Wednesday, 8 May 2013

সাভার

মীজান রহমান

লাশগুলো এখনো গোণা শেষ হয়নি। কাল সকালে শুনলাম চারশ’ ছাড়িয়ে গেছে। আজ সকালে রেডিও খুলে প্রথমেই শোনা গেল সংখ্যাটি পাঁচশ’ ছুঁই ছুঁইআরো বাড়বে হয়ত----খোঁড়ার কাজ এখনো চলছে পুরোদমে। খননকর্মে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল যুক্তরাজ্য। সেটা নাকি সরকার গ্রহণ করেনি, নিজেদেরই সে ক্ষমতা আছে, এই দাবিতে। সে ক্ষমাতার দাবি যে কতখানি ফাঁকা সেটা ফাঁশ করে দিয়েছে দেশের সংবাদমাধ্যম----- আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, অভিজ্ঞ কর্মীর অভাব, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব,আরো অনেক অভাব দ্বারা খননপ্রচেষ্টা নিদারুণভাবে ব্যাহত, জানালেন বিখ্যাত কলামলেখক নাজমুস সাকিব 
ক্যানাডার রেডিও-টেলিভিশনে  সকাল-বিকেল দুবেলাই প্রথম খবরটি বাংলাদেশের ওপর, এ অভিজ্ঞতা আগে কোনদিন হয়নি। তা’ও একদিন দুদিন নয়, সপ্তাহাধিক কালব্যাপী প্রায় প্রতিটা দিনই। রোজ সকালে-বিকেলে টেলিভিশনে দেখছি পাথর খুঁড়ে লাশ উদ্ধারের দৃশ্য----পাশাপাশি দেখছি প্রিয়জনদের বুকফাটা কান্না, তাদের ঠুনকো জীবন মুহূর্তের মাঝে ওই পাথরগুলোর মতই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবার মর্মান্তিক দৃশ্য। দেখছি সারি সারি কাফনঢাকা মৃতদেহ, যুদ্ধবিদ্ধস্ত শ্মশানক্ষেত্র যেন, দেখছি গণজানাজা, দেখছি গণকবরে তাদের বিবর্ণ, বিকৃত, বিগলিত দেহের নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ার দৃশ্য।
এত যে তাণ্ডব, মানবজীবনের এত যে অপচয় আর অবহেলা, এত কিছু দেখার পরও জানি না কেন আমার যেন কোন বোধশক্তি নাই শরীরেদেশ নিয়ে আমার অনুভূতিগুলো যেন সব মরে গেছে। আমার মন বোবা। আমার বোধ বোবা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগীর মত আমার গায়ে সূঁচ বেধালেও বোধ হয় টের পাব নাঅথচ এটা তো খুব বেশিদিনের কথা নয় যখন ‘দেশ’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ামাত্র মন আকুল হয়ে উঠত----মনে হত সুদূর কোনও প্রিয়জনের স্মৃতি কে যেন হৃদয় খুঁড়ে টেনে আনতে চাইছেদেশ, আমার অভাগিনী দেশ। পদ্মা-যমুনা-মেঘনার নিত্য পাড়ভাঙ্গা অশ্রুজলে সিঞ্চিত গ্রামবাংলার স্মৃতিই তো ছিল আমার ক্যানাডিয়ান লেখক জীবনের প্রধান উদ্দীপনা। বিদেশ-বিভূঁইতে এই যে এতগুলি বছর কাটিয়ে দিলাম আমি, তার সবটাই তো সমর্পণ করেছিলাম এই পোড়ামুখি দেশটারই পাদমূলে। বিলেতে প্রথম ডিগ্রিটি শেষ হতে-না-হতেই আমি ছুটে গেলাম দেশের কাছে, দেশকে কিছু দেব বলে, তার ঋণ শোধ করতে হবে বলে। ইচ্ছে করলে পারতাম আমি উলটোপথে যাত্রা করে উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে  তরী ভেড়াতে। সেযুগে ওই সুযোগটা ছিল আমার। কিন্তু আমি নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবিনি, নিজের কেরিয়ার নিয়ে গা করিনি, আমার যা কিছু অর্জন সব দুহাতে অর্পণ করে দেব দেশের কাছে এই ছিল একমাত্র বাসনা মনে। চার বছর পর দ্বিতীয়বার যখন বিদেশপাড়ি দিলাম উচ্চতর শিক্ষার জন্যে তখনো কোনও দ্বিধা ছিল ন্সা মনে। স্থির বিশ্বাস নিয়ে এসেছিলাম যে ডিগ্রিটা শেষ হয়ে গেলেই আবার ফিরে যাব দেশে।
তারপর এসে গেল সারা আকাশ ঘিরে এক মহা ঘনঘটাসেই করাল রাত্রি----২৫শে মার্চ, ১৯৭১। আমাদের প্রতিটি বাঙ্গালির জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করল ওই একটি মুহূর্ত থেকে। এক নতুন বাস্তবতার আকস্মিকতার মধ্যে আমরা কজন মুষ্টিমেয় বাঙালি অটোয়াতে, আবর্তিত হতে থাকলাম। সে এক অসাধারণ সময়ের স্মৃতি আমাদের মাঝে এখনো সজাগ। ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল-মে-জুন-জুলাই অবধি প্রায় প্রতিদিনই ছিল এদেশের জাতীয় খবরের শীর্ষস্থানে অবস্থিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের খবর----আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের খবর। আমরা গোগ্রাসে গিলতাম সেই খবরগুলো। প্রতিদিন আমরা উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম স্থানীয় রেডিওতে কি খবর আসছে, বা শেষ রাতের টেলিভিশন প্রোগ্রামে, বিবিসিতে, ভারতের আকাশবাণীতে। প্রতিদিন, গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠত, সারা পৃথিবী আমাদের কষ্টতে কষ্ট পাচ্ছে, আমাদের কান্নাতে কাঁদছে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশীদার হতে চাচ্ছে। তারা আমাদের ত্যাগ আর তিতিক্ষার ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত হচ্ছে। সে ছিল এক অপরূপ স্বপ্নিল সময় রে ভাই---জাতির প্রথম ও সম্ভবত শেষ, সত্যিকার গৌরবের যুগ। তখন আমরা ক্যানাডার রাজপথে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ বলতাম বিপুল গর্ব সহকারে। সেসময় ‘সোনার বাংলা’র গান গেয়ে অটোয়া-মন্ট্রিয়ল-টরন্টো-নিউইয়র্কের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে আমরা শ্লোগান দিতাম বুক ফুলিয়ে----নগরবাসীরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তখন হাততালি দিয়ে আমাদের ডাকে সাড়া দিত। সেটা ছিল আমাদের ত্যাগের যুগ, দেশমাতৃকার কাছে আত্মদানের যুগ।
আজ চল্লিশোর্ধ বৎসর সময়ের দূরত্বে দাঁড়ানো আমি, সেই একই মানুষ, জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছানো বয়োবৃদ্ধ মানুষটি, বারান্দার নীরব শূন্যতার মাঝে লক্ষ্যহীনভাবে তাকিয়ে আছি অন্তরীক্ষের অসীমতায়। ভাবছি, এমন কেন হল। এমন করে কেন ওই অনুভূতিগুলো সব হারিয়ে গেল?  কেমন করে উধাও হয়ে গেল সেই অনবদ্য ত্যাগ আর আত্মদানের প্রজ্বলিত বর্তিকা? কোথায় সেই জাতীয় ঐক্য আর মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়তা? কেমন করে কালের এক ক্ষুদ্র কণিকার মাঝে আমাদের প্রাণের সবগুলো প্রদীপ একে একে নির্বাপিত হয়ে গেল?
গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে বাংলাদেশের বিরাট অহঙ্কার। হবেই তো। দেশের শতকরা আশি ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় এই শিল্পখাতে। মোট ৪,০০০ ফ্যাক্টরি ছড়ানো-ছিটানো সারা দেশব্যাপী, যাতে কর্মরত শ্রমিকসংখ্যা আনুমানিক ৩৫ লক্ষ ( সংখ্যাটি নিয়ে বেশ মতভেদ আছে---কেউ বলে ১৫ লক্ষ, কেউবা ২৫)। এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে এই শ্রমিকগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ শতাংশই নারী----যা একটি মুসলিমপ্রধান, রক্ষণশীলতার কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, সমাজের জন্যে রীতিমত অবিশ্বাস্য। তার মূল কারণ হয়ত নারী উন্নয়ন পরিকল্পনা জাতীয় মহৎ কিছু ছিল না, একান্তই ব্যবসায়িক বুদ্ধিজাত একপ্রকার দুরভিসন্ধিই বলা চলে (মেয়েদের যত কম পয়সায় গাধার খাটনি খাটানো যায় তত সহজে হয়ত ছেলেদের যায় না), কিন্তু তা সত্বেও এটা অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই যে এতে করে বড় একটা উপকার হয়েছে সমগ্র দেশটারই, -----মেয়েরা তাদের স্বাধিকার ও আত্মমর্যাদার দাবি প্রতিষ্ঠা করার মত মনোবল অর্জন করতে পেরেছে, আর্থিকভাবে কিঞ্চিৎ স্বাবলম্বীতা অর্জন করতে পেরেছেতার ফলপ্রসূতে তাদের পারিবারিক জীবনেও কিছুটা ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়েছে। গোয়ালের বন্ধ্যা গরুকে অগ্রাহ্য করা যায় সহজেই, কিন্তু দুধেল গাইকে উপেক্ষা করা যে বোকামি ছাড়া কিছু নয় সেটা গাঁয়ের মূর্খ চাষীও বোঝে। আর কিছু না হোক গ্রামের মেয়েদের ওই সম্মানটুকু অর্জিত হয়েছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করার ফলে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতির জন্য এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপটির প্রয়োজন অনস্বীকার্যসবই ঠিক ছিল, ঠিক ছিল না কেবল আমাদের পয়সাওয়ালা আর ক্ষমতাওয়ালা মানুষগুলোর মনমানসিকতা। এই যে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ঠেলা উপার্জিত ধনসম্পদ দিয়ে গোটা দেশের শরীরে বাড়তি মেদের সঞ্চার হয়ে গেল, এত যে উল্লম্ফ দম্ভ আর আত্মগরিমা জাতীয় নেতানেত্রীদের, তারা যে আসলে রক্তমাংসের মানুষ, তাদের অকথ্য শ্রমের যে একটা দাম আছে, উচিত মজুরিপ্রাপ্তির একটা স্বাভাবিক অধিকার আছে, এবং সেই মজুরিদানের একটা নৈতিক, সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব আছে কারখানার মালিকদের, সেই মৌলিক বিষয়টার প্রতি কারুরই মনোযোগ ছিল না, এবং এখনো নেই। বিদেশ থেকে বড় বড় বস্ত্রব্যবসায়ীরা আমাদের দেশগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় মূলত কি কারণে? বিশ্বমানবতার ‘মহান আদর্শে’ অনুপ্রাণিত হয়ে? মহাপ্রভু যীশুর আদর্শে ঈশ্বরসৃষ্ট সর্বমানবের প্রতি কৃপা ও করুণা বর্ষণের ব্রতে ব্রতী হয়ে? না, তাদের একমাত্র স্বার্থঃ আমাদের দেশের সস্তা, অতিসস্তা শ্রমমূল্য। Cheap labor. Dirt cheap. এই চীপের প্রতিযোগিতায় যেদেশ যত নিচে নামতে পারবে সেদেশই হবে তাদের পছন্দের দেশ। সেই পছন্দের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে চীন, যাকে ওই একনম্বর থেকে নিচে নামানোর সাধ্য বোধ হয় আপাতত অন্য কোন রাষ্ট্রের নাই। আমাদের দেশের জন্যে এটা কতটা গর্ব বা গৌরবের বিষয় জানিনা, তবে এই মুহূর্তে চীনের ঠিক পরেই আমাদের স্থান! খুশিতে বাগবাগ হবার কথা, তাই না? এই ‘ডার্ট চীপ’এর কথাটি আমাদের সমাজপতিরা জানেন, রাজনীতির হোমরা চোমরারা জানেন, বুদ্ধিজগতের রাঘববোয়ালেরাও যে জানেন না তা নয়। সবচেয়ে ভাল করে জানেন এদেশের নব্য পুঁজিবাদী সমাজটি----যারা হয়ত এক প্রজন্ম আগেও গইগ্রামের ধান আর মূলা ক্ষেতে লাঙ্গল টেনে কোনরকমে জীবিকা অর্জন করতেন। এই মুনাফাখোর সম্প্রদায়টির জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসিক মজুরির প্রতিটি পাইপয়সাও সোনার পাল্লাতে মাপার যোগ্য। শ্রমিকদের দাম যত কমবে তাদের আয়ের পরিমানও তত বাড়বে, ততই বাড়বে তাদের বিদেশী কোম্পানির অর্ডার। সেই ‘ডার্ট চীপ’এর মোহ কেবল কুবেরদেরই নয়, দেশের ইতরভদ্র শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেরই। ওই ধূলিলুণ্ঠিত শ্রমমূল্যের বরাতেই তো আমরা জোরগলায় ঘোষণা  করতে পারছি যে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার এশিয়ার প্রায় সকল দেশকেই হার মানাতে সক্ষম, এমনকি ইউরোপ-ক্যানাডা-অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে যখন প্রবল মন্দাভাব, তখনও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এঞ্জিন পূর্ণোদ্যোমে চলমান। এই আপাত সচ্ছলতার ছিটেফোঁটা দ্বারা কোন-না-কোনভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিকই উপকৃত হয়েছেন বলে আমার ধারণা। অতএব কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের অত মাথা ঘামানোর কি দরকার বলুন তো। সোজা কথা হল যে ওরা যত কম বেতন পাবে জাতির ততই লাভ! এই সমীকরণটির সরল যুক্তিটুকু কি আপনার মাথায় প্রবিষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয়? পাঠকের অবগতির জন্য বলে রাখা প্রয়োজন যে ওদের মাসিক বেতন ৩৮ থেকে ৪০ ডলারের মাঝে। এবং তাদের খাটতে হয় সপ্তাহে ৭০ থেকে ৮৪ ঘণ্টার মত। সপ্তাহে ৮৪ ঘন্টার ডিউটি আপনি কল্পনা করতে পারেন? তার মানে দৈনিক ১২ ঘন্টা----একে ক্রীতদাসের খাটুনি বলা কি অন্যায় হবে? দুই শতাব্দী আগে আমেরিকার কৃষ্ণাংগ ক্রীতদাসরা ঠিক অতখানি পরিশ্রম করতেন বলে মনে হয়না। কিন্তু আমাদের দেশের সেই বাদামি ক্রীতদাসেদের সেটা করতে হয় দুঃসহ দারিদ্র্যের পীড়ন থেকে নিষ্কৃতি লাভের দায়ে। ছেলেমেয়েগুলোর দুবেলা অন্নসংস্থানের দায়েওরা স্কুলকলেজে যেতে পারবে সেই আশাতে। শত হলেও গার্মেন্টস কর্মীদেরও অধিকার আছে ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্নের ইমারত রচনা করার। দিনের ঘর্মাক্ত শরীরের ক্লান্তি তাদের রাতের স্বপ্নটিকে সম্ভব করে দেয়।
