মীজান রহমান
গতকাল, একই দিনের একই খবরে, দুটি বিপরীতমুখি তথ্য প্রচারিত হতে দেখলাম। একটির দৃষ্টি দূর অতীতে, আরেকটির দূর ভবিষ্যতে। নিজের মনের ভেতরই অনুভব করা গেল দ্বিমুখি স্রোতের ধারা। একদিকে মন কাঁদে হারিয়ে-যাওয়া সময়গুলোর কথা ভেবে। আরেকদিকে গতির আনন্দে মন চায় নতুন দিনের দ্রুতগামী রথের আরোহী হতে। আধুনিক মন এভাবেই এক ঘূর্ণ্যমান আবর্তের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
গতকাল, একই দিনের একই খবরে, দুটি বিপরীতমুখি তথ্য প্রচারিত হতে দেখলাম। একটির দৃষ্টি দূর অতীতে, আরেকটির দূর ভবিষ্যতে। নিজের মনের ভেতরই অনুভব করা গেল দ্বিমুখি স্রোতের ধারা। একদিকে মন কাঁদে হারিয়ে-যাওয়া সময়গুলোর কথা ভেবে। আরেকদিকে গতির আনন্দে মন চায় নতুন দিনের দ্রুতগামী রথের আরোহী হতে। আধুনিক মন এভাবেই এক ঘূর্ণ্যমান আবর্তের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
প্রথমে নাহয় নতুন দিনের খবরটাই বলি। এদেশের স্কুলপর্যায়ের
শিক্ষাব্যবস্থাতে তিনটি ‘R’ নামক একটা কথা আছে। Reading,
‘riting (writing), ‘rithmetic (Arithmetic). শব্দত্রয়কে সর্বপ্রথম একসাথে
সাজিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন স্যার উইলিয়ম কার্টিস নামক এক সুধীজন, ১৭৯৫ সালে একবার, এবং
দ্বিতীয়বার ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে। তার পর থেকেই বিলেত আমেরিকার প্রাথমিক শিক্ষায় এগুলো প্রায়
বেদবাক্যের রূপ ধারণ করে। অর্থাৎ, আর কিছু শেখ না শেখ বাছারা, এ-তিনটে থেকে কারো মুক্তি
নেই।
সেই বেদবাক্য এখন আধুনিক যুগের রক্ষচক্ষুর সম্মুখিন। আধুনিক প্রযুক্তির
দাবি, এই তিন মহারথির গ্যালারিতে কম্পিউটারকেও ঠাঁই দিতে হবে। ঋষি মুনিরা মাথা
চুলকে বলছেন, ওমা, সে কি করে হয়, ওপরতলাতে তো তিনটেই কেদারা, সেখানে এই নতুন ছোকরাকে
জায়গা দিই কি করে। না, ওসব মানি না, যেভাবেই হোক দিতেই হবে, নইলে আমরা ধর্মঘট
করব। অতএব তাদের দাবি না মেনে উপায় রইল না। সমস্যা হল যে ঠাঁই
তো মোটে তিনজনেরই, চতুর্থজন তো কিছুতেই আঁটবে না। অগত্যা সোয়া দু’শ
বছরের তিন ‘আর’ থেকে একটিকে ছাঁটাই করেই এই আগন্তুকের জায়গা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন
তাঁরা। কথা হল তিন যমজের কোন্টিকে ছাঁটাই করলে সবচেয়ে কম হৈ চৈ হবার সম্ভাবনা? অর্থাৎ
তিন কন্যার কোন্টি সবচেয়ে নিরীহ? বিজ্ঞজনদের গণনা অনুযায়ী, হস্তাক্ষর, অবশ্যই। কম্পিউটার থাকতে
কোন্ বেকুব আজকাল হাতে লিখতে চাইবে? ‘বেকুবত্বের’ দোহাই ছাড়াও বেশ কিছু সরেস যুক্তি
নিয়ে এলেন তাঁরা এই সিদ্ধান্তটিকে ফাঁকফোকর থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করার অভিলাষে। বললেন, Reading কে বাদ দেওয়া যায়
না, কারণ কম্পিউটারের ভাষা পড়তে না পারলে কম্পিউটার রেখে লাভ কি? তাইতো, বইপত্র পড়তে
পারুক বা না পারুক ইন্টারনেট না পড়ে কি উপায় আছে? বা উপায় আছে, বর্তমান যুগে, ফেসবুকে
দেশবিদেশের লাখো লাখো সমমনা মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা? আজকাল সেক্সপীয়ার-এলিয়েট-ভল্টেয়ারের
চাইতে ফেসবুক আর টুইটারের মূল্য হাজারগুণে বেশি। সেক্সপীয়ার দ্বারা
তাহরিয়ার আর শাহবাগ হয়না, ফেসবুক আর টুইটার-টেক্সটিং দ্বারা হয়। যুক্তি বটে!
