-নূরুন্ নাহার
মূল্যবোধ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত। ঢাকা, বাংলাদেশ। ১৯৮৯ জুন - মার্চ ১৯৯০। পৃষ্ঠা ৭৯-৮৬।
সুকান্ত! একটা জ্বলজ্বলে
নাম। কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতির পাতা উল্টালেই এক কথায় বলা
যায়, শ্রম সংগ্রামের এক অসাধারণ
কবি সুকান্ত। বয়সে তরুণ এবং উপলদ্ধিতে সুকান্ত ছিলেন অত্যন্ত উর্বর। সুকান্ত আমাদের কবিতার জগতে চির ভাস্বর ও চির তরুণ। কারন তারুণ্যের দুর্গম উচ্ছাসের মাঝেই তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাই তারুণ্যেকে ব্যথাময়
করে তুলেছেন তাঁর আঠারো বছর বয়সের কবিতার মাঝে। যেমন -
“আঠারো বছর বয়সের
নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে
পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা
নোয়াবার নয়
আঠারো বছর বয়স জানে
না কাদাঁ।"
১৯৪০-এর দিকে সুকান্ত
কাব্যের সাথে সন্ধি করেছিলন। বয়স তখন তাঁর চৌদ্দ। এক আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে সুকান্ত কবিতায় জন্ম নিলেন। নব চেতনায় চাঙ্গা হয়ে সুকান্ত দুঃখী মানুষের একেবারে অন্তর মহলে পৌঁছে গেলেন। সাধারন মানুষের কথা, খেটে খাওয়া মানুষের ব্যথা, স্বতন্ত্র উপমায়, শব্দে এবং উচ্চারণে
ব্যক্ত হ’ল সুকান্তের কবিতায়। প্রতিটি জীবনকে তিনি আশার আলো দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ‘হে মহাজীবন’- কবিতায় জীবনকে উদ্দেশ্য করেই তাই বলেছেন,
"হে মহাজীবন,
আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন কঠোর গদ্যে
আনো,
পদ্য লালিত্যে-ঝংকার
মুছে যাক
এ যেন জীবনকে নতুন
গন্ধে, নব-দিগন্তে উদ্ভাসিত
করে গড়ে তোলার এক অনন্ত আহবান। সুকান্তের অর্বিভাবের
সময়টা ছিল নিদারুণ শ্রেণী চেতনার। শ্রেণী বিভেদ,
মৃত্যু-ক্ষুধা, যুদ্ধ সবই সুকান্তকে এক ভিন্ন আঙ্গিকে নাড়া দিয়েছিল।
উনিশ শতকের বাংলা
কাব্য-সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র, অক্ষয় দত্ত, মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথকে
মানবতাবাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু সাহিত্য এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকেনি। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের সাহিত্য-চর্চা ধারা ধাপে ধাপে পাল্টে গেছে।
বিশ শতকের বাংলায়
রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক কবি। কিন্তু দু’জনের অসাম্প্রদায়িকতার
মাঝে পার্থক্য ছিল প্রচুর। নজরুল ছিলেন সম্পূর্ণরুপে
মনে প্রাণে বাঙ্গালি। তাঁর মত জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অন্য কবির মাঝে ছিল
না। সে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্ববরেণ্য কবি রবিঠাকুরকেও
ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাই বলে যে, নজরুল জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণতা এনেছে একথা বলা মুশকিল।
এই সমস্ত অর্পূণতার
মাঝে সুকান্ত উল্কার বেগে ছুটে এলেন নব সাজে কবিতার ডালি সাজিয়ে। কবিতা দিয়েই সুকান্ত অবাক পৃথিবীর স্বতন্ত্র বিস্ময় রূপ অনুভবে এনে বলে উঠলেন -
"অবাক পৃথিবী! অবাক
করলে তুমি!
জন্মেই দেখি ক্ষুদ্ধ স্বদেশভূমি!"
