মীজান রহমান
সে এক অবিশ্বাস্য গল্প।
প্রেমিকপ্রেমিকার গল্প ঠিকই, কিন্তু তাহলেও
এ-গল্প সাধারণ প্রেমিকপ্রেমিকাদের গতানুগতিক
গল্প নয়। প্রেমের গল্প যত হৃদয়বিদারকই হোক, কোন গল্পই এখন আর অশ্রুতপূর্ব কিছু নয়, অবিশ্বাস্য
তো মোটেও নয়। সব মিলনান্ত আর বিয়োগান্ত ঘটনাই ঘটে গেছে যা ঘটবার----নতুন করে ঘটবার কিছু নেই। কিন্তু আজকের এ-গল্প সত্যি সত্যি অবিশ্বাস্য
ও অবাস্তব। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মত নয়।
এ-গল্পের নায়কনায়িকা আমাদের বাংলা ছবির
অতিপরিচিত অতিনন্দিত উত্তম-সুচিত্রা নয়, নয় কোনও মধ্যযুগীয় রূপকথার শিরি-ফরহাদ বা লায়লা-মজনু
জাতীয় করুণ চরিত্র। সংসারের কোনও মাপকাঠিতেই এদের আদর্শ প্রেমিকপ্রেমিকার চিরাচরিত ছাঁদে ফেলা যাবে
না। এরা চেহারায় কুৎসিৎ,
আকারে কিম্ভূত, বপুতে বৃহৎ----এরা বেমানান, বেসামাল, বিসদৃশ। এমনকি বয়সেও দারুণ বেমিল তাদের----পুরুষটির
বয়স সম্ভবত মেয়েটির দ্বিগুণ। তবুও তারা একে অন্যের জন্যে পাগল----এক মুহূর্তের জন্যে তাদের
আলাদা করবার উপায় নেই। কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে ছাড়াবার চেষ্টা করলে। কিন্তু তা বলে কি অবিশ্বাস্য আখ্যায়িত
করা যাবে? এমন ঘটনা বিরল হলেও আগেও নিশ্চয়ই ঘটেছে কোথাও না কোথাও।
হয়ত ঘটেছে। তবুও বলা যায় আমাদের এ-গল্পটি আর সব গল্পের
চেয়ে আলাদা। এ গল্প আসলেই অবিশ্বাস্য।
একদিন এমন হল যে মেয়েটি ভয়ানক অসুস্থ
হয়ে পড়ল। একান্ত অজানিত কারণে। এমন অসুস্থ যে অতি অল্প সময়ের মাঝে একেবারে গুরুতর অবস্থায়----জীবন
মরণ অবস্থা। আশেপাশের লোকজন মহা উদ্বিগ্ন ওর অবস্থা দেখে। কি করা যায় কি করা যায় বলে রব উঠে গেল
চারিদিকে। ডাক্তার বদ্যি ডেকে আনা হল এদিকে ওদিক থেকে। চিকিৎসার কোনও ত্রুটিই হয়নি। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ওকে বাঁচানো গেল
না। অসহ্য যন্ত্রনায় দুদিন
দুরাত ভোগার পর বেচারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চলে গেল ওপারে।
প্রেমিক বেচারার মনের অবস্থা তখন কি দাঁড়িয়েছে
সেটা সহজেই অনুমেয়। যদি পারত সে চিৎকার করে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে তুলত। কিন্তু চিৎকার করার ক্ষমতা তার ছিল না,
ছিল কেবল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা নিথর পর্বতের মত। অনড় অটল পর্বতের মত। কোন খাবার মুখে দিতে চাইল না, নিল না
একফোঁটা জল। একদিন, দুদিন, তিনদিন। লোকজন চিন্তায় পড়ে গেল। ও তো মরে যাবে না খেয়ে খেয়ে। সময় সব সারিয়ে দেবে, ভাবলেন সবাই। অসহ্য শোক মাঝে মাঝে ক্ষিধে দূর করে দেয়,
কিন্তু সে-ক্ষুধাও একসময় অসহ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের এই কিম্ভূতকিমাকার উদ্ভট
প্রেমিকের সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হবার মত
ছিল না। সে যেন সত্যি সত্যি
পণ করেছে, প্রেয়সী নেই, অতএব তারও আর বাঁচার প্রয়োজন নেই। অবশেষে ঠিক তাই হল। লোকজনের বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে
সে সত্যি সত্যি আমরণ অনশনব্রত বজায় রেখে থাকল----চারপাশের অগণিত লোকজন কেউ তার মুখে
একটুকরো খাবার দিতে পারল না, পারল না একফোঁটা পানি ঢোকাতে তার কন্ঠনালীতে। এক সকালে তারা এসে দেখল ওর গা ঠাণ্ডা
হয়ে গেছে। বিশাল দেহটি বিদ্যুতস্পৃষ্ট বৃক্ষের মত ধরাশায়ী, ভূপতিত। মানুষ বুঝল সে তার প্রিয়ার কাছে চলে গেছে। এখন আর কোনও কষ্টই নেই তার।
অবিশ্বাস্য? বিজ্ঞজনেরা হয়ত ভ্রূকুঞ্চিত
স্বরে বলবেন---না, অবিশ্বাস্য বলা যাবে না তথাপি। বিরল, কিন্তু অভাবনীয় বা অবিশ্বাস্য মোটেও
