারেই লক্ষণীয় বলে মনে হয়নি, যেমনটি দেখা যায় আমাদের দেশে, এবং লঘুতর কারণে। আশ্চর্য হবার আরো ছিলঃ এত ছোট এই দেশটি, একদিকে আটলান্টিক মহাসাগর, আরেকদিকে প্রশান্ত মহাসাগর, মাঝখানে ৫১,০০০ বর্গ কিলোমিটারের একটি নড়বড়ে সেতুর মত দেশ, আকারে যার আয়তন বাংলাদেশের প্রায় তিনভাগের একভাগ, অথচ প্রাণশক্তির দিক থেকে কতই না অগ্রসর। কতই না তার আধু্নিক মনস্কতা। এত ছোট দেশেও তাই এরিয়াস স্যাঞ্চেজের মত বড় মাপের মানুষ জন্মাতে পারে।
পীস পার্কের অভ্যন্তরে দেখবার মত যাকিছু ছিল প্রায় সবই দেখে নিলাম আমরা। বরাবরের মত এবারও রিপি তার স্মার্ট ফোনের ক্যামেরাটির যত সদ্ব্যবহার করা সম্ভব ততটাই করে নিল। অবশেষে আমরা আবার গাড়িতে।
ভাবলাম, এবার নিশ্চয়ই ঘরে ফেরা হবে। কিন্তু হা কপাল----রিপির মত তারুণ্যময় মেয়ের সঙ্গী হতে হলে এত সহজে ছাড়া পাবার উপায় নেই। বললঃ চাচা, এবার আপনাকে আমার একান্ত প্রিয় দুটি জায়গাতে নিয়ে যাব। প্রমাদ গুণলাম, মনে মনে----একটি নয়, দুটি। অর্থাৎ আজকে আমার ঘুমের বারোটা বেজেছে। ঠিক আছে, একদিন ঘুম না’ই বা হল, তবুও আমার প্রিয় মানুষটির প্রিয় জায়গাদুটো তো দেখা হবে। প্রথমেই একটি পুরনো বাড়ির সদর দরজা-----লতায় পাতায় ঢাকা চারদিক, মনে হল না যে সেখানে কোনও জনপ্রাণী বাস করে। রীতিমত একটা জঙ্গল যেন। এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি? জিজ্ঞেস না করে পারা গেল না। চাচা, আসুন ভেতরে যাই, তখনই বুঝবেন আপনি। অতএব ভেতরে যেতে হল। এবং আসলেই তাই। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগতের মুখোমুখি হওয়া সেখানে। একতলা বাড়ি, দুতিনটে ঘর, কোনটাতেই কেউ থাকে বলে মনে হয় না, কিন্তু ভীষণ সাজানো গুছানো সবকিছু। দামি কাঠের আসবাব, বড় বড় লম্বা আয়না। সর্বোপরি, দেয়ালগুলো সব শিল্পীর তুলিতে আঁকা। বাড়ির মালিক একজন নিভৃতচারি বিবাগী মানুষ,এবং ভারি খামখেয়ালি শিল্পী-----যে কারো প্রশংসা কুড়ানোর জন্য ছবি আঁকেন না, আঁকেন তাঁর নিজেরই চিত্ত বিনোদনের জন্যে। তিনি এবাড়িতে থাকেন না, কিন্তু বাড়িটি তাঁর একটা প্রাইভেট স্টুডিওর মত, যখন খুশি তখন আসেন, এসেই লেগে যান দেয়ালের পুরনো ছবিগুলো মুছে নতুন ছবি আঁকার কাজে, একটা গাছের চারা এক জায়গা থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে-----এমন সব পগলামি নিয়েই এই রহস্যময় মানুষটি। একটা ঘরের ভেতর সুন্দর একটা গাছ লম্বা করে দাঁড় করানো বিশাল এক পটের ওপর, যার নাম রিপির কাছে জানলামঃ বার্ডস অব দ্য প্যারাডাইজ। স্বর্গোদ্যানের বলাকারা? এরকম বাহারি নাম কোনও উদ্ভিদের হতে পারে, জানা ছিল না তো। এর তাৎপর্য কোথায়? রিপি বললঃ ফুলগুলোর দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখুন চাচা, তাহলেই বুঝবেন এর তাৎপর্য। সত্যি তাই। গাছটার এমনই বৈশিষ্ট্য যে তার ফুলগুলো সাধারণ ফুলের মত কুড়ি মেলে বেরিয়ে আসে না কোনও এক সকালবেলা, বরং একটু একটু করে বেরুয়, যেন তার কোষের অঙ্গন থেকে আস্তে করে, পাখা মেলে বেরুচ্ছে, হুবহু যেন একটি পাখির শাবক ডানা মেলার চেষ্টা করছে। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম গাছটার দিকে। মনে হল এখানে এক পাখি যে  ফুলের শরীরে জন্ম নিয়েছে পৃথিবীতে, যে নিজে উড়তে পারে না, পারবেও না কোনদিন, কিন্তু তার কাছে দাঁড়ানো মুগ্ধ দর্শক কেবলি চাইবে অন্য কোথাও উড্ডীন হয়ে যেতে,হারিয়ে যেতে কোনও অজানা দ্বীপের বালুতটে। অদ্ভুত এই ফুল, অদ্ভুত এই পাখি। বাইরের বাগানে গিয়ে দেখি আরো এক বিস্ময়-----একটি গাছ, দশ বারো ফুটের বেশি উঁচু হয়ত নয়, কিন্তু এগাছ কি মাটির নিচে না ওপরে তা ঠিক ভাল করে বোঝার উপায় নেই। এর বড় বড় শিকড়গুলো যেন একসাথে জট পাকিয়ে নিজেদেরই একটা সংসার গড়ে নিয়েছে। এমন গাছ আমি দেশে কোথাও দেখিনি, বিদেশেও না। গাছটির নাম জানার চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু কেউ বলতে পারল না। নামের প্রয়োজনই বা কি। সংসারে সবকিছুরই কি নাম থাকতে হবে?
বাড়িটা কার্যত খালি হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের ভার দেওয়া হয়েছে গুটিকয় পরিচারিকার ওপর----তারা রোজ এসে ঝাড়ামোছা করে সারা বাড়ি, গাছে পানি দেয়, উঠান পরিস্কার করে, বাগানের শুকনো পাতা তুলে নেয়। চমৎকার লাগল বাড়িটা-----আরো চমৎকার লাগল বাড়ির সেই অনুপস্থিত মালিকের গল্প শুনে। বছরে একবার কি দুবার আসেন ভদ্রলোক, লোকচক্ষুর আড়ালে, থাকেন হয়ত কয়েক দিন, আপন মনে আয়েস আনন্দে কাটিয়ে যান কটা দিন, প্রাণ ঢেলে দেয়ালে দেয়ালে ছবি এঁকে যান, পুরনো ছবি সব মুছে ফেলার পর। দারুণ রহস্যময় মানুষ একটি, রহস্যময় তাঁর জীবনের সবকিছুই হয়ত। কে এই লোক?
 রিপির পরবর্তী দর্শনীয় স্থানটি তার নিজেরই ব্যক্তিগত স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। একটা পুরনো স্টাইলের হোটেল----আধুনিক যান্ত্রিক যুগের যাবতীয় উপসর্গসমূহ বহুলাংশেই অনুপস্থিত। প্লাস্টিকনির্মিত আসবাব বা নকল কাঠের চেয়ার টেবিল কোথাও পাবেন না সেখানে। রিপির কাছে হোটেলটির বিশেষ তাৎপর্যঃ ও আর তার স্বামী একবার তাদের বিয়েবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে ছিল দুতিনদিন।  অতএব তারা কোন্‌ ঘরে ছিল, কোথায় বসে তারা বিকেলবেলার সূর্য দেখেছে প্রশান্ত মহাসাগরে, সেসব স্মৃতির একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে ওর জন্যে, সেটা বুঝি। ব্যক্তিগতভাবে আমার ভাল লাগার কারণগুলো ছিল আলাদা। এই একটি জায়গা যেখানে কোনও জিনিসই বোধ হয় ‘মেইড ইন চায়না’ নয়, এবং অধিকাংশই অর্ডার দিয়ে তৈরি স্থানীয় কারিগরদের হাতের কাজ।  ‘হাতের কাজ’ কথাটি কতদিন যে শুনিনি। শুনতে কেমন অদ্ভুত লাগে। নিজের হাত আর নিজের আঙ্গুল দিয়ে আজকাল কি’ই বা করি আমরা। শুধু তাই নয়, এই হোটেলের গেটে রকমারি উর্দিপরা সব দ্বাররক্ষক এসে সালাম ঠুকে আপনার গাড়ি নিয়ে যাবেনা পার্ক করার জন্যে, এবং তাতে কৃতার্থ হয়ে আপনি দশ ডলারের একটা নোট গুঁজে দেবেন ওর হাতে, ওসবের বালাই নেই। এখানে ম্যানেজার ওয়েটার কন্সার্য সব বলতে গেলে একই মানুষ-----অত্যন্ত হাসিখুশি, চটপটে ও সিনেমার নায়কসুলভ চেহারার একটি ছেলে---নাম বলল তার আলফ্রেডো। যেহেতু হোটেলের গেস্টসংখ্যা শহরের সব নামিদামী হোটেলগুলোর মত নয়, সেহেতু আলফ্রেডো অতি সহজেই রাজি হয়ে গেল আমাদের দুজনকে নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরিয়ে দেখাতে। হোটেলের পাশেই অনেকগুলো ফলের গাছ। তার একটিতে আমাদের দুজনেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়ে গেল----জাম্বুরার গাছ। এদেশে যাকে বলে গ্রেইপফ্রুট। ছোটবেলায় দাদার বাড়িতে গিয়ে পেছনের জাম্বুরা গাছটি থেকে সদ্য কুড়ানো জাম্বুরার লাল টসটসে কোয়ার যে স্বাদ সেটা কি ভোলা যায় কখনো? রিপির হাবভাব দেখ মনে হল সে এখনো সেই ছোট্ট খুকিটিই রয়ে গেছে। বড় বড় পাকা জাম্বুরা দেখে সে কি উত্তেজনা তার। আবদার জানালো আলফ্রেডোকে, দুচারটে জাম্বুরা কি সে নিতে পারে এখান থেকে? অবশ্যই পারে, ওগুলো তো খাওয়ার কেউ নেইও সেখানে। পেকে পেকে এমনিতেই তারা ঝরে পড়ে একদিন, তারপর মাটির সঙ্গে মিশে যায় কালে কালে। রিপির কল্যানে সে জাম্বুরার ভাগ আমাকেও পেতে হল দুদিন পর। তার কি একই স্বাদ? না, তা কি হয় কখনো? আট বছর বয়সে যা অমূল্য আশিতে তা মূল্যহীন----কেবল স্মৃতিটুকু ছাড়া।
 সৌভাগ্যবশত বিকেলবেলা ঘন্টাখানেক ঘুমনোর সুযোগ পেলাম। নইলে সেদিন আমাকে নিয়ে সমস্যা হয়ে যেত রিপির। কারণ সন্ধ্যা ছটায় বাসায় এসে উপস্থিত রিপির তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু-----ডায়ান, সোফি ও সোফির মা আমিনা। তিনজনকেই সমান তারুণ্যোদ্দীপ্ত মনে হল-----সোফি যেমন ধীর স্থির শান্তশিষ্ট, ওর মা তার বিপরীত-----ভদ্রমহিলা যেন সর্বক্ষণ রসে টগবগ কচ্ছেন। বললেনঃ আমাকে নিয়ে তাঁরা খেতে যাবেন এমন এক জায়গায় যেখানে রাত ফুরায় না, এবং পায়ের ঘুঙ্ঘুরের শব্দ কখনো থামে না। সব্বনাশ! বলে কি ভদ্রমহিলা। এই বয়সে এত উত্তেজনা কি সইবে আমার?
 বাইরে বেশ অন্ধকার তখন। রাস্তাঘাট প্রায় নির্জন। পর পর দুটো গাড়িতে করে আমরা রওয়ানা হলাম। আমাদের গাড়ির চালক সোফির স্বামী, আরোহী আমরা দুজন বাদে সোফি আর তার দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। পেছনের গাড়িতে আমিনা, ডায়ান ও গাড়ির চালক সোফির ছোটভাই আমিন, বাইশ বয়স্ক যুবক যার কথা আমি আরো লিখব পরে। কোথায় যাচ্ছি আমরা তার কোন ধারণাই ছিল না আমার। শুধু আমিনার দুষ্টু চোখের ইশারাতে বোঝা যাচ্ছিল যে তারা আমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে যেখানে আমি চাই বা না চাই, বাধ্য হয়ে আমাকে ফিরে যেতে হবে যৌবনের উত্তাল দিনগুলোতে, কারণ জায়গাটি কেবল তরুণদেরই জন্যে।
 সরু পাহাড়ি পথ-----আঁকাবাঁকা, ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু গাড়ির হেডলাইটের আলোতে কোনরকমে ধুকে ধুকে, বুকের হৃদপিণ্ডখানিকে হাতের মুঠোতে শক্ত করে বেঁধে, ধীরে ধীরে চলা। মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস ওই মুখরা মহিলাটি এই গাড়িতে নেই। নিশ্চয়ই আমার মুখের ওপর ভয়ের ছাপ দেখে বলতেনঃ গাড়ি নিচে গড়িয়ে যাবে ভাবছেন বুঝি? কি জবাব দিতাম আমি? উপস্থিতবুদ্ধি সবটুকু না হারিয়ে ফেললে হয়ত বলতামঃ তাতে কি আসে যায়? আমি-আপনি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেই যদি গড়িয়ে পড়ি পাহাড় থেকে তাহলে পত্রিকার খবরে কি লেখা হবে পরের দিন সেকথাটি ভেবে দেখুন, তাহলেই দেখবেন আমাদের জীবন এবং মৃত্যু দুটিই সার্থক হয়েছে! নাহ, বেশি নাটকীয় শোনায়, তাই না?
গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর পর বুঝলাম টাকাওয়ালা লোকেরা ইচ্ছে করলে সবই করতে পারে-----চাইলে আকাশের ওপর বা সমুদ্রের নিচে গিয়েও রেস্টুরেন্ট বানাতে পারে। রিপি আর আমিনার পছন্দ-করা রেস্টুরেন্টটি ছিল, আমার বিচারে, আকাশের ওপর অন্ধকারের আচ্ছাদনে ঝুলন্ত এক তারকাখচিত নিরবচ্ছিন্নতা। পাহাড়ের নির্জন পথের গা বেয়ে যাত্রাকালে কোনক্রমেই বোঝার উপায় ছিল না যে এর শেষে রয়েছে মনুষ্যনির্মিত এক নৈশ কানন, যেখানে অনেকগুলো গাড়ি গায়ে গায়ে আঁট করে পার্ক করা-----একবেলা খাবারের উপলক্ষে সান্ধ্যবিহার করতে এসেছে পর্বতশৃঙ্গতে। আসলেও তাই----পর্বতশৃংগ। ভেতরে ঢুকে ওদের কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল নিচের বায়ুমণ্ডলে ভেসে যাচ্ছে গোটা স্যান হোজে শহরটি, আমরা যেন কোনও মায়াবী শূন্যযানের বিমুগদ্ধ আরোহী। রাতের শহর এমনিতেই আমার এক প্রিয় দৃশ্য, তার ওপর পাহাড়ের একেবারে শেষ মাথা থেকে। অনুপম দৃশ্য বটে। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল আমাদের রিজার্ভ করা সীটগুলি। ঠিক মঞ্চের পাশে। মঞ্চ মানে নাট্যমঞ্চ নয়, মিলনায়তনে যেরকম মঞ্চ থাকে সেরকম কিছু নয়, রেস্টুরেন্টের মঞ্চ মানে একটা অপেক্ষাকৃত খোলামেলা জায়গা যেখানে নাচিয়েরা এসে নাচ করতে পারে, গায়েনরা এসে গাইতে পারে, বাদকরা বাজাতে পারে তাদের বাদ্য বাজনা। রেস্টুরেন্টে ঢোকার অনেক আগেই আমরা শুনিতে পাচ্ছিলাম ঢোলের শব্দ, দুটি তরুণ ছেলে তালে তালে বাজিয়ে চলেছে দুটি ড্রাম, গেস্টরা এসে টেবিলে বসছেন, কেউ তাকাচ্ছেন ছেলেদুটোর দিকে, কেউ নিজেদের মধ্যে চুটকি চাটকি আলাপে মগ্ন-----ওদের বাদ্য যেন কোনও আবহ সঙ্গীত। কিছুক্ষণ পর ওই খালি জায়গাটিতে একরাশ আলোর ঢল নেমে এল-----ভিন্ন কিছু হবে সেখানে তারই ইঙ্গিত। প্রথমে এল দুটি ছেলে নাচিয়ে। তারপর একে একে চারজন নৃত্যবালা-----স্প্যানীশ নাচিয়েদের ভঙ্গীতে, হেলে দুলে, আবহ যান্ত্রিক সঙ্গীতের সঙ্গে তাল রেখে তারা ছন্দের মদিরাতে পূর্ণ করে দিচ্ছে কুয়াষাচ্ছন্ন রাত্রির আর্দ্র বাতাস