এমনি করে
এত সুন্দর স্বাভাবিকতায় কোন কালেই কোন লেখনিতে অবাক পৃথিবীর সর্বজনীন আর্শ্চয এই রূপ
ধরা পড়েনি।
সুকান্তের জীবন ছিল মাত্র ২১ বছরের। এই ২১ বছরের জীবনে সুকান্ত যে সমাজ-সচেতনতার কৃতিত্ব রেখে গিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে
বিরল। কোন কবিই সুকান্তের মতো নিখুঁত সমাজ সচেতন,
শ্রেণী সচেতন ছিলেন না।
গোর্কী সাহিত্যে
যেমন দেখা যায়, শ্রেণী সংগ্রামের
রূপ, এবং সেই সংগ্রামের বীজ জনসাধারনের
বপন করার স্পৃহা। তেমনি সুকান্ত তাঁর স্বল্প পরিসরের জীবনে গোর্কীর
মতই শ্রম-সংগ্রামকে গণ-আন্দোলনের মাঝে বপন করে গিয়েছেন। আমরা দেখতে পাই চল্লিশ দশকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে স্বাক্ষী রেখে সুকান্ত বলেছেন,
‘বেজে উঠলো কি সময়ের
ঘড়ি
এসো তবে আজ বিদ্রোহ
করি।’
তারপর বলেছেন,
"দেখবো, ওপরে আজো কারা
খসাব আঘাতে আকাশের
তারা
সারা দুনিয়াকে দেব
শেষ নাড়া
ছড়াবো ধান।"
এই বিদ্রোহের বিচ্ছিন্ন বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব-শান্তির
আশায় বিপ্লবী নেতা মহানায়ক লেনিনের উদ্দেশ্যে লিখলেন,
"হাজারো লেনিন যুদ্ধ
করে
মুক্তির সীমান্ত
ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।
বিদ্যুৎ ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশঃ সংক্ষিপ্ত করে
বিশ্বব্যাপী প্রতিটি দিন।"
আবার বলেছেন,
"বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ
চারিদিকে
আমি যাই তারি দিন
পঞ্জিকা লিখে।"
বিদ্রোহের ঢেউ না আসলে অবহেলিত জাতি জেগে উঠবে না,
তা তিনি খুব ভালভাবেই উপলদ্ধি
করেছিলেন। তাই তার কবিতায় বার বার বিদ্রোহ এসে কড়া নেড়েছে।
বিদ্রোহের মাঝেই
সুকান্ত আবার দৃঢ়ভাবে দেখেছিলেন আগামী ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তাই দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করলেন,
"এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে
নতুন শিশুকে
করে যাব আর্শীবাদ,
তারপর হব ইতিহাস।"
‘আগামীতে’
আবার দেখি,
"লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে
মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে।"
দুর্ভিক্ষের দুর্দিনের
পাশে দাঁড়িয়ে কবি-হৃদয় নিজেকে উৎসর্গ করে ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে অভিবাদন করে জানিয়েছেন,
‘যদিও রক্তাক্ত দিন’ তবু দৃপ্ত তোমার দৃষ্টিকে
এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে।
তবুও নিশ্চিত উপবাস
আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস
আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যূর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।'
সুকান্ত ক্ষণ-জন্মা
কবি। কবি হওয়ার জন্য তিনি কবিতা লেখেননি। লিখেছেন দুর্দশাগ্রস্ত মানব সমাজের মুক্তির চেতনা জাগানোর জন্য। এত সহজ, সুন্দর, সাবলীল, অর্থবহ শব্দে কোন কবিই সুকান্তের মত কবিতার উপমা সৃষ্টি করতে
পারেননি। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সূক্ষ দৃষ্টিতে পায়ে চলা সিঁড়ি পথে সুকান্ত শব্দ ছড়িয়ে
সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন
“আমরা সিঁড়ি
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও
তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে।”
এমনি উপমা দেখি ‘কলম’ কবিতায়-
"কলম, তুমি কতনা যুগ
ধরে
অক্ষরে অক্ষরে
গিয়েছ শুধু কান্তিহীন
কাহিনী শুরু করে।
কলম, তুমি কাহিনী
লেখো, তোমার কাহিনী কি
দুঃখে জ্বলে তলোয়ারের
মত ঝিকিমিকি।"
পাশাপাশি আবার বলিষ্ঠ
চিত্তে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেছেন-
"আমি একটা ছোট দেশলাইয়ের
কাঠি
এত নগন্য হয়তো চোখেও
পড়ি না
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস
করছে বারুদ
বুকে আমার জ্বলে
উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস।"
ভেতরের অকৃত্রিম
শক্তি না থাকলে কেউ এমনটি করে দুরন্ত হয়ে উঠতে পারে না।
এরপর ‘একটি মোরগের কাহিনী’ কবিতায় দেখি-
'মোরগের গলা ফাটানো
প্রতিবাদ। এ যেন আনকোরা নতুন ভাবে
সাধারণ মানুষের জ্বালাময়
প্রতিবাদ। এমনি করে একেবারেই আলাদা
ধরনের উপমায় সুকান্ত
তার কবিতাকে করে তুলেছেন সমৃদ্ধ।'
ফরাসী বিপ্লবের সময়
সাহিত্যের দিগন্ত বিশেষ ভাবে উন্মুক্ত হয়েছিল। তখনকার সামাজিক ব্যঙ্গ রসাত্বক রচনা মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। রুশ বিপ্লবের সংগ্রামের ধারাও সাহিত্যে এক পরিপূর্ণ স্থান পেতে আছে। জীবনের সাথে প্রহসন নয়, জীবনের প্রতি বিশ্বাসই সোভিয়েত কবিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সুকান্ত অগাধ বিশ্বাস
নিয়েই জীবনের সন্ধানে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চার পাশের নিয়ত ঘটনাবলীকে করে তুলেছিলেন জীবন্ত ফুলের পাপড়ির মত।
সুকান্তের কবিতা উপলদ্ধি করতে হলে দেশ বিদেশের বিপ্লবী কবিদের
আদর্শ অনুধাবন করতে হবে। যেমন বিশ শতকের কজন
কবির মাঝে ছিলেন, চিলির পাবলো নেরুদা। লাতিন আমেরিকার অত্যাচারিত জীবনের অসম্ভব যন্ত্রণায় ঘিরে আছে তাঁর কবিতা।
বিশ্বের বিপ্লবী
সমাজ সচেতন কবিদের সাথে সুকান্তের সমাজ সচেতনতা মিলিয়ে গবেষণা করলে আমরা তাঁর কবি চেতনায়
স্পষ্ট ধারণা ধারণ করতে পারি।
সুকান্তের কিশোর
বয়স ছিল সামাজিক বিভিন্ন অসঙ্গতির মাঝে অস্থির। বাস্তবের কঠিন হাত সুকান্তকে আঁকড়ে ধরেছিল কিশোর বয়স থেকেই।
তাই বাস্তবতায় দুর্গম
পথে বসেই সুকান্ত অসি দিয়ে নয় মসীর আঘাতে শক্তিময় করেছিলেন তাঁর লেখানীকে। তাই কঠিন বাহু বাড়িয়ে বলেছেন।
“কাস্তে দাও আমার
হাতে
সোনালী সমুদ্র সামনে
ঝাঁপ দেব তাতে।”
বাংলা সাহিত্যে গণ
আন্দোলনের ভূমিতে সুকান্তের কবিতা অনন্য আবদানমুখী। যাঁদের মাথার ঘামে নির্মিত হয়েছে সমাজের স্তম্ভ তাঁদের মহত্ত্বের কথা স্বীকার করতে
গিয়ে কবি নিজেই হয়েছেন মহান।
যখন অনেক কবিই কল্পনার
তরীতে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন, আপন চিত্তের প্রফুল্লতা খুঁজতে, ঠিক তখনই সুকান্ত কল্পনার জ্বাল ছিড়ে বেরিয়ে এসেছেন ঘামে ভেজা
শ্রমিকের শীর্ণ হাত ধরে। সুকান্ত শুধু গানের
কবি ছিলেন না, সুকান্ত হলেন একান্তাই
প্রাণের কবি। প্রাণের সূক্ষ্ম জায়গাগুলো তিনি কবিতা দিয়ে লেপে দিয়েছিলেন। প্রাণের যন্ত্রণাকে তিনি কবিতার ভাষায় উপশম করতে চেয়েছেন। যেমন দেখি, পূর্ণিমার চাঁদ অন্য
কবিদের কাছে যেখানে শোভা সৌন্দর্য্যে মন্ডিত, সেখানে পূর্ণিমান চাঁদকে সুকান্ত অনন্য অনুভূতিতে
