ঠিক
জানা নেই পৃথিবীতে সব মিলে কতগুলো ভাষায় বয়স অথবা সম্পর্কের মাপকাঠিতে
নির্ধারিত হয় দ্বিতীয় পুরুষের সর্বনাম; তবে সব মিলে নেহায়েত কম হবে না বলেই
বোধ করি যদি না এর উল্টোটা সত্যি হয়। এই ধারাকে আমি অন্ততঃ মনে করি যেকোন
ভাষার প্রাচুর্য ও উন্নতির পরিচায়ক যদিও ভাষা বিজ্ঞানীদের মতামত-ই এ
ব্যাপারে শিরোধার্য। যদি মারাত্নক কোন ভুল করে না থাকি, তাহলে বাংলা,
হিন্দী, উর্দু, স্প্যানিশ, চায়নীজ (ম্যান্ডারিন), আরবী, ফার্সী ইত্যাদি
ভাষায় ছোট-বড়-সমবয়সীতে সর্বনাম ব্যবহারে ভিন্নতা আছে যা কিনা পুরোদস্তুর
অবর্তমান ইংরেজী ভাষায়। স্প্যানিশে অবশ্য ‘Tu’ ব্যবহৃত হয় অনুজ আর
সমবয়সীদের ক্ষেত্র্রে এবং ‘Usted’ অগ্রজদের বেলায়। যেহেতু ইংরেজী ভাষা নতুন
শব্দের প্রবহমানতায় বিশ্বাসী, সেহেতু এ ক্ষেত্রে অন্ততঃ এই বিভিন্নতার
অনুপস্হিতি প্রশ্ন জাগায় বৈকি।
তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
কথা বলা যাক কেবল বাংলাভাষীদের নিয়ে। লক্ষ্যণীয়, ভাষা বিষয়ক কোন গূঢ়
তত্ত্বালোচনা এই রচনার উপপাদ্য নয়; বরং ভাষা ব্যবহারকারীদের আচরণই এই
সংক্ষিপ্ত আলোচনার মূল লক্ষ্য। তুই, তুমি এবং আপনি, অথবা আপনি, তুমি ও তুই
---যেকোন অনুক্রমেই বলা হোক না কেন, বাংলাতে এদের ব্যবহার অত্যন্ত
সুনির্দিষ্ট। বয়োজ্যেষ্ঠ, সম্মানিত, অপরিচিত কাউকে সম্বোধনে সাধারণতঃ আপনি,
সমবয়সী, বন্ধু, কাছের মানুষদের ‘তুমি’ আর তুচ্ছার্থে কনিষ্ঠদের অথবা
সম্পর্কের নিকটতার উপর ভিত্তি করে ‘তুই’ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে
দেখা যায় সম্বোধনের এই তিন রূপের মধ্যে স্লুইস গেটের মত প্রবেশদ্বার রয়েছে,
অর্থাৎ কিনা সম্পর্কের মাত্র্রা বাড়া কমার সাথে সর্বনামের প্রকৃতি বদলে
যেতে পারে।
ধরা যাক বাবা-মা, দাদা-দাদী,
নানা-নানী, খালা-মামা, ফুফু-চাচা এবং এঁদের বিপরীত লিঙ্গধারীগণ, বড় ভাই-বোন
এদের সবাইকে সামাজিক প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ‘আপনি’ বলে সম্বোধিত করার কথা।
যুগের পরিবর্তনে হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক এসব সম্পর্কে অধিকাংশ
ক্ষেত্র্রে ‘আপনি’ এখন ‘তুমি’ তে এসে দাঁড়িয়েছে যা সুখকরই মনে হয় কেননা এতে
ভালবাসার আহ্লাদিত ভাবটা একটু বেশীই ঠেকে, কাছের মানুষগুলোকে আরো বেশী
কাছের বলে মনে হয়।
আবার স্বামী-স্ত্র্রী সম্পর্ক
বিবেচনায় এর সম্বোধন কোনটি হওয়া উচিৎ তা খানিকটা চিন্তার বিষয় এ কারণে যে
যদি বয়স হয় সূচক, তবে যেহেতু বাংলার অধিকাংশ স্ত্র্রী তাদের স্বামীদের থেকে
বয়সে ছোট হয়ে থাকেন ক্ষেত্রবিশেষে যে ব্যবধান ২০ এরও উপরে দাঁড়াতে পারে
যেটা খুব কাছ থেকে দেখা বলে অসম্ভব বা অবাস্তব কিছু মনে হয়না, সেহেতু
