Friday, 31 May 2013

পূজারী

মীজান রহমান
আপনি কি রক্ষক, না ভক্ষক? শিকার, না শিকারী? পূজ্য, না পূজারী? নাকি এর কোনটাই নন? জানি,আপনি কোনও খোপে থাকার পক্ষপাতী ননআমিও নই। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন, আপনি-আমি দুজনই আসলে খোপের ভেতরই বাস করছি। সদাসর্বদাই। সেটা স্বীকার করতেই রাজি নই, এই যা। 

মোটা দাগের হিসাবে গোটা মানবজাতিকে আমি চারভাগে ভাগ করি। একঃ পূজ্য (সত্যিকারের মহামানব যাঁরা, একেবারে শীর্ষস্থানে যাঁদের অবস্থান, তা জ্ঞানবিজ্ঞানেই হোক, আর অপার্থিব ধ্যানমগ্নতাতেই হোক)
দুইঃ পূজারী (যাদের সারাটি জীবন নিবেদিত এবং অতিবাহিত হয় কোন-না-কোনও ব্যক্তি বা তাঁর কল্পিত অথবা বাস্তব মূর্তির পূজা-অর্চনাতে, যদিও তাদের বিশ্বাসের জগতে সেই মূর্তিটি কোনও বিশেষ ব্যক্তির নয়,
বরং কোনও বিশেষ অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার, যার অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ নেই)তিনঃ শিকারী (এঁরা পূজ্য আর
পূজারীর মধ্যিখানে সুবিধামত  একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে বেশ দুপয়সা কামিয়ে
 নেন, এবং বংশানুক্রমে এটিই তাদের জীবিকাতে পরিণত হয়)। চারঃ সংশয়ী ( এঁদের স্বভাবটাই এমন যে
সংসারের কোনও প্রচলিত প্রথাকে বিনাপ্রশ্নে গ্রহণ করে নিতে রাজি নন। লোকালয়ের নিরাপদ আঙ্গিনার
 চাইতে বরং প্রাকারবহির্ভূত নিষেধের রাজ্যে দারুণ বিপদসঙ্কুল পরিবেশে বিচরণ করতেই বেশি পছন্দ করেন)।


পৃথিবীর ৭০০ কোটি লোকের মাঝে ৬৫০ কোটিই ‘পূজারী’ দলভুক্ত হবেন বলে আমার অনুমান। বাকি
পঞ্চাশ কোটির অর্ধেক হয়ত শিকারী জাতির অন্তর্গত------পৃথিবীর যাবতীয় অশান্তির মূলে তো তাঁরাই
বাকি থাকল ২৫ কোটি। তার মাঝে মহামানবদের সংখ্যা কিরকম হবে বলে মনে হয় আপনার? বড়জোর
এককোটি? সম্ভবত তারও কম। এই যে অবশিষ্ট ২৪ কোটি মানুষ, এদেরই আমি বলি ‘সংশয়ী’। যাদের
মাঝে আছেন উঁচুমানের বিজ্ঞানীরা, যাঁরা কেবল পেশাতেই নয়, চিন্তাচেতনাতেও বিজ্ঞানী। অর্থাৎ তাঁরা
বিজ্ঞানী  ও বিজ্ঞানমনস্ক। (দুটির সূক্ষ্ম তফাৎটুকু পাঠককে খোলশা করে বলার দরকার আছে কি?)। তাঁদের
মাঝে আছেন দার্শনিকরা, আছেন অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-ভাস্কর-স্থপতি-প্রকৌশলী, আর শিক্ষক
-অধ্যাপক। আছেন সংশয়বিদ্ধ সাধারণ কেরাণী, মজুর, কৃষক, ছাত্র-ছাত্রী, রাজনীতিবিদ, এমনকি উন্নয়ন-
শীল বিশ্বের সর্বজননিন্দিত ও কদাচিৎনন্দিত ‘নাস্তিক ব্লগারগণ’। এঁরা আছেন বলেই সভ্যতার চাকা এখনো
থেমে নেই, এখনও ভাবনার জগতে নিত্যনতুন শুক্তি সংগৃহীত হয়ে চলেছে, গড়ে উঠছে বিপুলকায় সব
সৌধমালা, আগামী প্রজন্মের জন্যে নির্মিত হয়ে চলেছে মহাবিশ্বের সীমানাহীন দিগন্তএ কাজগুলো
করার ক্ষমতা নেই পূজারীদের। তাঁরা কেবল মূর্তিই রচনা করেন। ওদিকে শিকারীরা কেবল পূজারীদের পকেট
 শূন্য করাতেই ব্যস্ত, আর পূজ্যরা কেবল পর্বতশৃঙ্গেতে আসন গ্রহণ করে চক্ষুমুদ্রিত অবস্থাতে ধ্যানমগ্ন হয়ে
 থাকেন। কেবল সংশয়ীরাই আছেন সদাজাগ্রত। তারা সমাজের সকল বাধার দেয়াল অতিক্রম করে
 মানবজাতির সম্মুখগতিটিকে অব্যাহত রাখার চেষ্টায় সমর্পিত করে দেন নিজেদের জীবনকে।