তুলনা করলেন, ঝলসানো রুটির সাথে। এ থেকে বোঝা যায় তাঁর উপলদ্ধি কতখানি স্বতন্ত্রতায় সজীব ছিল। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে আমরা দেখতে পাই সমাজের নিচু শ্রেণীর লোকদের
দুঃখবোধের কথা:
'টালত মোর ঘর নাহি
পড়বেষী
হাড়িত ভাত নাহি নিতি
আবেশী'
অথার্ৎ টিলার উপরে আমার ঘর। প্রতিবেশী নেই। তবুও রোজ অতিথি আসছে নগরীর বাইরে পাহাড়ের গায়ে ছিল তাদের বাস। অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করে শেয়াল কুকুরের অত্যাচার উপোষ করে তাদের জীবন কাটাতে হত।
বলা যায়,
এমনি করে যুগে যুগে বাংলা সাহিত্যের
যে দুঃসময়, নিপীড়ন যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ভিক্ষ এসেছে সেই যুগ যন্ত্রণায় কবি সুকান্ত জনতার সংগ্রামী মিছিলে তিনি ঘুরেছেন আর
বলেছেন,
'আমি যাযাবর কুড়াই
পথের নুড়ি
হাজার জনতা যেখানে,
সেখানে আমি প্রতিদিন ঘুরি।'
সুকান্তের মেধাশক্তি
ছিল প্রশংসনীয়। তাঁর ভাষা ছিল স্পষ্ট। তাই, কোন এক দুঃসময়ের
বাংলাদেশের কবিদের প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশের কবিরা চিত্তে চিন্তায় ধ্যান ও জ্ঞানে, প্রকাশ ও প্রেরণায় জনসাধারণের অভাব অনাহার পীড়া পীড়ন
আর মৃত্যু মন্বন্তরকে প্রবলভাবে উপলদ্ধি করেন? তারা কি নিজেকে মনে করেন দুর্গতজনের মুখপাত্র?
তাদের অনুক্ত ভাষাকে কি নিজের
ভাষায় ভাষান্তরিত করেন? এক কথায় তাঁরা কি জনগনের কবি?
সুকান্ত সত্যি সত্যি
জনগনের কবি। জনগণকে যন্ত্রণামুক্ত করে জাগিয়ে তুলতে গিয়ে আবার
তাই দৃঢ় চিত্তে টগবগ করে বলেছেন।
'আঘাতে আঘাতে ছিন্ন
ভিন্ন ভাঙ্গা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে
সর্বনাশের খাল
ভাঙ্গা ঘর ফাঁকা
ভিটেতে জমছে নির্জনতার কালো
হে মহামানব,
এখানে শুকনো পাতার আগুন জ্বলো।'
সুকান্ত গতিশীল সাহিত্য
সাধনা করতেন।
প্রসঙ্গ : ফরাসী
সাহিত্যিক রম্যা রলাঁর একটা কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন “কেন লিখি?
কাদের জন্য লিখি? এই দুটো প্রশ্নকে আমি আলাদা করে দেখতে পারিনি।” সুকান্ত এমনি করে মূল্যবান বাণীগুলো রপ্ত করেছিলেন।
সুকান্তের প্রথম
কাব্যগ্রন্থ ‘ছাড়পত্র।’ মৃত্যুর তিন মাস পর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সালের মুহূর্ত গুলোর কথা ছাড়পত্রের বিষয়বস্ত। ছাড়পত্রের প্রকাশ কাল ১৩৫৪। তখন বর্ষাকাল। ছাড়পাত্রেই নব চেতনার সূত্রপাত। এখানে আসল যুদ্ধের বীভৎস দাঙ্গা হাঙ্গামা। এই কাব্য গ্রন্থটি কমরেড মুজাফফর আহমদকে কবি উৎসর্গ করেছিলেন। দ্বিতীয় রচনা ‘ঘুম নেই’
কাব্য গ্রন্থে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য
ফুটে উঠেছে। তৃতীয় কাব্য গ্রন্থ পূর্বাভাস। ১৩৫৭ তে প্রকাশিত। চতুর্থ গ্রন্থ ‘গীতিগুচ্ছ।’
অন্যান্য লেখা ‘মিঠে কড়া,’ ‘অভিযান,’ ‘হরতাল।’ এছাড়া তাঁর চিঠির গুচ্ছও অত্যন্ত সাবলীল।
সুকান্ত ছিলেন দরিদ্র
পরিবারের সন্তান। দারিদ্রতার ছোবল তাকেও সহ্য করতে হয়েছে। তাইতো তিনি তার তীক্ষ্ম উপলদ্ধি দিয়ে দরিদ্র মানুষের আত্মার কথা লিখেছেন কবিতার
প্রতিটি চরণে।
বাংলা ১৩৩৩ সালের