নয়। এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। তাহলে গল্পের বাকিটুকু
শুনুন। যে দু’টি প্রানীর গল্প
শুনে মন খারাপ হয়ে গেল আপনার, তারা কিন্তু মানুষ নয়---তারা চতুস্পদী জীব, বিপুলাকৃতি
জীব। তারা বন্য প্রানী, চিড়িয়াখানার
সংরক্ষিত পরিবেশে সযত্নে প্রতিপালিত দুটি হস্তী। একজনের ওজন প্রায় ১০ হাজার পাউণ্ড, আরেকজন
কম করে ৭ হাজার। একজনের উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট, আরেকজন ৮। তারা ঐরাবত। তাদের আবার হৃদয়াবেগ কিসের, হয়ত মূর্খের
মত বলতে প্রবৃত্ত হব আমরা। তারা শোক বোঝে নাকি? তারা প্রেম বোঝে নাকি? এ-গল্প আমার নিজের
চোখে দেখা----টেলিভিশনে যদিও। সম্ভবত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে, ঠিক মনে করতে পারছি না। বেশ কিছু আগেকার গল্প সেটা।
ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল আমাকে ওটা দেখার
পর। জীবজগতের একটি বিদ্ঘুটে
প্রাণী, যে তার বিশাল বপু সামলাতে সামলাতে অস্থির, যার শরীরের চাইতে দাঁতের প্রতিই
শিকারী মানুষের লোভাতুর দৃষ্টি, তার মন বলে কোনও জিনিস থাকতে পারে সেটা কেউ ভাবতেই
পারবে না। কিন্তু না, এই গল্প আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে কদাকার জীবেদেরও আবেগ
আছে, প্রায় আমাদেরই মত। তারাও প্রেমে পড়ে, অনেকটা আমাদেরই মত। প্রিয়জন চলে গেলে তারাও শোকে বিহ্বল হয়ে
যায়। আমাদের মত তারাও বিরহ
বোঝে, প্রিয়বিহনে তাদেরও বিশ্বজগত অন্ধকার
হয়ে যেতে পারে। ঠিক আমাদেরই মত। কিন্তু ঠিক আমাদের মত যা নয় তা হল সেই
শোক কখনও কখনও সহমরণের পথে ধেয়ে নিয়ে যায় তাদের। এর চেয়ে অবিশ্বাস্য আর কি হতে পারে সংসারে।
আচ্ছা, গৃহপালিত জীবেদের কি কোনও হৃদয়াবেগ
আছে? তারা কি প্রেমে পড়ে কখনও? একে অন্যের
জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয় কখনও? যেমন গরু? ছাগল? উট? যাদের আমরা জবাই করি কোরবানির
নামে, তারা কি ভয় বোঝে? জবাই করার জন্য যখন প্রাণীটাকে ধরেবেঁধে মাটিতে শোয়ানো হয় তখন
কি সে তার মা’কে ডাকে, নাকি ডাকে তার সৃষ্টিকর্তাকে? নাকি ডাকে তার প্রেয়সীকে? সেকথা
কি আমরা জানতে দেয়েছি কোনদিন?
যারা জানতে চায়, অবলা জীবেদের জীবনকথা
জানতে চায় বুঝতে চায়, আজকে আমি তাদেরই কথা বলব। বনজঙ্গলের অজানা জীবন নিয়ে যাদের অদম্য
কৌতূহল, যারা নিজ জীবনের স্বাভাবিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে নির্জন আত্মনির্বাসনে,
নিত্যবিপদসঙ্কুল একাকী জীবন কাটাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না, সেই বিশ্ববরেণ্য মহৎ
ব্যক্তিদের একজন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মলব্ধ
শ্বেতাঙ্গিনী নারী আন্দ্রিয়া টারকালো। ছোটবেলা থেকেই বুনো হাতী বিষয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ তাঁর। শুধু আগ্রহ বললে কমই বলা হয়---বালা যায়
নেশা। জীবন উৎসর্গ করবেন হাতীর
জীবনকাহিনী উদ্ধার করে, এই যেন তাঁর একমাত্র উচ্চাকাঙ্খা।
কলেজের প্রথম স্নাতক ডিগ্রি শেষ হতে-না-হতেই
আন্দ্রিয়া নেমে গেলেন তাঁর দুর্গম পথের একাকী যাত্রায়----সাথে কেবল দীর্ঘ সফরের ন্যুনতম
রসদপূর্ণ স্কন্ধঝুলি, আধুনিক তরুণ পর্যটকদের বিশ্বস্ত সঙ্গী। বয়স তখন একুশ কি বাইশ----যে বয়সে মেয়েরা
প্রেমে পড়ে, ঘরসংসার শুরু করে, অথবা উচ্চশিক্ষার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট
ক্লাসে ভর্তি হয়। তিনি বেরিয়েছেন আফ্রিকার গভীর অরণ্যবাসী হস্তীর খোঁজে। বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে জেনে নিয়েছিলেন