                                আমিনা ও লেখক
আমরা দেখছি, আর খাচ্ছি, আর খাচ্ছি, দেখছি বা দেখছিও না। তারা আমাদের চিত্তে ঝঙ্কার সৃষ্টি করে চলেছে, আমরা খাদ্য আর নৈশ আমেজের সুরাতে বিভোর-----তারা থেকেও নেই, কাছে থেকেও কত দূর তারা। একসময় আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেল। আমাদের পেটের ক্ষিধে মিটে গেছে। এবার বুঝি মেয়েগুলোর সঙ্গে একটু রসলীলা করা যেতে পারে। দেখলাম একজন দুজন করে অতিথিরা নেমে যাচ্ছেন মঞ্চে মেয়েগুলোর সঙ্গে (মহিলারা ছেলেদুটোর সঙ্গে) নাচের তালে অঙ্গভঙ্গি করার জন্যে। আমিনা ঠিক আমার পাশে বসা----যা ভেবেছিলাম তাই হল। আমার হাত ধরে টানতে শুরু করল নাচের মঞ্চে যোগ দেওয়ার জন্যে অন্যদের সাথে। এ-কাজটি যে আমার দ্বারা সম্ভব হবে না, সেটা সৌভাগ্যবশত, রিপির জানা ছিল। ওর চোখের ইশারাতে আমিনা বিবি নিবৃত হলেন, নইলে সেদিন আমার ভাগ্যে ভোগান্তি ছিল। হয় আমি কারো পা ভাঙ্গতাম, নয়ত আমারই পা ভেঙ্গে দিত অন্য কেউ। জীবনে যে কাজটি করিনি কোনদিন, যা আমার সামাজিক ও পারিবারিক সংস্কৃতির একেবারেই বাইরে তা হঠাৎ করে আরো অনেক নাচিয়েদের ভীড়ে চেষ্টা করাটাও বোকামি। একবার ওই নাচিয়ে মেয়েদের মাঝ থেকেও একজন এসে আমাকে নিয়ে মঞ্চে নামানোর উদ্যোগ নিয়েছিল-----আমিনার মধ্যস্থতাতে সেযাত্রা বেঁচে গেলাম। প্রবাসজীবনের আরো অনেক অভিজ্ঞতার মত এ’ও এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ থেকে একটা জিনিসই আবার নতুন করে শেখা হল আমার। যেদেশের যা রীতি সেদেশে সেটাই স্বাভাবিক-----এতে মন্দ ভাল বলে কিছু নেইতাই যারা নিজের দেশ ছেড়ে অন্যের দেশে এসে বসতি স্থাপন করে তাদের উচিত হবে, নিজেদের স্বার্থেই, অন্যের আচার আচরণগুলি যথাসাধ্য আয়ত্ব করে নেওয়া। ঠিক আছে আমি দেশে থাকাকালে নাচ শিখিনি কোনদিন, কারণ জিনিসটা আমাদের কালচারের বাইরে। কিন্তু বিদেশে আসার পর যদি শিখে নিতে পারতাম, তাহলে সেদিন অন্যদের মত আমিও মঞ্চে নেমে একটু আনন্দ উপভোগ করতে  পারতাম। এটুকু নির্মল আনন্দের জন্যে যদি কাউকে আগুণে পুড়তে হয় মৃত্যুপরবর্তী কোনও কাল্পনিক যুগে, হলই বা।