পাঠক হয়ত ঠোঁট বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাইবেনঃ “আপনি মশাই নিজেকে কোন্‌ কাতারে ফেলছেন?
প্রথমটি, নাহয় শেষেরটি নিশ্চয়ই?”
না, দুয়ের কোনটাই নয়। আমি কোন্‌ দলের তার বিচার আমার নয়। সে-ক্ষমতাই আমার নেই। সে ক্ষমতা
আপনার। আমাকে যারা চেনে তারাই হোক আমার বিচারক----যেমন আপনি, সে এবং তারা। আমার
বিশ্বাস, বিশ্বাস না হলেও একান্ত আশা, যে আমি পূজারীর দলে নেই। অন্ততঃ জ্ঞাতসারে যে আমি নই
সে-আশ্বাস আমি দিতে পারি আপনাকে। কোনকিছু সঠিকভাবে বিচার করার ক্ষমতাটুকু অনেক সময়
হারিয়ে ফেলে অতি বুদ্ধিমান পূজারীও----আমি তো কোন্‌ ছারপূজারী বলতে ঠিক কি বুঝাতে চাচ্ছি
 আমি সেটা বোধ হয় ব্যাখ্যা করা দরকার। পূজারী মানে এই নয় যে তারা পূজাঘর বা মন্দিরে গিয়ে
দেবদেবীর মূর্তির সামনে বসে সারাক্ষণ মন্ত্র উচ্চারণ করেননা, তা নয় মোটেও। মূর্তিকে দৃশ্যমান
 হতেই হবে এমন কোন বাঁধাধরা আইন নেই পূজারীদের----অদৃশ্যমান, নিরাকার, যে কোনও মূর্তি
 হলেই চলে। যারা চার্চে যান নিয়মিত, সিনাগগ-গুরুদ্বার-মসজিদ জাতীয় উপাসনাগৃহে বা নিজের বাড়িতে
মাদুড় পেতে, জায়নামাজে দাঁড়িয়ে, উপাসনা করেন, তাদেরও আমি পূজারীর পর্যায়ে ফেলতে দ্বিধা করব
না। তাদের মূর্তি বাইরে নয়, ভেতরে, দৈনন্দিনতার অভ্যাসেরবেড়িতে বাঁধা। একেশ্বরবাদী বলে যতই
 উচ্চকন্ঠে দাবি করুক তারা, তাদের সাথে মূর্তিপূজকদের পার্থক্যটা খুবই নগন্য। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে,
বৃহত্তর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, অধিকতর ক্ষতিকর। মোট কথা,পূজারী বলতে আমি একটা বিশাল
 জনগোষ্ঠীকেই অন্তর্গত করতে চাচ্ছি, যার ভেতরে একেশ্বরবাদথেকে বহু-ঈশ্বরবাদ, নিরীশ্বরবাদ,
 অগ্নিউপাসক, মূর্তি উপাসক----অর্থাৎ সবরকম উপাসকরাই আছেন। এদের সকলেরই মূল ধর্মটি
একঃ  উপাসনা এর প্রমাণ? প্রমাণ হিসেবে একটা যুক্তিই দাঁড় করাবো এমুহূর্তেঃ কে কিভাবে তার
প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন আমার এই উক্তির বিরুদ্ধে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলোর
বেশির ভাগই আসবে একেশ্বরবাদীদের কাছ থেকে। বিশেষকরে আমারই স্বজাতীয় ভাইবোনদের তরফ
 থেকে। তারা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন যে আমার পেছনে কোনও আত্মঘাতী যমদূত পাঠিয়ে দিলেও
আশ্চর্য হব না। এবং এই আশ্চর্য না হওয়াটাই কার্যত সেই প্রমাণ। তারা এতটাই উদ্গ্রীব প্রমাণ করার
জন্য যে তারা পূজারী নন, যে সেই উদ্গ্রীবতাই ধরিয়ে দেয় তাদের মানসিক দুর্বলতাগুলো, তাদের
অনিশ্চয়তাগুলো----সর্বোপরি তাদের সহনশীলতার নিদারুণ অনটনগুলোনিরাকারতত্ত্বের একনিষ্ঠ সেবক
হওয়া সত্ত্বেও তারা খৃষ্টমাতা কুমারি মেরির মূর্তি কোন কোন পবিত্র ক্ষণে দিগন্তের মেঘালয়ে ভাসমান
 হয়ে উঠতে দেখার মধ্যে কোনওঅসঙ্গতি খুঁজে পাবেন না। নিরাকার সৃষ্টিকর্তাকে অনুধাবন করতে সহজেই
 সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তারা নিরাকার শয়তানকে ঢিল ছুড়ে ঘায়েল করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। বা দ্বিধা
করেন না অতিশয় আকারবিশিষ্ট ‘পবিত্র’ প্রস্তরখণ্ডের গাত্রদেশে পরম ভক্তিভরে চুম্বনচিহ্ন অঙ্কন করে দিতে,
কোনও দুর্বোধ্য পুন্যার্জনের আকাঙ্খাতে হয়তবা। পূজারীরা সর্বপ্রকার স্ববিরোধিতাতে সুপারগ। তারা নিরাকার-
বাদী হয়েও পূর্নিমার পূর্ণচন্দ্রের গাত্রদেশে তাদের ধর্মগুরুর প্রতিকৃতি খোদাই থাকা নিয়ে কোনরকম
সংশয়বাণে বিদ্ধ হন না, বা বিচলিত হন না সদ্যজাত গোশিশুর কোমল গাত্রে সৃষ্টিকর্তার নামটি
নির্ভুল আরবি অক্ষরে লিখিত হওয়ার দৃশ্য দেখে। ইহুদী-খৃষ্টান-মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পরমপ্রিয়
পয়গম্বর ইয়াকুব ঘোষণা করেছিলেন যে সৃষ্টিকর্তার সাথে “মুখোমুখি” বসে আলাপ করার সৌভাগ্য
হয়েছিল তাঁর (Genesis 32:30)  ওদিকে হজরত মুসার ভাষ্য অনুযায়ী “মহাপ্রভুর সঙ্গে তাঁর সম্মুখ সাক্ষাৎ
ঘটেছিল অন্তরংগ বন্ধুদের যেমন সাক্ষাৎ ঘটে” (Exodus 33:11) ঘটনা যত অবিশ্বাস্য আর অবাস্তব
হবে পূজারীর চোখে সেটা ততই বিশ্বাসযোগ্য ও ঐশ্বরিক বলে মনে হবে। অনেকটা সেকারণেই পৃথিবীর যাবতীয়
 ধূর্ত শিকারীগণ এত সুন্দরভাবে তাদের পসরা সাজিয়ে রাখতে পেরেছেন----এত রমরমা তাদের ধর্মব্যবসা।
পূজ্য-পূজারী-শিকারী সম্বলিত এই যে বিপুল ত্রিভুজখানি, তার বিচিত্র নির্মাণকাহিনী ঠিক শিশুতোষ
রূপকথার মত উপভোগ্য না হলেও আরব্যোপন্যাসের পাশাপাশি দাঁড়াবার যোগ্যতা অবশ্যই ধারণ
করে। প্রথমে আমি দুচারটে উদাহরণ টেনে আনব ধর্মীয় ত্রিভুজটি থেকে। এই আখ্যানগুলোতে আমার
মূল উপপাদ্যটি হবে এই যে ধর্মবিষয়ের পূজ্য ব্যক্তিদের প্রায় সকলেই পূজনীয়র পোশাকে শিকারী বই
কিছু নন। অর্থাৎ এগুলোর বেশির ভাগই ঠিক আধ্যাত্মিক ধর্ম নয়, একান্তই জাগতিক খলধর্ম। ইংরেজিতে
এগুলোকে বলা হয় ‘কাল্ট’। শব্দটার কোনও যুৎসই বাংলা খুঁজে পেলাম না অভিধানেমোদ্দা কথা হলঃ
ব্যক্তিবন্দনা বা ব্যক্তিপূজা। এবং সেব্যক্তিটি অবধারিতভাবে একটি পুরুষ। এবং সেপুরুষটি অবধারিত-
ভাবে দারুণ চৌম্বিক আকর্ষণক্ষম একটি সুদর্শন ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিটি আশেপাশের সকল ব্যক্তিসমূহের
চাইতে আলাদা----প্রচণ্ড ক্যারিজমাসম্পন্ন একটি পুরুষ যার দর্শনমাত্র নারীহৃদয় সহজেই দ্রবীভূত
হয়ে পড়ে, তাঁরা চলচ্ছক্তি হারিয়ে ফেলেন। এই গুণাবলীর বাইরে আরো একটা জিনিস দরকার তাঁদের।
যাদুকর যেমন তাসের খেলা দেখিয়ে বা মাথার টুপি থেকে খরগোশ বের করে বালকবালিকাদের তাক
লাগিয়ে দেন, পূজ্য ব্যক্তিদেরও অনুরূপ কোনও বিদ্যা থাকা প্রয়োজন। সহজ ভাষায় যাকে বলে অলৌকি-
কতাএকটা-না-একটা বড়রকমের ভোজবাজী তাঁকে জানতেই হবে। কেউ হয়ত মরা লাশকে জ্যান্ত
করে তোলেন। কেউবা সশরীরে স্বর্গ থেকে ঘুরে আসেন রাতের বেলা, এবং ফিরে এসে অতিশয় বর্ণাঢ্য
বর্ণনাদ্বারা তাঁর ভক্তগণের চক্ষু এবং চোয়াল উভয়তেই খিল ধরাবার উপক্রম করেন। মোট কথা, তাঁদের
সবাইকেই ঈশপ সাহেবের পাইডপাইপারের মত মোহন বংশী বাজিয়ে তাঁদের মুষিকসম ভক্তসমূহকে
 নিরুদ্দেশের সুড়ঙ্গতে প্রবেশ করানোর ক্ষমতা ধারণ করতে হয়। সে কারণে এসব পূজারীদের আমি
একপ্রকার ‘ভাবের মুষিক’ হিসেবে গণ্য করি।
এবার একটা গল্প বলা যাক।
১৮৩০ সালের ৬ই এপ্রিল  নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের ফায়েট শহরে মাত্র ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি নতুন
চার্চ উদ্বোধিত হয়, যার নামকরণ করা হয় চার্চ অফ জেসাস ক্রাইস্ট অফ ল্যাটার ডে সেইন্টস।
সংক্ষেপে মরমন। অনেকটা বাংলাদেশের নবজাত খোকা যার নাম রাখা হয়েছে আবুল কাসেম
 মোহম্মদ-বিন-তোফায়েল খান আলমগীর, ওরফে বাদল’এর মত। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সেই
নবজাত ধর্মটির জন্মকাহিনী হয়ত সব পাঠকের জানা নয়। তাই এখানে তার একটু আভাষ দিচ্ছি।

১৮২৬ সালের মার্চ মাসে সেই অঙ্গরাজ্যেরই বেইনব্রিজ শহরের এক ফৌজদারি আদালতে একুশ বছর
বয়স্ক একটি যুবক দোষী সাব্যস্ত হয় তার “অসামাজিক আচরণ” ও “মিথ্যা পরিচয়ে লোক ঠকানোর”
মামলাতে। জজ সাহেব সমুচিত শ্রীঘরবাসের সাজা আরোপ করাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি। যুবকটির নাম
জোসেফ স্মিথ----দেখতে শুনতে খুবসুরৎ, কথাবার্তায় পটু----অর্থাৎ সফল ভণ্ড হতে হলে যেসব গুণাবলী
না হলেই নয়। জেলখানার অনতি-আরামপ্রদ পরিবেশে দিনযাপন করাকালে তিনি শারীরিকভাবে কর্মহীন
থাকলেও মস্তিষ্ক মোটেও অলস থাকেনি। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে তার ঈশ্বর-
দত্ত বাকপটুতার গুণটি ঈশ্বরের সেবাতেই ব্যবহার করতে হবে। তাতে যদি তার নিজেরও কিছু সুখ-
সুবিধার ব্যবস্থা হয়ে যায় তাহলে ক্ষতি কি? একবার তিনি স্বর্ণখনির ভাওতা দিয়ে লোকের
পকেট খালি করার চেষ্টা করতে গিয়ে জেল খেটেছেন, দ্বিতীয়বার তিনি অনুরূপ ভুল করবেন
না। ধোকা দিতে হয় স্বয়ং ঈশ্বরকেই দেবেন। ঈশ্বর তো মূর্খ মানুষগুলোর মত পুলিশের কাছে নালিশ
করতে যাবেন না। অতএব সোনার ধোকাবাজির চাইতে ধর্মের ধোকাবাজি অনেক নিরাপদ, নির্ঝঞ্ঝাট।
জেল থেকে ছাড়া পাবার সাথে সাথে তিনি প্রচার করতে শুরু করলেন যে তিনি মহাপ্রভুর কাছ থেকে
মরমন গ্রন্থ পুনরুদ্ধার করার বাণী প্রাপ্ত হয়েছেন----অর্থাৎ তিনি কোনও সাধারণ মানব নন, তিনি
একজন দৈবনির্বাচিত বার্তাবাহকএকজন  ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ।