আগে থেকেই কোথায় তাদের বাস, যাদের প্রতি তাঁর সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ। দুরকমের হাতী নাকি আছে আফ্রিকায়---একটা
বুনো হাতী, আরেকটি খোলা জায়গার বাসিন্দা। বুনো হাতীর নিবাস হল সেন্ট্রাল আফ্রিকান
রিপাব্লিক আর ক্যামেরুনের সীমান্ত ঘেঁষা এক বনানী অঞ্চল যার নাম জাঙ্গা সাঙ্গা। জাঙ্গা হল জায়গাটির নাম আর সাঙ্গা হল
সেখানকার সবচেয়ে বড় নদীর নাম। এর মাঝেই একটি জাদুকরি জায়গা, খানিক খোলামেলা, যেন গাছপালা
কেটে প্রকৃতি নিজেই হাতীদের জন্যে একটা খেলার মাঠ তৈরি করে রেখেছে। এই অপেক্ষকৃত খোলামেলা জায়গাটিকে বলা
হয় ‘জাঙ্গা বে’। একটা স্থানীয় শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ ‘হাতীর পার্ক’। কি আশ্চর্য, তাই না? স্বভাবতই আন্দ্রিয়ার
প্রথম গন্তব্য ঠিক সে জায়গাটি।
আফ্রিকার এ-জায়গাটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম
বাদলারণ্য (Rain Forest) বলে পরিচিত। সুতরাং হাতীর প্রেমে-পড়া শহুরে মেয়ে যে
সেখানে গিয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হোটেলকক্ষের আরাম আয়েসের প্রত্যাশাতে উপস্থিত হননি সেটা
বলাই বাহুল্য। সেজন্যে তিনি প্রস্তুতও ছিলেন পুরোপুরি। জাঙ্গা বে’র খোলা মাঠে গিয়ে তিনি প্রথমেই
তাঁবু গেড়ে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করাতে নেমে গেলেন। জনমানবশূন্য নিঝঝুম প্রশান্তিময় পরিবেশ
একটি। আন্দ্রিয়ার মনে হল এমন
নিরিবিলি জায়গা আর দেখেননি জীবনে। এমন নির্মল শান্তিও কি আছে পৃথিবীতে! তাঁর আফ্রিকান তাঁবুর
নিশ্ছিদ্র নীরবতা আর নির্জনতার মধ্যে প্রথম রাতটির অনুভূতি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলেন
টেলিভিশন প্রোগ্রামের সাক্ষাৎকারক-প্রযোজক বব সাইমন। তিনি হাসিমুখে জানালেনঃ এমন শান্তির ঘুম
জীবনে ঘুমুননি কখনো। সারারাত তাঁর কানের কাছে বেজে চলছিল হাতীদের অপরূপ
সিম্ফনি। সকালবেলা যখন ঘুম ভেঙ্গে প্রথম সূর্যের মুখোমুখি হলেন তখন মনে হল মর্ত্য হতে
স্বর্গে চলে গেছেন কোনও এক অলৌকিক উপায়ে।
তবে শুধুমাত্র ‘হাতীর সিম্ফনি’ শোনার
উদ্দেশ্যেই যে আন্দ্রিয়া টারকালো আফ্রিকার গাঢ় অন্ধারাচ্ছন্ন অরণ্যের নির্জন প্রান্তরে
বনবাস গ্রহণ করেননি সেটা বলাই বাহুল্য। একটা উচ্চতর লক্ষ তাঁর অবশ্যই ছিল। হাতী তাঁর ছোটবেলার নেশা ঠিকই, কিন্তু
পাশাপাশি আরো একটি নেশা গড়ে উঠেছিল তাঁর মনে ইতোমধ্যে----জ্ঞানের নেশা, নতুন তথ্য উদ্ধারের
নেশা। এ-নেশা যে কত দুর্দমনীয়
সেটা সত্যিকার ‘নেশাখোর’ ছাড়া কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আন্দ্রিয়া ছিলেন মূলত গবেষক। তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন জানতে
হাতীরা কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে, বা দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা
করে। জীববিজ্ঞানের ছাত্রী
ছিলেন বলে এটূকু জ্ঞান তাঁর ছিল যে চতুষ্পদী প্রাণীরা মানুষের মত মৌখিক প্রণালীতে কথাবার্তা
চালাতে না পারলেও তাদের একটা নিজস্ব ভাষা আছে বই কি। হয়তবা সাংকেতিক, বা ধ্বনিমূলক, বা সেজাতীয়
কিছু। বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জী,
উরাংগুটাঙ্গরা যে পারে সেটা তাঁর জানা ছিল। অতএব হাতীরাও নিশ্চয়ই নিজেদের মধ্যে একটা
মাধ্যম তৈরি করে নিয়েছে তাদের প্রজাতির সুদীর্ঘ অস্তিত্বের বয়স থেকে। সেই মাধ্যমটি তাঁর জানা দরকার। সেই জানাটুকুর জন্যে তিনি ব্যক্তিগত জীবনের
ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা সব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এটাই আসলে জ্ঞানসাধকদের বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে বৃহৎ ও মহৎ যাকিছু হয়েছে তার
পেছনে এরকম গুটিকয়েক নিঃস্বার্থ, একনিষ্ঠ সাধক-গবেষকের আত্মত্যাগের কাহিনী রয়েছে।
মৌলিক গবেষণা সাধারণত বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। ব্যক্তিগত আর্থসম্পদ যা’ই হোক, বৃহত্তর
কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়া বড়মাপের গবেষণাকর্ম প্রায় কখনোই সম্ভব হয় না। উন্নত দেশগুলোতে এরকম উদারহস্ত দাতাপ্রতিষ্ঠানের
অভাব খুব একটা হয়না সচরাচর----পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে অনেকসময় দেখা যায় সরকারি তহবিলই
তার মূল উৎস। সরকারি তহবিল যদি শুকিয়ে যায় কোন কারণে দেশের মেধার বাজারেও তখন নেমে আসে অচলাবস্থা। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে নতুন, এবং
মানবজাতির সার্বিক কল্যানমুখি জ্ঞানসৃষ্টির পেছনে সরকার আর সমাজের আর্থিক মদদই যথেষ্ট
নয়, তার সাথে চিন্তা, বুদ্ধি ও প্রশ্নের অবাধ স্বাধীনতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনেকটা ক্ষুদ্র বীজ থেকে সুস্থ ও ফলবান
বৃক্ষ গড়ে তোলার মত একটি সার্বিক প্রক্রিয়া এটি। চারার গোড়াতে প্রচুর সার আর জল ঢালা অবশ্যই
দরকার, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। তার জন্যে প্রচুর আলোবাতাসও দরকার। আজকের পৃথিবীতে অনেক উন্নয়নশীল দেশের
আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও কার্পণ্য হয়ত দেখা যাবে না, কার্পণ্য যা নিদারুণভাবেই পরিলক্ষিত
হয় সেখানে সেটা হল ওই ‘আলোবাতাসে’র ব্যাপারটিতে।
সৌভাগ্যবশত আন্দ্রিয়া টারকালো এমন এক
দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেখানে চিন্তা ও বুদ্ধির সুস্থ বিকাশের জন্যে যাবতীয় প্রয়োজনীয়
উপকরণ প্রচুরপরিমানেই বিদ্যমান। সম্ভবত আফ্রিকার পথে রওয়ানা হওয়ার সময়ই কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে
একটা আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। নইলে এতবড় একটা প্রকল্প সম্পূর্ণ একক
চেষ্টায় সম্পন্ন করা প্রায় একেবারেই সম্ভব হত না। খুব সম্ভব সেই দাতা প্রতিষ্ঠানটি ছিল
কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, কারণ তাঁর পরবর্তীকালের গবেষণাবিষয়ক যোগাযোগ
প্রায় সর্বোতোভাবেই ছিল ওই বিভাগেরই হস্তীকেন্দ্রিক শাখাটির সঙ্গে। অন্তত একটি খবর নিশ্চিতভাবেই জানা যায়
যে কর্নেলের ‘বন্য প্রানী সংরক্ষণ সংস্থা’র সঙ্গে আন্দ্রিয়ার একটা সরাসরি সংযোগ ছিল।
একটা সাধারণ ঝুলি নিয়ে ভদ্রমহিলা সেখানে
উপস্থিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু দুচারদিন বনেজঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে হাতী দেখার সখ মেটানো
হয়ে গেলে দেশে ফিরে যাবেন, সেরকম উদ্দেশ্য তাঁর অবশ্যই ছিল না। অতএব যাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকা যায় কোথাও,
এই বনবাদাড়ের মধ্যে, তেমন একটা ব্যবস্থা করে নিতে হয় প্রথমেই। দু’টি জিনিস জরুরিভাবে দরকার তাঁর। এক, অসম্ভব কায়িক পরিশ্রম করতে সক্ষম
ও ইচ্ছুক এমন কিছু স্থানীয় লোক, যারা বিশ্বাসী, নির্ভরশীল, এবং নিরক্ষর হলেও বুদ্ধিমান। সৌভাগ্যবশত এমন মানুষ তিনি পেয়েও গেলেন,
বেশ সহজেই। এরা ওই অঞ্চলের বিখ্যাত পিগমি জাতির অন্তর্গত একটি গোত্রের লোক। দেখতে খর্ব হলেও ভীষণ পরিশ্রমী, বিশ্বস্ত,
সৎ ও সাহসী। ভাষা না জানলেও যে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব, পরস্পরকে মানুষ