দুনম্বর হল Arithmetic. একে তো কোনক্রমেই বাদ দেওয়ার
উপায় নেই। শত হলেও কম্পিউটার নিজেই তো গণিতের ঘাড়ে চড়ে এতসব ফুটানি
মেরে যাচ্ছে। একহিসেবে গণিতই হল কম্পিউটারের মাতৃভাষা। আর তাছাড়া পড়াশুনা
শেষ (খেয়াল করুণ আমি কিন্তু ‘লেখা’পড়া বলছিনা, আগের মত। লেখাটাই যদি পাঠক্রম
থেকে বাতেল হয়ে যায় তাহলে পড়ার সঙ্গে ‘লেখা’কে যুক্ত করি কিভাবে?) করে যখন দুলালদুলালীরা
কর্মজীবনে প্রবেশ করে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করতে শুরু করবে, তখন তাদের ধনদৌলতের
হিসাব রাখার জন্যও তো গণিতের প্রয়োজন। সুতরাং ইউক্লিডের জ্যামিতি অনুযায়ী ত্রিবাহু আবশ্যিকের মাঝে
একমাত্র বর্জিতব্য হল হস্তলিপি। তাই হল। ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশের বেশ ক’টি প্রাথমিক শিক্ষাঞ্চলে
এখন থেকে হাতে-লিখার ওপর কোনও ক্লাস করা হবে না----এটা বাধ্যতামূলক নয়, স্বেচ্ছাধীন। বাবামা চাইলে বাড়িতেই
শেখাবেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের, কিন্তু স্কুলের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। কম্পিউটার দিয়েই
যখন সব লেখালেখির কাজ সেরে ফেলা সম্ভব তখন হাতের আঙ্গুলের মত ঢিলে জিনিসের ব্যবহার থাকার কি প্রয়োজন? আঙ্গুল
চালাতে হয় কিবোর্ডে চালাবে, কাগজে কেন?
তাইতো। ঢিলেদের কোনও জায়গা থাকবে কেন এযুগের ইনফর্মেশন হাইওয়েতে?
আধুনিক যুগের প্রধান যুক্তি হলঃ সময় ও দক্ষতা। কম্পিউটার, অর্থাৎ
যন্ত্র, নাকি সময় বাঁচায়, উৎপাদনক্ষমতা বাড়ায়, মানবজীবনের সমৃদ্ধিবর্ধন ও তুষ্টি আনয়নে
সহায়তা করে। ওরা বলেঃ টাইম ইজ মানি। পুরনো দিনে টাইম
ছিল পিপল---মানুষ। এখন মানুষ অবান্তর। এখন মানুষকে হটিয়ে
বহাল তবিয়তে আসন করে নিয়েছে যন্ত্র, প্রযুক্তি। ভাগ্যের কি অদ্ভুত
বিড়ম্বনা দেখুন। মানুষ তার মাথা খাটিয়ে তৈরি করল যন্ত্র, তার জীবনে একটু সুখস্বাচ্ছন্দ্য
এনে দেবে বলে, অথচ সেই যন্ত্রই আজকে তার চাকরিখানা খুইয়ে দিয়ে আরাম করে বসেছে তার ঘাড়ের
ওপর। মানুষের সুখ হয়ে গেছে এখন যন্ত্রের সুখ।
এটা অবশ্য না মেনে উপায় নেই যে দৈনন্দিন জীবনে এমন সব অত্যাশ্চর্য বস্তুর আবির্ভাব
হয়েছে এখন যে গত শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যায়েও সেগুলো কারুর কল্পনায় প্রবেশ করার মত
ছিল না। বিশ-পঁচিশ বছর আগে কি কেউ ভেবেছিল যে একদিন সে রাস্তার চৌমাথায়, প্রচণ্ড জানবাহনের
ভিড়ে, পকেট থেকে ফোন বের করে দশ হাজার মাইল দূরবর্তী প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে পারবে?
কিম্বা পারবে গাড়ির ভেতরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আরাম করে বসে তার তিনশ ডলারের সেলফোন
দিয়েই পথের জীবনের নানা দৃশ্য তুলে ফেলতে পারবে, এবং তোলার পর হয়ত গাড়ি থেকেই সেগুলো
ই-মেইলে করে পাঠিয়ে দিতে পারবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে? না, এগুলো কারো কল্পনায় ছিল না, একমাত্র
বিজ্ঞানের রূপকথা লিখিয়েরা ছাড়া? হ্যাঁ, আরাম এসেছে বটে, যাদের সে আরাম উপভোগ করার
মত সামর্থ্য আছে। কিন্তু এই ‘আরাম’ সৃষ্টিকারী মানুষগুলোর অনেকেই এখন বেকার,
সেটা আমরা, এই আরামভোগী ভাগ্যবানরা, প্রায়ই ভুলে যাই।
এবার আমার দ্বিতীয় গল্পটাতে নিয়ে যাব
পাঠককে। যেখানে প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় রয়েছে অতীত। রয়েছে স্মৃতি, প্রেম,
ভালোবাসা। এবং চিঠি, হাতে-লেখা চিঠি।
মেয়েটার নাম কার্বি।২৬ বছর বয়স্ক একটি সুশ্রী কমনীয় চেহারার
মেয়ে। শিক্ষিত, ক্যানাডা সরকারের শিক্ষাদপ্তরে মধ্য পর্যায়ের চাকরিতে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত। কলেজে থাকাকালেই একটা
প্রচণ্ড মেধাবী ছেলের সঙ্গে তার পরিচয়। এবং একবছরের মধ্যে তাদের বিয়েও হয়ে যায়। সেটা টেকেনি, বিবিধ কারণে। হয়ত তারই ভুল হয়েছিল কোথাও, হয়ত ছেলের, বা দুজনেরই। কিন্তু সেই একই ভুলের
পুনরাবৃত্তির কোনরকম ইচ্ছা তার আপাতত নেই। বছর তিনেক আগে, প্রথমে
