মীজান রহমান
১৯৪৮ সালের ২১শে
মার্চ, বেলা দুটো। ঢাকা শহর খালি। চারভাগের
তিনভাগ লোকই রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে যা রমনা পার্ক বা সুরাবর্দি পার্ক নামে
পরিচিত)। আমার বয়স তখন ১৫ পার হয়েছে। ম্যাট্রিক
পরীক্ষার জন্যে তৈরি হচ্ছি। আমাদের স্কুলের প্রায় প্রতিটি ছাত্রই উপস্থিত সেখানে----মাস্টাররাই
সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি একেবারে সামনে সারিতে। গত সপ্তাহের
প্রায় পুরোটাই বলতে গেলে ছুটি ছুটি ভাব ঢাকায়----উৎসবমুখর প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, রাস্তাঘাট। কয়েক
পা পর পর সাজানো গেট, তোরণ। ছেলেমেয়েদের গায়ে নতুন কাপড়, বয়স্কদের মাথায় জিন্না
টুপি, কারো কারো জিন্না কায়দার শেরোয়ানি।
উপলক্ষ? ঢাকায় আজকে
আসমান থেকে এক বিশাল ব্যক্তি অবতরণ করেছেন। তাঁর ভাষণ শুনব আমরা---ঐতিহাসিক ভাষণ। আমরা
উদগ্রীব, আমরা উৎকন্ঠ,
আমরা উত্তেজিত বক্ষে উপবিষ্ট রমনার সবুজ ঘাসের ওপর। আজ আমরা
কায়েদে আজমকে স্বচক্ষে দেখতে পাব। স্বকর্ণে তাঁর বাণী শুনতে পাব। তাঁর
বলিষ্ঠ কন্ঠের বজ্রধ্বনি আমাদের কিশোর প্রাণকে সিক্ত করবে আনন্দধারাতে, অনুপ্রাণিত
করবে। সেকালে পাকিস্তানের কোন মুসলমানই তাঁকে মুহম্মদ
আলী জিন্না বলে সম্বোধন করতে পারত না, বলতে হতঃ কায়েদে আজম ( শ্রেষ্ঠ নেতা)। (বাংলাদেশে যেমন একটা সময় ছিল যখন শেখ মুজিবুর
রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ না বললে মহান নেতাকে অসম্মান করা হচ্ছে বলে ধরা নেওয়া হত। এবং
অনেক মহলে সেই প্রথাটি এখনও প্রচলিত)।
‘কায়েদে আজম’ এলেন,
যথাযথ শানসওয়কতের মধ্য দিয়ে। লাখো জনতা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলঃ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’। ‘নারায়ে তাকবিরঃ আল্লাহু আকবার’। রমনার
তপ্ত আকাশ দেশাত্মবোধের উত্তেজনাতে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডতে পরিণত হয়ে গেল। তিনি
মঞ্চে আরোহণ করলেন ধীরে, সুনিশ্চিত পদক্ষেপে। মহান
নেতারা যেভাবে মঞ্চারোহণ করেন সচরাচর ঠিক ঐভাবেই। আমরা
দাঁড়ালাম। শ্রদ্ধাবনত শিরে কুর্নিশ জানালাম শ্রেষ্ঠ নেতাকে। তাঁর
উদাত্ত কন্ঠের পরিষ্কার ইংরেজি উচ্চারণে উচ্চারিত প্রতিটি বাণী, প্রতিটি শব্দ, ঐহীবাণীর
মত সুধাবর্ষণ করে গেল আমাদের কর্ণকুহরে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম মহান নেতার মহান বাণী।
তারপর। সেই
মুহূর্তটি। ইতিহাসের জ্বলন্ত, সমগ্র মহাদেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি-করা
সেই জ্বাজ্জল্যমান মুহূর্তটি, সামনে এসে দাঁড়ালো। “ Urdu, and Urdu alone, shall be the state language of
Pakistan.”
আমার ১৫ বছরের নেতামুগ্ধতার
অন্ধ নেশাতে আক্রান্ত কর্ণতে সেই আশ্চর্যরকম বাঙ্গালিবিদ্বেষী বার্তাটিও সেদিন অমৃতসুধার
মতই পরম সুমিষ্ট মনে হিয়েছিল। আমরা, ঢাকার এক-চতুর্থাংশ জনতা, সামনের সারিতে-বসা
অর্বাচীন কিশোরকিশোরীরা, তখন বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে শুনতে পেলাম, দূরে, ময়দানের একেবারে
পেছন দিকটাতে, আজকের সর্বোচ্চ আদালত যেখানে, সেখান থেকে একটা ক্ষীণ, প্রায় অস্ফূট ধ্বনি,
কেঁপে কেঁপে, বসন্তের মন্দ বাতাসের ছন্দে ভেসে ভেসে, মহান নেতার মঞ্চে এসে প্রতিবাদ
জানিয়ে ঘোষণা করলঃ “ No.
No. No”
কে রে তোরা এই দুরন্ত
শয়তানেরা? এত বড় সাহস তোদের! যে মানুষ তোদের পাকিস্তান এনে দিয়েছেন সোনার থালায় করে,
যে মানুষ তোদের অতীত ভবিষ্যত সবকিছুরই বিধাতৃস্থানীয়, সেই মানুষটিরই মুখের কথার ওপর
কথা বলার সাহস পাচ্ছিস? সেদিন ঢাকার এক-চতুর্থাংশ জনতার ১০০ ভাগের ৯০ ভাগই ছিল ওই দুঃসাহসী
ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে। ‘কায়েদে
আজম’ তাদের দেশের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমরা,
মূর্খ দেশের মূর্খ জনতা, মহান নেতার মহানত্বের মহিমাতে বুঁদ-হয়ে-থাকা অন্ধ জনতা সেদিন,
ওই ‘বেতমিজ’ ছাত্রগুলোকে আচ্ছা করে বকুনি দিলাম, মনে মনে।
‘মূর্খ জনতা’ নামটি
নেহাৎ অমূলক নয়। আসলেই
আমরা মূর্খ। যে-নেতাকে আমরা পছন্দ করি তাকে একসময় প্রায় পূজা
করতে শুরু করি। তার প্রতিটি শব্দই আমরা অকাট্য সত্য বলে গ্রহণ করে
নিই। অমৃতের মত পরম ভক্তিভরে পান করি। আবার
সেই একই নেতা যদি কোনও কারণে আমাদের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন তাহলে আল্লাপাক তার সহায় না
হলে আমরা, সেই মূর্খ জনতাই, তাকে পায়ের নিচে পিষে মারব। আমরা,
যাকে আমি মূর্খ জনতা বলে অভিহিত করছি, যা থেকে আমি নিজেকে ব্যতিক্রম বলে দাবি করছিনা,
আমাদের নেতাকে হয় পূজার মণ্ডপে স্থাপন করে উপাসনা করি, নয়তবা মাটিতে নামিয়ে অবমানিত
করি। কেবল নেতাকে অনুসরণ করতেই শিখিনি কখনও।
এটি বুঝতে বেশ সময়
লেগেছিল আমার। বুঝবার মত বয়স এবং কিঞ্চিৎ আক্কেল যখন আহরণ করা গেল তখন দেশের ক্ষয়ক্ষতি যা
হবার হয়ে গেছে। আমার ব্যক্তিগত বোধোদয়, বা স্বপ্নভঙ্গ, যা’ই বলুন,
যা হল তার সারমর্ম এইঃ ১৯৪৮ সালে রমনার আমজনতাই কেবল মূর্খ ছিল না, আমাদের সেই মহান
নেতাটিও একই রকম মূর্খ ছিলেন, সম্ভবত, সেই পেছনের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা দুঃসাহসী
ছাত্রগুলোর চাইতেই মূর্খ এবং অজ্ঞ। তিনি কুটিল রাজনীতি জানতেন সেটা মানি। আইনের
মারপ্যাঁচ বেশ ভালো করেই জানতেন সেটাও মানতে রাজি , গান্ধী আর নেহরুর মত জাঁদরেল নেতাদের
সঙ্গে তর্কযুদ্ধে একশতে একশ নম্বর পাওয়ার যোগ্যতাও হয়ত ছিল তাঁর। দেশের
আপামর মুসলমান সম্প্রদায়কে হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার ক্ষমতা তাঁর ছিল
বিস্তর, তাতেও কোন সন্দেহ প্রকাশ করছি না আমি। কিন্তু
তিনি ইতিহাস জানতেন না। তিনি বিজ্ঞানে বকলম। সাহিত্যে
নিরক্ষর, ভাষাশাস্ত্রের ওপর একটা বইও কোনদিন পড়েছিলেন কিনা সন্দেহ। তিনি
নিজে কতখানি সভ্য ছিলেন বলা মুশকিল, কিন্তু সভ্যতা উদয় হয় কিভাবে, তারপর অস্তই বা যায়
কেন এবং কিভাবে, সেসম্বন্ধে কোন ধারণাই বোধ হয় তাঁর ছিল না। যদি
থাকত, যদি না হতেন তিনি এমন অবিশ্বাস্যরকম অজ্ঞ পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়াদিতে, তাহলে সেদিন
রমনার ময়দানে দাঁড়িয়ে, নীল আকাশের তপ্ত সূর্যকে সাক্ষী রেখে কিছুতেই উচ্চারণ করতে পারতেন না “উর্দুই
হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”।
মুহম্মদ আলী জিন্নার
সেই অজ্ঞতার পরিমাণ সম্পূর্ণ অনুধাবন করার জন্যেও যে নিজের কিঞ্চিৎ জ্ঞান আহরণের প্রয়োজন হয়, আমি সলজ্জবদনে স্বীকার
করছি যে সেটুকু আমার ছিল না। পড়াশুনা যা ছিল সবই ভাসা ভাসা। কিছুটা
বইপত্রে পড়া, বেশির ভাগই লোকমুখে শোনা। শেষে আমার নিজের অজ্ঞতার মুখোশ খুলে গেল সৈয়দ মুজতবা
আলীর “ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ার পর।
সৈয়দ মুজতবা আলী
ভারত উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণিজনদের একজন ছিলেন সেটা, আশা করি, কারুরই
অজানা নয়। তিনি একাধারে সর্বোচ্চ মানের লেখক, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ,
ঐতিহাসিক, শিক্ষক ও বাগ্মী। তাঁর জন্ম ১৯০৪ সালে, সিলেটের করিমগঞ্জ অঞ্চলে। খুব
ছোটবেলাতেই তাঁর অসামান্য মেধা ও ধীশক্তির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। ১৯১৯
সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে, তিনি যোগাযোগ স্থাপন করেন তাঁর সেসময়কার (এবং পরবর্তীতে আজীবন)
পূজ্যপুরুষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। চিঠিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর গুরুদেবকেঃ “ আচ্ছা,
উচ্চাকাংখা কাকে বলে”। সেই গভীর, দার্শনিক প্রশ্নের সূত্র ধরেই দুই মহাপুরুষের
মধ্যে কালে কালে একটা পরম হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যক্তিগত স্নেহ-ভক্তির সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আমরা, বর্তমান যুগের
বাংলাদেশী শিক্ষিতসমাজ, যার মধ্যে অজ্ঞতাবশত আমি নিজেকেও মাঝে মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে
ফেলি নির্লজ্জভাবে, হয়ত অনেকেই জানিনা যে পাকিস্তানের সেই প্রথমযুগে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে
যে দারুণ একটা বিতর্ক শুরু হয়েছিল পূর্ব আর পশ্চিমের মাঝে, সেই বিতর্কের একেবারে প্রথম
সারিতে উপস্থিত ছিলেন এই অসাধারণ মানুষটি----সৈয়দ মুজতবা আলী। করাচীর
মুরুব্বিরা যখন চোখ রাঙ্গিয়ে, একতরফাভাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের
রাষ্ট্রভাষা, এবং সে অনুযায়ী তাঁরা সরকারি দলিলপত্র থেকে মুদ্রা নোট সব উর্দুতেই প্রচার