এই ‘ঈশ্বরপপ্রেরিত’ শব্দটির নিশ্চয়ই কোনও জাদুকরি শক্তি আছে। সাধারণ মানুষ সেটা শোনামাত্র
যেন সব জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। দ্বিপদী মানুষ তখন চতুষ্পদী মেষের আকার ধারণ করে---না, দৈহিক
ভাবে নয়, বুদ্ধির দিক থেকে। যেইমাত্র লোকের কানে গেছে যে জোসেফ স্মিথ নামক এক ‘মহাপুরুষের’
কাছে দৈববাণী প্রেরিত হয়েছে, তৎক্ষণাৎ গোটাছয়েক ভক্ত হাজির হয়ে গেল তার সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ‘গির্জায়’।
কিন্তু এই মেষের ছানারা সবসময়ই দল বেঁধে চলতে পছন্দ করে। সাধে কি বলা হয় গড্ডালিকা প্রবাহ।
মরমন প্রফেট জোসেফ স্মিথের রসনাশক্তি এতই মিষ্টমধুর যে তার শিষ্যসংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে দশ
বছরের মধ্যে ১৫,০০০ এ পৌঁছে গেল। সে তো গেল ১৮৩০-১৮৪০এর কথা। এখন তাদের মোট সংখ্যা
 কত অনুমান করতে পারেন? পাকা ১ কোটি ৪১ লক্ষ। এবং সেটা শুধু যক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়, ইউরোপ
আর এশিয়া-আফ্রিকাতেও তাদের সংখ্যা নেহাৎ হেলাফেলার মত নয়। মরমন সম্প্রদায়ের একটা প্রচলিত
বুলিYour life didn’t begin at birth, and it won’t end at death” (তোমার জীবন
জন্মক্ষণে আরম্ভ হয়নি, আবার মৃত্যুর সাথে শেষও হয়ে যাবে না।) তারা সর্বক্ষণ কেবল “ঈশ্বরের পরিকল্পনা”র
কথা আওড়ায়, যেন পরমেশ্বর তাঁর প্ল্যান পরিকল্পনা তৈরি করার সময় মরমনদের সঙ্গে সলা-পরামর্শ করে
নিয়েছিলেন।

না, আমাকে ভুল বুঝবেন না দয়া করে। পূজারী মাত্রই মেষজাতির অন্তর্ভুক্ত, তা বলছি না আমি। তবে
মেষেদের সঙ্গে এই একটা বিষয়ে বেশ মিল আছে পূজারীদের----গড্ডালিকা। অন্যরা যেপথে গমন করেন,
সেপথে তারাও গমন করতে চাইবেন, গমনের কারণটি জানা না থাকলেও। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যেতে পারে
ঢাকার মতিঝিলে এই যে কাণ্ডটা ঘটে গেল মে মাসের ৬ তারিখে। লাখ দেড়েক টুপি-আলখাল্লা পরিহিত
জোয়ান ইসলাম ধর্মকে হেফাজত করবার সঙ্কল্প নিয়ে লাঠিতরবারি সহকারে দাঁড়িয়ে গেলেন, তাদের অধিকাংশই
নাকি ছিল কচিকাচা বালক-কিশোর যাদের কোনও ধারণাই ছিল না ওরা কেন জমায়েত হয়েছে সেখানে,
এমনকি তাদের বাবামায়েদেরও জানাবার প্রয়োজন বোধ করেননি আন্দোলনের নেতারা----এমনই জরুরি
হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের ‘ইসলাম বাঁচানোর’ তাগিদ। বালকের হাতে মারণাস্ত্র দিতে না পারলে কি ধর্মরক্ষার  
কোনও উপায় আছে?
এবার শুনুন আরেক শিকারী-পূজ্যের গল্প। নাম তার শোকা আসাহারা, জাপানের একটি গরিব পরিবারে তার
জন্ম, ১৯৫৫ সালে। বাজারে বিক্রি করে কোনরকমে সংসার চালাতেন তার বাবা। শোকা জন্মতেই প্রায় অন্ধ।
বাঁ চোখটি একেবারেই নেই, ডান চোখটিও না-থাকারই মত। বাবা তাকে অন্ধস্কুলে পাঠিয়ে লেখাপড়া
শিখিয়েছিলেন কিঞ্চিৎ। ১৯৭৭ সালে সেখান থেকে টায়েটুয়ে পাস করার পর একুপাঙ্কচার এবং অন্যান্য
চাইনিজ চিকিৎসাবিদ্যাতে ঢোকার চেষ্টা করেন। ১৯৭৮ সালে বিয়ে করেন তিনি।

অনতিকাল পর তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় বিনা লাইসেন্সে ওষুধের প্রেসক্রিপশন লেখার দায়ে
হাকিম তাকে শ্রীঘরবাসের শাস্তি না দিয়ে আর্থিক জরিমানা করেই খালাশ করে দেন। সেই অভিজ্ঞতার পর
 তার মানসজগতে বিবিধপ্রকার ধর্মভাব জাগরিত হতে থাকেতাওবিদ্যা, তান্ত্রিক যোগসাধনা, শেষে খৃষ্টধর্ম,
কোনটাই বাদ রইল না তার অভিজ্ঞতার ঝুড়িতেএকসময় শোকা তার নিজেরই একটা ধর্মগোষ্ঠী তৈরি করে
ফেলেন, ১৯৮৪ সালে-----যার নাম দেওয়া হয় আউম শিনরিকো।
‘যীশুখৃষ্ট’এর অবতার---- এই বলে ঘোষণাপত্র জারি হয়ে গেল। বললেনঃ আমি ঈশ্বরের ব্যক্তিগত
মেষ। তবে এই মেষ মহাশয় ১৯৯৫ সালের ২০শে মার্চ যেকাণ্ডটি বাঁধিয়ে ফেললেন সেটা ঠিক মেষসদৃশ ছিল
কিনা সন্দেহ। তাঁর চেলাচামুণ্ডাদের লেলিয়ে দিলেন টোকিও শহরের পাতাল ট্রেনের ভেতর সশস্ত্র হামলা
চালাতে। কোনও ধাতব অস্ত্র নয়, ছিল মারাত্মক সারিন গ্যাস। বেশ কিছু যাত্রী দম বন্ধ হয়ে
মারা যায় তাতে। সেই হামলার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তিনি নিজেকে ঘোষণা করেন জাপানের ‘একচ্ছত্র
সম্রাট’ দুঃখের বিষয় যে জাপানের আইন আদালতের উর্দিপরা মানুষগুলো একটু বেরসিক বলেই ‘সম্রাট
আসাহারা’র মাথায় মুকুট না পরিয়ে গলায় দড়ি পরানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ২০০৪ সালে। সেই
সিদ্ধান্তটি কার্যকরি হবার কথা ছিল ২০১২ সালে। তা হয়নি। আইনের মারপ্যাঁচে সেটা বারবার স্থগিত
হয়ে শেষ পর্যন্ত আদৌ কার্যকর হবে কিনা কোনদিন সেবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তবে শ্রীঘরবাস
নিশ্চিত সারাজীবনের জন্যে তাতে বোধ হয় কোনও সন্দেহ নেই। বর্তমান যুগের স্বঘোষিত “প্রেরিত
পুরুষ”দের ভাগ্যে শ্রীঘর ছাড়া আর কিছু জোটে না সাধারণত----আগেকার যুগ হলে হয়ত সত্যি সত্যি
সাম্রাজ্য এসে যেত কপালে। তাই হত সেযুগে। আসলে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মিলে সর্বনাশ করেছে সাধুবাবাদের।