তার মা মারা গেলেন ব্রেস্ট ক্যান্সারে। সেই শোকেই হয়তবা, বাবাও হঠাৎ করে চোখ
বুঁজলেন হার্ট এটাকে, বছর পেরোতে না পেরোতেই। কার্বির ভাইবোন কেউ
নেই, সে একাই। বেঁচে ছিলেন কেবল বুড়ো দাদু আর দাদী। শহরের একটা বনেদী পাড়াতে,
(যদিও সেই ‘বনেদী’ত্বটা অনেকটাই ধ্বসে পড়েছে এখন আধুনিকতার চাপে পড়ে), ৬০ বছরের পুরনো
বাড়িতে দুটিতে মিলে সেই যে সুখের সংসার পেতেছিলেন যৌবনে সেটা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে
চাননি। কার্বির ইচ্ছা ছিল তাঁরা দুজনই কোনও আশ্রমে উঠে যান যেখানে চব্বিশ ঘন্টা কেউ-না-কেউ
তাদের ফুসফরমাস করতে পারবে, দরকার পড়লে যখন তখন ডাক্তার হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু না, তাঁরা কিছুতেই
নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। এবিষয়ে দুই বুড়োবুড়ি একেবারে অনড়। কি আর করা। কার্বি একার পক্ষে যতখানি
করা সম্ভব করে যাচ্ছিল। প্রতি সপ্তাহে একবার করে গ্র্যাপা আর গ্র্যামা’র বাড়িতে খাবারদাবার
নিয়ে যাওয়া, কপড়চোপড় ওয়াসে ঢোকানো, একাধটু ধোয়ামোছা করা, দরকার হলে মেঝে ভ্যাকুয়াম
করা, এগুলো সে করে দিত। দাদা-দাদী তার ভয়ানক কাছের মানুষ ছিলেন। এতটা কাছে সে বোধ হয়
তার বাবামার সাথেও ছিল না।
তারপর একদিন, বাবার মৃত্যুর শোকেই হয়ত,
দাদী চলে গেলেন প্রায় নিঃশব্দেই। রাতে শুতে যাবার আগে সুন্দর সুস্থ মানুষ,
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই বলেন, শরীরটা জানি কেমন করছে। ওমা, যেই না বলা অমনি কাত্
হয়ে শুয়ে সেই যে অজ্ঞান হলেন তারপর আর জ্ঞান ফিরে আসেনি।
কার্বি বলল, এবার আমি কোন কথা শুনব না
দাদু----আপনাকে আশ্রমে যেতেই হবে। এবাড়িতে একা থাকা কোনক্রমেই সম্ভব নয়
আপনার পক্ষে। ‘কে বলে সম্ভব নয়?’ ক্ষেপে উঠলেন দাদু। ‘তুমি দেখতে চাও কিভাবে
থাকি? সপ্তাহে একবার করে তুমি দেখতে এসো তোমার দাদু কেমন করে নিজের জীবন নিজেই চালাতে
পারে’। হাজার কাকুতি মিনতি করেও বুড়োর মন গলানো গেল না। তাঁর মুখের এক কথা। তা থেকে একবিন্দু নড়চড়
করানোর সাধ্য কারো নেই। একমাত্র একটি লোক ছিলেন সংসারে যে পারতেন, তিনি তো চলেই গেলেন। কার্বি মনে মনে ঠিকই
জানত দাদু ঠিক কি কারণে অন্য কোথাও যেতে চাচ্ছেন না----কারণ এ-বাড়িতেই তো সব স্মৃতি
তাঁর। দাদী সশরীরে না থাকলেও তাঁর উপস্থিতি তো নিত্যই তাঁর অন্তরে। তিনি তো এবাড়িরই একটা
অংশ। এবাড়িতে তিনি একাকি হয়েও নিঃসঙ্গ নন----দাদী আছেন তাঁর সঙ্গে দিবানিশি। এত গভীর ভালোবাসা কার্বি
সংসারে আর কোথাও দেখেনি। তার নিজের জানাশুনা পরিবেশে তো নয়ই, কখনও শোনেওনি কারু মুখে এমন প্রেমের গল্প। সেই কারণেই কার্বি এত
আকৃষ্ট ছিল তার দাদা-দাদীর প্রতি। অশীতিপর বৃদ্ধ হয়েও তাঁরা ছিলেন তার জীবনের
উজ্জ্বলতম আলোকবর্তিকার মত। ওঁদের সান্নিধ্যের উত্তাপে সে ধন্য বোধ
করত নিজেকে, ওঁদের প্রেমময় জীবন তার নিজের জীবনের নিরুদ্ধ শূন্যতাকে প্রকটভাবে ফুটিয়ে
তুলত। তাকে একাধারে খর্ব করে করে উত্তোলিত করে তুলত।
একদিন সকালবেলা এক কাপ কফি খেয়ে সে অফিসে
চলে গেছে। দুপুর হতে না হতেই টেলিফোন। হাসপাতাল থেকে----তার
দাদু এমার্জেন্সিতে। সব্বনাশ, কেন ? নার্স বলল পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙ্গে ফেলেছেন। এক প্রতিবেশীর ফোন পেয়ে
এমার্জেন্সির গাড়ি বাড়ি থেকে তুলে আনে তাঁকে। কার্বি তৎক্ষণাৎ বসকে বলে হাসপাতালে দৌড়। গিয়ে দেখে দাদু প্রায়
অবশ হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। কার্বিকে দেখে মুখে একটু হাসি ফোটাবার
চেষ্টা করে হাত বাড়িয়ে ওর হাতের ওপর রাখলেন। খুব আস্তে করে বললেন, লাইট বাল্ব নষ্ট
হয়ে গিয়েছিল। বেইজমেন্ট থেকে মই এনে নতুন বাল্ব লাগাবো বলে উঠেছি, মই আমাকে
নিতে চাইল না। এটা কি আমার দোষ বল? না, তোমার দোষ নয়, দাদু, দোষ তুমি আমাকে
ডাকলে না কেন। বারে, তুমি তো কাজে---আমি তোমাকে বাধা দেব কোন্ আক্কেলে?