হিসেবে সম্মান ও স্বীকৃতিদানই যার জন্যে যথেষ্ঠ, সেই আপ্তবাক্যটি নতুন করে প্রমান হল
আফ্রিকার ঘন অরণ্যের মাঝে। তারা ঘাড়ে তাঁর মাল পরিবহন করেছে। কাঠকুটুরি সংগ্রহ করে একটা ভদ্রমত বাসগৃহ
নির্মান করেছে তাঁর জন্যে, ঘরদুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখেছে, খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ
করা থেকে রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা জাতীয় সব কাজই তারা করেছে। বড় কথা, হাতী দেখা, পর্যবেক্ষক ও গবেষকের
দৃষ্টিতে, ওই কাজটিতে তারা দিয়েছে অমূল্য সহায়তা, তাদের যুগযুগান্তের অভিজ্ঞতা ও হস্তীজাতির
স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে তাদের নিজস্ব সহজাত জ্ঞানসম্ভার দ্বারা। ওদের ওই সাহায্যটুকু যদি না পেতেন তিনি
তাহলে পুরো প্রকল্পটি কতখানি সফল হত সেবিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। তাই, সেই যে পুরনো প্রবাদ (যা পুরুষপ্রবর্তিত
নিঃসন্দেহে) আছে একটা, প্রতিটি সফল পুরুষের পেছনে আছেন একজন সার্থক নারী, তাতে কিঞ্চিৎ
সম্পাদনা ও সংযোজনা করে আমি বলতে চাইবঃ প্রতিটি বিশাল সাফল্যের পেছনে রয়েছে তিনটি প্রধান
চরিত্রঃ এক, যিনি মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ও পরিকল্পক, দুই, তাঁর নিত্য অভয়দায়ী জীবনসঙ্গী,
তিন, দেয়ালের পশ্চাতে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর চিরবিশ্বস্ত পরিচারকটি। সব সৃষ্টির পেছনেই আছে এই তিনটি সত্তা। অন্তত আমার মতে।
আসলে একটি নয়, দু’টি তাঁবু স্থাপন করতে
হয়েছিল আন্দ্রিয়াকে। একটি তাঁর নিজের এবং কাজের লোকেদের থাকাখাওয়ার জায়গা, আরেকটি
তাঁর মানমন্দির, দূরবীন দিয়ে হাতীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার মত সুবিধার জায়গা, যার
জন্যে সবচেয়ে আদর্শ স্থান ছিল সেই ‘হাতীর মাঠ’এর ধারে। সেখানেই সবচেয়ে বেশি আনাগোনা তাদের। জায়গাটির এমনই বৈশিষ্ট্য যে হাতীদের দৈনন্দিন
বিনোদনের জন্যে যেমন উপযোগী, তেমনি তাদের দৈহিক পুষ্টির প্রয়োজনে অমূল্য লবনাক্ত খনিজ
পানীয়, সেটাও প্রচুরপরিমানে ছিল জাঙ্গা বে’র মাটির নিচে। প্রতিদিন তিনি দূরবীন দিয়ে দেখতেন হাতীরা
আসছে দলে দলে, এসেই শুরু করে দিয়েছে হৈহুল্লোড় নিজেদের মধ্যে, আনন্দে আত্মহারা তারা,
খেলার ছন্দে মাতোয়ারা, লীলায় লীলায় মত্ত। বিশাল বিশাল পা দিয়ে, পায়ের নখর দিয়ে
তারা মাটি খুঁড়ছে, খুঁড়ে খুঁড়ে ভূপৃষ্ঠের জঠর হতে উদ্গীরিত করে নিচ্ছে লবনমেশানো সঞ্জীবনী
সুধা----সে এক অপরূপ দৃশ্য। সেখানে বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গন, মুক্ত আকাশ---- গা দুলিয়ে, প্রান
ভরিয়ে, বালখিল্যতায় আত্মনিমগ্ন হয়ে থাকার এক অবারিত অবকাশ। সেখানে গজদেবতাদের বনবনানীঘেরা এক নিবিড়
আশ্রম। এ এক অলৌকিক নন্দনকানন
যেন। আন্দ্রিয়া টারকালো সেই
যে প্রথম রাতের নিদ্রাশেষে ভেবেছিলেন কোথায় কোন বিদেশের স্বর্গরাজ্যে এসে পৌঁচেছেন
তিনি, সেটা কি কেবল কল্পনাই ছিল তাঁর? টেলিভিশনে দেখে আমি এতটাই মুগ্ধ যে মনে হচ্ছিল
আহা,একটিবার যদি যেতে পারতাম সেখানে! এই প্রোগ্রামেই আমি প্রথম উপলব্ধি করতে পারলাম
যে হাতীদেরও একটা জীবন আছে, হাসিকান্না সুখদুঃখ প্রেমবিরহ তারাও বোঝে, অনেকটা মানুষেরই
মত। জাঙ্গা বে’র হাতীগুলোর
প্রানখোলা হাসিখুশি ভাব দেখে আমার মনে হল জায়গাটা যেন একপ্রকার মিলনয়াতন ওদের----কমিউনিটি
সেন্টার। হ্যাঁ, তাই। বনের হাতীদের কমিউনিটি সেন্টার! আইডিয়াটা মন্দ না, কি বলেন?