এখানে আমার সমস্যাটা কোথায় বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। না, শোকা আসাহারা নামক একটি উন্মাদ
ব্যক্তি নিয়ে আমার সমস্যা নয়, এধরণের উন্মাদরাই তো যুগে যুগে ধর্মপ্রচার করে এসেছেন। আমার
সমস্যা তার শাকরেদদের নিয়ে----তাদের মনস্তাত্বিক চিত্রটা নিয়ে। মন ও বুদ্ধির দিক থেকে কতখানি 
দুর্বল আর ফাঁকা হলে এসব ভণ্ড, ক্রূর মানুষগুলোর ধোকাবাজির ফাঁদে স্বেচ্ছায় আত্মবরণ করতে পারে

মানুষ একটা জেলখাটা দাগী আসামীর ধূর্ত চালাকির মধ্যে কেমন করে ধরা দেয় তারা জানিনা।
এই অবিশ্বাস্যরকম দুর্বলমনা মানুষগুলোকেই আমি বলি জন্ম-পূজারী। তারা পূজারী হবার জন্যই জন্মায়।
তাদের চামড়ার চোখ হয়ত আছে, কিন্তু অন্তরের চোখটি একেবারেই বোঁজাআমার কি মনে হয় জানেন?
মতিঝিলের সেই গুম্ফ-শশ্রুধারি কাফেলার অন্ধ, বধির, অবরুদ্ধ ছেলেগুলোও অনেকটা তাই। তারা জন্মপূজারী।
তাদের মূর্তিরা হল পৃথিবীর যাবতীয় কাদের মোল্লা আর ওসামা-বিন-লাদেনেরা। যারা শোকা আসাহারার মত
নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করার নির্দেশ দেয়।  তাদের পরম পূজ্য ব্যক্তি হল  মদজিদের মূর্খ ইমাম
আর মাদ্রাসার মূর্খতর মোল্লা। কে বলে তারা মূর্তিপূজা করে না? এই দৃষ্টিশক্তিহীন, নতমস্তক পূজারীগুলোর
মত নিষ্ঠ পূজারী আপনি নরমুণ্ডময় কালীমন্দিরেও পাবেন না।


ডেভিড কোরেশ নামক এক ‘পূজ্য’ মহাপুরুষের গল্প হয়ত পাঠকদের অনেকেরই জানা। তবুও নাহয়
আরো একবার শুনুন----এসব গল্প কি কখনো পুরনো হয়? ডেভিড কোরেশ আর শোকা আসাহারার
মত কাল্টগুরুরা বারবার দর্শন দিয়েছেন পৃথিবীতে, এবং একরকম গ্যারান্টি দিয়েই বলা যায় যে ভবিষ্যতে
বারবার দেবেনও। ডেভিড কোরেশের জন্মকালে (১৯৫৯) তার বাবা, ববি হাওয়েল, যাকে সে কোনদিন
স্বচক্ষে দেখেনি, তার বয়স ছিল ২০, আর তার মায়ের বয়স ছিল ১৪। বাবামা, বুঝতেই পারছেন, তখন
অবিবাহিত। শুধু তাই নয়, জন্মতেই বাবামা উভয়কর্তৃক পরিত্যাক্ত। অর্থাৎ পথেঘাটে ধূলায় বালিতে
একাকার হয়ে বেড়ে ওঠা মানুষ। যদিও চেহারাটা ছিল দারুণ, আর চাপাটা ছিল সিরায় মধুতে টসটস।
কথার জাদু দিয়ে লোক ভুলানোর বিদ্যা এদের সবারই থাকতে হয়। তা নাহলে ‘প্রফেট’ হওয়া যায় না,
কি বলেন? 
১৯৮১ সালেতে শুরু হয় ডেভিড কোরেশের নতুন জীবনের যাত্রা, যার সূচনাতেই একটি ১৫ বছর বয়স্ক
কিশোরীর পেটে বাচ্চা ঢুকিয়ে দেনএকই সময় নিজেকে পুনর্জন্মলব্ধ খৃস্টান ঘোষণা করে টেক্সাসের
ওয়েকো শহরে গিয়ে ব্রাঞ্চ ড্রেভিডিয়ান ধর্মগোষ্ঠীর সদস্য তালিকাভুক্ত হলেন
১৯৮৩ সালে নিজের মধ্যে শুনতে পেলেন একজন দৈববাণীপ্রাপ্ত প্রফেটকে----তাঁকে বলা হচ্ছে যে তিনি
হলেন ঈশ্বরপ্রেরিত সর্বশেষ বার্তাবাহী পয়গম্বর। ‘দ্য লাস্ট প্রফেট’ মর্তে অবতরণ করেছেন বলে রব ছড়িয়ে
গেল সর্বত্র। তাঁর প্রথম শিষ্য হলেন ব্রাঞ্চ ড্রেভিডিয়ানের তৎকালীন নেত্রী লইস রোডেন, যার বয়স ছিল
৭৭! বয়স যতই হোক দুজনের মধ্যে অনায়াসেই গড়ে উঠল একটি পরম ঘনিষ্ঠ যৌনসম্পর্ক। (অবিশ্বাস্য
মনে হচ্ছে? পুরনো কাহিনীগুলো ঘঁটে দেখুন একবার। সাধারণ মরণশীলদের বেলায় যা অবিশ্বাস্য মৃত্যুঞ্জয়ী
সাধুসন্ন্যাসীদের জন্য সেটা নস্যি)। যাই হোক স্বল্পকাল বাদে বয়োবৃদ্ধ প্রেয়সী যখন ইহলোক থেকে বিদায়
নিয়ে ঈশ্বরের রাজ্যে চলে গেলেন, তখন সেই ব্রাঞ্চ ড্রেভিডিয়ান সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব নিয়ে নানারকম ঝগড়া
বিবাদ অতি কৌশলে ফায়সালা করার পর তার একচ্ছত্র অধিপতির পদে প্রতিষ্ঠিত হলেন হাওয়েলপুত্র, যিনি
ঠিক ঐ মুহূর্তেই নতুন নাম ধারণ করে হলেন ‘ডেভিড কোরেশ’, পারস্যের কিংবদন্তী সম্রাট ‘সাইরাস দ্য
গ্রেট’এর (খৃঃপূঃ ৫৭৬-৫৩০) অবলম্বনেআস্তে আস্তে তাঁর শিষ্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। প্রথমে
পরিবারের একজন, তারপর গোটা পরিবারই নিজেদের জায়গাজমি বিক্রি করে দিয়ে যোগ দেন কোরেশের
ধর্মশিবিরে। রীতিমত একটা ঘরানা গড়ে ওঠে ওয়েকের কাছাকাছি শহর প্যালেস্টাইনে। ২৫ থেকে পঞ্চাশ,
৫০ থেকে ১০০----টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, এমনকি ইজরায়েল আর যুক্তরাজ্য থেকেও ভক্তরা এসে
জমায়েত হলেন তাঁর দরবারে। ব্রাঞ্চ ড্রেভিডিয়ানের শিষ্যদম্পতি পেরি ও মেরি জোন্স। তাদের কন্যা রেচেল
কোরেশের বিবাহিত স্ত্রী। একই সাথে স্ত্রীর ছোটবোন মিশেল জোন্সের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে ফেললেন,
এই ছুতোতে যে মিশেল তাঁর ‘আধ্যাত্মিক স্ত্রী’। (আধ্যাত্মিক স্ত্রীর সঙ্গে আলাদারকম কোনও আধ্যাত্মিক যৌনতা
 প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা সেটা অবশ্য আমার জানার কথা নয়)। বলা বাহুল্য যে ব্রাঞ্চ ড্রেভিডিয়ানে আরো কিছু
 অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সমাবেশ ছিল, এবং তাদের শয়নকক্ষে আমাদের ‘শেষ প্রফেট’এর আবির্ভাব দৈবাদেশেই
হোক, আর আধ্যাত্মিক প্রেরণাতেই হোক, ঘটেছিল কিনা সেসম্বদ্ধে দুষ্ট লোকের মুখে অনেক কথা শোনা যেত
সেসময়।
ব্রাঞ্চ ড্রেভিডিয়ানের ব্যবসা পূর্ণমাত্রায় জমে ওঠে ১৯৯০ সালে।
সংসারে সব ভাল জিনিসই একসময় ফুরিয়ে যায়। বেচারা প্রফেটের ভাগ্য খারাপ যে তার জন্ম দেড়-
দুহাজার বছর আগে হয়নি, হয়েছে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা, শিশু
অধিকার, ইত্যাদি বিরক্তিকর বিষয়গুলো বাধা সৃষ্টি করতে থাকে পদে পদে।
একসময় তাঁর চার্চের কোনও ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ মেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ ঠুকে দেয় তাঁর বিরুদ্ধে----
তার সম্ভ্রম হরণ করেছেন বলে, যখন সে রীতিমত অপ্রাপ্তবয়স্ক এক মেয়ের একটা নালিশ ক্রমে
অনেকগুলো মেয়ের অনেকগুলো নালিশে পরিণত হয়। পত্রপত্রিকায় অনিবার্যভাবে দাঁড়িয়ে যায়
একটা যৌনরাক্ষশের মূর্তি আমাদের সামনে। এমনও গুজব শোনা যায় যে তিনি একই সঙ্গে মা এবং
কিশোরী কন্যা, উভয়েরই শয্যাসঙ্গী হয়েছেন, সব ওই আধ্যাত্মিকতার ভাওতাতে
ব্যস, আর যায় কোথায়। ব্যভিচার পৃথিবীর সব দেশেই হয় কমবেশি। কিন্তু সব দেশে ব্যভিচার করে
দীর্ঘদিন ছাড়া পাওয়া যায় না। সেসময় প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের শাসনকাল। ঘটনা গড়াতে গড়াতে
একটা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে যায় ১৯৯৩ সালের ১৯শে এপ্রিল। ব্রাঞ্চ ড্রেভিডিয়ানের আখড়া তখন
ওয়েকোতে। আখড়া ঘেরাও করা হয়েছে মাসাধিককাল-----কোরেশ কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবেন
না। শেষে কর্তৃপক্ষের সশস্ত্র বাহিনী ধূম্রজাল সৃষ্টি করে তাদের বের করে নেবার চেষ্টা চালায়। ফল হল
উলটো। বের তারা হল না তবুও----ধোয়ার বদলে সেখানে জ্বলে উঠল দাবাগ্নি। সর্বমোট ৭৬ জন মানুষ
যার মধ্যে ১৭ জন ছিল ১৭ বা তার চেয়েও কম বয়সের, জীবন্ত পুড়ে মারা যায়। সে এক নিদারুণ দৃশ্য
বটে। সারা বিশ্ব বিস্ময়বিস্ফারিত চোখে দেখল সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দূরদর্শনীতে।
একজন ধূর্ত শিকারী----৭৬ জন নির্বোধ পূজারী একসাথে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। অথচ এঘটনা
সংসারের একমাত্র দুঃখজনক ঘটনা নয়---হাজার হাজার ঘটনার অন্যতম ঘটনা মাত্র। এবং সম্ভবত
ভবিষ্যতে আরো অনেক ঘটবে। পৃথিবীতে যুগে যুগে হাজারো শিকারী-পূজ্য আবির্ভূত হয়েছে অতীতে,
ভবিষ্যতেও হবে অনেক। এবং লক্ষ লক্ষ, এমনকি কোটি কোটি পূজারীও সৃষ্টি হয়ে যাবে নতুন আগুণে
ভস্ম হবার অপেক্ষায়।
মতিঝিলের সেই অবোধ বালকগুলো কি তার চেয়ে খুব আলাদা?
ওয়েকের সেই মর্মান্তিক ঘটনার পরিসমাপ্তি কিন্তু ওয়েকোর চত্ত্বরেই ঘটেনি----তার জের ধরে ওয়েকোর
চাইতেও বীভৎস দৃশ্য বিশ্ববাসীকে অবলোকন করতে হয় ঠিক দুবছর পর, ওক্লাহোমা অঙ্গরাজ্যের
অন্তর্গত ওক্লাহোমা সিটিতে। ১৯৯৫ সালের ১৯শে এপ্রিল, যেন ওয়েকোর দ্বিবার্ষিকী পালনেরই উদ্দেশ্যে।
২৭ বছর বয়স্ক এক ধর্মোন্মাদ যুবক, টিমথি ম্যাকভি, এবং টেরি নিকলস নামক আরেক সহমতবাদী
 ধর্মান্ধ, দুটিতে মিলে ওয়েকোর প্রতিশোধ নেবার সঙ্কল্প নিয়ে নগরকেন্দ্রের  আলফ্রেড মারা ফেডারেল
 বিল্ডিংটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়নিহতসংখ্যা, কোলের শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ, সর্বমোট
১৬৮ জন। আহত ৬০০। আমেরিকার ইতিহাসে গৃহজাত সন্ত্রাসী আক্রমণে এত হতাহত আগে হয়নি
কখনো