এই হল কার্বির দাদু। যেমন একরোখা, তেমনি
স্বনির্ভর----পারতপক্ষে কারু সাহায্য চাইবেন না, মরে গেলেও না। এমন মানুষকে প্রাণ দিয়ে
ভালো না বেসে উপায় আছে?
দুর্ভাগ্যবশত দাদুর বয়স তখন নব্বুই ছুই
ছুই। এবয়সে মই থেকে পড়ে হাড় ভেঙ্গে ফেলা মানে যমের বাসায় পা ঢোকানো। এবং ঠিক তা’ই হল। দুদিন আই সি ইউতে থাকার
পর যেদিন ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হয় তার পরের দিনই লাগল বুকের সর্দি। আস্তে আস্তে সে সর্দি
হয়ে গেল নিমোনিয়া। কদিন পর হাসপাতালের বিছানাতেই দাদু শেষ।
কার্বি বড় শক্ত মেয়ে। সহজে কাঁদে না। দাদীর মৃত্যুর সময় কাঁদেনি। দাদীর কফিন মাটিতে ঢেকে
ফেলার সময় সবাই কাঁদল, কেবল কার্বির চোখই শুকনো। দাদুর বেলায় তার ব্যতিক্রম
হওয়ার কথা ছিল, কারণ শেষের বেশ কতখানি সময় তো সে দাদুর সঙ্গেই কাটিয়েছে। কিন্তু না, সেই কবে
যে তার কান্না শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, সেই কাঠ আর নরম হবার নাম নাই। ফিউনারেলের সামাজিক
আনুষ্ঠাকিতা সেরে একদিন যখন বুকে সাহস নিয়ে দাদুর খালি বাড়ির দরজার চাবি খুলে ঘরে ঢোকে,
তখনও তার চেহারাতে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। তাদের পারিবারিক উকিল যখন খবর দিলেন ওকে যে মৃত্যুর আগে দাদু তাঁর সমস্ত বিষয়-আশয় ওরই নামে লিখে দিয়েছেন, তখনো কোনও বিকার নেই কার্বির। দারুণ সংযম আয়ত্ত করে ফেলেছে মেয়েটা।
দাদুর একটা কুকুর ছিল। বারো-তেরো বছর ধরে সে
এবাড়ির পারিবারিক সদস্য। দাদীর মৃত্যুর পর সেই কুকুরটাই বরাবর দাদুকে চোখে চোখে রেখেছে,
দাদুর মই থেকে পড়ে যাওয়ার পর সে’ই একটানা ঘেউ ঘেউ শব্দ করে পাড়াপ্রতিবেশিদের সজাগ করেছিল,
যার ফলে তারা ৯১১ এ খবর দিতে পেরেছিলেন। শেষে দাদু যখন হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেন
না বাড়িতে সে যে কি বিলাপ অবলা জীবের। কুকুরের কান্নার সঙ্গে যারা পরিচিত কেবল
তারাই বুঝবে তার অর্থ কি----বুকের পাঁজর কিভাবে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে সে শব্দ। দাদুর হাসপাতালে যাবার
পর কুকুরটিকে নিয়ে এসেছিল কার্বি। শেষকৃত্যের পর আজ এই প্রথম কুকুরটিকে
নিয়ে দাদুর বাড়িতে ঢুকেছে। ঢোকামাত্র সে যেন নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে
এমন স্বচ্ছন্দ ভাব তার চোখেমুখে। একদৌড়ে চলে গেল পেছনের পাকঘরে। সেখান থেকে ফ্যামিলি
রুমে, উপরতলায় শোবার ঘরে যেখেনে দাদু আর দাদী ঘুমুতেন। ইতিমধ্যে কার্বি চুপ
করে বসে ছিল দাদুর আরাম কেদারাটিতে। সামনের ফায়ারপ্লেসটা সে ইচ্ছে করেই জ্বালায়নি। এই ফায়ারপ্লেসের কাছে
দাদুর সঙ্গে কত সুন্দর সময় কাটিয়েছে সে। দাদু পুরনো দিনের মানুষ। তাঁর যৌবনে লোকের বাড়ি
বাড়ি সেন্ট্রাল হিটিং ছিল না----অধিকাংশ বাড়িতেই ছিল এই ফায়ারপ্লেসের ওপরই ভরসা। অনেকে হিটিং থাকা সত্ত্বেও
ফায়ারপ্লেসে আগুণ ধরিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। কার্বির দাদাদাদী ছিলেন ওরকম মানুষ। তাঁদের সাথে সাথে কার্বি
নিজেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল ওতে। কিন্তু আজ নয়। দাদুকে ছাড়া ফায়ারও
যেন কেমন ঠাণ্ডা মনে হয় তার কাছে।
দাদুর কেদারাতে বসে কার্বি কি ভাবতে ভাবতে
তার কুকুরের কথা প্রায় ভুলেই যাচ্ছিল। এমন সময় সেই কুকুরই এসে উপস্থিত তার সামনে। মুখের ভেতর কি যেন ঢুকিয়ে
এনেছে। তাকিয়ে দেখে দাদুর চশমার খাপ। চারপেয়ে প্রাণীটা তার প্রভুর ব্যবহৃত
চশমাটা দেখে বোধ হয় ভেবেছিল ওটা তাঁর দরকার হতে পারে, তাই নিয়ে এসেছে সঙ্গে। ঐ দৃশ্য দেখার পর কি