শুরু করেছেন, তখন তার বিরোধিতা করার মত সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের
মধ্যে পুরোপুরি দানা বেঁধে ওঠেনি। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের প্রথম শিখাটি প্রজ্বলিত হয়েছিল
তখন ঢাকায় নয়, সিলেটের এই ৪৩ বছর বয়স্ক সুধীজনের উদাত্ত কন্ঠ ও জ্ঞানসমৃদ্ধ যুক্তির
মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালের ৩০শে নভেম্বর, অর্থাৎ ভারতবিভক্তির মাত্র সাড়ে তিন মাস পর, সিলেটের কেন্দ্রীয়
সাহিত্য সংসদের এক বক্তৃতায় তিনি ইতিহাসের অনেক নজির তুলে, অনেক যুক্তিতর্ক দাঁড় করিয়ে
‘উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণাটির বিপক্ষে অত্যন্ত বলিষ্ঠ একটি কন্ঠ সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর,
বগুরার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত থাকাকালে, সিলেটের সাহিত্য সংসদে প্রদত্ত
ভাষণকে ভিত্তি করে যে দীর্ঘ প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন তিনি সেই প্রবন্ধটিকেই আমি আজকে
আমার বর্তমান নিবন্ধের প্রধান সূত্র হিসেবে নির্বাচন করেছি। পাকিস্তানের
রাষ্ট্রভাষা কেন কেবল উর্দু না হয়ে উর্দুবাংলা উভয়েরই সমান অধিকার থাকা দরকার তার সপক্ষে
জোরালো যুক্তি খুঁজতে যদি চান কেউ তাহলে এই “পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” প্রবন্ধটি
পড়লেই যথেষ্ঠ। লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, কোলকাতার
‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায়। এই অসাধারণ লেখাটি মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হবার
পর করাচীর প্রভুরা স্বভাবতই খুব নাখোশ হয়ে তাঁকে পত্রযোগে ওই বেয়াদপির ব্যাখ্যা দাবি
করেছিলেন। করাচীর মূর্খ উর্দুওয়ালাদের কাছে কোনরকম ব্যাখ্যা
দেওয়ার মত রুচি যে মুজতবা আলীর ছিল না সেটা যে কোন স্থূলমস্তিষ্ক ব্যক্তির পক্ষেও বোঝা
সহজ। তিনি পত্রপাঠ পদত্যাগ করে রওয়ানা হলেন পশ্চিম বঙ্গের
পথে যেখানে তাঁর মেধার কদর বোঝার মত মানুষ প্রচুরই ছিল।
সৈয়দ মুজতবা আলীর
নিবন্ধের ভিত্তিতে আমাদের ভাষা আন্দোলনের নাতিদীর্ঘ আলোচনাতে পৌঁছানোর আগে আমি, পাঠকের
সহৃদয় অনুমতিক্রমে, আমার ব্যক্তিগত একটিদুটি মন্তব্য পেশ করতে চাই। উদ্দেশ্য,
ইতিহাসের একটি প্রায়-বিস্মৃত দৃশ্যের ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত। বিংশ
শতাব্দীর একেবারে প্রথম দিককার ঘটনা সেটা। ব্রিটিশ ভারতের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তখন লর্ড কার্জন। ব্রিটেনের
প্রভুরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে প্রশাসনের সুবিধার্থে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাদেশিক
সীমানাগুলোর সংস্কার দরকার। সে অনুযায়ী ১৯০৫ সালে বাংলার সীমারেখা ভাংচুর করে
ঠিক হল যে পশ্চিম ভাগ যাবে আসামের সঙ্গে, আর পূর্বভাগ ভিন্ন একটা প্রদেশে পরিণত হবে,
এবং বড় কথা, সেই পুনঃগঠিত প্রদেশটির রাজধানী হবে ঢাকা, কোলকাতা নয়। এই সিদ্ধান্তের
সবচেয়ে উৎসাহী
সমর্থক যে বাংলার মুসলমানরাই ছিলেন প্রধানত সেটা তো বলাই বাহুল্য। সাথে
সাথে কারা ছিলেন এর ঘোর বিরোধী সেটাও সহজেই অনুমেয়----হিন্দু বুদ্ধিজীবি ও মধ্যবিত্ত
সমাজ। ঢাকা রাজধানী হলে যে তাঁদের প্রভাবপ্রতিপত্তি রাতারাতি
উধাও হয়ে যেতে বাধ্য সেটা তাঁরা ভাল করেই দেখতে পাচ্ছিলেন। সুতরাং
এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রতিবাদ। সেই
প্রবল বিরোধিতার একেবারে শিরোভাগে, অনেকটা নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশ নিয়েছিলেন সেসময়কার
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম তারকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আন্দোলনের
সপক্ষে তিনি বেশ কিছু কবিতা ও গান রচনা করেছিলেন, যার অন্যতম হল “ আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি”। এই অসাধারণ গানটি তিনি লিখেছিলেন বঙ্গভঙ্গের বিরোধী
শক্তিকে দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে তোলার আকাংখাতে---এবং তা তারা
হয়েও ছিল। সেই বঙ্গভঙ্গবিরোধী অমর গানটিই আজকে আমার নানা খণ্ডে
ভগ্ন-হয়ে-যাওয়া দেশটির জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়ে গেছে। এতে
যদি ইতিহাসচেতন কোনও অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি কিঞ্চিৎ বিড়ম্বনা খুঁজে পান তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করা কি ঠিক হবে?
যাই হোক, বঙ্গভঙ্গের
পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাতেল করতে হয়েছিল প্রচণ্ড বিরোধিতা ও আন্দোলনের ফলে। হিন্দু
মধ্যবিত্ত শ্রেনী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, সাথে সাথে মুসলিম ভঙ্গপন্থীরা হলেন নিদারুণভাবে
মর্মাহত। ব্রিটিশ এবং হিন্দু সমাজ উভয় শক্তির বিরুদ্ধে তাঁরা
ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে চরম মুসলিম-বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে----তাঁরা
যে আগাগোড়াই প্রচণ্ডরকম সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন সেই সত্যটাই প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। ব্রিটিশের
বিরুদ্ধে নালিশঃ তোমরা কথা দিয়ে কথা রাখনি, বিশ্বাসঘাতকতা করেছ আমাদের সঙ্গে। সম্ভবত
তখনই তৎকালীন মুসলিম নেতারা সিদ্ধান্ত
নিয়ে ফেললেন যে তাদেরও একটা সমান্তরাল রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার যার মাধ্যমে
বাংলার মুসলমান সমাজের আশাআকাংখাগুলো প্রকাশ করার একটা বলিষ্ঠ কন্ঠ তৈরি হয়ে যাবে----যাতে
করে তাদের দাবিদাওয়াকে কেউ অগ্রাহ্য করার সাহস না পায়।
সে অনুযায়ী নবাব
সলিমুল্লার নেতৃত্বে রমনার ইরশাত মঞ্জিলে ( যেখানে পরবর্তীকালে শাহবাগ হোটেল স্থাপিত
হয়), ১৯০৬ সালে, স্যার সৈয়দ আহমেদ প্রতিষ্ঠিত মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের বার্ষিক
অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে সর্বমোট ৪০০০ সদস্য অংশগ্রহণ করেন। তারা
যে সকলেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই এসেছিলেন কেবল তা নয়, অনেকে বিহার আর উত্তর প্রদেশ
থেকেও ট্রেনে করে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। বড় কথা, সেই অধিবেশনেই সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করা হয় যে বাংলা এবং সর্বভারতের মুসলিমদের পক্ষ থেকে ‘অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগ’
নামক একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হোক। ১৯৩০ সালে সেই প্রতিষ্ঠানটি আরো জোরদার হয়ে ওঠে
বিবিধ রাজনৈতিক কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে, এবং সেটাও ঘটে প্রধানত ঢাকাতেই।
ইতিহাসের ধূলোঝাড়া
পাতা থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটুকু উদ্ধার করে এখানে তুলে ধরার উদ্দেশ্যঃ পাঠককে সচেতন
করে দেওয়া যে সেসময়কার মহান নেতা কায়েদে আজম সম্ভবত এই ইতিহাসটুকু সম্বন্ধেও ওয়াকেফহাল
ছিলেন না যে তাঁর সাধের পাকিস্তান নামক দেশটির বীজটি পশ্চিমের উর্দুভাষী অঞ্চলে উপ্ত
হয়নি, হয়েছিল পূর্ববঙ্গের বাংলায়-কথা –বলা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনসাধারণের প্রাণের
ভেতর। এত বুদ্ধিমান হয়েও যে কেমন করে লোকটা এই সাধারণ
তথ্যটুকু বেমালুম ভুলে গিয়ে একটা বিদেশী (বাঙ্গালিদের
জন্যে উর্দু অবশ্যই বিদেশী) ভাষাকে তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইলেন ভেবে অবাক হতে হয়।
এবার আর নিজের কথা
নয়। চলুন ওস্তাদের মুখ থেকেই শোনা যাক সবকিছু----অর্থাৎ সৈয়দ মুজতবা আলী।
মাতৃভাষা থেকে রাষ্ট্রভাষা
পৃথক হওয়াটা যে একটা জাতির আত্মবিকাশ আর আত্মশক্তি প্রকাশের পথে কতখানি অন্তরায় হয়ে
উঠতে পারে সেই বিষয়টিকে তিনি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন চারটি ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ
করেঃ (১) ঐতিহাসিক; (২) অর্থনৈতিক; (৩) সামাজিক-রাজনৈতিক;
(৪) ভাষাভিত্তিক।
ঐতিহাসিক
মধ্যযুগের ষোড়শ শতাব্দী
পর্যন্ত সমগ্র খৃস্টান জগতব্যাপী ক্যাথলিক চার্চের একাধিপত্য বিস্তারের অন্যতম প্রধান
বাহন ছিল ল্যাটিন ভাষা, যা প্রায় কোনও খৃস্টানধর্মাবলম্বী ব্যক্তির মাতৃভাষা ছিল না। ওটা
ছিল মূলত চার্চের ভাষা, ধর্মশিক্ষা ও ধর্মচর্চার ভাষা। এবং
সেকালের শাসকশ্রেনীর ওপর চার্চের প্রচণ্ডরকম প্রভাব থাকার দরুণ উচ্চশিক্ষার প্রায় প্রতিটি