কিন্তু কেন? কিসের প্রতিশোধ? ওয়েকোর অগ্নিকাণ্ডতে এতগুলো লোক মারা গিয়েছিল ছিল বলে? 
না, মোটেও তা নয়। লোকক্ষয় নিয়ে এরা মাথা ঘামায় না। এদের বড় রাগ ছিল কেন ডেভিড কোরেশের
‘ধর্মীয় স্বাধীনতায়’  বাধা দেওয়া হল, তা’ও কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক? সরকারই সব দোষের দোষী,
এই হল আমেরিকার অন্ধ, উন্মাদ, পূজারী জাতিটির প্রধান অভিযোগ। ৭৬ জন লোক মারা গেছে ওয়েকোতে,
১৬৮ জন গেছে ওক্লাহোমাতে, কি আসে যায় তাতে? ধর্মের ‘হিফাজত’এর জন্য এরকম ক্ষয়ক্ষতি হবেই---
-এই হল ধর্মরক্ষকদের চিন্তাধারাওদের মতানুসারে মানুষের জন্য ধর্ম নয়, ধর্মের জন্য মানুষ । এবং সেই
ধর্মের মধ্যে যদি থাকে নারীধর্ষণ, শিশুনিপীড়ন, হলই বা, তবুও ধর্মের স্বাধীনতাতে যেন কেউ হস্তক্ষেপ
না করে, এই তাদের নিরাপস দাবি।

উগ্র মতবাদ, যা অবধারিতভাবেই একটা ভয়াবহরকম আগ্রাসী রূপ ধারণ করে একসময়, সেটা কিন্তু
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় কেবল। বরং ধর্মহীন মতবাদের উগ্রতা সমান বা অধিকতর হিংস্রতার
সঙ্গে বিপন্ন করে তুলতে পারে মানুষের জীবন। উগ্রতা, হিংস্রতা, অমানুষিকতা, এগুলো মানবচরিত্রের
মৌলিক উপাদানগুলোর বাইরে কিছু নয়। সেগুলো শান্ত পরিবেশে অনেকটা চাপা থাকে, আবার কোনও আগ্রাসী
মতবাদের অনুকূল হাওয়া পেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন মূর্তি ধারণ করতে পারে। ধর্মহীনদের ‘ধর্মান্ধতা’, বা তারাও যে
আসলে অত্যন্ত অনুগত, ভক্তিগদগদ, ‘পূজারী’ শ্রেণীতে পরিণত হতে পারে তার ইতিহাস খুব ছোট নয়।
এখানে আমি গুটিকয় উদাহরণ তুলে আনছি ইতিহাসের পাতা থেকে।

