নাজনীন সীমন
মানবতা বিরোধী শক্তি, ঘাতক দালাল রাজাকারেরা যখন
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর প্রত্যক্ষ, নির্লজ্জ সহযোগিতা ও সমর্থনে স্বাধীন বাংলাদেশের
সোঁদা মাটিতে মই গেঁড়ে উঠে যাচ্ছিলো তরতর করে, সাফারী পরা তাঁর দুই হাতের নীচে পরম
উষ্ণতায় নিজেদের ছানাপোনা বৃদ্ধি করতে উদ্যোগী হয়েছিলো ঠিক হাঁস বা মুরগী যেমন
ডিমে তা দেয় বাচ্চা ফোটানোর জন্য তেমনি ভাবে, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’—
শব্দগুলো যখন কেবল শব্দ হয়েই বইয়ের পাতায় গ্রন্হিত হচ্ছিলো, এবং পার্বণের মতো
বছরের ঐ বিশেষ দিনগুলোতে ঘটা করে পালিত হচ্ছিলো, মুক্তিযোদ্ধারা যখন কোণঠাসা,
মর্মাহত, আশাহত, অপমানিত বোধসহ চরম হতাশায় ভুগছিলেন, ঠিক সেই সময়ে আশার আলো
জ্বেলেছিলেন যিনি, আবারো প্রতিবাদী হতে আহ্বান করেছিলেন, তিনি শহীদ জননী জাহানারা
ইমাম।
রাজনীতির ছায়া থেকে সতর্কভাবে দূরে থেকে মূল উদ্দেশ্য থেকে
বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হয়ে তাঁরই নেতৃত্বে শুরু হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির
যাত্রা যার সুপ্ত দাবী হয়তো কুরে কুরে খাচ্ছিলো আমাদের সশ্রদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের
এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রতিটি মানুষের, প্রতিকূল অবস্হার কারণে অথবা ভিন্ন
কোনো হেতু কেউ তা হয়তো তেমনভাবে উচ্চারণ করেননি। কিন্তু সব যুগে সব সময়েই
নেতৃত্বের জন্য কিছু মানুষ জন্মায়; মানুষের নীতি বোধ জাগানোর জন্য, অন্যায়ের তীব্র
প্রতিবাদের জন্য কিছু কণ্ঠ আসে প্রতীক হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা যেমন
বঙ্গবন্ধু, ঠিক তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজাকারদের পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়ানোর জন্য, তাদের যথাযুক্ত বিচার নিশ্চিত করার জন্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক
নেতৃত্বের নাম জাহানারা ইমাম। স্বাধীনতার ৪০ বছর আজ যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার
প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আশাভঙ্গের চরম অবস্হা থেকে আড়মোড়া দিয়ে উঠে মানুষ যে আবার
স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, দৃঢ়তার সাথে বর্জন করছে ঐ সব ঘৃণ্য কুখ্যাত ঘাতকদের,
তাদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার হয়েছে, তার বীজ নিজ হাতে বপন করেছিলেন জাহানারা ইমাম
যাতে মৃত্যুবধি সার পানি দিয়ে উজ্জীবিত রেখেছিলেন। তাঁর গড়ে তোলা সেই আন্দোলন
এতোটাই সময়োপযোগী, অত্যাবশ্যক ছিলো যে মুক্তবুদ্ধির এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের কোনো
ব্যক্তি দ্বিধা করেননি এর সাথে একাত্নতা প্রকাশ করতে; তাই কবীর চৌধুরী, শামসুর
রাহমান, হাসান ইমাম সহ নানা শ্রেণী পেশার সূর্য সন্তানদের এই চেতনার সঙ্গে সরাসরি
সম্পৃক্ত হয়েছেন এবং ফলশ্রুতিতে আরো বেগবান হয়েছে এই রুখে দাঁড়ানো, এই আন্দোলন।
বাঙালীকে বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত করে থাকেন অনেকে। তবে,
অবস্হা দৃষ্টে মনে হয় অন্য সব ইতিবাচক বা আপাত নেতিবাচক বিশেষণের চেয়ে যেটি সবচে’ বেশী
প্রযোজ্য, সেটি হোল বাঙালী অকৃতজ্ঞ, বিশ্বাসঘাতক, এবং অপরিণামদর্শী। তা না হলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরম
পরিণতির মাধ্যমে কেনো বাংলা দাসত্বের খাতায় নাম লেখাবে, যিনি আমাদের স্বাধীনতার
স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতীয় যে চার নেতার অবদান অতুলনীয়, প্রশ্নাতীত, তাদের রক্তেই কি
করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি ভিজে যায়? পলাশী থেকে ঢাকা—কোনো ভিন্নতা নেই; একই
সূত্র, একই বিশ্বাস ঘাতকের দল, কৃতজ্ঞতাবোধহীন বাঙালীর ক্ষয়িষ্ণু মানসিকতা,
অপরিণামদর্শিতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের জ্বলজ্বলে উদাহরণ। আর এরই ন্যাক্বারজনক
প্রমাণ আবারো পরিলক্ষিত হয় শহীদ জননীকে মুরতাদ ঘোষণা দেয়া এবং অবশেষে
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়ে তাঁর প্রয়াণ; জীবদ্দশায় দেয়াল লিখন, পত্রিকার