সূত্রানুযায়ী ‘আপনি’ বলেই ডাকা উচিৎ স্বামীদের; আবার যদি সম্পর্ক আমলে আনা
হয় তাহলে এই ধরনের মধুর সম্পর্কের ক্ষেত্র্র্র্রে ‘তুমি’ ব্যবহারই প্রযোজ্য
উভয় পক্ষ থেকে। স্বামী-স্ত্র্রী সম্পর্কের মধুরতা মাপাও এই লেখার
প্রতিপাদ্য নয়; অতএব, মধুর সম্পর্ক মধুরই থাক আপাতত, তা না হলে কেঁচো
খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে। বলা বাহুল্য, এই বিশেষ ধরনের সম্পর্কে ‘তুই’
এর ব্যবহারও ব্যাপক লক্ষ্যণীয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্র্রেই একপাক্ষিক ভাবে:
পুরুষ থেকে নারীতে এর কোনোটা বোধ করি আঞ্চলিক প্রভাব আর বাকীটা তুচ্ছার্থে
ব্যবহৃত হয়। রাগান্বিত হলে বা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলেই পুরুষেরা ‘তুমি’
থেকে নেমে আসেন ‘তুই’তে—শিক্ষিত কি অশিক্ষিত অনেকেই---সবাই নন কোনোভাবেই।
সম্বোধনের এই বিভিন্নতা কিন্তু আমাদের প্রয়োজনীয় এইসব সম্পর্ক ছাড়াও আরো
আরো একটি বিষয় মনে করিয়ে দেয় খুব ঋজুতার সাথে অথচ মৌনভাবে। আর তা হোল
আমাদের সামাজিক শ্র্রেণীভেদ বয়স যেখানে কোন বিষয়ই না। তাইতো অশীতিপর কোন
বৃদ্ধ রিক্সাচালক, ভিক্ষুক বা ফেরিওয়ালাকে সমাজ ‘তুমি’ বলতে এতোটুকু দ্বিধা
করে না; কেউ কেউ আরো একধাপ নিচে নেমে তুই-তোকারি করেন অবলীলায়। আবার
হাঁটুর বয়সী কাউকে বিত্তবানের খাতায় নাম আছে বলে ‘আপনি’তে আপাদমস্তক
আচ্ছাদিত করা হয়। এটাতো আকাশ পাতাল ফারাক; খুব কাছাকাছি ভিন্নতা সীমাবদ্ধ
করলে দেখা যাবে বাড়ী বাড়ী মাছ বা সব্জী, ডিম ইত্যাদি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো
ফেরিওয়ালাদের যেখানে ‘তুমি’ বলে সম্বোধিত করা হয়, বাজারের ভেতর দোকান নিয়ে
গদিতে বসলেই এই ডাক অনেকেই পরিবর্তন করে ‘আপনি’ করেন। আবার দেখা যাবে
সোনাদানা, শাড়ী-কাপড়, গাড়ী-বাড়ী ইত্যাদির বাজারে বয়স কোন ব্যাপারই
না---এখানে শুধু ‘আপনি’ আর ‘আপনি’ করেন---কারণ এর সাথে জড়িত রয়েছে অর্থগত
শ্র্রেণী বৈষম্যের কাঠিন্য। ঠিক একই ভাবে দেখা যায়, রিক্সা ওয়ালারা ক্বচিৎ
কখনো কারো বিশেষ অভ্যাসবশতঃ ‘আপনি’ ডাকে সম্বোধিত হলেও হতে পারেন; নতুবা
‘তুই’ না হলেও ‘তুমি’ এই শ্র্রেণীর বা পেশার মানুষদের জন্য সার্বিকভাবে
বরাদ্দ। অন্যদিকে, ট্যাক্সি ক্যাব চালকেরা কদাচিৎই ‘তুই’ বলে সম্বোধিত হন,
এবং ‘তুমি’ বা ‘আপনি’-ই এই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে কারণ এদের অনেকেই
শিক্ষিত—পূর্ণ, অর্ধ বা স্বল্প যাই হোক না কেন শিক্ষার চাদর এঁদের চামড়ায়
জড়ানো। তার চেয়ে বড় কথা, রিক্সাচালক বা হকার বা মেরামতে নিয়োজিত যোগালীদের
মতো এঁদের নুন-পান্তা অবস্হা নয়। শ্রেণী বৈষম্যেরর কি নিদারুণ উপসংহার!