বর্তমান বিশ্বে ‘বিগ ব্যাঙ্গের’ কথা শোনেনি এমন লোকের সংখ্যা নিশ্চয়ই খুব বেশি নয়। অন্তত শিক্ষিতশ্রেণীর
মাঝে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, বিগ ব্যাংগ বলতে কি বোঝায় সেসম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা থাক
 বা না থাক। শব্দদুটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ফ্রেড হয়েল নামক এক ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ১৯৪৯ সালে,
বিবিসি’তে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়াকালে। মজার ব্যাপার হল যে শব্দদুটি তিনি খানিকটা ব্যঙ্গার্থে ব্যবহার
 করেছিলেন, মহাবিশ্বের সূচনা নিয়ে সেসময়কার প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলোকে খণ্ডন করে তাঁর নিজের
‘স্থিতিশীল বিশ্বের’ ধারণাকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে। বিগ ব্যাং তত্ত্বকে শক্ত বৈজ্ঞানিক কাঠামোর
ওপর দাঁড় করানোর দায়িত্বটি পালন করেন যে ব্যক্তি তাঁর নাম জর্জ গ্যামো। লোকটার জন্ম রাশিয়ার ওডেসা
শহরে, ১৯০৪ সালে। মারা যান আমেরিকার কলরাডো অঙ্গরাজ্যের বোল্ডারে, ১৯৬৮ খৃষ্টাব্দে। অসম্ভবরকম
ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষ, যাঁর জীবনের প্রতিটি বিষয়ই ছিল আশ্চর্যরকম বর্ণাঢ্য। দেখতে শুনতে ছিলেন রীতিমত
একটি পর্বত। লম্বা বাবড়ি চুল, স্বভাবচরিত্রে পুরোপুরি বোহেমিয়ান , মোটর সাইকেলে করে সারা মহাদেশ ঘুরে
বেড়াতেন নিজের খেয়ালখুশিমত, যখন ইচ্ছে তখন। লেখাপড়াতে যে কিরকম মেধাবী ছিলেন তিনি সেটা
তো বলাই বাহুল্য। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র পদার্থবিদ্যায়, ক্লাস করতেন সেসময়কার সেরা সোভিয়েট
গাণিতিক-বিজ্ঞানী আলেকজাণ্ডার ফ্রিডম্যানের আপেক্ষিক তত্ত্ববিষয়ে। ফ্রিডম্যান  (১৮৯৮-১৯২৫) বিশেষ
খ্যাতি অর্জন করেছিলেন আইনস্টাইনের সমীকরণ সমাধান করে তাতে ‘স্ফীতিশীল বিশ্বের’ সম্ভাবনা নিহিত
আছে বলে দাবি করার পর----স্বয়ং আইনস্টাইন যাতে দারুণ চমৎকৃত হয়েছিলেন। গ্যামোর ভীষণ সখ
ছিল ফ্রিডম্যানের সাথে কাজ করে পি এইচ ডি ডিগ্রি করবেনকিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফ্রিডম্যান সাহেব হঠাৎ করে
মারা যান মাত্র ২৭ বছর বয়সে। যাই হোক, পরে ভিন্ন একটা বিষয়ে ডিগ্রি করেছিলেন বটে গ্যামোসাহেব, কিন্তু
তাঁর মন পড়ে ছিল মহাবিশ্বের দূরদূরান্তেসেসময়ই ‘বিগ ব্যাঙ্গের’ ওপর তাঁর সাড়াজাগানো কাজ প্রকাশ হয়
এবং  সেসঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খ্যাতি। এ-বিষয়ে বক্তৃতা করার নিমন্ত্রণ আসতে থাকে দেশবিদেশের
বিভিন্ন গবেষণাগার থেকে

ইউরোপের সেসময়টা ছিল কুয়ান্টাম শাস্ত্রের যুগ----পদার্থবিজ্ঞানের বড় বড় মাথাওয়ালা ব্যক্তিরা তখন
নতুন নতুন তথ্য এবং তত্ত্ব আবিষ্কার করে চলেছেন সারা মহাদেশব্যাপী। এঁদের মাঝে ডেনমার্কের নিলস
বোর ছিলেন অপেক্ষাকৃত প্রবীণ, নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত গুরুজনজর্জ গ্যামো ইতালির একজাগায় বক্তৃতা
শেষ করে ভাবলেন, বোর সাহেবের সঙ্গে দেখা না করে দেশে ফিরে যাওয়া নেহাৎ বোকামি। নিলস বোর
তাঁর কথা আগেই শুনেছিলেন, তাঁর পেপার পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে তিনিও খুশি।
আলাপ করে বুঝলেন লোকটার ভেতরে কত আগুন। বরাদ্ধ সময় বাড়িয়ে আরো কিছুদিন তাঁর সঙ্গে থেকে
যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। বোরের আমন্ত্রণ পেয়ে গ্যামো আনন্দে আটখানা। সমস্যা দাঁড়ালো রুশ পাসপোর্ট
নিয়ে। তখন সোভিয়েট যুগ, লেনিন মারা গেছেন ১৯২৪ সালে। প্রথমে ট্রটস্কি, তারপর স্ট্যালিনের শক্তহস্তের
স্বাক্ষর সর্বত্র। কোথাও মার্ক্স-লেনিনবিরোধী কার্যকলাপের সামান্যতম গন্ধ পাওয়ামাত্র তৎক্ষণাৎ তার গলা টিপে
ধরা হত। গ্যামোর বিজ্ঞানের ভেতর ‘মার্ক্স-লেনিন’ বিরোধী গন্ধ তারা কোথায় পেলেন সেটা বোঝা মুস্কিল,
মোদ্দা কথা, তাঁর পাসপোর্ট নবায়ন না করে বরং তাঁকে তৎক্ষণাৎ দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি তাড়াতাড়ি করে ফিরে যান দেশে। গিয়ে দেখেন মহাবিপদ। চারদিকে
থমথমে অবস্থা। আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষকদের মনে আতঙ্ক, কখন না কার ডাক পড়ে। কমুনিস্ট সরকার
অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে সীমারেখা টেনে দিয়েছেন কোন্‌টা মার্ক্সিস্ট মতবাদ আর কোন্‌টি বুর্জোয়া। তাদের বিচারে
কুয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব, বিশেষ ও সাধারণ উভয়ই, কেবল মার্ক্সিস্ট-লেনিন
তত্ত্বের বিরোধী তাই নয়, অবৈজ্ঞানিকও বটে! একদিন গ্যামো কোনও এক বৈজ্ঞানিক বৈঠকে কুয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে
বক্তৃতা করছিলেন। এমন সময় শ্রোতা-দর্শকদের সঙ্গে বসা এক সরকারি কর্মচারি তাঁর বক্তৃতা থামিয়ে উপস্থিত
জনগণকে বললেন ঘর খালি করে দিতে। ওরা গ্যামোকে সাবধান করে দেন ভবিষ্যতে যেন এধরণের ‘রাষ্ট্র-
বিরোধী’ কথাবার্তা উচ্চারণ করবার সাহস না পান প্রকাশ্যে। আর হ্যাঁ, এ’ও বলে গেলেন তারা যেন নতুন
পাসপোর্ট পাবার আশা মন থেকে দূর করে দেন।
পরে যখন পারমাণবিক বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক অধিবেশনে জর্জ গ্যামোকে প্রধান বক্তা হিসেবে নিমন্ত্রণ
পাঠানো হয়, তখন ফ্রান্সের কমুনিস্ট  দলের নেতা,পল লঞ্জভোকে দিয়ে সুপারিশ করাতে হয় কোনরকমে
সোভিয়েট সরকারের মন গলানো যায় কিনা। নেতাসাহেব বিজ্ঞানের খাতিরেই রাজি হতেন কিনা বলা মুস্কিল,
তবে গুজবে প্রকাশ যে তাঁর সেসময়কার ‘অন্তরংগ’ বান্ধবী ছিলেন ম্যাডাম কুরি,--- হ্যাঁ, সেই রেডিয়েশন-খ্যাত
মেরি কুরি। এই যে আন্তর্জাতিক ধরাধরি, এর সবটাই ছিল গ্যামোর সেই ডেনীশ বিজ্ঞানী বন্ধু নিলস বোরের
সৌজন্যে। সেই যে কথায় আছে, জহুরীই জহর চেনে। উঁচু মানের জ্ঞানসাধকরা সবসময়ই একে অন্যের
বিপদ আপদে পাশে দাঁড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। ও হ্যাঁ, একটা কথা তো প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম
বলতে। এই যে বিশাল প্রতিভাধর ব্যক্তিগুলোর নাম উল্লেখ করা হল এখানে, এঁদের সকলেই নোবেল
বিজয়ী---পল লঞ্জভো ব্যতিরেকে অবশ্য।