জানি কি হল কার্বির, সেই শক্ত পাথরের মত মেয়েটি তার এতদিনের যত্ন করে ধরে রাখা সংযম
হারিয়ে ফেলল। সে অবোধ জীবটির গলা জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে শুরু করে দিল। বোকা কুকুর ওর কান্না
দেখে কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সেখানে----যেন কার্বিকে সান্ত্বনা
দেবার চেষ্টাতে।
ওপরতলায় চিলেকোঠার মত ছোট একটা ঘর ছিল----যেখানে
কেউ থাকেনি কোনদিন। পুরনো মালপত্র বোঝাই করে রাখা হত সেখানে----একপ্রকার স্টোররুমের
মত। কার্বির মন চাইল সেখানে দাদাদাদীর কোন রহস্য খুঁজে পাওয়া যায় কিনা দেখতে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা
ভাঁপসা স্যাঁতসেতে গন্ধ আর একঝাঁক প্রাচীন
ধূলা তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। এ ঘরটিতে আগে কখনো ঢোকার সুযোগ হয়নি কার্বির----ওর
দাদী সবসময় তালাবন্ধ করে রাখতেন ওটা। যেন পুরনো দিনের কোনও রাজাবাদশার গোপন
হীরাজহরত লুকানো আছে সেখানে। দাদীর মৃত্যুর পর তার খেয়ালই হয়নি দাদাকে
কিছু জিজ্ঞেস করতে সেবিষয়ে----কেন সেই ঘরটা সবসময় বন্ধ থাকে। এসব বিষয়ে এযুগের ছেলেমেয়েদের
কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আজকে এবাড়ি তার নিজেরই বাড়ি। এবাড়ির কোথায় কি আছে
তার জানা দরকার----ভাড়াটে পেতে হলে, বা বিক্রি করতে চাইলেও লোকে জানতে চাইবে বাড়ির
পুঙ্খানুপুক্ষ তথ্যাদি।
প্রথমেই চোখে পড়ে ঘরের ঠিক মধ্যিখানে
এলোমেলোভাবে স্থাপন করা একটা চারপায়া জাতীয় জিনিস, এদেশে যাকে বলে কলাপ্সিবল বেড----স্প্রিং
লাগানো হালকা বিছানা, যা দরকার না হলে সাধারণত গুটিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়, আবার
দরকার হলে স্প্রিং খুলে বিছানার মত করে পেতে দেওয়া হয়। এ-বিছানা গত বিশত্রিশ
বছরে একবারও ব্যবহার হয়েছে কিনা সন্দেহ, কিন্তু এমনভাবে ছড়ানো যাতে মনে হবে এইতো গত
রাতেই বাড়িতে অতিথি এসেছিল। এমনকি পুরনো ঘূনে-ধরা ময়লাতে-প্রায়-ঢেকে-
যাওয়া তোষকখানাও ঠিক সেভাবেই রয়ে গেছে। ওদিকে ঘরের এককোনাতে অনেকগুলো এলবাম একটার
পর একটা স্তূপ করে রাখা। নিশ্চয়ই সব পুরনো পারিবারিক ছবি সেখানে----একদিন সময় করে
দেখা যাবে, মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় কার্বি। তার ঠিক পাশেই একটা পায়াভাঙ্গা কাঠের
চেয়ার উপুড় করে রাখা। কয়েকজোড়া স্লিপার, জুতো, এদিক ওদিক ছড়ানো। এবং হাজার প্রকারের
জঞ্জালের মাঝে বেশ বড় আকারের একটা সেকেলে ট্রাঙ্ক----সাধারণত দরকারি কাগজপত্র, বাড়ির
দলিল, বিয়ের সার্টিফিকেট, বার্থ সার্টিফিকেট, এধরণের জিনিস যত্ন করে রেখে দেওয়া হত
এধরণের বড় বাক্সতে। কার্বি অনুমান করে নেয় যে এরই ভেতর পাওয়া যাবে দাদা-দাদীর
জীবনের খুঁটিনাটি খবর। আর কিছু না থাক, ওর বাবার ছোটবেলায় স্কুল থেকে পাওয়া রিপোর্ট
কার্ড, বাবার প্রথম পেন্সিলে আঁকা ছবি, প্রথম স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ লিখার চেষ্টা, প্রথম
জন্মদিনের কার্ডগুলো----এগুলো সংসারের কোন মা’ই পারতপক্ষে ফেলে দেয় না। ওগুলো না থেকেই পারেনা। কিন্তু আর কি? আর কি
রহস্য থাকতে পারে সেখানে? কার্বি তার কৌতূহল সামলাতে না পেরে প্রথমে ওই ট্রাঙ্কটাই
খুলে ফেলল----ওতে তালা লাগানো ছিল না (একটু আশ্চর্যই হয়ে গেল সে)। হ্যাঁ, ঠিক যা ভেবেছিল। পারিবারিক কাগজপত্র
তো ছিলই, উপরন্তু সে যা ভেবেছিল তার বাবার ছোটবেলাকে নিয়ে, তার সবই ছিল সেখানে। সাথে সাথে আরো একটা
জিনিস ছিল যা ওর কাছে একটু ভিন্নরকম মনে হল। বড় একটা খামের ভেতর অত্যন্ত যত্ন করে