                                    নৈশ নর্তকীদের একজন
রেস্টুরেন্টের পার্টি হয়ত আরো রাত পর্যন্ত চলতে পারত, কিন্তু আমার শরীর তখন প্রায় অবশ হয়ে আসছিল ঘুমের অভাবে। তার ওপর রিপি আগেই নোটিশ দিয়ে রেখেছিল আমাকে যে পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। কারণ সেদিনই সবচেয়ে বড় প্রোগ্রাম আমার জন্য। সকাল আটটাতে আসবে ট্যাক্সি, সেটা নগরকেন্দ্রের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে নিয়ে যাবে আমাদের। ওখান থেকে আমাদের দিনের সফর শুরু। টুরবাস ঘুরে ঘুরে নিয়ে যাবে এক দর্শনীয় স্থান থেকে আরেক দর্শনীয়তে। অতএব সেরাত্রির মত আমাদের নৈশ বিহার সাঙ্গ।
রাত্রে ঘুম খুব ভাল হয়েছিল বলা যাবে না। তবুও যথাসময়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে হল। সারা দিনের প্রোগ্রাম----সকাল থেকে রাত আটটা ন’টা পর্যন্ত এই টুরবাসের ভেতর। অতএব গামোড়া দিয়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠা দরকার।
 ন’টার দিকে আমাদের যাত্রীবোঝাই টুরবাস শহরের সীমা অতিক্রম করে পাহাড়ি পথের উঁচুনিচু বাঁকের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে চলল তার গন্তব্যে। টুরের গাইড ছিলেন আলবার্টো নামক এক দ্রুতরসনা যুবক, যে মূলত স্প্যানীস ভাষী হলেও ইংরেজিটা আয়ত্ত করে নিয়েছিল বেশ ভালোই। ওর যে চাকরি তাতে ইংরজিজ্ঞান একেবারেই অপরিহার্য-----বেশির ভাগ যাত্রীই তো বিদেশ-থেকে-আসা টুরিস্ট যারা স্প্যানীশ জানে না, হয়ত ইংরেজিও জানে না তেমন, তবুও স্প্যানীস বা ফরাসীর চাইতে ইংরেজিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। যেমন আমি আর রিপি।
 কস্টারিকা পুরোপুরি টুরিজম-নির্ভর দেশ নয়, কিন্তু তাদের জাতীয় কোষাগারের বার্ষিক উপার্জনের একটা বড় অংশই আসে পর্যটন খাতের অর্জন থেকে। সৌভাগ্যবশত এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যেমন একটা বড় আকর্ষণ বাইরের লোকেদের কাছে, তেমনি আকর্ষণ তাদের দেশটির অপেক্ষাকৃত ত্রাস ও অপরাধমুক্ত সুনামের জন্যে। রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ----এদুটি জিনিস পর্যটকদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
 আমাদের প্রথম গন্তব্যটি ছিল একটি কফিবাগান। আমার জন্য এ এক অভিনব অভিজ্ঞতা। বাগান দেখা দূরে থাক কফির গাছ দেখতে কেমন তা’রও কোন ধারণা ছিল না আমার। আলবার্টো আমাদের প্রথমেই
                                                         কফিবাগানে রিপি ও লেখক
নিয়ে গেলেন চারাঘরে----অর্থাৎ যেখানে কফির চারা গজাতে শুরু করে বীজ থেকে, ছোট ছোট পটের ওপর। কৌতূহলী দর্শকদের কাছে কফিচাষের দুচারটে মূল বিষয় বেশ পাণ্ডিত্যপূর্ণ গাম্ভীর্যের সাথে ব্যক্ত করার চেষ্টা করছিলেন আলবার্টো, আর আমি নিজের মনে গুণছিলাম চারাগুলির পাতারা কিভাবে ছোট থেকে বড় হতে হতে সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একেবারে শিশু চারাটির মাত্র একটি পাতা, তার একদিন পরই হয়ত আরো একটি। তার পর দুটি, তিনটি, পাঁচটি, এভাবেই তারা গুচ্ছে গুচ্ছে ছড়িয়ে পড়ে  বৃহত্তর গাছের আকারে। এই যে সংখ্যামালা-----১,১,২,৩,৫,------এগুলো আমাদের অঙ্কের জগতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একটা নামও আছে এদের----ফিবুনাচি রাশি। অতি বিখ্যাত ও সুপরিচিত একটি গাণিতিক রাশি, যার তাৎপর্য নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কফির চারা দেখে আমার গণিতের চোখ স্বভাবতই কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল এরা ফিবুনাচির নিয়ম অনুযায়ী বংশবৃদ্ধি করে কিনা দেখার জন্যে। মনে হল, করে বইকি। এ যেন প্রকৃতিরই প্রজনন রহস্যের একটি গূঢ় সূত্র।
 চারাঘর থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম বেড়ে-ওঠা কফিগাছেদের ভেতর দিয়ে। দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের লেবুগাছের মত, কেবল আকারে অনেক বড় লেবুর চাইতে। পাতাগুলো একেবারে ঝকঝকে মসৃণ, এককণা ধূলোবালির চিহ্ন নেই কোথাও, যেন কর্মীরা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে পাতাগুলো মুছে রাখে রোজ। আসলে কিন্তু তা নয়----পরিষ্কার রাখার কাজটি প্রকৃতিদেবী নিজেই সম্পন্ন করে দেন। রোজই তো বৃষ্টি হয় একবার, এবং একেবারে ঢালাও বৃষ্টি, যাতে মুহূর্তের মাঝে আপনার বাগানের পানি ঢালা হয়ে যাবে। কস্টারিকার বৃষ্টি আমাদের জ্যাষ্ঠ মাসের অঢেল বৃষ্টির চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। আমার ভ্রমণকালটা ছিল সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। বলা হয়, এদেশে দুটো ঋতু----বর্ষা আর শুষ্ক। বর্ষা হল মে থেকে নভেম্বরের শেষ অবধি, বাকিটা শুকনো। বর্ষাতে রোজই বৃষ্টি হবে একবার, সাধারণত বিকেল দুটো তিনটে থেকে শুরু হয়ে একটানা চলবে রাত আটটা ন’টা পর্যন্ত। এই ঋতু পরিক্রমাটি কফিচাষের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এর হেরফের হলে ফসল হবে না আশানুরূপ----তখন গোটা দেশেরই মন খারাপ। সেপ্টেম্বরে দেখা গেল কফির গাছগুলো বেশ তাজা হয়ে উঠেছে, গুটি গুটি কফিফল উঁকি দিয়েছে গাছে গাছে, আর মাস দেড়েক পরেই ফসল তোলার সময় হয়ে যাবে, ঠিক যখন শুকনো ঋতু শুরু হওয়ার কথা। তখন শুকনোটাই বেশি দরকার-----কফি গুঁড়ো করার আগে তাকে ভালো করে শুকোতে হয়, অনেকটা আমাদের দেশের বোরো ধানের মত, কৃষকরা তো উঠানের রোদেই সাধারণত ধান শুকোতে দেন, তাই না? কফিও ঠিক সেরকম। কোনও কারণে যদি শুকনোর ঋতুটা ঠিক রোদেলা না হয় তাহলে বাধ্য হয়ে তাদের কৃত্রিম উপায়ে কফি শুকাতে হয়, যার ফল কিন্তু রোদে-শুকনো কফির মত নয়----অনেকটাই নিচু মানের ফসল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় কৃষককে।
 কফির বাগানটি ঘুরে ঘুরে অনেক জিনিসই শেখা হল আমার। যেমন, কি করে পাখির উপদ্রব থেকে ফসল রক্ষা করে তারা, এবং কোনও রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার ছাড়াই। কস্টারিকার পাখি সম্পদ খুবই বিখ্যাত----অন্তত ৮৯৪ প্রকারের পাখি সেদেশে। ক্যানাডা-আমেরিকা মিলিয়ে গোটা উত্তর আমেরিকা মহাদেশে এত বিভিন্ন প্রকারের পাখি নেই। এবং এদের বেশির( আনুমানিক ৬০০) ভাগই স্থায়ী, অর্থাৎ ঋতুপরিবর্তনের সাথে এদের দেশান্তরী হতে হয় না খাদ্যাণ্বষণের জন্যে----নিজের দেশেই প্রচুর খাবার, এবং আবহাওয়া বেশ আরামপ্রদ। মুস্কিল হল কৃষকদের-----পাখির অত্যাচার থেকে ফসল বাঁচানো, এবং স্বাস্থ্যকর উপায়ে। কফিচাষীরা সেকারণে একটা চালাকি আবিষ্কার করেছেন-----বাগানের চারপাশে সারি সারি আমগাছ, পেঁপেগাছ, কলাগাছ ইত্যাদি লাগিয়ে রাখা হয় যাতে করে ওগুলো খেয়েই পাখিদের পেট ভরে যায়, এবং কফির প্রতি আকৃষ্ট হবার প্রয়োজন বোধ করে না। প্রশ্ন তোলা যায়ঃ তাহলে কি কফির মূল্য আম-কলা-পেঁপের চাইতে বেশি? হ্যাঁ বেশি, অনেকটাই বেশি। কফি হল কস্টারিকার প্রাণ----একসময় ওটাই ছিল ওদের বৃহত্তম ব্যবসা, ক্যাশ ক্রপ যাকে বলে। একসময় আমাদের পূর্ববঙ্গে যেমন ছিল পাট। আমাদের পাট প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু কস্টারিকার কফি সহজে ধ্বংস হবে না হয়ত, এটা ওদের জাতীয় সম্পদ। শুনেছি সারা দেশে মোট ৯ লক্ষ কফির বাগান, সবই ব্যক্তিগত মালিকাধীন।
 কস্টারিকা কোনও তৃতীয় বিশ্ব নয়, সেটা আগেই বলেছি। এবং তার মূলে যে অর্থনৈতিক মদদ সে-মদদটা এসেছে কফির চাষ থেকে। কফির চাষ শুরু হয় এদেশে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ১৮৪৩ সালে সেই কফি প্রথম রপ্তানি করা হয় ইউরোপে, এবং তখন থেকেই তাদের সুদিন শুরু। অচিরেই কফি তাদের দেশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্যতে পরিণত হয়ে বিস্তর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। কফির টাকা দিয়ে একটি আমেরিকান কোম্পানি সেখানে রেলরোড স্থাপন করে ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে। তাতে কফির চাষ আরো বিস্তৃত হবার সুযোগ পায়। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে কফির বদৌলতে সমস্ত কস্টারিকা দেশটি উন্নতমানের রাষ্ট্র হয়ে ওঠে।
তার পেছনে অবশ্য আরো কছু কারণ ছিল---কেবল টাকাপয়সা থাকলেই যে একটা দেশ বড় হয়ে যায় না, এমনকি একটা সভ্য দেশও হয়ে ওঠে না, তার প্রমাণ তো বর্তমান বিশ্বেই একাধিক, একেবারে চোখের সামনেকিন্তু কস্টারিকার কফিবাগানের মালিকরা ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও দেশপ্রেমিক মানুষ। তারা গোড়াতেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান কফির ধন দিয়ে গোটা জাতিকে যদি ভবিষ্যতের জন্যে গড়ে তোলা না যায় তাহলে একদিন দেশ ও কফি দুইই ফুরিয়ে যাবে। কথা হল, জাতির ভবিষ্যৎ বলতে কি বোঝায়? তাঁরা তার সঠিক উত্তর পেয়ে গেলেন নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে----তার নাম শিক্ষা। এবং সাধারণ চলনসই শিক্ষা নয়, উচ্চশিক্ষা, যেমনটি শিখেছিলেন কস্টারিকার এরিয়াস স্যাঞ্চেজ। তাঁরা দেশের জায়গায় জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন, এবং সেখান থেকে উত্তীর্ণ মেধাবী ছেমেয়েদের বৃত্তি দিয়ে পাঠিয়ে দেন ইউরোপের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে, এভাবেই তাঁরা আস্তে আস্তে গোটা দেশব্যাপী গড়ে তোলেন একটি উচ্চমানের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, ভবিষ্যতের নেতা ও জাতির কর্ণধার হবার সম্ভাবনা যাঁদের সবচেয়ে বেশি। এ এক আশ্চর্য দেশ! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবছিলামঃ শিক্ষাই যে একটা দেশের সত্যিকার সম্পদ, এবং সত্যিকার ভবিষ্যৎ একমাত্র শিক্ষার দ্বারাই সম্ভব, এই সহজ সত্যটি আমাদের দেশের নেতানেত্রীরা কেন বুঝতে চাইছেন না? নিজেরা তেমন শিক্ষিত নন বলে?
 কফিবাগান থেকে বেরুবার শেষ পর্যায়ে আমরা দেখলাম শুকনো কফি কোথায় এবং কিভাবে গুঁড়ো করা হয়, কিভাবে গুণের বিচারে স্তরে স্তরে ভাগ করে ছাঁটাই করা হয়, এবং ছাঁটাইকৃত কফির গুঁড়ো কিভাবে সংরক্ষিত করে প্যাকেটের ভেতর ভরা হয়। একেবারে শেষের পর্যায়টি হল খুচরো কফির দোকান, তাজা টাটকা ফ্যাক্টরিজাত কফি, যার কোনও জুড়ি নেই স্বাদের দিক থেকে। কথিত আছে যে কস্টারিকার কফিতে একটু বেশি মাত্রার ক্যাফিন থাকে। এবং সেই ক্যাফিন দূর করার যে পদ্ধতি ও কলাকৌশল তা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ, অন্তত স্থানীয়ভাবে। সুতরাং কস্টারিকার কফির ক্যাফিন ছাড়াবার কাজটি করা  হয় জার্মানীতে। তাতে নাকি খরচ অনেক কম!
 আমাদের টুরবাসের দ্বিতীয় গন্তব্য, রিপির বর্ণনা অনুযায়ী, একটি ‘রেইন ফরেস্ট’, যদিও সেটা মানুষের তৈরি (যেমন আমাদের ক্যানাডারই মন্ট্রিয়ল শহরে আছে একটি), নাকি প্রাকৃতিক,  তা ঠিক বোঝা গেল না। আমার জানামতে প্রাকৃতিক রেইন ফরেস্টগুলো সব নিরক্ষরেখার কাছাকাছিতে, অর্থাৎ আমাজন বনের অঞ্চলে, তবে আমি পৃথিবীর কতটাই বা জানি। সেখানে পৌঁছানোর আগে বোঝা যাবে না। কিন্তু পৌঁছানোর পরও পুরোপুরি বোঝা গেল বলে মনে হয়নি। বেশ বড় আকারের একটা ঘন জঙ্গলের মত জায়গা, এবং সেখানে বৃষ্টি হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটাই কি রেইন ফরেস্টের লক্ষণ কিনা তাই বা আমি জানব কেমন করে। বৃষ্টি তো হরহামেশাই হচ্ছে কস্টারিকাতে। যাই হোক, আমাদের গাইড সাহেবের কথা অনুযায়ী, এখানে বন জঙ্গল যা দেখার দেখে নিয়ে আমরা যাব নিচে, বেশ নিচুতে অবস্থিত একটি ক্যাফেটারিয়া, যেখানে আমাদের নগদ টাকা দিয়ে লাঞ্চ কিনতে হবে না, কারণ লাঞ্চের পয়সা টুর প্যাকের মাঝেই ধরে নেয়া হয়েছে। (সেই সংখ্যাটা যে কি তা রিপিকে জিজ্ঞেস করবার সাহস আমার ছিল না। অনুমান করছিলাম যে সংখ্যাটি নেহাৎ তুচ্ছ নয়)। বাসের সমতল থেকে বেশ নিচেই সেই ক্যাফেটারিয়া। ঠিক আছে, নিচে নাহয় নামা গেল অনায়াসেই, কিন্তু নিচে থেকে যখন ওপরে ওঠার ব্যাপার দাঁড়াবে তখন আমার উপায় হবে কি? আমার এই দুর্বল হার্ট নিয়ে তো তার সিকিভাগও ওঠা যাবে না। সৌভাগ্যবশত টুর কর্তারা সেব্যবস্থাটি আগে থেকেই করে রেখেছিলেন। জানা গেল যে ওপরে ওঠার জন্যে গলফ কার্টের ব্যবস্থা থাকবে-----কার্যত এলেভেটারে করে ওঠার শামিল।
 রিপি আমার জন্যে একটা প্লাস্টিকের কোট কিনে এনেছিল, যাতে বৃষ্টিতে ভিজতে না হয়। কোট গায়ে নিচে নামতে নামতেই টের পাওয়া যাচ্ছিল যে বাইরে যেমন বৃষ্টি নামছিল তখন ঝুপঝাপ করে তেমনি ভেতরের নিরক্ষীয় প্রাণীদের কারণেও তারা হোজ পাইপ দিয়ে মুষলধারে পানি বর্ষণের ব্যবস্থা করেছিল -----কতগুলো পাখি আছে যারা অবিরাম বৃষ্টি না হলে আরাম বোধ করে না। তেমনি এক পাখির খাঁচায় আমাদের নিয়ে গেলেন আলবার্টো। সেখানে ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম পাখির বাস। ক্ষুদ্রতম হল হামিং বার্ড। একটি অসাধারণ পাখি একটি-----ওজন হয়ত দুয়েক আউন্সের বেশি হবে না। এরা বেশিক্ষণ উড়তে পারে না সম্মুখদিকে, কিন্তু তারা পাখা ঝাপ্টাতে পারে প্রতি সেকেণ্ডে ষাটবার। যার ফলে তারা সামনে এগুতে না পারলেও হেলিকপ্টারের মত ওপর নিচ করতে পারে অনায়াসে। এদের নিয়ে এদেশে একটা কথা আছে এরকম যে এরা সময়হীন সমুদ্রে ভেসে বেড়ায় আপন প্রাণের তাড়নাতে, আমাদের সকল গোপন আশা আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছা আনন্দের প্রতীক হয়ে। আমরা যা হতে চাই কিন্তু হতে পারব না কখনোই , হামিং বার্ড যেন সেই কামনাগুলোকেই পৌঁছে দেয় উর্ধলোকের কোনও মৌন দেবতার কাছে। আমাদের রিপি মেয়েটি এই হামিং বার্ড পাখিটির দারুণ ভক্ত, জানিনা কোন মৌন দেবতার সন্ধানে