যাই হোক, গল্পটির সারাংশ আশা করি পাঠকের দৃষ্টি এড়ায়নি। না, গ্যামোর বিজ্ঞান নয়, লঞ্জভো-কুরির
গোপন সম্পর্কও নয়। মূল বিষয়টি হল অবিশ্বাসধর্মী কমুনিস্ট কর্তৃপক্ষের সেই একই অনমনীয় মনোভাব,
সেই একই ‘ধর্মহীনতার’ ধর্মান্ধতা। অর্থাৎ সবকিছুর মূলে একই উপাদান--- ক্ষমতা। সেটা ধর্মেরই হোক, আর
ধর্মহীনতারই হোক। ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রণ, এই হল সবকিছুর গোড়াতে। মন্দির-মসজিদ-গির্জা-সিনাগগ
যেমন শৈশবাবস্থা থেকেই প্রশ্ন আর কৌতূহলের গলা টিপে কেতাবী বুলি গেলাতে চায় মানুষকে, ঠিক একই
ভাবে সাম্যবাদ, সামন্তবাদ, জাতীয়তাবাদ, সবরকম ‘বাদ’ই মানুষের মস্তিষ্ক ধোলাই করার জন্যে উঠেপড়ে
লেগে যায় জন্মমুহূর্ত থেকেই। এই হল ক্ষমতার নিজস্ব ‘ধর্ম’কন্ট্রোল!
লেনিন-স্ট্যালিনের আমলে সোভিয়েট রাষ্ট্রে ধর্মকর্মের স্বাধীনতা ছিল কি ছিল না সে প্রশ্নের কি জবাব হতে
পারে তা ওয়াকেফহাল পাঠকের অজানা কিছু নয়। তবুও এই স্বাধীনতাহীনতার মাত্রা যে কোন পর্যায়ে
দাঁড়িয়েছিল সেটা সবার জানার কথা নয়। আমিও যে জানি তেমন তা নয়। তবুও দুয়েকটা উদাহরণ যা শুনেছি
তার বেশি আমার জানা বা শোনার প্রয়োজন নেই। এর বীভৎসতার সঙ্গে নাস্তিকদের প্রতি ধর্মীয় রাষ্ট্রের
বর্বরোচিত আচরণের খুব একটা তফাৎ নেই। কথিত আছে যে কমরেড লেনিন স্বয়ং অনেক পাদ্রী ও ধর্মীয়
নেতার প্রাণহরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেসব হয়ত অনেকেরই জানা। আমি শুধু সেসময়কার একটি
বিখ্যাত গাণিতিক গোষ্ঠী কিভাবে নিগৃহীত হয়েছিল, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেব।
বলশেভিক আন্দোলনের নেতারা নতুন রাষ্ট্র গঠন করেন ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে। তার ৪ বছর আগে, দ্বিতীয় নিকোলাস
জারের শাসনকালে, রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত গ্রীক দ্বীপ এথসের ‘নাম উপাসকদের’ (Name Worshippers)
আখড়া বা মঠের ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয়, যাতে অনেক, অনেক নিরস্ত্র সন্ন্যাসী নিহত হন। যারা প্রাণে
বেঁচে গিয়েছিলেন  তাদের নির্বাসনে পাঠানো হয় রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডতে। উদ্দেশ্য ছিল, তারা যেন জীবনেও যীশুর
নাম উচ্চারণ করার সাহস না পায়। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস, তা যতই অযৌক্তিক আর হাস্যকরই হোক, জোর
করে তার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা কোনদিনই সফল হয় না, যেমন সফল হয়না যে-কোনও গোষ্ঠীবদ্ধ সংস্কৃতির
গোড়া কেটে ফেলার চেষ্টা। ওটা কোন-না-কোনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবেই একদিন। রাশিয়ার নাম-
উপাসকদের বেলাতেও ঠিক তা’ই হল। আগে যা করতেন তারা প্রকাশ্যে এখন সেটা করতে লাগলেন গোপনে,
লোকচক্ষুর আড়ালে। ঠিক যেভাবে বলশেভিক বিপ্লবের নেতারা করতেন জারের দৃষ্টি এড়িয়ে
যাকে বলে ‘আণ্ডারগ্রাউণ্ড’। মজার ব্যাপার যে সেসময় এই ‘জিকিরবাদী’দের দলে যোগ দেন বেশ কিছু
প্রথম সারির গণিতজ্ঞ। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন দিমিত্রি এগরফ, নিকোলাই লুজিন, পাভেল
ফ্লোরিন্সকি, প্রমুখেরা। এঁদের খ্যাতি কেবল রাশিয়াতেই নয়, সারা বিশ্বজোড়াই তাঁদের নামধাম ছিল এঁরা যে
কিভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন ‘জিকিরকারি’দের নামজপের আখড়াতে সেটা কিছুতেই বোধগম্য
হয়না আমার। যাই হোক, এটাই তাঁদের বিশ্বাস, এবং এই বিশ্বাস নিয়ে কারো কোন ক্ষতিসাধনের চেষ্টা তাঁরা
কখনোই করেননি। নবীন সোভিয়েট রাষ্ট্রের নেত্রীবর্গ তখন ‘ধর্ম’ শব্দটাকে উৎখাত করার জন্য বদ্ধপরিকর।
এর মূলোৎপাটনের ওপরই যেন নির্ভর করছিল রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।  ঠিক যেভাবে পৃথিবীর ধর্মীয় রাষ্ট্রগুলি
নাস্তিক দূরীকরণের জন্যে সকল শক্তি ব্যয় করেন, যেন এরই ওপর তাদের ইহকাল পরকাল উভয়েরই অস্তিত্ব
নির্ভর করে ( আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশ বাংলাদেশের বর্তমান গতিবিধি দেখে এমন ধারণা করা হয়ত ভুল
হবে না যে এই দেশটিও অচিরেই আরেকটি ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হতে যচ্ছে)। আজকের পাকিস্তান বা ইরাণে
যেমন ‘নাস্তিক’ হওয়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া খুবই স্বাভাবিক, গত শতাব্দীর বিশ কি ত্রিশ দশকে সোভিয়েট
ইউনিয়নে ‘আস্তিক’ হওয়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড লাভ করাও ছিল অনুরূপ স্বাভাবিক।

যা বলছিলাম। তিন গাণিতিকের মাঝে সবচেয়ে বেপরোয়া ছিলেন পাভেল ফ্লোরিন্সকি। যেখানে এগরফ আর
লুজিন একটু রাখাঢাকা করে কথা বলতেন, যদিও তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের খবর কারুর অজানা ছিল না, সেখানে
ফ্লোরিন্সকি ছিলেন একেবারে খোলামেলা। তিনি যেখানে যেতেন সেখানেই পাদ্রীদের লম্বা পোশাক পরিহিত
অবস্থাতেই যেতেন, যাতে কারো দৃষ্টি না এড়ায়। তাঁর মত দুঃসাহসী, অবাধ্য লোকেদের কপালে যে বিপদ
অবশ্যম্ভাবী সেটা তো বলাই বাহুল্য। একটা মিটিংএ ঐ পোশাকে বক্তৃতা করাকালে তিনি সাক্ষাৎ ট্রটস্কির
সামনে পড়ে গেলেন। ট্রটস্কি তো তাঁর ঔদ্ধত্য দেখে স্তম্ভিত। সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “এই
 উজবকটা এল কোত্থেকে?”
ওঁর পরিণতি কি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সোভিয়েট সরকারকে এভাবে বুড়ো
আঙ্গুল দেখিয়ে যে বেশিদিন পৃথিবীর আলোবাতাস ভোগ করা সম্ভব নয় সেটা তিনি নিশ্চয়ই জানতেন---পরোয়া
করেন নি, এই যা। একসময় ‘নিরাপত্তা বাহিনীর’ হাতে ধরা পড়েন পাভেল ফ্লোরেন্সকি। শোনা যায় যে জেলের
ভেতরে একদিন তাঁকে উলংগ করে নিয়ে যাওয়া হয় বধ্যভূমিতে---যেখানে আরো গুটিকয়  ‘রাষ্ট্রবিরোধী’কে
একসাথে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে এক করুণ কাহিনী। অসম্ভব সরলপ্রকৃতির মানুষ ছিলেন
তিনি, সেটা তাঁর ঘোর শত্রুরাও স্বীকার করতেন।
বাকি দুজন, এগরফ ও লুজিন, ফ্লোরিন্সকির শেষ পরিণতি দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। লুজিন ততটা
ভোগেননি, কিন্তু এগরফ সাবধান থেকেও ছাড়া পাননি শেষ পর্যন্ত। লোকটা এতই বিখ্যাত ছিলেন একসময়
যে সোভিয়েট ইউনিয়নের গণিতপরিষদের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তিনি ধরে
রাখতে পারেন নি। তাঁর সহগাণিতিকরাই তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষের কাছে। তিনি সব হারিয়ে প্রায়
কপর্দকশূণ্য অবস্থায় চূড়ান্ত অপমান-লাঞ্ছনা সহ্য করার পর মৃত্যুমুখে পতিত হন একা একা,সবার আড়ালে।