প্রতিষ্ঠানেরই মুখ্য মাধ্যম ছিল ল্যাটিন। যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবন যে অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের
অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল আদিকাল হতে সেই অন্ধকারের আবরণ কখনোই উন্মোচিত হবার সুযোগ পায়নি। শাসক
শ্রেনী চিরকাল কঠোর হস্তে কেবল শাসন-পীড়নই করে গেছে, আর শাসিত শ্রেনী কেবল শাসিত-শোষিতই
থেকে গেছে। সেই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রথম যে ব্যক্তিটি বুক
ফুলিয়ে প্রতিবাদ জানাতে এলেন তাঁর নাম মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬)।
চার্চের বিরুদ্ধে
লুথার সাহেবের অনেক নালিশই ছিল, যদিও তিনি নিজেও ছিলেন চার্চেরই লোক (হয়ত সেকারণেই
চার্চের আভ্যন্তরীণ গলদগুলো খুব ভাল করেই জানা ছিল তাঁর)। তার
মধ্যে একটি বড় অভিযোগঃ ভাষা। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে তার মাতৃভাষা বাদ দিয়ে
বিদঘুটে ল্যাটিন ভাষাতে বাইবেল শিখতে হবে কেন? তাঁর প্রতিবাদ ক্রমে ক্রমে এতটাই জোরালো
হয়ে উঠতে লাগলো যে সেই ধাক্কাতে সমস্ত চার্চটাই বলতে গেলে ভেঙ্গে দুটুকরো হয়ে গেল----উৎপন্ন হল খৃস্টধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত মতাবলম্বী দুটি
শাখা, রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট। সাথে সাথে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অনূদিত
হতে লাগল জার্মান ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষাতে। এই করে
খৃস্টান ধর্ম চার্চের শ্বেতপ্রকোষ্ঠ হতে বহির্গত হয়ে গৃহস্থের হৃদয়মন্দিরে প্রবেশ করে
গেল-----ধর্ম পৌঁছে গেল তাদের বোধগম্যতার আঙ্গিনাতে। সভ্যতার
ইতিহাস জুড়ে যতগুলো বড় বড় বিপ্লব ঘটেছে পৃথিবীতে তার মধ্যে মধ্যযুগীয় ইউরোপের এই ঘটনাটির
গুরুত্ব কোনক্রমেই নগণ্য নয়। আমার ব্যক্তিগত মতানুসারে ক্যাথলিক-প্রটেস্টান্ট
বিভক্তির পেছনে মার্টিন লুথারের সেই ভাষা-আন্দোলনের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। তার
অর্থ, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার গোড়ার ইতিহাসেই ছিল মাতৃভাষার অবদান।
উর্দুওয়ালাদের যুক্তিঃ
পাকিস্তান একটি সদ্যগঠিত মুসলিম রাষ্ট্র যার রাজধানী করাচীতে, যেখানে কেউ বাংলা বলে
না, বলে উর্দু। তদুপরি উর্দু হল স্বভাবতই ইসলামানুকূল ভাষা, বাংলা
নয়। তাই নাকি? প্রশ্ন তুললেন সৈয়দ মুজতবা আলী। প্রথমত
উর্দুর চাইতে হাজারগুণে বেশি ইসলামানুকূল ভাষা হল আরবি, যা নিজেও গোড়াতে খুব একটা ইসলামপ্রবণ
ছিল না। তাঁর প্রবন্ধ থেকে একটা পংক্তির পুরোটাই আমি উদ্ধৃত
করছি এখানেঃ
“ আরবি ভাষায় কুরাণ
শরিফ যখন অবতীর্ণ হলেন তখন সে ভাষার রূপ কি ছিল? সে ভাষা কি ‘পাক’ পবিত্র ছিল, না,
পৌত্তলিকতার গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল? আমরা জানি লাত, উজ্জা, মনাত, প্রভৃতি দেবদেবীর
প্রশস্তিতে সে ভাষা পরিপূর্ণ ছিল এবং একেশ্বরবাদ বা অন্য কোন সত্য-ধর্মের (খৃস্ট অথবা
ইহুদি) কণামাত্র ঐতিহ্য সে ভাষায় ছিল না”।
আমাদের বদ্ধমূল ধারণা
(বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমানদের) যে আব্দুল্লা, আবু তালিব, আবু লাহাব, জুবায়ের, এই
নামগুলো খাঁটি মুসলমান নাম। তাই কি? এই নামচতুষ্টয়ের মাঝে প্রথমজন ছিলেন আমাদের
মহানবীর পিতা, যিনি এন্তেকাল করেন পুত্রের জন্মগ্রহণ করার অনতিকাল পরে নয়, আগে। অর্থাৎ পিতার ভাগ্যেই
ঘটেনি নবজাত পুত্রের মুখদর্শন করবার। বাকি
তিনজন ছিলেন রসূল করিমের আপন পিতৃব্য। নিশ্চয়ই
তাঁরা সকলেই খাঁটি মুসলমান ছিলেন? ভুল। এই পিতৃব্যত্রয়ের একজনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। অতএব
তাঁদের নাম আরবি বটে, কিন্তু মুসলমান নয়। তাঁরা ছিলেন খাঁটি পৌত্তলিক।
সৈয়দ সাহেব আমাদের
জানিয়েছেন যে ইসলাম ধর্ম যখন বিশ্বপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হয় জিব্রায়েল ফেরেশতার মাধ্যমে তখন
সারা আরব জগতের সর্বাপেক্ষা ‘পবিত্র’ ভাষা বলে গণ্য ভাষা ছিল হিব্রু, যার একটি অপভ্রংশ
ছিল আরমাইক, এবং সেই আরমাইকের মাধ্যমেই ইসা (আঃ) তাঁর খৃস্ট ধর্ম প্রচার করেছিলেন। অতএব
মহান আল্লাতা’লা প্রেরিত তিনটি প্রধান ধর্মের প্রথম দুটিই যদি হিব্রু ভাষাতে অবতীর্ণ
হয়ে থাকে, এবং তার পেছনে তৎকালীন ভাষার কৌলিন্যই যদি মূল বিবেচনা হয়ে থাকে, তাহলে সেই একই যুক্তি
অনুসারে পবিত্র কুরাণও ঠিক সেই ভাষাতেই অবতীর্ণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু
তা হয়নি। হয়েছিল আরবিতে। এবং
কেন হয়েছিল তার ব্যাখ্যা জানার জন্য মৌলবিসাহেবের কাছে দৌড়ুবার প্রয়োজন এই, কোরাণের
পাতা ঘাটলেই পাওয়া যাবে। পরিষ্কার লেখা আছে সেখানে, এক জায়গাতে নয়, কমপক্ষে
সাত জায়গায় (উদাহরণ স্বরূপ ৪৩ঃ৩, ১৪ঃ১-২৭, ১৪ঃ৪ দেখুন), যে এই গ্রন্থটি প্রেরিত হল
আরবি ভাষাতে কারণ আরবিই সাধারণ আরববাসীদের মাতৃভাষা, এবং যে কোন নতুন জিনিস শেখার জন্য
সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ভাষা
হল তার মাতৃভাষা। দুঃখের বিষয় যে এই সহজ কথাটি আমাদের মোল্লা মৌলবিরা
কিছুতেই গ্রহণ করতে রাজি নন, এবং নন প্রধানত দুটি কারণে। একঃ
আমাদের দেশে আরবিতে কুরাণ পড়ে পড়ে এমন একটা অজ্ঞতার আবহাওয়া সৃষ্টি হয়ে গেছে যে সেই
রুদ্ধ পরিবেশে মাতৃভাষার মর্যাদা বোঝা সম্ভব নয় (ঠিক এমন আবহাওয়াই তৈরি হয়ে গিয়েছিল
মার্টিন লুথারের সময়কার ইউরোপে)। দুইঃ আরবির স্থলে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে
মোল্লাদের রুজিরোজগারের কি দুরবস্থা সৃষ্টি হয়ে যাবে ভেবে দেখেছেন? তখন কি সেপারা শেখার
জন্য মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে কেউ দাঁড়াবে টুপি-পাঞ্জাবী হাঁকিয়ে? বা হিজাব-বোরখা
পরে ছোট ছোট মেয়েরা যাবে পুরুষ ওস্তাদের কাছে? না, যাবে না। ঠিক
যেমন যায়নি মধ্যযুগের প্রটেস্টান্ট আন্দোলনের পর থেকে খৃষ্টান পরিবারের ছেলেমেয়েরা।
এটা ইতিহাসেরই কথা
যে হজরত ওমরের খিলাফতকালে (৬৩৪-৬৪৪) যখন সেসানিদশাসিত, জুরাষ্ট্রবাদী পারস্য আরব মুসলমানদের
দখলে চলে যায় তখন পারস্যের ফার্সি ভাষা ইসলামিক ভাষা ছিল না, ছিল অগ্নিউপাসকদের ভাষা,
যেমন আরবিও ছিল না আরব পৌত্তলিকদের ভাষা। (ধর্মের
চাইতে ভাষার ইতিহাস অনেক প্রাচীন)। কিন্তু সেকালের সাম্রাজ্যবাদী যুগের ধারাটাই এমন
ছিল যে বিজয়ী শক্তি বরাবরই চেষ্টা করেছে বিজিত রাষ্ট্রের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিচ্যুত
করে তাদের নিজেদের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। আরবরা ঠিক তা’ই করেছিলেন পারস্যে। পরে
উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য রাষ্ট্রে, এমনকি একশ বছর পর স্পেনেও। মিশরে
তাঁরা সফল হয়েছিলেন, কারণ তাঁরা সেখানে শুধু রাজ্যজয়ের অভিলাষে যাননি, বসবাস করার সঙ্কল্প
নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে আস্তে আস্তে আরবি আর স্থানীয় ভাষাতে মিলে একটা
ভিন্ন ভাষা সৃষ্ট হয়ে যায়, যা আরবদেশের আরবি থেকে একটু আলাদা, সেই মিশ্র ভাষাতেই বর্তমান
যুগের মিশরবাসীরা জীবনযাপন করেন। এই তথ্যগুলোও সৈয়দ মুজতবা আলী পরিবেশন করেছেন তাঁর
নিবন্ধে। কিন্তু পারস্যের ব্যাপারটা আলাদা। সেখানে
তাঁরা বাস করতে যাননি, শাসন করতে গিয়েছিলেন। এবং সেই শাসনের কারণেই তাঁরা চেয়েছিলেন আরবিকে দেশের
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। সাময়িকভাবে পারস্যবাসীরা তা গ্রহণ করে নিলেও শেষ
পর্যন্ত সেটা টিকে থাকেনি। থাকতে পারে না, কারণ প্রথমত একটা বিদেশী ভাষা কখনোই
মাতৃভাষার বিকল্প হতে পারেনা; দ্বিতীয়ত ফার্সি ভাষা আরবির চেয়ে শতগুণে সমৃদ্ধ ও ইতিহাসপুষ্ট। আজকের
মোল্লাশাসিত ইরাণেও ধর্মশিক্ষার মাধ্যম আরবি নয়, ফার্সি। তাহলে
কেন বলুন তো আমাদের দেশে বাংলাকে হটিয়ে আমরা উর্দু বা আরবিকে নেব।
সৈয়দ মুজতবা আলী
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা উল্লেখ করেছেন এপ্রসঙ্গেঃ “---বাংলাভাষার জন্ম হয়েছে হিন্দুধর্মের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে”। এই অসাধারণ উক্তিটির সঙ্গে মূর্খ উর্দুওয়ালাদের
চিরাচরিত নালিশ যে ‘বাংলা হিন্দুদের ভাষা’ কোনভাবে খাপ খায় বলে মনে হয় আপনার? সৈয়দ
সাহেব তাঁর যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন এভাবেঃ “ বুদ্ধদেব যেরকম একদিন বৈদিক ধর্ম ও তার বাহন
সংস্কৃতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৎকালীন দেশজ ভাষায় (পরে পালি নামে পরিচিত) আপন ধর্ম প্রচার