                                  ম্যাকাউদের আখড়াতে

টুকান লেখকের হাতের ওপর

                              টুকান লেখকের হাতের ওপর
 এর কাছেই দেখা গেল টুকান নামক আরেকটি বেশ বড়সড় পাখি----ঠোঁট লম্বা, গায়ের রঙ একরকম, ঠোঁটের অন্যরকম। খুব মনুষ্যসংগ পচ্ছন্দ করে বলেই মনে হল। রিপি-আমি দুজনই ছবি নিলাম টুকানকে হাতের ওপর বসিয়ে। অনতিদূরে সবচেয়ে বড় পাখির বাসা----তাকে বলা হয় ম্যাকাউ। তার ঠোঁট বিশাল বড় কিছু নয় টুকানের মত, কিন্তু শরীরখানা বিপুল তাতে সন্দেহ নেই। ভীষণ কর্কশ তার গলার শব্দ-----মাকাউ পাখির গান শোনার জন্যে সংসারে কোনও প্রেমিক কখনো আকুল হবার কারণ নেই দেখতে দারুণ, মনে হয় ভীষণ সাজগোছ করে বেরিয়েছেন মহারানী, কিন্তু কানের কাছে একবার কাকা শব্দ করলেই কানদুটির বারোটা বেজেছে।
ম্যাকাউদের সংলগ্ন ছো’ট আরেকটি খাঁচা, যেখানে হরেক রকমের প্রজাপতির বাস। পাখি আর প্রজাপতি, উভয়ের প্রতি রিপির দারুণ দুর্বলতা। দেখামাত্র তার ক্যামেরা সারাক্ষণ ক্লিক করতে শুরু করে----বাচ্চাদের মত উত্তেজিত হয়ে যায়। ‘বিউটিফুল’ শব্দটি এমন মিষ্টি করে ওর মুখ দিয়ে বেরুয় যে মনে হয় একটা নতুন গানেরই কলি----বিউউউউউউটি-----ফুল। ওই ‘উ’টি যেন তরঙ্গায়িত হয়ে হয়ে অন্তরীক্ষের নিঃসীমিতায় পৌঁছে যায়বড় ভাল লাগে শব্দটি শুনতে ওর মুখে।