আন্দ্রিয়ার বীক্ষণযন্ত্রের গণনা অনুযায়ী
এই বে’ অঞ্চলের খোলা জায়গাটিতে রোজ চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি হাতীর সমাবেশ হয় একই সঙ্গে। তারা দল বেঁধে আসে, দল বেঁধে যায়। ওদের আসাযাওয়ার দৃশ্যটাই তাঁর মন ভরে
দেয় প্রতিদিন। প্রথমদিকে, সদ্য আগন্তুক এদেশে, তখন হয়ত স্বপ্নেও ভাবেননি যে একটা সময় আসবে
যখন সভ্য জগতের অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যাবার চিন্তা নিয়েই মহাচিন্তায় পড়তে হবে একদিন। যাব কি যাব না? এর চেয়ে সুন্দর ভুবন আমি
কোথায় পাব? হয়ত ভাবেন তিনি।
বন্য জন্তুর নেশা এক অদম্য নেশা। আন্দ্রিয়া টারকোলের নেশা এখনও কাটেনি,
২৪/২৫ বছর পার হয়ে যাবার পরও।
প্রধানত দু’টি প্রকল্প নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন
আফ্রিকায়। এক, বুনো হাতীদের দৈনন্দিন জীবন, বিশেষ করে তাদের সামাজিক জীবনের খুঁটিনাটি
তথ্য সংগ্রহ করা। দুই, তারা নিজেদের মধ্যে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিরুপন
করা। অর্থাৎ হাতীরা কি ভাষায়
কথা বলে সেটা প্রথমে নিজে শেখা, পরে অন্যকে শেখানো।
দীর্ঘকাল একই অঞ্চলের একই পরিবেশে ঠিক
একই কাজ প্রতিদিন করে করে দু’টি বিষয়ের ওপরই মোটামুটি একটা দখল এসে গেছে আন্দ্রিয়ার। তাঁর মতে ওই অঞ্চলে আনুমানিক এক হাজার
বুনো হাতীর বাস। তার মধ্যে ৪০০ কি ৫০০ হাতীর সঙ্গে তাঁর একরকম ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তিনি এই হাতীগুলোর প্রত্যেকটির নামকরণ
করেছেন, এবং নামগুলো খাতায় লিখে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, কোন হাতীর কি বৈশিষ্ট্য,
আকারে প্রকারে স্বভাবে ব্যবহারে, তা’ও সব লিপিবদ্ধ হয়ে আছে প্রতিটি নামের সঙ্গে। একদিনের একটা ঘটনা অবাক করার মত। চিরাচরিতভাবে অনেকগুলো হাতী জমা হয়েছে
বে’র জলাশয়ের ধারে। সবগুলোই তাঁর চেনা, কেবল একটিকেই ত্তৎক্ষণাৎ চিনে উঠতে পারছিলেন না। একে কি আগে দেখেছি কখনো? লক্ষ করলেন ওর
বাঁ কানে ছোট্ট ফুটোর মত কিছু একটা। নিজের মনেই খুঁজতে লাগলেন----কোথায় দেখেছি কোথায় দেখেছি। তারপর কাজশেষে ঘরে গিয়ে খাতা খুলে খুঁজে
দেখলেন সত্যি তাই। ঠিক এরকম কান-ফুটো একটি হাতীর নাম তিনি নিজেই দিয়েছিলেনঃ ফেনেনা। ফেনেনার বিস্তারিত বিবরণ সব তাঁর খাতাতেই
লেখা। চিনতে কষ্ট হচ্ছিল কারণ
হাতীটা কোনও কারণে অনেকদিন আসেনি জাঙ্গা বে’তে।
এমনই আশ্চর্য ঐকান্তিক ঘনিষ্ঠতা তিনি
স্থাপন করে নিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকার বুনো হস্তীকূলের সাথে। তিনি ওদের নাম ধরে চিনতেন, হয়ত ওরাও তাঁকে
চিনত। কে জানে সেই হাতীগুলো
আন্দ্রিয়াকে কোনও নাম দিয়েছিল কিনা তাদের নিজস্ব ভাষায়!
হাতীর রাজ্যে দূরাগত একাকী মানুষের বাস
সোজা কথা নয়। একে অন্যের সঙ্গে গোড়াতেই একটা বোঝাপড়া করে নিতে হয়----তুমি আমার পথ মাড়াবে
না, আমি তোমার পথ মাড়াব না। একে অন্যকে সম্মান করব----কেউ কাউকে উঁচুনিচু ভাবব না, তাহলেই
আমাদের বন্ধুত্ব সম্ভব হবে। বুনো পথ দিয়ে রোজ দু’বেলা আসাযাওয়া করতে হত আন্দ্রিয়ার। ঘন অরণ্যের ভেতর পথ ছিল একটাই----যেপথ
তৈরি করেছিল হাতীরাই, তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে। একই পথে বহুবার হেঁটে হেঁটে যে চিহ্ন
সৃষ্টি হয়েছিল গাছপালার ভেতর সেটাই, আন্দ্রিয়ার মতে, আমেরিকার বড়সড় হাইওয়ের চেয়ে নেহাৎ