করেন, ঠিক সেইরকম বাংলাভাষার লিখিত রূপ আরম্ভ হয় বৌদ্ধ চর্যাপদ দিয়ে”। এই কথাগুলো
পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্থানের বাসিন্দারা নাহয় জানতেন না, কিন্তু সেকালের সর্বজননন্দিত
জাতির পিতা কায়দে আজমেরও জানা ছিল না সেটাই আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। তাই
বিজ্ঞজনেরা যখন বলেন জ্ঞানের কোনও সীমানা নেই, তখন ভাবি, অজ্ঞতারই বা সীমা কোথায়।
অর্থনৈতিক
ভাষার যে একটা অর্থনৈতিক
দিকও আছে সেটা হয়ত সবার চোখে পড়ে না সবসময়। কিন্তু মুজতবা আলীর প্রবন্ধ থেকে এটা পরিষ্কারভাবে
ফুটে উঠেছে যে একটা জাতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা। সেটা
আভ্যন্তরীন শিক্ষিত-অশিক্ষিত ধনী-দরিদ্র আর উচ্চ-নিম্ন জাতিভেদের বেলাতে যেমন সত্য,
বাইরের বিজেতাশক্তির বেলাতে তার চেয়ে হাজারগুণে বেশি সত্য। আরবরা
যখন পারস্যে যান তখন সরকারি চাকরিবাকরিগুলো, বিশেষ করে উঁচুবেতনের পদগুলো প্রায় সবই
ছিল আরবিভাষীদের জন্যে বরাদ্দকৃত। অনেকটা সেকারণেই উচ্চাকাংখী, শিক্ষিত, পারস্যবাসীরা,
খানিকটা দায়ে পড়েই আরবি ভাষাটি শিখে নিয়েছিলেন। ঠিক
একই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল কায়রোতে, টিউনিসে, এমনকি স্পেনের টলেডোতেও। একসময়
স্পেনের উপরতলার কর্মচারিরা, বুদ্ধিজীবিরা, প্রায় সকলেই আরবিভাষায় লেখালেখি আর কথোপকথনের
কাজ চালাতেন----সেখানকার উচ্চ মধ্যবিত্ত বলতেই বোঝাত যারা ফটাফট আরবি চালাতে পারে এমন
সম্প্রদায়, তারা মুসলমানই হোক আর ইহুদি-খৃস্টানই হোক। কিন্তু
বিজিত দেশগুলোর অল্পশিক্ষিত বা একেবারে গণ্ডমূর্খ আপামর জনসাসধারণের তা হয়নি-----কোন
দেশেই হয় না কখনোই। ফলে শ্রেণীতে শ্রেণীতে একটা বৈষম্য তৈরি হয়ে যায়
অবধারিতভাবে----শিক্ষাদীক্ষায় তো বটেই, বড় কথা, আর্থিকভাবে। প্রতিটি
সমাজেই শ্রেণীবৈষম্যের একটি মুখ্য বাহন হল তার ভাষা। সেটা
আমরা মোগল আমলে দেখেছি, যখন হিন্দু এবং স্থানীয় উচ্চশিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ,
শাসকের ভাষা অর্থাৎ ফার্সি,
আয়ত্ত করে অর্থনৈতিক বিভক্তির উর্ধতর শ্রেণীতে আরোহন করার সুযোগ করে নেন। পরবর্তীতে
ব্রিটিশ আমলে ঠিক একইভাবে আমরা শিখেছি ইংরেজি ভাষা, কেবলমাত্র প্রভুর সুনজরে পড়ার আশাতে।
উর্দুওয়ালাদের লক্ষ
ছিল আস্তে আস্তে বাংলাকে একেবারে মুছে ফেলা পাকিস্তানের ‘পবিত্র’ মাটি থেকে। তাদের
প্রস্তাবানুযায়ী গ্রামেগঞ্জের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হবে উর্দু। বাংলা
থাকতে পারে চাষাভূষাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে, কিন্তু সরকারি সহায়তাপুষ্ট শিক্ষাঙ্গনগুলোতে
বাংলা শেখানোর দরকার নেই, উর্দুই যথেষ্ঠ। বাঙ্গালিদের বুঝতে হবে যে তারা মুসলমান, উর্দু তাদের
মাতৃভাষা না হলেও ভবিষ্যতে তাই হতে হবে, কারণ তারা এখন স্বাধীন মুসলমান দেশের নাগরিক। বাংলা
হিন্দুর ভাষা, উর্দু মুসলমানের। সোজা হিসাব----উর্দুওয়ালাদের উর্বর মস্তিষ্ক অনুযায়ী। সৈয়দ
মুজতবা আলী প্রশ্ন তুললেনঃ সেই ‘হিন্দু’ ভাষাটির গোড়া কেটে তাকে ওপারের নির্বাসনে পাঠাবার
দায়িত্বটি পালন করা হবে কিভাবে? নিশ্চয়ই উর্দুওয়ালাদেরই স্কন্ধে আপতিত হবে সেই মহান
দায়িত্বটি, কারণ বাংগালরা তো নিজে নিজে একটা বিদেশী ভাষা শিখতে পারে না, যত পাক্কা
মুসলমানই তারা হোক। অতএব পশ্চিমের মুসলিম ব্রাদারদের কাছ থেকে সাহায্য
নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অর্থাৎ অতি অল্পবেতনে তুষ্ট থাকা গ্রাম্য শিক্ষকগুলোকে
নোকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে ঢোকাতে হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করা প্রাথমিক শিক্ষকদের। তারা
কিন্তু সাধারণ বাংলা ভাষাভাষী গরিব মাস্টারদের মত বেড়ার-ঘরের-চাল-চুইঁয়ে-বৃষ্টির-পানি-পড়া
বাড়িতে থাকতে পারে না, প্রকৃতির ডাক পড়লে লোটা-বদনা নিয়ে বেগুণক্ষেতে দৌড়াতে পারে না,
পাক মুসলমানদের একটা শরমের ব্যাপার আছে তো, অতএব তাদের জন্য গ্রামে গ্রামে পাকা পায়খানা
বানাতে হবে, ভদ্রমত গোসলখানা বানাতে হবে, মক্তব থেকে মোকান পর্যন্ত নিশ্চিন্তে চলাফেরা
করার জন্য উপযুক্ত সড়ক বানাতে হবে। বিশাল খরচের ব্যাপার। এই খরচটা
কার পকেট থেকে যাবে বলে মনে হয়? নিশ্চয়ই পাঞ্জাবি-সিন্ধি-বেলুচ-বিহারী ব্রাদাররা নিজেদের
ঘাটের টাকা খরচ করে হিন্দু-ঘেঁষা বাংগালদের মুসলমান বানানোর চেষ্টা করবেন না। অতএব
পয়সাটা আসতে হবে পূর্বপাকিস্তানের পকেট থেকেই। পাট
আর চা থাকতে তাদের আবার কিসের অভাব। সুতরাং সোনার বাংলার সোনার পাটের টাকা দিয়েই তারা
মুসলমান হবে!
একটু সমস্যা দাঁড়াবে
গ্রামের ঐ গরিব মাস্টারগুলোকে নিয়ে। এতগুলো মানুষকে একসাথে বেকার করে ফেললে তারা কি
পরিবার পরিজন নিয়ে উপোস করে মরবে? কেন, তারা তো নিজেরাই উর্দু শিখে ফেলবে সেই পাঞ্জাবি-সিন্ধি-বেলুচি
ওস্তাদদের কাছ থেকে। তখন তো তারাই দেশ চালাবেন তাদের নতুন-শেখা ইসলামিক
ভাষার বিদ্যা নিয়ে---সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা যে কোথায় সেটা বুঝার মত মগজ আমাদের পশ্চিমা
‘ব্রাদারগুলোকে’ সৃষ্টিকর্তা দেননি। সৈয়দ সাহেব এখানে রবিঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার
হবুচন্দ্র রাজা আর গবুচন্দ্র মন্ত্রীর গল্পটা টেনে এনে একটু রসসঞ্চার করেছেন। দুঃখের
বিষয় যে আমাদের পাকিস্তানী ভ্রাতারা সেই রস হয়ত পুরোটা উপভোগ করতে পারবেন না। রস বুঝতেও
তো মগজ লাগে যৎসামান্য।
জোর করে বাঙ্গালির
গলা দিয়ে উর্দু নামানোতে আরো অনেক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন মুজতবা আলী। উর্দু
ভাষা যতই শিখুক বাঙ্গালিরা, তাদের উচ্চারণ বা লিখনপঠনের মান কখনোই উর্দু যাদের মাতৃভাষা
তাদের সমকক্ষ হবে না। যেমন ইংরেজের আমলে বাঙ্গালি সাহেবরা ইংরেজ সাহেবদের
অনুকরণ করে তাদের উচ্চারণ নকল করার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেকটা দিল্লির বানরদের মত আচরণ
শুরু করেছিলেন। উর্দুর বেলাতেও প্রায় একই দশা হবে। এবং
পাকিস্তানের গোড়ার দিকে তা হয়েও ছিল। ফলে নিচের তলার কেরানী-পেয়াদা-মুন্সি জাতীয় চাকরিগুলো
ছাড়া মোটা বেতন আর মোটা ইজ্জতের চাকরিগুলি বেশির ভাগই চলে যেত পাঞ্জাবী-বিহারীর হাতে। সেটা
তো আমার নিজের চোখেই দেখা। পঞ্চাশের একেবারে গোড়ার দিকে ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের
বড় বড় জেলাগুলোর জেলা-প্রশাসক ছিলেন উর্দুভাষী বিহারীরা। ’৫২ এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকার ইডেন বিল্ডিঙ্গের
চিফ সেক্রেটারি কোনও বাঙালি ছিলেন না, ছিলেন একজন পাঞ্জাবী সি এসপি, যার নাম ছিল আজিজ
আহমেদ। শোনা যায় (এবং সেটা ’৫২ তেই জানা ছিল আমাদের) যে
২১শে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্তটি কোন বাঙালি মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী
নেননি, নিয়েছিলেন এই উদ্ধত পাঞ্জাবী অফিসারটি। ’৫০
সালে ঢাকায় যে বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাটা ঘটেছিল, যার ধাক্কাতে জন্মভূমির-টানে-পাকিস্তানের-মাটি-কামড়ে-পড়ে-থাকা
হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই হতাশ হয়ে, এবং প্রায় সর্বহারা অবস্থায়, দেশত্যাগ করে চলে
যান ওপার বাংলায়। পূর্ববাংলায় সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত আবহাওয়াটি
তৈরি হয়েছিল প্রধানত বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত তথাকথিত মোজাহের (অতিথি আশ্রয়প্রার্থীদের)
উর্দুকরণ ও ‘হিন্দুত্ব’মোচনের উজবুকি প্রচেষ্টা দ্বারা। ধর্ম
আর ভাষার দোহাই দিয়ে তারা অল্পকালের মধ্যেই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে একটি মধ্যযুগীয়
উপনিবেশে পরিণত করে ফেলে।
বাঙ্গালিদের প্রচণ্ড
আপত্তির মুখে উর্দুওয়ালারা আরো অনেক যুক্তি দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলেন। চাষাভূষারা
দলিলপত্রের ভাষা বুঝবে না? তাদের জন্য বাংলা তরজমার ব্যবস্থা করা হবে। (যেমনটি করেছিলেন পূর্ববর্তী শাসকরা, অর্থাৎ ব্রিটিশ)। সেই
তরজমাটাই বা করবে কে? ভাষান্তর ব্যাপারটা অত সোজা নয়, ম্যাট্রিকের বিদ্যা দিয়ে তা হয়না। এক ভাষা
থেকে আরেক ভাষাতে অনুবাদ করতে হলে দুটি ভাষাই ভাল করে জানতে হয়, এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জ্ঞান। তার অর্থ, কেবল পাঠশালা পর্যায়ে নয়, উচ্চশিক্ষার
পর্যায়েও উর্দু শিক্ষার চর্চা বাড়াতে হবে, যার সরাসরি পরিণাম হবে আগেকার অনেক বাংলা
ভাষাভাষী অধ্যাপকের চাকরি শেষ, এবং সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য উর্দুজানা পাঞ্জাবী-বিহারী