                                  প্রজাপতির বাসা
পাখির খাঁচা থেকে বেরিয়ে আমরা এলাম প্রজাপতির ঘরে। পৃথিবীতে কত প্রকারের প্রজাপতি আছে জানিনা। সম্ভবত কয়েক লক্ষ। কস্টারিকার এ জায়গাটিতে যে বড়রকমের কোনও প্রদর্শনী নেই সেটা বোঝাই যাচ্ছিল-----এত ক্ষুদ্র পরিসরে কতই বা ঠাঁই দেওয়া যায়। তবুও প্রজাপতি তো নিজের ভুবনেই রঙের নৃপতি----শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক নিখুঁত সৌসাম্য। প্রজাপতির বাসায় গেলে বোঝা যায় ওরা কিভাবে জীবনযাপন করে, কি খেতে ভালোবাসে, কিসব খেলা খেলে নিজেদের মাঝে। আগন্তুক এলেই বা তারা কিভাবে আপ্যায়ন করে তাদের। রিপি আর আমাকে পেয়ে ওরা বেশ মজাই পাচ্ছিল বলে মনে হল। আমাদের হাতের ওপর, আমাদের ঘাড়ে-পিঠে, নাকের ডগাতে, পরম আনন্দে সওয়ার হতে লাগলো। আমরা হলাম তাদের নতুন খেলার সাথী। সংসারে বোধ হয় সব জীবজন্তুই খেলতে ভালোবাসে, কারণ তারা জানে জীবন কত ভঙ্গুর, কত ক্ষণস্থায়ী। কেবল মানুষই তা ভুলে যায় জীবনের একটা সময়। খেলার স্থান দখল করে নেয় বেঁচে থাকবার কাতরতা আর আকুতিভরা প্রার্থনা।
 প্রজাপতির বাসায় বেশিক্ষণ থাকিনি আমরা-----থাকবার মত বৈচিত্র্য ছিলও না। তাছাড়া ক্ষিধে পেয়ে গিয়েছিল বেশ। আলবার্টোর পিছু ধরে আমরা প্রবেশ করলাম যে-যত-খেতে-পারে রকমের স্বেচ্ছাসেবী ক্যাফেটারিয়াতে। পেটের ক্ষুধার চাইতে চোখের ক্ষুধাটাই বেড়ে যায় যখন প্লেটের ওপর খাবারের স্তূপ নিলেও মনে হয় সব খেতে পারব। তারপর দেখা যায় সিকিভাগও খাওয়া যাচ্ছে না। প্রকৃতি আর প্রবৃত্তির মাঝে এই যে চিরদ্বন্দ্বটি আমাদের, খাওয়ার টেবিলে বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডায় বসে, সেটা নিয়ে ভাবতে বেশ মজা পাই আমি। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমাদের টুরবাসের বড় শাখাটি চলে গেল কাছাকাছি একটা রেপটাইল আবাস দেখতে। আমরা দুজন থেকে গেলাম, প্রধানত আমার অনিচ্ছার কারণেই----বড় বড় সাপ, বিষাক্ত সাপ, এগুলোর প্রতি কেন জানি কোনদিনই তেমন আকর্ষণ ছিল না আমার। গা কাঁটা দিয়ে উঠত ছোটবেলায়----মজার ব্যাপার যে এখনো দেয়। আলবার্টোর সঙ্গে চুক্তি হল যে আমরা যেখানেই থাকি এক ঘন্টা পর ওপরতলার একটা গিফটস্টোরের ভেতর গিয়ে অপেক্ষা করব। বাস আসবে আমাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের শেষ গন্তব্য, পোয়াস আগ্নেয়গিরির একেবারে শেষ মাথা, সেখানে নিয়ে যেতে। আগ্নেয়গিরি আমি আগে দেখিনি কখনো, দেখার সুযোগই হয়নি, সুতরাং এই সুযোগটি কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
 গিফটস্টোরে প্রচণ্ড ভিড়। সখের ক্রেতাদের লম্বা লাইন আর নিস্প্রয়োজন কেনাকাটা, দুটোই এখন আমার রুচি স্পৃহা থেকে বিতাড়িত, বহির্ভূত। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছি। তাদের ছোট ছোট মূঢ়তাগুলো, ছোট ছোট অতৃপ্তিগুলো, বড় বড় মোড়কের ভেতর ভরে নিয়ে হৃষ্টচিত্তে ঘরে ফেরার ছবি দেখছি তাদের মুখমণ্ডলে। আমি এক বহিরাগত পথিক, পথই আমার ঠিকানা, মানুষের মুখে আমি নিজের ক্ষুদ্রতাগুলো, অপূর্ণতাগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজি দূর থেকে দাঁড়িয়ে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, নীরব কান্নার মত, চৈত্রমাসের তৃষার্ত মাটি যেমন করে কাঁদে। সেখানে একজন দুজন ছেলেমেয়ে সিগারেট ফুঁকছে।
 হঠাৎ দেখি চমকে ওঠা বিদ্যুৎ পাহাড়ের গা রাঙ্গিয়ে দিল মুহূর্তের জন্যে। তারপর সে কি গর্জন মহাকাশব্যাপী। সাথে সাথে নামল বৃষ্টি-----মুষলধারে বৃষ্টি। কোথা হতে এত জল, এত অশ্রু, এত হাহাকার, দিকবিদিক আচ্ছন্ন করে নেমে আসে পৃথবীতে জানিনা। বাংলাদেশের বৈশাখে দেখেছি এমন বৃষ্টি, জ্যষ্ঠ আষাঢ়েও দেখেছি বটে, কিন্তু অটোয়াতে দেখিনি, ক্যালিফোর্নিয়াতে দেখিনি, যে বৃষ্টি এখন দেখছি কস্টারিকার কোনও এক দূর পর্বতের দূরতর কোনও সুভেনিয়ার শপের ছাদের নিচে অনেক অচেনা মানুষের সঙ্গে গায়ে গায়ে আঁট হয়ে দাঁড়ানো অবস্থাতে। আমার চোখ তখনো বাইরে। সেই একই ছেলেমেয়েগুলোর দিকে নিবদ্ধ। তারা এবার অন্য খেলায় মেতেছে-----অঢেল বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে দুতিন জন বন্ধু, আর দোকানের ভেতর থেকে ডিজিটাল ক্যামেরাতে ছবি তুলে যাচ্ছে ওদের সেই মুষলধারায় ভিজতে থাকার দৃশ্য। তারা হাসছে, খিলখিল করে হাসছে, ছোটবেলায় আমি আর আমার ভাইবোনেরা যেমন করে হাসতাম উঠানের ওপর বৈশাখের শিলাবৃষ্টির সীমাহীন আনন্দতে গা ভাসিয়ে। সেযুগে কারো হাতে কোনও ক্যামেরা ছিল, সেলফোন আবিষ্কারই হয়নি তখন, তখন বৃষ্টিতে ভেজা ছিল ছোটদের খেলা। এখন মনে হয় যেন বৃষ্টিতে ভিজে ছবি তোলা হয়েছে বড়দের পুনরায় বাচ্চা হবার খেলা। প্রযুক্তি কত বিচিত্রভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে তা নিয়ে যদি একটিবার আঙ্গিনায় বসে ভাববার অবকাশ হত আমাদের, তাহলেই দেখতে পেতাম কি এক অদ্ভুত উপায়ে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ছোটদের হাতে দিয়েছে বড় বড় খেলা করার শক্তি, তেমনি আবার বড়দেরও দিয়েছে ছোটদের খেলায় মেতে যাবার কলাকৌশল। মাঝে মাঝে ভুলে যাই কে কাকে নিয়ে খেলছে----মানুষ না যন্ত্র?
কস্টারিকাতে মোট ৬টি সজীব এবং ৬১ টি নির্জীব বা প্রায়-মৃত আগ্নেয়গিরি। আরেনাল নামক গিরিটি একসময় ছিল সবচেয়ে সজীব ও সতেজ, তবে ২০১০ সালের পর থেকে কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছে----- সাময়িকভাবে হলেও দারুণ চুপচাপ। একধরণের আগ্নেয়গিরি আছে যাদের বলা হয় ক্যালডেরা, যার মানে হল তাদের মুখের দিকটা পুরোপুরি পানিতে ঢাকা, এবং সেই পানি থেকে গরম ধোঁয়া অবিরাম উদ্গীর্ণ হয়ে চলেছে। আমরা যে আগ্নেয়গিরিতে গিয়েছিলাম তার নাম পোয়াস, পোয়াস জাতীয় পার্ক নামে খ্যাত এই জায়গাটি, যেখানে বাইরের পর্যটকদের নিইয়ে যাওয়া হয় সাধারণত। এর উচ্চতা ৮,৮৮৫ ফুট, প্রায় এক মাইল ব্যাসব্যাপী সে বিস্তৃত, এবং অনবরত সেখান থেকে গরম বাষ্প উদ্গীরণ হয়ে যাচ্ছে। এবং সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর সাথে নির্গত হচ্ছে অন্তহীন গন্ধকের বুদ্বুদ। এর এমনই এক ভয়ঙ্করি রূপ যার আকর্ষণে

                   ক্যামেরাতে ক্ষুদ্রই বৃহৎ

           পোয়াসের দ্বারপ্রান্তে
বারবার মানুষ তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, বোঝার চেষ্টা করে তার নিজের ক্ষুদ্রতা, অনুধাবন করতে চায় তার জীবনেরই অনিবার্য অনিশ্চয়তাকেআমার নিজের জন্যে এ এক অভিনব অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে, জীবনে কখনো নিজেকে এতটা তুচ্ছ আর এতটা অক্ষম মনে হয়নি যতটা হয়েছিল পোয়াসের ধূম্রায়িত শরীরের সামনে দাঁড়িয়ে। আসলে সেখানে যাবার জন্যে সবচেয়ে আদর্শ সময় ওটা ছিল না, বৃষ্টি আর ঘোলাটে আবহাওয়া প্রায় সর্বক্ষণই লেগে থাকে সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি অবধি। কিন্তু সেদিনের পর্যটক আমরা সবাই ছিলাম দারুণ ভাগ্যবান, একটু আগে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেলেও ঠিক ওই সময়টি ছিল ধবধবে পরিষ্কার। দুচোখ মেলে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম এক উপকূল থেকে আরেক উপকূল-----পূর্বে বিপুল আটলান্টিকের শাখা মেক্সিকো উপসাগর, পশ্চিমে চির অশান্ত প্রশান্ত মহাসাগর।
এমন অসাধারণ দৃশ্য আমি জীবনে দেখিনি আর----পৃথিবীর বৃহত্তম দুটি মহাসাগর একই পর্বতশৃং গ থেকে দেখতে পাওয়া----এর চেয়ে বড় শিহরণ আর কিসে আছে জানিনা। আমার ঘূণে-ধরা প্রাচীন শরীরেও প্রবলভাবে অনুভব করা গেল প্রকৃতির সেই অনুপম প্রদর্শনীএকমাত্র আমারই হাতে সেদিন কোনও ক্যামেরা ছিল না, ডিজিটাল বা সেকেলে কোনপ্রকারই নাযন্ত্রের সঙ্গে একরকম আড়ি দিতেই শুরু করেছি বলা যায়। দরকারই বা কি। আমি ছাড়া সবার হাতেই তো রয়েছে সেই যন্ত্র। সেখানে দেখলাম প্রতিটি মানুষ তার আপন লোকগুলোর ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রিপি তুলল আমার, অনুরোধক্রমে রিপির ছবি তুলে দেয় ভিনদেশের কোনও অচেনা মানুষ। দেখলাম সেখানে বেশির ভাগ পর্যটকই চীন-জাপান-কোরিয়া থেকে আগত মানুষ। নতুন পয়সা এসেছে তাদের হাতে, সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে বিশ্বভ্রমণের স্পৃহা। তারা দেখছে আমাদের, আমরা দেখছি তাদের, দূরত্ব কমছে আস্তে আস্তে, পৃথকের পর্দা ছাড়িয়ে আমরা আবিষ্কার করতে পারছি ভিন্ন জগত থেকে বেড়াতে আসা অচেনা অদেখা আপনজনদেরকস্টারিকা একটি ক্ষুদ্র দেশ, কিন্তু প্রাণসম্পদের দিক থেকে বিপুল তার পরিসর। তার বেশ কটা  কারণই সেদিন আবিষ্কার করার  সুযোগ হয়ে গেল আমার
 আমাদের সেদিনকার মত ভ্রমণসূচী প্রায় সমাপ্তএবার ফিরে যাবার পালা। বেলা তখনো ফুরায়নি-----সূর্যের শেষ আলোকণাগুলি পাহাড়ের গায়ে গায়ে লাল আবির ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই আলোতে দেখলাম দুপাশে কি এক অদ্ভুত উপায়ে অনেকগুলো গরু শুয়েবসে আরাম করছে, ঘাস খাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবই বা করছে হয়তবাহ বেশতো, এই এত এত উঁচু পাহাড়ে এতগুলো গরু এল কোত্থেকে। রিপির কাছে জানা গেল কারণটি। বিংশ শতাব্দীর কোনও এক সময় ব্রিটেনের এক অভিবাসীর খেয়াল হল দেশ থেকে দুয়েকটা স্বাস্থ্যবতী গাভী এনে দুধের ব্যবসা জুড়ে দিলে কেমন হয়। সেই ‘দুএকটা’ গাভী এখন দুএকশ’ গরুতে পরিণত হয়েছে। তারা প্রতিদিন দুধ দিচ্ছে কৃষককে, সেদুধ দিয়ে কৃষক মাখন বানাচ্ছেন, বানাচ্ছেন অসম্ভব সুস্বাদু পনির, যার কিছুটা স্বাদ আমি পেয়েছিলাম সেই গিফটস্টোরে অপেক্ষমান থাকা কালেই-----ছোট একটা প্যাকেট কিনে রিপি আমাকে খেতে দিয়েছিল। পনির আমি সাধারণত পছন্দ করিনা----অতিরিক্ত লবণ মনে হয়, এবং কেমন একটা সোঁদা গন্ধ পনিরের যা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু ওই পনির খেয়ে আরো খেতে ইচ্ছে কচ্ছিল, এতই চমৎকার তার স্বাদ।
 যাত্রীদের সবাইকে একে একে তাদের সুবিধামত জায়গায় পৌঁছে দিয়ে টুরবাস যখন আমাদের নামিয়ে দেয় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের দরজায়  তখন সন্ধ্যা আটটার বেশি। ট্যাক্সি করে বাসায় গেলাম----রিপি আমি দুজনই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। নেয়েখেয়ে বিছানায় যেতে যেতে বেজে গেল সাড়ে দশটা। একটাই সান্ত্বনাঃ পরের দিন আমার ছুটি----রিপি আগেই বলে রেখেছিল আমাকে। শুধু ঘুম আর আড্ডা আর আয়েস। দুপুরের পর ওর এক বন্ধু আসবে কয়েক ঘন্টার জন্যে, এছাড়া আর কোনও কাজই নেই সেদিন। ভাবতেই ভালো লাগে। সমস্যা আমার নিজের শরীরটাকে নিয়ে। বহুদিনের অভ্যাসে তার একটা সময়জ্ঞান তৈরি হয়ে গেছে-----সকাল পাঁচটার পর আমি ঘুমুতে চাই বা না চাই শরীর কিছুতেই ঘুমুতে চাইবে না। অতএব আমি ছুটির দিন জানা সত্ত্বেও যথাসময়ে বিছানা ছেড়ে প্রাতঃরাশের যাবতীয় আনুষঙ্গিকতা সমাপন করে একটা বই নিয়ে বসলাম রিপির বসার ঘরের সোফাতে। আসলে আমার বই পড়ার বড় সুযোগটাই আসে কোথাও বেড়াতে গেলে----বিস্তর সময় পাই নিজের জন্যে, মানে নিজের ইচ্ছামত যা মনে চায় তাই করার জন্যে।
 বিকেল দুটোর দিকে রিপির এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ন্যাটালি যার নাম, ও এল বাড়িতে। ভীষণ মিষ্টি চেহারার  মেয়ে, আজেরবাইজান থেকে আসা একটি মুসলমান মেয়ে ( যদিও তার বাবামা ভাইবোন সবাই খ্রীস্টান), ফিজিওথেরাপিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি করার পর সে এখন রিফেক্সলজি নামক তারই এক শাখাতে বিশেষজ্ঞের কাজে লিপ্ত। সোজা কথায় একপ্রকারের মালিশবিজ্ঞান-----ব্যবসায়িক ভাষায় যাদের বলা হয় ‘মেসিউর’। দেখতে ত্রিশের বেশি মনে হবে না, কিন্তু আসলে তার বয়স নাকি চল্লিশের ওপর। তিনটি ছেলেমেয়ে। অল্পবয়সে বিয়ে করেছিল বাবামায়ের অমতে, প্রথম যৌবনের সেই চিরপরিচিত ধারাটি, তারপর কিছুদিনের মধ্যেই মুখোশ খুলতে শুরু করে, রঙ্গিন স্বপ্নের স্থান দখল করে নেয় দুঃস্বপ্নের প্রেতাত্মারা। তার যৌবনবতী জীবন এখন শূন্যতায় ভরা।