শ্রমিকদের কর্মস্থলের দুরবস্থা নিয়ে অনেক জ্ঞানীগুণি ব্যক্তি অনেক অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন দেশে-বিদেশে সর্বত্র। আলোবাতাসহীন একটা অসহ্যরকম রুদ্ধ পরিবেশে তাদের একটানা পরিশ্রম  করতে হয় ম্যানেজারদের কড়া দৃষ্টির তাপের মাঝে,যাতে তারা একে অন্যের সঙ্গে গালগল্প করে একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করতে পারে। বিরাট কারখানার ভেতর তাদের আসন গ্রহণ করতে হয় অনেকটা ফার্মের গরুছাগল আর হাঁসমুরগির মত। এমন চাপাচাপি অবস্থান তাদের যে পা ধরে গেলে যে একটু আড়মোড়া দেবে তারও উপায় থাকে না। তার ওপর দরজা জানালা সব বন্ধ। বন্ধই নয় কেবল রীতিমত তালামারা। সেটা ওদের নিরাপত্তার জন্য নয়, মালিকের মনের শান্তির জন্যে। মালিকের ধারণা দরজা খোলা রাখলে শ্রমিকরা মাল চুরি করে পাচার করে দেবে তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে! মানে ওই ন্যুনতম বিশ্বাসটুকু নেই তাদের কর্মচারিদের ওপর। এর চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারেফলটা দাঁড়িয়েছে কি এই রুদ্ধ আবহাওয়ার? ঘন ঘন আগুণ লাগছে ফ্যাক্টরিগুলোতে, এবং তালা-মারা দরজার কারণে কোনও কর্মীই দৌড়ে বের হয়ে জান বাঁচাতে পারছে না। মোট ছয়টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সাম্প্রতিক কালের মধ্যে, এবং প্রতিটিতেই প্রচুর লোক প্রাণ হারিয়েছেন----প্রধানত সেখান থেকে বেরুতে না পারার কারণে। এই অকথ্য অবস্থাটি কি সংশোধন করা যেত না? অবশ্যই যেত---সেই প্রথম ঘটনাটির পরেই সরকার শক্ত হস্তে লাগাম ধরে নিতে পারতেন। কারখানা কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে পারতেন গার্ন্টেস কর্মীদের কর্মস্থানের আমূল সংস্কার সাধন করতে----কমপক্ষে যেন আগুণ লেগে গেলেও তারা প্রাণ বাঁচানোর জন্যে খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা হয়নিদেশের মুনিবরা দুচারটে লোকদেখানো বিবৃতি দিয়েই খালাশ। আর বিদেশী মুনিবরা তো দায়সারাভাবে একটি-দুটি ইন্সপেক্টার পাঠিয়ে কাগজেকলমে ‘উন্নতিসাধনের কতিপয় পদক্ষেপ’ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি পেয়েই তুষ্ট। তারপর হয়ত দুচারটে পলস্তারা হল এখানে ওখানে----ব্যস তাতেই সরকারি বড়সাহেবরা খুশি। তাছাড়া তাদের পকেটে মোটা অঙ্কের কিছু দক্ষিনা ঢোকাতে পারলে তাঁরা শব্দ করবেন কেন। অতএব আমাদের গার্মেন্টস কর্মীদের ভাগ্যে আগুণে পুড়ে মরার ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই অবস্থাটিকে বাংলাদেশ ক্রনিকলের এক কলামিস্ট (লেখাটিতে কি কারণে যেন তাঁর নামটি জানা গেল না) ‘মুনাফার সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করেছেন।
বর্তমান বিশ্বের অন্ধ, উন্মত্ত যান্ত্রিকতা, আর নগ্ন,অশ্লীল অর্থলোলুপতার আবহাওয়াতে হয়ত বিবেক, সুকোমল মানবিক বৃত্তি, শ্রমিকমজুরদের মৌলিক মানবাধিকার, এসমস্ত সূক্ষ্ম, প্রমিত শব্দগুলো একটু অবান্তরই শোনাবে, এমনকি খানিক হাস্যকরও, তবুও মানবজাতির অন্তিম অস্তিত্বের খাতিরেই ‘মনুষ্যত্ব’ যেহেতু একটি পূর্বশর্ত সেহেতু সেগুলো উল্লেখ না করেই বা উপায় কি। জানি, আজকের ঈশ্বর স্বর্গে বাস করেন না, করেন খাজাঞ্চির কোষাগারে, ব্যাঙ্কের গুপ্তকক্ষে, কুবেরের ব্যক্তিগত বাক্সের ভেতর----আজকের ঈশ্বরের আরেক নাম ‘ডলার’। সর্বশক্তিমান ডলার। এই ডলারের পূজাতে প্রকাশ্যভাবে নিবেদিত পশ্চিমের ‘পুঁজিবাদী’ দেশগুলি, আর আড়ালে আড়ালে নিবেদিত আমাদের প্রাচ্যের বিষয়বৈরাগ্যতার আত্মশ্লাঘাতে বিভোর জাতিসমূহ। এই আড়ালের মুখোশের ভেতর বেশ ভালভাবেই  ঢাকা ছিল আমাদের বাইরের চেহারাটি, যতদিন আমরা পরাধীন ছিলাম। এখন আমরা স্বাধীন, সুতরাং কোনও মুখোশ পরার প্রয়োজন নেই। যদিও এখনো আমাদের মাঝে এমন লোকের অভাব নেই যারা দুহাতে কুড়িয়ে যাচ্ছেন ‘পুঁজিবাদী পশ্চিমে’র প্রতিটি ধনধান্য মনিমুক্তো হীরাজহরত, কিন্তু মুখে তাদের জোরগলায় ঘোষিত হয়ে যাচ্ছে ‘সাম্যবাদ’এর জয়বার্তা। তবু বলতে হয়, পশ্চিমের ‘নগ্ন’ পুঁজিবাদেরও একটা ধর্ম বলে কথা আছে----তারা ছিঁচকে চুরিতে নেই, কয়েক হাজার টাকা পকেটে পুরে দিলেই তারা নিজেদের স্বজনদের বিকিয়ে দেবে না। কিন্তু আমাদের গরিব দেশের লোকজন হয়ত তা করবে। এমনকি আপন সন্তানকেও যে করতে পারে তার প্রমাণ তো অহরহই পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা জাত-পুঁজিবাদী নই, ছিঁচকে পুঁজিবাদী। সেই ছিঁচকে পুঁজিবাদই এখন সমগ্র বাংলাদেশকে গলাধকরণ করার উপক্রম।
আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের পাঁতি পুঁজিবাদীরা সেই ভুঁইফোঁড় হয়ে যাওয়া ধনকুবেরে পরিণত হয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করার অধিকার অর্জন করেছেন। তারা দুহাতে যেমন ডলার কামিয়ে যাচ্ছেন তেমনি জায়গাজমি করায়ত্ত করে ফেলছেন, ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক, যেখানেই হোক, খালবিল নদীনালা, ক্ষেতখামার, নিজ সম্পত্তি পরের সম্পত্তি কিছু আসে যায় না, আল্লার মাল সব এক। হালের যে চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো ঘটে চলছে তার মূল নায়ক হলেন সোহেল রানা নামক এক ৩৫ বছর বয়স্ক প্রাক্তন গুণ্ডাসর্দার---- এবং সরকারি দলের একজন বিশ্বস্ত বাহুবল, ইংরেজিতে যাদের বলা হয় এনফোর্সার। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ৩০শে এপ্রিল সংখ্যাতে জিম ইয়ার্ডলি নামক এক প্রতিবেদকের লেখাতে জানলাম যে এই মহাশয়ের কাজই ছিল গোটা অঞ্চলব্যাপী একটা ত্রাসের রাজ্য স্থাপন করে নেয়া, এবং এই মহৎ কর্মটিতে তার প্রধান সহায়ক ছিলেন একটি অনুগত ‘বাইকার গ্যাং’ ( সোজা বাংলায় মোটরসাইকেল আরোহী গুণ্ডাবাহিনী)। তার মুখের ওপর স্থানীয় কোনও গৃহস্থ বা চাষবাস করে সামান্য জীবিকা অর্জন করা নিরীহ চাষীর টুঁ শব্দটি করার সাহস ছিল না। এভাবেই তিনি সাভার অঞ্চলে বিস্তর জায়গাজমির মালিক হয়ে উঠেছিলেন। কেবল তিনি নয়, তার পিতারও একই সুনাম সেখানে। বাপ-বেটাতে মিলে যেন একটা ছোটখাটো মাফিয়া রচনা করে ফেলেছিলেন তারা। এমনই ক্ষমতাবান সেই মাফিয়া যে স্থানীয় অধিবাসীরা তো বটেই, নির্বাচিত সংসদ-সদস্যও নাকি তাদের আনুগত্য ও বশংবদতা সমর্পণ করে দিয়েছেন তার কাছে। প্রকৃতপক্ষে এই সাংসদটি নাকি ছিলেন রানা পরিবারের গডফাদার গোছের মানুষ। ফলে তাদের অঙ্গস্পর্শ করার শক্তি ইহসংসারে কারুরইও ছিল না, অন্তত এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর আগ পর্যন্ত। বাপ-বেটার সম্পত্তিগুলোর সবই নাকি বাহুশক্তি দ্বারা অর্জিত-----এলাকার পূর্ববর্তী মালিকদের কাছ থেকে গায়ের জোরে দখল করে নেয়া। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সেই প্রতিবেদন থেকেই পেলাম খবরটা। সেই মালিকরাই নাকি কেঁদেকেটে নালিশ করেছেন তাঁর কাছে। এবার বুঝুন। ভাবছেন তাদের শাস্তি হয়নি কেন? আপনার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ, নয় আপনি বাংলাদেশের রাজনীতি বা দুর্নীতির স্বরবর্ণও শেখেননি।
ভাল কথা, প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম। জোরজুলুম করে অন্যের জায়গাজমি দখল করে নেয়াই পুত্রধনের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়, তার বিশেষত্ব হল অন্যত্র। তিনি সরকারের পক্ষবিপক্ষ উভয়দলের কাছেই হরতালবিশেষজ্ঞ বলে বিশেষভাবে পরিচিত ও সম্মানিত। তিনি যখন সরকারি পক্ষের নিমক খেয়ে কাজে নামেন তখন তাঁর কাজ হল হরতাল ভাঙ্গা----অর্থাৎ হরতালকারিদের মাথা ফাটানোর ব্যবস্থা করা। আর যখন বিপক্ষ দলের ভাড়াটে গুণ্ডা হয়ে কর্মলিপ্ত হতে হয় তাকে তখন তার মত করে হরতাল পালন-কারি সমাগম আর কেউ দাঁড় করাতে পারেনা। তার সাম্প্রতিক পৃষ্ঠপোষক শুনেছি বর্তমান সরকারেরই আপন দলভুক্ত যুবলীগ। সুতরাং দুনিয়াতে কার সাধ্য আছে তাকে নিয়ে একটা কটুকথা উচ্চারণ করে, অবাধ্যতার তো প্রশ্নই উঠেনা। সাধে কি সোহেল রানা সগর্বে ঘোষণা করতে পেরেছিলেনঃ “ এই দালান আগামী একশ’ বছর খাড়া হয়ে থাকবে”। দালান বলতে ঠিক কোন দালানটির কথা তিনি বুঝাচ্ছিলেন সেটা বুঝতে পাঠকের নিশ্চয়ই খুব বেগ পেতে হয়নি। অথচ তিনি এবং তার সাঙ্গপাংগরা ছাড়া সংসারের আর সবাই জানত এ দালানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। প্রথমত একটা খাল ভরাট করে কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে একটা আটতলা দালান বানিয়ে ফেলা, তা’ও বেআইনিভাবে, কারণ সরকারি অনুমতি অনুযায়ীই ছয়তলা পর্যন্ত যাওয়ার কথা, তার বেশি এক তলাও যাওয়া যাবে না, কিন্তু সোহেল রানাকে ‘অনুমতি’ শেখাবে এমন বুকের পাটা কার। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটাই ‘বে-আইনি’,  সরকারের পোষা মাস্তান হওয়া সত্ত্বেও।
যেদিন ঘটনাটি ঘটে সেদিন ছিল বিরোধী দলের হরতাল। অতএব রানার কাজ ছিল হরতাল পণ্ড করে দেওয়া, অন্তত তার নিজের কর্মস্থলে। এদিকে তার আগের দিন স্থানীয় প্রকৌশলী রানাভবনের অবস্থা দেখে রীতিমত ঘাবড়ে গিয়েছিলেন-----বিরাট ফাটল ভবনের দেয়ালে। যে কোন মুহূর্তে ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা। তিনি সেটাকে ব্যবহারযোগ্য মনে করেননি। এবং সেমর্মে দালানের সব ভাড়াটেকেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। এক ভাড়াটে ছিল ব্রাকের একটি ব্যাঙ্ক। তার ম্যানেজার বুদ্ধিমানের মত তাঁর কর্মচারিদের নিষেধ করে দিয়েছিলেন কাজে যেতে। কিন্তু সোহেল রানা ওসব পরোয়া করার লোক নয়। তিনি এবং তার ম্যানেজাররা কর্মীদের বলে কয়ে ভয় ভীতি দেখিয়ে, একরকম জোরজবরদস্তি করেই পাঠিয়ে দেন দালানের ভেতর----দুতলা, তিনতলা, চারতলা, সব তলাতেই।  তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিপুল গর্জনধ্বনি সহকারে সমস্ত দালানটি বালুর ঢিবির মত ঝুর ঝুর করে ভূপতিত হয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত সোহেল রাজা নিজে এবং তার চেলাচামুণ্ডারা সেসময় দালানের ভেতরে থাকা সত্ত্বেও চট করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন----কারণ তাদের দরজা বন্ধ ছিল না, এবং তারা তখন কোম্পনির মিটিং করছিলেন নিচের তলার একটি ‘বোর্ডরুমে’ বসে। পুরো দালানটির সবচেয়ে খোলামেলা ও জাঁকজমকপূর্ণ স্থানই ছিল এই নিচের তলাটি। বোর্ডরুম শুধু নয়, আধুনিক পাশ্চাত্য জীবনের যাবতীয় আরাম আয়েশের সবরকম ব্যবস্থাই নাকি ছিল সেখানে। যথা বিলিয়ার্ড বল খেলার আয়োজন, মাদকদ্রব্য এবং নেশাকর দ্রব্যাদি নাকি বিস্তর মজুত ছিল সেখানে(এসব আমার শোনা কথা নয়, নিউ ইয়র্ক টাইমসের সেই নিবন্ধ থেকেই জানা।) সেখানে সোহেল রানা এবং তারই সমশ্রেণীর লোকজনের নিত্য আনাগোনা ও  আসর বৈঠক হত। সব ওই নিচের তলাটিতে।  যার সঙ্গে ওপরতলার নিম্নস্থানীয় বাসিন্দাদের কোন সম্পর্কই ছিল না, এক মালিক-মজুর সম্পর্ক ব্যতিরেকে। ওপরের ওই সাতটি ঘিঞ্জি তলাতে অবস্থিত ছিল একাধিক ব্যবসাসংস্থান, এবং সর্বমোট পাঁচটি মার্মেন্টস কারখানা। রানা ভবনের শান শওকত যে কোন মার্গে অবস্থিত ছিল এ থেকে নিশ্চয়ই তা অনুমান করা যায়।