শিক্ষক নিয়োগ। মোদ্দা কথা, পাকিস্তানের স্বপ্ন সফল করতে গিয়ে পূর্ববঙ্গের
বাংলা ভাষাভাষী জনসাধারণ সবদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে----প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা
চাকরি হারাবে উর্দুর অক্ষমতার অপরাধে, আর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা বেকার হবেন
সেই একই কারণে।
জোর জবরদস্তী করে
একটা জনগোষ্ঠীর ওপর কোনও বিদেশী ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করলে তার কি ভয়াবহ পরিণাম
হতে পারে সেটা রোমান ক্যাথলিক চার্চের দ্বিখণ্ডীকরণের উদাহরণ তুলে সৈয়দ মুজতবা আলী
সেই ১৯৪৭ সালেই বুককাঁপানো সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেনঃ “ আজ যদি জোর করে পোপের ভ্রান্তাদর্শ
অনুসরণ করে উর্দুওয়ালারা পূর্ব পাকিস্তানের স্কন্ধে উর্দু চাপান তবে লুথারের মত লোক
পূর্ব পাকিস্তানে খাড়া হতে পারে। যাঁরা অখণ্ড পাকিস্তান চান তাঁরা এই কথাটি ভেবে
দেখবেন”। অসাধারণ জ্ঞান আর প্রজ্ঞা ছিল বলেই তিনি এতখানি
দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে
মুজতবা আলী আরো একটা বিষয় উল্লেখ করেছেনঃ পাকিস্তানের দুই অঙ্গের মাঝে ব্যবসাবাণিজ্যের
সম্পর্ক। একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত হওয়ার কারণে তাদের যোগাযোগ
আগের চেয়ে শতগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া স্বাভাবিক। উর্দুওয়ালারা
তখন বলবেঃ ইংরেজ গেল, উর্দুটাও শিখতে চাওনা তোমরা, তাহলে ব্যবসাবাণিজ্য চলবে কেমন করে
পশ্চিমের সঙ্গে? তার উত্তরে তিনি দেশবিদেশের ভুরি ভুরি উদাহরণ টেনে এনে যুক্তি দাঁড়
করালেন যে ব্যবসা করতে হলে দুটি ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিকে পরস্পরের ভাষা শেখার প্রয়োজন
হয়না। আরব বণিকরা যখন মধ্যযুগে ভারতের পশ্চিম উপকূলে মশলা
আর খেজুর বিক্রি করতে এসেছিলেন তখন তাঁরা যেমন জানতেন না স্থানীয় ভাষা, তেমনি স্থানীয়দেরও
বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না এই জোব্বাজাব্বা পোশাকপরিহিত মানুষগুলো কি বলছেন। তাতে
কোন পক্ষেরই পরস্পরের পণ্য বেচাকেনার ব্যাঘাত ঘটেনি। ওদের
কাছ থেকে আমরা যেমন মশলা খেতে শিখেছি, তারাও তেমনি আমাদের কাছ থেকে নারকেল সুপুরি কিনে
ধন্য হয়েছে।
তারপর আছে ইউরোপের
দৃষ্টান্ত। ইংল্যাণ্ডের শতকরা ৯৯ জন লোক ফরাসী বলতে পারে না,
আর ফ্রান্সের হাজারে ৯৯৯ জন পারেনা এককথা ইংরেজি বলতে। তবুও
কি তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক কোনদিন থেমে ছিল? না, থামেনি। বরাবরই
চলেছে, পুরোদমে। ভারতবর্ষের উদাহরণ তো আমাদের নাকের ডগায়। মারোয়ারিরা
দীর্ঘকালব্যাপী ঢাকা-কোলকাতার বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা চালিয়ে গেলেন। তারা
মুসলমানদের কাফনের কাপড় বিক্রি করে নিজেদের মুল্লুকে আলিশান অট্টালিকা তৈরি করলেন। কই,
তারা তো কয়েক প্রজন্ম আমাদের দেশে ব্যবসা করা সত্ত্বেও গুটিকয় বাংলা শব্দ ছাড়া স্থানীয়
বাঙ্গালিদের কাছ থেকে আর কিছুই শেখেন নি। তাতে কি তাদের ব্যবসার কোনও ক্ষতি হয়েছিল? না, বাঙালি
ক্রেতারা হয়েছিলেন বেজার? ভাষা যদি কোনভাবে ব্যবসায়িক সম্পর্কের অন্তরায় হত তাহলে মারোয়ারি
বেনিয়ারা বঙ্গভূমিতে পদার্পণ করার বহু আগেই নিজের দেশ থেকে কিছু বাংলা তালিম নিয়ে আসতেন। কই,
তাদের বাসভূমিতে তো কোনও বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হবার খবর পাওয়া যায়নি। শেষমেশ
আরো একটা যুক্তি উপস্থাপন করা যায় এপ্রসঙ্গে। পূর্ব
আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলার খাতিরে যদি বাঙালি ব্যবসায়ীকে
উর্দু শিখতে হয়, তাহলে সেই একই যুক্তিতে তো পশ্চিমের ব্যবসায়ীদেরও প্রয়োজন হবে বাংলা
শেখা, তাই না? তাছাড়া, ব্যবসা তো প্রধানত করাচী বন্দরের সঙ্গে, যেখানে অধিকাংশ লোকের
মাতৃভাষা হল সিন্ধি, উর্দু নয়, এবং ব্যবসাবাণিজ্যে ব্যবহার হয় প্রধানত ইংরেজি, সিন্ধি,
আর যৎসামান্য গুজরাটি। সেখানে
উর্দুর স্থান কোথায়?
অতএব ব্যবসার দোহাই
দিয়ে পূর্ববাংলায় উর্দু চাপানোর চেষ্টা বৃথা।
মুজতবা আলী তাঁর
নিবন্ধে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক তুলে ধরেছেন----সর্বসাধারণের
সার্বিক উন্নতি। প্রধানত অর্থনৈতিকভাবে, এবং তারই সূত্র ধরে বিভিন্ন
প্রকারের জাগতিক, সামাজিক ও মানসিক উন্নতি। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পাঠককে যে পাকিস্তানের
স্বপ্ন সফল হয়েছিল মূলত জনগণের সাহায্যে। ব্রিটিশ ভারত হয়ত আরো দীর্ঘকাল ব্রিটিশই থেকে যেত
যদিনা মুসলিম লীগ আর কংগ্রেসের পেছনে একটা বিরাট গণজাগরণ উত্থিত হয়ে উঠত। মুসলিম
লীগের জন্মের পর বহুকাল সেটা জনগণের দরবারে পৌঁছুতে সক্ষম হয়নি, গুটিকয় নবাব ওমরাহ
আর জমিদার-জোতদার শ্রেণীর মধ্যেই সীম্নাবদ্ধ ছিল। তারপর,
অনেকটা মুহম্মদ আলী জিন্নার দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই, সেটা গণমঞ্চে প্রবেশ করে রাতারাতি
একরকম বজ্রশক্তি অর্জন করে ফেলে। এবং সেই জনগণজাত বজ্রশক্তি সৃষ্টির পেছনে পশ্চিম
পাকিস্তানের উর্দু-সিন্ধি-পাঞ্জাবী ভাষী মুসলমানদের চাইতে বাংলার চাষবাস-করে-জীবিকা
অর্জন করা মুসলমানদের অবদান কোন অংশেই কম ছিল না। সেই
বিপুল শক্তি সঞ্চারের জন্য তো তাদের নিজস্ব ‘ হিন্দুয়ানী’ মাতৃভাষা ত্যাগ করে ‘মুসলমানি’
উর্দু ভাষা শিখবার প্রয়োজন হয়নি। এখন হবে কেন? পাকিস্তানের স্বপ্ন যাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল জানমাল
উৎসর্গ করে দীর্ঘ সংগ্রামে
ঝাঁপিয়ে পড়তে, তাদের নাতৃভাষাকে অগ্রাহ্য করে একটা বিদেশী ভাষা জোর করে চাপিয়ে দিয়ে
গোড়াতেই তাদের স্বপ্নভংগ করার প্রয়াস কখনোই হিতকর হতে পারেনা। তাদের
অধিকার আছে লাহোর-পেশোয়ার-করাচীর মুসলমান ভ্রাতৃগণের সমান মর্যাদা দাবি করা রাষ্ট্রচালনার
সর্বব্যাপারে। ভাষার অস্ত্র দ্বারা বাঙালিকে অধঃস্তর স্থানে দাবিয়ে
রাখার চেষ্টা করলে তার পরিণাম কি হতে পারে তারও একাধিক উদাহরণ তিনি ইতিহাসের পাতা খুলেই
তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। বাঙালি মুসলমান যেমন ইংরেজের গোলাম থাকতে চায়নি,
ঠিক একইভাবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী-সিন্ধি সাহেবসুবোদের গোলামি করতেও প্রস্তুত
নয়। এক গোলামি থেকে আরেক গোলামিতে প্রবেশ করার জন্য
পূর্ববঙ্গের তরুণতরুণীরা সিলেটের গ্রামে গ্রামে গিয়ে কাদায়-মাটিতে একাকার হয়ে দিন-নেই-রাত-নেই
ক্ষুধাতৃষ্ণা অগ্রাহ্য করে, পাকিস্তানের সপক্ষে গণভোটের আন্দোলন করেনি। পাকিস্তান
তাদের জীবনে সুখশান্তি বয়ে আনবে এই ছিল তাদের প্রত্যাশা। সেই
প্রত্যাশা যেন অঙ্কুরেই চূর্ণ না হয়ে যায় মূর্খ ভাষার দাপট দ্বারা।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক
ভাষা ও ধর্মের রাজনীতি
দিয়ে করাচী-লাহোরের নব্য শাসকশ্রেণী যে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন পূর্ববঙ্গের
বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর তাতে করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা অর্থনৈতিক দূরত্ব
তো তৈরি হয়েই গেছে, সাথে সাথে সামাজিকভাবেও তারা ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে থাকলেন পরস্পর
থেকে। কতগুলো দৃশ্য তো আমার নিজের চোখেই দেখা। ঢাকার
বনেদী পাড়া বলতে সেকালে, মানে পঞ্চাশের প্রথমদিকে, বোঝাত শান্তিনগর, রমনা আর ক্যান্টনমেন্ট
এলাকাগুলো। ধানমণ্ডী মাত্র শুরু হয়েছে তখন। এই
‘বনেদী’ পাড়াগুলোর বেশির ভাগ বাড়িঘরই ছিল বিহারী-পাঞ্জাবীদের দখলে। ছড়ানো-ছিটানোভাবে
দেখা যেত দুচারটে বাংগালি পরিবার, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পশ্চিম বংগ থেকে উঁচু বেতনের
চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে আসা উচ্চ মধ্যবিত্ত অফিসার শ্রেণীর লোক। বাকিসব
বাঙ্গালির আশ্রয় ছিল সারি সারি ‘কলনি’ জাতীয় এলাকাগুলোতে। আজিমপুর
কলনি ছিল একটু উপরের চাকরিধারী বাঙ্গালিদের, আর মতিঝিল কলনি তৈরি হয়েছিল প্রধানত কেরাণীকূল,
অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত
শ্রেণীটির বসবাসের জন্যে। আমার নিজের বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের বেশির ভাগই
থাকত শেষোক্ত পাড়াদুটির কোন একটিতে। কিন্তু তাদের একজনও ছিল না কোনও উর্দুভাষী বড়লোক
আর ক্ষমতাধর বিহারী-পাঞ্জাবী পাড়াতে। ফলে ওসব পাড়াতে ভুল করেও যাওয়ার সাহস পেতাম না,
পাছে না কেউ আমার পোশাকঅশোকের হীনদশা দেখে পুলিশে খবর দেয়!