    


                            

                             
                           
                                    লেখকের পদমর্দনরত ন্যাটালি

                                 ন্যাটালির সঙ্গে লেখক
নালিশ জিনিসটা আমি ভীষণ অপছন্দ করি। আমার কখনো কোনও স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিলেও চেপে রাখার চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব। কিন্তু কতগুলো সমস্যা আছে যেগুলো চেপে রাখা সম্ভব হয় না। যেমন পা ফুলে যাওয়া। দূরপাল্লার ভ্রমণে কমবেশি প্রায় সবারই হয় সেটা, আমার একটু বেশি হয় এই যা, প্রধানত অন্যান্য উপসর্গের

                             
                            
                                    লেখকের পদমর্দনরত ন্যাটালি
কারণেই। আমার সেই স্থূলাকার পদযুগলটি রিপির দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। কি মনে করে  সে ন্যাটালির কাছে আবদার জুড়ে দেয় আমার পাদুখানি একটু মালিশ করে দিতে পারবে কিনা। অবশ্যই পারবে, এতে ‘না’ বলার মত মামুষই নয় সে। তারপর আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা-----ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে আমার আশি বছরের আয়ুষ্কালে আজ পর্যন্ত কেউ আমার পা মালিশ করেছে বলে মনে করতে পারলাম না। আমি করেছি অন্য কারো পদমর্দন, অনেক অনেকবার, কিন্তু আমার পায়ে কদমবুছি ছাড়া অন্য কোনও কারণে কেউ হাত দেয়নি কখনো। তাই কেমন অদ্ভুত লাগছিল মেয়েটির নরম আদুরে হাতের স্পর্শ আমার দুটি শীতল পায়ের ওপর। রীতিমত বিব্রত বোধ করছিলাম। দশ মিনিট নয়, আধঘন্টা বা একঘন্টাও নয়, পাকা দেড় ঘন্টা মেয়েটি আমার অভদ্র পাদুটিকে একটু মার্জনীয় আকারে ফেরানোর চেষ্টা করে গেল----খুব একটা সফল হয়েছিল বলা যায় নাস্ফীতপদ বৃদ্ধ আগের মতই একটুকরো কদাকার মাংসপিণ্ড হয়ে পড়ে থাকল রিপির সোফাটিতে পরের দিন। আমার এবারকার ভ্রমণের চতুর্থ দিবস। গত রাতে ঘুম নেহাৎ মন্দ হয়নি। গা’টা মোটামুটি চাঙ্গাই বোধ হচ্ছে। বাইরে যাবার জন্যে শরীর ও মন দুই তৈরি। সকালবেলার নাস্তা সেরে আমরা দুটিতে বেরিয়ে গেলাম ট্যাক্সি করে। প্রথম গন্তব্যঃ স্যান হোজের সাপ্তাহিক বাজার, ক্যানাডা-আমেরিকায় যাকে বলা হয় ফার্মার্স মার্কেট। আমাদের

                                      ফার্মার্স মার্কেট
অটোয়াতে যেমন আছে বাইওয়ার্ড মার্কেট, যা খোলা থাকে প্রতি শনিবার, গরমের মরশুমে। স্যান হোজের বাজারটি বলতে গেলে একেবারে শহরের মাঝখানে, চতুর্দিক থেকে লোক আসে সেখানে, ভিড়টা সকালবেলাতেই হয় বেশি, কারণ ওসময়কার আবহাওয়াটাই এরকম যে রোজ সকালে আকাশ জুড়ে একটুকরো মেঘ দেখা যাবে না কোথাও, আবার বিকেলবেলা ধূমধাম করে নামবে অঝোর বৃষ্টি। তাই লোকজন বেশির ভাগই সকাল সকাল সেরে নেয়ে বাজারের কাজটি। কস্টারিকাতে প্রকৃতি আর মানুষদের মধ্যে সুন্দর একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে যেন----একে অন্যের সুবিধামত নিজেদের অবস্থানটি শুনশান করে সাজিয়ে নিয়েছে। কেউ কারো পথের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। বাজারের ঠিক পাশেই বেশ বড়সড় রাসভারি একটা দালান, দেখেই মনে হয় রাজাবাদশাদের আমলে তৈরি করা এক শখের ভবন। রিপি জানালো আমাকে যে এটি হল স্যান হোজের জাতীয় শিল্পকলা ভবন-----ন্যাশনাল আর্টস থিয়েটার। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কফিচাষের যুগ শুরু হবার সময় থেকেই। সেসময়কার ইউরোপিয়ান অভিবাসীদের এমন একটা দৃষ্টি ছিল যে একটা নতুন দেশের নতুন জাতিকে ভবিষ্যতের  জন্যে গড়ে তুলতে হলে যে কটি উপাদান দরকার তার প্রথম সারিতে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও শিল্পকলা। এই তিনটি বিষয়ের প্রতিই সেকালের জাতীয় নেতারা সমান যত্নবান ছিলেন একেবারে গোড়া থেকেই। শিক্ষা, মানে উন্নতমানের আধুনিক,শিক্ষার জন্যে যেমন তাঁরা সরকারি বা বেসরকারি জলপানি দিয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েদের পাঠিয়েছিলেন ইউরোপে, তেমনি উচ্চমানের শিল্পকলাচর্চার কথা ভেবেও তাঁরা সেই একই সময় তৈরি করেছিলেন স্যান হোজের এই ন্যাশনাল আর্টস থিয়েটার, যার শানসৌকত দেখে এখনো আমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়িসে কি অসাধারণ কারুকার্য, যেন আগাগোড়া সুবর্ণমণ্ডিত এক রাজপ্রাসাদ, এর প্রতিটি  আসবাব, মেঝেতে তার প্রতিটি মার্বেলের পাথর, প্রতিটি কাঠের হাতল, সবকিছুতেই

                                                    ন্যাশনাল আর্টস থিয়েটার
সেই পুরনো দিনের ইউরোপিয়ান ঐতিহ্য আমাদের মত সুদূরাগত দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এর সঙ্গে আমাদের অটোয়ার ন্যাশনাল আর্টস সেন্টারের তুলনা চলতে পারে, যদিও আমাদেরটি এতুলনায় খুবই সাম্প্রতিক----এর জন্মকাল ১৯৬৭ সালে। কস্টারিকার এই থিয়েটারটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয় ১৮৯৭ সালের ২১ শে অক্টোবর, এবং তার প্রথম আকর্ষণই ছিল গ্যটের বিখ্যাত নাটক ‘ফাউস্ট’এর মঞ্চায়নকস্টারিকার মত ছোট একটা দেশের জন্যে এর চেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ উদ্বোধন আর কি হতে পারে। রিপি আর আমি গোটা দালানটাই দেখলাম ঘুরে ঘুরে। বিশাল, বিশাল সব স্তম্ভ, বিশাল সেই মঞ্চ, স্টলগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন রাজপ্রাসাদের বিশেষ অতিথিদের জন্যে বিশেষভাবে তৈরি সেগুলো। সবচেয়ে অবাক যাতে হলাম আমি সেটা হল যে সেই একশ-দেড়শ বছরের ঐতিহ্যটিকে কেমন যত্ন করে, সম্মানের সাথে ধারণ করে রেখেছেন তারাএতেই বোঝা যায় এজাতির প্রাণপ্রাচুর্যের পরিচয় কতটা নিষ্ঠা তাদের জাতীয় মর্যাদা ও সুনাম রক্ষার প্রতি। এই জাতির কাছে ঐতিহ্য কেবল মিউজিয়ামের বয়মে ভরা মুখের বুলি নয়, বক্তার মাঠে গিয়ে গালভরা বক্তৃতা করা নয়, ঐতিহ্য হল জাতির সম্মিলিত প্রাণসপম্পদ, যা তার আত্মার শিরায় শিরায় প্রবাহিত শোনিতধারার মত। ওপরতলার বসার ঘরের একটা সংরক্ষিত জায়গায় গিয়ে দেখলাম একটি অল্পশিক্ষিত পরিচারিকা কি অসম্ভব ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে ধূলা মোছার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিশাল গোলাকার একটি তক্তপোশের তলা থেকে। আমি দাঁড়িয়ে  দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই অসাধারণ দৃশ্য। দীর্ঘশ্বাস? হ্যাঁ, দীর্ঘশ্বাস তো বটেই। দীর্ঘশ্বাস আমাদের হতভাগা জাতিটার হতদশার সঙ্গে কস্টারিকার চেহারা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। আমাদের  ভাগ্যে ওই দীর্ঘশ্বাসটুকু ছাড়া আর কিই বা আছে বাকি।
থিয়েটার ভবনের ভেতরটা যেমন উচ্চমানের শিল্পকর্মভূষিত, বাইরেও তার রূপ কম মনোমুগ্ধকর নয়। সমস্ত এলাকাটিকে ঘিরে রেখেছে পাশ্চাত্য সঙ্গীত জগতের গুটিকয়  চিরস্মরণীয় ব্যক্তির আবক্ষ মূর্তি-----সবই শ্বেতশুভ্র মার্বেলের নিখুঁত পাথরে খোদাই। এতটা সময় পেরিয়ে গেল ভবনটি তৈরি হবার পর, অথচ কেমন আশ্চর্য সতেজ সজীব সব। এতটুকু দাগ পড়েনি সময়ের। ভাবনা এসে যায় মনেঃ আমাদের ঢাকা শহরে কি কোনও মহৎ ব্যক্তির মূর্তি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত একশ দেড়শ বছর? মাদ্রাসার ছাত্ররা শিক্ষকরা কি সেগুলোকে আল্লাপাকের শরিকত্বের দায়ে ভেঙ্গে গুঁড়ো করে ফেলত না, যেমন করেছে তাদেরই জ্ঞাতিভাইরা আফগানিস্তানের বেরিয়ান মূর্তিকে।
 রিপি আগাগোড়া বাঙালি মেয়ে হলেও খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ঠিক অন্যান্য বাঙ্গালির মত নয়। তার খাবার টেবিলে সবচেয়ে বেশি থাকে ফলমূল আর শাকসবজি। তাই সাপ্তাহিক ফার্মার্স মার্কেটটি ভীষণ প্রিয় একটি জায়গা তারএবং অবধারিতভাবে মাছমুরগির চাইতে বেশি আকৃষ্ট হবে কত প্রকারের ফল আছে সেখানে, আছে কতপ্রকারের সবজি। বহিরাগত হওয়া সত্বেও দুএকজন ফলবিক্রেতার কাছে ওকে রীতিমত পরিচিত বলেই মনে হল, এতটাই ফলপাগল মেয়ে সেরিপিই একমাত্র বাঙালি মেয়ে যার বাড়িতে গিয়ে আমি ফল খেয়েছি নাস্তাহিসেবে। অতএব সেদিন আর্টস সেন্টার থেকে বেরিয়ে আমরা যখন মার্কেটে