৩রা মে পর্যন্ত ৫০০ মত লোক মারা গেছে এই দালানধ্বসা ঘটনাতে। আজ সকালে, অর্থাৎ ৫ই মে, শুনলাম সংখ্যাটি ৬০০ অতিক্রম করেছে। সম্ভবত আরো বাড়বে। এ যে কত বড় ট্র্যাজেডি সেটা পুরোপুরি অনুধাবন করবার শক্তিটাও আমাদের এই জাতিটার আর আছে বলে মনে হয় না। দুঃখ সয়ে সয়ে এমন হয়ে গেছে যে দুঃখকে আর দুঃখ বলে মনেই হয়না যেন। আমরা তো এমনিতেই অদৃষ্টবাদী জাতি, ‘আল্লা যা করেন সব ভালর জন্যই করেন’ মন্ত্রতে গভীরভাবে বিশ্বাসী, যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে আমরা জাতিহিসেবে নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা ও অধিকারের ওপর বিন্দুমাত্র আস্থা স্থাপন করিনা, ব্যক্তিহিসেবে তো একেবারেই না। তাই আমাদের ভাগ্য সবসময়ই নির্ধারিত হয় এইসব সোহেল রানা জাতীয় ব্যক্তিদের দ্বারা, নির্ধারিত হয় সমাজের ওইসব ছায়াবাসী ব্যক্তিবর্গ দ্বারা। ওরা আমাদের নিয়ন্ত্রিত করে কারণ আমরা তাদের হাতে সেই ক্ষমতাটি, অজান্তে অজ্ঞানে, কখনোবা সজ্ঞানেই, তুলে দিই। সংসারে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কোনদিন গাড়ি চালাতে শেখেনি। শেখেনি কারণ তাদের মরণভয় গাড়ির চাকা হাতে নিতে, পাছে না গাড়ি চলতে শুরু করে। আমরা, এই বাংলাদেশী জাতি, সেই চাকাভীতিসম্পন্ন দুর্বলমনা জাতি।
আজ সকালে আরো শুনলাম এক ভদ্রলোক নিজের কানে শুনেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের এক প্রবীণ ও প্রবল ক্ষমতাশীল মন্ত্রী বিবিসি’র এক সাক্ষাৎকারে বলেছেনঃ ‘সাভারের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মত ঘটনা ঘটেই থাকে! পৃথিবীর যে কোন দেশে, আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের মত বড় মাপের শিল্প উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানে, ৫০০ লোকের মৃত্যু কোনও দুর্ঘটনাতে, এমন কোনও বড় ঘটনা নয়’। অতএব, সহৃদয় পাঠকবন্ধুরা, সাভারের এই ‘দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাতে’ ৫০০ কি ৬০০ লোক মারা গেছে তাতে কি হয়েছে? এরকম হয়েই থাকে। আমাদের বড় মুরুব্বিরাই বলছেন। তাঁর ওই মূল্যবান সাক্ষাৎকারের পর আপনি-আমি, আমজনতা, কি ভাবলাম, কতটা ভূকম্পসৃষ্টিকারি ঘটনা বলে আখ্যায়িত করলাম সাভারকে, তাতে সংসারে কারো কিছু আসে যায় না। এদেশের বিনোদনবাণিজ্যে একটা প্রচলিত বয়ান আছেঃ দ্য শো মাস্ট গো অন্‌। দুনিয়া বরবাদ হয়ে যাক, তামশা চলবে বরাবরের মত।  রানা ভবনের কারখানাগুলো কতদিন বন্ধ থাকবে বলে মনে হয় আপনার? যতদিন আপনি আমি রাস্তায় নেমে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব, আর সেই ফাঁকে শিল্পপতিরা গোপনে গোপনে তাদের মালপত্র সরাতে পারছেন অন্য কোনও ‘রানাভবনে’,  ঠিক ততদিন। তারপর আপনি আমি যে যার গতানুগতিক জীবনে ফিরে যাব, রাগ পড়ে যাবে আল্লারসূলের বাণীতে আস্বস্ত হয়ে, লাশগুলো সব চলে যাবে মাটির নিচে, স্বজনদের আহাজারি বন্ধ হয়ে উনুনে আবার আগুণ ধরানো হবে, তখন আবার সেই চক্র একই গতিতে চলমান হতে থাকবে, তখন আবার সেই একই মেয়েগুলি, বা ঠিক তাদেরই মত দেখতে মেয়েগুলি, ওই নতুন ভবনের দরজা দিয়ে ঢুকবে দুবেলা অন্ন এবং অদূর ভবিষ্যতের ধ্বসন বা দহনের প্রায়-নিশ্চিত সম্ভাবনাতে। একেই ওরা বলে নিয়তি, গরিবের অন্ধ, অনিবার্য এবং অপ্রতিরোধ্য অদৃষ্ট। অদৃষ্টের ওপর অটল বিশ্বাসই তাদের জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা।

এমুহূর্তে আপনি আমি দুজন ঠিক একই জিনিস কামনা করি----প্রতিশোধ।  জানের বদলে জান----আমরা চাই সোহেল রানার ফাঁসি। সম্ভব হলে,হাতের কাছে পেলে জনগণ তাকে আস্ত পুঁতে ফেলত মাটিতে। ছিন্নভিন্ন করে ফেলত তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যংগ। কিন্তু তারপর? ঠিক আছে, সেটা হয়নি, ভাগ্য ভাল যে সেটা হয়নি, সোহেল রানারা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেললেও সাধারণ মানুষ যেন কখনো তা হারাতে না দেয়----তাহলে আমাদের কিছুই থাকবে না বাইরের জগতকে দেবার মত। যে জাতি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে তারা সভ্যতার পরিবার থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তারাই তখন সত্যিকার ‘সর্বহারা’ জাতিতে পরিণত হয়অনেকটা সেকারণেই আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতি নই-----আসলে মৃত্যুদণ্ড দ্বারা উপকার একমাত্র অপরাধীরই হয়, আর কারো হয়না। তার জীবন এক ফুৎকারেই শেষ হয়ে যায়, সারাজীবন জেলখানার নিরালা ঘরের অন্ধকার একাকিত্বের মধ্যে ধুকে ধুকে, তিলে তিলে মরতে হয়না। বর্তমান যুগে পৃথিবীর প্রায় সবগুলো উন্নত রাষ্ট্রেই মৃত্যদণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তাতে কি অপরাধ বেড়েছে? মোটেও না। কমেছে হয়ত কিছুটা, দণ্ড লাঘবের কারণে নয়, উন্নততর আইনশৃংখলা  প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে। অতএব আমাদের এই রানা সাহেবের একটা সমুচিত শাস্তি হওয়া দরকার। দেশের অন্য সবাই হয়ত চাইবে মৃত্যুদণ্ড, সেটা স্বাভাবিক, তবে আমি চাইব যাবজ্জীবন, যার শর্ত হবে কখনোই জেলখানার বাইরে যেন তাকে পা ফেলতে না দেওয়া হয়।