না, পাকিস্তান এমন
বিকৃতভাবে বিভক্ত জাতি হয়ে ওঠার কথা ছিল না। সেসময়কার পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার
তুলনা হয়ত পুরোপরি চলে না, তবে সত্যিকার অর্থে খুব একটা ব্যবধানও যে ছিল তা নয়।
সৈয়দ মুজতবা আলী
অত্যন্ত জোরালো ভাষাতে পাকিস্তান সৃষ্টির বিড়ম্বনাটি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখাতে। স্বাধীনতা,
নতুন রাষ্ট্র, গণজীবনের আশা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন প্রকাশ পায় তার সাংস্কৃতিক প্রস্ফূটন
ও বিকাশের মধ্য দিয়ে। মুজতবা আলী বলছেনঃ
“ কত গবেষণা, কত
সৃজনীশক্তি, কত শাস্ত্রাশাস্ত্র বর্জন গ্রহণ, কত গ্রন্থ নির্মাণ, কত পুস্তিকাপ্রচার,
কত বড় বিরাট, সর্বব্যাপী, আপামর জনসাধারণ সংযুক্ত বিরাট অভিযানের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ব
পাকিস্তান। এর উৎসব অনুপ্রেরণা যোগাবে কে? প্রধানতঃ সাহিত্যিকগণ। এবং
সে সাহিত্যসৃষ্টি মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষাতে হতে পারেনা”।
মহৎ সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে মুজতবা আলীর বিস্তারিত আলোচনা
রচিত হয় ১৯৪৭ সালে, যখন পাকিস্তানের প্রকৃত স্বরূপ সম্পূর্ণ প্রকাশ পায়নি। মুহম্মদ
আলী জিন্নার ঢাকা আগমনেরও বছরখানেক বাকি। তাই তাঁর লেখাতে যে আশাবাদ আর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ
পেয়েছিল তার সুর নিশ্চয়ই ভিন্নরকম হয়ে যেত জিন্নার সেই ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’
ঘোষণাটি যদি জানাজানি হয়ে যেত চারদিকে। বিশেষ করে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিগুলো। তখন
তাঁর কলম দিয়ে আশাবাদের পরিবর্তে নিশ্চয়ই প্রকাশ পেত চরম নৈরাশ্য। সেসব
পরবর্তীকালের ঘটনা। যার পরিণতি আমাদের সকলেরই সুবিদিত।
মাতৃভাষা ছাড়া অন্য
কোন ভাষাতে পূর্ণভাবে সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব হয় না, এই মতবাদটি ১৯৪৭ সালে সত্য হলেও আধুনিক
যুগে নিশ্চয়ই সেটা আক্ষরিকভাবে সত্য নয়। এযুগের গতিশীল জনপ্রবাহের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার
করতে গেলে মানুষের যথার্থ শেকড় কোথায় আর বাসস্থান কোথায় সেই ভেদাভেদের সীমারেখাটি খানিক
ঝাপসা হয়ে গেছে। আজকাল ইংরেজি সাহিত্যের অনেক কৃতিজনের জন্ম ইংরেজিভাষী
অঞ্চলে হলেও হয়ত তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মাতৃভূমি ছিল ভারত উপমহাদেশে। তার
মধ্যে একজন, ভি এস নাইপল তো ইংরেজি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারই পেয়ে গেলেন। সালমান
রুশদি, অরূন্ধতী রায়, কিরণ দেশাই, অরবিন্দ আদিচা প্রমুখেরা পেলেন ম্যান বুকার প্রাইজ। প্রায়
একই মাপের লেখকদের মাঝে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন, আমার মতে, অমিতাভ ঘোষ, বিক্রম
শেঠ, ঝুম্পা লাহিড়ি----এঁরা। অ-ভারতীয় ইংরেজি ভাষাভাষী লেখকদের নাম করতে গেলে
তো খাতা ভরে যাবে। এঁদের অনেকেরই মাতৃভাষা হয়ত ইংরেজি নয়, কিন্তু ছোটবেলা
থেকেই তাঁদের লেখাপড়া সব ইংরেজিতে। তাঁরা ইংরেজিতে যতটা স্বচ্ছন্দ নিজেদের ‘মাতৃভাষা’তে
ততটা নন, এমনকি সেভাষাতে কথা বলতে পারলেও বইপত্র পড়তে পারেন না। ১৯৪৭
সালে সে অবস্থাটি একেবারেই পরিচিত ছিল না মুজতবা আলীর। সেসময়কার
পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্যটি একশ ভাগই সত্য।
মাতৃভাষা ছাড়া অন্য
কোন ভাষাতে যে কোনও লেখকই নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ঢেলে দিতে পারেন না, এবং চেষ্টা করলেও
বিশেষ কোনও খ্যাতি বা স্বীকৃতি অর্জন করা সম্ভব হয়না, তার বিস্তর উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা
আলীর জানা ছিল। ফ্রান্স এবং ইংল্যাণ্ডের মধ্যে যে দীর্ঘকালীন ঘনিষ্ঠ
সম্পর্ক তার বরাতে দুপক্ষের গুণিজনদেরই প্রচুর সুযোগ হয়েছিল পরস্পরকে অত্যন্ত কাছে
থেকে চেনা, জানা ও ভাবের আদানপ্রদান করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও ইংরেজ লেখক কখনো ফরাসীতে
সাহিত্য রচনা করে প্রসিদ্ধি লাভ করেন নি। অনুরূপভাবে ফরাসীভাষার এত এত বিশাল ব্যক্তিদেরও
কেউ ইংরেজি লিখে নাম করতে পারেন নি। রাশিয়ার টলস্টয় আর তুর্গেনিভ দুজনই রূপার চামচ মুখে
করে জন্মগ্রাহণ করেছিলেন বলে শৈশবাবস্থা থেকেই ফরাসীভাষী গৃহপরিচারিকার তত্বাবধানে
বড় হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। অতএব ভাষাটি যে খুব ভাল করেই জানা ছিল তাঁদের, সেটা
সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু কই, তাঁদের একজনও তো ফরাসীতে এককথা লিখে
খোদ ফরাসীদের মনজয় করতে পেরেছিলেন বলে শুনা যায় নি।
আমাদের ভারত উপমহাদেশেই
যে হাজারো উদাহরণ সেদিকেও সৈয়দ সাহেব পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মির্জা
গালিব উর্দু ভাষাতে অতি বড় মাপের লেখক ছিলেন। বলা
বাহ্যল্য যে ফার্সি ভাষাতেও ছিল তাঁর দারুণ পাণ্ডিত্য। এমনকি
বেশ কছু লেখালেখিও করে গেছেন সে ভাষায়। কিন্তু কই, ইরাণে তো তাঁর লেখা নিয়ে টুঁ শব্দটি
হয়না।
বাংলাভাষার মাইকেল
মধুসূদন আরেকজন জলজ্যান্ত উদাহরণ। তাঁর মত বহুভাষা জানা মানুষ সারা বঙ্গদেশে, এমনকি
সারা ভারতবর্ষেই ক’জন ছিল বা আছে? ইংরেজিতে তাঁর সমকক্ষ বাংগালি অন্তত সেযুগে কেউ ছিল
না। কিন্তু এত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তিনি তো শেষ পর্যন্ত
‘জননী জন্মভূমির’ পাদমূলেই ফিরে এসেছিলেন। এবং সে যে কি অন্তহীন রত্নের ভাণ্ডার নিয়ে এসেছিলেন
তিনি বাংলার মাটিতে সে ইতিহাস কি কোনও শিক্ষিত বাঙ্গালি কখনও ভুলতে পারবে। আধুনিক
বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন তো বলতে গেলে তিনিই স্থাপন করে গিয়েছিলেন।
এতসব উদাহরণ তুলে
ধরার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর একটাইঃ উর্দুওয়ালাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যে বাঙালি
মুসলমানের মাতৃভাষা বিসর্জন দিয়ে কেবল ধর্ম ও পশ্চিমা পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্নবোধ
সৃষ্টি করার অজুহাতে উর্দু চাপানোর চেষ্টা করলে ফলটা দাঁড়াবে এই যে বাংগালি মন ও মনন
কখনোই বিশ্বদরবারে তার ধনভাণ্ডার দম্ভভরে প্রচার করবার ক্ষমতা অর্জন করবে না। সে চিরকালই
থেকে যাবে উর্দুর আঁচলে ঢাকা এক হাস্যকর ব্যঙ্গচরিত্র।
অথচ নিজের ধর্মীয়
বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখেও বাঙ্গালি মুসলমান অমর সাহিত্য রচনা করতে পারে তারও
দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কাজী নজরুল ইসলাম একটি জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। নজরুল
যে প্রধাণত বাঙালি কবি, এবং অত্যন্ত উঁচুমানের কবি, সাথে সাথে সগর্বি মুসলমান কবিও, তাঁর কবিতায় অজস্র আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহারই
তার সাক্ষ্য দেয়। বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান তাতে করে কোনক্রমেই খর্ব
হয়ে যায়নি তার প্রমাণ তো স্বয়ং গুরুদেবই দিয়ে গেছেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর
আরেকটি চমকপ্রদ উদাহরণ হল পূর্ববঙ্গের লোকসাহিত্য। প্রধানত
গ্রাম্য আঞ্চলিক ভাষাতে লেখা সরল সাধারণ রচনার ভেতর দিয়েও যে অসাধারণ সাহিত্যরস সৃষ্টি
করে বিশ্ববাসীর সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব তিনি সেদিকটাতেই বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি
উভয় পাঠককেই সচেতন করার চেষ্টা করেছেন, যা হয়ত আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। শুধু
তাই নয়। তিনি দাবি করছেন যে পূর্ববঙ্গের লোকসাহিত্য পৃথিবীর
অন্য যেকোন দেশের তুলনায় সগর্বে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবার যোগ্যতা রাখে। তাঁর নিজের
ভাষাতেই বলা যাক সেটাঃ
“ ভাষার বাজারে বহু
বৎসর ধরে এ অধম বড় বড়
মহাজনদের তামাক সেজে ফাই-ফরমাস খেটে দিয়ে তাঁদের আড়তের সন্ধান নিয়েছে, এবং সে হলপ করে
বলতে প্রস্তুত, লোকসাহিত্যের ফরাসী, জর্মন, ইতালি, ইংরেজি আড়তের কোনটিই পূর্ববংগ লোকসাহিত্যের
মত সরেস নেই”।
এসব উদাহরণ তুলে
তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করবার পর সৈয়দ মুজতবা আলী ক্ষেদ প্রকাশ না করে
পারেননি যে ‘ অশিক্ষিত চাষাভূষারা’ সাহিত্যসৃষ্টিতে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে বটে, কিন্তু
তার সমতুল মানের অবদান বাংলার শিক্ষিত মুসলমান সমাজ এখনো সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। যারা
ধর্মীয় পরিচয়ের ভ্রান্ত মোহেতে আকৃষ্ট হয়ে স্বগৃহের অফুরন্ত ধনভাণ্ডারের দিকে ফিরেও
তাকালেন না তাদের পক্ষে কি কখনও কোনও মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব? পাকিস্তানের ভূয়া একতা
প্রতিষ্ঠার অজুহাতে উর্দু যদি হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার ঘাড়ের ওপর তাহলে তো এই
বন্ধ্যা জাতির বন্ধ্যাত্ব কোনদিনই দূর হবে না।
বাংলাভাষাটি ঐতিহাসিকভাবে
হিন্দুধর্মের স্বাভাবিক বাহন বলে মনে হলেও সাথে সাথে এই বাংলাই যে মুসলমান চিত্তেরও
স্বতস্ফূর্ত আকুতি প্রকাশ করতে পারে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ তো কাজী নজরুল ইসলামই (এখানে বর্তমান লেখকের
নিবেদনঃ সৈয়দ মুজতবা আলী নিজেও খুব অপাংক্তেয় উদাহরণ নন। তার
সাথে যোগ করুণ সাম্প্রতিক কালের অনেক অনেক কীর্তিমান কবি সাহিত্যিকের নাম)। উর্দুওয়ালাদের
স্থূল মস্তিষ্কে একটা কথা প্রবেশ করা দরকার যে উর্দুর মাধ্যমে যেমন কৃষণ চন্দ্র, প্রেমচন্দ্র,
যোগিন্দর পাল, সরনকুমার ভার্মা, প্রমুখের মত বিরাট মাপের অমুসলিম কবি-সাহিত্যিক অমরত্ব
অর্জন করে গেছেন, অনুরূপভাবে বাঙালি মুসলমানও নিজের মাতৃভাষাতে সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াস