                                 আর্টস থিয়েটারের পরিচারিকা
গেলাম তখন রিপির ঝুড়ি কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভরে গেল নানাপ্রকারের ফল আর সবজিতে। সেদিনকার মত আমাদের বাইরের ঘোরাফেরা শেষ। বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে আরেক দফা ঘুম-----দিবানিদ্রা আমার অভ্যাসের বাইরে হওয়া সত্বেও কস্টারিকাতে গিয়ে সবই কেমন ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল।
 সেদিন সন্ধ্যায় রিপির বাড়িতে ছোটখাটো পার্টির আয়োজনও বিড়িয়ানি রাঁধবে। খাশির মাংস, কাবাব আর প্রচুর স্থানীয় শাকসবজির স্যালাদ। সবশেষে মিষ্টান্ন----না, আমাদের দেশী মিষ্টি নয়, ওর নিজেরই হাতে তৈরি এ-অঞ্চলের উপকরণ দ্বারা প্রস্তুত সুস্বাদু ‘পাই’। অতিথিদের মাঝে রয়েছে দুটি স্কুলগামী মেয়ে----ষোল-সতেরো তাদের বয়স। বিদেশী দুজনই। একজন জাপান থেকে, আরেকজন আমাদের বাংলাদেশ থেকে। ওরা একই স্কুলে পড়ে----স্কুলটি কোনও এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। জাপানি মেয়েটির নাম মিউলি। মিষ্টি চেহারা, মিষ্টি নাম। মিষ্টি তার ব্যবহারও। আমাদের দেশী মেয়েটির নাম লুৎফে---না লুৎফা নয়, লুৎফে,----কি এক দুর্বোধ্য কারণে মেয়ে নিজের ইচ্ছাতেই হিজাব পরতে শুরু করেছে যদিও তার অতি উচ্চশিক্ষিত মা বা খালাফুফুদের কেউই কোনদিন হিজাব জাতীয় কোন শিরবস্ত্র পরিধান করেননি বলেই ও জানালো আমাকে। কথাবার্তায় ভীষণ চটপটে এই মেয়েটি, দারুণ বুদ্ধিমতী যা তার চোখেমুখেই ফুটে থাকে বরাবর, এবং ভীষণ মিষ্টিভাষী ও বিনয়নম্র তার আচার ব্যবহার। বড় ভাল লাগল মেয়েদুটিকে। চুটিয়ে গল্প করলাম ওদের সঙ্গে। ওরা কি শিখেছে আমার কাছে জানিনা, কিন্তু আমি যে শিখেছি অনেক ওদের কাছ থেকে সেটা হয়ত ওরাও জানে না ভালো করে।
 পার্টিতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক অতিথিও ছিলেন অবশ্য। মূলত জার্মান ভদ্রমহিলা, উবা তাঁর নাম, রিপির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। দৈত্যাকার তিনি উচ্চতায়, ফলে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকাকালে আমি অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম তার চেয়ে বরং বসে বসেই কথা বলা ভালো। মহিলা পেশাতে ডাক্তার আর ধাইএর মাঝামাঝি একটা কিছু যার নাম, উনি বললেন, বার্থার, যার সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞানই ছিল না। দূর থেকে ফোনে উপদেশ দিয়েই গর্ভবতী মেয়েদের সন্তান প্রসব নিয়ে কিছু একটা ব্যাপার, এটুকু শুধু উদ্ধার করা গেল। ভদ্রমহিলা খুব কথা বলতে ভালোবাসেন তা বোঝা গেল। সংসারের প্রায় প্রতিটি বিষয়েই তিনি মতামত পোষণ করেন, এবং তা থেকে সহজে টলানোর সাধ্য কারো আছে বলেও মনে হল না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও তাঁর বেশ কড়া কড়া মন্তব্য আমাকে শুনতে হল। জীবনে কোনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছিলেন কিনা জানি না কিন্তু তাতে কি? মতামত দিতে আবার জানতে হয় নাকি কিছু? সৌভাগ্যবশত রিপির মিষ্টি গলার ডাক শোনা গেল ইতোমধ্যেঃ ডিনার রেডি। মনে মনে বললামঃ বাঁচালে মা। আই এম রেডি টুউ...।
পরের দিন ১৫ই সেপ্টেম্বরঃ কস্টারিকার স্বাধীনতা দিবস-----ক্যানাডার যেমন ১ লা জুলাই আর যুক্তরাষ্ট্রের ৪ঠা জুলাই। ভোর রাতে ঘুমের ঘোরেই কানে আসছিল বাজিবাজনার শব্দ। দিনটি কেবল কস্টারিকারই নয়, পার্শ্ববর্তী আরো চারটে দেশের স্বাধীনতা দিবস-----ওই একই দিন তারা স্বাধীনতা অর্জন করে ঔপনিবেশিক শক্তি স্পেনের কবল থেকে। পূর্ণ স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করতে খানিক সময় লেগেছিল যদিও, প্রধানত বৃহত্তর শক্তি মেক্সিকোর আধিপত্যের কারণে, তবে সে সমস্যার সমাধান হয়ে যায় ১৮৪০ সালেই। আজকে গোটা সেন্ট্রাল আমেরিকার মহা উৎসবের দিন। কস্টারিকার বেলাতে সেটা আরো সত্য কারণ ছয়টি দেশের মাঝে তারাই একমাত্র দেশ যেখানে পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৫০ সাল থেকে। কেবল তাই নয়, ১৯৪৮ সালে তারা সর্বসম্মতিক্রমে  দেশের সামরিক বাহিনী তুলে দেয়। নেতারা ঘোষণা দেন যে তাঁরা যুদ্ধ চান না, চান শিক্ষা। সৈন্যবাহিনীর চেয়ে অধিক প্রয়োজন তাঁদের শিক্ষক বাহিনী। দেশের দৈনন্দিন নিরাপত্তা রক্ষার ভার দেওয়া হয় ২,০০০ সদস্য বিশিষ্ট পুলিশবাহিনীর ওপর, এবং জনগণ তাতেই খুশি। আজকে সেদেশে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ছেলেমেয়ের স্কুলশিক্ষা বাধ্যতামূলক, এবং সেশিক্ষা পুরোপুরি অবৈতনিক। সেদেশে গণস্বাস্থ্যের স্থান গণশিক্ষার ঠিক পরপরই-----প্রতিটি নাগরিকের পূর্ণ অধিকার সেখানে সরকারি খরচে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়াঅনেকটা আমাদের ক্যানাডার মত, এবং যুক্তরাষ্ট্রের মত মহা পরাক্রান্ত দেশ হাজার চেষ্টা করেও যা হতে পারছে না। এদেশে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকের অনুপাত শতকরা ৯৪.৬ আমার এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতাতে সমস্ত স্যান হোজে শহরে কোথাও একটি ভিক্ষুক দেখিনি, একটি হোমলেস মানুষকে উদ্দেশ্যহীন চেহারা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখিনি, যেমন আমি দেখি আমাদের এই অত্যুন্নত

                                সাগরসৈকতে ছবি তুলছে ন্যাটালি
শহর অটোয়ারই নগরকেন্দ্রে। এ এক আশ্চর্য ও অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা আমার। কস্টারিকাতে যাবার আগে আমার ছেলেদের ভয় ছিল সেখানে গিয়ে না জানি কোন অজানা রোগের কবলে পড়ে যাই, পাছে না কস্টারিকার মশা আর মক্ষিকা বাহিনীদের যুগ্ম আক্রমনে তাদের বৃদ্ধ পিতার প্রাণহানি হয়ে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন হাসি পায় সেসব কথা ভেবে। রোগ দূরে থাক একটি মশা বা মাছি আমার চোখে পড়েনি, একটি ময়লার ঢিবি চোখে পড়েনি পুরো সপ্তাহের ভেতর। এ তো ভাই থার্ড ওয়ার্ল্ড নয়, পুরোপুরি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের বাড়া। আমার মতে ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় দেশগুলোরও অনেক কিছু শেখার আছে ক্ষুদ্র দেশ কস্টারিকার কাছ থেকে।
 সেদিন সকাল  সকালই  চলে এলেন ন্যাটালির বাবা ম্যানুয়েল মারেনকো ও ষোড়শী কন্যা লুজমেরি। রিপি আর আমাকে নিয়ে তারা যাবে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে, যেখানে আমরা প্রথমে দেখব সমুদ্র সৈকতে বসে বালু আর সাগরের খেলা, তারপর পাহাড়ি রাস্তা ধরে ওপরে উঠে উঠে যাব একেবারে সর্বোচ্চ বিন্দুতে----সেখানে একটা মনোরম রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখব মহাসাগরের নীল জলেতে। মনে মনে হাসলাম একটু। রোমান্টিক কেবল আমি নই, আমার মত বা আমার চেয়েও বেশি