ভরে রাখা একগাদা চিঠি, যার সবগুলোই পুরনো দিনের পাতলা নীল রঙের কাগজে লেখা। নিশ্চয়ই দাদী আর দাদার
ব্যক্তিগত চিঠি। তাঁদের দুজনেরও কেউ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে অবশ্যই সে তাঁদের
অনুমতি ছাড়া কোনক্রমেই চিঠিগুলো খুলে পড়ার কথা কল্পনা করতে পারত না। কিন্তু তাঁরা কেউ নেই
এখন। এই চিঠিগুলো এখন পারিবারিক সম্পদ----যার একমাত্র স্বত্বাধিকারী কার্বি নিজে। সে আপাতত অন্য কিছু
বাদ দিয়ে চিঠির খামটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নিজের এপার্টমেন্টে
গিয়ে আরাম করে পড়বে।
চিঠি, চিঠি আর চিঠি। একসাথে এত চিঠি সে জীবনে
দেখেনি। দাদুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে চিঠিগুলো সব খুলে রেখেছে সে তার লিভিং রুমের লম্বা
টেবিলটাতে। সময় নিয়ে, একটু একটু করে পড়বে। তাড়াহুড়ো করে নয়, ধীরে
সুস্থে, যখন মন চায় তখন, সোফার গদিতে আরাম করে বসে, পড়বে। দাদীর প্রথম যৌবনের
হস্তাক্ষরে, গুটি গুটি করে লেখা, তাঁর দূরবাসী প্রিয়তমের কাছে লেখা প্রেমপত্র। এ-বয়সে সদ্য-বিয়ে-করা
স্বামীর কাছ থেকে মাসের পর মাস বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা যে কি মর্মান্তিক সে অভিজ্ঞতা তার
নিজেরও কিছুটা ছিল। দাদীর মত দীর্ঘ তিনমাস সতেরো দিন নয়, পুরো একমাসও নয়, আটাশ
দিন সব মিলে, তাতেই মনে হয়েছিল ও ফিরতে ফিরতে সে বুঝি বুড়োই হয়ে যাবে। ওর বর ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তর ছাত্র। সুপারভাইজারের সঙ্গে চার সপ্তাহের জন্য
গিয়েছিল আফ্রিকার কোন এক প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থলে। কার্বির মনে হয়েছিল
সে পাগল হয়ে যাবে---যেন কেউ তাকে জোর করে একটা অন্ধকার জনমানবশূন্য কারাগৃহে ঢুকিয়ে
রেখেছে। দাদীর চিঠিগুলো পড়তে পড়তে তার নিজের জীবনের ব্যর্থতা-বিড়ম্বনা যেন নতুন করে
তার সামনে এসে দাঁড়ালো। পুরনো ক্ষত আবার কনকনিয়ে উঠল মনের গভীরে।
চিঠিগুলোর ব্যক্তিগত আবেদনটুকু বাদ দিলে
অন্য কোন বৈশিষ্ট্য অবশ্য মোটেও ছিল না। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে গেলে একেবারেই সাদামাঠা----একটি
স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মেয়ের একাকি হৃদয়ের হাহাকার বই কিছু নয়। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত
ঐতিহাসিক চিঠিপত্রের সঙ্গে এক আসনে স্থান পাবে সে সম্ভাবনা বোধ হয় বাতেল করা যায় অনায়াসে। কিন্তু কার্বির কাছে
সেগুলো দুর্মূল্য। সেগুলো তাকে লণ্ডনের অলিতে গলিতে নিয়ে যায়, যেখানে দাদী-দাদুর
স্বল্পকালীন অভিসারের সোনালী সময়টি অতিবাহিত হয়েছিল। যেখানে তাঁরা একে অন্যের
হাতে হাত রেখে চলতেন, একে অন্যের প্রতি গাঢ় মুগ্ধতায় গভীরভাবে আচ্ছন্ন----সেই অনন্য
মুহূর্তগুলোকে ধরে রেখেছে সেই জায়গাগুলো। কার্বি তার মনের ভেতর একটা প্রচণ্ড টান
অনুভব করে সেই ছবিগুলোর প্রতি। দাদীর অপক্ক হাতের স্পর্শে তাঁর চিঠির মধ্য দিয়ে আশ্চর্য
সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে উঠেছে ওই দৃশ্যগুলো। দাদীর চিঠিতে কার্বি জানতে পারে ফুলহাম
রোডের কফিহাউসের কথা, যেখানে তাঁরা চা-কফি খেতে যেতেন। জানতে পারে টটেনহাম
কোর্ট রোডের মুভিহাউসের কথা যেখানে দুটিতে মিলে ছবি দেখার নাম করে চুটিয়ে প্রেম করতেন। এ সব কথাগুলোই নির্লজ্জভাবে
ফুটিয়ে তুলেছেন দাদী তাঁর কাঁচা ইংরেজিতে।
কার্বি ভাবেনি যে চিঠিগুলো তাকে এতটা
আবেগপ্রবণ করে তুলবে। আপনজনের নিজের হাতে লেখা পুরনো চিঠি যে এত শক্তিশালী হতে
পারে সেটা এই যান্ত্রিক যুগের ছেলেমেয়েদের পক্ষে কি বোঝা সম্ভব? তার প্রয়াত পিতামহী