বড় প্রশ্ন হল, এই “সমুচিত” শাস্তিগুলোর কোনটাই পেতে হবে কিনা লোকটার। নাজমুস সাকিব সাহেব তাঁর নিবন্ধে যথেষ্ঠ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তাতে, এবং আমি তাঁর সঙ্গে একমত। তাঁর যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্পেক্ট্রাম আর তাজরিন ফ্যাক্টরিতে আগুণ লেগে অনেক হতাহত হবার পরও অপরাধীদের বিচারকের সামনে দাঁড় করাতে সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা। আরো দুটি উদাহরণ দিয়েছেন তিনিঃ এডভোকেট নুরুল ইসলামের নৃশংস হত্যা। নাটোরের বি এন পি নেতা সানাউল্লা নূর বাবুকে প্রকাশ্য দিবালোকে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনী দ্বারা অনুরূপ হত্যা। দ্বিতীয় ঘটনাটির পর পর প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপরাধীদের কঠোর শাস্তিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ জাতিকে। সেই প্রতিশ্রুতি এখনো কার্যে পরিণত হবার অপেক্ষায়। একদিকে আছে দেশের আইনশৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত পুলিশ-বাহিনীর অবিশ্বাস্য অক্ষমতা ও অযোগ্যতা (দুর্নীতির কথা নাহয় বাদই দিলাম কারণ দুর্নীতি এমনই একটা বিষয় যাতে সরকারের এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগের ব্যবধান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর), তদোপরি আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ওদিকে আমাদের বিরোধীদল ভাবলেন এসুযোগে একটু রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের ব্যবস্থা করা যাক। রানা ভবনের  দুর্ঘটনার পর বিরোধীদলের নেত্রী ঘোষণা করলেন যে তাঁর দলের পক্ষ থেকে ২০ লাখ টাকা দান করা হবে নিহতদের শোকার্ত পরিবারদের। অথচ তাঁদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকাকালে স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টস ভবন ধ্বসে পড়ার ফলে বেশ কিছু কর্মী যখন  প্রাণ হারায় তখন এই বদান্যতাটুকু তাঁর মনে উদয় হয়নি কেন সে প্রশ্ন নিপুনভাবে উত্থাপন করেছেন সাকিব সাহেব।
রাজনৈতিক বৈকল্য ও চরম অথর্বতা। এই একটি জায়গাটিতে আমরা সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বের যে কোন জাতির সমকক্ষ, এমনকি ল্যাটিন আমেরিকার ওই সব কুখ্যাত স্বৈরাচারি সরকারগুলোর সাথেও তুলনীয়। শোনা যায় যে দেশের ছোটবড় প্রায় সব নেতারই একটা গুপ্ত মাস্তানবাহিনী আছে, অনেকটা পুরনোদিনের জমিদারদের যেমন থাকত আস্তাবলের লাঠিয়াল বাহিনী (প্রজাদের খাজনা বা অন্য যে কোন সমস্যার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই আস্তাবলের গেট খুলে দেওয়া হত----সঙ্গে সঙ্গে লাঠিয়ালরা হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ত প্রজাদের ওপর।)  বাংলাদেশের এই এনফোর্সারদেরও প্রায় একই ভূমিকা ওপরতলার রাজনৈতিক অঙ্গনে। সেকারণেই বড়রকমের কোন অপরাধ ঘটে গেলে তাদের হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু হাজত থেকে বিচারালয় আর জেলখানার অনেক দূরত্ব। দুবছর আগে আমি যখন দেশে গেলাম কয়েক সপ্তাহের জন্যে তখন পত্রিকায় গরম খবর বেরুল একদিন যে এক সাংবাদিক দম্পতি---রুনা-সাগর, অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছেন তাদের শিশুসন্তানের সামনে। পরের দিন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোরগলায় ঘোষণা করলেন যে এক সপ্তাহের মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করে “দৃষ্টান্তমূলক” শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা হবে। (“দৃষ্টান্তমূলক” শব্দদুটি নিশ্চয়ই আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের ভীষণ প্রিয়।  কতবার যে শুনেছি কথাটা!) দৃষ্টান্ত বলতে কি বুঝায় সেটা জনগণ মোটামুটি বুঝে ফেলেছে। শুনেছি রুনা-সাগরের অপরাধী বা অপরাধীদের শাস্তি দূরে থাক, তারা কারা সেটাই কেউ জানল না এখনোএই “দৃষ্টান্ত” আমাদের সব নেতাই সমান দক্ষতার সঙ্গে স্থাপন করেছেন। অতএব সোহেল রানার হাতে যারা হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নিয়ে গেলেন, হয়ত তাঁরাই পরে হাজতের নিরালাতে, ওপরতলা থেকে টেলিফোন পাওয়ার পর, রানাসাহেবের কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন অনিচ্ছাকৃত “বেয়াদপী”র জন্যেব্যক্তিগতভাবে আমি খুব একটা আশ্চর্য হব না যদি অদূর ভবিষ্যতে সাহেবের মুখ দেখতে পাওয়া যায় টরন্টো বা ভ্যাঙ্কুভার-মন্ট্রিয়ল-অটোয়ার কোনও বনেদী পাড়ার নতুন বাসিন্দা হিসেবে। গুরুতর অপরাধের গুরুতর শাস্তির ভয় থেকে পলাতক এমন স্বদেশী ভাইব্রাদারের সংখ্যা নেহাৎ কম নয় ক্যানাডাতে।
এবিষয়ে কারো কোনও দ্বিমতের অবকাশ নেই যে আমাদের বস্ত্রশিল্প এমুহূর্তে জাতির অর্থনীতিখাতের মেরুদণ্ডএর সামান্যতম দুর্বলীকরণ মানে গোটা জাতিরই একটা পশ্চাদমুখি পদক্ষেপ। সৌভাগ্যবশত বিদেশী কোম্পানিগুলো আপাতত কোনও বিরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি (অন্তত ব্যাপকভাবে নয়, ডিজনীল্যাণ্ডই একমাত্র ব্যতিক্রম বলে মনে হয়) যাতে করে শ্রমিকদের জীবকা অর্জনের পথে কোনরকম বাধাসৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতে যে তারা নেবে না তারই কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? বাংলাদেশের অর্থনীতি আর গরিব শ্রমিকদের জীবিকা নিয়ে তাদের উদ্বেগ-আবেগের ওপর নির্ভর করে না সে সিদ্ধান্ত, করে তাদের তৈরি পোশাকের বিদেশী ক্রেতাদের মেজাজের ওপর। ক্রেতারা যদি বেঁকে বসেন যে, না, ঐ দেশের কোন কাপড় আমরা আর কিনব না, যত সস্তাই হোক সে-কাপড়, তাহলে কোম্পানির মালিকদের দয়ামায়াও শুকিয়ে যাবে তৎক্ষণাৎ। সেই যে বললাম, মূল ব্যাপারটা হল ডলার----মুনাফা, দরদী হৃদয়ের করুণারস নয়। সে সম্ভাবনা যে খুব নগণ্য নয় তার প্রমাণ তো এই দফাতেই পাওয়া গেল। টরন্টোর বাজারের কোন কোন ক্রেতা তো রীতিমত প্রতিজ্ঞা করে বসেছেন যে তারা জো ফ্রেশ’এর দোকান থেকে কোন বাংলাদেশে-তৈরি কাপড় কিনবেন না। ভাগ্যক্রমে সেই মনোভাবটি বেশিদূর ছড়ায় নি। এযাত্রা হয়ত আমরা অল্পতেই বেঁচে গেলাম, কিন্তু পরের বার ভাগ্যলক্ষী ততটা প্রসন্ন না’ও হতে পারেন। গোড়ার কথাটা এই দাঁড়ায় যে আমাদের দেশটি রপ্তানিযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে তেমন সবল নয় বলে আমাদের নির্ভর করতে হয় ‘সস্তা শ্রমমূল্যের’ ওপর। সম্পদবহুল দেশগুলো বিক্রি করে স্বদেশের সম্পদ দিয়ে উৎপন্ন দ্রব্যাদি, আর আমরা বিক্রি করি সস্তা শ্রম! হুমায়ুন আজাদের ভাষায় ‘কামলা’। এতে করে বিশ্বদরবারে জাতির মানমর্যাদা যে দারুণভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না, নেতানেত্রীদের বিবৃতিতে যতই বড়াই করা হোক না কেন, সেটা বোধ হয় খুব দুর্বোধ্য কিছু নয়।