শ্রেণী বৈষম্য, নারী-পুরুষ সম্পর্ক ইত্যাদি থেকে বেরিয়ে সাদামাটা সহজ সরল
সম্পর্কে দেখা যায় অপরিচিত, অর্ধ বা স্বল্প পরিচিতদের ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন
করা হয় যা কিনা নিতান্তই যুক্তিসঙ্গত। সময়ের স্রোতাবহে তা ‘তুমি’ ‘তুই’ তে
রূপান্তরিত হতেই পারে—কোন সমস্যা নেই এতে; সমস্যা হলো কেউ কেউ যখন সময়কে
অগ্রাহ্য করতে চান। এমন উদাহরণ বিরল নয় যেখানে প্রথম পরিচয়েই ‘তুমি’ বলে
ডাকা হয়, কিংবা সুযোগ বুঝেই দু’চারবার কথোপকথনের পরই ‘আপনি’ নেমে আসে
‘তুমি’-তে যা কিনা আবার পুরুষ থেকে নারীতেই ধাবিত অধিকাংশ সময়ে অর্থাৎ
বেশীর ভাগ ক্ষেত্র্রে পুরুষেরাই সম্বোধনের এই পরিবর্তনে উদ্যোগী হন। এখানে
বলা বাহুল্য, কলকাতার বাঙালীদের কথা বলা হচ্ছে না যেখানে প্রথম থেকে ‘তুমি’
সম্বোধন করা সম্ভবত এই অংশের সংস্কৃতির একটি অংশ---অতএব তা চোখকে বেঁধে না
বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনে হয়না। এই অনুশীলন-উদাহরণ বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের
ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সবচে’ দুঃখজনক হোল, এরা এক মুহুর্তের জন্যও অপর
পক্ষের সম্মতির কথা চিন্তা করেন না। আরো হাস্যকর ব্যাপার হোল, এঁরা ‘আপনি’
আর ‘তুমি’-তে অনবরত ভ্রমণ করতে থাকেন এইসব ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ এক ধরনের
অনিশ্চয়তা বোধ থেকে---তথাপি নিশ্চয়তা আনয়নের কোনো প্রচেষ্টা তাঁদের মধ্যে
লক্ষ্য করা যায় না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় জনসম্মুখ থেকে
ব্যক্তিগত আলাপে সম্বোধনের তফাত যাতে কিনা প্রমাণ হয় এই ‘তুমি’ ‘আপনিতে’
কোনো ঘাপলা আছে। আর এটার ধরন কি হতে পারে সে সম্পর্কেও সবারই ধারণা আছে।
আজকাল আবার নারী গোষ্ঠীর মধ্যেও এর প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলা নেই,
কওয়া নেই, এরা যে কোন বয়সের মানুষদের ‘তুমি’, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘তুই’
বলে আহ্লাদিত হন যেখানে হাবেভাবে একধরনের মোড়লীপনা থাকে। সাথে থাকে মেকী
ভালোবাসার আস্ফালন এবং সম্বোধনের কৃত্রিমতা তুলে ধরেন বোধহয় নিজের অজান্তেই
পুনরাবৃত্তির বাড়াবাড়িতে। কেউ কেউ আবার ব্যক্তিগত উষ্মা প্রকাশের জন্যও এই
মাধ্যম বেছে নেন যা তাদের ব্যক্তিগত রুচিহীনতাকেই বরং চোখে আঙ্গুল দিয়ে
দেখিয়ে দেয়।
লক্ষ্যণীয় যে, এই বিশেষ শ্রেণীর লোকদের এই
বিশেষ আচরণে শিক্ষা বা অর্থ কোনো নিয়ামক নয়---বরঞ্চ রুচি, মানসিকতা,
নৈতিকতা, ভদ্রতা বোধের পরিচায়ক। সম্বোধনে আদতে কিছু যায় আসে না যদি তাতে
থাকে স্বচ্ছতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বোঝাপড়া, সম্পর্কের একটা পর্যায়ে
এমন রূপান্তর অস্বাভাবিক কিছু নয়। উপরোক্ত চারটি গুণাবলীর একটিও এখনো
বাঙালীরা(জাতিগত ভাবে) সামগ্র্রিকভাবে অর্জন করতে পারেনি, আদতে কখনো পারবে
কিনা সন্দেহ---আরো অন্ততঃ এখন, যখন কিনা বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় বা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র্র কিছুই বলেনা একজন মানুষ সম্পর্কে। তাছাড়া ওগুলো
কিনতেও পাওয়া যায় চড়া বা মাঝারি দামে। ফলে, এ ব্যাপারে ব্যক্তি সচেতনতা,
সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।
অনেকে আবার ‘তুই’ বা
‘তুমি’ ব্যবহার করে থাকেন অনেকটা আরোপিত ভাবে। কৃত্র্রিম গোলাপ টিকে থাকে
বছরের পর বছর, শুধু ধুলো ঝেড়ে মুছে দিলেই ঝকঝক করে; কিন্তু আসল ফুলের মত
সুগন্ধ কখনোই দেয় না। এতে আমাদের চোখ সাময়িক তৃপ্তি লাভ করে বটে, কিন্তু
প্রকৃত আনন্দ হয় না যা হতে পারে অনেক কষ্টে লালিত গাছে ঝোলা একটি গোলাপ
দেখে বা ছুঁয়ে। ঠিক তেমনি, জোর করে পাতানো বা ত্বরান্বিত করার চেষ্টায়
‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ বা ‘তুই’-তে এসে বেশীর ভাগ ক্ষেত্র্রেই অপর পক্ষের
অস্বস্তি ও বিরক্তির উদ্র্রেক ছাড়া আর তেমন কিছুই হয়না সর্বনামের এহেন
অপব্যবহারে। তাছাড়া হাজার বছর ধরে যে ভাষা ও সংস্কৃতি পরিপক্ক হয়েছে, তাকে
সাময়িক তৃপ্তি লাভের আশায় অবজ্ঞা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। সর্বনাম এতে
কোর্টে গিয়ে মানহানির মামলা না ঠুকলেও বাংলা ব্যাকরণ ও ভাষা ক্ষতিগ্রস্হ
হবে সুনিশ্চিত।