যেন আদর করে তার হাত ধরে নিয়ে গেলেন সেখানে, যেখানে তাঁর স্মৃতির পুষ্পকলিগুলো ছড়িয়ে
এসেছিলেন যাতে করে সে একদিন নিজে থেকেই সেই পদচিহ্ন অনুসরণ করে খুঁজতে যাবে তার শিকড়কে। একটা অব্যক্ত তৃষ্ণা
জেগে উঠল তার মনে। এ-তৃষ্ণা দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ চাওয়াপাওয়ার মত নয়---এর
প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তাকে যেতে হবে লণ্ডনে। নিজের চোখে সব দেখতে
হবে। হাত দিয়ে সব স্পর্শ করতে হবে দাদীর স্মৃতিমন্দিরে।
হিথ্রো থেকে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে করে পিকাডেলি
লাইনে সোজা নাইটসব্রিজ স্টেশন। সেখানে একটা রুমিং হাউসে আগে থেকেই একটা
রুম সে ভাড়া করে রেখেছিল দু’মাসের জন্য। ইন্টারনেটে আজকাল কিছুই শক্ত নয়। নাইটসব্রিজ কেন? কারণ
দাদীর চিঠিগুলোতে সেই এলাকাটিরই একটা ঠিকানা লেখা ছিল। সেখানে যেতে হবে তাকে। কার্বির ইচ্ছে রুমিং
হাউস থেকে হেঁটে হেঁটেই চলে যাবে সেখানে। লণ্ডনে তার জানাশুনা যে কেউ ছিল না তা
নয়, স্কুলের একই ক্লাসে-পড়া এক ক্যানাডিয়ান বন্ধু বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে লণ্ডনে চলে
এসেছিল----দূতাবাসের সেকেণ্ড সেক্রেটারি তার স্বামী। কিন্তু কার্বি ইচ্ছে
করেই তার বন্ধুকে এড়িয়ে যাচ্ছে। সে এসেছে তার দাদী আর দাদুর শেকড়ের সন্ধানে। এ-ভ্রমণ অত্যন্ত ব্যক্তিগত।
লণ্ডনের ম্যাপের মধ্যে দাদীর সেই ঠিকানা
বের করে কার্বি সহজেই পৌঁছে গেল তার গন্তব্যে। সাধারণ মধ্যবিত্ত গোছের
বাড়ি---লণ্ডনের বেশির ভাগ বাড়ির মত এটিও পুরো রাস্তার একমাথা থেকে আরেক মাথা অবধি লম্বা
রো হাউসের ছোট অংশবিশেষ। দাদীর সময় থেকে ৬০ বছরের ওপর সময় পার হয়ে গেছে। অনেককিছুই আগাগোড়া বদলে
যাওয়ার কথা----ক্যানাডা-আমেরিকায় সচরাচর যা হয়। কিন্তু ইংল্যাণ্ডে বড়রকমের
পরিবর্তন কেবল বড়রকমের বিপর্যয় ঘটলেই ঘটে, নইলে নয়। দাদীর এই বাড়িটা ১৯৪৬
সালে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটের সমষ্টি ছিল, এখনও তা’ই। দাদী থাকতেন চারতলায়,
একেবারে ছাদের নিচে, এটিকে। জানালা বলতে ঠিক যা বোঝায় সেরকম কিছু
ছিল না, ছাদের কাঠ কেটেই একটা জানালার মত করে তৈরি করা ফাঁকা জায়গা, যেখান থেকে দাদী
রোজ আকাশ দেখতেন, আর ভাবতেন তাঁর প্রিয়জন সেই আকাশেরই কোথাও দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখছেন। রীতিমত কাব্য! প্রেমে
পড়লে বুঝি সবার ভেতরেই একটু কাব্যভাব জন্মায়। চারতলার উঁচু সিঁড়ি
ভেঙ্গে সেই ফ্ল্যাটের দরজায় আস্তে করে টোকা দেয় কার্বি। এক বিদেশী রকম দেখতে
ভদ্রমহিলা পুরো দরজাটা না খুলে জিজ্ঞেস করলেনঃ কি চাই। কার্বি সংক্ষেপে গল্পের
সারমর্মটুকু বর্ণনা করে ভদ্রমহিলার অনুমতি চাইল কিছুক্ষণের জন্যে ওকে একা থাকতে দেবেন
কিনা তাঁর ঘরে। মহিলা চট করে রাজি হবার আগে ওর আপাদমস্তক পরীক্ষা করে যেন
দেখতে চাইল গোপন কোন অভসন্ধি আছে কিনা। তারপর কি মনে করে বললেনঃ ঠিক আছে, দশ
মিনিট। তার বেশি সময় দিতে পারব না। কার্বি হয়ত আরো কিছু সময় ব্যবহার করতে
পারত, কিন্তু কি আর করা। ওই দশ মিনিটেই সাধ মেটাতে হবে যতটুকু সম্ভব। ভদ্রমহিলা ঘর ছেড়ে চলে
যাওয়ার পর সে ভালো করে তাকাল চতুর্দিকে। কল্পনা করতে চেষ্টা করল দাদী যখন থাকতেন
সেখানে তখনকার চেহারাটা। নিশ্চয়ই এতটুকু ঘরের ভেতরে এতগুলো আসবাব ঠাসাঠাসি করে রাখতেন
না তিনি। হয়ত এককোনাতে ছো্ট একটা টেবিল ছিল, চারপায়া না তিনপায়া তাই
বা কে বলবে, সেকালে তো বিলেতে অনেক বাড়িতে তিনপায়া টেবিলের ব্যবহার ছিল, দাদীর মুখেই