অথচ দেখুন বাংলাদেশ কিন্তু একমাত্র স্বল্পসম্পদ জাতি নয় বর্তমান বিশ্বে। আরো অনেক প্রায়-সম্পদহীন দেশ আছে জগতে। আসলে অঢেল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পপদ থাকাটা যে সবসময় বড় একটা আশীর্বাদ জাতির জন্য তা কিন্তু নয়। অনেকসময় আশীর্বাদ না হয়ে হয়েছে তার উল্টো----অভিশাপ। পশ্চিম আফ্রিকার হীরকবহুল দেশক’টি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ-----প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে দেশগুলি সেই সম্পদের ভোগদখল নিয়ে মারামারি কাড়াকাড়ি আর খুনোখুনির ফলে। ওগুলো প্রায় বাসযোগ্যতার বাইরে চলে গেছে। এই অভিশাপটার কথা মনে রেখেই ভেনেজুয়েলার এক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ওয়ান পাব্লো পেরেজ আলফনসো, ভেনেজুয়েলার তেলসম্পদ প্রসঙ্গে বলেছিলেনঃ “10 years from now, 20 years from now, oil will bring misery. Oil is Devil’s excrement”. (আজ থেকে ১০ বছর, বা ২০ বছর পর, তেল আমাদের কপালে দুঃখ আনবে। তেল হল শয়তানের বিষ্ঠা।)
পূর্ব এশিয়ার চারটি দেশ প্রায় সম্পদহীনঃ সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, হং কং (জাপানের কথা নাহয় বাদই দিলাম)। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকাটাই যেন একরকম আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতি তাদের প্রচুর দেয়নি বলে তাদের নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়েই সম্পদ বের করতে হয়েছে। তাদের তেল বা খনিজ দ্রব্যের বদলে আছে উচ্চমানের শিক্ষা, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা, যাতে করে তারা তৈরি করে নিতে পেরেছে বিপুল একটা সৃষ্টিশীল, নিত্যনতুন পণ্য উৎপাদনক্ষম, মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তারা বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে পশ্চিমের যে কোন উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দেবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা আন্তর্জাতিক মেধা প্রতিযোগিতায় অনেক সময় বিলেত আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে যায়-----সিংগাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বিশ্বজরিপে প্রথম বিশটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে নিজের স্থানটি একরকম কায়েম করে নিয়েছে বলেই মনে হয়। জাপানের কথা তো বলাই বাহুল্য। সেতুলনায়, আমাদের ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে যাকে নিয়ে আমরা লোকের কাছে বুক ফুলিয়ে অহঙ্কার করার চেষ্টা করি, সেই অতিপ্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঐ জরিপের প্রথম দশপাতার কোথাও খুঁজে পাবেন না----একটা জরিপে দেখেছিলাম একেবারে চারহাজারের নিচে। এতেই খানিকটা অনুমান করা যায় দেশের আভ্যন্তরীন অবস্থা কতটা শোচনীয় মাত্রায় পৌঁছে গেছে। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানে দ্রুত উন্নতি সাধন করার ফলে আজ সম্পদবিহীন দেশ তাইওয়ান আর দক্ষিণ কোরিয়া উভয়ই বিশ্বের সেরা আন্তর্জাল পণ্য উৎপাদনকারি শক্তিসমূহের প্রথম সারিতে অবস্থিত। ওদিকে ক্ষুদ্র দেশ সিঙ্গাপুর আর হং কং, দুটিকেই পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ফিনান্সিয়েল কেন্দ্র বলে গণ্য করা হয়। কই, তাদের দেশে তো বড়রকমের কোন সমস্যার কথা কেউ শোনেনি কখনোতাদের দেশে তো সপ্তাহে দুদিন বন্ধ থাকে না কোন-না-কোনও দলের হরতালের কারণে। তাদের দেশে তো স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা কথায় কথায় ধর্মঘট করে না, পরীক্ষা পেছানোর দাবি করে না, শিক্ষাঙ্গনে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে না। তারা যা অর্জন করেছে জাতীয়ভাব, সব বুদ্ধি ও মেধার জোরে, আর আমরা যা হারিয়েছি তার বেশির ভাগই ওই বুদ্ধিরই অপব্যবহার বা সম্পূর্ণ শূন্যতারই কারণে।
সাভার দুর্ঘটনার পরপর একটা গুজব বেরুল এই মর্মে যে রানা ভবন ধ্বসে পড়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে প্রস্তাব করেছেন দেশের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুণধর মহিউদ্দিন খান আলমগীরঃ বি এন পি’র হরতালকারিরা সরকারকে বিব্রত করার মতলবে দালানের দেয়ালে জোরে “নাড়াচাড়া” দিয়েছিল বলেই সেটা ধ্বসে পড়েছিল। একজন শিক্ষিত মন্ত্রী যে এধরণের কথা বলতে পারে সেটিই আশ্চর্য। কথাটা যে নেহাৎ গুজব নয়, তার প্রমাণ এটা একাধিক জায়গায় দেখেছি আমি। শেষ দেখাটা দেখলাম নাজমুস সাকিবের লেখাতে। তাঁর সুলিখিত নিবন্ধটির উপসংহারে তিনি এক অজ্ঞাতনামা ফেসবুক মন্তব্যকারের অতি ক্লান্ত, নৈরাশ্যজড়িত,  উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেনঃ “ We have a home minister who is capable of protecting his party at the cost of innocent lives, we have a Prime Minister who wants to stay in power at any cost, we have an opposition leader who hardly does any movement for the people, we have a Nobel laureate who always keeps mum on any national issue, and we are the innocent people who are destined to tolerate like this! When the culture of impunity becomes the order of the day and the opposition party and government, both lose their credibility, how can you expect peace and sanity in the society?”