৩১ শে শ্রাবণ সুকান্তের পৃথিবীতে আগমন। ২১ শে বৈশাখ ১৩৫৪ তে তার প্রস্থান। সুকান্ত যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখনকার দিনে যে রোগকে বলা হত ‘যার হয় যক্ষ্মা তার নেই রক্ষা।’ কুরে কুরে খেয়েছিল
সুকান্তকে এই যক্ষ্মা। তবুও মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সুকান্তের কলম
থামেনি। স্বল্পকালের পরিসীমায় তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা কোন
কালেই কোন সাহিত্যিকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কবি তরুণ মিত্র তাই অশ্রুসিক্ত ভাষায় লিখেছেন। “মৃত্যুর আগের দিন
পর্যন্ত রোদের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিল সুকান্ত? রোদের একটা
ঝলক যদি সুকান্তের অন্ধকার তন্ত্রে আর ফুসফুসে ঢুকতে পারত।”
সুকান্তের অকাল মৃত্যু
বাংলা সাহিত্যকে অভাবনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভাবতে গেলেই হৃদয়টা কেঁপে ওঠে চোখ দুটো জলে ভরে যায়।
কিশোর বয়সেই সুকান্ত
অনেক বই এর সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। পথের পাঁচালী পড়ে ধর্মগ্রন্থের সমান সমান দিয়ে তিনি বইটি সভার ঘরে রাখার অনুরোধ
জানিয়েছিলেন। এ থেকে অনুমান করা যায় তাঁর চরিত্রের আদর্শগত দিক ছিল কত প্রবল।
সুকান্ত ছিলেন মা-হারা
সন্তান। ক্যান্সারে তাঁর মা মারা যান। অনাদর আর অবহেলায় বলতে গেলে তার জীবন কেটেছিল। সুকান্ত ছিলেন ভীষণ অভিমানী। সুকান্তের বন্ধুর
মা সরলা বসু তাকে স্নেহ করতেন। তিনি তাঁর স্মৃতি
কথায় লিখেছেন, “মা ছিল না। ভাইরা ছোট ছোট। তাই তাকে মাঝে মাঝে রান্না করতে হতো দেখতাম। কত দুঃখের মধ্য দিয়েই যে ও কবি উঠেছিল। বড় মুখচোর লাজুক নিরীহ ছিল ও, কারো কাছে কিছু চাইতে দেখিনি ওকে।”
তাঁর সমস্ত অভিমানের কথা তাই কবিতায় জানিয়েছিলেন। একজন সুকান্তকে লিখেছিলেন, তাঁকে দেখবে বলে। উত্তরে সুকান্ত জানিয়েছেন - "তাঁর লেখাগুলো হৃদয় দিয়ে পড়তে। কবিতাতেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া বাবে।" কতখানি আত্মবিশ্বাস ও সচেতন মনোভাব থাকলে এমনটি করে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তা বিবেচনার বিষয়।
সুকান্ত তাঁর কবিতার মাঝেই -- চির-ভাস্মর। তাঁর অন্তরের সমস্ত রূপ কবিতার মাঝেই খেলা করছে অনন্তকাল ধরে।
আত্মপ্রত্যয়ের সাথে তাই বলা যায়, সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশার কথা চির জাগ্রত হয়ে থাকবে সুকান্তের কবি-বার্তায়।
তাঁর সমস্ত অভিমানের কথা তাই কবিতায় জানিয়েছিলেন। একজন সুকান্তকে লিখেছিলেন, তাঁকে দেখবে বলে। উত্তরে সুকান্ত জানিয়েছেন - "তাঁর লেখাগুলো হৃদয় দিয়ে পড়তে। কবিতাতেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া বাবে।" কতখানি আত্মবিশ্বাস ও সচেতন মনোভাব থাকলে এমনটি করে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তা বিবেচনার বিষয়।
সুকান্ত তাঁর কবিতার মাঝেই -- চির-ভাস্মর। তাঁর অন্তরের সমস্ত রূপ কবিতার মাঝেই খেলা করছে অনন্তকাল ধরে।
আত্মপ্রত্যয়ের সাথে তাই বলা যায়, সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশার কথা চির জাগ্রত হয়ে থাকবে সুকান্তের কবি-বার্তায়।
মূল্যবোধ সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত। ঢাকা, বাংলাদেশ। ১৯৮৯ জুন - মার্চ ১৯৯০। পৃষ্ঠা ৭৯-৮৬।