পাঠক যেন ভেবে না বসেন যে আমি কমুনিজম পছন্দ করিনা বলেই এসব লিখছি। না, মোটেও তা নয়।
নাস্তিকতা আস্তিকতার মধ্যে বাছাই করতে বললে আমি বরং নাস্তিকদেরই পক্ষ নেব। তার কারণ এই নয়
যে আমি নিজে নাস্তিক। নিজে যাই হই না কেন আমি যে-কোনরকম মানসিক নিয়ন্ত্রণের ঘো্র বিরোধী।
ভয়ভীতি দেখিয়ে কাউকে ‘সুপথে’ আনবার চেষ্টা করাকে আমি কখনোই সমর্থন করব না। তাই ক্ষমতা যখন
মানুষের মৌলিক স্বাধীনতাকে খর্ব করার চেষ্টা করে তখনই আমি সোচ্চার হয়ে উঠব সেটা ধর্মের ক্ষমতা
হোক আর বিধর্মেরই হোক।
প্রশ্ন দাঁড়ায়ঃ সংসারে কি এমন কোনও মতবাদ নেই যা সত্যিকার অর্থেই মানবকল্যান্মুখি? যেখানে মুক্তবুদ্ধি
ও মুক্তচিন্তার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে? যেখানে সরকারবিরোধিতা মানেই রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়? যেখানে মতের মিল
না হলেই জীবন বিপন্ন হয় না? যেখানে সব নাগরিককে এক ঝুড়িতে ঢোকানোর চেষ্টা করা হয় না? যেখানে
তীক্ষ্ণ, উদ্ধত ও দুর্বিনীত প্রশ্নকে প্রশ্নের ধৃষ্টতার অপরাধে অন্তরীণ করার পরিবর্তে বরং স্বাগত জানানো হয়?
সর্বোপরি, যেখানে পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহসহ সংসারে কোনকিছুই প্রশ্নাতীত বলে গণ্য করা হয় না?
এমন প্রশ্নের জবাব কি আছে কারো কাছে?
পশ্চিমের উন্নততর সমাজে যাদের জন্ম তারা হয়ত একবাক্যেই বলবেনঃ আছে, অবশ্যই আছে। এই দেখুন
না, আমরাই তো সেই সমাজ। আমরা, এবং আমাদের মত পশ্চিমের সব গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে আমরা
ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার আদর্শে দীক্ষিত হয়েই বড় হয়েছি----এটা আমাদের রক্তের ভেতরে প্রবেশ করে
গেছে।
পক্ষান্তরে, আমরা যারা পশ্চিমে জন্মাইনি, কিন্তু জন্মভূমি ত্যাগ করে পশ্চিমে এসে বসবাস স্থাপন করেছি,
তাদের দৃষ্টিভঙ্গী হয়ত একটু ভিন্নই হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিজ্ঞতা বহুলাংশেই ইতিবাচক---
সম্ভবত ষাটের দশকের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ও বাড়ন্ত সময়ে চলে আসার সুযোগ হয়েছিল বলে। এদেশে
সারাজীবন থেকে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি আমি, কিন্তু এদেশের মুক্তসমাজের মুক্ত আবহাওয়ার আকর্ষণ
প্রতিরোধ করার শক্তি ছিল না আমার, বিশেষ করে নিজের দেশের রাজনৈতিক আকাশ যখন দুর্যোগের
ঘনঘটাতে সমাচ্ছন্ন হয়ে উঠছিল। পশ্চিমের বিষয়বৈভব কখনোই আমাকে টানেনি, কিন্তু একটু মন খুলে কথা
বলতে পারা, প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে প্রচলিত প্রথা, প্রচলিত বিশ্বাসের ভিত্তি টলমল করে তোলার স্বাধীনতাটুকুর
মূল্য আমার কাছে অপরিসীম। ওই স্বাধীনতাটুকু আমার অভাগা দেশে নেই। এদেশে সেটা আছে। তাই থেকে
যাওয়া এতকাল।
জানি, লোকে কি বলবে আমাকে। পশ্চিমঘেঁষা, পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া----ওই গদবাঁধা বুলিগুলো। এই শব্দগুলোর
অর্থ আমি আগে ভাল বুঝতাম না, এখন কিছুটা বুঝতে শুরু করেছি। আশা করি আমার সমালোচকরা বোঝেন।
না, পশ্চিম একেবারে তুলসিধোয়া পুন্যধাম নয়। এখানেও স্বাধীনতা নিঃশর্ত নয়, সীমানা রয়েছে পরিষ্কার দাগ-
কেটা দেয়া, যার বাইরে যাওয়া যাবে না। এই শর্তগুলো সবসময় যুক্তিযুক্তও মনে হয়না। পঞ্চাশ দশকের কথা
যাদের মনে আছে তারা এর মর্ম ভাল করেই বুঝবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মুক্তবিশ্বের বড় মুরুব্বি বলে জোরগলায়
দাবি করতে যারা ভালবাসেন, সেখানে ‘ম্যাকার্থিজম’ নামক এক ঘোর বিভীষিকা দীর্ঘদিন টুঁটি টিপে রেখেছিল
জনজীবনকে। প্রতিটি নাগরিকই যেন গুপ্তনাহিনীর সন্দেহের পাত্র----সকলেরই ভয় কখন না তাকে ‘দেশের
শত্রু’ বলে ঘোষণা করা হয়। তাহলে তো সর্বনাশ----তার পরিবার তাকে চোখে দেখারও সুযোগ পেত না।
মুক্তবিশ্বের সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মনে নিরাপত্তা-বোধ বলতে কিছু ছিল না। আমি তখন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র----বাম রাজনীতিতে সরাসরি সংযুক্ত না থাকলেও সেযুগে বামপন্থী, মানে,
কমুনিস্টদরদী হওয়াটাই ছিল হালের ফ্যাশান----বর্তমান যুগের বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে যেমন হয়েছে
ইসলামবাদী হওয়া। পঞ্চাশের সেই লোমহর্ষক ঘটনা, রোজেনবার্গ দম্পতির দীর্ঘ বিচারশেষে  তাঁদের
মৃত্যুদণ্ড, কোনদিনই ভুলবার নয়। তাঁরা কি সত্যি সত্যি অপরাধী ছিলেন----মানে সোভিয়েট ইউনিয়নের
গুপ্তচর? তার সত্যমিথ্যা কখনোই অকাট্যভাবে প্রমাণ হয়নি---সেরহস্য চিরকাল রহস্যই থেকে যাবে। ক্ষমতা
যখন মাত্রা ছাড়িয়ে একাধিপত্যের পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন মুক্তবিশ্ব আর রুদ্ধবিশ্বের সূক্ষ্ণ আবরণটুকুও
ভীষণ ঝাপসা হয়ে যায়। সেই যে বললাম একটু আগে, পরম সত্য আসলে মুক্ত আর রুদ্ধ নয়, পরম
সত্য হল ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন। ক্ষমতাহীনরাই যাকে আমি বলি পূজারী, আর শিকারী হলেন এই ক্ষমতাধর
মানুষগুলো। এই দুটি দলই পৃথিবীটাকে মোটামুটিভাবে দখল করে রেখেছে। বাকি রইলেন মুষ্টিমেয় কিছু পূজ্য-
জন----যাদের মধ্যে আমি অন্তর্ভুক্ত করি যুগান্তকারী বিজ্ঞানীদের, আর করি উইলিয়াম সেক্সপীয়ার, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর, টলস্টয়, আর গ্যটের মত কালজয়ী বিশাল ব্যক্তিদের। আর হ্যাঁ, পূজ্যব্যক্তিদের দলে আমি সত্যিকার
সাধুসজ্জনদেরও উল্লেখ করতে কার্পণ্য করব না---যেমন সুফি শাহজালাল, নিজামুদ্দিন আওলিয়া, গৌতম
বুদ্ধ, জুরায়াষ্ট্র আর কনফুসিয়াস। নমস্য ব্যক্তিরা যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলেই সভ্যতার মশাল প্রজ্জ্বলিত
থাকতে পেরেছে অদ্যাবধি।
কিন্তু সবার শেষে যে সত্যটি কিছুতেই মুছে ফেলার উপায় নেই তা হল, সবচেয়ে নিচের জায়গাটিতে বসে যারা
চিরকাল সমাজের কোপদৃষ্টির সম্মুখিন হয়েছে তাদের অন্তহীন জিজ্ঞাসা, সংশয় আর অনুসন্ধিৎসার প্রবণতা
দ্বারা, যারা প্রচলিত প্রথাকে অনুক্ষণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলেছে, যারা ঘোর আস্তিকের দেশে নাস্তিক
পরিচয়ে পরিচিত হতে কুন্ঠিত নয়----সেই দুরন্ত, দুঃসাহসী সংশয়ী জাতিটি সমাজের যত পুঞ্জীভূত আবর্জনা,
সব মোচন করে নতুন দিনের সূর্যোদয়ের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। আজ, জাতির এই চরম দুর্দিনে, আমাদের
এই দুঃসাহসী ছেমেয়েগুলোকে, আততায়ীর তরবারির ঘা থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রতিটি দেশপ্রেমিক, বিবেক-
বান নাগরিকের। সেদায়িত্ব আমরা কতটা নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি তারই উপর নির্ভর করে জাতির
ভাবিষ্যৎ।

অটোয়া,
৩১শে মে, ২০১৩
মুক্তিসন ৪২

সূত্রঃ 1. Internet
      2. “God is not Great” by Christopher Hitchens, 2007, Warner Books,
      a division of Hatchete Book Group USA, Inc.
     3.”Many Worlds in One” by Alex Vilenkin,2006, Hill and Wang, New
       York.
     4. “Naming Infinity”,2009, by Loren Graham and Jean-Michel Kantor, The
        Belknap Press of Harvard University Press, Cambridge, Massachusetts.