পেলে তার ‘মুসলমানিত্ব’ বিন্দুমাত্র কলুষিত হয়ে যাবে না।
ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য
এবার আমি ভাষার নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য বিষয়ে দুচারটে বক্তব্য পেশ করব। অবশ্য এনিয়ে নিজে থেকে কিছু লেখা, এমনকি মুখ খোলাটুকুর
যোগ্যতাও আমার নেই। টেনেটুনে দুটি ভাষাই অল্পবিস্তর সামলাতে পারি----ইংরেজি
আর বাংলা। বাংলা আমার মাতৃভাষা, তাই যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞান দখলে আনতে হয়েছে। দ্বিতীয়টিতে
আমি বলতে গেলে একেবারেই অজ্ঞ। নেহাৎ দীর্ঘদিন ইংরেজি ভাষাভাষী জগতে বসবাস করেছি বলে
দায়ে পড়েই শিখতে হয়েছে একাধটু। কিন্তু এদুয়ের কোনটার ওপরই বড় বড় কথা বলার স্পর্ধা
আমার নেই। এ নিবন্ধে যেটুকু আমার নিবেদন সবই সেই পণ্ডিতেরই
কথা-----সৈয়দ মুজতবা আলী। যাকে বলে অশ্বানন। আগেই
বলেছি, অন্তত ১৫ টি ভাষাতে তাঁর প্রায় সমান দখল ছিল। তাঁর
বাংলার খবর তো বাঙালি পাঠকের কারুরই অজানা নয়-----মৃত্যুর ৩৯ বছর পর তিনি এখনো অনেকের
প্রিয় লেখক। তিনি উর্দু-হিন্দি-পশতু-মারাঠী-গুজরাটি ভাষাগুলোও
জানতেন খুব ভালো করেই-----শুধু পড়তে-বলতেই নয়, লিখতেও। সুতরাং
বাংলা বনাম উর্দুর বিতর্কতে তাঁর চেয়ে জোরালো, মজবুত যুক্তি আর কে দাঁড় করাতে পারবে
জানি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর উর্দুজ্ঞান পাকিস্তানের মহান
নেতা কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নার চাইতে শতগুণে বেশি বই কম ছিল না----লিখনে পঠনে
কেবল নয়, কথনেও। জিন্না সাহেব যদি ঢাকার সেই শোচনীয় ভাষণটি দেবার
আগে আলী সাহেবের সঙ্গে একটু পরামর্শ করে নিতেন তাহলে, কে জানে, আজকে পাকিস্তানের ইতিহাস
হয়ত এতটা শোচনীয় হয়ে উঠত না। দেশের রক্তাক্ত ভাঙনটি অন্তত রোধ করা হয়ত সম্ভব
হত।
উর্দু ভাষাটির জন্ম
কোথায়? বাংলার মত ভারতবর্ষের মাটিতেই। দুয়ের মিলটি সেখানেই শেষ। বাকিটা
সবই অমিল। বাংলা যেমন সংস্কৃতের শ্বাসরোধকর বাহুপাশ থেকে মুক্ত
হয়ে আপন স্বত্ব প্রতিষ্ঠার কামনাতে চর্যাপদ, বৈষ্ণব ও পদাবলীর বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে এগিয়ে
এসেছিল ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে, উর্দুর সেরকম আকর্ষণীয় কোনও জন্মকাহিনী নাই। ‘উর্দু’ শব্দটি আসলে তুর্কি, যার অর্থ ‘সেনানিবাস’। তার
মানে গোড়াতেই ‘উর্দু’র শরীরে গোলাবারুদের গন্ধ, বুটের আওয়াজ, জোয়ানদের প্রাত্যহিক কুচ-কাওয়াজ। ভাষাটি
সৃষ্টি হয়েছিল নিতান্তই আক্রমণকারী সৈন্যবাহিনীর দৈনন্দিন প্রয়োজনের তাগিদে। মুহম্মদ
বিন কাসিম সিন্ধু আর পাঞ্জাব জয় করেন অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তাঁর
সৈন্যসামন্তরা তখন থেকেই স্থানীয় ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের
উপযোগী একটা ভাষা তৈরির কথা ভাবছিলেন। সেটা তৎক্ষণাৎ ফলপ্রসূ হওয়া সম্ভব না হলেও পরবর্তীতে যখন খিলজি,
পাঠান আর মোগলরা এসে সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন উপমহাদেশে, তখন সেই পরকল্পিত ভাষাটি নির্মাণ
করে ফেলবার একটা আশু প্রয়োজন দাঁড়িয়ে গেল। শেষে সম্রাট আকবর, এবং বিশেষ করে সম্রাট জাহাঙ্গীরের
আমলে ‘উর্দু’ নামক নতুন ভাষাটি ধীরে ধীরে একটা নিজস্ব আকার ধারণ করে নেয়। সেসময়
এটি ছিল ৭০ ভাগ ফার্সি, আর ৩০ ভাগ আরবি-সংস্কৃতের পাঁচমেশালি। আকবরের
আগে এর নাম ঠিক উর্দু ছিল না, ছিল ‘হিন্দুস্তানি’। একেক
সম্প্রদায় সেটা একেক হরফে লিখতেন। হিন্দুরা লিখতেন দেবনাগরিতে, মুসলমানরা প্রধানত
ফার্সি হরফে। দুটিতে কোনরকম বাদবিবাদ ছিল না-----যার যা ইচ্ছা। মোটকথা
যেটা দাঁড়ায়, সেটা হল যে ফার্সি যেহেতু উর্দুর জনক এবং ফার্সি নিজেই অগ্নিউপাসকদের
ভাষা ছিল ইসলামি যুগের আগে, সেহেতু বলা যায় যে উর্দুর জন্ম কোনও পীরফকিরের পবিত্র ঔরসে
নয়, খোদ পৌত্তকলিকদেরই সূতিকালয়ে (ইসলাম যে জিনিসটাকে অচ্ছুত বলে গণ্য করে)। ‘উর্দু’র ইসলামীকরণটা আসলে মুসলমানী আমলে ঘটেনি,
ঘটেছিল ইংরেজ আমলে, সেটা যত অবিশ্বাস্যই হোক না কেন। ১৮৩৭
সালে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ফার্সি-হিন্দুস্তানীর পরিবর্তে হিন্দুস্তানী আর
তাদের নিজেদের ইংরেজি ভাষাদুটিকে যুগ্ম রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। গণ্ডগোলটা
সৃষ্টি হয় তখনই। মুসলমানদের দাবি তারা হিন্দুস্তানী লিখবে ফার্সি
হরফে। হিন্দুরা পালটা দাবি জানালেন, না, সেটা হবে দেবনাগরিতে। এই নিয়ে
কোন্দল এতটাই তুঙ্গে উঠে গেল যে বিহারের অপেক্ষাকৃত গোঁড়া হিন্দু সম্প্রদায় গোটা হিন্দুস্তানী
ভাষাটিকেই আগাগোড়া হিন্দুয়ানী করে তোলার চেষ্টায় আরবি-ফার্সি যথাসম্ভব কমিয়ে, সাথে
সাথে সংস্কৃত শব্দ যথাসম্ভব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করে, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ভাষা তৈরি করে
ফেললেন, যার নাম দেওয়া হল ‘হিন্দি’। সেই থেকেই হিন্দুস্তানীর একটা শাখা হয়ে গেল আরবি-ফার্সি
হরফে লেখা উর্দু, আরেকটি হয়ে গেল সংস্কৃতপ্রভাববিশিষ্ট, দেবনাগরি হরফের হিন্দি।
ভাষার যে কোনও ‘পাক’,
‘নাপাক’, ‘পবিত্র-অপবিত্র’ বলে কিছু নেই, একথাটি মুজতবা আলী অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে আমাদের
সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন ‘পাক’ ভাষার প্রবক্তাদের কাছে-----‘পাকিস্তান’
শব্দটির উৎস কোথায়?
সে কি জাতে ‘পাক’, না, ‘নাপাক’? ‘পাক’ শব্দটি
নিজেই তো পাক নয় সেবিচারে, কারণ এর ‘পা’ অক্ষরটির
উৎপত্তি আরবিতে হতে পারেনা,
তার কারণ আরবি অক্ষরমালাতে ‘পে’ উচ্চারণের কোন অক্ষর নাই। তবে
ফার্সিতে আছে, এবং ফার্সি হল আদতে অমুসলমান ভাষা, মানে ‘নাপাক’। আর পাকিস্তানের
‘স্তান’ কথাটি সংস্কৃত ‘স্থান’এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট, অর্থাৎ তৌবাস্তাগফেরুল্লাহ।
সৈয়দ মুজতবা আলী
‘পাক-নাপাক’এর বিতর্ক নিয়ে ইসলাম ধর্মের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করেননি। বরং
তাঁর বক্তব্যঃ “তাই বলি ‘পাকনাপাক’এর প্রশ্ন শুধানো ইসলাম-ঐতিহ্য পরিপন্থী”।
এই ফাঁকে এবার আমি নিজের উদ্যোগে দুচারটে কথা বলব,
পাঠক যদি অনুমতি দেন।
১৯৪৮ সালে মুহম্মদ
আলী জিন্না উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন জাতীয় ‘ঐক্যের’
দোহাই দিয়ে। মুজতবা আলী ১৯৪৭ সালেই তাঁকে এবং পাকিস্তানের তৎকালীন অন্যান্য নেতৃবৃন্দদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে
“ unity ( ঐক্য) আর
uniformity (সমতা) এক জিনিস
নয়। সমতা হলেই ঐক্য হয় না। আর যারা
সমতা চায় তাদের জেদ-বয়লাক্কার অন্ত নেই। আজ তারা বলবে ভাষার সমতা চাই, পূর্ব-পাকিস্তান উর্দু
নাও, কাল বলবে পোশাকের সমতা চাই, পরশু বলবে খাদ্যের সমতা চাই, মাছ ভাত ছেড়ে রুটি-গোস্ত
খাও; তার পরদিন বলবে নৌকা বদ্খদ্ জিনিস, তার বদলে গোরুর গাড়ি চালাও”।
সবশেষে তাঁর পূর্ববর্ণিত
হুঁশিয়ারবাণীটি দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করার লোভ সামলাতে পারেননি তিনিঃ “ ----পূর্বপাকিস্তানের
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয় তবে স্বভাবতঃই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মা
শুধু ভাষার জোরেই পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবে। এ জিনিস
অত্যন্ত স্বাভাবিক, তার জন্য উর্দুভাষাভাষীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই-----এবং এর ফলে জনসাধারণ
একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে”।
কি আশ্চর্য নিখুঁতভাবে
ফলে গেল ১৯৪৮ সালেতে দেওয়া তাঁর সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদবাণীটি। ইতিহাস
যারা মনোযোগ দিয়ে পড়েন তারা অতীতের আলোতেই দেখতে পারেন ভবিষ্যতে কি ঘটবার সম্ভাবনা। মুজতবা
আলী তুরষ্কের ইতিহাস খুব ভালো করেই জানতেনঃ “ তুর্কী একদা আরবখণ্ডের ওপর রাজত্ব করত। তুর্কী
সুলতান সর্ব আরবের খলিফাও ছিল বটে। তৎসত্ত্বেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত আরব ভূখণ্ড খলিফার
জিহাদ ফরমান উপেক্ষা করে নসারা ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তুর্কীকে পর্যুদস্ত করল”।
ইতিহাসের এই মূল্যবান
তথ্যটি থেকে এতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করার ক্ষমতা সেকালের পাকিস্তানী নেতাদের ছিল না, তার
প্রকৃষ্ট উদাহরণ তো ‘কায়েদে আজম’ নিজেই।
মুজতবা আলীর প্রবন্ধের
শেষ লাইনটি আমার এ-নিবন্ধের শেষ লাইন করবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। একতা
না থাকলে ভারতের বৃহত্তর শক্তি দ্বারা একদিন পাকিস্তান আক্রান্ত হতে পারে সেসম্বন্ধে
মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলছেনঃ “ আজ যদি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় মাতৃভাষা ত্যাগ করি
তবে কাল প্রাণ যাওয়ার ভয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হব”।
পরিশিষ্ট
সৈয়দ মুজতবা আলী
আমাদের স্বাধীনতার তিন বছরের মাঝেই দেহত্যাগ করেছিলেন। জীবনের
শেষ দুটি বছর নিজের জন্মভূমিতেই অতিবাহিত করবার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর-----জন্মভূমিই
নয় কেবল, স্বাধীন সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জন্মভূমি। তাঁর
আরো সৌভাগ্য যে ১৯৭৫ সালের অবিশ্বাস্য ঘটনাবলী তাঁকে সচক্ষে দেখে যেতে হয়নি, বা দেখে
যেতে হয়নি গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা, উভয় তন্ত্রের মূলেতেই প্রচণ্ড কুঠারাঘাত ১৯৭৭
সালের পর। ভাগ্যদেবতা তাঁকে রক্ষা করেছেন সেই লজ্জার কলঙ্ক
থেকে। সেজন্যেই আমি বলি মাঝে মাঝে, মানুষ কখনো কখনো মরে
গিয়ে বেঁচে যায়!