ছোট কিছু নয়---হাতীর পায়ের চাপ যে কি জিনিস সেটা ভূমাতার নিশ্চয়ই ভাল করেই জানা। এপথে হাঁটবার একটাই নিরাপদ উপায়---এমন
কিছু করো না যাতে করে হাতীর মনে খটকা লাগে তোমার মতলবটা কি। যেদিকে হাঁটছ, হাতী দেখার পর ভুল করেও
যেন সেপথ থেকে সরে না পড় এতটুকু, তাহলেই দেখবে, বিপদ। হাতী ক্ষেপে গেছে। এবং হাতীর দেশে হাতীকে ক্ষেপানো যে কতবড়
ঝুঁকি সেটা যদি না জান তাহলে তুমি বনে আসার যোগ্য নও।
রবিবার সন্ধ্যায় প্রতি সপ্তাহে আমি CBS এর 60 Minutes প্রোগ্রামটি দেখি
ভীষণ আগ্রহের সঙ্গে। সেদিন বব সাইমন প্রযোজিত আন্দ্রিয়া টারকালোর হাতীকাহিনী দেখলাম
আমি বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে। দেখলাম ওদের আশ্চর্য আনন্দমুখর, শান্তিপূর্ণ জীবন। তারা খেলছে, তারা রঙ্গতামাশা করছে পরস্পরের
সঙ্গে, কুস্তি করছে একে অন্যের সাথে। শিশুরা কাদা ছুড়ছে একে অন্যের দিকে, লুকোচুরি খেলছে, মারামারি
করছে, সময়ে অসময়ে বিরক্ত করছে তাদের মায়েদের। মায়েরা তাদের শাসন করছে দুষ্টুমির মাত্রা
ছাড়িয়ে গেলে। এক বাচ্চাকে দেখলাম মায়ের ‘বকুনি’ খেয়ে লুকোবার চেষ্টা করছে গাছের আড়ালে। কিন্তু হাতীর শরীর কি তুচ্ছ গাছের আড়াল
মানে? দারুণ হাসি পাচ্ছিল আমার শিশু হাতীটার কাণ্ড দেখে। আরো দেখলাম তরুণ হাতীদের প্রেমের লীলা। মেয়ে হাতীগুলো একটু শান্তশিষ্ট, সংযত
তাদের আচার আচরণে, আর ছেলেগুলো ঠিক তার বিপরীত। দুরন্ত, অস্থির, চঞ্চল। তারা সারাক্ষণ মেয়েগুলোকে ধেয়ে চলেছে।
উদ্দেশ্য একটাই। রিরংসা। হাতী জাতির দাম্পত্য জীবন একটু ভিন্ন প্রকৃতির। বাচ্চা প্রসবের পর মায়েরা বাচ্চার দেখভাল
নিয়েই ব্যস্ত সারাক্ষণ, আর পুরুষরা ছুটে বেড়াচ্ছে অন্য সঙ্গীর সন্ধানে। মানুষের চেয়ে খুব কি আলাদা তারা? আন্দ্রিয়া
টারকালো হেসে হেসে অবিরাম ধারায় বর্ণনা করে গেলেন হাতীর জীবনবৃত্তান্ত। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম সেই অসাধারণ
গল্প।
প্রশ্ন তোলা যায়, এই যে বিচিত্র জীবন
হস্তীকূলের তার প্রমাণ কিসে? এসব তিনি জানতে পেলেন কেমন করে? তাঁর সোজা উত্তরঃ অনেকদিন
ধরে ধৈর্যের সঙ্গে ওদের আচার আচরণ লক্ষ করে করেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন তিনি। একই শব্দ, একই অঙ্গভঙ্গী বারবার পরীক্ষা
করে একটা ধারণা সৃষ্টি করা সম্ভব যে সে বোধ হয় এই কথাটাই বলতে চাইছে। আসলে আমাদের শিশু সন্তানেরাও তো এভাবেই
ভাষা শেখে আমাদের কাছ থেকে, তাই না? দেখে দেখে, শুনে শুনে, একের সঙ্গে আরেকটিকে মিলিয়ে। হাতীর ভাষাও ঠিক একই ভাবে শিখেছেন আমাদের
এই আশ্চর্য মহিলা আন্দ্রিয়া টারকালো। তিনি এতটাই নিশ্চিত তাদের ভাষা ব্যাপারে যে কোন হাতীর কোন
ভঙ্গীতে বা কোন শব্দতে কি ইঙ্গিত করে, কি তার তাৎপর্য, সেটা তিনি অনায়াসে বলে দিতে
পারেন। এমনকি তাদের অনুকরণে
নিজের জিভেই সেই শব্দগুলো প্রায় অবিকলভাবে উচ্চারণ করতে পারেন। আমরা যেমন অনেক সময় পাখির ডাক নকল করতে
পারি, অনেকটা সেরকম। হাতীর ডাক অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। ওটা গাঢ়, গভীর, সুদূর, কখনো ক্রুদ্ধ,
কখনো করুণ, কখনোবা হালকা।
তিনি কতগুলো উদাহরণ দিলেন ওদের মত শব্দ
করে। একপ্রকার শব্দ আছে যাতে
বোঝায় খোশমেজাজী অভিবাদনঃ ‘ এই যে কেমন আছেন? খবর ভাল তো?’
আরেকটি একটু বিরক্ত স্বরঃ ‘তুমি আবার কোত্থেকে উদয় হলে?’