শোনা সেটা, আর সেখানে বসে তিনি গুটি গুটি করে চিঠি লিখতেন তাঁর প্রিয়তমকে রোজ। কার্বি সেই মুহূর্তগুলোকে
নিজের বুকের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করে। অনুভব করার চেষ্টা করে তাঁর পদধ্বনি,
সন্ধ্যাবেলা একা একা ঘরে ফিরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ার দৃশ্য মেঝের মাঝখানে লম্বালম্বি
করে পেতে রাখা খাটিয়ার ওপর। দাদী যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন সবকিছু
খুটে খুটে দেখাবেন বলে। এই খাটের নিচে তোর দাদুর চিঠিগুলো সব রেখে দিতাম। ওই টুলটাতে থাকত আমার
চায়ের সরঞ্জাম। রাতে যখন তোর দাদুর কথা ভেবে ভেবে ঘুম চলে যেত চোখ থেকে তখন
আলো জ্বালিয়ে চা খেতাম মাঝরাতে। কার্বির মন আপনা থেকেই কোথায় কোথায় চলে
গেল। সম্বিৎ হল সেই ভদ্রমহিলা যখন কাজ সেরে
ফিরে এলেন তাঁর ফ্ল্যাটে। এবার যাবার সময়।
এর পর একে একে লণ্ডনের প্রতিটি চিহ্নিত
জায়গায় গিয়ে এমনি করে বেশ কিছু সময় কাটায় কার্বি। ফুলহাম রোদের সেই কফিহাউসটি
এখনো কফিহাউস বলেই মনে হয়। কার্বি সেখানে একটা ডোনাট আর এক কাপ কফি
নিয়ে আরাম করে বসে একটা খালি টেবিলে। একই টেবিলে এসে যোগ দেয় তার দাদাদাদী----অন্তত
সেরকমই মনে হয় তার কাছে। সেখান থেকে সে যায় টটেনহাম কোর্ট রোডের সেই মুভিহাউসে। কি ছবি চলছিল না দেখেই
টিকেট কিনে ঢুকে পড়ল। সে ছবি দেখতে যায়নি, অন্য কিছু দেখতে গিয়েছিল। তারপরের দিন অক্সফোর্ড
স্ট্রীটের একটা সস্তা খাবারের দোকানে, যেখানে বসে ওঁরা ‘উইম্পি’ খেতেন মজা করে। উইম্পির কথা আমারও মনে
আছে। ছাত্রাবস্থায় কেম্ব্রিজ থেকে লণ্ডনে আসতাম বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে। তখন সবাই মিলে উইম্পির
দোকানে গিয়ে মজা করে উইম্পি খেতাম আমরা। খেতে অনেকটা আমাদের কড়া-ভাজা সমুসার মত। কিন্তু লণ্ডনে এখন উইম্পি
পাওয়া দুষ্কর। তার পরিবর্তে সবাই মনোযোগ দিয়েছে সোজা সমুসার প্রতি----বিলিতি
সাহেবসুবোদেরও জিবের স্বাদ বদলে গেছে। কার্বি উইম্পির বদলে সমুসা খেয়েই দুধের
স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে এল। তারপর সে যায় কেন্সিংটন হাই স্ট্রীটের বার্কলেতে যেখানে শীতের
কোট কিনতে গিয়ে দাম শুনে দাদী ভয়ে দৌড় দৌড় করে পালিয়ে এসেছিলেন। অন্তত দোকানটা দেখা
দরকার। আরেকদিন সে হাইড পার্কে। সারপেন্টাইউন লেকের ধারে সবুজ ঘাসের ওপর
আরাম করে বসে সে লেকের জলে নৌকাবিহারে বেরুনো তরুনতরুনীদের দিকে চেয়ে চেয়ে তার গ্র্যাণ্ডপা-গ্র্যাণ্ডমার
পুরনো দিনগুলোর কথা ভাবে। তাঁরাও ঠিক এভাবেই মনের আনন্দে বৈঠা বেয়ে লেকের শান্ত জলের
ওপর ভেসে বেড়াতেন। পরের দিন হয়ত পার্লামেন্ট বিল্ডিঙ্গের সামনে---বিগ বেনের
নিচে, যেখানে তাঁদের জড়াজড়ি করে একে অন্যকে ধরেরাখা পোজের ছবি আছে দাদুর ঘরে। একসময় সে নাইটসব্রিজ
এলাকারই স্থানীয় মার্ক্স এণ্ড স্পেন্সার দোকানে গিয়ে গরম কোটের জায়গাতে যায়। নেড়ে চেড়ে দেখে কোটগুলো। দাদী হয়ত এই দোকান থেকেই
একটা কোট পরে ক্যানাডায় গিয়েছিলেন।
দুটো মাস কেমন করে কেটে গেল। একপ্রকার ঘোরের মধ্যে। কার্বির মনে হয়, যে-মানুষটি
তার দেহের ভেতরে থেকে হিথ্রোতে নেমেছিল, হিথ্রো থেকে যাবার সময় যেন ঠিক একই মানুষটি
যাচ্ছে না তার সঙ্গে।
এক বাক্স পুরনো চিঠি কি আশ্চর্য ক্ষমতাবান।
ভাবছি, কার্বি নিজে যদি দাদী হয় কোনদিন তাহলে তার ট্রাঙ্কে কি কোন প্রেমপত্র থাকবে যেগুলো অনুসরণ করে তার দৌহিত্রী তাকে খুঁজতে বেরুবে?
অটোয়া, ২রা মার্চ,’১৩
মুক্তিসন ৪২
মীজান রহমান :: Mizan Rahman
No comments:
Post a Comment