জাতির বর্তমান মনের অবস্থাটি কোথায় নেমেছে তার পুরো ছবিটাই ফুটে উঠেছে এই ক’টি বাক্যতে।

আজকের এই লেখাটিতে দেশ নিয়ে এতগুলো নেতিবাচক কথা লিখতে হল আমাকে, বিশ্বাস করুণ, তার কোনটাই আমি খুশিমনে লিখিনি----লিখতে চাইনি এর একটিও। আমি বরং লিখতে চেয়েছিলাম আমাদের কৃতী মানুষগুলোর কথা, যারা দেশবিদেশে নিজেদের এবং দেশবাসী সকলের সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। যাঁরা তাদের কাজ দিয়ে, অপরিমেয় সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়ে, প্রভূত সাধুবাদ কুড়িয়েছেন সর্বত্র, সর্বনন্দিত হয়ে উঠেছেন সুধীমহলে। আমার পাঠককে আমি শোনাতে চাই এই স্বনামধন্য মানুষগুলোর গল্প-----যা দেশের সাধারণ লোকেদের জানা দরকার। বিশেষ করে জানা দরকার স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর, যাতে করে তারা ওঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে, তাদের মনে রচনা করতে আদর্শ পুরুষ বা আদর্শ নারীর ছবি যা তাদের পড়ার টেবিলে দাঁড় করিয়ে বুনে যেতে পারে নিজেদেরই স্বপ্নের ভুবন।
আজ কেবল কয়েকটি নাম উল্লেখ করেই আমি বিদায় নেব।
১। এফ আর খান (১৯২৯-১৯৮২) ঃ বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি। ‘টিউবুলার ডিজাইন’ নামক প্রকৌশল শাস্ত্রের একটি বিশেষ শাখার জনক গণ্য করা হয় তাঁকে। আমেরিকার শিকাগো শহরে তাঁর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে (ভাল কথা, ঢাকায় কি সেরকম কোনও রাস্তা আছে তাঁর নামে?)। শিকাগোর জন হ্যানকক সেন্টারের উইলস টাওয়ারের স্থাপত্য কাজের জন্যই তিনি বিশেষ সুনাম অর্জন করেন যুক্তরাষ্ট্রে। পরবর্তীতে তিনি সৌদি আরবের হজ টার্মনাল নির্মাণের ডিজাইন করেন। কোন কোন মহলে তাঁকে স্ট্রাকচারেল ডিজাইনের আইন্সটাইন বলে গণ্য করা হয়।
২। মোহম্মদ আতাউল করিমঃ ফলিত আলোকবিদ্যা (Applied Optics) তে বিশ্বের সেরা ৫০ জন গবেষকের মাঝে অন্যতম বলে গণ্য করা হয় তাঁকে, অন্তত গত ৫০ বছরের ইতিহাসে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৬ টি বিজ্ঞান বিষয়ক পরিষদে তিনি নির্বাচিত সদস্য হিসেবে সম্মানিত।
৩। জাভেদ করিমঃ ‘ইউটিউব’এর যুগ্ম উদ্ভাবক।
৪। জামাল নজরুল ইসলাম (১৯৩৯-২০১৩)ঃ  অসাধারণ মেধাবী এক গাণিতিক ও পরমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানীকেম্ব্রিজের বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিভেন হকিং তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুদের অন্যতম। মহাবিশ্বের নানা রহস্যবিষয়ে তাঁর রচিত মৌলিক গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থাবলী দেশবিদেশের বিভিন্ন ভাষাতে অনূদিত হয়েছে। এ-লোকটার কীর্তির শেষ নেই। তিনি সারাজীবন পশ্চিম বিশ্বের যে কোন সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি উচ্চ সম্মানের আসন দখল করে পারতেন। হয়ত বিরাট কোনও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও পেয়ে যেতেন একদিন। কিন্তু তার বদলে তিনি দেশের সেবাতেই অতবাহিত করে দিলেন সারাটি জীবন। তাঁর কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
৫। এ কে এম ফজলে হুসেনঃ অতি উচ্চমানের প্রকৌশলী, যার বিশেষত্ব হল জলবলবিদ্যা ও টার্বুলেন্স। এর ওপর তাঁর অনেক মৌলিক কাজ তাঁকে বিশেষভাবে পরিচিত ও সম্মানিত করেছে তাঁর নিজের পেশাতে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের “ Culler Distinguished Professor of Mechanical Engineering, Physics, and Earth and Atmospheric Sciences.” তদুপরি তিনি সেখানকার ইন্সটিটিউট অব ফ্লুইড মেকানিক্স এণ্ড টার্বুলেন্সে’এর সর্বাধিনায়ক।
৬। অমিত চাকমাঃ ক্যানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ণ অন্টারিও’র দশম উপাচার্য।
৭। স্যার ফাজলে হুসেন আবেদঃ বিশ্বের বৃহত্তম এন জি ও ‘ব্রাক’ এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা।
৮। আইরিন খানঃ এমনেস্টি ইন্টার্ন্যাশনাল’এর প্রথম মহিলা ও প্রথম মুসলিম সেক্রেটারি জেনারেল।
৯। মুসা ইব্রাহিমঃ প্রথম বাংলাদেশী যিনি স্বদেশের লাল-সবুজ পতাকা সগর্বে উত্তোলন করতে পেরেছিলেন এভারেস্ট চূড়াতে ২০১০ সালের ২৩শে মে। পরে তিনি দুর্গম কিলিমাঞ্জোরো পর্বতও আরোহণ করেছিলেন। তাঁকে নিয়ে কি আমরা গর্বে বুক ফুলাতে পারি না?
১০। সালমান খানঃ “খান একাডেমি”র প্রসিদ্ধ সালমান খান। খান একাডেমি এখন বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারি তরুণ প্রজন্মের কাছে একটি অতি পরিচিত ও সুপ্রিয়, গণিতশিক্ষার ব্যক্তিত্বতাঁর শিক্ষাপদ্ধতি এতই নাম করে ফেলেছে বিদেশে যে মাইক্রোসফট কোম্পানির বিল গেইটস স্বয়ং সালমান খানের শিক্ষ পদ্ধতির ভক্ত হয়ে উঠেছেন। ছোটদের গণিতভীতি দূর করাতে তাঁর পদ্ধতির মত কার্যকরি পন্থা এযাবত কেউই বের করতে পারেনি।
 এই লোকটার নাম কি আমার দেশের লোকেরা জানে? নাকি জানেন আমাদের গণ্যমান্য নেতানেত্রীরা??
১১। আকরাম খানঃ বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। উপমহাদেশের নামকরা শিল্পী যত ছিলেন অতীতে, এবং যত আছেন বর্তমানে, তাঁদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে এই লোকটার নাম। তিনি দেশবিদেশের প্রায় প্রতিটি মুখ্য শিল্পকলা ভবনে অনুষ্ঠান করেছেন। তাঁর জন্মবৃদ্ধি সবই লণ্ডনে, কিন্তু তাঁর বাবামা দুজনেরই জন্ম বাংলাদেশে, এবং তিনি বাংলা বলেন স্বচ্ছন্দে। তাঁর নতুন অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে মাঝে মাঝে রাণী এলিজাবেথও উপস্থিত থাকেন। তাঁর নাচের অভিনবত্ব ও আধুনিক-ধ্রুপদী মিশ্রিত ধারার আবেদন পূর্ব-পশ্চিম উভয় বিশ্বেরই বোদ্ধা শ্রোতা-দর্শকদের  ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। লণ্ডনের বিখ্যাত টাইমস, নিউ ইয়র্কের নিউ ইয়র্ক টাইমস, এসব মানিদামি পত্রিকায় তাঁর নাচের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আমি নিজেই পড়েছি।
তাঁর নামটিই কি আমাদের কারো জানা ছিল?

অটোয়া
রচনাকালঃ ৩-৭ই মে, ২০১৩
মুক্তিসন ৪২

মীজান রহমান

No comments:

Post a Comment