আরো একটিতে বোঝায়ঃ ‘ বিপদ কেটে গেছে।
কোন ভয় নেই আর। তোমরা যে যার কাজে চলে যাও’।
বাচ্চার মা শাসন করছে অবাধ্য সন্তানদেরঃ
‘ আহা, তোরা একটু শান্তি দিবি আমাকে। যাহ, সর এখান থেকে, নইলে ভাল হবে না বলছি’। কপট রাগ, বিরক্তি, আদর আর শাসনমিশ্রিত
মায়ের অতিপরিচি, অতিকাংখিত শাসানি। হাতীদের ধ্বনি অনুকরণের প্রধান উপায় হল শব্দের যে মূল উপাদান,
অর্থাৎ কম্পাঙ্ক (Frequency), সেটাকে
যথাসম্ভব নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করে নেওয়া। ওই কম্পাংকের হেরফেরই শব্দের অর্থভেদ
সৃষ্টি করে। নিচু, মাঝারি, উচ্চ, এই তিনিটে প্রধান ধারার মাঝে আরো কতগুলো প্রকরণ আছে যেগুলো
রপ্ত করতে সময় লাগে, লাগে অসীম ধৈর্য ও নিশ্ছিদ্র
মনোনিবেশ। শব্দগুলো তিনি অতঃপর ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে প্রেরণ করেন আমেরিকার কর্নেলে অধীর
আগ্রহে বসে-থাকা সহকর্মীদের কাছে। সেখানে ইতোমধ্যে গঠিত হয়ে গেছে Elephant Listening Center নামের এক প্রতিষ্ঠান, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রাণীবিভাগেরই একটি বিশেষ শাখা। এতে করে একসময় ‘হাতীর ভাষা’ নামক প্রানীবিজ্ঞানের
একটি নতুন শাখাই হয়ত তৈরি হয়ে যাবে। কে জানে হয়ত ভাষাবিজ্ঞানেরও শাখা হয়ে যাবে একদিন।
একেই বলে উন্নত বিশ্ব!
হাতীসমাজের আরেকটা জিনিস আমার কাছে অসাধারণ
মনে হল----তারা যেভাবে মৃত হাতীর শেষকৃত্য পালন করে। প্রথমে নিশ্চিত হয়ে নেয় হাতীটা সত্যি
সত্যি মারা গেছে কিনা। নাকি এমনি এমনি শুয়ে আছে মাটির ওপর। মৃত্যু ঘটেছে সেটা প্রমান হয়ে গেলে শুরু
হয় শোকপর্ব। মারা গেছে বলে তার দেহটাকে তারা ফেলে রাখবে না জীবজন্তুর ভোগের সামগ্রী হবার
জন্যে। তারা ওর চারদিকে সার
বেঁধে ঘুরবে, একপ্রকার শোকনৃত্যও বলা যায়, যেন সবাই মিলে কান্নাকাটি করছে, এবং সংযত
শৃঙ্খলার সাথে। এরকম করে তারা তিনদিন কি চারদিন শোকব্রত পালন করবে। এর মাঝে একমুহূর্তের জন্যেও তারা মৃত
হাতীটার কাছে অন্য কোন প্রাণীকে আসতে দেবে না, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে কেউ চেষ্টা করলে। এই ঘূর্ণনক্রিয়া তারা পালন করবে পালা
করে---একদলের ডিউটি শেষ হলে আরেকদল আসবে। মানে সে এক অসাধারণ ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম সেই দৃশ্যের
দিকে। প্রকৃতির কি আশ্চর্য
রূপ---এই সে বিশাল এক জীব, নিজের দেহের ভারে যে ব্যাহত আজীবন, যার কোনও মূল্যই দেওয়া
হয়না মানবসমাজে, কেবল তার মূল্যবান দন্তযুগল ছাড়া, সেই উদ্ভট জীবটিরও কি অদ্ভুত নরম
মন। পরস্পরের জন্যে কত না
তাদের মায়ামমতা।
সবশেষে আন্দ্রিয়া আক্ষেপ করে জানালেন
হাতীর সংখ্যা কি দ্রুত হারে কমে যাচ্ছে পৃথিবীতে। অনতিকাল আগে এদের মোট সংখ্যা ছিল এক থেকে
দেড় মিলিয়ন, এখন সেটা সাত কি আটশ হাজারে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রাকৃতিকভাবে ঘটেনি এই হ্রাস, ঘটেছে
দস্যু মানুষের হাতে। মানুষের লোভের শিকার তারা। মানুষের লোভের শিকার পৃথিবীর যা কিছু
সুন্দর, যা কিছু মহান ও বিশাল। মানুষের লোভের শিকার কি মানুষ নিজেও নয়?
হস্তীদন্তের বাণিজ্য এখন আন্তর্জাতিকভাবে
নিষিদ্ধ। কিন্তু যাদের টাকা আছে তাদের আবার নিষেধ কিসের। দক্ষিণ এশিয়ার নব্যধনী পরিবারদের দরকার
‘আইভরি’র অলঙ্কার---হাতীর দাঁতে বাড়ির সম্মান বাড়ে, পরিবারের সুনাম হয়। এটা তাদের স্টেটাস সিম্বল। এবং এশিয়ানদের আর কিছু না হলেও ‘সিম্বল’
থাকতেই হবে। ওটা ছাড়া জীবন বৃথা।
হাতীর গল্প শুনে ভাবছি, এই তো সামনেই
একটা উৎসব আসছে। কয়েক লক্ষ গরু, ছাগল আর উটের প্রান যাবে। ধর্মীয় উৎসব মানেই তো প্রানীহত্যা----চিরকালের
ধারাই এটা। আচ্ছা, গরু কি ভাষায় কথা বলে সেটা কি জানা যায় না? তার জন্যে কি আরেকজন আন্দ্রিয়া টারকালোর প্রয়োজন হবে, নাকি
অন্য কোন দেশের অন্য কোন প্রানীদরদী মানুষ উদয় হবেন?
মীজান রহমান
মীজান রহমান
অটোয়া,
৮ই অক্টোবর, ‘১২
মুক্তিসন ৪১
No comments:
Post a Comment