                                     প্রশান্ত মহাসাগরে সূর্যাস্ত
রোমান্টিক আছে বটে সংসারে। রিপি নিজেই তার একজন। সম্ভবত মারেনকো পরিবারের লোকগুলোও তাই। এঁরা আসলে গোড়া থেকেই কস্টারিকার বাসিন্দা ছিলেন তা নয়। মারেনকো সাহেবের ডাক্তারি পেশার সূচনা হয়েছিল নিকারাগুয়াতে। নিকারাগুয়া দেশটি নিকটতম প্রতিবেশী হলেও উন্নয়নের দিক থেকে অনেকটাই পশ্চাতে। সেখান থেকে প্রতি বছরই ৪ থেকে ৬ লক্ষ শ্রমিক আসে কস্টারিকাতে চাকরির খোঁজে। এবং মোটামুটিভাবে চাকরি তারা পেয়েও যায়। প্রধানত কফি কুড়নোর সময়, যখন স্থানীয় শ্রমিক দ্বারা কিছুতেই কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয়না কফি উৎপাদকদের। এই শ্রমজীবি বিষয়টিতে একটা জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে-----ওদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা। কফি বাগানে এই শ্রমিকদের জন্যে তৈরি করা বাড়িগুলোর চেহারা দেখেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। সব্বনাশ, এগুলো শ্রমিকদের জন্য? অফিসারদের নয়? রীতিমত আধুনিক কায়দার সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত আবাসস্থল। এতে বোঝা যায় জাতিটা কত উন্নত। সাধারণ কায়িক শ্রমিকদেরও ওরা সম্মান করতে জানে। নেহাৎ অকারণে নয় যে দেশটি মানবোন্নয়ন সূচকের পরিমাপে সর্বোচ্চ আসন দখল করেছে সমগ্র আমেরিকা মহাদেশে। পরিবেশ সচেনতার কাঠিতে তো কস্টারিকার জুড়ি দেশ খুব বেশি নেই----সারা বিশ্বে তার স্থান পঞ্চম। কস্টারিকাই একমাত্র দেশ যেখানে বিনোদনের জন্যে প্রাণীশিকার একেবারে নিষিদ্ধ। মাথা নত হয়ে আসার কথা, তাই না?
 ন্যাটালির মা কেন প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে  যোগ দিতে পারেননি তার কারণ বোঝা গেল পরে। তিনি প্যাসিফিকের নিকটবর্তী কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়তে অনুষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর গবেষণার বিশেষত্ব মাইক্রোবায়োলজিতে। তিনি সেখানে পেপার দিচ্ছিলেন। আমরা যখন পাহাড়ের চূড়াতে গিয়ে পৌঁছাই তখন তিনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে এলেন নিজের গাড়িতে করে। একটাই সমস্যা-----তাঁর পরিবারে তিনিই একমাত্র সদস্য যার তেমন ইংরেজি শেখা হয়ে ওঠেনি। ফলে তাঁর সঙ্গে আলাপ যেটুকু করা গেল সবই অন্যের মাধ্যমে। কিন্তু তাতেই বোঝা গেল ভদ্রমহিলার রসবোধ ও বুদ্ধির প্রাখর্য কতখানি। ভীষণ আনন্দমুখরতার ভেতর দিয়ে কাটল একটি মনোরম পার্বত্য সন্ধ্যা।
১৬ই সেপ্টেম্বর, আমার জন্মদিন। আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করলেও লাভ নেই-----ওরা সবাই মিলে আমাকে মনে করিয়ে দেবে। হয় ছেলেরা, নয় কোন-না-কোনও আপনজনেরা। এবার সে দায়িত্বটি পালন করার ভার নিয়েছিল রিপি। আগেই সব ঠিক করা ছিল-----এবার অন্য কোথাও নয়, ওর ওখানে। কথা ছিল আমর আর ও দুজনে মিলে করবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমরকে চলে যেতে হল বাইরে। ফলে বাধ্য হয়ে রিপি বিকল্প ব্যবস্থা করেছে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমিনার বাড়িতে----সেটা আমি আগেও টের পেয়েছিলাম যখন প্রথম সাক্ষাতেই আমিনা আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তার বাড়িতে, সোমবার দুপুরে! প্রথমত সোমবার, তদুপরি দুপুর। ইঙ্গিত বোঝার জন্যে বড় বিজ্ঞানী হবার প্রয়োজন হয়না। দুপুরে না করে উপায় ছিল না কারণ পরের দিন সকাল ছটায় আমার ফ্লাইট
বেলা একটার দিকে আমরা আমিনার বাসায় গিয়ে পৌঁছুলাম। নগরকেন্দ্র থেকে কিঞ্চিৎ দূরবর্তী উচ্চ মধ্যবিত্ত পাড়া সেটা। প্রকাণ্ড বাড়ি তা নয়, কিন্তু গাড়িবারান্দা আছে, বড় উঠান আছে, পেছনবাড়িতে একসময় সুইমিং পুল ছিল যেটা এখন আমিনা পরিবারের বদৌলতে সুসজ্জিত পারিবারিক উদ্যান ও বিশ্রামাগারে পরিণত হয়েছে। লিভিং রুমটি বেশ বড়, এবং তার প্রতিটি দেয়ালই বড় বড় ছবির ফ্রেম দিয়ে ঘেরা-----ছবিগুলো সব আমিনার নিজের হাতে আঁকা। শিল্পী হিসেবে তাঁর স্থান কোথায় হতে পারে এবং

                              আমিনার পেছনবাড়ির বাগানে
দেয়ালের সেই ছবিগুলোর কিই বা গুণাগুণ তার বিচার করার মত যোগ্যতা আমার নেই, অতএব সে প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকব। আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ঠ যে লিবিয়ার এক মুসলিম পরিবারের মেয়ে কস্টারিকাতে এসে কিম্বা তারও আগেই ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এবং ছেলেমেয়ের মা এমনকি তিনটে ছোট ছোট বাচ্চার নানী হবার পরও তা অব্যাহত রেখেছেন। শিল্পকলা, সঙ্গীত আর নৃত্যচর্চার প্রতি আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির কি মনোভাব তা খানিকটা জানি বলেই ভদ্রমহিলার প্রতি আমার মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধ দারুণ বৃদ্ধি পেয়ে গেল। সত্যিকার নমস্য ব্যক্তি বটে। সোমবার সেখানে কাজের দিন হওয়া সত্বেও তাঁর মেয়ে সোফি অফিস থেকে ঘন্টাদুয়েক ছুটি নিয়ে আমার সাথে বসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিল। ওর ছোটভাই, আমিন, সে’ও।
প্রথম দফাতে আমিনার বাগান পরিদর্শন। হরেক রকমের গাছ----ফলের গাছ, ফুলের গাছ। প্রায় কোনটিরই নাম জানা ছিল না আমার। কতগুলো একেবারেই স্থানীয় যা কোনদিন দেখারই সুযোগ হয়নি। একটি গাছে অসংখ্য ফুল----ছোট ছোট ফুল, একেবারে ঝাঁক বেঁধে আছে। এই ফুল নাকি হামিং বার্ডের ভীষণ প্রিয়। মজাই লাগলো। দুই বন্ধুই হামিং বার্ডের ভক্ত। আমিনার বাগানে বেশ কিছু ছবি তোলা হল। যেহেতু দিনটা আমারই অন্তর্গত (অন্তত ওদের ধারণাতে) সেহেতু সবগুলো ছবিতেই আমাকে উপস্থিত থাকতে হল। এবং বিশেষরকম অঙ্গভংগিমাতে----প্রধানত আমিনা ও আমাকে একসাথে করে। ভদ্রমহিলা যেন আমাকে একরকম খেলার পুতুল হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। সে যে কি লীলাখেলা। বয়সটা একাশি না হয়ে আঠারো হলে অবশ্য তা একেবারেই সম্ভব হত না। আমি বা উনি কেউই সেপথ মাড়ানোর কথা কল্পনাতেও স্থান দিতাম কিনা সন্দেহ। বার্ধক্য নাকি শৈশবকে ফিরিয়ে আনে মানুষের জীবনে। হয়ত এ’ও তার অন্যতম কারণ।

                           রিপি ও লেখক আমিনার আঁকা ছবির নিচে
জন্মদিন উপযোগী আয়োজনের কোথাও কোন ত্রুটি রাখেন নি ভদ্রমহিলা। নাকি পেছনে সবটাতেই রিপির হাত। কেমন করে বলব-----দুজনের কারো কাছেই তো আদর আপ্যায়ন কম পাওয়া হল না। সবশেষে এল     জন্মদিনের কেক। তাতে যত্ন করে লেখা ১৮, ৮১ নয়। হাসলাম। গণিতের চাকা ঘুরালেই ৮১ কে ১৮ তে পরিণত করা সম্ভব, এবং আসলে এই একটিমাত্র সংখ্যা যাকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরালেই অন্য সংখ্যাটি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু প্রকৃতিকে ঠোকানোর কাজটা যদি অত সহজ হত। তারা সবাই সুর করে হ্যাপি বার্থডে গাইলেন। তারপর  তারা একে একে আমার মুখে একটুকরো কেক ঢুকিয়ে দেয়-----একদিনের কেক খেয়ে আমার পুরো একমাসের বরাদ্দ চিনি খতম। ডাক্তার সাহেব কাছে ছিলেন না বলে রক্ষে। অনুষ্ঠানের পর আমিনা একটা পুরনো খাতা নিয়ে এলেন আমাকে দেখানোর জন্যে। কিসের খাতা? আমিন ছোটবেলায় কবিতা লিখত-----সেগুলো তিনি জমা করে রেখেছেন। খাতা দেখে তো আমিন নিজেই অবাক। তুমি এটা পেলে কোত্থেকে মা? অর্থাৎ ওর নিশ্চিত ধারণা ছিল যে খাতাটা আসলে হারিয়ে গেছে-----অনেকদিন ধরেই নাকি খুঁজছিল খাতাটা। কবিতাগুলো সব ইংরেজিতে। ওর বয়স যখন ষোল কি সতেরো তখনকার লেখা। আমি নিজে খুব একটা সমঝদার নই কবিতার, বাংলা ইংরেজি কোনটারই না, কিন্তু খাতাটির প্রথম কটি পাতা ঘঁটাঘাঁটি করে আমার মনে হল এগুলো কোন  অপরিপক্ক বালকের কাজ নয়, বেশ উঁচু মনের প্রয়োজন এসব শব্দ আর কথাকে ঠাঁই দিতে কল্পনাতে। একটা কবিতার প্রথম লাইনটি ছিল এরকমঃ “তারপর যখন মৃত্যুর পরের মুহূর্তটি এসে দাঁড়ালো আমার সামনে তখন...।“  এধরণের লাইন কোনও টিনেজের কাছ থেকে আশা করব না আমি। বললাম তুমি

                                                কেকপর্ব
এখন আর লিখছ না? না, সময়  হয় না। তাছাড়া কি হবে লিখে? কে পড়বে আমার কবিতা? বর্তমান যুগে কার এত সময় কবিতা পড়ার? আমার নিজেরই নাই। হ্যাঁ তাই। এযুগের এক গভীর ক্ষতচিহ্নের দিকেই তাকিয়ে আছে বাইশ বছরের যুবক আমিন আর একাশি বয়সের বৃদ্ধ আমি, দুজনই। দুজনেরই মর্মবেদনার একই কন্ঠস্বর।
বিকেল পাঁচটার দিকে আমিনা পরিবারের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা অঝোর বৃষ্টির মাঝে ফিরে এলাম রিপির বাসায়। সকাল আড়াইটা থেকে তিনটের মধ্যে উঠতে হবে বিছানা ছেড়ে। এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছুতে হবে চারটের মধ্যে। তারপর আধুনিক যুগের বিমানভ্রমণের সেই চূড়ান্ত বিভীষিকা-----যার চলতি নাম নিরাপত্তা। তবুও উপায়ই বা কি। শকুনের চোখ তো চতুর্দিকে। কখন কোথায় ছোঁবল মেরে তুলে নেবে কাকে কে বলবে।
বেচারি রিপি। কি কষ্টটাই না ভুগতে হল মেয়েটাকে আমার যত্ন নিতে গিয়ে। সাতটা  দিন একদণ্ড বিশ্রাম দিই নি ওকে। তবু তো সে সহ্য করেছে সব হাসিমুখে, তার প্রাণপ্রিয় মীজানচাচাকে কাছে পাবার আশায়। সারা জীবনভর এত ঋণ জমা হয়েছে আমার যে এখন আর গুণছিনা কার কাছে কত ঋণ------এর কোনও সীমাপরিসীমা নেই। জীবনে ভালোবাসা বোধ হয় একমাত্র ঋণ যা শোধ না করলেও ক্ষতি নেই। তাই না?
কস্টারিকা থেকে আমি অনেক নিয়ে এলাম। আকারে ছোট হয়েও যে প্রকারে বড় হওয়া যায় নিজের চেষ্টায় এই শিক্ষাটি যেমন করে শিখেছি আমি এই একটি সপ্তাহের মাঝে ততটা আমি সারাজীবনেও শিখিনি অন্য কোনখানে।

অটোয়া, ১৫ই অক্টোবর, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২



মীজান রহমান

No comments:

Post a Comment