পাতায়, মিছিলে মিটিং-এ তাঁকে নিয়ে কুরুচিকর হয়রানিমূলক মন্তব্যের কথা বাদই রইলো।
প্রেসিডেন্ট জিয়া রক্ত নিয়ে হোলি খেলা সহ রাজাকারদের
পুনর্বাসনের যে ঘৃণ্য প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, তাঁর একদিক বাদে (!) সর্বদিক দিয়ে
অযোগ্য স্ত্রী ষোলোকলার উপর আরো কয় কাঠি যোগ করে একে জঘন্যতম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন
যা কিনা আবারো প্রমাণ করে মূর্খ অযোগ্যের হাতে ক্ষমতা গেলে শ্যাম কূল তো থাকেই না,
প্রাণেও বাঁচা দায় হয়। ফলতঃ রাজাকারদের বাঁচানোর জন্য তিনি এখন আর অন্ধকারে
ফিসফিসিয়ে নয়, হেড়ে গলায় খোঁড়া পায়ে ভর করে খোলা ময়দানে চেঁচাচ্ছেন, খেটে খাওয়া
মানুষদের জীবন বিপন্ন করে তুলছেন, দেশের অর্থনীতিকে ঠেলে দিচ্ছেন চরম বিপর্যয়ের
মুখে।
শিক্ষিত দুষ্কৃতিকারী যখন কিছু করে, তখন তার মধ্যেও এক
ধরনের ভাবনার কিছু থাকে; কিন্তু অশিক্ষিত কুচক্রীর নীলনক্সাও এতোটাই নিম্নমানের ও
রুচিহীন হয় যে তা নিয়ে কথা বলতে গেলেও বমনোদ্রেক হয়। জাতি এখন সেই ধরনের
ক্রান্তিকাল পেরোচ্ছে। অবশ্য এর সাথে আছেন কিছু তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা যাদের
কুলাঙ্গার বলাই শ্রেয়, যারা ক্ষমতা ও বিত্তের জন্য কারো পায়ের ধুলো জিভে মুছে নিতে
দ্বিধা করবেন না। সর্বোপরি রাজাকারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছানাপোনা তো আছেই যারা
বাংলাদেশের ইতিহাসটাই জানে বিকৃতভাবে। এমতাবস্হায় বর্তমান সরকারকে সর্বাত্নক
অকুণ্ঠ সহযোগিতা ও সমর্থন ছাড়া বাঙালী
সত্তা, স্বার্বভৌমত্ব সবই হুমকির মুখে। কেননা এবার যদি চার দলীয়, পরিবর্তিত রূপে
আঠারো (!!) দলীয় জোট ক্ষমতায় আসে যার জন্য তারা বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছে,
তবে ধেড়ে দাড়িওয়ালা শয়তানগুলো রক্তমাখা হাত ও দাঁত নিয়ে হামলে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের
স্বপক্ষ শক্তির উপর, এর চেতনাকে নখ দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করবে, এবং চাঁদ তারার পতাকা
উড়িয়ে মহানন্দে গাইবে “পাক সার জমিন সাদ বাদ” ত্রিশ লক্ষের রক্তভেজা মাটিতে
দাঁড়িয়ে; তাদের চকচকে মুখে নিজের হায়েনার মতো দাঁত পরখ করে মাননীয় বিরোধী দলীয়
নেত্রী নামবেন ‘বাংলাদেশ’ শব্দটিকে ফালা ফালা কেটে নতুন পুরোনো শকুনদের দিকে ছুঁড়ে
মারতে ঠিক যেমন করে চিড়িয়াখানায় বাঘ সিংহকে দেয়া হয় সদ্য কাটা গরুর মাংশ, আর নিজে
চেটেপুটে খাবেন প্রকৃত বাঙালীর পবিত্র রক্ত।
“কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি,
ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি,
খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে
দাড়ি কামাচ্ছি, দু’বেলা
পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনী
কথা শুনছি
ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি”
(দুঃস্বপ্নে
একদিন/শামসুর রাহমান)—বলার মতো সময় এখন আর নেই হাতে।
ঝাঁকের কই না হয়ে এখন সময় এসেছে বলার:
“পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা
বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে
স্বাধীনতা।”
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে
স্বাধীনতা/শামসুর রাহমান
বাংলাদেশের অস্বিত্ব টিকিয়ে রাখতে আজ তাই সোচ্চার হবার সময়
এসেছে। একক ভাবে নয়, বরং সম্মিলিত ভাবে জাহানারা ইমামের রেখে যাওয়া আলোকবর্তিকা
হাতে নিয়ে তাই এগোতে হবে তাঁর শুরু করা কাজের চূড়ান্ত পরিণতি দিতে, পিতৃ-মাতৃ
হত্যার প্রতিশোধ নিতে। প্রতীকী বিচার আর নয়, আর নয় কুশ পুত্তলিকা দহন; এবার
প্রয়োজন শূলে চড়ানো ওইসব বর্বর খুনীদের এবং বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোো হবে
সমর্থন দিচ্ছেন যেসব অমানুষেরা। আজ সেই অনন্য মহিয়সীর শুভ জন্মদিন। তাঁর অসমাপ্ত
কাজ সম্পন্ন করার গুরু দায়িত্ব মাথায় তুলে নেয়া ছাড়া আর কিভাবেই বা তাঁকে সম্মান,
জানানো যায়?
শুভ জন্মদিন জাহানারা ইমাম! বাংলাদেশ অচিরেই রাজাকার মুক্ত
হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এই বাংলায় হবেই।
No comments:
Post a Comment