বেঁচে থাকলে জনাব
আলীকে আরো এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে যেতে হত। মাতৃভাষার সম্মানের জন্য, দেশজ সংস্কৃতির সম্মান
ও ঐতিহ্য অক্ষত রাখার জন্য, তার বাঙালি পরিচয় গর্বভরে প্রচার করতে পারার অধিকার অব্যাহত
রাখার জন্য, যে বাঙালি বন্দুকের মুখোমুখি হয়ে প্রাণ দিতে পশ্চাদপদ হয়নি, যে বাঙালি
তার ভাতের থালা আর চাষের লাঙ্গল পরিহার করে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে
পড়তে দ্বিধা করেনি, সেই একই বাঙালি কেমন করে আজ সেই মাতৃভাষাটিকেই আস্তে আস্তে অবজ্ঞা
অবহেলা করতে শিখে গেল। আজকে বাংলাদেশে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে-----তাদের
বিচারে বাংলাভাষা হঠাৎ করে
‘হিন্দু’ ভাষা হয়ে গেছে, ’৪৭-’৪৮ এর পাঞ্জাবী-সিন্ধি-বেলুচরা যেমন বলত, ’৭১ এর পাকিস্তানের
বর্বর পশুরা যেমন বলত। নবজাত শিশুর বাংলা নাম রাখতে চাইলে চারদিক থেকে
ছি ছি রিরি রব পড়ে যায়----মুসলমান বাচ্চার হিন্দু নাম? নাম রাখার সময় তারা এখন বাংলা
অভিধান ঘাটে না, ঘাটে পবিত্র কোরাণের পাতা। খোঁজে সবচেয়ে শক্ত, সবচেয়ে দাঁতভাঙ্গা আরবি শব্দ,
অর্থ তার যা’ই হোক। এতেই নাকি সোয়াব বেশি। বাঙালি
মুসলমানের ঘরে ঘরে এখন ‘সোয়াব’এর সংস্কৃতি, বাংলার মাঠ-ঘাট-নদীনালার গান কবিতা ছড়া
নৃত্যমুখর সনাতন সংস্কৃতি নয়। সেগুলো এখন শহরবন্দরের গুটিকয় শিক্ষিত, আধুনিক মনোভাবাপন্ন
গোষ্ঠীর বাইরে ‘হিন্দু’ ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে। তারা
‘পানি’কে ভুল করে ‘জল’ বলে ফেললে অজু করে তৌবা পড়ে-----কারণ জল হিন্দু আর পানি মুসলমান। তাই
নাকি? কই, আমার জানামতে ‘পানি’ তো আরবিও নয়, ফার্সিও নয়, তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই
যে আরবি-ফার্সি দুটোই ‘মুসলমান’ শব্দ ( যদিও এরকম হাস্যকর আর বালসুলভ কথা গ্রামের পাঁড়
নিরক্ষর চাষীদের মুখেই মানায় কেবল)। আসলে জল আর পানি দুটোরই উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে। পানির
মূল হল ‘পানীয়’, যার গোড়া সংস্কৃতে। সেকারণেই পানি হয়ে গেছে হিন্দি বা হিন্দুস্তানী
(যার ভেতরে উর্দুও ঢুকে যায়, একহিসেবে)। আমি বলিঃ বাংলাদেশী মুসলমানের যদি এতই খায়েশ হয়ে
থাকে খাঁটি আরবি শব্দ ব্যবহার করে খাঁটি মুসলমান হয়ে যেতে, তাহলে ‘হিন্দু’ পানি বর্জন
করে বরং আরবি ‘মা’ ই ব্যবহার করা উচিত। তাহলে একগ্লাশ ‘মা’ খেয়েই হয়ত জান্নাতুল ফেরদৌসে
চলে যাওয়া সম্ভব হতে পারে।
এবার চলুন ‘খোদা
হাফেজ’ বনাম ‘আল্লা হাফেজ’ প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। আমার
জন্ম থেকে প্রঢ়ৌত্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের কাউকেই বিদায় নেবার সময় ‘আল্লা হাফেজ’ বলতে
শুনিনি। আমার বাপদাদা চোদ্দপুরুষ বর্তমান যুগের ‘পাক্কা’
মুসলমানদের চাইতে কোন অংশে কম ‘পাক্কা’ ছিলেন বলে আমি মনে করি না। কিন্তু
তাঁদের কারো মুখেই কোনদিন ভুলক্রমেও ‘ খোদা হাফেজ’ এর পরিবর্তে ‘আল্লা হাফেজ’ শুনিনি। এমনকি
১৯৭১ এর কিছু আগে এবং কিছু পর পর্যন্ত বাঙ্গালি মুসলমান একে অন্যকে ‘জয়বাংলা’ বলে অভিবাদন
জানাতেও দ্বিধা করেনি, বরং সোৎসাহেই তা করেছে, এবং তাতে তাদের ‘মুসলমান’ত্ব বিন্দুমাত্র
খর্ব হয়েছিল বলে শোনা যায়নি। কিন্তু আজ? আজ একি দারুণ মহামারি লেগে গেল দেশে? চারদিক থেকে কেন দাঙ্গাকালীন যুদ্ধদামামা ‘নারায়ে
তাকবির’এর মত ‘আল্লা হাফেজ’এর ধ্বনি ভেসে আসছে বাতাসে? চিরপরিচিত ‘খোদা’কে বিতাড়িত
করে ‘আল্লা’ আসন করে নিলেন কিভাবে, এবং কেন? ‘খোদা’ ফার্সি হওয়ার অপরাধে ত্যাজ্য হবার
যোগ্য, আর ‘আল্লা’ যেহেতু আরবি সেহেতু তার সাতখুন মাফ?
তাহলে দেখা যাক শব্দদুটির
উৎপত্তি কোথায়। ফার্সির
‘খোদ’ শব্দের অর্থ হল স্বয়ম্ভূ-----অর্থাৎ স্বয়ংসৃষ্ট। সৃষ্টিকর্তার
অস্তিত্ব বিষয়ে যদি সামান্যতম সন্দেহ না থাকে আপনার মনে তাহলে কি মনে হয়না যে তাঁর
সৃষ্টি অন্য কোন শক্তির হাত ধরে হয়নি, হয়েছে তাঁর নিজেরই হাতে? অর্থাৎ তিনি স্বয়ংসৃষ্ট----স্বয়ম্ভূ? তার মানে, ফার্সি
ভাষাতে, ‘খোদা’?
এবার দেখা যাক ‘আল্লা’
শব্দটির ইতিহাস। হ্যাঁ, আমি একশবার মানব যে মহানবী মুস্তফা মোহম্মদ
(দঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির পর তাঁর নতুন ধর্মের সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তাকে ‘আল্লা’ বলে
সম্বোধন করেছিলেন। সেহিসেবে ‘আল্লা’ কে যদি মুসলমাম শব্দ বলতে চান
বলুন। কিন্তু তার পেছনেও কি কোনও কেচ্ছাকাহিনী নেই? আছে।
সম্প্রতি একটা মূল্যবান
বই আমার হাতে এসেছেঃ “
Arab Administration”. প্রণেতাঃ
Dr. S.A.Q. Husaini. বইটা প্রকাশ হয়েছিল লাহোরের শেখ মুহম্মদ আশরাফ
কর্তৃক, ১৯৪৯ খৃষ্টাব্দে। এর দ্বিতীয় মুদ্রণ ঘটে ১৯৫৬ সালে। হুসাইনি
সাহেব চল্লিশের দশকে (এবং পঞ্চাশ দশকের প্রথমাংশে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। অতএব
আরবের ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান অন্তত আমার চেয়ে হাজারগুণে বেশি থাকার কথা। গ্রন্থটির
মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ইসলামোত্তর আরবের শাসনব্যবস্থা----বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত
হবার পর আরবজাতি কি অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যের সাথে নিজেদের বহুবিভক্ত গোত্রগুলোকে একত্র
করে একটা সুসংহত সুশৃংখল সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে
প্রথম অধ্যায়টিতে লেখক ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজের একটা সংক্ষিপ্ত ছবি দাঁড় করিয়েছেন পাঠকের
অবগতির জন্যে। সেখানে, বেদুইনদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের একটা সংক্ষিপ্ত
নক্সা দিতে গিয়ে বলেছেন একজায়গায়ঃ
“ Just as each of their clans was
considered to be an offspring of the common ancestor, so also the Arabs thought
that each of their clan deities was a daughter of the Supreme God, Allah.”
একটু মাথা ঠাণ্ডা
রেখে চিন্তা করলে কি দাঁড়ায় এর অর্থ? দাঁড়ায় যে ‘আল্লা’ শব্দটি আরবি ভাষার অন্তর্গত
হবার কারণেই আরবের ইসলামপূর্ব বেদুইনরা ‘আল্লা’কে তাদের দেবদেবীদের জনক বলে গণ্য করতেন। তার
মানে ‘আল্লা’ যেমন নিরাকার ইসলামী সৃষ্টিকর্তার নাম, তেমনি ইসলামের আগে এই একই শব্দ
ছিল তাদের পৌত্তলিক মতবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ মূর্তি! এবার একটু ভাবুন দয়া করে। আমরা
না আরব না ফার্সি। আমাদের ভাষা বাংলা, আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। আমরা
কারো পরাধীন নই, কারো নূন খাই না, কারো গীত গাইনা। আমরা
কেন একটা শব্দের কল্পিত মাহাত্ন্য দ্বারা এমনই মোহিত হয়ে পড়ব যে বাপদাদার নাম ভুলে
সেই শব্দটাই জপ করতে থাকব দিবানিশা? এ কি অধঃপতন আমাদের! ঠিক আছে, গ্রামগঞ্জের মূর্খ অশিক্ষিতরা না হয় তদোপেক্ষা
মূর্খ মোল্লাদের মিথ্যা প্রচারণায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলল, তাই বলে শহরের উচ্চ উচ্চ
অট্টালিকাবাসী শিক্ষিত সমাজটির এ দুর্দশা হল কেমন করে? তারা কোত্থেকে খবর পেলেন যে
আল্লাতা’লা আরবি ছাড়া অন্য কোন ভাষা বোঝোন না? কিম্বা বুঝতে চান না?
তা’ও যদি শব্দের
মধ্যেই তাদের আরবিপ্রীতি সীমাবদ্ধ থাকত। ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-খুলনার রাস্তায় রাস্তায়
আরবি জোব্বাজাব্বা পরিহিত বাংগালি দরবেশদের দেখেছেন? কিম্বা দেখেছেন লক্ষ লক্ষ হিজাব-বোরখা পরা বড় বড়
ডিগ্রিপ্রাপ্ত মেয়েদের? এ দৃশ্য আমি কৈশোরে
দেখিনি, যৌবনে তো একেবারেই না। কিন্তু এখন সেটা সর্বত্র।
১৯৭১ এর আগে পূর্ববঙ্গের
বাঙালি মুসলমান ছিল উর্দুর শেকলে বাঁধা পরাধীন জাতি। স্বাধীনতার
পর তারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে নিয়েছে আরব জাতির আরবিভাষার শেকলবাঁধা আধিপত্য। পরাধীনতাই
কি আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য?
১৯৭১ সালে যে নেতারা
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতিকে সগর্বে ‘জয়বাংলা’ বলতে শিখিয়েছিলেন
সেই নেতারা আজ কোথায় গেলেন। জাতি যখন পরাধীন ছিল তখন আমাদের নেতারা ছিলেন স্বাধীনচেতা। আজকে
জাতি হয়েছে স্বাধীন, আর নেতা-নাগরিক উভয়েরই মন পরাধীনতার পঙ্কে ডুবন্ত। এ বিড়ম্বনা
আমার বোধগম্য নয়।
অটোয়া, ২০শে মার্চ, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২
মীজান রহমান
অনেক মূল্যবান তথ্য ও প্রামাণ্য রয়েছে। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হলো- ৯০ শতাংশ মানুষও ভুল করতে পারে। তার অর্থ এটাও হতে পারে প্রচলিত অর্থে (৯০শতাংশ যে দিকে, সেটাই গণতন্ত্র এবং সেটাই ঠিক) গণতন্ত্র সব সময় ঠিক হয় না। হয়, তারুণ্যের অন্যায়ের প্রতিবোধ। তা তারা ৫ শতাংশও হতে পারে, ১০ শতাংশও হতে পারে। তার প্রমাণ যারা সেদিন No, no, no, বলেছিলেন। তারা ছিলেন মাত্র কয়েকজন...ইতিহাস তো তাই-ই বলছে।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ- অনেক তথ্যবহুল লেখার জন্য---- আশিস বিশ্বাস, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ঢাকা, ashishbiswas@rocketmail.com